হযরত ইবন উমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে নাফে’, মালিক, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন ইউসুফ ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘কুরআন মজীদের ধারক রশি দ্বারা বাঁধা উটের মালিকের মতো। উটের মালিক উহাকে বাঁধিয়া রাখিলে উহা তাহার নাগালে থাকিয়া যায়। পক্ষান্তরে সে ছাড়িয়া দিলে উহা তাহার নিকট হইতে ভাগিয়া যায়।’ ইমাম মুসলিম এবং ইমাম নাসায়ীও উক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী মালিক হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং বিভিন্ন অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন।

হযরত ইব্‌ন উমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে নাফে, আইউব, মা’মার, আবদুর রায্যাক ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ

নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘কুরআন মজীদের ধারক হইতেছে উটের মালিকের ন্যায়। উটের মালিক উহা বাঁধিয়া রাখিলে উহা তাহার নাগাল ও অধিকারে থাকিয়া যায়। পক্ষান্তরে সে উহা ছাড়িয়া দিলে উহা তাহার নাগাল ও অধিকারের বাহিরে চলিয়া যায়। ঠিস সেইরূপ কুরআন মজীদের ধারক রাত্রিদিন তিলাওয়াত করিয়া উহা ধরিয়া রাখিলে উহা তাহার নিকট থাকিয়া যায়। পক্ষান্তরে সে উহা ঐ রূপে ধরিয়া না রাখিলে উহা তাহার নিকট হইতে চলিয়া যায়।’ মুহাদ্দিস ইব্‌ন জাওযী ‘জামেউল মাসানীদ’ নামক হাদীস সংকলনে মন্তব্য করিয়াছেন যে, উক্ত হাদীস ইমাম বুখারী এবং ইমাম মুসলিমও বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু শুধু ইমাম মুসলিম উহা উপরোক্ত রাবী আবদুর রায্যাক হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং অন্যরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন।

হযরত আবদুল্লাহ্ (ইবন মাসউদ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ওয়ায়েল, মানসুর, শু‘বা, মুহাম্মদ ইব্‌ন আরআরা ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- কোন ব্যক্তির পক্ষে ইহা বলা বড়ই বেমানান যে, ‘আমি কুরআন মজীদের অমুক অমুক আয়াত ভুলিয়া গিয়াছি’; বরং সে তো উহা স্বেচ্ছায় নিজকে ভুলাইয়া দিয়াছে। (অতএব উহা বলাই তাহার পক্ষে সমীচীন যে, আমি উহাকে ভুলাইয়া দিয়াছি।) আর তোমরা কুরআন মজীদ বারংবার তিলাওয়াত করিয়া উহা স্মৃতিতে ধরিয়া রাখিও। কারণ, গৃহপালিত পশুর পক্ষে ভাগিয়া যাইবার যতটুকু আশংকা থাকে, উহার পক্ষে মানুষের স্মৃতি হইতে ভাগিয়া যাইবার তদপেক্ষা অধিকতর আশংকা থাকে।’

বিশর ইব্‌ন মুহাম্মদ সাখতিয়ানী উপরোক্ত হাদীসটি পূর্বোক্ত রাবী শু’বা হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং শু’বা হইতে ইব্‌ন মুবারকের ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম তিরমিযী উহা শু‘বা হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনাদাংশে এবং, শু’বা হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ দাউদ তায়ালেসী ও মাহমুদ ইব্‌ন গায়লানের ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি উহাকে সহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীস নামে অভিহিত করিয়াছেন। ইমাম নাসায়ী উহা শু’বা হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং অন্যরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। আবার তিনি উহা উপরোক্ত রাবী মানসুর হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং ‘মানসুর হইতে উসমান ইব্‌ন জারীরের ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম উহা উপরোক্ত রাবী মানসুর হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং মানসুর হইতে ধারাবাহিকভাবে জারীর, উসমান, যুহায়র ই হারব এবং ইসহাক ইব্‌ন ইবরাহীমের ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। উপরোক্ত তথ্যে দেখা যাইতেছে যে, উল্লেখিত ইমামগণ সকলেই উপরোক্ত রাবী মানসূরের মাধ্যমে উপরোক্ত হাদীসটি স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী (حديث مرفوع) হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন।

অবশ্য ইমাম নাসাঈ উহা হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ওয়ায়েল, মানসূর, হাম্মাদ ইব্‌ন যায়দ ও কুতায়বার সনদে হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি (এ এসব তরুন এ) হিসাবেও বর্ণনা করিয়াছেন। তবে উহা হযরত আবদুল্লাহ্ (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি (حديث موقوف) হিসাবে বর্ণনা করা সমর্থিত নহে।

হযরত আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে শাকীক, আবদাহ ও ইব্‌ন জুরায়জ প্রমুখ রাবী হইতেও উহা স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবে বর্ণনা হইয়াছে। ইমাম মুসলিম উহা ইব্‌ন জুরায়জ হইতে উপরোক্ত উর্ধ্বতন সনদাংশে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম নাসাঈ উহা ‘আল ইয়াওমু ওয়াল্লাইলাহ্’ পুস্তকে উপরোক্ত রাবী ইবাদাহ ইব্‌ন আবূ লুবাবাহ হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং আবাদাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে মুহাম্মদ ইব্‌ন জাহাদাহ প্রমুখ রাবীর ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন।

হযরত আবূ মূসা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ বুরদাহ, ইয়াযীদ, আবূ উসামা, মুহাম্মদ ইব্‌ন আ’লা ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘কুরআন মজীদ পুনঃপুনঃ তিলাওয়াত করিয়া উহা বিস্মৃতি হইতে রক্ষা কর। কারণ, যে সত্তার হস্তে আমার প্রাণ রহিয়াছে তাঁহার কসম ! দড়ি দিয়া বাঁধা উটকে ছাড়িয়া দিলে উহার পক্ষে ভাগিয়া যাইবার যতটুকু আশংকা থাকে, মানুষের স্মৃতি হইতে কুরআন মজীদেঁর চলিয়া যাইবার তদপেক্ষা অধিকতর আশংকা থাকে।

ইমাম মুসলিম (রঃ) উপরোক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী আবূ উসামা হাম্মাদ ইব্‌ন উসামা হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং আবূ উসামাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ কুরায়ব মুহাম্মদ ইব্‌ন আলা ও আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন বুরদ আশআরীর ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন।

হযরত উকবা ইব্‌ন আমের (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আলী মূসা ইব্‌ন আলী, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মুবারক, আলী ইব্‌ন ইসহাক ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন— ‘তোমরা আল্লাহ্ কিতাবকে শিখ, উহা পুনঃপুনঃ তিলাওয়াত করিয়া বিস্মৃতি হইতে রক্ষা কর এবং উহা সুরের সহিত তিলাওয়াত কর। যে সত্তার হস্তে আমার প্রাণ রহিয়াছে, তাঁহার কসম ! জলাশয়ে দড়ি দিয়া বাঁধা গৃহপালিত পশুর ভাগিয়া যাইবার যতটুকু আশংকা থাকে, স্মৃতি হইতে কুরআন মজীদের চলিয়া যাইবার তদপেক্ষা অধিকতর আশংকা থাকে।’

উপরোক্ত হাদীসসমূহের মূল বক্তব্য হইতেছে- কুরআন মজীদ পুনঃপুনঃ তিলাওয়াত করিবার প্রতি উৎসাহ প্রদান। কারণ, কুরআন মজীদ ভুলিয়া যাওয়া কবীরা গুনাহ। আর পুনঃপুনঃ তিলাওয়াত করিবার মাধ্যমেই উহা বিস্মৃতি হইতে রক্ষা করা সম্ভবপর। আল্লাহ্ তা’আলা আমাদিগকে উক্ত কবীরা গুনাহ হইতে রক্ষা করুন।

হযরত সা’দ ইবন উবাদাহ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে জনৈক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি, ঈসা ইব্‌ন ফায়েদ, ইয়াযীদ ইব্‌ন আবূ যিয়াদ, খালিদ, খালফ ইব্‌ন ওয়ালীদ ও ইমাম আহমদ বৰ্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- মাত্র দশজন লোকের উপর নেতৃত্বকারী ব্যক্তিকেও কিয়ামতের দিন হাতকড়া পরানো অবস্থায় উপস্থিত করা হইবে। অধীন ব্যক্তিদের প্রতি আচরিত তাহার ন্যায়বিচার ছাড়া কোন কিছুই তাহাকে উক্ত অবস্থা হইতে মুক্তি দিতে পারিবে না। অতঃপর নবী করীম (সাঃ) কুরআন মজীদ শিখিবার পর যে ব্যক্তি উহা ভুলিয়া গিয়াছে, তাহাকে তাহার শাস্তি সম্বন্ধে সতর্ক করিয়াছেন (যাহা এখানে বর্ণিত হয় নাই।) উক্ত হাদীসটি যেরূপ উপরোক্ত রাবী ইয়াযীদ ইব্‌ন যিয়াদ হইতে খালিদ ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ রিওয়ায়েত করিয়াছেন, তদ্রূপ উহা ইয়াযীদ হইতে জারীর ইবন আবদুল হামীদ এবং মুহাম্মদ ইব্‌ন ফুযায়লও রিওয়ায়েত করিয়াছেন। ইমাম আবূ দাউদ উহা কুরআন মজীদের তিলাওয়াত ভুলাইয়া দেওয়ার ঘটনার সহিত ‘হযরত সা’দ ইব্‌ন উবাদাহ (রাঃ)’ হইতে ধারাবাহিকভাবে ঈসা ইব্‌ন ফায়েদ, ইয়াযীদ, ইব্‌ন আবূ যিয়াদ, ইব্‌ন ইদরীস ও মুহাম্মদ ইব্‌ন আ’লার সনদে বর্ণনা করিয়াছেন। উক্ত সনদে হযরত সা’দ ইবন উবাদাহ (রাঃ) এবং ঈসা ইবন ফায়েদ এই রাবীদ্বয়ের মধ্যে অজ্ঞাতনামা কোন রাবীর থাকিবার কথা উল্লেখিত হয় নাই। তেমনি উহা ইয়াযীদ ইব্‌ন আবৃ যিয়াদ হইতে আবূ বকর ইব্‌ন আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। উক্ত হাদীস আবার যায়দ হইতে সাঈদও বর্ণনা করিয়াছেন। তাহার বর্ণনায় সনদের ব্যাপারে সন্দেহের উল্লেখ রহিয়াছে। উক্ত হাদীস আবার যায়দ ইব্‌ন ঈসা ইব্‌ন ফায়েদ হইতে ধারাবাহিকভাবে তাঁহার শিষ্যগণ ও ওয়াকী কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। উহাতে রাবী সাহাবীর নাম উল্লেখিত হয় নাই।

উক্ত সনদে উহা স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবেই বর্ণিত হইয়াছে। ইমাম আহমদ উহা ‘মুসনাদে উবাদাহ ইব্‌ন সামিত (রাঃ)’ নামক হাদীস সংকলনেও বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ হযরত উবাদাহ ইবন সামিত (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ঈসা ইব্‌ন ফায়েদ, ইয়াযীদ ইব্‌ন আবূ যিয়াদ, আবদুল আযীয ইব্‌ন মুসলিম ও আবদুস সামাদ আমার নিকট বর্ণণা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘কোন ব্যক্তি মাত্র দশ জন লোকের উপর নেতৃত্ব করিয়া থাকিলেও (কিয়ামতের দিন) তাহাকে হাতকড়া পরানো অবস্থায় উপস্থিত করা হইবে। নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিদের প্রতি কৃত তাহার ন্যায়বিচার ছাড়া কোন কিছুই তাহাকে উক্ত বন্দীদশা হইতে মুক্তি দিতে পারিবে না। আর যে ব্যক্তি কুরআন মজীদের তিলাওয়াত শিখিবার পর উহা ভুলিয়া গিয়াছে, কিয়ামতের দিন সে কর্তিত হস্ত হইয়া আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হইবে।’ উক্ত হাদীসটি ইয়াযীদ ইব্‌ন আবূ যিয়াদ হইতে আবূ উআইনাহও বর্ণনা করিয়াছেন। দেখা যাইতেছে, উহার সনদের বিষয়ে রাবীদের মধ্যে মিল নাই। তবে সতর্কীকরণ (ترهيب) সম্পর্কীয় হাদীসের ক্ষেত্রে সনদ সম্বন্ধীয় এইরূপ অমিল আপত্তিকর নহে। আল্লাহ্ই সৰ্বশ্ৰেষ্ঠ জ্ঞানী। এইরূপ অমিল সনদের হাদীস যখন অন্য হাদীস দ্বারা সমর্থিত হয়, তখন এইরূপ ক্ষেত্রে উহা বিশেষত গৃহীত হইয়াই থাকে। উক্ত হাদীস নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা সমর্থিত হইয়াছেঃ

হযরত আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্‌ন জুরায়জ, হাজ্জাজ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘আমার সম্মুখে আমার উম্মতের নেক আমলসমূহ উপস্থাপন করা হইয়াছে। এমনকি কোন ব্যক্তি মসজিদ হইতে যে খড়-কুটাটি অথবা পশুর লাদটি বাহির করিয়া ফেলে, উহার নেকীটিও। আর আমার সম্মুখে আমার উম্মতের বদ আমলসমূহ উপস্থাপন করা হইয়াছে। কোন ব্যক্তি কুরআন মজীদের কোন আয়াত বা সূরার তিলাওয়াত শিখিবার পর উহা ভুলিয়া গেলে তাহার আমলনামায় যে বদী লেখা হয়, তদপেক্ষা বৃহত্তম কোন বদী আমি উহার মধ্যে দেখি নাই।

হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) হইতে ই জুরায়জ বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘আমার উম্মতের লোকদিগকে কিয়ামতের দিনে যে সকল গুনাহের শাস্তি পূর্ণরূপে প্রদান করা হইবে, তাহাদের মধ্যে একটি বড় গুনাহ হইতেছে কোন ব্যক্তির কুরআন মজীদের কোন সূরার তিলাওয়াত শিখিবার পর উহা বিস্মৃত হইবার গুনাহ।’ ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম তিরমিযী, ইমাম আবূ ইয়া’লা এবং ইমাম বায্যারও উপরোক্ত হাদীস হযরত আনাস ইব্‌ন মালিক (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে মুত্তালিব ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন হানতাব, ইব্‌ন জুরায়জ ও ইব্‌ন আবূ দাউদের অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং বিভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। উক্ত হাদীস সম্বন্ধে ইমাম তিরমিযী মন্তব্য করিয়াছেনঃ উক্ত হাদীস হযরত আনাস (রাঃ) হইতে শুধু উপরোক্ত মাধ্যমেই বর্ণিত হইয়াছে; অন্য কোন মাধ্যমে উহা তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত হয় নাই। আমি উহা ইমাম বুখারীর নিকট উল্লেখ করিলে তিনিও উহা সম্বন্ধে অনুরূপ মন্তব্য করিয়াছেন।’ ওয়ালেবী বর্ণনা করিয়াছেন যে, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আবদুর রহমান দারেমী বলিয়াছেন- ‘(উপরোক্ত রাবী) মুত্তালিব ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন হানতার হযরত আনাস (রাঃ) হইতে হাদীস শ্রবণ করেন নাই।’ আমি (ইব্‌ন কাছীর) বলিতেছি, হযরত আনাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে যুহরী, ইব্‌ন জুরায়জ, ইব্‌ন আবূ দাউদ ও মুহাম্মদ ইব্‌ন ইয়াযীদ আদমীও উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

কোন কোন তাফসীরকার উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত বিষয়কে নিম্নোক্ত আয়াতসমূহের তাফসীর প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا – وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيمَةِ أَعْمَى

قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا – قَالَ كَذَالِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا

فَنَسِيتَهَا وَكَذَالِكَ الْيَوْمُ تُنسى

‘যে ব্যক্তি আমার উপদেশ হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে, তাহার জন্য জীবিকা হইবে সংকুচিত। অতঃপর আমি কিয়ামতের দিনে তাহাকে অন্ধ করিয়া অন্যদের সঙ্গে উঠাইব। সে বলিবে, হে প্রভু ! কেন আমাকে অন্ধ করিয়া উঠাইলে? আমি তো দুনিয়াতে চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ্ বলিবেন, তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ (নিদর্শনাবলী) আসিয়াছিল; কিন্তু তুমি উহা ভুলিয়া রহিয়াছিলে। সেইরূপে আজ তোমাকে ভুলিয়া থাকা হইবে।’

উপরোল্লেখিত হাদীসের বক্তব্য বিষয় উপরোক্ত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যার সমগ্রটুকু না হইলেও উহার অংশবিশেষ বটে। কারণ, কুরআন মজীদের তিলাওয়াত হইতে বিরত থাকা, উহা বিস্মৃত হওয়া এবং উহার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়া কুরআন মজীদের প্রতি এক প্রকারের অবহেলা প্রদর্শন করা এবং উহা এক প্রকারের ভুলিয়া থাকা বৈ কিছু নহে। আল্লাহর নিকট এইরূপ কার্য হইতে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি। নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- تعاهدوا القران অর্থাৎ তোমরা কুরআন মজীদ পুনঃপুনঃ তিলাওয়াত করিয়া উহাকে বিস্মৃতি হইতে রক্ষা কর। তিনি আরও বলিয়াছেনঃ

اسْتَذْكُرُوا الْقُرْآنَ – فَانَّهُ أَشَدُّ تَفَصِيًا مَنْ صُدُورِ الرِّحَالِ مِنَ النَّعْم

অর্থাৎ তোমরা বারবার কুরআন মজীদকে অবিস্মৃত রাখো। গৃহপালিত পশুর পক্ষে পালাইয়া যাইবার যতটুকু আশংকা থাকে, মানুষের স্মৃতি হইতে কুরআন মজীদের দূরে সরিয়া যাইবার ততোধিক আশংকা থাকে। التفصى শব্দের অর্থ হইতেছে মুক্ত হওয়া, খালাস পাওয়া, দূরীভূত হওয়া। تفصى فلان من البلية অমুক ব্যক্তি বিপদ হইতে মুক্তি পাইয়াছে। تفصى النوى من التمرة খেজুর হইতে উহার দানা পৃথক হইয়া গিয়াছে। উক্ত হাদীসের তাৎপর্য এই যে, গৃহপালিত পশুকে ছাড়িয়া দিলে উহার পালাইয়া যাইবার যত আশংকা থাকে, কুরআন মজীদ তিলাওয়াত না করিয়া স্মৃতিতে রাখিয়া দিলে স্মৃতি হইতে উহার পালাইয়া যাইবার ততোধিক আশংকা রহিয়াছে।

ইবরাহীম হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’মাশ, আবূ মুআবিয়া ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করেনঃ ইবরাহীম বলেন যে, হযরত ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) বলিয়াছেন- ‘আমি যদি কোন ব্যক্তিকে দেখি যে, সে কুরআন মজীদ শিখিবার পর উহা ভুলিয়া গিয়াছে এবং সে মোটা-সোটা রহিয়াছে, তবে তাহাকে মারিয়া ফেলিব।’ যিহাক ইব্‌ন মুযাহিম হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুল আযীয ইব্‌ন আবূ দাউদ ও আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মুবারক বর্ণনা করিয়াছেন যে, যিহাক ইব্‌ন মুযাহিম বলেন- ‘কোন ব্যক্তি কুরআন মজীদ শিখিবার পর ভুলিয়া গেলে বুঝিতে হইবে যে, সে পূর্বে কোন গুনাহ্ করিয়াছে । কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

مَاأصابكُم من مصيبة فَبمَا كسيت أَيِدِيْكُم

অর্থাৎ ‘তোমাদের প্রতি যে মুসীবত আসে উহা তোমাদের হাতেরই উপার্জন বৈ নহে।’ নিঃসন্দেহে কুরআন মজীদ ভুলিয়া যাওয়া একটি মহা মুসীবত। এই কারণেই ইসহাক ইব্‌ন রাহওয়াই প্রমুখ ব্যক্তিগণ বলিয়াছেন- ‘তিন দিনের কম সময়ের মধ্যে সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত সম্পন্ন করা যেরূপ মাকরূহ, চল্লিশ দিনের মধ্যে কুরআন মজীদ আদৌ তিলাওয়াত না করা সেইরূপ মাকরূহ।’ শীঘ্রই এতদসম্পর্কিত আলোচনা আসিতেছে।

error: Content is protected !!