বাংলাদেশ দর্শন সমিতির ষষ্ঠ সাধারণ সম্মেলনে পঠিত বক্তৃতা
মাননীয় সভাপতি সাহেব, উপস্থিত সুধীবৃন্দ ও আমার প্রিয় তরুণ-তরুণীগণ! আজকে এ মহতী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ও দু’টি কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এ সভায় বলবার মতো কিছুই আমার আয়ত্তে নেই, একমাত্র পরিচয় জ্ঞাপন ছাড়া। তাই আমার পরিচয় জ্ঞাপক দু-একটি কথা বলেই বক্তব্য শেষ করবো।
আমার পরিচয়- বরিশাল জেলার লামচরি গ্রাম নিবাসী একজন অজ্ঞ চাষী। মাত্র চার বৎসর বয়সে আমার বাবা মারা যান এবং দশ বৎসর বয়সে দেনার দায়ে নিলামে বিক্রি হয়ে যায় সামান্য বিত্তটুকু এবং বসতঘরখানা। তখন বেঁচে থাকতে হয় দশ দুয়ারের সাহায্যে। দারিদ্র নিবন্ধন কোনো বিদ্যায়তনে বিদ্যালাভের সুযোগ ঘটেনি আমার, বর্ণবোধ ছাড়া।
পেটের দায়ে আমাকে কৃষি কাজ শুরু করতে হয় অল্প বয়সেই। কৃষি কাজের ফাঁকে ফাঁকে সামান্য পড়ার কাজ ও চালাতে থাকি ঘরে বসেই। বাংলা ভাষা পড়ার সামান্য ক্ষমতা জন্মে গ্রাম্য পুঁথিপাঠকদের সঙ্গে পুঁথিপাঠ ও স্থানীয় পড়ুয়া ছাত্রদের পুরোনো পাঠ্যপুস্তক পাঠের মাধ্যমে। পয়সা দিয়ে কোন বিদ্যালয়ে বিদ্যা খরিদ করা ছিল আমার ক্ষমতার বাইরে। তাই আমার কাছে কোন শিক্ষাঙ্গনের ক্যাশমেমো নেই।
আপনারা জানেন যে, অধুনা উচ্চতর জ্ঞান লাভের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। আর তা-ই আমার অনায়ত্ব। একাধিক ভাষা বিশেষত ইংরেজি ভাষা না জানায় আমি পঙ্গু। যে ব্যক্তি একটি পায়ের অধিকারী, কায়ক্লেশে সমতল ভূমিতে বিচরণ সম্ভব হলেও তার পক্ষে পর্বতে আরোহণ যেমন সম্ভব নয়, তদ্রুপ ইংরেজি ভাষা না জানার ফলে আমি উচ্চতর জ্ঞান লাভে হয়েছিউ বঞ্চিত।
বিগত ২৭.১০.৭৮ তারিখের ‘বিচিত্রা’ পত্রিকা, ১০.৬.৮১ তারিখের ‘সংবাদ’ পত্রিকা ১৯.৭.৮১ তারিখের ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকা, ৪.৯.৮১ তারিখের ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা, ১২.১২.৮২ তারিখের ‘সন্ধানী’ পত্রিকা ও আমার সম্পাদিত ‘স্মরণিকা’ পুস্তিকাখানা যারা পাঠ করেছেন এবং যারা ১৭.৪.৮৩ তারিখে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানে আমার সাক্ষাৎকারের বাণী শ্রবন করেছেন – তাঁরা হয়তো জানেন আমার দুঃখজনক একটি ঘটনা। তবুও সেই অবিস্মরণীয় বিষাদময় ঘটনাটি সংক্ষেপে এখানে বলছি। যে ঘটনা আমাকে করেছে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দ্রোহী।
আমার মা ছিলেন অতিশয় নামাজী-কালামী ধার্মিকা রমণী। তাঁর নামাজ-রোজা বাদ পড়া তো দূরের কথা, কাজা হতেও দেখিনি আমার জীবনে। তাঁর তাহাজ্জুদ নামাজ বাদ পড়েনি মাঘ মাসের দারুণ শীতের রাতেও। ১৩৩৯ সালে আমার মা মারা গেলে আমি মৃত মায়ের ফটো তুলেছিলাম। মাকে দাফন করার উদ্দেশ্যে যে সমস্ত মুন্সি, মৌলবি ও মুসল্লিরা এসেছিলেন, ‘ফটো তোমা হারাম’ বলে তাঁরা জানাজা ও দাফন করা ত্যাগ করে লাশ ফেলে চলে যান। অগত্যা কতিপয় অমুসল্লি নিয়ে জানাজা ছাড়াই মাকে সৃষ্টিকর্তার হাতে সমর্পণ করতে হয় কবরে।
ধর্মীয় দৃষ্টিতে ছবি তোলা হারাম হলেও সে দোষে দোষী স্বয়ং আমিই, আমার মা নন। তথাপি কেন যে আমার মায়ের অবমাননা করা হল, তা ভেবে না পেয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে মা’র শিয়রে দাঁড়িয়ে তাঁর বিদেহী আত্মাকে উদ্দেশ্য করে এই বলে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, “মা, আজীবন ছিলে তুমি ধর্মের একনিষ্ঠ সাধিকা। আর আজ সেই ধর্মের নামেই হলে তুমি শিয়াল-কুকুরের ভক্ষ্য। সমাজে বিরাজ করছে এখন ধর্মের নামে অসংখ্য অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার। তুমি আমায় আশীর্বাদ করো, আমার জীবনের ব্রত হয় যেন কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস অভিযান। আর সে অভিযান সার্থক করে আমি যেন তোমার কাছে আসতে পারি।
“তুমি আশীর্বাদ করো মোরে মা,
আমি বাজাতে পারি যেন সে অভিযানের দামামা।”
মায়ের মৃত্যু দিন থেকে সামান্য বিদ্যার পুঁজি নিয়ে বিজ্ঞান ও দর্শন সমুদ্রের বেলাভূমিতে বিচরণ করে যাচ্ছি কিছু উপলখন্ড সংগ্রহের আশায়, যার দ্বারা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে আঘাত করা যায়।
মাননীয় সভাপতি সাহেব ও শ্রদ্ধেয় সুধীবৃন্দ! আমি দার্শনিক নই, এমনকি কোন পুঁথিগত দর্শন আমার আয়ত্তে নেই, কতকটা লালন শাহের মতোই। তবে দর্শনকে ভালোবাসি, দার্শনিকদের শ্রদ্ধা করি এবং তাঁদের সংসর্গ লাভে আনন্দিত হই। কিন্তু আমি ভাববাদী দর্শনে অনুরক্ত নই।
বাংলাদেশ দর্শন সমিতির মাননীয় সদস্যবৃন্দ। আপনাদের এ দার্শনিক সম্মেলনে আমার মতো অজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে দর্শন সম্বন্ধে কোনোরূপ আলোচনা করার অর্থ হবে আমার অজ্ঞতাই প্রচার করা। অধিকন্তু তা হবে মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প বলার মতোই হাস্যকর। তবে উপসংহারে আমি এই বলতে চাই যে, যদিও দর্শনশাস্ত্রটি সার্বজনীন, তথাপি হিন্দু দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন, মুসলিম দর্শন, ভারতীয় দর্শন, গ্রীক দর্শন ইত্যাদি দর্শনে যেমন স্বাতন্ত্র, বর্তমান বাঙ্গালীর জাতীয় দর্শনেও তেমনটি বাঞ্ছনীয়। আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত থেকে বলছি, তা হওয়া উচিত মানবতাবাদী দর্শন। কেননা সর্বদেশে এবং সর্বকালে মেহনতী মানুষই মানবতার প্রত্যাশী, পুঁজিপতিরা নয়। আর দুনিয়ার দরিদ্রতম দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, যেখানে মেহনতী মানুষের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৯০। তাই এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন দর্শনই হওয়া উচিত বাঙ্গালীর জাতীয় দর্শন তথা মানবতাবাদী দর্শন।
সুধী সভাসদবৃন্দ! আমি মূল্যহীন বক্তব্য দ্বারা আপনাদের মূল্যবান সময় আর নষ্ট করতে চাই না। বাংলাদেশ দর্শন সমিতি অমর হোক – এই কামনা করে এবং এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
ধন্যবাদ, শুভ হোক।
১৯৮৪
অপ্রকাশিত
৮.১ মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ভাষণ
৮.২ বাংলাদেশ সোসিও-ফিলসফিক হিউম্যানিস্ট গিল্ড সেমিনারে ভাষণ
৮.৩ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.৪ নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.৫ গুণী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.৬ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.৭ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক বিবরণী ভাষণ
৮.৮ মানবিক উন্নয়নে যুব সমাজের ভূমিকা সেমিনারে ভাষণ
৮.৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় ভাষণ
৮.১০ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক অধিবেশনে ভাষণ
৮.১১ বার্ষিক বৃত্তিপ্রদান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.১২ বাংলাদেশ কুটির শিল্প সংস্থায় ভাষণ
৮.১৩ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক বিবরণী ভাষণ
৮.১৪ বাংলাদেশ দর্শন সমিতিতে ভাষণ
৮.১৫ বার্ষিক বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.১৬ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীতে ভাষণ
৮.১৭ বাংলা একাডেমীর সংবর্ধনা ভাষণ