ভারতের দুই বিখ্যাত জাদুকর গণপতি (চক্রবর্তী) এবং রাজা বোসও বিভিন্ন ধরনের বন্ধনমুক্তির খেলায় ছিলেন প্রবাদপুরুষ। ১৯৭১ সালে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে অনুষ্ঠিত এক জাদু-সম্মেলনে বন্ধনমুক্তির খেলা দেখিয়ে এই দুই জাদুকর দর্শকদের বিস্মিত বিমূঢ় করেছিলেন।
অনুষ্ঠানে গণপতি হাজির করলেন একটি কাঠের বাক্স ও একটি তালা। বাক্স ও তালাটি পরীক্ষা করে যখন দর্শকরা নিশ্চিত হলেন যে, এই দুটির কোনওটিতেই কোনও কৌশল নেই, তখন গণপতিকে বাক্সে ঢুকিয়ে ডালায় তালা বন্ধ করে, বাক্সটাকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছিল, তারপর বাক্সটা ঢেকে দেওয়া হয়েছিল একটা চাদর দিয়ে, অথচ গণপতি অতি দ্রুত বাক্স থেকে বেরিয়ে এসে চাদর ঠেলে, দর্শকদের সাম্নেদ হাজির হয়ে আবার ঢুকে গিয়েছিলেন বাক্সে। দড়ি-দড়া আর তালা খুলতে দেখা গেল গণপতি রয়েছেন বাক্সের ভেতরে।
সেদিন রাজা বোস যা দেখিয়েছিলেন, তা আরও বিস্ময়কর। স্টেজে হাজির করা হল একটা পিপে। পিপের ওপরে ছিল একটা ডালা। সঙ্গে হাজির করা হয়েছিল একটা তালাও। পিপে আর তালা পরীক্ষা করতে অনুরোধ করা হল দর্শকদের। দর্শকরা পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হওয়ার পর জাদুকর রাজা বোস তাঁর এক সহকারীকে পিপেতে ঢুকিয়ে দিলেন। দর্শকরা ডালা বন্ধ করে তালা এঁটে চাবি নিজেদের কাছেই রাখলেন। রাজা বোস এবার ডালার ওপর উঠে বসে একটা চাদর দিয়ে নিজেকে ঢেকে দিয়েই মুহূর্তে চাদরটা ফেলে দিলেন। কি আশ্চর্য! এ তো রাজা বোস নন, এ যে পিপের ভেতরে বন্ধ করে রাখা সেই লোকটি! রাজা বোস তবে কোথায়? পিপের তালা খুললেন দর্শকরা। সেখানে অপেক্ষা করছিল আরও কিছু বিস্ময়। রাজা বোস বসে রয়েছেন পিপের মধ্যে!
বিশ্বখ্যাত জাদুকর পি.সি. সরকারের হাত-পা রেললাইনের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল। ট্রেন তাঁর শরীরের ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তে তিনি নিজেকে লোহার শেকলের বাঁধন থেকে মুক্ত করেছিলেন। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৩১-৩২ সালে চীনে, ট্রেনটা ছিল সাংহাই এক্সপ্রেস।
এযুগের অনেক যাদুকরই এখন নানা ধরনের বন্ধনমুক্তির বা escape’-এর খেলা দেখিয়ে থাকেন। এই আনন্দে দেওয়ার কৌশলগুলোই অসৎ লোকদের হাতে যুগযুগ ধরে লোক ঠকাবার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং যতদিন মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত-বিশ্বাস ও অন্ধ-বিশ্বাস থাকবে, ততদিন এই লোক-ঠকানোর ব্যবসাও চলতেই থাকবে।
হাতে হাতকড়ি লাগিয়ে বস্তা-বন্দী ও তারপর বাক্স-বন্দী করার পর মুহূর্তে নিজেকে মুক্ত করার খেলা অনেক জাদুকরই অতীতে দেখিয়েছেন এবং বর্তমানেও দেখিয়ে থাকেন। হাতে হাতকড়ি পরিয়ে বস্তা-বন্দী করে বস্তার মুখ বেঁধে তারপর বাক্সে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দিতে দর্শকদের লাগে সাধারণ পাঁচ থেকে দশ মিনিট। অথচ বাক্সটা তিরিশ সেকেন্ডের মতন অস্বচ্ছ মশারিতে বা চাদরে আড়াল করলেই জাদুকর সমস্ত বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে মশারি বা চাদর ঠেলে মুখ বের করেন। বিস্ময়কর এই ঘটনা দেখার পর দর্শকরা অনেক সময় জাদুকরকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বা পিশাচ-সিদ্ধ বলে মনে করেন। এমনই এক ধারণা প্রবলতর
হয়েছিল জাদুকর গণপতি চক্রবর্তীকে ঘিরে। এই ধরনের বন্ধন মুক্তির খেলায় অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে বহু জাদুকরই দর্শকদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অদ্ভুত সব যুক্তিহীন ধারণা। কেউ বা মনে করেন – ব্যাপারটা পুরোপুরি গণ-সম্মোহন, আবার কেউবা ভাবেন – ওদের একটা অলৌকিক ক্ষমতা নিশ্চয়ই আছে।
বাস্তবে এই ধরনের প্রতিটি বন্ধন মুক্তিই ঘটানো হয়ে থাকে নেহাতই লৌকিক কৌশলের সাহায্যে।
দর্শকদের একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে, হাতকড়ি বা পায়ের বেড়ি খোলার চাবি ব্যাঙ্ক-লকারের মতনই আর দ্বিতীয় হয় না। না, তা নয়। সব হাতকড়ি আর পায়ের বেড়ির চাবি একই। দু’জোড়া কিনলেই হাতে চলে আসে একটা অতিরিক্ত চাবি। এই অতিরিক্ত চাবিই জাদুকর নিজের হাতকড়ি খুলতে কাজে লাগান।
যে রাস্তায় বন্ধ করা হয়, সেই বস্তার তলায় এমন ধরনের সেলাই দেওয়া থাকে যাতে বস্তা-বন্দী জাদুকর বস্তার ভেতরে হাত বুলোতেই সেলাই চটপট খুলে যায়।
জাদুকরের পোশাকের আড়ালে থাকে একটা মুখ-বাঁধা বস্তা। সেলাই-খোলা বস্তাটি পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে নিয়ে বাক্সে ফেলে রাখেন মুখ-বাঁধা বস্তাটা।
এবার বাঁকি শুধু কাঠের সিন্ধুক থেকে বেরিয়ে আসা। এতটা শোনার পর বুদ্ধিমান পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বাক্সে কোনও একটা গোপন দরজা থাকে, তবে সাধারণ চোখে এই দরজার অস্তিত্ব বোঝা বা খোলা সম্ভব হয় না।
দেখলেন তো, এতক্ষণ বিখ্যাত সব জাদুকরদের যে-সব খেলাগুলোর কথা শুনে বিস্মিত হয়ে ভাবছিলেন, সত্যিই কি এগুলো লৌকিক কৌশলে করা সম্ভব? সেগুলোরই মূল কৌশলটা কত সোজা। এই কৌশলই একটু অদল-বদল করে বিভিন্ন জাদুকররা বন্ধন-মুক্তির খেলা দেখান, আর ঠকবাজেরা লোক ঠকায়।