কারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা?

‘৭১ এর চেতনা, আশা, স্বপ্ন প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অন্তরে ছিল জলন্ত শিখার মত। তারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পূনর্গঠনে অন্যান্য অবদান রাখতে পারতেন। তারা পারতেন হারানো গর্ব এবং সম্মান ফিরিয়ে আনতে পুরো জাতির জন্য ঠিক একইভাবে যেভাবে তারা স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে।

যে আশা-আকাংখা এবং স্বপ্ন নিয়ে জানবাজী রেখে একদিন দেশের স্বাধীনতার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সে স্বপ্ন আজো বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার বুকে তুষের আগুনের মতই জ্বলছে। দেশের মঙ্গলের জন্য সুযোগ পেলে আজো তারা বিশেষ অবদান রাখতে উদগ্রীব। তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য আবার জনগণের সাথে সঙ্গবদ্ধ হয়ে সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন তারা। স্বাধীনতার মত সার্বিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেন স্বার্থপর জাতীয় বেঈমানদের পরাজিত করে। গড়ে তুলতে পারেন সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ। জাতিকে ফিরিয়ে দিতে পারেন তাদের হারানো মর্যাদা ও গৌরব।

কারা এই মুক্তিযোদ্ধা? কি ছিল তাদের স্বপ্ন? কি হল তাদের পরিণাম? তাদের বিরুদ্ধে কি চক্রান্ত করা হয়েছিল স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে? এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব পাঠকদের কাছে তুলে ধরবার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

১৯৭১ সালে যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করেছিল তারা সবাই ছিলেন বাংলাদেশের খেটে খাওয়া জনগণের সন্তান। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের ছেলে মেয়েরাই সেদিন দেশকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। এর পেছনে তাদের কোন হীন স্বার্থ ছিল না। ছিল একটি মাত্র স্বপ্ন। হানাদারদের কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে শোষণহীন আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ। তাদের গভীর দেশপ্রেমই ছিল তাদের ত্যাগের উৎস। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাদের সেই নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও প্রচন্ড সাহসের ইতিহাস। তাদের সেই বীরত্ব ও ত্যাগের ফলেই স্বাধীন হল বাংলাদেশ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী মানুষের ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাঙ্খিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হল না স্বাধীন বাংলাদেশে। অথচ তখনকার নেতৃত্ব যদি তাদের বিশ্বাস করে তাদের দুর্বার কর্মক্ষমতা ও আত্মত্যাগের অঙ্গীকারকে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে কাজে লাগাতে চাইতেন তবে তারা নিশ্চয়ই অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারতেন। কিন্তু তেমনটি হয়নি। তখনকার সরকার যে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের অবিশ্বাসই করেছিল তা নয়; তাদের উপর চালানো হল নির্যাতনের ষ্টিমরোলার। একটি সশস্ত্র সংগ্রামের বিজয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হল বাংলাদেশ, নব চেতনায় জন্ম নিল একটি জাতি। কিন্তু মাত্র স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জাতির ভাগ্যে নেমে এল চরম বিপর্যয়। দারিদ্র, হতাশা, নৈরাশ্য, নৈরাজ্য, নীতিহীনতা, আদর্শের পরাজয় এবং মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অবজ্ঞা এবং লাঞ্ছনা। পৃথিবীর ইতিহাসে মুক্তিকামী মানুষের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও রক্তদানের প্রতি এমন অবমাননা এবং অসম্মান বোধ হয় অন্য কোথাও দেখানো হয়নি৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের সর্বস্তরের জনগণ যুদ্ধ করল তবুও ঘৃণ্য অতীতই আবার ফিরে এল। মানুষের কাম্য জীবন ও সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হল না। জাতীয় পর্যায়ে বেঈমান ও শোষকের দলই ক্রমে দেশের কর্ণধার হয়ে বসল।

মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ করে তাকেই বলা হয় মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তি বলতে শুধুমাত্র ভৌগলিক স্বাধীনতা বোঝায় না। মুক্তি বলতে বোঝায়- সেই সমাজ যেখানে প্রতিটি মানুষ তার সম্মান নিয়ে মাথা উচু করে বেঁচে থাকতে পারে আপন গর্বে, দাস বা ভিক্ষুকের মত নয়। মানুষ তখনই প্রকৃত অর্থে মুক্ত হয় যখন সে তার মেধা, প্রতিভা এবং কর্মক্ষমতা প্রকাশের সমান অধিকার লাভ করে। সুযোগ পায় তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা প্রকাশের এবং নিজ প্রজ্ঞা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তার ভাগ্যের উন্নতি করার। আর্থিক ও সামাজিক অধিকারে বৈষম্য থাকলে মানুষ মুক্ত বলে বিবেচিত হতে পারে না। যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে বাস করে, দু’বেলা ভাত পায় না, সে দেশের মানুষ মুক্ত কিংবা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে এ ধরণের উচ্চবাচ্য করা পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকেই বলেন, ‘৭১ এর যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। আমি বলি ভারতীয় বাহিনী কেন তার সাথে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীও যদি যোগ দিত তাহলেও ‘৭১ এর যুদ্ধে তাদের পক্ষে পাকিস্তানকে পরাজিত করা সম্ভব হত না। কারণ জয় পরাজয় নির্ভর করে জনগণের সমর্থনের উপর। অল্প কিছু লোক এবং গোষ্ঠি ব্যতিত পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জনসাধারণ মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছিল বলেই দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু এই জনগণকেই তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সরকার।

মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করার হুকুম মোতাবেক সমস্ত অস্ত্র জমা নেবার পর দু/তিন দিনের নোটিশে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার হাতে ৫০ টাকা করে পথ খরচা দিয়ে খোদা হাফেজ জানায় আওয়ামী লীগ সরকার। সরকার অঙ্গীকার করল মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেয়া হবে। যারা এ সার্টিফিকেট পাবে তাদের পূর্ণবাসনের জন্য চেষ্টা করবে সরকার। পরবর্তিকালে এই সার্টিফিকেট সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ না করে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় জেলা প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতাদের মাধ্যমে বিলি করা হয় তাদের পছন্দের লোকদের মাঝে। যদিও এদের অধিকাংশের সঙ্গে যুদ্ধের কোন সম্পর্ক ছিল না। যুদ্ধাপরাধী এবং দালালদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে মাফ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে অনেক রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর সদস্যরা নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে সার্টিফিকেট দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বনে ঘুরে বেড়াতে থাকে সমাজের সর্বত্র। দেশদ্রোহী এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের আওয়ামী সরকার ক্ষমা করেছিল মহত্বের করণে নয় বরং অভিন্ন শ্রেণী স্বার্থে এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তাদের মদদ হাসিল করে নিজেদের হাত শক্তিশালী করতে। যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ। কিন্তু ১২ থেকে ২০ লাথ সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ডজন মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ১১ জনই ভুয়াঁ। অত্যন্ত সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমুর্তি নষ্ট করার জন্য এবং স্বাধীনতা বিরোধী দালাল চক্রকে পূনর্বাসিত করার জন্যই এ ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভীড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাপ্য কৃতিত্ব ও স্বীকৃতি পাবার আগেই হারিয়ে যায়।

যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে হাতিয়ার নিয়ে নিলেও সরকার যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতীয় সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল তাদের নিরস্ত্র করা থেকে বিরত থাকে। উপরন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় ঐ বাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতার পরমুহুর্ত থেকেই লুটতরাজ, ডাকাতি, রাহাজানী, হত্যা, লাইসেন্স পারমিটবাজীতে মেতে উঠে। ভারতীয় মারোয়াড়ীদের সাথে হাত মিলিয়ে চোরাচালানেও তারাই লিপ্ত হয়৷ কালোবাজারী এবং মজুতদারীদের এরাই প্রটেকশন দিয়ে রাখে। পরিত্যক্ত সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে দলীয় লুটপাটও করা হয় এই বিশেষ বাহিনীর যোগসাজসে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙ্গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগিতায় যারা সর্বপ্রকার অসামাজিক কাজ ও লুটপাট করেছিল তাদের পাপের বোঝা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আজও টানতে হচ্ছে। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে বিনা কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে এখনো বিনা বিচারে কারাবন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে। সরকারের ক্ষমা প্রাপ্ত লেলিয়ে দেয়া দালালরা ছাড়া পাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে লাগে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য। দালালরা সবাই ছিল যার যার নিজ এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি। স্থানীয় প্রশাসন, থানা ইত্যাদির উপর এদের প্রভাব ছিল অসীম। স্বাধীন দেশের নতুন সরকার প্রশাসনিক কাঠামোর কোন পরিবর্তন না করায় তাদের প্রভাবে ও কোন তারতম্য ঘটেনি ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন হয়ে উঠে সঙ্গীন ও দুঃর্বিষহ।

পৃথিবীর ইতিহাস থেকে দেখা যায়, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে যে সমস্ত দেশ এবং জাতি স্বাধীন হয়েছে ঐ সমস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে জাতীয় পুর্নঃগঠন প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধারাই অগ্রণী ভূমিকায় থেকেছেন। নীতি নির্ধারণ করা থেকে নীতি বাস্তবায়ন করার প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ অবদান রেখেছেন জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কিন্তু আমাদের বেলায় হল ঠিক তার বিপরীত। যে চেতনা ও সংকল্প একটা মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে তুলে আমাদের ক্ষেত্রে তার অভাব ছিল গোড়া থেকেই। যুদ্ধের জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। যুদ্ধটা ছিল আমাদের উপর আরোপিত। ‘৭১ এর ২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনীর আচমকা আক্রমণের আগ পর্যন্ত বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতারা সবাই রাজনৈতিক সমাধানের রাস্তাই খুঁজে পাবার চেষ্টা করছিলেন। এর ফলে যে কোন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় শর্তাবলী যথা:- সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য উপযুক্ত নীতি আদর্শ, সংগঠন, সামরিক প্রস্তুতি এবং বিচক্ষণ নেতৃত্ব এর প্রায় সবকয়টিই ছিল অনুপস্থিত। ফলে যে নেতার নামে সংগ্ৰাম তিনি শুরুতেই ধরা দেন শত্রুর হাতে। আর তার সহযোগিরা নিরস্ত্র জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। প্রথমে বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও যে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল সেটা ছিল প্রধানত: আত্মরক্ষার তাগিদে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। তবে যারা এ ধরণের প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাদের সাহস ও সংকল্প ছিল অকৃত্রিম। কিন্তু যুদ্ধটা যে আকষ্মিক ছিল এবং সমগ্র জাতিকে সে আকষ্মিক ঘটনার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে জড়িত হয়ে পড়তে হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। সূত্রহীন এই আকস্মিকতার একটা মহান যুদ্ধকে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে নেবার জন্য যে রাজনৈতিক আদর্শের প্রয়োজন সে আদর্শ গড়ে উঠার সুযোগ আমরা পাইনি। যুদ্ধের নেতৃত্ব যারা কব্জা করে নেয় তাদেরও এটা কাম্য ছিল না। দেশের আপামর জনসাধারণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিরোধিতা করার জন্যই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল কিন্তু জনগণের সে আশা পূরণ করা আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ সেটা হত তাদের শ্রেণী স্বার্থের পরিপন্থী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতারণার শিকারে পরিণত হয় মূলতঃ একারণেই। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং যুদ্ধে সহায়তা করেছেন তারা লক্ষ্যহীন ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছেন তাদের বিপুল অংশই ছিলেন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, মা-বোন ও দেশবাসীর লাঞ্ছনার প্রতিশোধের আকাঙ্খাই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল যুদ্ধে যোগ দিতে। অবশ্য আত্মরক্ষার তাগিদেও অনেকে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে বেশিরভাগ লোকই স্বেচ্ছায়, আত্মত্যাগের মহৎ মনোভাব নিয়েই এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন করা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার কিশোর-যুবক বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধ করে বিভিন্ন সেক্টরে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা তাদের কর্মীদের নিয়ে ভারতের সহায়তায় নিজেদের নিজস্ব বাহিনী গঠন করে তাদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে না পাঠিয়ে তাদের অতি সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখে স্বাধীনতা উত্তরকালে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। প্রকৃতপক্ষে ন’মাসের আগাগোড়া যারা যুদ্ধ করেছে তাদের অধিকাংশ‍ই ছিল অরাজনৈতিক সাধারণ ঘরের ছেলে-মেয়ে। তারা ছিল সরলমনা। তাই যুদ্ধ শেষে বিনা দ্বিধায় তারা তাদের অস্ত্র জমা দিয়ে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশে অস্ত্রের দাপট, পারমিটবাজী, লুটতরাজ, হাইজ্যাক, গুম, খুন, ধর্ষণ ও অন্যান্য দুঃষ্কর্মে এসব নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সামান্য। রাজনৈতিক চেতনার অভাবে শক্তি থাকা সত্ত্বেও এরা সংগঠিত হতে পারেননি। বাংলাদেশের বিশাল জনসমুদ্র থেকে এসে তারা আবার জনসমুদ্রেই মিশে যান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করে সুষম আর্থসামাজিক ব্যবস্থা কায়েম করার মত শক্তি তাদের ছিল। এটা আঁচ করতে পেরেই আওয়ামী লীগ সরকার শংকিত হয়ে পড়ে এবং দেশে ফিরে প্রথমেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। একই সাথে সুখী ভবিষ্যতের কথা বলে তাদেরকে ভাওতা দেয়। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত বিজয়ের পর যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে পুর্নগঠনের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং সেই সঙ্গে সূর্য্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সমাজে সসম্মানে পূর্ণবাসনের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংসদের আহ্বানে দ্রুত দেশের প্রতিটি থানায় এবং ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অঙ্গ সংগঠন গড়ে উঠে। ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে এই সংগঠনের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন হয় এবং ঐ অধিবেশনে একটি গঠনতন্ত্র এবং জাতীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচিত হয়। এই কমিটির লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশের তৎকালীন গণবিরোধী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন সরকার এবং ধোকাবাজীর রাজনীতির হাতছানি মারাত্মক অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। সরকারের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে কয়েকজন কাউন্সিল সদস্য সরকারি প্ররোচণায় সংসদের গঠনতন্ত্রকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সংসদকে আওয়ামী সরকারের লেজুড়ে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। জাতীয় নির্বাহী পরিষদের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া সত্ত্বেও নতুন নির্বাচনের বিধানকে আমল না দিয়ে ১৯৭৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী ঐ চক্র এক কোরাম সভায় গঠনতন্ত্রকে উপেক্ষা করে বৈধ জাতীয় নির্বাহী কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি পরে ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের এক সভায় জনধিকৃত বাকশালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের যোগদানের কথা ঘোষণা করে। সংসদের আদর্শ জলাঞ্জলী দিয়ে সংসদের গঠনতন্ত্রের অবমাননার দায়ে জনাব নঈম জাহাঙ্গীর ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পচাঁত্তরের মার্চ মাসেই ঢাকা মুন্সেফ কোর্টে ঐ অবৈধ পরিষদ গঠনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। কোর্ট ইনজাংশন জারি করে অবৈধ পরিষদের গঠনতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়। ফলে সংসদ বাকশালের রাহুগ্রাস থেকে সাময়িকভাবে বেচে যায়। ইনজাংশন জারি করলেও কোর্ট সরকারের রোষ এড়াবার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মামলার রায় প্রদান স্থগিত রাখে।

 

ঐক্য প্রচেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি

স্বৈরাচারী একনায়কত্বের বিরুদ্ধে লড়াই এর জন্য জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ছিল অপরিহার্য। কিন্তু অনেক চেষ্টায়ও সেই ঐক্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

সরকারি দল ও তাদের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো তাদের সাধ্যমত প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সর্বহারা পার্টি এবং জাসদের কর্মীরাই সরকার বিরোধিতায় মারাত্মকভাবে তৎপর। অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবং প্রগতিশীল সংগঠনগুলো তাদের সাধ্য ও সামর্থ অনুযায়ী সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়ছে। জনগণ সাধারণভাবে আওয়ামী ঐক্যজোটের বিরুদ্ধে। ঐক্যজোটের স্বৈরাচারী নির্যাতনে জীবন ও জীবিকার তাগিদে সবাই দিশেহারা। জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, লেনিনবাদী কম্যুনিষ্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, জাতীয় লীগ ইত্যাদি দলগুলো নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং এবং তাদের গোপন সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে। তাদের মধ্যে সরকার বিরোধিতার ব্যাপারে কয়েকটি বিষয়ে ঐক্যমতও রয়েছে। জনগণও আজ পিছিয়ে নেই। তারাও আজ আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু এরপরও কোন একটি দলের পক্ষেই পর্যাপ্ত পরিমাণের শক্তি এবং প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হচ্ছে না সরকারি নিষ্পেষণের কারণে। ফলে জনগণ কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের পেছনে দাড়াতে ভরসা পাচ্ছে না। তারা এটাও লক্ষ্য করছে যে, বিরোধী দলগুলো মোটামুটিভাবে সরকার বিরোধী একই রকমের বক্তব্য রাখছে; একইভাবে সরকারের বিরোধিতা করছে কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে না। দলগুলোর মধ্যে তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য না থাকায় এবং তাদের বক্তব্য এবং মতামতের মধ্যে একটা মৌলিক সাদৃশ্য দেখতে পাওয়ায় তারা চাইছিল সব বিরোধী দল এবং সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হোক। এ ব্যাপারে কিছু নির্দলীয়, রাজনৈতিকভাবে সচেতন, দেশপ্রেমিক ব্যক্তি নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছিল ঐধরণের একটা ঐক্য প্রচেষ্টার। লেখকেরও এই ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা ছিল। বিরোধী দলগুলোর কোনটাই সরকারের নির্যাতন এবং দমন নীতির মুখে এককভাবে দাড়াতে পারবে না; এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত ছিল না। গণআন্দোলন এবং সরকার বিরোধী সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাবে পর্যায়ক্রমে; এ ব্যাপারেও ঐক্যমত ছিল। এই দু’টো মূল বিষয়ই ছিল ঐক্য প্রচেষ্টার ভিত্তি। বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং আগামী দিনগুলোতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে কারো পক্ষেই শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না বরং দলগুলোর বিলুপ্তি ঘটারই সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে; এ বিষয়টিও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। তাছাড়া সরকার যেভাবে দেশে প্রকাশ্য রাজনীতির পরিধি ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত করে আনছে তাতে করে অচিরেই আগামীতে দেশে একদলীয় শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। সেক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে সরকার বিরোধী কিছু করতে গেলে তাতে শক্তিক্ষয়ই ঘটবে কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না। গোপনে বৈঠকের পর বৈঠক চললো। আলোচনাকালে বোঝা গেল ঐক্যের পক্ষে যারা; তারা শীর্ষ নেতাদের জন্য তেমনভাবে তাদের মতামতও প্রকাশ করতে পারছিলেন না। সারকথা, বুঝতে পারা যাচ্ছিল ঐক্যের পথে মূল বাধা নেতারা। আবিষ্কার করতে পারলাম এর কারণও রয়েছে অনেক:- নেতৃত্বের কোন্দল, অতীতের তিক্ততা, অবিশ্বাস, নেতাদের বিভিন্ন দুর্বলতা এবং নীতিগত ভুলের জন্য অতীতের ব্যর্থতা। এসব জটিল সমস্যাগুলোর উর্ধ্বে উঠার মত মানসিকতা নেতাদের মাঝে নেই। তার উপর ঐক্যের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিল ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে নেতৃত্বের কোন পদে কে থাকবেন; সেই প্রশ্নটি। নেতাদের সবাই যার যার হাতে সাড়ে তিন হাত! সবাই নিজেকে সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করছেন। এ ধরণের মনোভাব এবং পরিস্থিতিতে কোন ঐক্য গড়ে তোলা অসম্ভবই নয় অবাস্তবও বটে। তাই আমরা সেই উদ্যোগ থেকে সরে দাড়াব ভেবেছিলাম এক সময়। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত হল ভেঙ্গে পরলে চলবে না; ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সব নেতাদের মধ্যে পারষ্পরিক বিভেদ থাকলেও তাদের প্রত্যেকেই আমাদের আন্তরিকতার তারিফ করেছিলেন। পরিশেষে আমাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে একদিন কর্নেল আকবর এসে বললেন যে, এদের নিয়ে কোন ঐক্য গড়ে তোলা কিছুতেই সম্ভব নয় বলেই তিনি, কাজী জাফর, মেনন এবং রনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার। এই দলে আমাকে একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে যোগদানের প্রস্তাব দিলেন তিনি। জবাবে আমি বলেছিলাম, “এত তাড়াতাড়ি হতাশ হলেতো চলবে না; ঐক্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যেখানে পুরনো দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে তাদের অস্তিত্বই বজিয়ে রাখতে পারবে না বলে মনে করা হচ্ছে সেখানে আর একটি নতুন দল করে লাভটা কি হবে? এরপরও আপনারা দল করতে চান ভালো কথা; তবে আমার জন্য এই মুহুর্তে নির্দলীয় থাকাটাই উচিত হবে বলে মনে করি। আপনাদের দলে যোগ না দিলেও সময়মত আমরা সবাই একত্রিত হব কোন বৃহত্তর স্বার্থে; সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।” এর অল্প কয়েকদিন পরেই United People’s Party (UPP) আত্মপ্রকাশ করে। কর্নেল আকবর সেই পার্টিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে যোগদান করেন। এরপরও আমাদের যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন থাকে।

 

সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে বিয়ে হলো শেখ ভাত্রিদ্বয়ের !

যখন হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরছে তখন শেখ কামাল এবং শেখ জামালের বিয়ে হলো সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর একদিন শেখ কামাল এবং শেখ রেহানা সত্যিই এল আমাদের মালিবাগের বাসায় বিয়ের নিমন্ত্রণ জানাতে। দুই ভাইয়ের একই সাথে বিয়ে। শেখ জামাল ইতিমধ্যে যুগোস্লাভিয়ায় গিয়েছিল সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে কিন্তু ওখানকার পরিবেশ ভালো না লাগায় পরে কিছুদিন স্যান্ডহার্টসে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে কমিশন্ড অফিসার হিসাবে যোগ দিয়েছে জেনারেল শফিউল্লাহর নিজস্ব নিজস্ব ইউনিট ২য় ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে কিছুটা নিয়ম বর্হিঃভুতভাবেই। বিয়ে হয়েছিল নতুন গণভবনে। বিশাল আয়োজন। অগুনিত অতিথির ভীড়। মনে হচ্ছিল পুরো ঢাকা শহরটাই এসে উপস্থিত হয়েছে বিয়েতে। বর্নাঢ্য জাকজমক পরিবেশে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। বিয়ের মন্ডপে কামাল-জামাল দুই ভাই সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে বর সেজে বসেছিল। বিয়ের পরদিন প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকায় বড় করে ছাপানো হল প্রধানমন্ত্রীর দুই ছেলের সোনার মুকুট মাথায় পড়ে বিয়ের খবর। একই পাতায় ছাপানো হয়েছিল দুর্ভিক্ষপীড়িত, অনাহারক্লিষ্ট, হাড্ডিসার মুমুর্ষ মানুষ নামি কঙ্কালের ছবি এবং দুর্ভিক্ষের খবর। ১৯৭২ সালে কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, “কবে যে বাংলাদেশের মেয়েরা স্বর্নালঙ্কার বাদ দিয়ে বেলী ফুলের মালা পড়ে বিয়ে করবে!” তার এই খায়েশটাও বেশ ফলাও করে বেরিয়েছিল খবরের কাগজগুলোতে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের কথা আর কাজের মধ্যে কত তফাৎ ! বিয়ের ব্যাপারটা হয়তো বা ছোট কিন্তু এ বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়েছিল সব মহলেই।

 

সিরাজ সিকদারের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছিল

ঢাকার তদানীন্তন পুলিশ সুপার মাহবুব সরল বিশ্বাসে বন্ধু হিসেবে আমাকে হুশিয়ার করে দিয়েছিল এবং বলেছিল, সিরাজ সিকদার খুব শীঘ্রই ধরা পড়বে।

১৯৭৪ সালের শেষের দিকে আমার ছোট ভাই স্বপনের বিয়ে ঠিক হল আমারই ফুপাতো বোন গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামালুদ্দিনের কন্যা মুন্নির সাথে। এয়ারর্ফোস মেসে রিসেপসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেইখানে এসপি মাহবুব এক ফাঁকে আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল,

– ডালিম বন্ধু হিসাবে একটা কথা বলছি কিছু মনে করিস না। ওর কথার ধরণ দেখে বললাম,

– ভনিতা ছেড়ে আসল ব্যাপারটা কি বলে ফেলতো।

– দেখ, আমি চাইনা তোর কোন বিপদ হোক। বন্ধু হিসাবে তোকে সাবধান হতে অনুরোধ করছি। Please be careful. কিছুদিনের মধ্যেই সিরাজ সিকদার ধরা পড়বে। This is certain. But I don’t care about it, what is bothering me is that during interrogation of one of his close associate your name has also come up This is certain. But I don’t care about it, what is bothering me is that during interrogation of one of his close associate your name has also come up. তার এক close comrade এর নোটবুকে তোর নাম পাওয়া গেছে।

– কারো নোটবুকে আমার নাম পাওয়া গেলে আমি কি করতে পারি? প্রশ্ন করলাম আমি।

– Well you are matured enough. please be very very careful about your movements and be causcious about the people you meet that is what is needed. I am pretty serious, do you understand? আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখতে পেয়ে একজন বেয়ারা এসে জানাল খাবার দেয়া হয়েছে। দু’জনেই খাবারের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। খাচ্ছিলাম আর মাহবুবের কথাগুলোর বিষয়ে ভাবছিলাম। যতটুকু সম্ভব স্পষ্ট ঈঙ্গিত দিয়ে দিয়েছে মাহবুব। আরো সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হবে আমাকে। সরকারের বিশেষ মহলের সুনজরে পরে গেছি। অতএব সাবধান! খুব সাবধান হতে হবে আমাকে। খুব শীঘ্রই ধরা পড়বে সিরাজ সিকদার; এ কথাটা এত জোর দিয়ে কি করে বলতে পারলো মাহবুব? তবে সরকার নিশ্চয়ই কোন ফাঁদ পেতেছে; যে ফাঁদ বুঝতে না পেরে সিরাজ সিকদার ধরা পড়বে। নিশ্চয়ই তাই। তা না হলে মাহবুবের মত লোক এত দৃঢ়তার সাথে কথাটা বলতো না। সংবাদটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংশ্লিষ্ট মহলে পৌঁছে দিতে হবে। সাবধানের মার নেই। পরদিনই খবরটা জায়গামত পৌঁছে দিয়ে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল। জবাব পাওয়া গিয়েছিল তেমন কোন আশঙ্কার কারণ নেই।

মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকায় টয়েনবি সাকুলার রোডের উপর আমাদের SANS International এর অফিস। ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে নিত্য নানা ধরণের লোক আসা-যাওয়া করছে। বিভিন্ন ধরণের লোকজন আসতো আমাদের অফিসে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও আসতো জনতার স্রোতে মিশে। সে অবস্থায় কোন রাজনৈতিক ব্যক্তির নোটবুকে আমার নাম পাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু যেটা ভাবনার বিষয় সেটা হল, সর্বহারা পার্টির গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তির নোটবুকে আমার নাম পাওয়া গেছে; সেটাই আশঙ্কার বিষয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও আমার যোগাযোগ রয়েছে সে বিষয়ে কিন্তু মাহবুব কিছুই বলল না। তবে কি বুঝে নিতে হবে সর্বহারা দলের সদস্যদের সাথে আমিও সরকারের priority target -তে পরিণত হয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হল। সবাই মত প্রকাশ করল মাহবুবের ঈঙ্গিতকে হালকাভাবে দেখা ঠিক হবে না। উপযুক্ত নিরাপত্তার সাথেই আমাকে চলাফেরা করতে হবে। তবে জীবনের স্বাভাবিকতাও বজিয়ে রাখতে হবে। যেকোন অস্বাভাবিক আচরণ সরকারি মহলকে আরো সন্দিহান করে তুলবে।

 

চাকুরীচ্যুত হওয়ার পরও জনাব তাজুদ্দিন আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

যদিও তাজুদ্দিন আহমদের নীতিসমূহ আমরা যুদ্ধকালীন সময় সমর্থন করিনি তবুও তার কিছু ব্যক্তিগত গুনাবলীর জন্য আমরা তাকে সম্মান করতাম। তার চাকুরিচ্যুতির খবর জানামাত্র আমি সেদিন সন্ধ্যায় তার সরকারি বাসভবনে দেখা করতে যাই।

তিনি বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্য গোছগাছ করছিলেন। বাড়ির লনে বসেই আলাপ হল। আলাপ শেষে বেরিয়ে আসছিলাম ঠিক তখন তিনি হঠাৎ করে জানতে চাইলেন, ভবিষ্যতে যোগাযোগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমি তাঁর সাথে দেখা করব কিনা? জবাবে বলেছিলাম, আমার তরফ থেকে কোন বাধা নেই। ঠিক হল যোগাযোগ হবে গোপনে৷

একদিন অফিসে বসে আছি হঠাৎ আমার চাচা শ্বশুড় জনাব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবি-লেখক-সাংবাদিক এবং পাকিস্তান আমলে দৈনিক পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশ টুডের মালিক) এসে হাজির। অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাড়িয়ে তাকে বসতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– কাক্কু, আপনি হঠাৎ কি মনে করে? খবর দিলেইতো পারতেন আমি নিজে গিয়ে দেখা করে আসতাম।

– বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি। তাজুদ্দিন তোমার সাথে জরুরীভাবে দেখা করতে চায়। সম্পর্কে কা এবং তাজুদ্দিন সাহেব ভায়রা ভাই।

– কোথায়? জানতে চাইলাম।

– তাঁতিবাজারে।

– লাঞ্চের পর আগামীকাল আমি আর নূর আসব। তিনি চলে গেলেন। পরদিন সময়মত গিয়ে পৌঁছতেই দেখি জনাব তাজুদ্দিন অপেক্ষা করছেন। আমরা দুইজনই তার বিশেষ পরিচিত। দোতালার একটি নিভৃত কক্ষে আমাদের বৈঠক শুরু হল কুশলাদি বিনিময়ের পর

– দেশের অবস্থা সম্পর্কে কি মনে করছেন? প্রশ্ন করলেন তিনি।

– যে দেশ বানিয়েছেন তার সর্ম্পকে ভাবনার কি কোন অন্ত আছে?

– দেশতো আপনারাই স্বাধীন করেছেন।

– তাই কি? আমরাতো এভাবে দেশ স্বাধীন করতে চাইনি সেটা আপনার চেয়ে বেশি আর কারো জানার কথা নয়। চুপ করে ছিলেন তিনি। আমি বললাম,

– তাজুদ্দিন সাহেব ‘৭১ এর আমাদের যুক্তিগুলোর সত্যতাই কি ক্রমান্বয়ে এই বাংলাদেশে সত্যে পরিণত হচ্ছে না? যাক অতীত নিয়ে আলোচনা না করে বলেন কেন ডেকে পাঠিয়েছেন? সরাসরি প্রশ্ন করলাম তাকে।

– দেশটাকে বাচাঁতে হবে।

– অবশ্যই। তবে কি করে?

– জনগণের মুক্তি আনা সম্ভব সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই।

– এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। সারাজীবন আপনারা বুর্জুয়া রাজনীতি করে এসে এখন সমাজতন্ত্র করবেন সেটা কি করে সম্ভব? আর জনগণই তা বিশ্বাস করবে কেন? আওয়ামী লীগতো একটা বুর্জুয়া সংগঠন। শেখ মুজিব কেন, কেউই এ দলের মাধ্যমে প্রকৃত সমাজতন্ত্র স্থাপন করতে পারবে না। আপনিও এ সত্য এতদিনে নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হল বাংলাদেশের জনগণের সম্মুখে সমাজতন্ত্রের নামে আপনারা যে বিভীষিকা তুলে ধরেছেন তাতে আগামী ৫০ বৎসরেও সমাজতন্ত্রের কথা শুনলেই এদেশের লোক আতঁকে উঠবে। তাছাড়া গ্রামে- গঞ্জে সাধারণভাবে ঘুরে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার আলোকে বলব আমাদের জনগণ সাম্প্রদায়িক নয় এটা ঠিক; তবে তারা সমভাবেই ধর্মভীরু। আপনারা আপনাদের রাষ্ট্রীয় চার নীতির কোনটাই গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেননি আপামর জনসাধারণের কাছে। বাংলাদেশ বলতে ঢাকা, চিটাগাং বোঝাচ্ছি না, বোঝাচ্ছি ৬৪ হাজার গ্রাম যেখানে বাস করে ৯৫% লোকজন। সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব এ দেশের গণমানুষের কতটুকু উপকার করবে তা জানি না তবে অল্প বিদ্যায় যতটুকু বুঝি এ দেশের লোকজনকে নজর আন্দাজ করার অবকাশ নেই। উপর থেকে তাদের উপর জোর করে কিছুই চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া মানুষ রক্ত মাংসের গড়া। তার জৈবিক এবং বাচাঁর চাহিদার পাশাপাশি মনের এবং আত্মিক চাহিদাও রয়েছে। মানুষ মেশিন নয়। এ সত্য বাদ দিয়ে কিছু করলে সেটা হবে নেহায়েত ক্ষণস্থায়ী। থাক, তা আপনি বলুন আপনার রাজনৈতিক পরিকল্পনা কি? আপনি একজন সুশিক্ষিত সৎ ব্যক্তি। আপনার রাজনৈতিক দর্শনের সাথে একমত না হলেও এতটুকু আস্থা রাখতে পারেন, আমরা আপনাকে একজন ভাল মানুষ বলেই মনে করি। আর একটা কথা আপনাকে স্পষ্ট করে বলতে চাই- বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত আমাদের জন্য যদি কিছু করে থাকে তবে সেটা তার স্বার্থেই সে করেছে। তবুও আমরা তাকে কৃতজ্ঞতা জানাব জাতি হিসাবে। কিন্তু ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কি করে আমাদের সহায়ক শক্তি হতে পারে? সেটাতো তাদের নিজস্ব স্বার্থের পরিপন্থী। এদের প্রতি আপনি দুর্বল এ কথা সবাই জানে। এ ব্যাপারে আপনার কাছ থেকেই আপনার অভিমত আমরা জানতে চাই। আর সমাজতন্ত্রের দর্শন অনুযায়ী এটা কায়েম করা যায় শুধুমাত্র সর্বহারা দলের নেতৃত্বে। আপনার দল কোনটি সেটাও আমাদের জানা দরকার। গম্ভীরভাবে আমার বক্তব্য শুনে যাচ্ছিলেন জনাব তাজুদ্দিন। রাজনীতি নিয়ে এটাই ছিল আমাদের প্রথম বিশদ আলোচনা৷ -রাজনৈতিকভাবে আপনারা সবাই কি এতটা সচেতন?

– সবাই বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন সেটা জানি না, তবে সেনাবাহিনীর একটা বৃহৎ অংশ রাজনৈতিকভাবে অবশ্যই সচেতন।

– খুব খুশি হলাম জেনে। I can see some silver lining over the dark clouds. সমাজতন্ত্রের নীতিতে আমি বিশ্বাসী। তবে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন পদ্ধতি তবে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন পদ্ধতি সব দেশেই সেদেশের বাস্তব পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করেই বের করতে হয়। ভারত একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। তাদের দেশের অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্রের যে প্রভাব রয়েছে সেটা অবশ্যই সোভিয়েত মডেলের নয়। গণতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাসী দেশ ভারত নীতিগতভাবে আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য করেছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বেলায়ও এ কথাই বলা চলে। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সব রকম সাহায্য করে চলেছে। রুশ বিরোধিতার মূলে কাজ করছে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। তাদের এ চক্রান্ত কি দেশের জন্য কোন মঙ্গল বয়ে আনবে?

– দেখেন স্যার, আমি সে সমস্ত মানুষের মনোভাব আপনাকে জানিয়েছি যারা সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এ দু’টো শব্দ ঠিকমত উচ্চারণও করতে পারে না; বোঝাতো দূরের কথা। এ সমস্ত আলোচনাতো শহুরে তথাকথিত বুদ্ধিজীবি সমাজের মাঝেই সীমিত। তারা জনগণের ১ কিংবা ২%ও নন৷ আমরা মনে করি ভারত প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক দেশ নয়। গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে চড়িয়ে সেখানে গত ২৫ বছর ধরে চলেছে এক পার্টির তথা এক পরিবারের শাসন। শ্রীমতি ইন্দীরা গান্ধী ‘অখন্ড ভারত’ নীতির বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছেন। অনেকেই তাকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু আজ কিছুতেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন স্বনির্ভর দেশ হিসাবে viable হয়ে উঠুক সেটা ভারতের কেন্দ্রিয় সরকার কোনমতেই সমর্থন করতে পারে না। পরিবর্তে তারা চেষ্টা করবে আমাদের অর্থনীতিকে ভারতের অর্থনীতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আমাদের উপর তাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে। মানে আমাদের অবস্থা হতে হবে ভুটান বা সিকিমের মত। এতে করে ভারতের অভ্যন্তরে কেন্দ্রিয় শোষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঞ্চলে যে সমস্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অঙ্গার আজ জ্বলে উঠেছে তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যাবে যে, স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উপমহাদেশের কোন জাতির পক্ষেই আজ স্বতন্ত্রভাবে বেঁচে থাকা সম্ভবপর নয়। ভারতের আজ্ঞাধীন হয়েই বেচে থাকতে হবে তাদের। বাংলাদেশকে সব ব্যাপারে তাদের উপর নির্ভরশীল করে তুলতে পারলে ঐ সমস্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়বে। আর আমরা যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে দাড়াতে সক্ষম হই তবে সেই সমস্ত জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অঙ্গার দাবানলে পরিণত হয়ে ভারতকে টুকরা টুকরা করে ফেলবে অল্প সময়ের মধ্যেই। ‘অখন্ড ভারতের’ স্বপ্ন কর্পূরের মত উড়ে যাবে। যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলগুলো আজ ভারতীয় কেন্দ্রিয় দুঃশাসনের নিষ্পেষনে জর্জরিত সেখানে তাদের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হলে আমাদের অবস্থা কি হবে? বরং অধুনাকালে ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা তৈরি আজকের ভারত যদি সনাতন রূপ পরিগ্রহ করে তবেই আমাদের লাভ। শুধু আমাদেরই নয় এ ভূ-খন্ডের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বারও লাভ। বর্হিঃশক্তির শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্য উপমহাদেশের স্বাধীন রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে অখন্ড ভারত সৃষ্টি করার ফলেই আজ বিকশিত হচ্ছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো। এই দ্বন্দ্বের অবসানের মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব এ অঞ্চলে সত্যিকারের স্থিতিশীলতা অর্জন করা। এর কোন বিকল্প নেই। ভারত একটি বহুজাতিক দেশ সেটাই বাস্তবতা৷ আমার বক্তব্য শুনে জনাব তাজুদ্দিন বললেন,

– ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। তার রাজনৈতিক দল হিসাবে জাসদের প্রতি ঈঙ্গিত করলেন তিনি। জবাবে আমি বলেছিলাম,

– জাসদ অবশ্যই আজ সরকার বিরোধী সংগ্রামে একটি অগ্রণী ভূমিকায় আছে। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথাও বলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে আসা এ দল সৃষ্টিকারীরা সত্যিই কি সমাজতন্ত্রী? তাদের নেতৃত্বের প্রায় সবারই আগমন ঘটেছে বুর্জুয়া কিংবা পেটি বুর্জুয়া শ্রেণী থেকে। কতটুকু তারা নিজেদের De-class করতে সক্ষম হয়েছে সেটা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। ঠিক এই মুহুর্তে জাসদকে একটি সর্বহারার দল হিসাবে চিহ্নিত করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এভাবেই সেদিনের বৈঠক শেষ হয়। ভবিষ্যতে আবার আলোচনায় বসবো ঠিক করে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম। তত্ত্বগত দিক থেকে জাসদের নেতৃবৃন্দেরও একটি অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ এবং ভারতকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ বলে মনে করত। তাদের ধারণা অনেকটা জনাব তাজুদ্দিনের মতই। মানে রুশ এবং ভারত বাংলাদেশের গণমুক্তি এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি। কিন্তু জাসদের সাধারণ সদস্যদের বৃহৎ অংশই ছিলেন ভারত বিরোধী। পরবর্তিকালে জাসদের অবক্ষয়ের জন্য অন্যান্য কারণের সাথে এই দ্বন্দ্বটিকেও একটি প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করা চলে। নেতৃবৃন্দের মধ্যেও ভারত নীতি নিয়ে দ্বিমত ছিল সেটাও আমরা জানতাম। সেদিন জাসদের সাথে জনাব তাজুদ্দিনের সম্পর্কের কথা জেনে আমাদের মনে একটি প্রশ্ন বিশেষভাবে দেখা দেয়। তবে কি জাসদ সত্যিই ভারতের ‘বি’ টিম? তাই যদি না হবে, তবে কোন যুক্তিতে জাসদ জনাব তাজুদ্দিনের নেতৃত্ব মেনে নেবে?

এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে হবে। নারায়ণগঞ্জে কর্নেল তাহেরের ওখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম একদিন। তার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করার ফাকে জেনে নেবার চেষ্টা করলাম জনাব তাজুদ্দিনের সাথে জাসদের সম্পর্ক কি? তিনি ব্যক্তিগতভাবে জানালেন যে, জনাব তাজুদ্দিনের সাথে জাসদের কোন সম্পর্ক নেই। এতে ঘটনা আরো ঘোলাটে হয়ে উঠল। হয়তো কর্নেল তাহের এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না কিংবা জাসদের হাইকমান্ডের সাথে কোন গোপন বিশেষ মাধ্যমের সাহায্যে জনাব তাজুদ্দিন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন যা জাসদ নেতৃবর্গের অনেকের কাছ থেকেই গোপন রাখা হয়েছে। আমাদেরই আর একজন জাসদের জনাব শাহজাহানের কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল। জনাব শাহজাহানও একই জবাব দিয়েছিলেন, জাসদের সাথে জনাব তাজুদ্দিনের পার্টিগত কোন সম্পর্ক নেই।

কয়েকদিন পর জনাব তাজুদ্দিনের সাথে আমাদের দ্বিতীয় বৈঠক হয়। সে বৈঠকে ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়েই আলোচনা হয়। আমি গত বৈঠকের জের টেনে বলেছিলাম,

– বাংলাদেশের তিনটি জিনিস ভারত কখনো মেনে নিতে পারবে নাঃ-

১। বাংলাদেশে স্বাধীন অর্থনীতি গড়ে উঠুক।

২। বাংলাদেশে একটি ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম হোক।

৩। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা এক হয়ে একটা ভিন্ন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হোক।

এ ব্যাপারে তার মতামত জানতে চাইলে জনাব তাজুদ্দিন বলেন,

– ভারত উপমহাদেশ তুলনামূলকভাবে একটা পরাশক্তি; এ সত্যকে পরিহার করলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই ভারতের সাথে একটা সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক বজিয়ে চলতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ তিনি নেপালকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,

– নেপালের সাথে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। বিষয়ে ভারতের উপর নির্ভরশীল তাই বলে নেপালের স্বাধীনতা ও হস্তক্ষেপ করেনি। জবাবে আমি বলেছিলাম,

– নেপাল একটি হিন্দু রাষ্ট্র। আমার জানামতে নেপালের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব অত্যন্ত প্রচন্ড। কিন্তু নেপাল ও বাংলাদেশ কি এক? বাংলাদেশ ১০কোটি মুসলমানের দেশ। এটাওতো একটা বাস্তব সত্য। এ জাতি সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে পাকিস্তানের শোষকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতা লাভ করার জন্য; দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়ার জন্য নয়। অস্তিত্ব হবে সম্পূর্ণ এবং প্রকৃত অর্থে স্বাধীন স্বকীয়তায়। সেটাই এদেশের জনগণের আশা ও অঙ্গীকার। জনগণের এ চেতনাকে সাংগঠনিক রূপ দিতে পারলে ভারত যত বড় শক্তিধর হোক না কেন; আমাদেরকে সিকিম বানাতে পারবে কি? ১০কোটি লোককে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলে তাদের সংগঠিত করে যেকোন বর্হিশক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে একটি দুর্ভেদ্য দূর্গে পরিণত করে গড়ে তোলা অবশ্যই সম্ভব এবং সে চেষ্টাই কি করা উচিত নয় প্রতিটি দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিকের?

এর জবাবে জনাব তাজুদ্দিন সাহেব কিছু বলেননি। তার সাথে দু’দিনের আলোচনায় একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা গেল ভারত সম্পর্কে তার একটা বিশেষ দুর্বলতা কিংবা বাধ্যবাধকতা রয়েছে যার বাইরে তিনি যেতে পারছেন না। এই দুর্বলতা কিংবা বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে তিনি কখনোই আমাদের কিছু বলেননি। পরবর্তী বৈঠকগুলোতে আমরাও তাকে আর বিব্রত করিনি ভারত সম্পর্ক উত্থাপন করে।

 

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বস্থানীয় অনেক নেতাই ছিলেন মুজিব বিরোধী

সেনা পরিষদের নেতাদের সাথে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাই মুজিবের শাসন পদ্ধতিতে হতাশ এবং বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। শাসনকার্যে ব্যার্থতা এবং গণবিচিচ্ছন্নতার জন্য তারা যুবনেতাদেরকেই দায়ী করতেন। কিন্তু ঐ সমস্ত যুবনেতাদের দাপটের মুখে মনোভাব প্রকাশ করার সুযোগ কিংবা সাহস কোনটাই তাদের ছিল না। জনাব তাজুদ্দিনের পর তারা আরো অসহায় বোধ করতে থাকেন।

অন্যান্যদের মধ্যে খন্দোকার মোশতাক আহমদ, জনাব কামরুজ্জামান, জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, জনাব এ আর মল্লিক, জনাব এম আর সিদ্দিকী, জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, জনাব রিয়াজউদ্দিন ভোলা মিয়া, জনাব আব্দুল মালেক উকিল, জনাব ফণীভূষন মজুমদার, জনাব মনোরঞ্জন ধর, জনাব ফরিদ গাজী, জনাব আব্দুল মান্নান প্রমুখ সেনা পরিষদের নেতাদের সাথে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতেন।

 

শেখ মুজিবকে কি করে ‘জাতির পিতা’ কিংবা ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যা দেয়া যায়?

শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ফিরিয়ে নেয়া হয়।

ঐতিহাসিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ ধরণের খেতাব অযৌক্তিক বলেই প্রমাণিত হয়।

‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি এবং তার আজীবন ডাকসুর সদস্যপদও বাতিল করা হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। ৩রা জানুয়ারী পল্টন ময়দানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত এক সভায় ইউনিয়নের নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঘোষণা করেন, “দরকার হলে আরো রক্ত দেব৷ তবুও সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় সরকারকে উৎখাত করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবই।” ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি সেলিম ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ থেকে শেখ মুজিবর রহমানকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। এবং সদস্যপদ বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতাটি জনসভায় ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেন ।

রাজনীতির পরিহাস, ১৯৭২ সালের ৬ই মে এই ছাত্রনেতাই শেখ মুজিবর রহমানকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেবার গৌরব অর্জন করেছিলেন। জনাব সেলিম ডাকসুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিও প্রত্যাহার করে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন, “সংবাদপত্র, টিভি ও বেতারে শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহার করা চলবে না৷” তিনি বাড়িতে, অফিস-আদালতে দোকানে টানানো শেখ মুজিবর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলারও আহ্বান জানান। একই দিনে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতা মনি সিং বলেন, “বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ অযোগ্য।” ২রা জানুয়ারী শেখ মুজিবর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি এক বিবৃতিতে বলেন, “পুলিশী হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী যুবলীগ ও বহু দেশপ্রেমিক গ্রুপ সহ জনগণের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিন্দা প্রকাশ করছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি জাতি আজ যখন ঘটনার ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য সরকারের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগকে অভিনন্দিত করছে এসময় জনগণকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করে দিয়ে এক শ্রেণীর অরাজকতা সৃষ্টিকারী পুঁজিবাদের ধারক ও ভাসানীর পরিচালনায় উচ্ছৃঙ্খলতা সৃষ্টিকারী আলবদর, রাজাকার এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্টের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েছে। এই বিশেষ অরাজকতা সৃষ্টিকারী শক্তিগুলো তথাকথিত বিরোধী দলের ছদ্মাবরণে এমন আচরণ প্রদর্শন করছে যা খুবই উস্কানিমূলক এবং তারা দেশের শান্তি বিঘ্নিত করার ষড়যন্ত্র করছে বলে ধরে নেয়া যায়। এসব শক্তি সমাজতান্ত্রিক রীতি নীতির প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রদর্শন করে দু’জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে প্রহার ও একজনকে হত্যা করেছে বলে জানা গেছে। তারা মোজাফফর ন্যাপের অফিসের সামনে ছাত্রলীগের একটি মিছিলের উপরও হামলা চালিয়েছে। তারা তেঁজগাও শিল্প এলাকা ও ঢাকেশ্বরী কটন মিলে খোলা অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়েছে। এমনকি ন্যাপ সভাপতি মোজাফফর আহমদের মতো লোকও ব্যক্তিগতভাবে একটি সংবাদপত্র অফিসে হামলা চালাবার চেষ্টা করেছে।”

৩রা জানুয়ারী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি সম্পাদিত বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ নিবন্ধে বলা হয়, “ঢাকায় ২রা জানুয়ারী পূর্ণ হরতাল পালনের নামে মোজাফফর ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া, মেনন ও মাহাবুবউল্লাহ গ্রুপদ্বয় এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বহিস্কৃত অংশের কর্মী নামধারী ফ্যাসিবাদী গুন্ডারা মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও চকবাজার এলাকায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উপর নগ্ন হামলা চালায়। পাটুয়াটুলী এলাকায় মোজাফফর ন্যাপের গুন্ডারা ছাত্রলীগের আঞ্চলিক শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক জনাব মীর জাহানকে অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরদিন মুজিববাদী ছাত্রলীগ এই হত্যার প্রতিবাদে এক জঙ্গী মিছিল বের করে।”

৩রা জানুয়ারী কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে মুজিববাদী ছাত্রলীগ আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভা ছাত্রলীগ সভাপতি শেখ শহিদুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অশোভনীয় উক্তি উচ্চারণের জন্য ন্যাপ মোজাফফর, জাসদ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের আগামী ৭ই জানুয়ারীর মধ্যে জনতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, “যদি ক্ষমা না চাওয়া হয় তাহলে জনতা ৭ই জানুয়ারীর পর থেকে বাংলার মাটিতে ন্যাপ মোজাফফর, জাসদ ও ছাত্র ইউনিয়নের কোন জনসভা অনুষ্ঠিত হতে দেবে না।” তিনি আরো বলেন, “যেসব লোক মন্ত্রী হবার খায়েসে সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য সরকারের কাছে শতবার তোষামোদ করছেন, তারা এবং তাদের ছত্রছায়ায় থেকে ছাত্র ইউনিয়ন আজ গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অশোভন উক্তি করার সাহস পাচ্ছেন।” তিনি ঘোষণা করেন, “আজ বৃহঃস্পতিবার ৪ঠা জানুয়ারী থেকে যে পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর নামের পূর্ণ মর্যাদা দেবে না সংগ্রামী জনতা বাংলার মাটিতে সেই পত্রিকার অস্তিত্ব রাখবে না।” তিনি আরো বলেন,“বঙ্গবন্ধুকে ডাকসুর আজীবন সদস্য করা হয়েছে ডাকসুর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে। সুতরাং সেখানে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা অন্য কারো নেই। বর্তমান ডাকসু যেহেতু ছাত্রসমাজের মতবিরোধী কাজ করছে এবং তাদের আস্থা ও ভালোবাসা হারিয়েছে তাই এই ডাকুস বাতিল।” ছাত্রনেতারা এই তৎপরতাকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন। ইতিমধ্যে ডাকসু অফিসও তছনছ করে ফেলা হয়।

ঐ দিনই বাংলার বাণীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, শেখ মুজিবের ছবি নামিয়ে ফেলার দায়ে এক ব্যক্তির কান কেটে দেয়া হয়েছে। পরদিন ঐ একই পত্রিকা খবর ছাপে যে, একই কারণে রংপুরে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

 

ভারতের শাসনতন্ত্রের ধারকদের চার নীতির উপর তৈরি ‘মুজিববাদ’ ছিল একটা জগাখিচুড়ি।

ঐ সমস্ত স্ববিরোধী নীতিসমূহ জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। সংক্ষেপে ঐ সমস্ত নীতিগুলোকে তুলে ধরা হল পাঠকদের সুবিধার্থে।

ভারতে দাসখত লিখে দিয়ে, ভারতীয় শাসনতন্ত্রের ভারতীয় শাসনতন্ত্রের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র গলধঃকরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগ সরকার স্ববিরোধী ঐ চার নীতিকে শাসনতন্ত্রের চার স্তম্ভে পরিণত করে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখিত গণবিরোধী নীতিগুলোর ককটেল ফর্মুলা দিয়ে দেশ শাসন করে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা ও সুষম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টার ফলে দেশ ও জাতির অবস্থা কি হয়েছিল সেটা অনুধাবন করার জন্য নীতিগুলোর কিছুটা বিশ্লেষন দরকার। জনাব তোফায়েল আমদের দাম্ভিক বক্তব্য, “সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র একসাথে কায়েম করে মুজিববাদকে বিশ্বের তৃতীয় রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। হবে।” এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞানুযায়ী বলতে হয়, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দু’টো সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দর্শন। গণতন্ত্ৰে মূল প্রেরনা এসেছে মানুষের মৌলিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে। “Man is born free and shall die free.” রাষ্ট্রকাঠামোর Basic structure that is economics এবং super structure that is politics এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের থাকবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, থাকবে তাদের মেধা ও কর্মশক্তির বিকাশের অবাধ পরিবেশ, থাকবে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। এ নীতির উপরই গড়ে উঠেছে পশ্চিমা দেশগুলোর ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও তাদের কৃষ্টি এবং সভ্যতা। বিকশিত হয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। গণতান্ত্রিক সভ্যতার anti thesis হিসেবেই কার্ল মার্কস উপস্থাপন করেন সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক দর্শন। ধনতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরনের Transitionary phase -কে বলা হয় সমাজতান্ত্রিক অধ্যায়। সমাজতন্ত্রকে কার্যকরী করার জন্য কেড়ে নেয়া হয় ব্যক্তি স্বাধীনতা। জাতীয় পরিসরে চাপিয়ে দেয়া হয় একটি বিশেষ শ্রেণীর একনায়কত্ব। রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে উৎপাদন যন্ত্রগুলোর ভাগ্য বিধাতা হয়ে উঠেন দলীয় নেতারা৷ উৎপাদন শক্তির স্বাভাবিক বিকাশের সব সম্ভবনা ও পথ রূদ্ধ করে দেয়া হয়। Incentive হীন উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের মাত্রা কমে যায়। অস্বাভাবিকভাবে মানুষকে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালানো হয় যন্ত্রে। যান্ত্রিক জীবনের বিভীষিকার চাপে জনগণের কর্মস্পৃহা লোপ পায়। সাধারণ জনগণের শ্রমের ফলে অর্জিত সম্পদের ভোগী হয়ে উঠেন রাজনৈতিক পার্টির নেতারা এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আমলাতন্ত্র। জনসাধারনের জীবনযাত্রার মান কমে যায় ক্রমান্বয়ে। ফলে ঘনীভূত হয়ে উঠে সামাজিক ক্ষোভ। তারই বর্হিপ্রকাশ সামাজিক বিপ্লবের স্রোতে ঠুনকো তাসের প্রাসাদের মত ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায় রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সমাজ ব্যবস্থা৷ সমাজতন্ত্রের নিঃসাড়তা আজ বিশ্ব পরিসরে প্রমাণিত হয়েছে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিপর্যয়ের ফলে। সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতারা আজ সমাজতন্ত্রের আদর্শকে আস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির নীতিকে গ্রহণ করে অতীত ভুলেরই শুধু প্রায়শ্চিত্ত করছেন তা নয়; তারা এটাও পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করেছেন গণতন্ত্রকে গ্রহণ করলে সমাজতন্ত্রকে বর্জন করাটা হয়ে উঠে অপরিহার্য। এ দু’য়ের সহাবস্থান বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব। প্রতিটি মানুষ তার আপন স্বাতন্ত্রে বিকশিত। এ প্রাকৃতিক নিয়মকে মেনে নিয়ে গড়ে উঠেছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দর্শন। তাই আজও মানুষের কাছে আবেদন রয়েছে এ দর্শনের। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক নিয়মকে অস্বীকার করে মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা এবং যন্ত্র হিসেবে মূল্যায়ন করার ফলেই সমাজতন্ত্র দর্শন হিসেবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেনি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের জনগণ ও ঠিক একই কারণে মেনে নেয়নি সমাজতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া নীতি। বিশ্বাস করেনি আওয়ামী লীগের জগাখিচুড়ী মুজিববাদী আদর্শের ভাওতাবাজী।

এবার আলোচনা করা যাক ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে। ধর্মনিরপেক্ষতার আক্ষরিক মানেটা আজ অব্দি আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যদি বোঝানো হয় সব ধর্ম থেকে সমদূরত্ব বজিয়ে চলা, তাহলে সেটা হয়ে পড়ে ধর্মহীনতারই শামিল। বর্তমান আধুনিক বিশ্বেও প্রতিটি মানুষ কোন না কোন আদর্শ এবং বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই বেঁচে থাকে। তারা বাঁচার উৎপ্রেরনাও পেয়ে থাকে সে সমস্ত বিশ্বাস এবং আদর্শ থেকে। কেউ কি কোন আদর্শ কিংবা বিশ্বাস ছাড়া এ পৃথিবীতে জীবনধারণ করতে পারে? হয়তো বা পারে। তবে আমার জানা মতে তেমন কোন ব্যক্তির সাক্ষাত আজঅব্দি আমি পাইনি। বিশ্বাস অনেক প্রকার হতে পারে। যেমন:- ধর্মীয় বিশ্বাস, মানবতাবাদ, এথিজম বা নিরশ্বরবাদ, এনিমিজম, পৌত্তলিকতাবাদ প্রভৃতি। যে যাই বিশ্বাস করুক না কেন সেটা ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপার। প্রত্যেকের কাছে তার বিশ্বাস তার জীবন ধর্ম। রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা জণগণের উপর চাপিয়ে দেয়ার অর্থ দাড়িয়েছিল জনগণকে তাদের নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস থেকে জোর করে নিরপেক্ষ রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। এ ধরণের প্রচেষ্টা অবশ্যই মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সরকারিভাবে শাসনতন্ত্রের স্তম্ভ হিসাবে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু উভয় সম্প্রদায়ের লোকের ধর্মীয় চেতনা ও বিশ্বাসের অবমাননা করেছিল। বাংলাদেশের ধর্মভীরু জনতা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের এ অবমাননা কিছুতেই মেনে নেয়নি। প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্ম পালন করার পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে এ দেশের মানুষ চিরকাল। তাছাড়া ধর্মীয় সহনশীলতার এক গৌরবময় ঐতিহ্য বাংলাদেশী জনগণ আদিকাল থেকে বহন করে এসেছে। উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে ধর্মীয় আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক হিংসাত্বক হানাহানি এমনকি ধর্মীয় যুদ্ধও হয়েছে। বর্তমান ভারতেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটছে বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে বিভিন্ন ধর্মের সম্প্রদায় শান্তিতে বসবাস করেছে যুগ যুগ ধরে, নির্ভয়ে, আপন ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে। এটা ঐতিহাসিক সত্য এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গৌরব। এ গৌরবকে কলুশিত করার জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে কায়েমী স্বার্থ এবং রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করেছে অনেকেই। কিন্তু তাদের সব চক্রান্তই ব্যর্থ করে দিয়েছে বাংলাদেশের সচেতন জনতা। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়। ধর্ম বাঙ্গালী মুসলমানদের কাছে শুধুমাত্র একটি আধ্যাত্মিক বিশ্বাসই নয়, ধর্ম হচ্ছে তাদের জীবন আদর্শ (Way of Life)। তারা মনেপ্রানে ধার্মিক কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ইসলাম ধর্মের অনুশাসন তাই তারা পালন করে বিচার বিবেচনা করে। ইসলাম ধর্মে অন্য ধর্মালম্বীদের ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ অধিকার দেয়া হয়েছে শুধু তাই নয়; সংখ্যালঘু ধর্মালম্বীদের প্রতি মুসলমানদের কিংবা মুসলমান রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব সে সম্পর্কেও পরিষ্কার নির্দেশ পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে। সে অবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি শাসনতন্ত্রে গ্রহণ করা ছিল নিঃপ্রয়োজন। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের জীবনধারার আলোকে প্রণীত হবে স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র এটাই ছিল জনতার আশা ও আকাঙ্খা।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতীয় পরিচিতি এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে শোরগোল তুলল। কিন্তু তারা পূর্বতন ঐতিহাসিক বাংলাদেশের এই মানবগোষ্ঠির জাতীয়তার মূল ও ভিত্তি সম্পর্কে কিছুই বলল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সুযোগে অনেকেই আবার সরবে মেতে উঠল। তারা বলে বেড়াতে লাগল, “মুসলিম লীগের দ্বি- জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে যে রাজনীতি উপমহাদেশে সংগঠিত হয়েছিল এবং পরিণতিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল, সেই দ্বি-জাতি তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে।” অর্থাৎ পক্ষান-রে তারা এটাই বলার চেষ্টা করল যে, ১৯৪৮ সালে ভারত বিভক্তি অন্যায়ভাবে করা হয়েছিল।

এ ধরণের উক্তি নেহায়েত অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ ধরণের বক্তব্যে অখন্ড ভারতের প্রবক্তাদের প্রচারণারই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামকালে কংগ্রেস অনুসৃত অখন্ড ভারত এবং মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্ব এই বিষয় দুইটির একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে।

প্রাগঐতিহাসিক যুগ থেকেই এই অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠি তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বাধীনভাবে বসবাস করে এসেছে। শুধুমাত্র বহিরাগত বিজাতীয় শক্তিরাই তাদের শোষণ পাকাপোক্ত করার জন্য অস্ত্রের বলে দেশীও বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই উপমহাদেশে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। বৈদিক যুগে আর্য্য ভাষীদের আগমনের কাল থেকে বৃটিশ ঔপনিবেশবাদের শাসনকাল পর্যন্ত ইতিহাস ঘাটলে এই সত্য অতি সহজেই অনুধাবন করা যায়।

আদিকালের বর্ণ হিন্দুরা রামরাজ্য কায়েমের ধুঁয়া তুলে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি আফগান এবং মুঘল শাসকরাও। একমাত্র বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদই আধুনিক উচ্চতর মানের সমরাস্ত্র এবং বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির বদৌলতে পুরো উপমহাদেশকে একটি প্রশাসনিক রাষ্ট্রের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল। অতএব যুক্তিসঙ্গত কারণেই বলা যায় যে, একক রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক।

উনিশের দশকে বৃটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির আন্দোলন যখন দানা বেধে উঠছিল তখনই পাশ্চাত্য ধ্যানধারণায় দীক্ষিত বর্ণ হিন্দুদের নেতৃত্বে সৃষ্টি করা হয় কংগ্রেস পার্টি বৃটিশ প্ররোচণায়। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন জাতি সত্বার স্বাধীনতার দাবিকে উপেক্ষা করে বৃটিশ সৃষ্ট Indian Union -কে অটুট রেখে স্বাধীনতার পর তাদের ক্ষমতায় বসানো। এর ফলে বর্ণ হিন্দুরা দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন অখন্ড ভারতে রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনা দেখতে পায়। তাদের প্রতি বৃটিশ সহযোগিতার কারণ ছিল মূলতঃ দু’টি।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উপমহাদেশ দখল করতে হয়েছিল মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে। ফলে মুসলমানরা হয়ে উঠে তাদের চোখের বালি। প্রতিহিংসার রোষানলে বৃটিশ সরকার মুসলমানদের ঘৃনা ও সন্দেহ করতে থাকে। পক্ষান্তরে হিন্দুরা বৃটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের সাহায্যই করেছিল মুসলমানদের পরাস্ত করে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে। পুরস্কার স্বরূপ মুসলমানদের ধনসম্পদ হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে বৃটিশ অনুকম্পা ও মদদপুষ্ট হিন্দুরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হয়। মুসলমানরা হয়ে পরে নিঃস্ব ও ক্ষমতাহীন। সুদীর্ঘ দুই’শ বছরের বৃটিশ গোলামীর ইতিহাসে হিন্দু সম্প্রদায় বরাবরই ছিল বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির সহযোগী মিত্রশক্তি আর মুসলমানরা পরিণত হয় নিগৃহ ও করুণার পাত্রে। পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং ধ্যানধারণায় গড়ে উঠা উচ্চবিত্ত বর্ণ হিন্দু সমপ্রদায়ের আনুগত্য সম্পর্কে বৃটিশ শাসক গোষ্ঠি ছিলেন নিশ্চিত (Convinced)। তাই তারা চেয়েছিলেন স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ঐ শ্রেণীকেই অধিষ্ঠিত করতে, যাতে করে সমগ্র উপমহাদেশে তাদের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ কায়েম রাখা সম্ভব হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কংগ্রেসকে জাতীয় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি ছিল তাদের সমগ্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দাবিদার বানাবার পূর্বশর্ত। সেটা অর্জন করার জন্য ধর্মীয় চেতনাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। অতি কৌশলে ‘বন্দে মাতরম’, ‘ভারতমাতা’, ‘হিন্দুস্তান’, ‘জয় হিন্দ’ ইত্যাদি শ্লোগান তুলে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থন ও আনুগত্য লাভ করে কংগ্রেসকে একমাত্র জাতীয় দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ‘নব্য চানক্যরা’। but every action has an equal and opposite reaction. বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলনের গায়ে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী কংগ্রেস যখন হিন্দু ধর্মের নামাবলী একতরফাভাবে চাপিয়ে দিল তখন সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠিগুলো নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে শংকিত হয়ে হয়ে উঠে।

এই অবস্থায় উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্বায় বিভক্ত মুসলমান সম্প্রদায় নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার জন্য ভিন্ন রাষ্ট্রের দাবিতে সোচ্চার হয়ে জোর আন্দোলন গড়ে তোলে। এই প্রেক্ষাপটেই কংগ্রেসের মোকাবিলায় মুসলমানদের দাবিকে রাজনৈতিক রূপ দেবার জন্যই গঠন করা হয়েছিল রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের অখন্ড ভারত তত্ত্বের মোকাবিলায় মুসলিম লীগ প্রচার করেছিল দ্বি-জাতি তত্ত্ব। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান এবং মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান, এই দু’টো দাবিতে হিন্দু-মুসলমান এই দুই ধর্ম গোষ্ঠির মেরুকরণ ভয়াবহ সংঘাতের রূপ ধারণ করে। সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটে দু’পক্ষেই। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হয়েছিল বৃটিশ সরকারকে। তর্কের খাতিরেও যদি ধরে নেয়া হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা দ্বি-জাতি তত্ত্বকে খন্ডিত করেছে তবে যুক্তিগত কারণেই মেনে নিতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অখন্ড ভারত তত্বকেও খন্ডিত করেছে একইভাবে।

কিন্তু আমার মনে হয় ১৯৭১ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের অসাড়তা নয় বরং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে ভারত একটি বহুজাতিক দেশ। একই সাথে এটাও প্রমাণিত হয় যে, শুধুমাত্র বিশেষ একটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে কোন জাতিসত্ত্বা গড়ে উঠতে পারে না। জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে মূল ভূ-খন্ড, ভাষা, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধও একইভাবে প্রভাব রাখে। নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠি, সমপ্রদায়, জাত, কুল নির্বিশেষে যখন কোন জনগোষ্ঠি এক সামগ্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে তখনই জাতীয়তাবাদ প্রাণ পায়। জাতীয়তাবাদ মূলতঃ এক ধরণের অনুভূতি, এক ধরণের মানসিকতা, এক ধরণের জাগ্রত চেতনা, যার সৃষ্টি হয় জনসমষ্টির প্রবাহমান ঐতিহাসিক জীবনধারায়। জাতীয় সংগ্রামের ধারায় গতিশীলতা অর্জন করার জন্য কখন কোন উপাদানটা বিশেষ ভূমিকা রাখবে সেটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সময়, বাস্তব পরিস্থিতি, জনগণের প্রত্যাশা এবং নেতাদের উপর।

অতীত সম্পর্কে গৌরববোধ, বর্তমানের উপভোগ বা বঞ্চনা আর ভবিষ্যতের রঙ্গীন স্বপ্ন জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত করে এবং জনমনে গড়ে তোলে ঐক্যবদ্ধ সুরের মূর্ছনা৷ এ ধরণের ঐক্যবদ্ধ চেতনা যখন কোন জনসমষ্টিকে একত্রিত করে তখন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। সামগ্রিক সত্ত্বা হিসাবে তা বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত হয় আর তারই ফলে একটি জাতি সবরকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আদর্শিক ও দৈহিকভাবে প্রস্তুত হয়।

বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে এখনও প্রচুর বিভ্রান্তির অবকাশ রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ বিভ্রান্তিকে আরো জটিল করে তুলেছেন তাদের ক্ষণস্থায়ী রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য। າ বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য বুদ্ধিজীবিদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রয়োজন তাও প্রায় অনুপস্থিত। পরিষ্কারভাবে সত্যকে আমাদের জানতে হবে। আমাদের জাতীয়তাবাদ কি? বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ? না বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ?

প্রাচীন বঙ্গ অববাহিকা ও তৎসংলগ্ন ভূ-ভাগ যে ভারতীয় উপমহাদেশে একটি প্রাচীন এবং সুপরিচিত স্ব-বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল অঞ্চল ছিল তার অসংখ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে বিধৃত রয়েছে। (খ্রীষ্টপূর্ব ১৪০০-১০০০ সালের মধ্যে) ঐতরেয় অরণ্যকে বঙ্গের কথা রয়েছে। মহাভারত ও হরিবংশেও দেখা যায় বঙ্গ প্রসঙ্গ। সুতরাং বঙ্গ জনপদকে নেহায়েত অর্বাচীন বলে আখ্যায়িত করার কোন কারণ নেই। রামায়নেও বঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে প্রাচীন জনপদ হিসেবে বঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। এ দেশের দু’কুল পাত্রোর্ন ক্ষৌম কার্পাসিক বস্ত্ৰ বয়ন শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল বলেও কৌটিল্য বয়ান করেছেন। বরাহ মিহির (৫০০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দে) তার বৃহৎ সংহিতা গ্রন্থে পূর্বাঞ্চলীয় দেশ অর্থাৎ বঙ্গ দেশ, পরবর্তিকালে বাংলাদেশের অন্তর্গত যে কয়টি জনপদের নাম করেছেন সেগুলো হল: হরিকল, গৌতক, পৌন্ড্র, বঙ্গ, বর্ধমান, তাম্রলিপ্তি, সমতট ও উপবঙ্গ। সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয় যশোর, খুলনা সংলগ্ন দক্ষিন বঙ্গের কিছু অংশকে উপ-বঙ্গরূপে শনাক্ত করেছেন। এ ছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের আর একটি প্রাচীন জনপদ সুহেমুর কথাও ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের এবং আদিকালের বঙ্গ দেশের পশ্চিম এলাকার নাম ছিল সুক্ষ্ম, অঙ্গ, বর্তমান মিথিলা ও কলিঙ্গ উড়িষ্যা প্রদেশের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের তথা বঙ্গ দেশের অন্তর্ভূক্ত ছিল।

হিম যুগের পর থেকে বাংলাদেশ কখনও জনশূন্য থাকেনি। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মানবগোষ্ঠির মতো বাংলাদেশেও আদিম মানব সভ্যতার বিবর্তন ঘটেছিল। কারণ, এখানেও প্রত্ন ও নব্য প্রস্তর এবং তাম্র যুগের অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পোদ, বাউড়ী, কোল, ভীল, মুন্ডা, সাওঁতাল, সাবর, পুলিন্দ, হাড়ি, ডোম, চন্ডাল, রাজবংশী সমুদয় অন্তজ জাতির সমষ্টিই বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীগণের বংশধর। ভাষার ও আকৃতির মূলগত ঐক্য হতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, এই সমুদয় জাতি একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠির বংশধর। এই মানবগোষ্ঠির সাথে অস্ট্রেলিয়ার অদিবাসীদের চেহারার এবং ভাষার মিল পাওয়া গিয়েছিল বলে এদের বলা হয় অস্ট্রো-এশিয়াটিক অথবা অষ্ট্রিক।

বাংলাদেশের দোরগোড়ায় রাজমহল পাহাড়। সেখানে বন-জঙ্গলের অধিবাসী পাহাড়ীদের ছোট্ট- খাট্টো গড়ন, চেহারা, গায়ের রং মিশমিশে কালো, নাক থেবড়া। বেদ এবং নিষাদে যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে হুবহু মেলে সিংহলের ভেড্ডাদের। ফলে এদের নৃ-তাত্ত্বিক নাম হয় ভেড্ডিড। নিষাদ জাতি বলেও তারা আখ্যায়িত হয়েছে। প্রাচীন বাংলাদেশের নানা জায়গায় নানারকম পরিবেশে এবং জল হাওয়ায় নানান দলে ভাগ হয়ে মানুষ বসবাস করত। পরে তাদের রক্তে বহিরাগতদের নানা রক্তের ধারা এসে মিশেছে। বাচঁবার আলাদা আলাদা ধরণের দরুন এবং রক্তের মেশামেশি হওয়ায় স্থানভেদে চেহারায় নানারকম ধাঁচ সৃষ্টি হয়েছে। মনের গড়নে, মুখের ভাষায়, সভ্যতার বাস্তব উপাদানে তার প্রচুর ছাপ আছে। বাংলাদেশের মাটির গুন আর সেই মাটিতে নানা জাতের মেলামেশা এরই মধ্যে বাংলাদেশী জনপ্রকৃতির বৈচিত্র আর ঐক্যের গোড়া খুঁজে পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীগন আর্য্য জাতির বংশগত নন। বাংলা ভাষার বিশ্লেষন করে পন্ডিতগণ এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন। উপরক্ত দ্রাবিড় বা আর্য্য আসলে নরগোষ্ঠির নাম নয়, ভাষাগোষ্ঠির নাম মাত্র। একই নরগোষ্ঠির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার চলন থাকতে পারে। কাজেই শুধুমাত্র ভাষা দিয়ে কোন নরগোষ্ঠির নামকরণ সঠিক নয়।

আসমুদ্রহিমাচল আমাদের এই দেশের নাম বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ। প্রশ্ন দেখা দেয় বাংলা অথবা বাঙ্গালা এবং বাঙ্গালী শব্দের উৎপত্তি হল কি করে? বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় এই সমস্ত শব্দের ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক। জনাব আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বাংলা, বাঙ্গালা, বাঙ্গালী শব্দের উৎপত্তির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা হল:- প্রাচীন বঙ্গ শব্দের সাথে আল শব্দ যুক্ত করে সুলতান শামসুদ্দিন বাঙ্গালী শব্দের চয়ন করেন। আল শব্দের অর্থ পানি রোধ করার ছোট- বড় বাঁধ। অন্যদিকে সুকুমার সেনের অভিমত হল প্রথমে বঙ্গ থেকে বাঙ্গালাহ্র সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম শাসন আমলে পারসিক বাঙ্গালাহ্ উচ্চারণ থেকে পুর্তুগীজরা বানিয়েছে বেঙ্গল এবং ইংরেজদের হাতে পড়ে বঙ্গ পরিণত হয়েছিল বেঙ্গলী বা বাঙ্গালীতে।

বাংলাদেশী জনগণের বাসভূমির রয়েছে একটি ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক সীমানা। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সীমা সংক্ষেপে বলতে গেলে, উত্তরে হিমালয় ও তার গায়ে নেপাল, সিকিম ও ভূটান রাজ্য, উত্তর-পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদ ও উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারভঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সীমান্তবর্তী সমভূমি, পূর্ব দিকে গারো, খাসিয়া, জৈন্তিয়া, ত্রিপুরা, আসাম, চট্টগ্রামের শৈলশ্রেণী বেয়ে দক্ষিনে সমুদ্র পর্যন্ত। পশ্চিমে রাজমহল, সাওঁতাল পরগনা, ছোট নাগপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চলসমূহ, বিহারের বীরভূম, মানভূম, ধলভূম, কেওজ্ঞর, ময়ুরভজ্ঞের অরণ্যময় মালভূমি, দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর। এই সীমারেখার মধ্যেই প্রাচীন বাংলাদেশের বা বঙ্গের গৌড়, পুণ্ড্র, বারেন্দ্র, রাড়, সুহস্র, তাম্রলিপ্ত, সমতট, বঙ্গ, বাঙ্গাল, হরিকল প্রভৃতি জনপদ গড়ে তুলেছিল বঙ্গবাসী বা বাংলাদেশীরা। কোল, ভীল, শবার, পুলিন্দ, হাড়ী, ডোম, চন্ডাল, সাওঁতাল, মুন্ডা, ওরাঁও, ভূমিজ, বাগদী, বাউড়ী, পোদ, মালপাহাড়ী প্রমুখ অস্তজ জনগোষ্ঠির মিলন এবং তাদের রক্তের সাথে বহিরাগত নানা রক্তের ধারা এসে মিশে এক হয়ে সৃষ্টি হয় বঙ্গবাসী অথবা বাংলাদেশী জাতিসত্বার। সময়ের স্রোতে রাষ্ট্র বিধাতাদের হাতে বাংলাদেশীদের আবাসভূমি বাংলাদেশ খন্ড-বিখন্ড হলেও তার ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক সীমারেখা মুছে ফেলতে পারবে না কেউ কোনদিন। রাষ্ট্রীয় সীমারেখা অপরিবর্তনীয় নয়৷ নয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রাচীন বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ জনপদগুলো গড়েছেন। রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন, জন্ম দিয়েছেন বিস্ময়কর সংস্কৃতি ও শিল্প ঐতিহ্যের। এ ঐতিহ্য আমাদের জাতীয় অধিকার। আজ রাষ্ট্রীয় পরিসীমা এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে গোষ্ঠি স্বার্থে অযথা যতই যুক্তিহীন বিতর্কের অবতারনা করা হোক না কেন, বাংলাদেশের সচেতন জনগণকে বোকা বানিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সম্ভব হবে না বেশি দিন। তারা তাদের অতীত ঐতিহ্য এবং ন্যায্য অধিকার ভবিষ্যতে একদিন না একদিন আদায় করে ছাড়বেই ইনশাল্লাহ্। পূর্ণ মর্যাদায় একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে প্রকৃত বাংলাদেশ এবং আমরাও বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সক্ষম হব গর্বিত বাংলাদেশী হিসাবে।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের কোন কোন পর্যায়ে বাংলা ভাষা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এ কথা সত্যি। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বললে সেটা হবে বিভিন্ন নরগোষ্ঠির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাজার বছরের ঐতিহ্যে গড়ে উঠা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উপর একটি ভাষাগোষ্ঠির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা। কারণ, বাঙ্গালী কোন নরগোষ্ঠির নাম নয়, ভাষাগোষ্ঠির নাম মাত্ৰ।

 

আমার প্রাণনাশের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা

উত্তরবঙ্গে কর্মক্ষেত্র পরিদর্শন করতে যাবার সময় ঐ ঘটনা ঘটে।

১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধে সারিয়াকান্দী এবং ধুনটেতে তখন আমাদের প্রজেক্টের কাজ চলছে। একদিন আমার উপর দায়িত্ব পড়ল কিছু মেশিনপত্র নিয়ে প্রজেক্ট পরিদর্শনে যেতে হবে। স্বপন ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে; নূরও বিশেষ একটা কাজে ঢাকাতেই আটকে পড়েছে; তাই বাধ্য হয়েই আমাকে ঐ দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। ট্রাকে মাল ভর্তি করে রওনা হলাম। আমি নিজের গাড়িতেই যাব কারণ আমাকে তাড়াতাড়ি আবার ঢাকায় ফিরতে হবে অন্য আরেকটি কাজে। আরিচা ঘাটে পৌঁছে দেখি ফেরি বিভ্রাট। নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছালাম বেশ রাত করে। রাতে ড্রাইভ করা সেই সময় ছিল বিপদজনক। তাই ঠিক করলাম ঘাটেই রাতটা কাটিয়ে ভোরে রওনা দেব গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। প্রায়ই উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়া-আসা করতে হয় নগরবাড়ি ঘাট দিয়ে। ঘাটের ছাপড়া বেড়ার একটা রেষ্টুরেন্ট বিশেষ পরিচিত। সবসময় এই রেষ্টুরেন্টেই খাওয়া- দাওয়া করে থাকি আমরা যাত্রাকালে। সেই সুবাদে মালিক হাজী সাহেবের সাথে বেশ হৃদ্যতা হয়ে গেছে। আমাদের সবসময় বিশেষ খাতির-যত্ন করে পছন্দমাফিক টাটকা মাছ রেধে খাওয়ান হাজী সাহেব। হাজী সাহেবকে সমস্যাটা বোঝাতে বললাম, “হাজী সাহেব রাতটাতো এখানেই কাটাতে হয় আজ।” হাসিমুখে হাজী সাহেব জবাব দিলেন, “কোন অসুবিধা নাই স্যার। চকি একটা পাইতা দিমু; বিছানাপত্র বাসা থাইকা আইনা দিমু; মশারীও একটা লাগাইয়া দিমু।” রাতের খাবারের পর বাইরে বেরিয়ে দেখি আমার ট্রাক ড্রাইভার এবং অন্য সবাই টুয়েন্টিনাইন খেলছে ট্রাকের পাশেই। ঘুম আসছিল না; ভাবলাম ওদের সাথে কিছুক্ষণ তাসই খেলা যাক। অল্প সময়েই খেলা জমে উঠল। খেলা ভীষণ জমেছে; কথন মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে টেরও পাইনি। হঠাৎ করে ষ্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনতে পেলাম কাছেই। নিরাপত্তার জন্য সবাইকে ট্রাকের নিচে শুয়ে পড়তে বলে নিজেও কাভার নিলাম। ট্রাকের নিচে শোয়া অবস্থা থেকে দেখলাম হাজী সাহেবের রেষ্টুরেন্টকে টার্গেট করেই দু’জন লোক একনাগাড়ে গুলি ছুড়ে চলেছে। পাশে দাড়িয়ে আছে একটা জিপ। মিনিট খানেক গুলিবর্ষণ করে লোক দু’টো জিপে উঠার পর জিপটা উত্তর দিকে চলে গেল। হাজী সাহেবের বাসা দোকানের কাছেই। গোলাগুলির আওয়াজ থামতেই তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে নিয়ে। আমরাও বেরিয়ে এলাম ট্রাকের নিচ থেকে। আমাকে অক্ষত অবস্থায় দেখতে পেয়ে হাজী সাহেব দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বেচারা নিজেকে সামলাতে না পেরে বাচ্চাদের মত কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, “আল্লাহ্ মেহেরবান, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ্।” সত্যিই আল্লাহ্ মেহেরবান। অন্যরা বুঝতে না পারলেও আমি আর হাজী সাহেব ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম কি উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয়েছিল। পরদিন অতি প্রত্যুষে ট্রাক ড্রাইভার ও অন্যদের গন্তব্যস্থানে চলে যাবার নির্দেশ দিয়ে আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। এই ঘটনার ব্যাপারে বিশেষ ঘনিষ্ঠমহল ছাড়া অন্য কারো সাথেই আলাপ করলাম না। এরপর থেকে নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া আমি ঢাকার বাইরে তেমন একটা যেতাম না। বাইরের কাজ দেখাশুনার দায়িত্ব নূর ও স্বপনকেই নিতে হয়।

 

বাকশাল ছিল দু-মুখী অস্ত্র

শেখ মুজিব বাকশালের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেখ মনি এবং তার দোসররা চেয়েছিল বাকশালকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে।

দেশের এই দূরাবস্থায় শেখ মুজিবের ক্ষমতালিপ্সা বেড়ে গেল। ক্ষমতার চূড়ায় অবস্থান করেও তার সন্তুষ্টি ছিল না। রাষ্ট্রের সর্বক্ষমতা তার নিজ হাতে কুক্ষিগত করার জন্য তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি মূল উপাদান ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা এর জন্যই হয়তো বা শেখ মুজিব এতদিন এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। তার এই মনোভাব জানতে পেরে দলীয় সুবিধাবাদী গোষ্ঠি নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য প্ররোচণা দিতে থাকে। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই শেখ মুজিব একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন। নভেম্বর ১৯৭৪-এ মস্কোপন্থী দলগুলোও সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে একদলীয় শাসন কায়েম করার জন্য আহ্বান জানায়। শেখ মুজিবের একান্ত বিশ্বস্ত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মনসুর আলীকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দূতাবাসে ডেকে একদলীয় সরকার কায়েমের পরামর্শ দেয়া হয়। মনসুর আলী, শেখ মনি এবং মস্কোপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্ররোচণা এবং শেখ মুজিবের নিজের ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে তোলার বাসনা ও রাষ্ট্রকে সবদিক দিয়ে তার এবং তার দলের অনুগত রাখার জন্য একদলীয় সরকার কায়েমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসের ১৮ তারিখে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব যখন সংসদীয় দলের মিটিং এ উত্থাপন করা হয় তখন প্রস্তাবটির বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন সংসদীয় দলের বেশিরভাগ সদস্য। এ অবস্থায় মিটিং এ বলা হয়- এই প্রস্তাব এর বিরোধিতা করা হলে শেখ মুজিব পদত্যাগ করবেন নতুবা একটি মেরুদন্ডহীন সংসদ সৃষ্টি করে এ প্রস্তাব পাশ করানো হবে। এই কথা শোনার পর মুজিবের ইচ্ছাকে অনেকটা বাধ্য হয়েই সবাইকে মেনে নিতে হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী জরুরী আইন ঘোষণার মাত্র ২৭দিন পর দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করে এক আদেশ জারি করলেন শেখ মুজিব। সারাজীবন যে শেখ মুজিব গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে এসেছিলেন তিনিই বাংলাদেশে একদলীয় শাসনতন্ত্র কায়েম করে সর্বপ্রথম স্বৈরাতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করেন। বাংলাদেশে একদলীয় শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে দেশের সকল বিরোধী দল বাতিল বলে গন্য হয়।

বাকশাল গঠন করার আগে শেখ মুজিব কোন পদ্ধতিই অনুসরন করেননি। সংসদীয় দলের মিটিংয়ে অনেকেই বাকশাল গঠনের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী ৫৫মিনিট বক্তৃতা করেন। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় শেখ মুজিব প্রমাদ গুনেছিলেন। তার কারণ, এ বক্তৃতাকে সংসদ সদস্যদের বৃহৎ অংশ ঘনঘন করতালির মাধ্যমে সমর্থন জানান। এই বক্তৃতার পর অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা করা হয়। পরদিন জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জনাব শামছুল হকও বক্তৃতা করার অনুমতি চান। কিন্তু তাদের সে অনুমতি না দিয়ে জনাব শেখ মুজিব গম্ভীর স্বরে সবাইকে বলেন, “আর বক্তৃতা নয়। তোমরা আমারে চাও কি না সে কথাই শুনতে চাই৷” সবাই তার এ ধরণের বক্তব্যে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল, সব সদস্যকেই এ প্রস্তাবের উপর বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হবে। তিনি আবার বললেন, “বলো, আমারে চাও কিনা?” এরপর তার বিরোধিতা করার সাহস আর কারো হল না। কিন্তু বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এরপরও তার বক্তৃতায় নির্ভয়ে বলেন, “আমরা ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে মুজিব খানকে চাই না।”

এরপর ২০শে জানুয়ারী বসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংগঠিত সেই কলঙ্কিত অধিবেশন।

২৫শে জানুয়ারী সংসদে কোন রকমের বির্তক ছাড়া গণতন্ত্রকে পুরোপুরি সমাহিত করে পাশ করানো হয় চতুর্থ সংশোধনী। মাত্র এক বেলার সেই অধিবেশনে স্পীকার ছিলেন জনাব আব্দুল মালেক উকিল। এই আব্দুল মালেক উকিলই মাত্র তিন মাস আগে ১৬ই অক্টোবর সংসদ ভবনে পার্লামেন্ট সংক্রান্ত এক সেমিনারে বলেছিলেন, “আমাদের জনগণের জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রই সর্বাপেক্ষা উপযোগী বলে বিবেচিত হয়েছে।” তারই পৌরহিত্যে চালু হয়ে গেল প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। বাতিল করে দেয়া হল সকল বিরোধী দল। পাশ করিয়ে নেয়া হল একদলীয় স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্টকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে শপথ পড়িয়ে নিলেন সেই আব্দুল মালেক উকিলই। ঐ চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা সংসদ সদস্য না হলে ভোট দিতে পারবেন না। প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী সংসদ সদস্য হবেন তেমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। মন্ত্রী পরিষদ রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন, তবে রাষ্ট্রপতি তা কার্যকর করলেন কি করলেন না সে সংক্রান্ত ব্যাপারে আদালতে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। ঐ অধিবেশনে ‘জরুরী ক্ষমতা বিল’ কোন আলোচনা ছাড়াই আইনে পরিণত হয়ে যায়। ২৫শে জানুয়ারী দুপুর ১:১৫ মিনিটে এক সংক্ষিপ্ত অধিবেশনে জারিকৃত চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয়, “এই আইন প্রণয়নের পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে। শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করবেন। এই আইন প্রবর্তনের ফলে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন এমনিভাবে যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধিনেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রপতি ও একজন উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে। তিনি প্রত্যক্ষভাবে অথবা তার অধিনস্থ কর্মচারীর মাধ্যমে যে ক্ষমতা নির্ধারণ করবেন উপ-রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র সেই ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্ব পালনে সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য একটি মন্ত্রী পরিষদ থাকবে। রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কিংবা সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য এরূপ ব্যক্তিদের মধ্য হতে একজন প্রধানমন্ত্রী ও আবশ্যক মনে করলে অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন। প্রত্যেক মন্ত্রী সংসদে বক্তৃতা করতে এবং কার্যাবলীতে অংশ নিতে পারবেন তবে তিনি যদি সংসদ সদস্য না হন তাহলে ভোট দান করতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবেন অথবা তার নির্দেশে উপ-রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী ঐ সভায় সভাপতিত্ব করতে পারবেন। মন্ত্রীগণ রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। সংশোধিত সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেশে শুধু একটি মাত্র রাজনৈতিক দল গঠন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা জাতীয় দল নামে অভিহিত হবে। সংশোধনীতে কার্যভারকালে তার বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন ফৌজদারী কার্যধারা দায়ের করা বা চালু রাখা যাবে না এবং তার গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্য কোন আদালত হতে পরোয়ানা জারি করা যাবে না।” জাতীয় দলের ঘোষণায় বলা হয়, “কোন ব্যক্তি জাতীয় দল ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দল গঠন কিংবা ভিন্ন ধারার কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।”

ঐ সংশোধনীর পক্ষে ২৯৪ জন সাংসদ ভোট দেন। কেউ বিরোধিতা করেননি। সংসদের ২ঘন্টা ৫মিনিট স্থায়ী ঐ অধিবেশনে স্পীকার ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। বিলের বিরোধিতা করে তিনজন বিরোধী ও একজন স্বতন্ত্র সদস্য ওয়াক আউট করেন। এরা হলেন জাসদের আবদুল্লাহ সরকার, আব্দুস সাত্তার ময়নুদ্দিন আহমেদ ও স্বতন্ত্র সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আতাউর রহমান খান আগেই সংসদ অধিবেশন থেকে বেরিয়ে আসেন। বিলটি উত্থাপন করা হলে আওয়ামী লীগের দলীয় চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখার প্রেক্ষিতে কোন প্রস্তাব উত্থাপনের সুযোগ না দেবার আহ্বান জানান। এই পর্যায়ে বাংলাদেশ এই পর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয় লীগের জনাব আতাউর রহমান খান বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করে আলোচনার সুযোগ দানের জন্য স্পীকার জনাব মালেক উকিলকে অনুরোধ করেন। কিন্তু স্পীকার তা নাকচ করে দেন। পরে কন্ঠভোটে চীফ হুইপের প্রস্তাব গৃহিত হয়। তারপর আইনমন্ত্রী মনরঞ্জন ধর সংসদে ‘জরুরী ক্ষমতা বিল ১৯৭৫’ পেশ করেন। চীফ হুইপ এ ক্ষেত্রেও মৌলিক অধিকার স্থগিতকরণ বিধি প্রয়োগ না করার আবেদন জানালে বিষয়টি কন্ঠভোটে পাশ হয়। এখানে একটি বিষয় বিশেষ প্রানিধানযোগ্য। যদিও বিলটি সংসদে বিনা বাধায় পাশ হয়; তবে গণতন্ত্রের বিকল্প একনায়কত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যেও দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়।

পরে জেনারেল ওসমানী ও জনাব ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিরোধিতা করে তাদের সংসদ সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ গণতন্ত্রীমনা নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের এই পদক্ষেপে ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। বাকশাল গঠনের পর দেশের রাজনৈতিক অবস্থার কথা ভেবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্য অন্য কেউই দায়ী নন। স্বয়ং শেখ মুজিবই হত্যা করেছিলেন গণতন্ত্রকে। দেশে একনায়কত্বের বিরুদ্ধে চাপা অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। বাকশাল গঠনের দিন অনেকেই বলেছিলেন, “শেখ মুজিব নিজেই আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিলেন স্বীয় স্বার্থে।” বাকশালের জগদ্দল পাথর বাংলাদেশের মানুষের বুকের উপর এভাবেই চেপে বসল। এ পাথরকে উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত মানুষের নিস্তার নেই। এর পরই সরকারি আদেশ জারি করে আইন বিভাগের স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও জনগণের মৌলিক স্বাধীকার ছিনিয়ে নেয়া হয়।

আওয়ামী লীগের খন্দোকার মোশতাক এবং বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা ও কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন অনেক প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এ সমস্ত তথ্যগুলো ছিল আমাদের পরিকল্পনার জন্য অপরিহার্য। আমরা জানতে পেরেছিলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখরাই ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে কট্টর রুশ-ভারতপন্থী। বাকশালী একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার মূল উদ্দ্যোক্তা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, নজরুল ইসলাম, আব্দুস সামাদ আজাদ, আব্দুর রাজ্জাক, মনসুর আলী, সেরনিয়াবাত, সৈয়দ হোসেন, মনি সিং এবং প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং নিজের অবস্থানকে সুসংহত করার জন্যই শেখ মুজিব এ সমস্ত উচ্চাভিলাসী নেতাদের প্রভাব ও পরামর্শ মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের বলি দিয়ে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার এই হঠকারী সিদ্ধান্তকে আওয়ামী লীগের বৃহৎ অংশই মেনে নিতে পারেনি। শেখ মুজিবের ক্ষমতার প্রতাপের মুখে নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে সেদিন এরা প্রকাশ্য বিরোধিতা না করে নিরব থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের এ সিদ্ধান্তের ফলে সংসদে সেদিন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল গণতন্ত্রীমনা নেতৃবৃন্দ ও সংসদ সদস্যেদের মাঝে। এদের অনেকেই বর্ষীয়ান নেতা খন্দোকার মোশতাকের সাথে আলোচনা করে এ ব্যবস্থার প্রতিকারের রাস্তা খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার কোন পদক্ষেপ নিলে আওয়ামী লীগের এই বৃহৎ অংশের সমর্থন পাওয়া যাবে অতি সহজেই। তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে অভিনন্দন জানিয়ে সমর্থন করবেন এ ধরণের যে কোন পরিবর্তনকে। আর একটি বিষয়ও আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠে সেটা হল আওয়ামী লীগের মধ্যে খন্দোকার মোশতাকের সমর্থন রয়েছে অনেক। তার ব্যক্তিগত প্রভাব ও জনপ্রিয়তা পার্টির নেতা ও কর্মীদের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট।

♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত

♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ

♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার

♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন

♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ

♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার

♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী

♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম

♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান

♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ

♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব

♦ রাষ্ট্রদূত লেঃ কর্নেল (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তম

“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

error: Content is protected !!