অভিজিৎ রায়
১.

যে সমাজ আর সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী আমরা, তার সবটুকুই যে নির্ভেজাল তা বলা যায় না। এতে যেমন প্রগতিশীল বস্তুবাদী উপাদান রয়েছে, তেমনি রয়েছে আধ্যত্মবাদ, বুজরুকি, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস আর অপবিশ্বাসের রমরমা রাজত্ব; রয়েছে অমানিষার ঘোর অন্ধকার । এই অন্ধকার সুদীর্ঘকাল ধরে বংশ পরম্পরায় আমাদের চিন্তা চেতনাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে এই ‘চেতনার দাসত্ব’ থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়- বরং বাস্তবিকই কঠিন ব্যাপার । রাহুল সাস্কৃত্যায়ন একবার তার একটি লেখায় বলেছিলেনঃ

‘মানুষ জেলে যাওয়া বা ফাঁসির মঞ্চে যাওয়াটাকে বিরাট হিম্মত মনে করে । সমাজের গোঁড়ামিকে ভেঙে তাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, জেলে যাওয়া বা ফাঁসির মঞ্চে ওঠার চেয়ে ঢের বেশী সাহসের কাজ ।’

কথাটি মিথ্যে নয় । তাই ইতিহাসের পরিক্রমায় দেখা যায়, খুব কম মানুষই পারে আজন্ম লালিত ধ্যান ধারণাকে পরিত্যাগ করে স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে, খুব কম মানুষই পারে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে । খুব কম মানুষের মধ্যে থেকেই শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসে একজন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, দীনবন্ধু, ভূদেব, বেগম রোকেয়া, আরজ আলী মাতুব্বর, প্রবীর ঘোষ, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন কিংবা আহমদ শরীফ । শাসক আর শোষক শ্রেণী আর তাদের নিয়ন্ত্রিত বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা কখনও চায় না জনগণ প্রথা ভাঙুক, কুসংস্কারের পর্দা সরিয়ে বুঝতে শিখুক, জানতে শিখুক অজ্ঞতা, শোষণ আর অসাম্যের মূল উৎসগুলো কোথায় । জনগণের ‘জ্ঞান চক্ষু’ খুলে গেলেই তো বিপদ, তাই না! আর সেজন্যই জনগণকে অন্ধকারে রাখতে চলে বিজ্ঞানের মোড়কে পুরে ধর্মকে পরিবেশন, লাগাতার অধ্যাত্মবাদী প্রচারণা, পত্রপত্রিকায় ঢাউস আকারে রাশিফল, সর্পরাজ আর অধ্যাত্মবাদী গুরু আর কামেল পীরের বিজ্ঞাপন, মন্ত্রী আর নেতানেত্রীদের মাজার আর দরগায় সিন্নি দেওয়া অথবা নির্বাচন উপলক্ষে হজে যাওয়া, মাথায় টুপি ও কাল-পট্টিসহ বিচিত্র লেবাস ধারণ । মুক্তমনাদের লড়াই এই সামগ্রিক অসততার বিরুদ্ধে, অন্ধবিশ্বাস আর অপবিশ্বাসকে উস্কে দেয়া এই সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে । এ লড়াই কামান-বন্দুক হাতে মামদোবাজি নয়, এ লড়াই বৌদ্ধিক, এ লড়াই সাংস্কৃতিক। এ লড়াই সমাজকে প্রগতিমুখী করবার ব্রত নিয়ে সামগ্রিক অবক্ষয় আর অন্ধকার ভেদ করে আশার আলো প্রজ্জ্বলিত করবার লড়াই। এ লড়াই আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কাছে চেতনা মুক্তির লড়াই ।

চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত করার লড়াইয়ের ময়দানটি একদিনে গড়ে উঠেনি । আজ ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্বাস এবং যুক্তির সরাসরি সংঘাতের ভিত্তিতে যে সামাজিক আন্দোলন বিভিন্ন ফোরামগুলোতে ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে, তা আমরা মনে করি প্রাচীনকালের ব্রহ্মবাদী বনাম চার্বাকবাদীদের লড়াইয়ের একটি বর্ধিত, অগ্রসর ও প্রায়োগিক রূপ । এ এক অভিনব সাংস্কৃতিক আন্দোলন, বাঙালির এক নবজাগরণ যেন । এর প্রেক্ষাপট সূচিত হয়েছিলো আজ থেকে পাঁচ বছর আগে— ২৫শে মে, ২০০১এ। কুসংস্কার, ভাববাদ, অধ্যাত্মবাদ, নিয়তিবাদ ও অলৌকিকতা-মুক্ত এক স্পর্ধিত বাঙালি প্রজন্ম গড়ে তুলতে মাত্র ৩০ জন সদস্য নিয়ে এ দিনটিতে সৃষ্টি হয়েছিল প্রথম ওয়েবভিত্তিক কুসংস্কারবিরোধী মননশীল বাঙালি আলোচনাচক্র- ‘মুক্তমনা’ । প্রথম দিকে মূলত বাংলাদেশী সদস্যদের নিয়ে গঠিত হলেও এটি দেশ ও কালের সীমাকে অতিক্রম করে যায় খুব তাড়াতাড়িই । পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ফ্রিথিংকারদের এক মিলন মেলায় পরিণত হয় মুক্তমনা। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ইরাক, সৌদি আরব, দুবাই, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ড, ইংলন্ড, আমেরিকা, কানাডা, ইরানসহ নানা দেশ থেকে সদস্যরা ভিড় করতে শুরু করেন, মুক্তমনা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠে এক ‘আন্ত জাতিক’ প্রগতিশীল সংগঠন। 

কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস আর শাস্ত্রানুগত্য মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার দরকার যে আছে তা তো আর নতুন করে বলে দেবার প্রয়োজন নেই । প্রাচীন ভারতের সেই যুক্তিবাদী চার্বাকরা অনেক আগেই তা বুঝেছিলেন । তারা তাদের মত করে যুদ্ধ করে গেছেন । আত্মাকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই সম্ভবত চার্বাকদের লড়াইটা শুরু হয়েছিল । আত্মাই যদি না থাকবে তবে কেন অযথা স্বর্গ নরকের কেচ্ছা-কাহিনীর আমদানি । কাজেই আত্মা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে করতে শেষ পর্যন্ত ঠোঁট কাটা চার্বাকেরা ঈশ্বর- আত্মা-পরলোক-জাতিভেদ-জন্মান্তর সব কিছুকেই তারা নাকচ করে দিয়েছিলেন । তারাই প্রথম বলেছিলেন বেদ ‘অপৌরুষেয়’ নয়, এটা একদল স্বার্থান্বেষী মানুষের রচনা । জনমানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া সেইসব স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণদের চার্বাকেরা ভণ্ড, ধূর্ত, চোর, নিশাচর বলে অভিহিত করেছিলেন। এ হচ্ছে খ্রীষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর কথা— তখনো শ্রেণী শোষণ বুঝাবার জন্য মার্ক্স-এঙ্গেলসের জন্ম হয়নি । চার্বাকেরা তাদের মত করেই শ্রেণী শোষণের মর্মবাণীটুকু বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন । তারা বলেছিলেন ধূর্ত স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণেরা শোষণের সুবিধার্থে বেদের শে-াকগুলো ঈশ্বরের বাণী হিসেবে প্রচার করেন । এখানে শ্রেণীচেতনার বিষয়টি কিন্তু স্পষ্ট। ব্রাহ্মণ পাণ্ডারা যে লোক ঠকানোর ব্যবসা ফেঁদেছে, আর ধর্ম জিনিসটাই যে শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা চার্বাকেরা তাদের লেখায় প্রথম থেকেই স্পষ্ট করেই বলেছেন । ফলে দেখা যায় যে, এই চার্বাক দর্শন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে কেবল বৈপ-বিক ভূমিকাই পালন করেনি, পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে আরো অনেক প্রগতিশীল ও বস্তুবাদী মতপ্রকাশের ক্ষেত্র তৈরিতে একটি দৃঢ়ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল ।

এই প্রসঙ্গে সাংখ্য দর্শনের কথাও বলা যায় । সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা কপিল যীশু খ্রীষ্টের ছ’সাতশ বছর আগে জন্মেছিলেন । সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরের কোন ভূমিকা ছিল না । এই দর্শনের আচার্যরা ঈশ্বরীয় শক্তির মাধ্যমে সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করার কিংবা ঈশ্বরকে ‘আদি কারণ’ ভেবে নেবার পক্ষে কোন যৌক্তিক সমর্থন খুঁজে পাননি ।

চার্বাক ও সাংখ্যদর্শনের প্রভাবে পরবর্তীতে বৌদ্ধ ও জৈন— এই দুই বিখ্যাত ধর্মমত জন্মলাভ করেছিল । বৈদেক যুগের আচার সর্বস্বতা, তুক তাক, যাগযজ্ঞ, কুসংস্কার, জাতিভেদসহ নানা ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে “বিদ্রোহী মতবাদ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল এ দুই মতবাদ । এ দুটি দর্শনের স্রষ্টা গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর মূলত আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন । ঈশ্বর আছেন কি নেই, সেটাকে তারা গৌণ মনে করেছেন । বৌদ্ধ দর্শন ও জৈন দর্শন উভয়েই প্রথম দিকে নাস্তিক্যবাদী দর্শন হিসেবে আবির্ভূত হলেও পরবর্তীতে এর অনুসারিগণ একে একেবারে ‘প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম’ বানিয়ে ফেলেন । প্রবর্তকদের দার্শনিক মর্মবাণী ভুলে গিয়ে এদের অনুসারীরা পূজা-অৰ্চনা, নানা ধরনের তুকতাক আর আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন । অথচ বুদ্ধদেব আর মহাবীর দুজনই বৈদেক ধর্মের অমানবিকতা, নিষ্প্রাণ আনুষ্ঠানিকতা, আর অপ্রয়োজনীয় আচার আচরণের বিরুদ্ধেই মূলত বিদ্রোহ করেছিলেন । চার্বাক, কপিল, বৌদ্ধ কিংবা জৈন ধর্মের অনুসারী ছাড়াও প্রাচীন ভারতে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেছিলেন । যীশু খ্রীষ্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে থেকেই ভারতে মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সংশয়াবাদ আর যুক্তিবাদ বিকাশ লাভ করে । বৃহস্পতি, ধীষণ, পরমেস্তিন, ভৃগু, কশ্যপমুনি, ঋষি জাবালি, মসকরী গোষল, পুরন্দর, চানক্য, রাজাবেন, বাৎসায়ন, ভাগুরী প্রমুখ চিন্তাশীল ব্যক্তিরা খ্রীষ্টের জন্মের অনেক আগেই ভারতে যুক্তি আর মুক্তবুদ্ধির আলো ছড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে । উদ্দালোক অরুণী, অজিতকেশকাম্বলী প্রমুখেরা বুদ্ধের সমসাময়িক মুক্তমনা । প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে এ ধরনের বাষট্টি জন বিদ্রোহী মুক্তমনাদের কথা জানা যায় যাঁরা সে সময় যুক্তির নিরিখে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মশাস্ত্র ও ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন ।

মোতাজিলারা ছিল প্রথম সম্প্রদায় যারা ইসলামের মধ্যে থেকে যুক্তিবাদের চর্চা শুরু করেছিলেন । তাদের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল বসরাতে । তারা সংশয়বাদী দৃষ্টি নিয়ে আল্লাহ, কোরান আর পয়গম্বরদের বাণী ও কার্যাবলিকে বিচার করতেন । এমন কি হযরত মুহম্মদের জীবিতকালেই অনেকে আল্লাহ, কোরান আর মুহম্মদের নবুওত নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন, এমনকি কেউ কেউ ব্যঙ্গ বিদ্রূপও করেছিলেন । কোরানের কোন কোন আয়াতে এ সম্পর্কে ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে । পরবর্তীতে গ্রীক ও রোমান দর্শনে প্রভাবিত হয়ে মোতাজিলারা নিজেদের মুক্তবুদ্ধির চর্চায় নিয়োজিত করেন। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে তারা কোরানের অলৌকিকতাকে অস্বীকার করেন । তারা মনে করতেন কোরান কোন অনাদি ও অপরিবর্তনীয় গ্রন্থ নয় । আল-াহর তার বান্দাদের বিপথে চালনা করা কিংবা অযথা নরকের ভয় দেখানোকেও মোতাজিলারা অযৌক্তিক ও বালখিল্য বলে মনে করতেন। খলিফা হারুন-অর-রশীদ আর আল মামুনের শাসনকাল (৭৮৬- ৮৩৩খ্রিঃ) ছিল মোতাজিলা সম্প্রদায়ের জন্য আক্ষরিক অর্থেই এক সুবর্ণ যুগ । এ দুই খলিফা মোতাজিলা সম্প্রদায়কে পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন আর জ্ঞান চর্চাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করতেন । মোতাজিলাদের মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অগ্রগতিতে প্রেরণা যুগিয়েছিলো । কিন্তু নবম শতাব্দীর শেষে এসে ইসলামের ভিতর মৌলবাদী ধারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে আর মোতাজিলা সম্প্রদায় আর সে সময়কার অন্যান্য মুক্তমনারা নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার হন নিদারুণভাবে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে যান মোতাজিলাবিরোধী আল আশারী, আল গাজ্জালীর মত গোঁড়াপন্থীরা। তারা মোতাজিলাদের এতোদিনের গড়ে তোলা অনুসন্ধিৎসু মননকে সমূলে বিনাশ করতে সচেষ্ট হন আর ‘ধর্মীয় জোশে’ প্রচার করেন-

তনুকিদ্ (যুক্তিবাদ ও জ্ঞান বিজ্ঞান) নয়, তকলিদ্ই (অন্ধবিশ্বাসের অনুসরণ ও অনুকরণ) মুক্তির একমাত্র পন্থা। তকুনিদ্ হারাম, অধর্ম, কুফর আর কবিরা গুনাহ্ ।’

ইসলামের প্রথম দিকে তুলনামূলক সহনশীল পরিবেশে জ্ঞান চর্চার যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল তা নবম শতাব্দীর শেষভাগে এসে গাজ্জালীদের হাতে পড়ে কূপমণ্ডুকতায় রূপান্তরিত হয় । জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে প্রতিহত করে মুক্তমনাদের উপর আক্রমণ সে সময়কার ইসলামে কট্টরপন্থীদের এক নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। আগেই আবু যার গিফারীকে খাদ্য আর পানীয় থেকে বঞ্চিত করে মরুভূমিতে বেঁধে রেখে হত্যা করা হয় । ইবনে সিনা কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, পালিয়ে দেশ ত্যাগ করে কোন রকমে বাঁচলেন । ইবনে রুশদেরও প্রায় একই দশা হয়। প্রগতিশীল যুক্তিবাদী ইবনে যিরহামকে ৭৪১ খ্রীষ্টাব্দে আর আল-দিমিস্কিকে ৭৪২ খ্রীষ্টাব্দে হত্যা করা হয়। শুধুমাত্র যুক্তিবাদী মোতাজিলারাই নন, ইসলামে মরমীয়া চিন্তাধারাসহ সমস্ত সনহশীল মতাদর্শকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিলো। কূপমণ্ডুকতার চর্চা আর ‘ফ্রিথিঙ্কার’ শুনলেই ফতোয়া দিয়ে হত্যা করার যে রীতি নবম শতাব্দীতে চালু হয় মূলত গাজ্জালী গংদের হাত দিয়ে, তার অভিশাপ থেকে ইসলাম আজো মুক্ত হতে পারে নি। কট্টর মোল-াদের কাছে মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর বিরুদ্ধ মতবাদ কী দারুণভাবে অসহনীয় তা দেখতে পাই আজকের সালমান রুশদী, তসলিমা নাসরিন কিংবা হুমায়ুন আজাদের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মনোভাবে।

 

২.

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আর উনবিংশ শতকের শুরুতে বাংলার চিন্তা-চেতনার জগতে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয় । ইউরোপীয় রেঁনেসার সাথে তুলনা করে কেউ কেউ একে ‘বাংলার রেঁনেসা’ বলেও অভিহিত করেন । এ জারগণের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন সমাজের পশ্চাৎপদ যুক্তিবিরোধী আচার প্রথা, কুসংস্কার ও নিশ্চল স্থবির সমাজ কাঠামোতে কাঁপন ধরিয়েছিলো । এ রেঁনেসার দু’জন পুরোধা পুরুষ হলেন রামমোহন ও বিদ্যাসাগর । এঁদের প্রভাব প্রসঙ্গে সুহাস চট্টোপাধ্যায় তার মার্কসবাদ ও নন্দনতত্ত্ব বইয়ে বলেন,

‘রামমোহন-বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদ পরবর্তী যুগের বাংলা সাহিত্যে আরো বেশি বস্তুবাদী চেতনার বিকাশ ঘটালো এবং তা মাইকেল দীনবন্ধুর সময়ে সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে রীতিমত বৈপ-বিক লড়াইয়ে পরিণত হল ।’

রামমোহন রায়কেই (১৭৭২-১৮৩৩) ‘বাংলার রেঁনেসা’র পথিকৃৎ বলে মনে করা হয় । ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এসে তিনি ইউরোপীয় উদারনৈতিক ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। তার আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মসংস্কারভিত্তিক। সনাতন ধর্মের বহু যুক্তিবিরোধী আচার আচরণকে শাস্ত্র থেকেই যুক্তি উত্থাপনের মাধ্যমে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন । হিন্দু ধর্মের নানা দেব দেবীর পূজা-অর্চনাকে অযৌক্তিক প্রমাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন এই বলে— ‘মূর্তিপুজো সমাজের বিন্যাসটা ধ্বংস করে দেয় ৷’ তিনি নিরাকার ঈশ্বরভিত্তিক একেশ্বরবাদের পক্ষে তার যুক্তিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। তার এই ভাবনার পেছনে ইসলামের প্রভাব ছিল যথেষ্ট।

একেশ্বরবাদী ধারণাটা আসলে রামমোহনের সময় নতুন কিছু ছিলো না । রামমোহনের জন্মের অনেক আগেই ভারতবর্ষে নিরাকার একেশ্বরবাদী তত্ত্ব নিয়ে আসেন মুসলমানেরা— সেই সপ্তম শতাব্দীতে মুহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে । তারপর অষ্টম শতাব্দী থেকে উপমহাদেশে খুঁটি গাড়া মুসলিম মরমী সাধকেরা একেশ্বরবাদের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন । রামমোহন নিজেও পাটনায় থাকাকালে ইসলামের উদারনৈতিক মোতাজিলা সম্প্রদায়ের যুক্তিবাদী চিন্তায় প্রভাবিত হন । এ প্রেক্ষিতেই রামমোহন ও তাঁর অনুসারীরারা ১৮২৮ সালের ২০শে আগস্ট গঠন করলেন ‘ব্রাহ্মসভা’ । এই ব্রাহ্মসভার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছিল রামমোহনের ধর্মীয় চিন্তাভাবনার সর্বোচ্চ রূপ । তারপরও বলা যায়, ব্রাহ্মসভার উদ্দেশ্য মোটেও সফল হয়নি । রামমোহনের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ তার কিছু গুণমুগ্ধ কিছু অনুগামী (যারা ছিলেন মূলত নব্য ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি এবং রাজা-মহারাজা ও জমিদার) ছাড়া সাধারণদের মধ্যে কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি । ১৮৩৩ সালে রামমোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজের গতি ঝিমিয়ে পড়ে। পরবর্তীতে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজকে ব্রাহ্মধর্মে পরিণত করে কিছুটা প্রাণের জোয়ার আনতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত দেবেন্দ্রনাথের এই ‘ব্রাহ্মধর্ম’ হিন্দু ধর্মের বিশাল পরিসরে বিলীন হয়ে যায় ।

তবে রামমোহনের সবচাইতে বড় অবদান হল সতীদাহের মত একটা অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো । তিনি শাস্ত্র ঘেটে সতীদাহের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেন এবং সাথে সাথে মানুষের স্বাভাবিক বিবেক ও বিচারশক্তিকে এই প্রথার বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। প্রথম দিকে ইংরেজরা সতীদাহের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে সাহসী না হলেও, রাজা রামমোহন সতীদাহ বন্ধ করার জন্য প্রবল জনমত গড়ে তুললে ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথাকে বিস্তারেও রামমোহনের ভূমিকা ছিল । তিনি নিজ উদ্যোগে এ্যাংলো হিন্দু বিদ্যালয়, বেদান্ত মহাবিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং সেখানকার পাঠ্যসূচিতে বলবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা আর পাশ্চাত্য দর্শন অন্তর্ভুক্ত করেন ।

সমাজ সংস্কারে রামমোহনের ব্যাপক অবদান থাকা সত্ত্বেও জমিদারী প্রথার সাথে রামমোহনের সরাসরি সম্পর্ক থাকার ফলে তিনি সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি। এ ধরনের সীমাবদ্ধতা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) ছিল না । জমিদারী প্রথার সাথে সরাসরি সম্পর্ক না থাকায় তিনি বহুক্ষেত্রেই বলিষ্ঠভাবে সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পেরেছিলেন । ধর্ম আর ঈশ্বরের প্রতি তার আস্থা ছিল না বলেই মনে হয়। তিনি পুরাতন ও প্রথাগত শাস্ত্রানুগত্যকে সরাসরি মিথ্যা বলেছেন । সামন্ততান্ত্রিক ক্ষয়িষ্ণু আচার আর সাংস্কৃতিক আচার আচরণের বিরুদ্ধে তিনি রামমোহনের তুলনায় অনেক বেশি নিঃশঙ্কচিত্ত ছিলেন । সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে অব্রাহ্মণ শিক্ষার্থীদের জন্য কলেজের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি । শিক্ষা প্রসারের জন্য নিজেও অনেকগুলো বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন । মেয়েদের উচ্চশিক্ষার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন তিনি । মেয়েদের বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যেমনি সরব ছিলেন তিনি, পুরুষদের বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও ছিলেন প্রতিবাদমুখর । তবে সবকিছু ছাপিয়ে বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বড় সাফল্য হল হিন্দুদের বিধাবিবাহের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা । আর এ ধরনের সনাতন প্রথা ভাঙতে তিনিও রামমোহনের মতোই ধর্মগ্রন্থ ঘেটে অনেক যুক্তি উদ্ধৃত করেছিলেন, এবং গোড়া ধর্মাবলম্বীরা অনেকেই তার ক্ষুরধার যুক্তির আক্রমণে পিছু হটেছিলেন । ফলে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ ও বিধবাবিবাহ আইনসম্মত হয় ।

রামমোহন আর বিদ্যাসাগরের চেয়ে চিন্তাচেতনায় ঢের বেশি ‘র‍্যাডিক্যাল’ ছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১)। কিশোর বয়সেই ফরাসী বিপ-বের সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বের বাণী আর মুক্তবুদ্ধি চর্চার বাঁধভাঙা জোয়ার তাকে আলোড়িত করেছিলো । শিক্ষক ড্রামন্ডের ‘সেক্যুলার’ চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি । ‘ভিনদেশী’ হলেও ডিরোজিও ভারতবর্ষকে নিজেরদেশ বলেই মনে করতেন । ১৮২৬ সালে হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ডিরোজিও। প্রচলিত পুঁথিগত শিক্ষার বাইরে তিনি ছাত্রদের যুক্তিনিষ্ঠা ও বস্তুবাদী চিন্তাধারায় আগ্রহী করে তুললেন। তাঁর যুক্তিবাদী মনমানসিকতা ও মুক্তমন ছাত্রদের চুম্বকের মত আকর্ষণ করেছিল । শ্রেণীকক্ষের শিক্ষাদান যথেষ্ট মনে না হওয়াতে তিনি ছাত্রদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠকে মিলিত হতেন। এই বৈঠকের একটা গালভরা নামও ছিল – “অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ । সত্যবাদিতা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব, দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়ে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভায় আলোচনা হত, অনেকটা আমাদের ‘মুক্তমনা’ ফোরামের মতই । তিনি ছাত্রদের এ ধরনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে তাদের স্বাধীনভাবে তর্ক-বিতর্ক করার উপযোগী করে গড়ে তুলতেন ।

খুব তাড়াতাড়িই ডিরোজিওর প্রভাব ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । কলেজের সেরা ছাত্ররা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল । মূলত ডিরোজিওর নেতৃত্বেই সে সময় কলকাতায় ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত সেই সব ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’রা অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল । এরা অস্বীকার করল উপনয়ন, সান্ধ্য আহ্নিক ছাড়ল, প্রাচীন প্রথাকে অমান্য করল, নারী শিক্ষার দাবি তুলল । তারা প্রতিদিনের আহ্নিকে মন্ত্রোচ্চারণের বদলে ইলিয়ড থেকে আবৃত্তি করতে লাগল; তুলে আনতে লাগলো ভয়ঙ্কর সব স্পর্শাতীত বিষয় সতীদাহ, কুলীন ও বাল্যবিবাহ, জাতিভেদ সব প্রাচীন প্রথার বিরুদ্ধেই তারা সোচ্চার হয়েছিল ।

নিজেদের সংস্কারমুক্ত প্রমাণ করতে এমনকি গোমাংস খাওয়া এবং মদ্যপান করাও তারা শুরু করল, প্রকাশ্যে। ভারতীয় অন্ধ বিশ্বাসের অচলায়তনে সে সময় এক নবমন্ত্রের ঝড় তুলেছিলেন এই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামের ডিরোজিওর এই ভাবশিষ্যরা । রামমোহন যা পারেননি, ডিরোজিও তাই করে দেখাতে চাইলেন । রামমোহন পুরনো প্রথাকে ভাঙার লড়াই শুরু করেছিলেন ঠিকই কিন্তু মূল উৎসে গিয়ে সেই গোঁড়াই রয়ে গিয়েছিলেন । পারেননি তিনি পুরোপুরি কুসংস্কার মুক্ত হতে, পারেননি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ী হতে । ধর্ম সংস্কার করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেই আরেকটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন । প্রবীর ঘোষ তার ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ (তৃতীয় খণ্ড) গ্রন্থে তাই বলেনঃ

‘ধর্মান্ধতার ঊর্ণজাল কে ছিন্ন করেছিলেন? রামমোহন রায়? রামমোহন রায় তো স্বয়ং ধর্মমতের স্রষ্টা। ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করে নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । মন্দির ও দেবমন্দির ভাঙে কালের করাল গ্রাসে । অথবা নিশ্চিহ্ন হয় কেউ নিশ্চিহ্ন করে দিলে । নিরাকার ঈশ্বরকে ওভাবে মুছে ফেলা যায় না। এমনই এক ঈশ্বর চিন্তা জনমানসে প্রথিত করতে চেয়েছিলেন রামমোহন, যেখানে ঈশ্বর থাকবেন অনেক নিরাপদে ।’

‘ইয়ং বেঙ্গল’রা বরং এদিক দিয়ে অনেক অগ্রসর ছিল, তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে বসলো, ফলে আনুষঙ্গিক ছোটখাটো কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা তাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল । তারা ধর্মকে আশ্রয় না করেই মুক্তচিন্তাকে বিকশিত করতে চেয়েছিলেন । তারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পাশ্চাত্যের লক, বেকন প্রমুখ দার্শনিকদের যুক্তিবাদী চিন্তা দিয়ে ।

সমাজের কুসংস্কার ও কুপ্রথা খণ্ডনে রামমোহন যেখানে বেদ পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রকে ব্যবহার করেছিলেন, সেখানে ডিরোজিও নিখাঁদ নির্ভেজাল যুক্তিবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন । তিনি শাস্ত্রনির্ভর সমাজকে পাল্টাতে গিয়ে যে জ্ঞান এবং যুক্তির আলো জ্বালিয়েছিলেন, তাতে প্রমাদ গুণলেন সমাজের কর্তাব্যক্তিরা। তারা উঠে পড়ে লাগলেন এই ‘নাস্তিক’কে সমাজের কচি কচি ছেলেগুলোর ‘মাথা খাওয়া’ থেকে বিরত করতে। ডিরোজিওর অপরাধ তিনি ছেলেদের ‘অবান্তর প্রশ্ন’ করতে শেখাচ্ছেন । এ ধরনের অভিযোগ সক্রেটিসের বিরুদ্ধেও উঠেছিলো । সেই যে এথেন্সের যুবকদের প্রথাবিরোধী চিন্তায় প্রভাবিত করে মাথা খাওয়ার অভিযোগ । পরিণতিতে সক্রেটিস তুলে নিয়েছিলেন হেমলকের পাত্র। ডিরোজিওর পরিণতিও অনেকটা সেরকমই । ১৮৩১ সালে হিন্দু কলেজ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভার পরে ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে পদত্যাগ করতে বলা হয় । তিনি পদত্যাগ করলেন । কলেজ কমিটির সদস্য ডা. এইচ উইলসনকে তিনি চিঠিতে লিখলেনঃ

‘…তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব সম্পর্কে মুক্তমন নিয়ে আলোচনা যদি অপরাধ হয় তবে নিজেকে অপরাধী হিসেবে স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই; কিন্তু একথা স্বীকার করতে আমি ভীত অথবা লজ্জিত নই যে দার্শনিকদের এই বিষয়ক সন্দেহের সাথে আমি পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, এবং তা সমাধানের কথাও বলেছি ।…

এই শিক্ষার ফলে ছাত্রদের ধর্মবিষয়ক গোঁড়ামির মূল যদি নড়ে থাকে তবে আমি কি অপরাধী?… ধর্ম সম্বন্ধে স্বাধীন চিন্তা করলে নাস্তিক ও নরাধম আখ্যা পেতে হয়, একথা আমি জানি ।’

ডিরোজিও যে কেবল দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে বিপ-বী ছিলেন তা নয়, তার রাজনৈতিক দর্শনও ছিল প্রগতিশীল । ১৮২৭ সালে ডিরোজিও দাসত্বের বিরুদ্ধে মুক্তির জয়গান গেয়ে ‘ক্রীতদাসের মুক্তি’ রচনা করেন । জমিদারদের সঙ্গে কিংবা জমিদার সভার সঙ্গে ডিরোজিও পারতপক্ষে কোন সম্পর্ক রাখতেন না, বরং জমিদারদের নানা রকম শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতেন । নীলচাষীদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমালোচনা করে তিনি বলেনঃ

‘Whatever tendency the permanent settlement of Lord Cornwallis might have to spirited and large improvement of the country, it is certain, that but a small part of his golden prospects has yet been realized. Wealth and but a small part of his golden prospects has yet been realized. Wealth and happiness were the sum of those prospects, but little of these is visible anywhere.’

ইংরেজরা উপনিবেশ স্থাপন করে ‘জংলি ভারতবাসী’কে একেবারে উদ্ধার করে দিয়েছেন বলে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ আর তাদের মোসায়েবের দল যেখানে নগ্নভাবে উপনিবেশবাদের সাফাই গেয়েছেন, সেখানে ডিরোজিও শুনিয়েছেন অন্যকথা, অন্যগান । তিনি ‘ক্যালকাটা মানথলি জার্নালে লেখেনঃ

‘ইংরেজরা ভারতবর্ষ জয় করার আগে এদেশ বর্বরতার স্তরে ছিল, এ কথা মনে করবার অধিকার ইংরেজদের কে দিয়েছে? ভারত ছিল একটি শিল্পসমৃদ্ধ, উন্নত ও সভ্য দেশ এবং আমেরিকার দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে যে, ইংরেজদের পরাধীনতার বন্ধন ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলে, তবেই ভারতবাসীর দুর্গতি মোচন সম্ভব ।’

কলেজ থেকে পদত্যাগের বছরেই ডিরোজিওর মাত্র ২২ বছর বয়সে অকাল প্রয়াণ ঘটে । শ্রীপল-ব সেনগুপ্ত লিখেছেন ‘দৈত্যাকার মিথ্যার তাণ্ডব নৃত্যের দাপটে একজন তরুণ শিক্ষকের জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল । তার পরও প্রায় এক যুগ ধরে তার শিষ্যদের মধ্যে ডিরোজিওর প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিলো ।

সমাজ বদলের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রামমোহন, বিদ্যাসাগর কিংবা ইয়ং বেঙ্গলদের যথেষ্ট অবদান থাকলেও সে সময়টাকে ইউরোপীয় রেঁনেসার আদলে সত্যই “বাঙলার রেঁনেসা’ বলা যায় কি না এ প্রশ্ন থেকেই যায় । ইউরোপের রেঁনেসা ছিল সামন্ত প্রথার বিরুদ্ধে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আর্থ সামাজিক ও সমাজ সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাল্টানোর আন্দোলন । এই আন্দোলন শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিলো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে । এ ব্যাপারটা কিন্তু বাঙলার রেঁনেসার ক্ষেত্রে সেভাবে প্রযোজ্য নয় । এক্ষেত্রে ‘সমাজ পরিবর্তনের’ সুফল ঘরে তুলেছিলো কেবল বঙ্গীয় জমিদার সম্প্রদায়, শহরের বণিক সম্প্রদায় এবং শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় । বাংলার রেঁনেসা আন্দোলনের প্রাণপুরুষদের অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজদের সহযোগী অথবা ইংরেজ সহযোগীদের সন্তান । রেঁনেসার নায়কদের এই শ্রেণীগত অবস্থানের কারণে তাদের আন্দোলন ব্যাপক গণজাগরণে রূপ নিতে পারেনি । রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ চাকরি বা ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকলেও অর্থনৈতিকভাবে জমিদারির উপর নির্ভরশীল ছিলেন । প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ব্রিটিশদের অনুগ্রহ প্রাপ্ত হওয়ায় রেঁনেসার পথিকৃতেরা ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও লুণ্ঠনকে দেখতে পাননি (এদের মধ্যে ডিরোজিওই ছিলেন ব্যতিক্রম)। বরং ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এসে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন । রামমোহন তো খোলাখুলি বলেছেন : ‘ভারতবাসীর পরম সৌভাগ্য যে ভগবৎকৃপায় তাহারা ইংরেজদের রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে ।’ যে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, সেই নীলকরদের সাফাই গেয়েছিলেন রামমোহন। তার মতে, ‘নীলকর সাহেবেরা এ দেশে অকল্যাণের চেয়ে কল্যাণই করেছেন বেশি। লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে লংঘন করা উচিত নয় ।’ বঙ্কিমচন্দ্রও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সাফাই গেয়ে বলেছেন, এটি বন্ধ করলে ‘ঘোর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবে ।’ তিনি জমিদার দর্পণ নাটকের প্রচার বন্ধ করতে বলেছিলেন, ‘নীল দর্পণ’ নাটকের তো সরাসরি বিরোধিতাই করেছেন। রামমোহন ব্যক্তিগত জীবন কাটিয়েছেন আর দশটি জমিদারদের মতই ভোগ-বিলাসে। সোফিয়া ডবসন কলেটের ‘Life and letters of Raja Rammohun Roy’ থেকে জানা যায় এমনকি রামমোহন ব্যক্তিজীবনে জাতপাত মানতেন, অহিন্দু বা অন্য জাতের সাথে কখনও একসাথে আহার করতেন না । হিন্দুদের প্রচলিত সামাজিক আচরণগুলো পরিবর্তনের বিপক্ষে ছিলেন রামমোহন । তার কাঁধের উপবীত তিনি মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত বহাল রেখেছিলেন । আর সাম্রাজ্যবাদ তোষণ তো ছিলই । আবদুল মতিন খান ‘ব্রাহ্মধর্ম : প্রকরণ ও প্রেক্ষাপট প্রবন্ধে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে রামমোহনের যে ‘ফতোয়া’গুলো লিপিবদ্ধ করেছেন তা নিম্নরূপঃ

১. ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্ব ও অভিভাকত্ব মেনে নাও । তার মত হবার চেষ্টা কর ।

২. ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ঈশ্বরের অফুরন্ত করুণার ধারা।

৩. ইংরেজি ও ইংরেজিয়ানা ভাল করে রপ্ত কর । ইংরেজদের অধীনে একটি চাকরি লাভের আপ্রাণ চেষ্টা কর ।

৪. স্বাধীন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী হবার কখনো চেষ্টা করো না। ইংরেজদের দালালি করলেই অভীষ্ঠ সিদ্ধ হবে ।

৫. ইংরেজকে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসে উৎসাহ যোগাও । তাহলে ব্রিটিশদের উন্নত ও উদার সাহচর্যে থেকে দেশকে স্বর্গ বানাতে পারবে ।

৬. সভা সমিতি গড়ে তোল এবং সেগুলোর মাধ্যমে যখন তখন ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য দেখাও । মনে রেখ ইংরেজদের খুশিতে তোমার মঙ্গল ।

৭. সংবাদপত্র প্রকাশ কর, তাতে ব্রিটিশ শাসনের সুফল তুল ধর ।

৮. ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে ও বিদ্বেষভাব পোষণ করে তাদের কঠোর ভাষায় নিন্দা কর । তাদের নির্মূলে ইংরেজদের সর্বাত্মক সহযোগিতা কর ।

৯. ইংলন্ড কাঁচামাল রপ্তানি ও সেখান থেকে তৈরি সামগ্রী আমদানির অবাধ বাণিজ্য সমর্থন কর । কারণ তাতে ভারতের সার্বিক কল্যাণ নিহিত ।

১০. রাজনৈতিক সুবিধাধি লাভ ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ধর্মাচরণে পরিবর্তন সাধন কর । এটা করলেই ইংরেজদের অনুমোদন পাবে ।

বিদ্যাসাগর ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে নির্মোহ হলেও সামাজিক বৈষম্য ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারেননি। তিনি নিজের মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে কোন মুসলমান ছাত্রকে ভর্তি করাতে পারেননি । জাতিভেদের বিরুদ্ধে তিনি কোন আন্দোলন পরিচালনা করেননি । তিনি শিক্ষাকে উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে ছিলেন । তিনি ‘Downward filtration theory’ নামের আদ্ভুতুড়ে তত্ত্বের উপর আস্থা রেখে ভাবতেন, সমাজের উপরের স্তরে বিদ্যা ঢেলে দিলে তা এমনিতেই চুইয়ে নীচের স্তরে নেমে আসবে ।

বাংলার রেঁনেসার কর্ণধারদের সমস্যা ছিল এই যে, তারা প্রগতিকে ব্রিটিশ প্রগতির সমার্থক হিসেবে গণ্য করেছেন এবং ব্রিটিশরা যে আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে তা বলতে বরাবরই সজ্ঞানে এড়িয়ে গেছেন । একটি পরাধীন দেশে ঔপনিবেশিক প্রভুর বিরোধিতা করাটাই কোন আন্দোলনের পক্ষে বা ব্যক্তির পক্ষে প্রগতিশীল হিসেবে চিহ্নিত করার মাপকাঠি হওয়া উচিত । ঔপনিবেশিক প্রভুর দালালি করাটা কখনই প্রগতিশীল মুক্তমনাদের কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে না ।

বাঙালি রেঁনেসার আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা ছিল, রেঁনেসার সাথে সম্পর্কিত বেশিরভাগ সমাজ সংস্কারই তদানীন্তন মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে ছিল অর্থহীন । ইসলামে সতীদাহ কখনও ছিল না। মুসলিম বিধবারা সব সময়ই বিয়ে করতে পারে- ধর্মীয় কোন বাধা কখন ছিল না । ক’নের পূর্ণ সম্মতিতে বিয়ে করতে হয় বলে এতে একটা চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপার থাকে। অতএব মুসলিম সমাজে বাল্যবিবাহ থাকতে পারে না (বাস্তবে যেটুকু আছে তা বিভিন্ন আর্থ সামাজিক কারণে ।) মুসলমানরা সব সময়ই গো-মাংস খেতেন, ফলে ইয়ং বেঙ্গলদের এত ঘটা করে গো-মাংস খাওয়ার মধ্যেও তারা কোন অভিনবত্ব খুঁজে পাননি । অর্থাৎ যে কয়টি বিষয়কে ঘিরে বাংলায় রেঁনেসাস বা সমাজ সংস্কারের ঝোঁক দেখা গেছে, তার প্রায় সবক’টি সংস্কারেরই ঊর্ধ্বে ছিল বাংলার মুসলিম সমাজ । কিন্তু তাতে করে কি বাংলার মুসলিম সমাজের কোন অগ্রগতি ঘটেছে? শোষণমুক্তি ঘটেছে? না ঘটেনি । বাংলার মুসলিমদের সংখ্যাগুরু অংশ বরাবরই ছিলেন হিন্দু সংখ্যাগুরু অংশের চেয়ে পিছিয়ে পড়া, অনেক অনেক বেশি শোষিত ।

 

৩.

১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আত্মপ্রকাশ করে ‘ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ । আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী আনোয়ারুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবদুল কাদির, আবুল ফজল প্রমুখ তরুণ লেখকেরা ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজকে ঘিরে যে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ গড়ে তুলেছিলেন, তা চিন্তার জগতে আলোড়ন তুলেছিল । নামে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ হলেও কেবল ‘ইসলামী সাহিত্য’ সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য ছিলো না । বরং মুসলিমদের পশ্চাৎপদতা ও কূপমণ্ডুককতাকে আঘাত করাই ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য । তাঁদের লেখার মধ্যে দিয়ে মুক্ত চিন্তার যে স্ফুরণ ঘটেছিল তা সত্যই অভিনব। প্রচলিত ধর্মমতের সাথে তাদের লেখালেখি কথাবার্তার মিল না থাকায় তারা বারবারই গোঁড়াপন্থীদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন । মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক মুখপত্র ‘শিখা’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে । ‘শিখা’র মাত্র পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল । কিন্তু স্বল্পকালীন আত্মপ্রকাশের মধ্যে দিয়েই ‘শিখা’ নামটি অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল । এই পত্রিকাটি হয়ে -উঠেছিল পূর্ববাংলার শাস্ত্র, প্রথা, আনুগত্য আর অন্ধকার ভেদ করা এক উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল চিন্তার নবজাগরণ। “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’– এ ছিলো শিখার স্লোগান। মোতাজিলা সম্প্রদায়ের যুক্তিবাদ আর ডিরোজিও-রামমোহনের উদারনৈতিক চিন্তা দিয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন মুসলিম সাহিত্যসমাজের লেখকেরা। শিখার লেখকেরা চিন্তা চেতনায় কত অগ্রসর ছিলেন, তা দু’একটি নমুনা উলে-খ করলেই বোঝা যাবে । আমি আবুল হুসেনের ‘মুসলিম কালচার ও উহার দার্শনিক ভিত্তি’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ

‘কাজের পেছনে চিন্তা চাই । … চিন্তাই Philosophy. Religion (ধর্ম) বলছেঃ

‘চোখ বুজে মেনে চল’ । Philosophy (দর্শন) বলছে ‘চোখ খুলে চেয়ে দেখ ।’ একটার বাহন হল ভক্তি, অন্যটার বাহন হল জ্ঞান ।’

কাজী আবদুল ওদুদের এমনি একটি লেখা থেকে উদাহরণ টানা যাকঃ

বিজ্ঞানই হচ্ছে চিন্তার পরশমনি; এর অভাবে ব্রহ্মবিদ্যাও যাদু-বিদ্যায় পরিণত হতে পারে । একালে ধর্ম বলতে জ্ঞান ও মনুষ্যত্ব সাধনই মুখ্যভাবে বুঝতে হবে-ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের দিক তার তুলনায় গৌণ ।’

এ ধরনের অসংখ্য উদ্ধৃতি হাজির করে দেখানো যায় যে, সে সময়কার মুসলিম সাহিত্য সমাজের লেখকরা যথেষ্ট পরিমাণেই প্রথাবিরোধী, শাস্ত্রবিরোধী ও যুক্তিবাদী মননের পরিচয় দিয়েছেন। আজ থেকে সাত-আট দশক আগেকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে, লেখকদের সাহসিকতার নমুনা দেখে সত্যই অবাক হতে হয় । আজকের দিনেও কি অমন সাহসিকতার সাথে বাংলাদেশে কিছু বলা সম্ভব? একবার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মুসলিম সাহিত্য সমাজের একটি বার্ষিক সভায় যোগ দিয়ে মন্তব্য করেছিলেনঃ

“বহুকাল পরে কাল রাত্রে আমার ঘুম হয়েছে। এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলুম যে, মৌঃ আনোয়ারুল কাদীর-প্রমুখ কতকগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আমি চাই না ৷ ‘

স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্ত স্বঘোষিত কাফেরদের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন নির্বিঘ্ন ছিল না । এতো স্বাভাবিকই; ইতিহাস খুঁড়লে দেখা যায়, যখনই সমাজে একদল প্রথাবিরোধী মানুষ সাহসিকতার সাথে সত্য উচ্চারণ করেছে, শাসক শ্রেণীর তল্পিবাহক আর ধর্মান্ধরা তাদের উপর হা-রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের ক্ষেত্রেও তাই হল । কাজী আবদুল ওদুদের ‘সম্মোহিত মুসলমান’ আর আবুল হুসেনের ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’ প্রবন্ধ দু’টি প্রকাশিত হলে মুসলিম সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । শিখার লেখকদের শক্তিশালী লেখনী থামানোর জন্য নানা ধরনের ভয় ভীতি আর পেছনে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। ১৯২৯ সালের ৮ ডিসেম্বর আহসান মঞ্জিলে ‘ইসলামিয়া আঞ্জুমান’ অফিসে এক বিচার সভার আয়োজন করে আবুল হুসেনকে এক স্বীকারোক্তিপত্র লিখতে বাধ্য করা হয়, যাতে বলা হয়- ‘ঐ প্রবন্ধের ভাষা দ্বারা মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের মনে যে আঘাত দিয়াছি সে জন্য আমি অপরাধী ।’ আধুনিক যুগের ইনকুইজিশনের বিচার!

ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের কাছে মুক্তমনা আবুল হুসেনের এই অসহায় আত্মসমৰ্পণ কি গ্যালিলিওর কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় না, যিনি চার্চের চাপে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁর নিজের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ভুল, আসলে সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে! গ্যালিলিওর মতই আত্মগ্লানিতে ভোগা আবুল হুসেন এ ধরনের স্বীকারোক্তি দিয়ে এতই ব্যথিত হলেন যে, সাহিত্য সমাজের সম্পাদকের পদ তো বটেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমালেন ।

বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) ছিলেন এ দেশে নারী জাগরণের পথিকৃৎ । রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল এক মুসলিম পরিবারে জন্ম । ১৯০২ সাল থেকে মূলত রোকেয়ার সাহিত্যচর্চা শুরু । বিভিন্ন প্রবন্ধ ও উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তিনি কখনো সরাসরি, কখনোবা ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাধ্যমে সমাজের গোপন ক্ষতগুলোকে উন্মোচন করেছেন । তৎকালীন সময়ে বেগম রোকেয়া সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে যে মুক্তচিন্তা ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা সত্যই অভাবনীয় । রোকেয়া ‘আমাদের অবনতি’ প্রবন্ধে বলেনঃ

‘যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে । … আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি।… আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন । এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে ৷ ‘

রোকেয়ার লেখা আমাদের মনে করিয়ে দেয় পাশ্চাত্যের এলিজাবেথ স্ট্যান্টনকে যিনি পাঁজরের হার থেকে নারী জন্মের উপাখ্যানকে স্রেফ রূপকথা বলে ঘোষণা করে অবশেষে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন পুরো বাইবেলটিকেই । কারণ পুরো বাইবেলটিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে ইভের পাপের উপর । স্ট্যান্টন এবং রোকেয়া দু’জনের বক্তব্যেই প্রথাবাদীরা চিৎকার করে ওঠে যার যার মত। রক্ষণশীলদের উন্মত্ততায় রোকেয়া শেষ পর্যন্ত ধর্মবিদ্বেষী ‘আপত্তিকর অংশ’গুলো (পাঁচটি অনুচ্ছেদ) বাদ দিতে বাধ্য হন । ওই বাদ দেয়া পাঁচটি অনুচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে রোকেয়ার যুক্তিবাদী মুক্তমন দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ পেয়েছিল । ড. হুমায়ুন আজাদের মতে, ওই আপত্তিকর নিষিদ্ধ অংশটুকুই রোকেয়ার শ্রেষ্ঠ রচনা ।

রোকেয়া ধর্মকে অস্বীকার করতে পারেননি । অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো আপোষ করেছেন । অনেক সময় অপ্রিয় সত্য বলে ফেলেছেন, কিন্তু তাকে পশ্চাদপসারণও করতে হয়েছে । রোকেয়া পর্দা প্রথার সরাসরি বিরোধিতা করেননি, বরং প্রকারান্ত রে সমর্থনই করেছেনঃ

‘প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠনসহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই । স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না ।’

যে যুগে নারীর ঘরের বাইরে আসাটাই ছিল কঠিন, সে যুগে বোরকায় আবৃত করে হলেও অন্তত বাইরে বের করে আনাটা জরুরি মনে করেছিলেন। রোকেয়া চাইছিলেন নারী বোরকা পরে হলেও বাইরে আসুক, সামাজিক কাজকর্মে অংশ নিক, শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হোক, তাহলে হয়ত অপ্রয়োজনীয় পর্দার বাহুল্য এমনিতেই ঘুঁচে যাবে । মুসলিম সাহিত্য সমাজের বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন, আর বেগম রোকেয়ার নারীবাদেরই সার্থক উত্তরসূরী তসলিমা নাসরিন, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদের মতো মুক্তমনারা । তারা তিনজনই স্বঘোষিত নিরীশ্বরবাদী । তিন জনের কথা একসাথে বলা হলেও চিন্তা চেতনা আর কাজে তিনজনই ভিন্নধর্মী, কিন্তু আবার স্বমহিমায় উজ্জ্বল । এ তিনজনই স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন নিজেদের মত করে। একজনকে মৌলবাদীদের আক্রোশে দেশত্যাগ করতে হয়েছে, আরেকজন ‘মুরতাদ’ উপাধিবরণ করে নিয়েই মারা গেছেন, আর শেষোক্তজন তো সরাসরি ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাতে ।

যে মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর প্রগতিশীলতাকে এতদিন কেবল ‘শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর’ কর্মকাণ্ড বলে মনে করা হত, সে মিথটির গালে সজোরে আঘাত করেছেন এক গ্রাম্য কৃষক- আরজ আলী মাতুব্বর । যে মানুষটির দু’হাতে কড়া পড়েছিল লাঙ্গলের হাল ধরতে ধরতে, যার সারা দেহে ছিল পলিমাটির সেঁদো গন্ধ, কে জানত তিনি একদিন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের কর্ণধারদের অহমিকার ফানুস ফুটো করে দেবেন, হয়ে উঠবেন সারা বাংলার সত্য সন্ধানীদের আরাধ্য ? আরজ আলীর দর্শনের ভিত্তি রামমোহন, ডিরোজিও কিংবা মুসলিম সাহিত্য সমাজের সদস্যদের মত উপর তলা থেকে নেমে আসেনি, বরং তা উঠে এসেছিল লামচরি গ্রামের মত নীচু (আক্ষরিক অর্থেই) জায়গা থেকে । মুক্তবুদ্ধির চর্চা বিজ্ঞানমনস্কতা যাদের কাছে কেবল ‘প্রগতিশীলতার বিলাস’, সেই সব এলিট শ্রেণীর মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীদের সাথে আরজ আলী মাতুব্বরের পার্থক্যটি অতি স্পষ্ট । গ্রামীণ মেহনতি কৃষক আরজ আলীর মুক্তবুদ্ধিচর্চা নাগরিক মধ্যবিত্তদের মত কেবল মানসিক ব্যায়াম ছিল না । বুদ্ধিবিলাসের আত্মরতিতে মগ্ন থেকে ‘আঁতেল’ সাজার মানসিকতাকে তিনি কখনও প্রশ্রয় দেননি । সামাজিক দায়িত্ববোধই তাকে মুক্তবুদ্ধি চর্চায় প্ররোচিত করেছে । তার মা মারা গিয়েছিল । মার শেষ স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার চেষ্টায় এক ক্যামেরাম্যান ডেকে ছবি তুলেছিলেন তিনি মায়ের মৃতদেহের। এ ‘নাফরমানির’ অপরাধে গ্রাম্য মোল-ারা আরজ আলীর মায়ের জানাজা পড়েননি । আরজ আলীর ‘জ্ঞানচক্ষু’ খুলে গেল । তিনি নামলেন সমাজ ও মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস, সঙ্কীর্ণতা আর কুসংস্কার দূর করতে । প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন প্রথাগত সমাজকে । হাত পা ছুঁড়ে অনর্থক চিৎকার করেননি, বরং শান্ত নিরাসক্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে গেছেন একের পর এক । অনেকটা সক্রেটিসের (৪৬৩-৩৯৯ খ্রীঃ পূঃ) মতই। সক্রেটিসের সাথে আরো অনেকদিকেই তার মিল ছিল । সক্রেটিস নিজেও ছিলেন শ্রমজীবী । অট্টালিকা ও ভাস্কর্যে ব্যবহারের জন্য মার্বেল পাথর কাটতেন । শক্ত পেশীতে টান পড়ত । টান পড়ত আরজ আলীর পেশীতেও— দিনের বেলা শক্ত হাতে লাঙ্গল চালিয়ে। তারপরও রাত জেগে করতেন জ্ঞান সাধনা । স্ত্রী অনুযোগ করেন ‘দিনে এত খাটেন, আবার রাত জেগে পড়াশুনা করেন । কষ্ট হয় না?’ আরজ আলী হাসতেন, ‘না কষ্ট হবে কেন!’ চাষাবাদের অর্থ জমিয়ে তৈরি করলেন পাঠাগার ৷ দশ বছরের চেষ্টায় সংগ্রহ করলেন ৯৬৬ খানা বই । কিন্তু প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পুরোটাই হারালেন । আবার আঠারো বছরের সাধনায় আস্তে আস্তে সংগ্রহ করলেন ৪০০টি বই । কিন্তু আবারো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সবকিছু হারালেন । আরজ আলী হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন, সন্তান হারানোর ব্যথায় শোকে পাথর হলেন যেন । কিন্তু তারপরও জ্ঞান সাধনা আর লাইব্রেরি গড়বার প্রচেষ্টায় কখনই বিরত হননি ।

আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশে আধুনিক যুক্তিবাদী দর্শনের পথিকৃৎ । তিনি সত্যের সন্ধান বইটিরও আদি নাম দিয়েছিলেন— ‘যুক্তিবাদ’। কোন সিদ্ধান্তকে স্বতঃসিদ্ধ না ধরে পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিবিচারের মাধ্যমে সত্যে উপনীত হওয়ার আরোহী (Inductive) পদ্ধতিকেই তিনি সঠিক মনে করেছেন । আরজ আলীর কাছে তাই প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস কিংবা সংস্কারের কোন কিছুই সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকেনি । তিনি আত্মা, স্বর্গ-নরক, ভাগ্যলিপি, ফেরেস্তা, গোর আজাব, পাথর চুম্বন, সৃষ্টিতত্ত্ব ইত্যাদি অসংখ্য ধারণাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন। সহজ সরল প্রশ্ন করেই তিনি আঘাত করেছেন অন্ধবিশ্বাসের অচলায়তনে। আরজ আলী নিজেই বলেছেনঃ

‘সত্যের সন্ধান দিয়ে আমি কুসংস্কারের ডালপালা ছেঁটে দিয়েছি । আর সৃষ্টিরহস্য দিয়ে কুসংস্কারের মূলশুদ্ধ উপড়ে ফেলেছি ।’

প্রকৃতপক্ষে আরজ আলী যা পেরেছেন, এদেশের অনেক বড় বড় ডিগ্রীধারী দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীরাও তা পারেননি । সেইসব বুদ্ধিজীবীদের একাংশ আবার আরজ আলীর রচনা নিয়েই সন্দিহান ছিলেন— এগুলো আদপেই এক ‘গ্রাম্য কৃষকের’ রচিত কিনা । ঔপন্যাসিক হাসনাত আবদুল হাই তাই সঠিকভাবেই ‘আরজ আলী মাতুব্বর শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের অহঙ্কার ও আত্মতৃপ্তিকে শক্তহাতে নাড়িয়ে দিয়েছেন ।’

 

৪.

আরজ আলী মাতুব্বরের দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০১ সালে প্রশ্ন আর তর্ক- বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টা এবং ধর্মান্ধতা আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে মুক্তমনার প্রাথমিক লড়াই সূচিত হলেও পাশাপাশি সারা পৃথিবী জুড়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত ফ্রিথিঙ্কারদের সহযোগী মানবতাবাদী সংগঠন হিসেবে কাজ করার সচেতন প্রয়াস নেয়া হয় । আসলে মানবিক দিকটি শুরু থেকেই মুক্তমনা কখনও অগ্রাহ্য করেনি । আমরা খবর পাই পাকিস্তানে ইউনুস শায়িখ নামের এক চিকিৎসক ব্লাসফেমি আইনের শিকার হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন । তাঁর অপরাধ, তিনি শ্রেণীকক্ষে লেকচার দিতে গিয়ে নাকি ছাত্রদের বলেছেন মহানবী হযরত মুহম্মদ তার নবুওত প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত মুসলিম ছিলেন না। পাকিস্তানের মত ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ম এবং ধর্মপ্রচারক সম্পর্কে সামান্য বিপরীত কথাবার্তা সহ্য করা হয় না । শাস্তি একটাই, মৃত্যুদণ্ড । ইউনুস শায়িখ বন্দি হলেন এবং যথারীতি কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন । মুক্তমনা এই ভাগ্যহত ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলো । আমরা পিটিশন আর প্রতিবাদলিপির বন্যায় পাকিস্তান সরকারের মেইলবক্স একেবারে ভর্তি করে ফেললাম । আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালো আইএইচইইউ এবং র‍্যাশনালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। আর অন্যদিকে ঢাকাতে ইউনুস শায়িখের মুক্তি এবং ব্লাসফেমি আইন বিলোপের দাবিতে ‘সেভ ড. ইউনুস শায়িখ’ ব্যানারে প-াকার্ড, পোস্টার হাতে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করলেন ড. অজয় রায়ের নেতৃত্বে অন্যান্য মুক্তমনা সদস্যরা । তারা সভা-সমিতি-সেমিনার করেছেন, রাস্তায় নেমেছেন আর বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন পাক দূতাবাসের সামনে; স্মারকলিপি দিয়েছেন পাক প্রেসিডেন্টের কাছে। মুক্তমনার শুভানুধ্যায়ী এবং হোস্ট ড. অ্যালেন লেভিন চারিদিকে নেটওয়ার্ক তৈরি করে মানবতাবাদী সংগঠনগুলোকে উদ্বুদ্ধ ও এক ছাতার নিচে নিয়ে আসলেন ৷ এমনিভাবে সারা বিশ্বব্যাপী মানবতাবাদীদের প্রবল চাপে পাকিস্তান সরকার এক সময় গোপনে ড. শায়িখকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, ড. শায়িখও সাথে সাথে দেশত্যাগ করলেন। ড. শায়িখ ক’দিন পরেই আমার সাথে যোগাযোগ করে মুক্তমনাকে তার পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন। এর পরপরই তিনি মুক্তমনায় যোগদান করেন এবং বেশ ক’বছর ধরেই মুক্তমনায় লিখছেন ।

ড. শায়িখের প্রোজেক্টটি মুক্তমনার প্রথম দিককার অন্যতম সফল প্রজেক্টগুলোর একটি। এটি সফল হওয়ায় আমাদের উৎসাহ অনেক বেড়ে যায় । আমরা ইতিমধ্যেই বহু জায়গায় পিটিশন করেছি । আমিনা লাওয়াল নামের এক মহিলাকে ‘শারিয়ার রজম’ থেকে বাঁচানোর জন্য মুক্তমনা উদ্যোগী হয়, এবং শেষ পর্যন্ত সফলও হয় । তারপর থেকে মুক্তমনা আন্তর্জাতিকভাবে নানা ধরনের পিটিশন করেছে, আবেদন করেছে, কখনও প্যালেস্টাইনে নির্বিচারে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে, কখনও গুজরাটে গণহত্যার বিচারের দাবিতে, কখনও ভারতে নদী সংযোগ প্রকল্পের বিরোধিতা করে, কখনও তথাকথিত ‘বাংলাভাই’কে গ্রেফতারের দাবিতে, কখনও বা কানসাটে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে ।

বিগত নির্বাচনের পর জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে যখন নির্বিচারে সংখ্যালঘুদের উপর নির্বিচারে অত্যাচার নিপীড়ন শুরু হল, তখন এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে শুরু করেছিল এই মুক্তমনাই । আসলে শুধুমাত্র ‘অত্যাচার’ আর ‘নিপীড়ন’ বললে বোধ হয় ভয়াবহতার মাত্রাটা বোঝা যাবে না । নির্বাচনের পরবর্তী কয়েক মাসে ঠিক কি হয়েছিল, তা বোঝা যাবে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত জন ভাইদালের ‘Rape and torture empties the villages’ (July 21, 2003) একটি প্রবন্ধ পড়ে নিলেই । প্রবন্ধটিতে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে পূর্ণিমা রানীর মত হতভাগ্যদের উপর সে সময় কিরক ভাবে গণধর্ষণের স্টিমরোলার চালানো হয়েছিলো । শুধুমাত্র পূর্ণিমা রানীই একমাত্র শিকার নন, ভাইদালের মতে নির্বাচনোত্তর তিন মাসে ডজনকে ডজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, অন্তত এক হাজার মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে আর কয়েক হাজার লোকের জমিজমা কেড়ে নেয়া হয়েছে। এ ধরনের রিপোর্ট শুধু গার্ডিয়ানে বা হিন্দুস্থান টাইমসে নয়, পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছিল ডেইলি স্টার, প্রথমআলো, সংবাদ, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজসহ দেশের সকল শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোতে । এমনকি মৌলবাদী আর সরকার সমর্থিত পত্রিকা ইনকিলাব আর সংগ্রামও একেবারে বাদ যায়নি । মুক্তমনার ঢাকা নিবাসী সদস্যরা ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ ব্যানারে দেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘু উপদ্রুত অঞ্চলে ছুটে গিয়েছেন- তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন । নাগরিক অধিকার কমিটির উদ্যোগে গঠিত হয় অধ্যাপক জিল-র রহমান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ‘গণতদন্ত কমিশন’- যা প্রকাশ করে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ শিরোনামে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত সংখ্যালঘুদের ওপর লোমহর্ষক নির্যাতন-অত্যাচারের প্রতিবেদন (২০০২, ডিসেম্বর) (http://www.mukto-mona.com/human- rights/report.htm) তখন থেকে মুক্তমনায় উপদেষ্টা সদস্য ড. অজয় রায় সংখ্যালঘু উপদ্রুত অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করছেন আর তুলে আনছেন তাদের অসহায় নির্যাতনের কাহিনী— প্রকাশ করে চলেছেন ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। তবে পর্যবেক্ষণই শুধু উদ্দেশ্য ছিলো না, সেই সাথে কর্মসূচি নেয়া হয়েছিলো যারা সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের শিকার হয়েছে তাদের আর্থিক ও মানসিকভাবে সহায়তা প্রদান করা। আমরা দৃষ্টিপাত নামের একটি সংগঠনের সাথে মিলে ভোলা জেলায় অন্নদা প্রসাদ গ্রামের শত পরিবারকে পুনর্বাসনে সহায়তা করতে সম্মত হই । সরকার পক্ষ থেকে আমাদের কাজকর্মকে ভাল চোখে দেখা হল না । বক্তব্য দেয়া হল এই বলে যে দেশের বাইরে এক ‘বাংলাদেশ বিরোধী কুচক্রী মহল’ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বেশকিছু জ্বালাময়ী ভাষণও দিলেন । রটিয়ে দেয়া হল যারা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে তারা হয় ভারতের ‘র’ এর এজেন্ট, নয়ত ইহুদীদের ‘মোসাদ’র আর না হয় আমেরিকার সিআইএর! আমি সে সময় মুক্তমনায় ‘যুক্তির আলোয় দেশের ভাবমূর্তি এবং দেশপ্রেম’ নামের একটি প্রবন্ধ লিখি, বাংলায়। সে প্রবন্ধে আমি তুলে ধরেছিলাম দেশপ্রেমের যৌক্তিক সংজ্ঞা । বলেছিলাম, দেশ মানে দেশের মাটি নয়, দেশপ্রেম মানে কখনই দেশের মাটির প্রতি বা প্রাণহীন নদীনালা আর পাহাড়- পর্বতের জন্য ভালবাসা হতে পারে না। দেশপ্রেম মানে হওয়া উচিত দেশের মানুষের প্রতি প্রেম; লাঞ্ছিত, বঞ্চিত অবহেলিত গণমানুষের প্রতি ভালবাসা । রাষ্ট্রের একটি প্রধানতম উপাদান হল জনসমষ্টি । এই জনসমষ্টিকে বাদ দিয়ে শুধু কতকগুলো প্রাণহীন নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত আর মাটির প্রতি ভালবাসা সৃষ্টিকে আর যাই বলা হোক, ‘দেশপ্রেম’ বলে অভিহিত করার কোন যৌক্তিকতা নেই । উদ্ধৃতি হাজির করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের, আইনস্টাইনের আর হাল আমলে যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষের । দেখিয়েছিলাম প্যাট্রিওটিজমও শেষ পর্যন্ত কিন্তু একটা ডগমাই । শুধু আমি নই, মুক্তমনার অন্যান্য সদস্যরাও এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন । দেশপ্রেম নিয়ে মুক্তমনাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সে সময় সচেতন মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলেন, কোন সরকারের অন্ধ আনুগত্যই দেশপ্রেম নয় । দেশে অরাজকতা, হত্যা নিপীড়নের কাহিনী যে কোন মূল্যে কার্পেটের নিচে পুরে রেখে দেশকে আকাশে তুলে রাখার নামই দেশপ্রেম নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলাটাও দেশপ্রেমের অংশ । সংকীর্ণ দেশপ্রেমের সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তিবাদী দৃষ্টি দিয়ে ‘দেশের ভাবমূর্তি’ দেখবার এই মানসিকতার উত্তরণ একদিনে হয়নি । এর কৃতিত্ত্ব মুক্তমনার দাবি করতেই পারে ।

মুক্তমনার সবচাইতে বড় অবদান সম্ভবত ইন্টারনেটে (এবং পরবর্তীতে প্রিন্টেড মিডিয়ায়) বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার প্রসার । আমার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ সে উদ্দেশ্যেই লেখা । বন্যা আহমেদের লেখা সাম্প্রতিক বিবর্তনের সিরিজটির উদ্দেশ্যও একই । প্রায় একই উদ্দেশ্য নিয়ে অবিরত লিখছেন অপার্থিব, অনন্ত, ফরিদ আহমেদ, জাহেদ আহমেদ, জাফর উল-াহ, অজয় রায়, বিপ-ব পাল এবং আরো অনেকেই । এই ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ ব্যাপারটি আমাদের কাছে সবসময়ই ভিন্ন অর্থ বহন করে । ‘বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার’ বলতে আমরা এটি বোঝাই না যে গ্রামে গঞ্জে বিদ্যুৎ পৌঁছিয়ে দেয়া; কিংবা উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করা। ওগুলোর প্রয়োজন আছে কিন্তু তা করার জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারই আছেন । আমরা বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার বলতে বোঝাই কুসংস্কারমুক্ত, প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমুখী সমাজ গড়ার আন্দোলন । আমার ঢাকা কলেজের প্রিয় শিক্ষক আবদুল-াহ আবু সাইদের ভাষায় আমাদের আন্দোলন হচ্ছে ‘আলোকিত মানুষ’ গড়ার আন্দোলন । বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই সে ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ হয় না, হয় না আলোকিত মানুষ । তাই দেখা যায় এ যুগের অনেকেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেও বা বিজ্ঞানের কোন বিভাগকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেও মনে প্রাণে বিজ্ঞানী হতে পারেননি, পারেননি মন থেকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করতে । বাংলাদেশের এক বিখ্যাত ‘ইসলামী পদার্থ বিজ্ঞানী’ আছেন যিনি একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শতাব্দী প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের মধ্যে ‘আধুনিক বিজ্ঞানের’ সন্ধান পান, মহানবীর মিরাজকে ‘আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি’ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চান। ভারতের এক স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানী আবার বেদ আর গীতার মধ্যে ‘বিগ-ব্যাং’ আর ‘টাইম-ডায়ালেশন’ খুঁজে পান । এরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন ঠিকই, চাকরি ক্ষেত্রে সফলতাও হয়তো পেয়েছেন, কিন্তু মনের কোণে আবদ্ধ করে রেখেছেন সেই আজন্ম লালিত সংস্কারগুলোকে, আঁকড়ে ধরে রেখেছেন যুক্তিহীন ধর্মীয় ধ্যান ধারণা । এই “বিজ্ঞানী’ তকমাধারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোই বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে সবচেয়ে বড় বাধা । বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী ‘বিজ্ঞানী’ ঠিক নামধারী মানুষগুলোর কুসংস্কারের সাথে যেমন আমরা পরিচিত হয়েছি, তেমনি আমাদের দেশে আরজ আলী মাতুব্বর বা রঞ্জিত বাওয়ালীর মত স্বল্পশিক্ষিত, ডিগ্রীহীন, সংস্কারমুক্ত ও যুক্তিবাদী মনমানসিকতার নির্লোভ মানুষও আমরা দেখেছি । এরাই আমাদের শক্তি ।

মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে কারো একটি বড় অভিযোগ মুক্তমনারা দেশের মানুষের জন্য খুব বেশি কিছু করে না, যতটা না ঈশ্বর, আধ্যাত্মিকতার বিরোধিতা কিংবা ডারউইন ডে উদযাপনে ব্যয় করে । এ ধরনের অভিযোগ যারা করেন তারা ভুলে যান এ ক’বছরে মুক্তমনাদের সফল প্রোজেক্টগুলোর কথা । হ্যাঁ মুক্তমনা ঘটা করে ডারউইন ডে, হিউম্যানিস্ট ডে, র‍্যাশনালিস্ট ডে, আর্থ ডে দিবস ব্রুনো— ইত্যাদি পালন করেছে ঠিকই, কিন্তু যখন প্রয়োজন হয়েছে দেশের মানুষের প্রয়োজনে মুক্তমনা সচেতনভাবেই এগিয়ে এসেছে । অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে সাহায্যের ব্যাপারটিই কেবল নয়, সাংবাদিক মানিক সাহার পরিবারকে সাহায্য করা, প্রয়াত ড. হুমায়ুন আজাদের পরিবারের অনুরোধে তার গ্রামের বাড়িতে লাইব্রেরি তৈরির জন্য ‘আজাদ ফান্ড’ গড়ে তোলা এগুলো সময় সুযোগ মত মুক্তমনারা করেছে । দুর্ঘটনার কবলে পড়ে শাহরিয়ার কবির, সাংবাদিক বিভুরঞ্জন দাসসহ দেশের বরেণ্য কয়েকজন ‘সেক্যুলার অ্যাক্টিভিস্ট’ জীবনের জন্য লড়ছিলেন, তখন তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে মুক্তমনাই । ফোরামে চাঁদা তুলে তাদের সাহায্য করেছে মুক্তমনার সাধারণ সদস্যরা। এছাড়াও বিভিন্ন সময় এবং বিভিন্নভাবে আর্থিক দিক দিয়ে সাহায্য করেছে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের শিকার পুরঞ্জিত দাস, মনিকা বালা দাস, স্বাতী দাস, পূর্ণিমা শীলকে । পড়াশোনার করার জন্য সামান্য খরচ দিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রী অনীমা চক্রবর্তীকে। এই তো সেদিন রৌমারীর বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য সেমিনারের আয়োজন করেছে শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের সাথে মিলে। তারও আগে রৌমারীতে একটি প্রাইমারী স্কুল পুনর্নির্মাণ করলেন মুক্তমনারা। এগুলো কি দেশের মানুষের জন্য করা নয়? তারপরও একটি বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যারা যুক্তিবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের চেতনামুক্তি আর সেই পথ ধরে শোষণ মুক্তির স্বপ্ন দেখেন তাদের কিন্তু একটা বিষয়ে সচেতন থাকতেই হবে । উপলক্ষ যেন লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে না যায় । কুসংস্কার মুক্তির লক্ষে পৌঁছুতে জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম কেবল উপলক্ষ্য‍ই হতে পারে, এ বিষয়ে অতি সচেতনতার প্রয়োজন । স্পষ্টই মনে রাখতে হবে এই সত্যটি- জনসেবা করে আর যাই করা যাক, সমাজ ব্যবস্থা পাল্টানো যায় না, সার্বিক শোষণমুক্তি ঘটতে পারে না । শোষণ মুক্তি ঘটতে পারে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের সচেতনাবোধ থেকে । সচেতনতাবোধ যেন তৈরি না হয় সে জন্য শোষিতের ক্ষোভ ভুলিয়ে রাখে শাসকশ্রেণী । গরিবের ক্ষোভ ভুলিয়ে রাখতে ধনীর অর্থে চলে ‘দরিদ্র নারায়ণসেবা ।’ দরিদ্র-নারায়ণের সেবাই যাদের কেবল লক্ষ্য তারা আসলেই কখনই চায় না সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হোক, কেননা দারিদ্র্য দূর নয়, বরং দারিদ্রকে পুঁজি করে জনগণের ‘মগজ ধোলাই’ই তাদের অন্তিম লক্ষ্য। এ ধরনের সেবামূলক কাজে দু’একটি দরিদ্রের তাৎক্ষণিক লাভ হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের জন্য পড়ে থাকে অনন্ত বঞ্চনাময় জীবন। অর্থনৈতিকভাবে দেশকে স্বাবলম্বী করার চাইতে মগজ ধোলাই করে জনচিত্ত জয় করার পদ্ধতিটি সফলভাবে কাজে লাগায় বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সেজন্যই মাদার টেরেসা, রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবা সংঘ, তবলীগ জামাত, প্রমুখ নানা সংগঠন নানা কৌশলে জনকল্যাণমূলক কাজের সাথে নিজেদের জড়িত রেখেছে । গড়ে উঠেছে ইসলামী এনজিও । কৌশলে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ঠিকমত দান খয়রাত করলে, জাকাত দিলে দারিদ্র্য নাকি এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা । এ ধরনের দান খয়রাত, জাকাত আর সমাজসেবার মাধ্যমে সমাজের শোষণ মুক্তি ঘটেছে এমন একটি দৃষ্টান্তও ইতিহাসে নেই । হাজারটা রামকৃষ্ণ মিশন, সেবাসংঘ, তবলীগ জামাত, হাজারজন মাদার টেরেসা, হাজি মুহম্মদ মুহসিন বাংলাদেশের কিংবা ভারতের জনতার শোষণ মুক্তি ঘটাতে পারবে না । আমরা সমাজসেবার বিরুদ্ধে নই, কিন্তু ‘উদ্দেশ্যমূলক’ জনসেবার মাধ্যমে মগজ ধোলাই  করে মানুষকে অন্ধ রাখার অভিসন্ধির বিরুদ্ধে ।

মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ মুক্তবুদ্ধি, নাস্তিক্যবাদ, মানবতাবাদ এগুলোর চর্চা করে তারা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন । এর জবাবে প্রবীর ঘোষের মত বলা যায়, যে কোন অসুস্থ সমাজে সুস্থ সচেতন, যুক্তিবাদী মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য । পৃথিবীর ইতিহাসে গ্যালিরিও, প্যারাসেলস, ব্রুনো, বিদ্যাসাগরসহ বহু চিন্তাবিদের নাম করা যায় যারা প্রত্যেকেই ছিলেন সমাজে একাকী । একাকী ছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর বা আহমদ শরীফও । কিন্তু এইসব বিদ্রোহী মানুষগুলো প্রথাগত স্থবিরতাকে চূর্ণ করতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, সে সময়কার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে । সেকালের বিচ্ছিন্ন বিশাল ব্যক্তিত্বদের মূল্যায়ন করার ক্ষমতা ছিল না তৎকালীন মানব গোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের এবং মগজ বেচা বুদ্ধিজীবী তকমাধারী ফেউদের । আজ সেসব বিচ্ছিন্ন মানুষেরাই হয়ে উঠেছেন এক একজন মহামানব, শ্রদ্ধেয় আদর্শ ও প্রেরণার উৎস। যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ পচনধরা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে সংস্কারমুক্ত করা, যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ শোষণের অবসানমুখী সংগ্রাম, যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে সুস্থ সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে আনা, সে বিচ্ছিন্নতা অবশ্যই কাম্য। একটা সময় আমরা দেখেছি ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবসানের মধ্য দিয়ে বস্তুবাদের বিকাশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের পরিক্রমায় আমরা একে একে দেখেছি ভারতীয় লোকায়ত বা চার্বাক দর্শন, গ্রীসের আয়োনিয়ার বস্তুবাদী দর্শন, পশ্চিম এশিয়ার মুসলিমদের মোতাজিলা দর্শন, গ্রীসের আয়োনিয়ার বস্তুবাদী দর্শন, পশ্চিম এশিয়ার মুসলিমদের মোতাজিলা দর্শন, ইউরোপের দার্শনিকদের (বেকন, লক, হবস, হিউম প্রমুখ) ইহজাগতিক দর্শন, ফরাসী বিপ-ব, ইউরোপের রেঁনেসা এবং উনিশ শতকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিওদের কল্যাণে বাঙালিদের নবজাগরণ; আমরা সেই ঐতিহ্যের অনুসারী, জাতীয়ভাবে আমরা সহজিয়া, বাউলিয়ানার মত বিভিন্ন অজ্ঞেয় লোকজ মতবাদ, বিভিন্ন সমমনা ইহজাগতিক সংগঠন ও ব্যক্তির যুক্তিবাদী ভাবধারার উত্তরসুরী ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ধর্মান্ধতা, কুপমণ্ডূকতা আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিনিষ্ঠ এক প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছে । আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি ভারতে প্রবীর ঘোষের নেতৃত্বে ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ সেদেশের যুক্তিবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। তার সুযোগ্য নেতৃত্বেই ‘যুক্তিবাদী’ চিন্তা আজ সেখানে ব্যক্তিগণ্ডি অতিক্রম করে আন্দোলনের রূপ পেয়েছে : আন্দোলনে আন্দোলিত হয়েছে লক্ষ কোটি মানুষ, আন্দোলিত হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, নাট্য সংস্থা বিজ্ঞান ক্লাবসহ বহু সংগঠন; এরা অংশ নিয়েছে যুক্তিবাদী চিন্তার বাতাবরণ সৃষ্টিতে। কুসংস্কার, ভাববাদ, অধ্যাত্মবাদ, নিয়তিবাদ ও অলৌকিকতা-মুক্ত এক স্পর্ধিত বাঙালি প্রজন্ম গড়ে তুলতে অবদান রেখে চলেছে ‘মুক্তমনা’। প্রত্যাশা বেড়েছে অনেক। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। আমাদের দেশে ‘বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ’, ‘জনবিজ্ঞান আন্দোলন’, ‘মুক্ত চিন্তা চর্চা কেন্দ্ৰ’, ‘বাংলাদেশ যুক্তিবাদী সমিতি’ বিভিন্ন নামে সংগঠন গড়ে উঠেছে প্রায় একই উদ্দেশ্য সামনে রেখে। এ মুক্তমনার কারণেই অনন্তের মত প্রতিশ্রুতিবান লেখকেরা দায়বদ্ধের দেনা পরিশোধ করতে পেরেছেন, গ্রামীণ মেহনতি মুক্তমনা রঞ্জিত বাওয়ালীকে প্রচারিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন ।

 

তথ্যসূত্রঃ

O মফিজুর রহমান রুননু, যুক্তিবাদ- চেতনামুক্তির লড়াই। বাংলাদেশ যুক্তিবাদী সমিতি, ঢাকা (২০০১)।

O প্রবীর ঘোষ, অলৌকিক নয়, লৌকিক (১ম ও ৩য় পর্ব), দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা ৷

O যতীন সরকার, মুক্তবুদ্ধিচর্চা ও বাঙালির লৌকিক ঐতিহ্য। আরজ আলী মাতুব্বর স্মারক বক্তৃতা, ঢাকা, ১৪০৭ (২০০০)।

O শফিকুর রহমান, হিউম্যানিজম, প্রমিথিউস পাবলিশার্স, ঢাকা (১৯৮৯)

O শফিকুর রহমান, পার্থিব জগৎ, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা (১৯৮৭)

O যুক্তিবাদীর চোখে ধর্ম, সম্পাদনা : প্রবীর ঘোষ, অগ্রণী বুক ক্লাব, কলিকাতা (১৯৯২)

O আরজ আলী মাতুব্বর, আরজ আলী রচনা সমগ্র-১। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা (২০০০) লোকায়াত দর্শন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলিকাতা (বাং ১৩৬৩)

O রাহুল সংস্কৃত্যায়ন, চেতনার দাসত্ব, অনুবাদ কমলেশ সেন, রবীন্দ্রগুপ্ত ও মলয় চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা (১৯৯৩)

O আবুল হুসেন, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ঢাকা (২০০০)

O Mukto-mona: A Secular site for Bengali humanists & freethinkers (www.mukto-mona.com)

error: Content is protected !!