ভগবদ্‌গীতা যথাযথ গ্রন্থের পূর্বতন সংস্করণের সাথে যে সমস্ত পাঠক-পাঠিকা পরিচিত আছেন, তাঁদের সুবিধার্থে বর্তমান সংস্করণটি সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্বতন সংস্করণের এবং বর্তমান সংস্করণের বিষয়বস্তু অভিন্ন, তবু উল্লেখযোগ্য এই যে, ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্টের সম্পাদকমণ্ডলী শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের মূল রচনার প্রতি অধিকতর বিশ্বস্ত হওয়ার অভিলাষে তাঁদের মহাফেজখানা থেকে অতি পুরানো পাণ্ডুলিপিগুলি অনুসন্ধান করে বর্তমান সংস্করণটির আদ্যোপান্ত সংশোধন, পরিমার্জন ও সম্পাদনা সম্পন্ন করেছেন।

শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ তাঁর ভারত থেকে আমেরিকায় যাওয়ার দুই বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে ভগবদ্গীতা যথাযথ গ্রন্থের মূল ইংরেজী সংস্করণ ভগবদ্গীতা অ্যাজ ইট ইজ্ সম্পূর্ণ করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে ম্যাকমিলান কোম্পানি ঐ গাঁতার একটি সংক্ষেপিত সংস্করণ প্রকাশ করেন এবং প্রথম অসংক্ষেপিত সম্পূর্ণ সংস্করণটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।

আমেরিকা থেকে গীতার এই ইংরেজী প্রথম সংস্করণটি প্রকাশের আগে শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের নতুন আমেরিকান সুযোগ্য শিষ্যবর্গ পাণ্ডুলিপি ও প্রেসকপি প্রস্তুতির দুরূহ কাজে বহু বাধা-বিঘ্নের মধ্যে দিয়ে শ্রীল প্রভুপাদকে সাহায্য করেছিলেন। টেপরেকর্ডে বাণীবদ্ধ তাঁর ভাষ্য থেকে যাঁরা অনুলিখন করেছিলেন, তাঁরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁর সুদৃঢ় বাচনভঙ্গির ইংরেজী উচ্চারণ অনুধাবনে অসুবিধা বোধ করতেন এবং তাঁর সংস্কৃত উদ্ধৃতিগুলিও তাঁদের কানে অপরিচিত মনে হত। আমেরিকান ভক্তদের মধ্যে সংস্কৃত সম্পাদনার ভারপ্রাপ্ত সকলেই ঐ ভাষায় নিতান্ত প্রাথমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন। তাই, ইংরেজী সংস্করণের সম্পাদকদের যথাসম্ভব সতর্কতার সঙ্গেই পাণ্ডুলিপি ও প্রেসকপি প্রস্তুতির সময়ে অনেক ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য জায়গাগুলিতে বিচ্যুতি স্বীকার করেই যেতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও শ্রীল প্রভুপাদের ভাষ্যরচনা প্রকাশনার কাজে তাঁদের প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছিল এবং ভগবদ্গীতা অ্যাজ ইট ইজ্ সমগ্র পৃথিবীতে বিদগ্ধ মহলে ও ভক্তসমাজে প্রামাণ্য সংস্করণ হয়ে উঠেছে। এই বর্তমান সংস্করণটির জন্য অবশ্য শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্যবর্গ বিগত পঁচিশ বছর যাবৎ তাঁর যাবতীয় গ্রন্থাবলী নিয়ে কাজ করবার সুযোগ পেয়েছেন। ইংরেজী ভাষার সম্পাদকেরা তাঁর দর্শনত্বত্ত্ব ও ভাষাশৈলীর আরও ঘনিষ্ঠ পরিচিতি অর্জন করেছেন এবং সংস্কৃত ভাষার সম্পাদকেরাও ইতিমধ্যে সুযোগ্য ভাষাতত্ত্ববিদ হয়ে উঠেছেন। আর তাই ইংরেজি ভাষায় শ্রীল প্রভুপাদ যখন ভগবদ্গীতা অ্যাজ ইট ইজ্ লিখেছিলেন, তখন যে সমস্ত সংস্কৃত ভাষা তিনি পর্যালোচনা করেছিলেন, সেগুলি সম্পর্কে পাণ্ডুলিপির মধ্যে দুর্বোধ্যতা সম্পাদকদের কাছে এখন সহজবোধ্য হয়ে ওঠে।

তার ফলে এমন এক গ্রন্থাকৃতি পরিণতি লাভ করেছে, যা পূর্বাপেক্ষা অধিকতর সৌন্দর্যমণ্ডিত ও প্রামাণ্য। সংস্কৃত তথ্য ইংরেজী প্রতিশব্দগুলি এখন শ্রীল প্রভুপাদের অন্যান্য গ্রন্থসম্ভারের প্রামাণিকতা অনেক বেশি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করে চলেছে এবং তাই হয়ে উঠেছে অনেক সুস্পষ্ট আর যথাযথ। কোনও কোনও জায়গায় অনুবাদকর্ম যদিও ইতিপূর্বে শুদ্ধভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল, তবু মূল সংস্কৃত ও শ্রীল প্রভুপাদের মূল অনুবাদশৈলীর নিবিড় ভাবানুগ করে তোলার উদ্দেশ্যে তা সযত্নে সংশোধিত হয়েছে। আদি সংস্করণে ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য থেকে অনেক অনুচ্ছেদ বাদ পড়ে গিয়েছিল, সেগুলি বর্তমান সংস্করণে যথাযথ স্থানে পুনরুদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে। আর যে সমস্ত সংস্কৃত উদ্ধৃতির উৎস বিবরণ প্রথম সংস্করণে অনুল্লিখিত ছিল, সেগুলি যথাযথভাবে অধ্যায় ও শ্লোকসংখ্যার পূর্ণ সূত্র উল্লেখসহ এখন উপস্থাপিত হয়েছে।

বর্তমান বাংলা সংস্করণের অন্যতম অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, বাঙালী পাঠকসমাজের সুবিধার্থে প্রত্যেকটি মূল সংস্কৃত শ্লোক বাংলা অক্ষরে উপস্থাপিত হয়েছে এবং তা ছাড়াও, শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ রচিত বহুল প্রচারিত গীতার গান নামক অনবদ্য গ্রন্থখানি থেকে প্রতিটি শ্লোকের বাংলা পদ্যে ভাবানুবাদও শ্লোকগুলির নীচে সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

 

error: Content is protected !!