বামুন বাড়ির মেয়ে,
কাঁচা রোদের বরণ ঝরে গা-খানি তার বেয়ে-
সে রোদ দেখা যায়, যেমনি বনের পাতার ফাঁকে,
শিশু-রবির টুকরো আলো ছড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকো;
তেমনি তাহার বসন বেয়ে, আঁচলখানি বেয়ে,
যে পথ দিয়ে চলে সে পথ রূপে যে যায় নেয়ে।
এই গাঁয়েতে আধলা পুকুর, পচা কাজল জল;
বেঙের ছাতি তাহার বুকে ভাসছে অবিরল।
সেখানেতে পানার বহর মশার দলের সনে,
চিরস্থায়ী ঘর বাঁধিয়া বাস করে নির্জনে।
তারির ফাঁকে বরষ বরষ জল-সাপলার পরী,
চাঁদের আলো মাখায় তাহার ফুলেল কুটীর ভরি।
সেই জলেরি ঢেউ বাঁধিয়া সূক্ষ্ম লতার সনে
কলমী-কুসুম নিতুই সাজে নতুন বিয়ের কনে।
সেখানেতে পদ্মপাতায় মেলি পূজার ফুল,
কলমিনী পুকুর জলে ভাসায় জাতি-কুল।
তেমনি এই সুদূর গাঁয়ে ম্যালেরিয়ার বাস,
ঝগড়া ফেসাদ-কুসংস্কার ঘুরছে চারি পাশ।
এরির মধ্যে বাস করে এই বামুন বাড়ির মেয়ে,
সবার সনে থেকেও সে যে একলা সবার চেয়ে।
ও যেন ঠিক কুমুদ-কুসুম দীঘির পচা জল,
আজও তাহার পায়নি ছুঁতে পরাগ শতদল।
ও যেন ঠিক ঝুমকো লতা জড়িয়ে গাঁয়ের সব,
হাসছে উহার পাতায় পাতায় ফুলে মহোৎসব।
এই গাঁয়েতে বরষ বরষ আসছে মাহমারী,
হাজার পরাণ ধূলায় লোটে চরণ ঘায়ে তারি।
আসে হেথায় বসন্ত আর কলেরা প্লেগ আদি,
ওই মেয়েটির প্রতি এদের কেউ নাহি হয় বাদী।
সে যেন গাঁর পূজার কুসুম, সকল অত্যাচার,
সাহস নাহি পায় ছুঁইতে চরণ দুটি তার।
আছে গাঁয়ের নারদ-পিসী ক্ষান্ত মাসীর মাতা,
যাহার যত পোপন কিছু লিখছে ভরি খাতা।
আছে গাঁয়ে মোক্ষদা সে খ্যাংরামুখী বুড়ী;
মুখে কথার বজ্রশিলা ফিরছে ছুঁড়ি ছুঁড়ি।
ওই মেয়েটির জগৎ যেন তাদের হতে আর;
কিংবা তারা বুঝছে যে ও, নাগাল পাওয়ার বার।
ওই মেয়েটির চলন-চালন আর যে হাসি-খুশী,
কারো হাসি-খুশীর সনে হয়নি আজো দুষী।
এ গাঁয় প্রথম চাঁদ আসিয়া বসে শিমূল ডালে,
সোনা হাসির মুঠি মুঠি ছড়ায় উহার গালে।
সন্ধ্যা বেলায় যে রঙ ঝরে গাঁয়ের পুকুর জলে;
সেও হয়ত ওরির পায়ে আলতা মাখার ছলে।
গাঁয়ের মাঝে বামুন বাড়ি সকল বাড়ির সেরা;
চার ধারে তার নানান বরণ ফুল-বাগিচার বেড়া।
পাতায় পাতায় ফলের বাসা, ফুলের স্বপন মাঝে,
ফুলের চেয়েও ফুলেল সাজে বামুন বড়ি রাজে।
তাদের ঘরে ঠাকুর আছে মন্ত্র পড়ি রোজ
তুলসী তামা গঙ্গাজলে দেয় যে পূজার ভোজ।
সেথায় জ্বলে হোমের আগুন, ঘন্টা কাঁসর বাজে,
তাহার মাঝে বামুন বাড়ির পূজার ঠাকুর রাজে।
বামুন পাড়ার স্বপন যেন ধূপের ধোঁয়ায় হেসে,
পূজারতির মন্ত্র সনে বেড়ায ভেসে বেসে।
হোমাগুনের গন্ধ ঝরে সারাটি গাও বেয়ে
তারি মতন দাঁড়িয়ে হাসে বামুন বাড়ির মেয়ে।
“ধান-ক্ষেত” কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ