আজ আমরা জানি মহাবিশ্ব বিশাল, অনন্ত অসীম, এবং সম্প্রসারণশীল, অর্থাৎ প্রতিমুহূর্তে বেড়ে চলছে মহাবিশ্ব। মহাবিশ্বের কথা ভাবলেই এক অনন্ততার মধ্যে হারিয়ে যাই আমরা; তবে মহাবিশ্ব কোনো অতীন্দ্রিয় অতিপ্রাকৃত ব্যাপার নয় । মানুষের চোখে চিরকাল মহাবিশ্ব এতো বিশাল, এমন অসীম ছিলো না; অনন্ত মহাবিশ্ব আধুনিক কালের আবিষ্কার । মহাবিশ্বের ধারণাটিও আধুনিক কালের। পুরোনো কালের মানুষের কাছে বিশ্ব ছিলো এক বদ্ধ, সীমিত, আজকের মহাবিশ্বের তুলনায় খুবই ছোটো এলাকা, যার কথা ভাবলে আজ আমাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তারা মনে করতো তারা আছে পৃথিবীতে, আর পৃথিবী হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র, তাই তারা আছে বিশ্বের কেন্দ্রে, আর তাদের ঘিরে ঘুরছে সূর্য, চাঁদ, তারার বিভিন্ন গোলক বা ঢাকনা । তাদের পক্ষে এটা ভাবা যে খুব অস্বাভাবিক ছিলো, তা নয়; তারা পুথিবী সম্পর্কেই জানতো খুব কম, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতো গোলাকার ঢাকনার মতো আকাশ ঘিরে আছে তাদের। তারা আকাশে যা-কিছু দেখতে পেতো, এবং দেখতে পেতো না, তার সবই ব্যাখ্যা করতো ধর্মীয় পুরাণের সাহায্যে, এবং ভুল করতো, কেননা ধর্মীয় বিশ্বাস দিয়ে কিছুই ব্যাখ্যা করা যায় না, শুধু ভয় আর লোভ দেখানো যায় । এমন ভুলে ভুলে কেটে গেছে হাজার হাজার বছর। সত্য বের করা ও ব্যাখ্যার জন্যে দরকার বিজ্ঞান, অন্য কোনোভাবে প্রকৃতির সত্য বের করা সম্ভব নয় । খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিকরা প্রথম বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে বিশ্ব সম্পর্কে ধর্মীয় পুরাণের ব্যাখ্যা থেকে; তারা বুঝতে চায় বিশ্ব কী, কেমন তার গঠন, কীভাবে চলছে তার ক্রিয়াকলাপ। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কেউ হঠাৎ কোনো কিছু বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা ক’রে উঠতে পারে না; গ্রিকরাও পারে নি। তারা গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি দেখেছে, এবং বিভ্রান্ত হয়েছে; তারা কল্পনা করেছে এমন এক বিশ্ব, যার কেন্দ্রে রয়েছে পৃথিবী। পৃথিবী হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র, বিশ্ব ভূকেন্দ্রিক, গ্রিকরাই প্রথম সৃষ্টি করে এই ধারণা; আর তাদের এই ধারণা অনুসারে বিশ্বের রূপ কল্পনা করে পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম। ভূকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা চূড়ান্ত রূপ পায় পুরোনো মিশরের জ্যোতির্বিদ ক্লদিয়াস টলেমির ভূকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামোতে । তিনি এতো সফল হয়েছিলেন যে তাঁর বিশ্বকাঠামো ভুল হওয়া সত্ত্বেও দেড় হাজার বছর তাঁর বিশ্বকাঠামো সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তোলে নি।
পুরোনো কালের মানুষের কাছে আকাশমণ্ডল ছিলো বিস্ময়কর অলৌকিক এলাকা, কিন্তু গ্রহনক্ষত্র তাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে ছিলো নিবিড়ভাবে, গ্রহনক্ষত্র অনেকটা ছিলো তাদের পরিবারের শক্তিমান অভিভাবক সদস্য। এখন গ্রহনক্ষত্রের কথা ভাবতে হয় না আমাদের, শহরের মানুষ আকাশের দিকে না তাকিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়; কিন্তু তাদের ভাবতে হতো প্রতিদিন, আকাশের দিকে না তাকিয়ে তাদের পক্ষে জীবনযাপন করাই ছিলো অসম্ভব । এখন দিন, মাস, ঋতু, ঝড়, বৃষ্টি, ও আরো বহু কিছু সম্পর্কে সংবাদ পাই আমরা বই পত্রিকা পঞ্জিকা থেকে, কিন্তু পুরোনো কালের মানুষের কাছে আকাশই ছিলো ঘড়ি আর দেয়ালপঞ্জিকা । খ্রিপূ ১৬০০ সালের দিকে বেবিলনিরা প্রথম তৈরি করেছিলো তারা বা নক্ষত্রের তালিকা, এবং গ্রহগুলোর কীভাবে চলাফেরা করে, তারও হিশেব রাখতে শুরু করেছিলো তারা। বেবিলনের জ্যোতির্বিদেরা ছিলো পুরোহিত, তাই তারা বিজ্ঞানীর মতো বিশ্ব বর্ণনা না ক’রে বর্ণনা করেছিলো পুরোহিতের মতো ধর্মীয়ভাবে, এবং সিদ্ধান্তে পৌচেছিলো যে দেবতারা সৃষ্টি, বিন্যাস ও চালায় জগত। বেবিলনের জ্যোতির্বিদ-পুরোহিতেরা গ্রহনক্ষত্র বর্ণনা করতে পারতো, কোনটি কখন কোথায় থাকবে সে-সম্পর্কেও পারতো ভবিষ্যদ্বাণী করতে; কিন্তু গ্রহনক্ষত্রগুলো কেনো ঘুরছে, কেনো যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, তার কোনো প্রাকৃতিক কারণ তারা ব্যাখ্যা করে নি । তাদের কোনো তত্ত্ব ছিলো না, তারা ছিলো পর্যক্ষেক, বর্ণনাকারী। বিজ্ঞানে শুধু পর্যবেক্ষণ ও বর্ণনা করলেই চলে না, তত্ত্ব তৈরি ক’রে ব্যাখ্যা করতে হয় । এই তত্ত্ব তৈরির কাজ প্রথম শুরু করে গ্রিকরা। তারা বেবিলনিদের মতো গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে নি, কিন্তু তৈরি করে বিশ্বের একধরনের জ্যামিতিক কাঠামো। বেবিলনিরা গ্রহনক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করলেও তারা বিশ্ব ব্যাখ্যা করেছে পৌরাণিক উপকথার সাহায্যে; গ্রিকদেরও পুরাণের অভাব ছিলো না, তবে তারা বিশ্বের রূপ বোঝার জন্যে তৈরি করে বিশ্বকাঠামো। গ্রিক জ্যামিতিবিদ পিথাগোরাস (আনুমানিক খ্রিপৃ ৫০০) প্রথম তৈরি করেন একটি বিশ্বকাঠামো, যাতে দেখা যায় বৈজ্ঞানিক বিশ্বকাঠামো তৈরির প্রথম চেষ্টা।
জ্যামিতিবিদ পিথাগোরাসই সবার আগে প্রস্তাব করেন যে পৃথিবী গোলাকার ও বিশ্বের কেন্দ্র। পরে তাঁর অনুসারীরা তাঁর বিশ্বকাঠামোটিকে একটু অদ্ভুতভাবে বদলে দেন; তাঁরা তৈরি করেন এমন এক গোলাকার বিশ্বকাঠামো, যার মাঝখানে রয়েছে এক কেন্দ্রীয় আগুন, তবে ওই আগুনটা সূর্য নয়, এটা এক কল্পিত আগুন; এ-আগুনকে ঘিরে ঘুরছে পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, আর গ্রহগুলো। কীভাবে ঘুরছে? এদের প্রত্যেকের জন্যে রয়েছে একটি ক’রে গোলক; আর এসব গোলকের একেবারে বাইরে রয়েছে ঢাকনার মতো নক্ষত্রের গোলক, যার ওপর স্থিরভাবে লাগানো আছে নক্ষত্রগুলো। তাঁদের মতে নক্ষত্রের গোলকটি ভেতরের অন্য গোলকগুলো নিয়ে প্রত্যেক দিন ঘোরে পুব থেকে পশ্চিমে; আর গ্রহদের গোলকগুলো ঘোরে পশ্চিম থেকে পুবে। এই বিশ্ব গোলকের পর গোলক দিয়ে আটকানো এক বদ্ধ এলাকা। গোলকগুলো হচ্ছে গোলাকার ঢাকনার ওপর গোলাকার ঢাকনা।

পিথাগোরাসীয়দের বিশ্বকাঠামো এর পর পড়ে প্লাতোর (খ্রিপূ ৪২৮-৩৪৮) হাতে। দার্শনিক প্লাতো মুগ্ধ ছিলেন জ্যামিতিক সৌন্দর্যে, তাই তিনি চান জ্যামিতিকভাবে সুন্দর এক বিশ্বকাঠামো। প্লাতো আর প্লাতোনীয়রা জ্যামিতিকে উন্নীত করেছিলেন ধর্মের স্তরে। প্লাতোর ভাববাদী দর্শনে বিমূর্ত জ্যামিতিক আকৃতিগুলোই হচ্ছে বিশ্ব, আর বাস্তব বস্তুগুলো ওই সব বিশুদ্ধ আকৃতির বিকৃত ছায়া। দর্শন খুব চমৎকার জিনিশ, কিন্তু শুরু থেকেই দর্শন বাঁধিয়েছে নানা গোলমাল, সৃষ্টি করেছে নানা ধাঁধা; অনেক অসত্যকে মানতে বাধ্য করেছে সত্য ব’লে। যেমন প্লাতোর ভাববাদ সম্পূর্ণ ভুল- তাঁর ভাববাদে আদর্শলোকে রয়েছে সব কিছুর আদর্শ সত্য রূপ, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা ওই সত্যের বিকৃত নকলমাত্র; এটা খুবই বাজে কথা, কিন্তু আজো অনেক মানে প্লাতোর এই ভুল ভাববাদ। প্লাতো বাইরে বেরিয়ে গ্রহনক্ষত্র দেখতে পছন্দ করতেন না, কিন্তু নক্ষত্রের সৌন্দর্যের স্তব করতেন না দেখেই। প্লাতো একটি বিশুদ্ধ জ্যামিতিক বিশ্বকাঠামো চান, কিন্তু তিনি জ্যামিতিবিদ ছিলেন না; তাই বিশুদ্ধ জ্যামিতিক কাঠামো গঠনের ভার দেন তিনি ইউডোক্সাসের (থ্রিপৃ ৩৭০) ওপর। ইউডোক্সাসের কাজ হয় এমন একটি বিশ্বকাঠামো তৈরি করা, যা হবে একই সাথে দার্শনিকভাবে তৃপ্তিকর ও বাস্তবসম্মত । ইউডোক্সাস কল্পনা করেন এক বিশ্বকাঠামো, যার কেন্দ্রে রয়েছে গোলাকার স্থির পৃথিবী, এবং তাকে ঘিরে আছে সমকেন্দ্রিক গোলকের পর গোলক । বেশ অসুবিধায় পড়েন ইউডোক্সাস, কেননা অল্প সংখ্যক গোলক দিয়ে বিশ্বের দৃশ্যমান বাস্তব রূপ ঠিক মতো বর্ণনা করা সম্ভব নয় । পৃথিবী থেকে ইউডোক্সাস যা কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন আকাশে, সে-সব কিছুর চলাচল বর্ণনার জন্যে তিনি ২৭টি গোলক বিন্যাস করেন পৃথিবী ঘিরে। খুবই জটিল ও অতৃপ্তিকর হয়ে ওঠে ইউডোক্সাসের গোলকের বিশ্ব।
ইউডোক্সাসের জটিল বিশ্বকাঠামোও ব্যর্থ হয় দূরের আকাশের অনেক ঘটনা ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে । তখন নতুন, তৃপ্তিকর, বিশুদ্ধ বিশ্বকাঠামো তৈরির জন্যে এগিয়ে আসেন আরেক দার্শনিক- আরিস্ততল (খ্রিপূ ৩৮৪-৩২২)। আরিস্ততল জ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু বহু ভুল জ্ঞানেরও জনক তিনি, আর তাঁর ভুল জ্ঞানকে পরম জ্ঞান মনে ক’রে প্রায় দু-হাজার বছর ধ’রে মেনে চলেছে মানুষ, এবং আটকে থেকেছে আরিস্ততলের শেকলে । বিশ্বকাঠামো তৈরিতেও তিনি ভুল করেন, বিশ্বের একটি ভুল রূপ তুলে ধরেন তিনি বিশ্বের সামনে, কিন্তু তাঁর ভুলকেই সত্য ব’লে মেনে নেয় সবাই; এমনকি ধর্মের তিনটি প্রধান বইও তাঁর বিশ্বকাঠামোকেই বিধাতার বিশ্বকাঠামো ব’লে চালিয়ে দেয়। তাঁর বিশ্বকাঠামো বিজ্ঞান না থেকে হয়ে ওঠে অটল ধর্মীয় বিশ্বাস। আরিস্ততল বিশ্বকাঠামো তৈরি করার জন্যে সঙ্গী হিশেবে নেন কালিপ্পাসকে, এবং তাঁরা ইউডোক্সাসের বিশ্বকাঠামো ভিত্তি ক’রে তৈরি করেন এক সুন্দর কিন্তু মহাভুল বিশ্বকাঠামো। আকাশমণ্ডল নামক বইতে তিনি বর্ণনা করেন তাঁর বিশ্বকাঠামো, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে বিভ্রান্ত করতে থাকে মানুষকে। আরিস্ততল ইউডোক্সাসের বিশ্বকাঠামোতে আরো ২৮টি গোলক যুক্ত করেন, তাঁর কাঠামোতে গোলকের সংখ্যা হয়ে ওঠে ৫৫; কিন্তু তারপরও তাঁর বিশ্বকাঠামো বিশ্বকে ঠিক মতো ব্যাখ্যা করতে পারে না। এতে তিনি অস্বস্তি বোধ করেন, কিন্তু সুখী বোধ করেন যে তাঁর বিশ্বকাঠামো দার্শনিকভাবে খুবই তৃপ্তিকর আরিস্ততল তাঁর বিশ্বকে ভাগ করেন দুটি এলাকায়; একটি বিশুদ্ধ আকাশমণ্ডল, আরেকটি দূষিত ভূমণ্ডল । তাঁর দু-এলাকা চলে দু-রকম নিয়মে, আকাশ চলে আকাশের অজর সূত্রে, পৃথিবী চলে পৃথিবীর সূত্রে। চাঁদের নিচ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত এলাকা আরিস্ততলের চোখে বিকার, দূষণ, পরিবর্তনের এলাকা; আর চাঁদ থেকে ওপরের এলাকা হচ্ছে অবিকার, শুদ্ধতা, শাশ্বতের স্বর্গীয় এলাকা, যা গঠিত এক অজর স্বচ্ছ স্ফটিকজাতীয় পদার্থে। তাঁর মতে অজর আকাশমণ্ডলে গোলকগুলোর কাজ হচ্ছে ঘোরা । গ্রহগুলো কক্ষপথে ঘুরছে এজন্যে বল প্রয়োগের দরকার নেই । তাঁর বিশ্বেও শেখ গোলকটি হচ্ছে নক্ষত্রের গোলক; এবং তাঁর মতে ওই গোলকের পর আর কিছু থাকতে পারে না, এমনকি কোনো শূন্যতাও থাকতে পারে না । তাঁর বিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে স্থির, অচল, নিশ্চল পৃথিবী- ভুল বিশ্বের ভুল কেন্দ্রমণি।
পৃথিবী কি সত্যিই বিশ্বের কেন্দ্র, আর বিশ্ব একটির পর একটি গোলকের পর গোলক দিয়ে আবদ্ধ ছোটো এলাকা? এমনকি আরিস্ততল বললেও? একজন বলেন সম্পূর্ণ অন্য রকম কথা; তিনিও গ্রিক, তবে দার্শনিক নন, জ্যোতির্বিদ, তাঁর নাম আরিস্তারকাস (খ্রিপূ তৃতীয় শতক)। বিখ্যাত নন তিনি প্লাতো আর আরিস্ততলের মতো, এই রহস্যময় পৃথিবীতে কতো ভুল ব্যক্তি বিখ্যাত হয় আর অখ্যাত থাকেন শুদ্ধরা; আরিস্তারকাসই প্রথম প্রস্তাব করেন যে বিশ্বের কেন্দ্র পৃথিবী নয়, সূর্য। আরিস্তারকাস সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের প্রথম প্রস্তাবকারী; এ-প্রস্তাব তিনি করেছিলেন কোপারনিকাসের সতেরো শো বছর আগে। তিনি বলেন সূর্য ঘোরে না পৃথিবীর চারদিকে, বরং পৃথিবীই ঘোরে সূর্যের চারদিকে। তিনি অনেক এগিয়ে ছিলেন তাঁর সময়ের থেকে; তাঁর প্রস্তাব মানার মতো প্রস্তুতি ছিলো না তাঁর সময়ের। যুগে যুগে দেখা গেছে যে মানুষ মিথ্যেকে মেনেছে সত্য ব’লে, আর সত্যকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে প্রচণ্ডভাবে । আরিস্তারকাসের প্রস্তাবও তাঁর সময় গৃহীত হয় নি, বরং আক্রান্ত হয়েছে। তাঁর বিরোধীরা যুক্তি দেয় যে পৃথিবী ঘুরতেই পারে না, ঘুরলে মানুষ এক জায়গায় লাফ দিলে পড়তো অন্য জায়গায় গিয়ে, আর আরিস্ততল বলেছেন যে পৃথিবী ঘোরে না, তাই পৃথিবী ঘোরে না । আরিস্ততলের প্রভাব এতো বেশি ছিলো যে আরিস্তারকাসের বিজ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায় পৃথিবী থেকে। এক অসামান্য জ্যোতির্বিদ ছিলেন আরিস্তারকাস, কিন্তু হারিয়ে যান তিনি প্রতাপশালী আরিস্ততলের ভুল দর্শনের অন্ধকারে।

আরিস্তারকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্ব গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি, তবে আরিস্ততলের ভূকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামোও ঠিকমতো কাজ করছিলো না; তাই জ্যোতির্বিদেরা ভূকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামোকে সংশোধনের পর সংশোধন এবং আবার সংশোধন করতে থাকেন, ক্লান্তিহীনভাবে কাঠামোতে জুড়তে থাকেন পরিবৃত্তের পর পরিবৃত্ত (এপিসাইক্যলঃ কোনো বিন্দুকে ঘিরে বৃত্তাকার কক্ষপথ, যে-বিন্দু নিজেই ঘোরে অন্য কোনো বিন্দুকে ঘিরে) আর উৎকেন্দ্রিক বৃত্তের পর উৎকেন্দ্রিক বৃত্ত (এক্সেন্ট্রিকঃ বিশ্বের কেন্দ্র থেকে কোনো ঘূর্ণমান গোলকের কেন্দ্রের স’রে যাওয়া); এই সংশোধন চূড়ান্ত রূপ পায় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে মিশরের নীল নদের তীরের জ্যোতির্বিদ ক্লদিয়াস টলেমির গ্রিক ভাষায় রচিত গাণিতিক বিন্যাস নামক রচনায় । তাঁর রচনা আরব জ্যোতির্বিদরা অনুবাদ করেন আলমাজেস্ত বা সর্বশ্রেষ্ঠ’ নামেঃ এবং এ-নামেই এটি পরিচিত। টলেমি কঠোর পরিশ্রমী জ্যোতির্বিদ ছিলেন, তবে মাঝেমাঝে তথ্য চেপে যেতেন ছিমছাম বিশ্বকাঠামোর প্রয়োজনে। তাঁর বিশ্বকাঠামো ভুল ছিলো, কিন্তু এটি দিয়ে কাজ হতো: গ্রহনক্ষত্র প্রভৃতির পরিক্রমা এটা মোটামুটি ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারতো। তাহলে ভুল জিনিশ দিয়েও কাজ চলে! টলেমি শুরুতেই ধ’রে নেন যে পৃথিবী গোলাকার, এটা বিশ্বের কেন্দ্ৰ, এটি অচল, এর কোনো গতি নেই; আর এটা নক্ষত্রের গোলকের থেকে আকারে অনেক ছোটো । টলেমির বিশ্ব ভূকেন্দ্রিক । তাঁর বিশ্বকাঠামো কাজ করে, কিন্তু এতে সমস্যার অভাব নেই । সমস্যাগুলো খুবই জটিল; ওই জটিল সমস্যাগুলো সমাধান করতে গিয়ে টলেমি জটিল থেকে জটিলতর ক’রে তোলেন তাঁর বিশ্বকাঠামো। এটা করা খুবই দরকার ছিলো, কেননা তাঁর বিশ্বকাঠামোকে ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে হয় দৃশ্যমান আকাশমণ্ডলকে, গ্রহনক্ষত্রের ঘোরাঘুরি, এগোনো পেছোনোকে; আর মেনে চলতে হয় প্লাতোর একটি নির্দেশ । প্লাতো ব’লে গেছেন ‘প্রতিভাসকে বাঁচাও’, অর্থাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে যা-কিছু চোখে দেখা যায়, সে-সব রক্ষা করতেই হবে বিশ্বকাঠামোতে; তাই জটিল হয়ে ওঠে তাঁর বিশ্ব।

টলেমির বিশ্বকাঠামো ভূকেন্দ্রিক, তিনি মেনে নিয়েছিলেন আরিস্ততলকে যে বিশ্বের কেন্দ্রে আছে স্থির নিশ্চল অচল পৃথিবী । পৃথিবী ঘুরতে পারে না, ঘুরলে মানুষেরা তা টের পেতো; তাহলে অ্যাথেন্স নগরের লোকেরা ঘণ্টায় হাজার মাইল বেগে পুব দিকে ছিটকে পড়তো, সব সময় প্রবল ঝড় বইতো পৃথিবীতে, অলিম্পিক খেলোয়াড়রা সামনের দিকে লাফ দিয়ে গিয়ে পড়তো পেছনে; তাই পৃথিবী ঘুরতে পারে না, পৃথিবী অচল অটল স্থির, তাই পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্র! তাত্ত্বিক বা দার্শনিক দিকে তাঁর কিছু করার ছিলো না, সেগুলো ক’রে গেছেন দার্শনিক আরিস্ততল, কেননা দার্শনিকেরাই পারেন পরম সত্য বের করতে- তবে চরম মিথ্যেই তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করেছেন বেশি; টলেমির কাজ ছিলো আরিস্ততলীয় দর্শন মেনে গ্রহনক্ষত্রের পরিক্রমা ঠিকঠাকভাবে নির্দেশ করা । ভুল বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের রূপ দিতে গেলে যে-বিপদে পড়তে হয়, টলেমি পড়েছিলেন সেই বিপদে।
টলেমি মেনে নিয়েছিলেন আরো একটা গ্রিক বিশ্বাস যে আকাশমণ্ডলের জিনিশগুলো ঘোরে বিশুদ্ধ গতিতে। বিশুদ্ধ গতি হচ্ছে সুষম গতি, আর বিশুদ্ধ বক্ররেখা হচ্ছে বৃত্ত; তাই টলেমির বিশ্বাস ছিলো যে আকাশমণ্ডলে গ্রহগুলো ঘোরে সুষম বৃত্তাকার গতিতে । এ-ধারণাটি প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন প্লাতো । কিন্তু বিপদ হচ্ছে পৃথিবীকে কেন্দ্র ধ’রে সুষম বৃত্তাকার গতিতে গ্রহগুলোর গতি নির্দেশ করতে গেলে দেখা যায় ওগুলো বেশ অবাধ্য, ওগুলো এমন সুষম বৃত্তাকার গতিতে ঘোরে না । গ্রহগুলো কখনো ঘোরে দ্রুত কখনো ধীর গতিতে; আবার কখনো কখনো মনে হয় সেগুলো যেনো এক জায়গায় থেমে থাকছে, বিশ্রাম নিচ্ছে, তারপর যাচ্ছে পেছনের দিকে। বিশুদ্ধ আকাশমণ্ডলে ঘটছে এমন অশুদ্ধ কাণ্ড। গ্রহদের পেছনের দিকের গতিকে বলা হয় ‘প্রতীপগতি’, অর্থাৎ পেছনের দিকে গতি । দার্শনিকেরা গ্রহদের বিশুদ্ধ ভাবলেও তাদের ক্রিয়াকলাপ ততোটা বিশুদ্ধ নয়, গুগুলো প্লাতো আরিস্ততলের বিশুদ্ধতার দর্শন ও জ্যামিতির বিশুদ্ধ বৃত্তের কথা জানে না । জ্যোতির্বিদের শুধু মনগড়া দর্শনে চলে না; তাঁকে চলতে হয় গ্রহনক্ষত্রদের পথে, তবে প্রতাপশালী দর্শনকে পুরোপুরি ছেড়ে দিলেও চলে না। বিশ্ব ভূকেন্দ্রিক, গ্রহগুলো সুষম বৃত্তাকার পথে ঘুরছে পৃথিবীকে ঘিরে, কখনো থামছে, থেমে পেছনের দিকে যাচ্ছে, তারপর আবার এগোচ্ছে সামনের দিকে, এসব জটিল ব্যাপার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টলেমি তাঁর বিশ্বকাঠামো জুড়ে বিন্যাস করেন চাকার ভেতর চাকা বা গোলকের ভেতর গোলক। তাঁর বিশ্বে পৃথিবীকে ঘিরে গ্রহগুলো ঘোরে একটি ছোটো বৃত্তে, এর নাম এপিসাইক্যল বা পরিবৃত্ত; আবার পরিবৃত্তের কেন্দ্রটি ঘোরে পৃথিবীকে ঘিরে একটি বড়ো বৃত্তে, এর নাম ডেফারেন্ট বা বৃহৎ বৃত্ত । গ্রহগুলো শুধু পাক খায় আর পাক খায়, এক ধরনের পাক খেতে খেতে আরেক ধরনের পাক খায় । বৃত্তগুলোর আকার আর গ্রহগুলোর গতি বাড়িয়ে কমিয়ে টলেমি অধিকাংশ গ্রহের গতি নির্দেশ করেন তাঁর বিশ্বে, আকাশমণ্ডল হয়ে ওঠে অজস্র ঘূর্ণমান চাকার বিশাল কারখানা; এবং সম্পূর্ণ ভুল হওয়া সত্ত্বেও টলেমির ভূকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামো ১৪০০ বছর ধ’রে গণ্য হয় নির্ভুল ধ্রুব ব’লে । কিন্তু এটি সম্পর্কে সন্দেহ যে ছিলো না, তা নয় । একটি চমৎকার গল্প প্রচলিত আছে যে ত্রয়োদশ শতকে কাস্তিলের রাজা আলফনসো বুঝতে চেয়েছিলেন টলেমির বিশ্বকাঠামোটি; তাঁকে এটা বোঝানোর পর এর অবিশ্বাস্য জটিলতায় বিমূঢ় হয়ে রাজা আলফনসো বলেছিলেন, বিশ্ব সৃষ্টির সময় তিনি যদি থাকতেন, তাহলে তিনি কিছু সুপরামর্শ দিতেন বিধাতাকে!
ইউডোক্সাস, আরিস্ততল, আর টলেমির ভূকেন্দ্রিক বিশ্ব আজকের মহাবিশ্বের তুলনায় ছিলো খুবই ছোটো; তবে এগুলোর মধ্যে টলেমির বিশ্বই সবচেয়ে বড়ো । টলেমি বিশ্বকে খুবই বড়ো মনে করতেন, অন্তত তাঁর সময়ে যতোটা বড়ো মনে করা বিশ্বাসযোগ্য ছিলো; তাঁর ধারণা ছিলো তাঁর বিশ্বের তুলনায় পৃথিবী একটি বিন্দুর সমান মাত্র। তাঁর কালের মানদণ্ডে টলেমি বিশ্বের সীমা খুবই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যখন জ্ঞানীরা ও সাধারণেরা গ্রহনক্ষত্রগুলোকে বেশ ছোটো আকারের জিনিশ ব’লেই মনে করতো, এবং বিশ্বাস করতো ওগুলো বেশি দূরের বস্তু নয়, আছে কয়েক মাইলের মধ্যেই। হেরাক্লিতাস আর লুক্রেতিয়াস মনে করতেন সূর্য আকারে একটা ঢালের সমান; আর আনাক্সাগোরাস যখন বলেন সূর্যটা আকারে পেলোপোনেসাসের থেকে বড়ো, তখন অধার্মিকতার অপরাধে তাঁকে নির্বাসিত করা হয়েছিলো দেশ থেকে । কেনো পুরোনো কালের জ্ঞানীরা ও সাধারণ মানুষেরা বিশ্বকে ছোটো মনে করতো? এর মূলে কাজ করেছে তাদের বদ্ধমূল ধারণা যে পৃথিবী নিশ্চল আর আছে বিশ্বের কেন্দ্রে । যদি পৃথিবী না ঘোরে, তাহলে নিশ্চয়ই তারাগুলো ঘোরে; আর তারাগুলোকে এক দিনে ঘুরে আসতে হয় পৃথিবীর চারদিকে । যদি তারাদের গোলক বড়ো হয়, তাহলে তাকে ঘুরতে হয় অত্যন্ত দ্রুতবেগে, যতো বেশি বড়ো হবে ঘুরতে হবে ততো দ্রুত গতিতে । যদি বিশ্ব খুব বড়ো হয়, তাহলে তারার গোলককে ঘুরতে হয় অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে । টলেমি যে-বিশ্বকাঠামো তৈরি করেন, তার ব্যাসার্ধ মোটামুটিভাবে পাঁচ কোটি মাইল, আর তাঁর তারার বৃত্তকে ছুটতে হয় ঘণ্টায় এক কোটি মাইল বেগে; এটা খুবই দ্রুত গতি; আর যদি তাঁর বিশ্ব হতো এর একশো গুণ বড়ো, তাহলে তাঁর তারার গোলককে ঘুরতে হতো আলোর গতির থেকেও দ্রুতবেগে। এতো দ্রুত ঘোরা সম্ভব নয়, তাই ইউডোক্সাস, আরিস্ততল ও টলেমিকে কল্পনা করতে হয়েছিলো একটা ছোটো বদ্ধ শ্বাসরুদ্ধকর বিশ্ব। তবে টলেমি বিশ্বকে অনেক গুণে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অন্যদের থেকে, কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বের তুলনায় সেটি একটি বিন্দুমাত্র, এবং ভুল বিন্দু। মহাবিশ্বের ধারণা তখনো তৈরি হয় নি।
টলেমি ভুল বিশ্বকাঠামো তৈরি করেছিলেন, কিন্তু প্রতারণা করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো না; তাঁর পর যদি খ্রিস্টান ধর্মান্ধদের ক্রোধে জ্ঞানের বিকাশ থেমে না যেতো, দিকে দিকে পুড়িয়ে না মারা হতো জ্ঞানকে, তাহলে হয়তো কোনো জ্যোতির্বিদ দু-এক শতকের মধ্যেই তৈরি করতেন নতুন বিশ্বকাঠামো। হয়তো তা হতো আরিস্তারকাসের অনুসরণে সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামো। কিন্তু তখন পশ্চিমে ঘনিয়ে আসে খ্রিস্টধর্মের অন্ধকার, ধর্মান্ধরা শুরু করে কোলাহল, তাদের ক্রোধে নিষিদ্ধ হয়ে যায় সব ধরনের জ্ঞানচর্চা, মূর্খরা হাত বাড়ায় জ্ঞানীদের মুণ্ডের দিকে, পশ্চিমে শুরু হয় দীর্ঘ অন্ধকার মধ্যযুগ। খ্রিস্টধর্মের মহাসন্তরা বলতে থাকে পার্থিব জ্ঞান তুচ্ছ, দরকার শুধু মহান অপার্থিব জ্ঞান। ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান ধর্মান্ধরা ধ্বংস করে আলেকজান্দ্রিয়ার সারাপিউম জ্ঞানকেন্দ্র; ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে তারা খুন করে আলেকজান্দ্রিয়ার নারী জ্যামিতিবিদ বিজ্ঞানী হাইপাতিয়াকে, মিছিল ক’রে এসে তাঁকে টেনে রাস্তায় নামিয়ে ঈশ্বরের নামে ছিঁড়েফেড়ে ফেলে তাঁর পোশাক, ন্যাংটো ক’রে ছিন্নভিন্ন করে তার সুন্দর দেহ; ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ান বন্ধ ক’রে দেয় প্লাতোর একাডেমি । ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের উত্থান ঘটে জ্ঞানকে ধ্বংস ক’রে; গভীর অন্ধকার নেমে আসে পশ্চিমে,- আলেকজান্দ্রিয়া ও রোম থেকে জ্ঞানীরা পালিয়ে যেতে থাকেন বাইজেন্টিয়ামে।
৬৪০ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা আলেকজান্দ্রিয়া জয় করে; তাদেরও জ্ঞানের আগ্রহ ছিলো না; রাজ্য, জয়, আর ক্ষমতার উল্লাসে তারা পুড়িয়ে দেয় আলেকজান্দ্রিয়ার মহাগ্রন্থাগার, নষ্ট হয়ে যায় অনেক মূল্যবান গ্রিক বই ও জ্ঞান । ৭৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানি হয় বাগদাদ; অনেক প্রমোদের পর ও মধ্যে জ্ঞানের পিপাসা জাগে মুসলমান রাজপুরুষদের মনে, তাঁরা অনুবাদ করাতে শুরু করেন গ্রিক জ্ঞানের বই । পশ্চিমে তখন জ্ঞান চর্চার দায়িত্ব নেন মুসলমান পণ্ডিতেরা, তাঁরা চর্চা করতে থাকেন গ্রিক জ্ঞান; তবে এই জ্ঞানীদের অধিকাংশই লাঞ্ছিত হন গোড়া ধর্মান্ধদের হাতে, কেননা ওই জ্ঞানীরা বিশেষ ধার্মিক ছিলেন না। জ্যোতির্বিদ্যাও মুসলমান জ্ঞানীদের চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে, অনেক নক্ষত্রের নাম রাখেন তাঁরাই; যেমন, অ্যালডেবরন তারার নাম এসেছে আরবি আল দাবারন থেকে, যার অর্থ ‘অনুসরণকারী, বাঙলায় এর নাম ‘রোহিণী’; রিগেল-এর নাম এসেছে রিজল জউজাব আল ইউসরা থেকে, যার অর্থ ‘জউজার বা পা’; ডেনেব-এর নাম এসেছে আল ধানব আল দাজাজব থেকে, যার অর্থ ‘মুরগির লেজ’। তাঁদের অনুবাদ থেকেই ইউরোপ আবার ফিরে পায় গ্রিক জ্ঞান।
আরব জ্যোতির্বিদেরা কোনো নতুন বিশ্বকাঠামো তৈরি করেন নি, তাঁরা প্রশ্ন করেন নি, তাঁরা মুগ্ধ ও বিশ্বাসী ছিলেন টলেমির বিশ্বকাঠামোতে; ওটিকে তারা একটি বিমূর্ত জ্যামিতিক কাঠামো মনে না ক’রে মনে করেছেন বাস্তব সত্য ব’লে, যেনো সত্যিই গোলকগুলো ঘুরছে আকাশে; তাঁদের কাছে ওটি হয়ে ওঠে একক বিধাতার বিশ্বকাঠামো । জ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে তাঁরাও মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেন একটি ভুল বিশ্বকাঠামো, বলতে থাকেন সাত আসমান দশ আসমানের কথা । আসমানগুলো আর কিছু নয়, গুগুলো টলেমির গোলকগুচ্ছ। খ্রিস্টানদের মধ্যে জ্ঞান সাধনার শেষ চেষ্টা করেছিলেন আঙ্কিয়াস বোয়েথিউস; কিন্তু ৫২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুদণ্ডিত হন, এবং জ্ঞানের শেষ শিখাটি নিভে যায় পশ্চিমে। তারা ভুলে যায় কোণ কাকে বলে, ত্রিভুজ কাকে বলে; মূর্খ ধর্মযাজকেরা বলতে থাকে যে আকাশ একটা তাঁবু, আর গ্রহগুলোকে ঠেলছে ঈশ্বরের দেবদূতেরা, তাই এগুলোর গতিবিধি জ্যামিতি দিয়ে পরিমাপ করার বিষয় নয়; তাদের ধর্মের বই বলে সূর্যের নিচে আর নতুন কিছু নেই । এতো দিন পৃথিবী গোলাকার ছিলো, কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মযাজকেরা ধর্মের হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে সেটিকে চ্যাপ্টা ক’রে তোলে, চ্যাপ্টা ক’রে তোলে মহান সূর্যকেও। আকাশের পেছনে তারা রাখে শাশ্বত স্বৰ্গকে, যেখানে ঢোকা সম্ভব শুধু মৃত্যুর পরে । অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বে।
এক হাজার বছর কেটে যায় অজ্ঞানতার অন্ধকারে (৫০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দ). ইউরোপ জুড়ে রাজত্ব করে মধ্যযুগ: তারপর জ্ঞানের শিখা জ্বলতে শুরু করে ষোড়শ শতকে ইউরোপে। পুবে তো জ্ঞানের শিখা আজো ভালোভাবে জ্বলে নি।
১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি পোলান্ডে জন্ম নেন আধুনিক বিশ্বকাঠামোর প্রথম প্রস্তাবকারী মিকোলাই কোপারনিক, যিনি বিশ্ব জুড়ে বিখ্যাত তাঁর নামের লাতিন রূপ নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) নামে । তিনি সূর্যকেন্দ্ৰিক বিশ্বকাঠামোর জনক; মানুষ হিশেবে বিপ্লবী না হ’লেও তিনি ঘটান একটি বিপ্লব, – ‘কোপারনিকি বিপ্লব’, যা বিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেয় পৃথিবীকে, সেখানে প্রতিষ্ঠিত করে সূর্যকে । বিশ্বের রূপ তিনি বদলে দেন; বিশ্ব তাঁর কাঠামোতে হয়ে ওঠে সৌরজগত, যার কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য, যাকে ঘিরে ঘুরছে পৃথিবী আর বিভিন্ন তিনি সূচনা করেছিলেন এক মহাবিপ্লবের, যা চলে দেড়শো বছর ধ’রে (১৫৪০-১৬৯০); এ-বিপ্লবে প্রধান ভূমিকা পালন করেন পাঁচজন বিজ্ঞানীঃ কোপারনিকাস, টাইকো ব্রাহে, কেপলার, গ্যালেলিও, এবং নিউটন। এর ফলে চিরকালের জন্যে বদলে যায় বিশ্বের রূপ, বদলে যায় মানুষের বিশ্বচিন্তার কাঠামো, মানুষ হয়ে ওঠে ভিন্ন মানুষ; আমরা বদ্ধ বিশ্ব থেকে এগোতে থাকি অনন্ত মহাবিশ্বের দিকে।

কোপারনিকাস পড়াশুনো করেন ইতালিতে- ক্র্যাকাও, বোলোগ্না ও পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে; শিক্ষার্থী থাকার সময়েই তিনি আলোড়িত হ’তে থাকেন সেখানকার নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা দিয়ে । তিনি জড়িত হন কয়েকজন জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদের সাথে, এবং চব্বিশ বছর বয়সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এক অসাধারণ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের, দেখতে পান চাঁদের ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে আলডেবরন তারাটি । এছাড়া তিনি অজস্র রূপে ও পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ করেন সূর্যকে: নিজে যন্ত্র তৈরি ক’রে দেয়ালে সূর্যের ছায়া ফেলে দেখেন সূর্যের রূপ; এবং নিশ্চিত হন যে টলেমির বিশ্বকাঠামো ভুল । কয়েক বছর পর তিনি একটি চাকুরি পান ক্যাথিড্রালে। একত্রিশ বছর বয়সে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন এক বিরল ব্যাপার, কর্কট তারামণ্ডল বা রাশিতে একই সঙ্গে দেখতে পান তাঁর সময়ে পরিচিত পাঁচটি গ্রহ ও চাঁদকে। কিন্তু সেটা মিলছিলো না তাঁর সময়ের বিশ্বকাঠামোর সাথে তিনি – দেখেন টলেমির বিশ্বকাঠামো এ-সম্পর্কে ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। কোপারনিকাস নানাভাবে গ্রহদের গতিবিধি বিশ্লেষণ করতে থাকেন; এবং বুঝতে পারেন অনেক সরল হয়ে উঠবে বিশ্বকাঠামো আর গ্রহদের গতিবিধি নির্দেশ করা যাবে অনেক সহজে যদি সূর্যকে বসানো হয় সৌরজগতের কেন্দ্রে । তখন পৃথিবী আর বিশ্বের কেন্দ্রে থাকবে না, সেটিও হবে একটি গ্রহ, এবং অন্য গ্রহগুলোর মতোই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে নিজের কক্ষপথে। ভুল মহিমার অবসান ঘটবে পৃথিবীর!
১৫১২ খ্রিস্টাব্দে নিজের বিশ্বকাঠামো সম্পর্কে একটি ছোটো রচনা লিখে সেটি কোপারনিকাস প্রচার করেন পরিচিতদের মধ্যে। একে তিনি বলেন ‘গ্রহদের নৃত্যনাট্য’ । এ-বিশ্বকাঠামোতে সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্র, গ্রহগুলো প্রদক্ষিণ করে সূর্যকে, আর তারাগুলো আছে অনেক অনেক- অকল্পনীয় দূরে। কোপারনিকাস তাঁর রচনা বেশি লোকের মধ্যে প্রচার করেন নি; কিন্তু তাঁর পরিচিতরা ভয় পান যে এটা মহাবিপর্যয় বাঁধাবে, প্রচণ্ড ধাক্কা দেবে মধ্যযুগকে। কোপারনিকাস গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন, কিন্তু বিতর্ক সৃষ্টি হবে ব’লে ভয় পান, বিরত থাকেন বই প্রকাশ থেকে; উনিশশতকে ডারউইনও তাঁর মতো ভয়ে বই প্রকাশে দেরি করেছিলেন । তখন খ্রিস্টান যাজকেরা ছিলো অত্যন্ত শক্তিশালী, বাইবেলের বিশ্বাস থেকে একটু স’রে গেলেই তারা লোকজনকে পুড়িয়ে মারতো ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে। তাঁর ছোটো রচনাটি অনেক বছর পর চোখে পড়ে বিটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-জন জ্যোতির্বিদের রেটিকাস ও রেইনহোল্ডের; তাঁদের মুগ্ধ করে কোপারনিকাসের বিশ্বকাঠামো। তখন কোপারনিকাস বৃদ্ধ, অসুস্থ, সত্তরের মতো বয়স; রেটিকাস এসে দেখা করেন কোপারনিকাসের সাথে। কোপারনিকাস তাঁকে দেখান তাঁর সারাজীবনের গবেষণার ফল যে-বই, তার অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, যার নাম দ্য রেভোলিউশনিবাসঃ প্রদক্ষিণ সম্পর্কে।
রেটিকাস কোপারনিকাসকে অনুরোধ করেন বইটি প্রকাশের জন্যে । অনেক জটিলতার পর ১৫৪৩-এর এপ্রিলে বেরোয় বইটি। তখন কোপারনিকাস হুদরোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী । জুন মাসে তিনি মারা যান, মৃত্যুর আগে তাঁর হাতে বইটি তুলে দেয়া হয়েছিলো, তবে নিজের বই তিনি প’ড়ে যেতে পারেন নি। নামও বদলে গিয়েছিলো বইয়ের; কোপারনিকাস নাম রেখেছিলেন দ্য রেভোলিউশনিবাস বা ‘প্রদক্ষিণ সম্পর্কে’, কিন্তু বইটি বেরোয় দ্য রেভোলিউশনিবাস অবিউম কোয়েলিস্তিউম (গগনমণ্ডলের গোলকসমূহের প্রদক্ষিণ সম্পর্কে) নামে । বইটির শুরুতে একটি অস্বাক্ষরিত মুখবন্ধও ছাপা হয়; মুখবন্ধে বলা হয় গ্রহদের অবস্থান নির্ণয়ের জন্যে বইটি সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের একটি নতুন প্রকল্পমাত্র; এটা সত্য নয়, অনুমান, কেননা জ্যোতির্বিদ্যা নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারে না । মুখবন্ধটি কোপারনিকাস লেখেন নি, তিনি জানতেনও না যে এমন একটি মুখবন্ধ থাকবে তাঁর বইয়ের শুরুতে । মুখবন্ধটি বাতিল করে দেয় বইটির প্রস্তাব, এ থেকেই বুঝতে পারা যায় কী ধর্মীয় বিভীষিকার মধ্যে বের করতে হয়েছিলো এই বই; স্বীকার ক’রে নিতে হয়েছিলো যে জ্যোতির্বিদ্যা সত্য জানে না, সত্য জানে শুধু বাইবেল। দ্য রেভোলিউশনিবাস প্রকাশের পর বহু বছর সবাই মনে করেছে মুখবন্ধটি কোপারনিকাসেরই লেখা, আর তিনিই ব’লে গেছেন তাঁর প্রস্তাবের পেছনে কোনো সত্য নেই। পরে আরেকজন জ্যোতির্বিদ, ইয়োহানেস কেপলার, আবিষ্কার করেন যে ওই মুখবন্ধটি লিখেছিলেন অ্যান্ড্রু অসিঅ্যান্ডার নামে একজন ধর্মযাজক । অসিঅ্যান্ডারের উদ্দেশ্য অবশ্য খারাপ ছিলো না; তিনি বইটির ছাপা দেখাশুনো করছিলেন, এবং বুঝতে পেরেছিলেন বইটির শুরুতে এমন একটি অস্বীকারপত্র না থাকলে প্রোটেস্ট্যান্টরা এ-বই প্রকাশ করতে দেবে না। বইটির নামও হয়তো তিনিই বদল করেছিলেন, যাতে মনে হয় যে কোপারনিকাস গগনমণ্ডলের গোলকগুলোর প্রদক্ষিণের কথা বলছেন, পৃথিবীর প্রদক্ষিণের কথা বলছেন না। ধর্ম এভাবেই সত্যকে প্রতিরোধ করে তার অন্ধতা দিয়ে; ধর্মের অন্ধ ভুল বিশ্বাস কয়েক হাজার বছর ধ’রে, এবং আজো, সন্ত্রস্ত ক’রে রাখছে সত্যকে।

কোপারনিকাস দ্য রেভোলিউশনিবাস-এ মোটামুটিভাবে পাঁচটি মূলকথা বলেন। প্রথমটি হচ্ছে সূর্যকে ঘিরে ঘোরে আকাশমণ্ডলের গোলকগুলো, অর্থাৎ গ্রহগুলো, তাই সূর্য বিশ্বের কেন্দ্র; দ্বিতীয়টি হচ্ছে পৃথিবী থেকে সূর্য যতো দূরে তার চেয়ে অজস্র গুণ দূরে রয়েছে স্থির নক্ষত্রের গোলক, অর্থাৎ তারাগুলো আছে বিপুল সুদূরে; তৃতীয়টি হচ্ছে আকাশের বস্তুগুলোকে যে প্রতিদিন ঘুরতে দেখা যায়, তার কারণ নিজের অক্ষরেখা ঘিরে পৃথিবী ঘোরে প্রতিদিন; চতুর্থটি হচ্ছে পৃথিবী সূর্যকে বছরে একবার প্রদক্ষিণ করে ব’লে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সূর্যই ঘোরে, আর পঞ্চমটি হচ্ছে গ্রহগুলোর প্রতীপগতির গ্রহগুলো যে মাঝেমাঝে পেছনের দিকে ঘুরছে ব’লে মনে হয়, তার কারণ হচ্ছে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর গতির সাথে গ্রহগুলোর গতির পার্থক্য । তিনি বলেন এসব অনেকের কাছে মনে হ’তে পারে অবোধ্য ও প্রচলিত বিশ্বাসের বিরোধী, তবে তিনি তাদের কাছে এটা সূর্যের থেকেও স্পষ্ট ক’রে তুলবেন, বিশেষ ক’রে তাঁদের কাছে যারা কিছুটা গণিত বোঝেন।
কিন্তু কী ক’রে তিনি এটা স্পষ্ট করবেন মূঢ় একবইয়ের পাঠক জোব্বাপরা সুবিধাভোগী ধর্মযাজকদের কাছে? বইটি প্রকাশের পর বেশ একটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেহেতু ধর্মান্ধরা কখনোই বৈজ্ঞানিক সত্যকে সহজে মেনে নেয় না । তখন যাজকেরা ও অধিকাংশ পণ্ডিতই মনে করতো যে পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্র। ধর্মের পাণ্ডারা উত্তেজিত হ’তে থাকে; আর অনেক আগে, ১৫৩৯-এ, প্রোটেস্ট্যান্ট ধারার প্রবর্তক মার্টিন লুথার, যে ছিলো উগ্রভাবে প্রতিক্রিয়াশীল, কোপারনিকাসকে তিরস্কার ক’রে বলেছিলো, ‘ওই আহাম্মকটা জ্যোতির্বিদ্যাকে সম্পূর্ণ উল্টে দিতে চায়… কিন্তু পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আমাদের বলেছে যে জশুয়া সূর্যকে স্থির হয়ে থাকতে আদেশ করেছেন, পৃথিবীকে নয়।’ খ্রিস্টধর্মের এক বড়ো পির ও পাণ্ডা ক্যালভিন এ-বই বেরোনোর পর ক্ষেপে বলে, ‘পবিত্র আত্মার কর্তৃত্বের ওপর কে প্রতিষ্ঠা করবে ওই কোপারনিকাসের কর্তৃত্ব?’ কোপারনিকাসের ভাগ্য ভালোই, দ্য রেভোলিউশনিবাস প্রকাশের পর যে-উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তার শিকার হ’তে হয় নি কোপারনিকাসকে; তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন দ্য রেভোলিউশনিবাস প্রকাশের মাসখানেকের মধ্যেই মৃত্যুবরণ ক’রে । কিন্তু বইটির প্রকাশ ও কোপারনিকাসের মৃত্যুর পাঁচ দশক পর এ-বইয়ের জন্যেই ধর্মান্ধদের হাতে প্রাণ হারাতে হয় জিয়োরদানো ব্রুনোকে। ব্রুনো প্রবক্তা হয়ে ওঠেন কোপারনিকাসের বিশ্বকাঠামোর, এবং একে তিনি সম্প্রসারিতও করেন। তিনি বলেন তারাগুলো আসলে সূর্যের মতোই জিনিশ; আর সেগুলোকে ঘিরে হয়তো ঘুরছে অনেক গ্রহ । ১৫৯২ সালে ইতালির ধর্মীয় বিচারসংস্থা বেঁধে ফেলে ব্রুনোকে; এবং আট বছর ধ’রে ব্রুনোর মতবাদ বিচার ক’রে ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডিত করে পুড়িয়ে মারে ব্রুনোকে । পুড়িয়ে মারাই খ্রিস্টানদের রীতি ছিলো, রক্তপাত তারা পছন্দ করতো না। ১৫৭৫-এ এক পত্ৰলেখক টাইকো ব্রাহেকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলো, ‘আকাশমণ্ডলের অনন্ত আকার ও গভীরতার থেকে খ্রিস্টধর্মের ওপর আর কোনো আক্রমণই বেশি ভয়াবহ নয়।’ পৃথিবীকে কি মনে করতে হবে বিশ্বের একটা ছোটো এলাকা ব’লে? তাহলে স্বর্গ কোথায় থাকে? ১৬১৬ অব্দে ক্যাথলিক গির্জা ‘শুদ্ধ না করা পর্যন্ত’ দ্য রেভোলিউশনিবাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ৷
কোপারনিকাসের বিশ্বকাঠামো- সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্র, সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে গ্রহগুলো- নির্ভুল; তবে তাঁর কাঠামো সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন নয়। এর একটি বড়ো ত্রুটি কোপারনিকাস আরিস্ততল ও ইউডোক্সাসের মতোই মুগ্ধ ছিলেন প্লাতোর গোলকের সৌন্দর্যে। তাঁর কাছে গোলককেই মনে হতো বিশুদ্ধ আকার ও সৌন্দর্যঃ তাই তিনি তাঁর বিশ্বকাঠামোতে সূর্যকে ঘিরে গ্রহগুলোর কক্ষপথগুলোকে রেখেছেন বৃত্তাকার;- গ্রহগুলো সূর্যকে ঘিরে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে সুষম গতিতে । বাস্তবে গ্রহগুলো অমন বৃত্তাকার বিশুদ্ধ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে না, সুষম গতিতেও ঘোরে না, যা পরে দেখিয়েছেন কেপলার। তাঁর বিশ্বকাঠামো টলেমির কাঠামোর থেকে কম জটিল নয়; আর সূর্যকে তিনি বিশ্বের কেন্দ্র বললেও তাঁর কাঠামোতে সূর্যকে তিনি ঠিক বিশ্বের কেন্দ্রে রাখেন নি, সূর্যটি আছে কেন্দ্র থেকে একটু দূরে। কিন্তু তিনি সূচনা ক’রে যান একটি বিপ্লবের, যা বদলে দেয় বিশ্বের রূপ।

রাজকীয় অভিজাত বংশে সাধারণত জ্ঞানীবিজ্ঞানী প্রতিভাবানদের জন্ম হয় না, তবে কখনো কখনো এমন সুন্দর দুর্ঘটনাও ঘটে; এমন একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে দ্য রেভোলিউশনিবাস প্রকাশের তিন বছর পর ডেনমার্কের এক অভিজাত বংশে- ১৪ ডিসেম্বর ১৫৪৬-এ, জন্ম নেন অসাধারণ পর্যবেক্ষণবিদ জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে (১৫৪৬-১৬০১)। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সাধারণত পরিচিত নামের শেষাংশ দিয়ে, কিন্তু রাজকীয় ব্রাহের জন্যে পরিস্থিতির পরিহাস হচ্ছে যে তাঁকে ব্রাহে না ব’লে বলা হয় টাইকো। বেঁচে থাকলে এটা পছন্দ করতেন না তিনি, কেননা তিনি ছিলেন উগ্রভাবে অভিজাত; সাধারণ মানুষেরা তাঁকে ডাক নামে ডাকবে, এটা তাঁর ভালো লাগতো না। তাঁর জীবন অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পূর্ণ। তাঁর এক কাকার সন্তান ছিলো না, কিন্তু উত্তরাধিকারী দরকার ছিলো; তাই তিনি শিশু টাইকোকে চুরি ক’রে নিয়ে পালন করেন নিজের পুত্ররূপে। তাঁর ইচ্ছে ছিলো তাঁর পালকপুত্র আইনজীবী হবে, অংশ নেবে ডেনমার্কের রাজনীতিতে, থাকবে ক্ষমতায়; কিন্তু টাইকো জানিয়ে দেন দূষিত রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ নেই, তাঁর আগ্রহ জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতে। ছাত্রাবস্থায় তিনি একবার ডুয়েল লড়েন, এবং হারিয়ে ফেলেন নিজের নাকটি; সেখানে বসানো হয় সোনা ও রুপো দিয়ে বানানো একটি নকল নাক, যেটি তিনি লাগিয়ে রাখতেন মোম দিয়ে।
ছাত্রাবস্থায়ই টাইকো করেন বেশ কয়েকটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ১৫৬৩ অব্দের আগস্ট মাসের ২৪ তারিখে টাইকো দেখেন যে বৃহস্পতি আর শনি গ্রহ দুটি বেশ কাছাকাছি এসে গেছে পরস্পরের, প্রায় মিলে গিছে একটি বিন্দুতে । তিনি সে-সময়ের বিখ্যাত দুটি তারার পঞ্জিকা – আলফনসিন টেবল ও টেনিক টেবল-এর ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে এটা মিলিয়ে দেখেন যে দুটিই ভুল করেছে। এতে তিনি বিমর্ষ বোধ করেন, এবং আগ্রহী হয়ে ওঠেন গ্রহের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে । ১৫৭২ সালের নভেম্বর মাসে ক্যাসিয়োপিয়া তারামণ্ডলে হঠাৎ একটি নতুন তারা জ্বলজ্বল ক’রে দেখা দেয়, দিনেও স্পষ্ট দেখা যায় তারাটি, ওটি এখন পরিচিত ‘টাইকোর সুপারনোভা’ নামে, কেননা টাইকোই ওটির আবিষ্কারক। সুপারনোভা হচ্ছে বিশাল তারার বিস্ফোরণ। টাইকো ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে এটি পর্যবেক্ষণ করেন, এবং দেখেন যেখান থেকেই দেখা যাক না কেনো, তারাটির কোনো প্যারাল্যাক্স বা ‘অবস্থানান্তরতা’ (দর্শক এক স্থান থেকে কোনো বস্তুকে দেখে পরে যদি অন্য কোনো স্থান থেকে দেখে, তাহলে বস্তুটি তার অবস্থান বদল করেছে ব’লে যে-ভ্রম জন্মে) নেই; তারাটি স্থির হয়ে আছে একই স্থানে । তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে তারাটি একটি নতুন তারা, এবং আছে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, অন্তত চাঁদের থেকে দূরে, আছে সুদূর নক্ষত্রলোকে । কিন্তু এ-সিদ্ধান্ত আরিস্ততল ও টলেমির সিদ্ধান্তের বিরোধী; তাঁরা ব’লে গেছেন ও সবাই মেনে নিয়েছে আকাশ বা নক্ষত্রমণ্ডল হচ্ছে বিশুদ্ধ এলাকা, সেখানে কোনো পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নক্ষত্রমণ্ডল বিশুদ্ধ নয়, সেখানেও পরিবর্তন ঘটে, আসলে পৃথিবীর থেকে সেখানেই বদল ঘটে বেশি; আকাশমণ্ডলে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয় আগের জিনিশ এবং জন্ম নেয় নতুন জিনিশ। এ-আবিষ্কার তাঁর মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে টলেমির বিশ্বকাঠামো সম্পর্কে। এ নিয়ে তিনি লেখেন একটি ছোটো বই দ্য স্টেলা নোভা বা নতুন তারা নামে।
দ্য স্টেলা নোভা টাইকোকে বিখ্যাত ক’রে তোলে । ডেনমার্কের রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক তাঁকে বিপুল পরিমাণ অর্থ, জমিদারি, ও ক্ষমতা দেন হভিন দ্বীপে একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্যে । টাইকো সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন একটি প্রাসাদোপম মানমন্দির, নাম ইউরানিবোর্গ, আকাশমণ্ডলের ক্যাসল, যেটি বিশ্বের প্রথম আধুনিক মানমন্দির । টাইকো সেখানে যাপন করতেন রাজকীয় জীবন, সহকারী ও পরিচারকের তাঁর অভাব ছিলো না, দুর্দণ্ড জমিদারের মতো তিনি শাসন করতেন তাঁর মানমন্দির ও জমিদারি, এবং বেশ অজনপ্রিয় ছিলেন তিনি প্রজাদের কাছে। কিন্তু তিনি চালান প্রখর জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণা; এবং তাঁর মানমন্দির হয়ে ওঠে তখনকার বিশ্বের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণার কেন্দ্র।
টাইকো তাত্ত্বিক ছিলেন না, ছিলেন পর্যবেক্ষণবিদ জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ ক’রে সেগুলোর প্যারাল্যাক্স বা অবস্থানান্তরতা দেখতে না পেয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন যে পৃথিবী স্থির, এটা এতো অলস যে এটার পক্ষে ঘোরা সম্ভব নয়, তাই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামো; আবার তিনি টলেমির বিশ্বকাঠামোও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কেননা ওটি যথাযথভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না। তার বদলে তিনি একটি অদ্ভুত জটিল বিশ্বকাঠামো তৈরি করেন, যাতে পৃথিবী স্থির হয়ে আছে বিশ্বের কেন্দ্রে, যাকে ঘিরে ঘোরে সূর্য আর চাঁদ; তবে বাকি গ্রহগুলো ঘোরে সূর্যের চারদিকে। তাঁর কাঠামো পৃথিবীকেন্দ্রিক, তবে জ্যামিতিকভাবে গুটি কোপারনিকাসের বিশ্বকাঠামোর সাথে অভিন্ন । টাইকোর অসামান্য প্রতিভা ছিলো পর্যবেক্ষণের;- তাঁর দূরবিন ছিলো না, তখনো দূরবিন আবিষ্কৃত হয় নি, কিন্তু তিনি নানা কৌশল ও যন্ত্র উদ্ভাবন ক’রে বিশ বছর ধ’রে ধারাবাহিক ও যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ ক’রে গেছেন তারা, সূর্য, চাঁদ ও গ্রহগুলোর অবস্থান, যা পরে কাজে লাগিয়েছেন কেপলার।
১৫৮৮ অব্দে মারা যান রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক, এবং রাজা হন তাঁর তরুণ পুত্র। টাইকোর সাথে বিরোধ বাঁধে তরুণ রাজার; টাইকো তাঁর যন্ত্রপাতি ও পর্যবেক্ষণের বইপত্র নিয়ে ছেড়ে যান তাঁর প্রতিষ্ঠিত মানমন্দির, গিয়ে ওঠেন বোহেমিয়ার রাজধানি প্রাগে । সেখানে তিনি গ্রহণ করেন রাজা দ্বিতীয় রুডোক্ষের রাজগণিতবিদের পদ। তাঁর কাজ হয় আলফনসিন টেবল সংশোধন করা, রাজার নামে যার নাম হবে রুডোঙ্কিন টেবল। টাইকো টলেমির কাঠামোর ওপর ভিত্তি ক’রে তাঁর রুডোর্ফিন টেবল তৈরি করতে চান নি, চেয়েছেন নিজের কাঠামো অনুসারে তৈরি করতে, যাতে প্রমাণ হয় যে তাঁর কাঠামোই ঠিক। নিজেকে সাহায্য করার জন্যে তিনি নিয়োগ করেন কয়েকজন গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ, যাঁদের একজন ছিলেন ইয়োহানেস কেপলার। ১৬০১ অব্দের নভেম্বর মাসে এক রাজপুরুষের বাড়িতে অতিপানভোজন ক’রে অসুস্থ হয়ে পড়েন টাইকো, মারা যান ন-দিন পরে; মৃত্যুর আগে তিনি রাজাকে অনুরোধ করেন কেপলারকে রাজগণিতবিদের পদে নিয়োগ করার জন্যে। গরিব কেপলার টাইকোর পদটি পান টাইকোর অর্ধেক, কারো কারো মতে টাইকোর একতৃতীয়াংশ বেতনে । টাইকো ব্রাহের মৃত্যুর সাথে শেষ হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক যুগের, এবং সূচনা ঘটে এক নতুন যুগের;- ইয়োহানেস কেপলার টাইকোর পর্যবেক্ষণ ভিত্তি ক’রে সৃষ্টি করেন এক নতুন জ্যোতির্বিজ্ঞান। কোপারনিকাস তৈরি করেছিলেন এক নতুন বিশ্বকাঠামো, যার কেন্দ্র সূর্য; তবে তাঁর বিশ্বকাঠামোর লক্ষ্য ছিলো বেশ রক্ষণশীল, তিনি গ্রহগুলোর চলাচল নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন বৃত্তাকার সুষম গতির পুরোনো আদর্শেই । তা ছাড়া কোপারনিকাসের বিশ্বকাঠামোর কোনো পদার্থিক ভিত্তি ছিলো না: তাঁর কাঠামো ছিলো জ্যামিতিক। ইয়োহানেস কেপলার (১৭৫১-১৬৩০ ) আসেন নতুন প্রতিভা নিয়ে, এবং সৃষ্টি করেন গ্রহের গতির আধুনিক ধারণা । কোপারনিকাসের বিশ্বকাঠামোকে কেপলার ক’রে তোলেন সত্যিকারভাবে সূর্যকেন্দ্রিক, যাতে সূর্য শুধু বিশ্বের কেন্দ্রই নয়, পালন করে কেন্দ্রীয় পদার্থিক ভূমিকা। কেপলারই সবার আগে বোঝেন সূর্য কোনো পদার্থিক শক্তির সাহায্যে গ্রহগুলোকে ঘোরায় কক্ষপথে।
কেপলার জন্মেছিলেন ১৫৭১ অব্দের ডিসেম্বর মাসের ২৭ তারিখে দক্ষিণপশ্চিম জার্মানির এক গরিব পরিবারে। তাঁর বাবার কাজকর্মের কোনো স্থিরতা ছিলো না, তিনি মাঝেমাঝে খাটতেন ভাড়াটে সৈনিক হিশেবে। অবশেষে একবার ভাড়া খাটতে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি, হয়তো মারা গিয়েছিলেন, বা ফিরে আসতে আর তাঁর মন চায় নি। কেপলারের মাও ছিলেন এক কর্কশ মহিলা, যাকে সাধারণত কেউ পছন্দ করতো না। ডাইনি শিকারের সেই ধার্মিক যুগে তাঁর বুড়ো মাকে ডাইনি হিশেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো, কেপলার বহু চেষ্টায় অভিযোগ থেকে মুক্ত করেছিলেন মাকে; কিন্তু মা পর বছরই মারা যান।

কেপলার গরিবের ছেলে ছিলেন, স্বাস্থ্যও তাঁর কখনো ভালো ছিলো না । তিনি ছেলেবেলায় পড়াশুনো করেছেন ভিখিরিদের বিদ্যালয়ে; কিন্তু মেধাবী ছিলেন ব’লে বৃত্তি পেয়ে পড়তে যান টুবিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিএ ও এমএ পাশের পর সেখানে তিনি পুরোহিত হওয়ার জন্যে পড়েন ধর্মশাস্ত্র । বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষবর্ষে পড়ার সময় অস্ট্রিয়ায় অবস্থিত গ্রাজের একটি বিদ্যালয়ে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন কেপলার। তিনি বাধ্য হয়েছিলেন পদটি নেয়ার জন্যে, কিন্তু এটা পছন্দ করেন নি, কেননা তখন তিনি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সামান্যই জানতেন । শিক্ষক হিশেবে তিনি ভালো ছিলেন না; প্রথম বছরে কয়েকটি ছাত্র পেয়েছিলেন, দ্বিতীয় বছরে কোনো ছাত্র পান নি। তখন তাঁর ওপর ভার পরে একটি পঞ্জিকা তৈরির, যাতে থাকবে জলবায়ু, রাজনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে জ্যোতিষিক ভবিষ্যদ্বাণী । তিনি পঞ্জিকাটি তৈরি করেন; কেপলারের ভাগ্য ভালো ছিলো, ১৫৯৫ অব্দে সম্ভবত গ্রহনক্ষত্রের অবৈজ্ঞানিক চক্রান্তে জয়বায়ুবিষয়ক তাঁর তিনটি প্রধান ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যায়, আর কেপলার খ্যাতি অর্জন করেন একজন জ্যোতিষী ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিশেবে। কেপলারের সময়ে জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় নি, আর তাঁর ভেতরে এক ধরনের পুরোনো অতীন্দ্রিয়তাও ছিলো; বুড়ো বয়সেও তিনি ওই পঞ্জিকা থেকে বেশ আয় করতেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিশেবেও কেপলারের খ্যাতি শুরু হয় আকস্মিকভাবে। একদিন ক্লাশ নেয়ার সময় তিনি অনুভব করেন এক অন্তর্দৃষ্টির ঝিলিক;- ছাত্রদের বৃহস্পতি ও শনির সংযোগ অর্থাৎ সবচেয়ে কাছাকাছি আসার ব্যাপারটি বোঝানোর জন্যে দুটি বৃত্তের ভেতরে তিনি আঁকেন একরাশ ত্রিভুজ, আঁকতে আঁকতে উপলব্ধি করতে থাকেন যে বাইরের ও ভেতরের বৃত্তের ব্যাসার্ধের অনুপাত হচ্ছে ২:১, আর এটা বৃহস্পতি ও শনি থেকে সূর্যের দূরত্বের অনুপাতের প্রায় সমান। এই দূরত্বের অনুপাত হচ্ছে ১.৮৩:১। এটা ভুল ছিলো, তবে এটা তাকে এক অতীন্দ্রিয় আনন্দ দেয় । তাঁর মধ্যে অবৈজ্ঞানিক অতীন্দ্রিয়তা ছিলো, যা তাঁর রচনার মধ্যেও দেখা যায় । কেপলার বিশ্বাস করতেন কোপারনিকাসের বিশ্বকাঠামোতে; দ্য রেভোলিউশনিবাস পড়ার পর তিনি সূর্যকেন্দ্রিক পদ্ধতির ভেতর দেখতে পান সঙ্গতির সৌন্দর্য, আর এটা আকৃষ্ট করে তাঁকে। সঙ্গতি নিয়ে কাজ ক’রে ক’রে ১৫৯৪ অব্দে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম বই, যার নাম মিস্টিরিয়াম কসমোগ্রাফিকাম বা মহাজাগতিক রহস্য। আজকের মানদণ্ডে বইটিতে মূল্যবান বিশেষ কিছু নেই; এটির শুরুতে আছে কোপারনিকি মতবাদের দীর্ঘ প্ৰশংসা, তারপর তিনি অনুমান করার চেষ্টা করেছেন গ্রহগুলোর কক্ষপথের মধ্যবর্তী ফাঁকের কারণ। তাঁর মনে হয় যে তিনি বিশ্বের স্থাপত্যের আন্তর কাঠামো পেয়ে গেছেন পাঁচটি নিয়মিত বা সুষম ঘনবস্তুতে; ঘনক্ষেত্র, চতুস্তলক, দ্বাদশ-পার্শ্বক, আইকোসাহেড্রন ও আটতলকে। বইটি পাঠান তিনি টাইকো ও গ্যালিলিওর কাছে; তাঁরা দুজনেই তাঁর অতীন্দ্রিয়তা সত্ত্বেও তাঁর প্রতিভা স্বীকার করেন।
১৬০০ অব্দে টাইকোর আমন্ত্রণে কেপলার প্রাগে আসেন টাইকোর সহকারী হিশেবে কাজ করার জন্যে। ১৬০১-এ টাইকোর আকস্মিক মৃত্যুর পরে টাইকোর পর্যবেক্ষণরাশি তাঁর হাতে আসে, কেননা তখন তিনি রাজগণিতবিদ; তিনি ওগুলো ব্যবহার ক’রে গ্রহগুলোর গতি বিশ্লেষণ ও রুডোঙ্কিন টেবল সংশোধন করার উদ্যোগ নেন । তিনি যেহেতু কোপারনিকি পদ্ধতিতে বিশ্বাসী, তাই টাইকোর পরিবার মামলা করে তাঁর বিরুদ্ধে, যাতে তিনি টাইকোর যন্ত্রপাতি ও পর্যবেক্ষণের বইপত্র ব্যবহার করতে না পারেন। থামিয়ে দিতে হবে তাঁকে; তবে মামলার ফলে টাইকোর পরিবার পায় টাইকোর যন্ত্রপাতি আর কেপলার পান টাইকোর পর্যবেক্ষণের বইপত্র । তিনি চার বছর ধ’রে মঙ্গলগ্রহের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন, এবং বের করতে চেষ্টা করেন গ্রহটির গতির রীতি। ১৬০৬ অব্দের মধ্যে তিনি নির্ভুলভাবে উদ্ঘাটন করেন মঙ্গলের গতির রহস্য। কেপলার দেখেন মঙ্গল (ও সব) গ্রহের কক্ষপথ হচ্ছে উপবৃত্ত, আর তার একটি ফোকাস বা নাভিতে আছে সূর্য; এবং তিনি বিদায় জানান দু-হাজার বছরের পুরোনো প্রিয় বৃত্তাকার গতিকে । গতির রহস্যটা আরো অনেক জটিলঃ গ্রহগুলো তাদের কক্ষপথে সুষম গতিতে চলে না, সূর্যের কাছাকাছি তারা চলে দ্রুত, আর দূরে গেলে চলে ধীরে। তাই কেপলার একসাথে বাদ দেন দুটি পুরোনো মহান বিশ্বাস- সুষম গতি আর বৃত্তাকার কক্ষপথ। কেপলার তাঁর সিদ্ধান্ত ১৬০৯ অব্দে প্রকাশ করেন আস্ত্রোনোমিয়া নোভা বা নতুন জ্যোতির্বিজ্ঞান নামের বইয়ে । এ-বইতে কেপলার সেই শক্তি আলোচনা করেন, যা গ্রহগুলোকে ধ’রে রেখেছে তাদের কক্ষপথে । এমনকি তিনি অনেকটা পারস্পরিক অভিকর্ষতত্ত্ব আবিষ্কারের কাছাকাছি পৌছেন।
১৬০৪ অব্দে আকাশে একটি সুপারনোভা বা বিস্ফোরিত তারা দেখা দেয়, তিনি ওটি সম্পর্কে লেখেন; ওটি এখন পরিচিত কেপলারের সুপারনোভা নামে। ১৬১৯ অব্দে বেরোয় তাঁর বই হারমোনিকে মুক্তি বা বিশ্বের সঙ্গতি। এ-বইয়ে তিনি আবার ফিরে যান মিস্টিরিয়াম কসমোগ্রাফিকাম -এর মহাজাগতিক রহস্যে। এ-বইয়ের একমাত্র উল্লেখযোগ্য জিনিশ হচ্ছে একটি আবিষ্কার যে গ্রহগুলোর কক্ষপথগুলোর ব্যাসার্ধগুলো গ্রহের প্রদক্ষিণের কালের সাথে সম্পর্কিত। আগের দুটি (একঃ গ্রহের কক্ষপথ উপবৃত্ত, যার এক ফোকাস বা নাভিতে থাকে সূর্য, এবং দুইঃ কোনো গ্রহ থেকে সূর্য পর্যন্ত কোনো রেখা সমপরিমাণ সময়ে সমপরিমাণ জায়গার ওপর দিয়ে যায়), এবং এ-বইয়ের একটি আবিষ্কার এখন কেপলারের গ্রহগতির তিন সূত্র নামে পরিচিত। কেপলারের সূত্রগুলো প্রপঞ্চ বর্ণনা করে, ব্যাখ্যা করে না । তিনি টাইকোর উপাত্ত ভিত্তি ক’রে সুত্রগুলো রচনা করেছিলেন, কিন্তু বুঝে উঠতে পারেন নি যে সূর্যই এর কারণ; তাই তিনি কোনো তত্ত্ব তৈরি করতে পারেন নি। জ্যোতির্বিজ্ঞানের এসব সূত্র আবিষ্কারের সাথে সাথে অবৈজ্ঞানিক জ্যোতিষশাস্ত্রেরও চর্চা করেছেন কেপলার, এবং সংশোধন করেন রুডোঙ্কিন টেবল। এটি প্রকাশ করেন তিনি ১৬২৮-এ, উৎসর্গ করেন টাইকোর নামে । রুডোফিন টেবল তাঁর এক মহাকীর্তি; এটি দেখিয়ে দেয় যে কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্ৰিক বিশ্বতত্ত্ব নির্ভুল । কোপারনিকাস এমন একটি টেবলই চেয়েছিলেন তাঁর তত্ত্বের প্রমাণ হিশেবে, কিন্তু তিনি তা পান নি; সেটি তৈরি করেন কেপলার। কেপলার ১৬৩০-এর ১৫ নভেম্বরে মারা যান; তিনি ভাগ্যবান ছিলেন, তাঁকে কোনো ধর্মীয় পীড়ন সহ্য করতে হয় নি। এর কারণ তিনি বাস করতেন উত্তর ইউরোপে, যেখানে খ্রিস্টীয় বিচারসংস্থার কোনো ক্ষমতা ছিলো না।
এর পর অসামান্য অদ্বিতীয় গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২)। গ্যালিলিও সম্পর্কে সাধারণত আলোচনা করা হয় কেপলারের পরে, যদিও তিনি জন্মেছিলেন কেপলারের আগে; এর কারণ তিনি বেঁচেছিলেন কেপলারের মৃত্যুর পরেও অনেক বছর, এবং এমন এক প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিলেন বিশ্বকে, যার আলোড়ন আজো অনুভব ক’রে চলছি আমরা । ঠাণ্ডাভাবে কেপলারকে শেষ করার পরই স্বস্তি লাগে গ্যালিলিও নামক তীব্রতাকে আলোচনা করতে । কেউ কেউ হয়ে ওঠেন অবিস্মরণীয় প্রতীক, তাঁকে ঘিরে গ’ড়ে ওঠে কিংবদন্তি; বিজ্ঞানের ইতিহাসে গ্যালিলিও নেই প্রতীক ও কিংবদন্তি । গ্যালিলিওর কথা মনে হ’লে দেখতে পাই পিসার হেলানো টাওয়ারের চুড়ো থেকে তিনি ফেলছেন কামানের গোলা ও গাদা বন্দুকের গুলি, দেখিয়ে দিচ্ছেন যে অসমান ওজনের বস্তু নিচে পড়ে সমান ত্বরণে অর্থাৎ সমান সময়ে দুটির পড়ার গতি বাড়ে সমানভাবে (এটা ঘটনা হিশেবে অবশ্য সত্য নয়, তবে এ-কিংবদন্তিটি দীর্ঘকাল ধ’রে জনপ্রিয় ) । আধুনিক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার প্রতীক এটি। দেখতে পাই দূরবিনে চোখ দিয়ে দূরের আকাশ দেখছেন গ্যালিলিও। যন্ত্র যে আধুনিক কালে আমাদের দৃষ্টিকে অসীমের দিকে খুলে দিয়েছে, এটা তার প্রতীক। দেখতে পাই মহান গ্যালিলিও নতজানু হয়ে আছেন মূর্খ অন্ধ ক্যাথলিক বিচারসংস্থার সামনে, এটা বিজ্ঞান ও ধর্মের বিরোধের প্রতীক । গ্যালিলিও শুধু বিজ্ঞানী ছিলেন না, নৃশংস ধর্মের অন্ধতার সাথে লড়াই করে আপাতপরাজয় মেনে নিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু তার মধ্য দিয়েই জয় ঘোষণা ক’রে গেছেন বিদ্রোহের, বিজ্ঞানের, সত্যের; হয়ে আছেন অসামান্য প্রতীক।

গ্যালিলিও গ্যালিলি জন্মেছিলেন ১৫৬৪ অব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির পিসায় কোপারনিকাসের দ্য রেভোলিউশনিবাস প্রকাশের বিশ বছর পর। তাঁর পিতা ভিনসেঞ্জো গ্যালিলি ছিলেন পেশাদার বাঁশিবাদক, যার নেশা ছিলো গণিত । পিতার কাছে থেকে গ্যালিলিও পেয়েছিলেন অনেক কিছু, পেয়েছিলেন প্রখর পরিহাসের প্রবণতা, যুক্তিতর্কের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, আর শক্তিশালীদের অমান্য করার ঔদ্ধত্য। তরুণ বয়সেই তিনি প্রচারে নেমেছিলেন, গ্যালিলিওর ভাষায়, ‘যারা মনে করে আমাদের মননকে দাস ক’রে তুলতে হবে অন্য কারো’, সেই পুরোনোপন্থী অন্ধদের বিরুদ্ধে। পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি পরিহাস করতেন প্রাচীনপন্থী গোঁড়া অধ্যাপকদের, দিতেন অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা; এজন্যে তিনি পেয়েছিলেন একটি উপাধিঃ ‘উচ্চকলরবকারী’। পিতামাতার ইচ্ছেয় গ্যালিলিও পড়েন চিকিৎসাবিদ্যা, তবে ওই বিদ্যা তাঁর নিরীক্ষাপরায়ণ মনকে তৃপ্তি দেয় নি; কেননা তখন দেড় হাজার বছর আগে মৃত গ্যালেনের বই অনুসারে পড়ানো হতো ওই বিদ্যা, আর ক্যাথলিক গির্জার নির্দেশে কোনো রকম ব্যবচ্ছেদ ছিলো নিষিদ্ধ। পড়া ছেড়ে দিয়ে নিজে নিজে তিনি পড়তে থাকেন গণিত, নানা ছোটোখাটো যন্ত্র বানাতে থাকেন, এবং পড়েন ভার্জিল ও ওভিদের কাব্য।

পঁচিশ বছর বয়সে গ্যালিলিও এক পৃষ্ঠপোষকের চেষ্টায় পিসায় নিযুক্ত হন গণিতের অধ্যাপকের পদে; সেখানে পড়াতেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, কবিতা ও গণিত; এবং পরিহাস করতেন আরিস্ততলের মতো টোগা প’রে পড়াতে আসা পুরোনো পণ্ডিতদের, একবার তাঁদের ব্যঙ্গ ক’রে একটি কবিতাও প্রচার করেন । এতে ছাত্ররা মজা পায়, অধ্যাপকেরা একটুও মজা পান না। অল্প পরেই তাঁকে বিদায় নিতে হয় ওই পদ থেকে । এর পর তিনি ভেনিসের পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপকের পদ লাভে সমর্থ হন, যে-পদের আরেক প্রার্থী ছিলেন জিয়োরদানো ব্রুনো । গ্যালিলিও ১৫৯২-এর সেপ্টেম্বরে যখন যোগ দেন পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন ব্রুনো সূর্যকে বিশ্বের কেন্দ্র আর তারাগুলোকে একেকটি সূর্য ব’লে প্রচারের অপরাধে ক্যাথলিক বিচারসংস্থার কারাগারে রুদ্ধ। গ্যালিলিও পাদুয়ায় ছিলেন। আঠারো বছর; এ-সময়ে তিনি লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন, আবিষ্কার করেছেন বৈজ্ঞানিক যন্ত্র, যার একটি হচ্ছে তাপপরিমাপক যন্ত্র— থার্মোমিটার । এ-সময়ে তাঁকে অনেক আর্থিক কষ্ট পোহাতে হয়েছে, এক গায়ক ভাইকে টাকা দিতে হয়েছে নিয়মিত, দুই বোনের বিয়ের পণ দিতে হয়েছে, যা ছিলো তাঁর কয়েক বছরের বেতনের সমান। টাকার খুব অভাব ছিলো তাঁর; তবে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে তিনি গণ্য হন একজন শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী হিশেবে।
গ্যালিলিও, ১৬০৯ অব্দে, ভেনিসে গিয়ে হল্যান্ডে বেড়িয়ে এসেছে এমন একজনের কাছে শোনেন সেখানে কাচ বসিয়ে এক রকম যন্ত্র বানানো হয়েছে, দিয়ে দূরের জিনিশ কাছে দেখা যায়। একটা আলো ঝিলিক দিয়ে উঠেছিলো তাঁর ভেতরে হয়তো; দেরি না ক’রে তিনি কয়েকটি পরকলা বা লেন্স সংগ্রহ করেন, নিজেই তৈরি করেন একটি টেলিস্কোপ বা দূরবিন। নিজের তৈরি দূরবিনের চাবি দিয়ে গ্যালিলিও খোলেন দূরবিশ্বের বন্ধ দরোজা, যা তাঁর আগে আর কেউ খুলতে পারে নি; তাঁর আগে কোনো মানুষ এতো দূর দেখে নি। তিনি দূরবিন আবিষ্কার করেন নি, তবে তিনিই প্রথম দূরবিনে চোখ দিয়ে রাতের পর রাত তাকিয়ে থেকেছেন গ্রহনক্ষত্রের দিকে, পাঠ করেছেন ওগুলোর আচরণ, লিপিবদ্ধ করেছেন পর্যবেক্ষণ, ছবি এঁকেছেন ওগুলোর, এবং প্রচার করেছেন সকলের কাছে । তিনি বিজ্ঞানকে শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ রাখতে চান নি; সকলকে করে তুলতে চেয়েছেন বিজ্ঞানমনস্ক। ১৬০৯ ও ১৬১০-এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি সম্পন্ন করেন একরাশ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, সূচনা করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন কালের। তিনি দূরবিন দিয়ে প্রথম তাকান অতিপরিচিত চাঁদের দিকে, দেখেন সেটা কতো অচেনা; মানুষের মধ্যে তিনিই প্রথম দেখতে পান একটি ভিন্ন, বাস্তব চাঁদ, যা স্বর্গীয় নয়, পবিত্র নয়, নিতান্তই একটি উপগ্রহ; দেখেন চাঁদের ভূভাগ মসৃণ নয়, উঁচুনিচু, সেখানে আছে পাহাড় ও উপত্যকা, আর অনেক বিকট সব গর্ত । এটা মেলে না আরিস্ততলের কথার সাথে; ওই দার্শনিক ব’লে গেছেন আকাশমণ্ডলের বস্তুরাশি স্ফটিকের মতো মসৃণ। কিন্তু চাঁদ দেখতে চাঁদের মতো নয়; ওটি দেখলে মুহূর্তে নষ্ট হয়ে যায় বহু পুরোনো সুন্দর স্বপ্ন, ভেঙে যায় অমর্ত্য ধ্যান, শিউরে ওঠে কবিতার উপমারূপক। তারপর গ্যালিলিও দূরবিন দিয়ে তাকান তারারাশির দিকে, ছায়াপথে তিনি দেখতে পান অসংখ্য তারা, যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না । এটাও যায় আরিস্ততলের বিরুদ্ধে; তিনি ব’লে গেছেন তারার গোলকে আটকানো আছে গুটিকয় অবিনশ্বর তারা, সেখানে কোনো বদল ঘটে না ব’লে তারার সংখ্যা বাড়ে না কমে না। গ্যালিলিও দেখেন আকাশমণ্ডলের আছে গভীরতা, তারাগুলো আরিস্ততলের কথামতো গোলকের গায়ে আটকানো নয়, বরং ওগুলো ছড়ানো মহাশূন্যের গভীরতার ভেতরে।
এরপর গ্যালিলিও সম্পন্ন করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারটিঃ দেখতে পান ৪টি নতুন ‘গ্রহ’, যা আগে কেউ দেখে নি। এগুলো অবশ্য গ্রহ নয়, এগুলো বৃহস্পতির সবচেয়ে উজ্জ্বল চারটি উপগ্রহ বা চাঁদ (বৃহস্পতির আছে ১৬টি চাঁদ)। তিনি দেখেন এ-চাঁদগুলো ঘোরে বৃহস্পতিকে ঘিরে। কোপারনিকাসের তত্ত্বের বিরোধীরা বলতো পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরতে পারে না, ঘুরলে চাঁদ পেছনে প’ড়ে থাকতো আর একলা এগিয়ে যেতো পৃথিবী । কিন্তু দেখা যাচ্ছে বৃহস্পতির চারদিকে ঘুরছে তার চাঁদগুলো। গ্যালিলিও এতে পান প্রথাগত পণ্ডিতদের মতের বিরোধী আরেকটি মারাত্মক যুক্তি । বৃহস্পতি আর তার চারদিকে প্রদক্ষিণরত চাঁদগুলো একটা ছোটো বিশ্বের মতো। এটা আরিস্ততলের সিদ্ধান্তের বিরোধী; তিনি বলেছেন বিশ্বের কেন্দ্র হচ্ছে পৃথিবী, আর পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই শুধু ঘুরতে পারে আকাশমণ্ডলের কোনো কিছু। তাহলে তো বিশ্বের আরেকটি কেন্দ্র দরকার। তাঁর আরেকটি বড়ো আবিষ্কার হচ্ছে শুক্রগ্রহের কলা বা তার ওপর আলোর বাড়াকমার পরিমাণ আবিষ্কার। তিনি দেখেন চাঁদের মতো শুক্রও বিভিন্ন কলার ভেতর দিয়ে যায়, অর্থাৎ তাকে কখনো বাঁকা চাঁদ, কখনো আধোচাঁদ, কখনো পূর্ণিমার চাঁদের মতো দেখায়, কখনো আকাশে ওঠে পঞ্চমীর শুক্র, কখনো একাদশীর, কখনো পূর্ণিমার; তার ঘটে ক্ষয়বৃদ্ধি । টলেমির তত্ত্ব অনুসারে এটা দেখা যাওয়ার কথা নয়; কিন্তু গ্যালিলিও দেখেন শুক্রের সবগুলো কলা। এতে প্রমাণ হয় যে শুক্র সূর্যের চারদিকে ঘোরে। গ্যালিলিও এসব আবিষ্কার প্রকাশ করেন ১৬১০ অব্দে তাঁর সিডেরাস নান্সিয়াস বা নক্ষত্রদূত বইয়ে । এ-বই তাঁকে বিখ্যাত ক’রে তোলে; এবং অল্প পরেই তিনি পান তুস্কানির মহাডিউকের ব্যক্তিগত দার্শনিক ও গণিতবিদের পদ। ১৬১১ অব্দে গ্যালিলিও রোমে যান, সেখানে বক্তৃতা দেন, অনেক অনুরাগী ও অসংখ্য শত্রু তৈরি করেন । তাঁর শত্রুরা শক্তিশালী ছিলো । তাঁর দূরবিন হয়ে উঠতে থাকে শত্রুদের আক্রমণের বিষয়, তারা ওটিকে অবিশ্বাস করতে থাকে; কিন্তু গ্যালিলিও দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তিনি সূর্যে দেখতে পান কালো দাগ বা কলঙ্ক । সূর্যের কলঙ্কও আরিস্ততলীয় বিশ্বকাঠামোর বিরুদ্ধে যায়; কারণ তাঁর বিশুদ্ধ আকাশমণ্ডলে কলঙ্কের মতো অশুদ্ধ কিছু থাকতে পারে না। সৌরকলঙ্ক সম্পর্কে তিনি ১৬১৩ অব্দে প্রকাশ করেন একটি বই- সৌরকলঙ্ক সম্পর্কে পত্রাবলি ৷ আকাশমণ্ডলকে অপবিত্র অস্বর্গীয় ক’রে তোলেন গ্যালিলিও; এবং এ-বইতেই তিনি প্রথম স্পষ্টভাবে জানান তিনি বিশ্বাসী কোপারনিকি বিশ্বকাঠামোতে।
১৬১৬ অব্দের মধ্যে অনেক শক্তিমান শত্রু তৈরি হয়ে যায় গ্যালিলিওর, তাদের মধ্যে ছিলো পুরোনো পণ্ডিতেরা আর ধর্মযাজকেরা; এবং এ-বছরই ক্যাথলিক বিচারসংস্থার এক কর্মকর্তা গ্যালিলিওকে নির্দেশ দেয় তিনি যেনো কোপারনিকি তত্ত্বকে সত্য হিশেবে না পড়িয়ে পড়ান নিতান্তই অনুমান হিশেবে। তিনি এটা মেনে নেন; তবে এ-সময়ে জড়িয়ে পড়েন বৈজ্ঞানিক সত্য ও প্রত্যাদেশের মাধ্যমে পাওয়া তথাকথিত সত্যের তর্কের মধ্যে- তর্ক তিনি পছন্দ করতেন। কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্নদের অনেকে মনে করেন এ-বিতর্কে গ্যালিলিও জড়িয়ে না পড়লেই ভালো করতেন; তবে সত্য হচ্ছে বিতর্কে কাউকে না কাউকে জড়িয়ে পড়তেই হয়, এমনকি প্ৰাণও দিতে হয় । নির্মোহ বিজ্ঞান ও অন্ধ ধর্মের দ্বন্দ্ব একদিন চরম রূপ লাভ করতোই; গ্যালিলিও সেই বিপদের কেন্দ্রে দাঁড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন নিজে। ইতিহাসের এক পরিহাস হচ্ছে অনেক তুচ্ছ কিন্তু শক্তিশালী ব্যক্তি পীড়ন করে প্রতিভাদের, পরে তারা স্মরণীয় হয়ে থাকে ওই প্রতিভাদের পাদটীকা হিশেবে; এটা ঘটে গ্যালিলিওকে ঘিরেও। ১৬২৪ অব্দে কোপারনিকি বিশ্বতত্ত্ব সমর্থন ক’রে একটি বই লিখতে শুরু করেন তিনি, ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার পর বইটি বেরোয় ১৬৩২ অব্দে । বইটির নাম দায়ালোগো দেই দুয়ে মাসিমি সিস্তেমি বা দুটি প্রধান বিশ্বকাঠামো সম্পর্কে সংলাপ। অসাধারণ-এ-বইটি লেখা হয় তিন বন্ধুর-কথোপকথন হিশেবে, যারা তর্ক করছে কোপারনিকি ও টলেমীয় বিশ্বকাঠামো সম্পর্কে। এতে প্রধান কথক সালভিয়াতি, যে কোপারনিকি বিশ্বকাঠামোর প্রবক্তা; দ্বিতীয় কথক সাগ্রেদো, যে বেশ বুদ্ধিমান, তবে বিশ্বাস ক’রে এসেছে টলেমীয় কাঠামোতে, আর তৃতীয় কথকটির নাম সিম্পলিসিও, যার নাম থেকেই বোঝা যায় সে একটি সরল নির্বোধ, নির্বোধের মতো বিশ্বাস করে টলেমীয় কাঠামোতে। গ্যালিলিও বইটি লাতিনে না লিখে লেখেন ইতালীয়তে, যাতে সাধারণ পাঠকও পড়তে পারে বইটি । তিনি যে লাতিনে লেখেন নি বইটি, এও পরিচয় দেয় তাঁর অগ্রসরতার; কয়েক শতক পর দেখা যায় ইউরোপে সবাই বিজ্ঞান চর্চা করছে মৃত লাতিনের বদলে নিজেদের ভাষায়।
দুটি প্রধান বিশ্বকাঠামো সম্পর্কে সংলাপ বেরোনোর পরপরই ক্ষেপে ওঠে ক্যাথলিক ধর্মীয় বিচারসংস্থা, গ্যালিলিওকে ডেকে পাঠায় রোমে। বিচারসংস্থার বিচারকদের সামনে তাঁকে দাঁড়াতে হয় চারবার; তারা তাঁকে শারীরিক পীড়ন করে নি, তবে পীড়নের ভয় দেখায়। প্রথমে গ্যালিলিও কোপারনিকি তত্ত্ব সমর্থনের চেষ্টা করেন, কিন্তু বিচারসংস্থার প্রচণ্ডতা বুঝতে পেরে সংবরণ করেন নিজেকে। তিনি দেখেছেন এ-অন্ধ সংস্থাই ১৬০০ অব্দে পুড়িয়ে মেরেছে ব্রুনোকে; তাই অন্ধকারের সামনে বিজ্ঞানের মহাজাগতিক সত্য নিয়ে তর্ক করা বোকামি । তিনি আরেক ব্রুনো হ’তে চান নি, খুবই ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গ্যালিলিও, শহিদ হওয়ার আবেগ তাঁকে পেয়ে বসে নি। ১৬৩৩ অব্দের ২২ জুন সত্তর বছরের বৃদ্ধ বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বিচারসংস্থার সামনে নতজানু হয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন, যা কোনো অপরাধ ছিলো না, পাঠ করেন বিচারসংস্থার তৈরি করা পূর্বমত পরিহারের বিবৃতি । এখানেও কিংবদন্তি তৈরি হয় তাঁকে ঘিরে; একটি গল্প চলতি হয়ে যায় যে তিনি উঠতে উঠতে ফিসফিস ক’রে বলেন, ‘এপ্পুর সি মুভে’- তবু এটা (পৃথিবী) ঘোরে । হয়তো তিনি একথা বলেন নি, ওই অন্ধ হিংসদের সামনে এই অবস্থায় এমন ঔদ্ধত্য নির্বুদ্ধিতা হতো; তবে এ-উপকথা বুঝিয়ে দেয় যে তখন টলেমীয় তত্ত্ব সাধারণেরও আস্থা হারিয়ে ফেলছিলো, আর গ্যালিলিও গণ্য হয়েছিলেন প্রচণ্ড শক্তিমানদের অস্বীকার করার মতো কিংবদন্তিরূপে।
গ্যালিলিওকে কারাদণ্ডিত করা হয় সারাজীবনের জন্যে; তবে, পোপের আদেশে, তাঁকে কারাগারে না রেখে গৃহবন্দী রাখা হয় ফ্লোরেন্সের বাইরে তাঁর নিজের বাড়িতে। তাঁর সাথে পরিবারের লোকেরা দেখা করতে পারতো, অন্য কেউ নয় । গ্যালিলিও জীবনের বাকি বছরগুলো কাটান বন্দীর নিঃসঙ্গ জীবন; আর এ-সময়ে লেখেন গতি ও জাড্য সম্পর্কে একটি অসাধারণ বই দুটি নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে সংলাপ। তাঁর মেয়ে সিস্টার মেরি সেলেস্তে থাকতেন গ্যালিলিওর সাথে, পিতার হয়ে প্রতিদিন সাতবার আবৃত্তি করতেন বাইবেলের প্রায়শ্চিত্তের শ্লোক । এটা আবৃত্তির আদেশও দেয়া হয়েছিলো গ্যালিলিওকে । ১৬৩৭ অব্দে অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দূরবিন দিয়ে গ্রহনক্ষত্র দেখতেন গ্যালিলিও; অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গভীর বেদনায় লেখেন, ‘যে-মহাবিশ্বকে আমি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম সহস্র গুণে, তা সংকুচিত হয়ে আজ হয়ে উঠেছে আমার ক্ষীণ শরীরের সমান।’ দশ বছর গৃহবন্দী থাকার পর ১৬৪২-এর ৮ জানুয়ারি গ্যালিলিও মৃত্যুবরণ করেন। যে-বিচারসংস্থা শাস্তি দিয়েছিলো গ্যালিলিওকে, সেটিই যে অপরাধ করেছিলো তা আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে। তিন শতাব্দী ধ’রে অপরাধবোধে ভোগার পর ১৯৮৩ অব্দে ক্যাথলিক গির্জা স্বীকার করে তার অপরাধ, এক বিবৃতিতে বলে ৩০০ বছর আগে গ্যালিলিওর বিচারে ভুল করেছিলো ক্যাথলিক গির্জা, এখন তাঁর নাম ওই বিচার থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। এতে কিছু যায় আসে না গ্যালিলিওর, কিন্তু যায় আসে আমাদের; আমরা দেখি ধর্ম আজো বিজ্ঞানের সাথে কলহে লিপ্ত, যদিও ধর্মই ভুল ক’রে আসছে সব সময়। মানুষ এক অদ্ভুত প্রজাতি; সে শিল্প সৃষ্টি করে, বিজ্ঞান চর্চা করে, অভাবিত সব আবিষ্কার সম্পন্ন করে, আবার সে পোষণ করে চূড়ান্ত অপবিশ্বাস। যুক্তির থেকে অপবিশ্বাসই আলোড়িত ও নিয়ন্ত্রণ করে অধিকাংশ মানুষকে, তারা বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো উপভোগ করে, কিন্তু চালিত হয় অপবিশ্বাস দিয়ে।

ক্যাথলিক গির্জার ক্রোধও প্রতিরোধ করতে পারছিলো না সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামোকে, তার পক্ষে জড়ো হচ্ছিলো এতো প্রমাণ যে কোপারিনিকি বিপ্লব প্রায় সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিলো সতেরো শতকে, তবে তার ছিলো এক অসম্পূর্ণতা। সূর্যকে ঘিরে যে ঘোরে গ্রহগুলো, গ্রহগুলোকে ঘিরে উপগ্রহগুলো, এর জন্যে দরকার ছিলো একটি পদার্থিক ব্যাখ্যা। যিনি এ-ব্যাখ্যা দেন, এক সূত্রে বাঁধেন মাটি ও আকাশমণ্ডলকে, সারা মহাবিশ্বকে, তাঁর নাম আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)- যাঁকে গণ্য করা হয় চিরকালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী বলে । যে-বছর মারা যান গ্যালিলিও, সে-বছরেরই শেষ দিকে জন্ম নেন নিউটন ইংল্যান্ডের উথোপ গ্রামে । অসামান্য প্রতিভাবান ছিলেন নিউটন, বিস্ময়কর ছিলেন সব দিকে, – অদ্ভুত, দুর্গম, অন্যমনস্ক, অমানবিক, নক্ষত্রের মতো সুদূর; মানুষ ছিলেন তিনি, তবু যেনো মানুষ ছিলেন না, ছিলেন প্রাকৃতিক শক্তির মতো, যাঁর কাছাকাছি যাওয়া ছিলো অসম্ভব । অ্যালডাস হাক্সলি বলেছেন, ‘মানব হিশেবে তিনি ব্যর্থ ছিলেন, কিন্তু দানব হিশেবে ছিলেন অত্যুৎকৃষ্ট।’ যা কল্পনায় আসে নি কোপারনিকাসের, যা বিমূঢ় করেছে কেপলার ও গ্যালিলিওকে, তা গাণিতিক নির্ভুল সূত্রে বাঁধেন নিউটন; – তিনি অভিকর্ষের এমন সূত্র রচনা করেন, যা ব্যাখ্যা করে পার্থিব ও মহাজাগতিক প্রপঞ্চ। এটা ক’রে তিনি ধ্বংস করেন বিশ্বের আরিস্ততলীয় বিভাজন; আরিস্ততল বিশ্বকে ভাগ করেছিলেন দু-ভাগে, একটি ভাগ চাঁদের নিচে- এটা দূষিত অঞ্চল, আরেকটি ভাগ চাঁদের ওপরে- এটা বিশুদ্ধ মণ্ডল, এ-ভাগাভাগি বাতিল ক’রে দেন নিউটন, সৃষ্টি করেন কোপারনিকি মহাবিশ্বের পদার্থিক ভিত্তি। এতো যথাযথভাবে তিনি এ-কাজ করেন যে তাঁর তত্ত্বকে ধ্রুব ব’লে মানা হয়েছে দু-শতকের বেশি সময় ধ’রে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে আইনস্টানীয় আপেক্ষিকতাতত্ত্বের পরও আমরা বাস করি নিউটনের মহাবিশ্বে, অর্থাৎ বিশ্বকে আমরা আজো দেখি নিউটনীয় তত্ত্বের আলোকে; তাঁর তত্ত্ব আজো কাজ করে ওপর থেকে নিচে কিছু পড়ার, আর চাঁদে বা কোনো গ্রহে মহাশূন্যযান পাঠানোর সময়। ক্যামব্রিজে পড়ার সময়ই ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সে তিনি উদ্ভাবন করেন ক্যালকুলাস, আবিষ্কার করেন অভিকর্ষের সূত্র, আলোর কিছু বৈশিষ্ট্য, এবং আবিষ্কার করেন প্রতিফলক দূরবিন । ছাত্রাবস্থায়ই তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ।
প্রচার ও প্রকাশবিমুখ বিস্ময়কর মানুষ ছিলেন নিউটন। তিনি অসামান্য সব আবিষ্কার করতে থাকেন, কাগজে লিখে রাখতে থাকেন সে-সব, অন্যমনস্কভাবে হারিয়ে ফেলতে থাকেন, বিরত থাকেন ওগুলোর প্রকাশ থেকে। ৪১ বছর বয়সে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমান্ড হ্যালির অনুরোধে তিনি লিখতে শুরু করেন তাঁর অভিকর্ষ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা : পদার্থিক দর্শনের গাণিতিক নীতি; এবং বইটি বেরোয় ১৬৮৭ অব্দে । বইটি সমাধান করে গ্রহদের গতির সমস্যা। নিউটনের অভিকর্ষতত্ত্ব আবিষ্কারের সাথে জড়িয়ে আছে একটি আপেল পড়ার গল্প। তিনি শিল্পকলা ও সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না- ওসবকে নিরর্থক মনে করতেন, নারীর প্রতিও নয়, প্রকৃতির প্রতিও নয়; আপেলের গল্পটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে মানবিক সুন্দর গল্প । একটি আপেল ও চাঁদকে তিনি চিরকালের জন্যে জড়িয়ে দিয়ে যান। ডাল থেকে খ’সে-পড়া একটি আপেল তাঁর ভেতরে হঠাৎ আলোর ঝলকানি জাগিয়েছিলো, দেখিয়ে দিয়েছিলো মহাজাগতিক সূত্র। ১৬৬৬ অব্দে প্লেগ দেখা দিলে তিনি ক্যামব্রিজ ছেড়ে গ্রামে যান, একদিন বাগানে ব’সে থাকার সময় দেখতে পান একটি আপেল পড়ছে। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে যে-শক্তির টানে আপেল পড়ে, সেই শক্তিই কি টানছে না চাঁদকে? চাঁদকে কোনো শক্তি যদি না টানতো, তাহলে চাঁদ তো এমন ঘুরতো না পৃথিবীকে ঘিরে, সরল রেখায় দূর থেকে দূরে চ’লে যেতো। এভাবে ভেবে নিউটন সম্পন্ন করেন বিজ্ঞানের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণতম আবিষ্কারগুলোর একটি । একে বলা হয় মহাজাগতিক অভিকর্ষের নিউটনীয় সূত্র’। সূত্রটি হচ্ছেঃ মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা আকর্ষণ করে অন্য প্রতিটি বস্তুকণাকে, এ-আকর্ষণের বল তাদের ভরের সাথে আনুপাতিক এবং তাদের দূরত্বের বর্গের সাথে বিপরীতভাবে আনুপাতিক বা ব্যস্তানুপাতিক । মহাবিশ্বের বস্তুকণাগুলোর পারস্পরিক আকর্ষণই কাজ ক’রে চলছে বিশ্বে, তাই গ্রহগুলো সূর্যকে ছেড়ে দূর থেকে দূরে চ’লে না গিয়ে ঘোরে সূর্যকে ঘিরে। সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থান করছে বিশাল সূর্য, টেনে ধ’রে রেখেছে গ্রহগুলোকে অদৃশ্য অভিকর্ষের সাহায্যে।
নিউটন যখন আবিষ্কার করেন যে অভিকর্ষগতভাবে বিভিন্ন ভর আকর্ষণ করে পরস্পরকে, তখন তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন অভিকর্ষই সেই বল, যা গ্রহগুলোকে ঘোরাচ্ছে সূর্যকে ঘিরে। কিন্তু সূর্য গ্রহগুলোকে একটুও না ছুঁয়ে এতো দূর থেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কক্ষপথে? গ্রহগুলো কীভাবে অবস্থান করে আকাশে, যদি কোনো গোলক তাদের ধ’রে না রাখে? অভিকর্ষ কি কোনো ইন্দ্রজাল? দূর থেকে ক্রিয়ার এসব প্রশ্নের উত্তর দেন নিউটন গতির তিনটি সরল সূত্র ও অভিকর্ষের সূত্রের সাহায্যে । এগুলোর ওপর ভিত্তি ক’রেই গ’ড়ে উঠেছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান। এ-সূত্রগুলো পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি ক’রে রচিত শুধু প্রয়োগিক সূত্র নয়, এগুলো মৌল সিদ্ধান্ত, যার সাহায্যে নির্দেশ করা সম্ভব কেপলারের সুত্রগুলো, এবং আরো অনেক প্রপঞ্চ। তাঁর সূত্রগুলো ঠিকমতো নির্দেশ করে এর আগের শতকের পর্যবেক্ষণগুলো, এবং কোপারনিকি বিপ্লবকে নিয়ে যায় চূড়ান্ত পর্যায়ে অভিকর্ষের বল যদি ভিন্ন হতো তাঁর অভিকর্ষের সূত্রের থেকে, তাহলে অন্য রকম হতো গ্রহগুলোর কক্ষপথ; আর এ-সূত্রগুলো নির্দেশ করে গ্রহগুলো সরল রেখায় ছুটে নিজেদের কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে না গিয়ে কেনো ঘুরতে থাকে সূর্যকে ঘিরে। ১৭২৭ অব্দে ৮৪ বছর বয়সে যখন মারা যান নিউটন তখন সৌরজগত লাভ করে তার যথারূপ, যে-রূপে আজো আমরা দেখি সৌরজগতকে । তখন অবশ্য ইউরেনাস, নেপটুন, আর প্লুটো আবিষ্কৃত হয় নি । তাঁর সূত্র শুধু পৃথিবীতে কাজ করে না, করে সৌরজগত ভ’রে, এবং মহাবিশ্বের অন্যান্য এলাকায়।
মহাবিশ্বের যে-পদার্থিক সূত্র আবিষ্কার করেন নিউটন, তাতে মহাবিশ্ব সম্পর্কে সৃষ্টি হয় নতুন ধারণা। মহাবিশ্বকে তো তিনি বদলে দেন নি, তার রূপ যেমন ছিলো প্লাতোর কালে, তারও কোটি কোটি বছর আগে, আজো আছে তেমনি; শুধু বদল ঘটেছে ধারণার। আগে সত্য অজানা ছিলো, এখন আমরা সত্য জানি । গ্রিকদের চোখে, টলেমি ও বিভিন্ন ধর্মপ্রবর্তকের কাছে, এমনকি কোপারনিকাসের চোখে বিশ্ব ছিলো সীমাবদ্ধ; গ্যালিলিও সৃষ্টি ক’রে যান এমন ধারণা যে হয়তো বিশ্ব অনন্ত; আর নিউটন দাবি করেন যে তাঁর সূত্রগুলো নির্দেশ করে যে বিশ্ব অনন্ত । এই প্রথম বিশ্ব হয়ে ওঠে মহাবিশ্ব মুক্ত ও অনন্ত। তিনি বলেন যে বিশ্ব যদি সসীম হতো, তাহলে অভিকর্ষ বিশ্বের সমস্ত বস্তুকে টেনে জড়ো করতো নিজের কেন্দ্রে, তখন থাকতো শুধু একটা বৃহৎ বস্তুর ভর। নিউটনের তত্ত্ব অবশ্য মহাবিশ্বের সব সমস্যা সমাধান করে নি; এবং তিনি খুবই ভীত ছিলেন গ্রহদের পারস্পরিক অভিকর্ষ নিয়ে, তাঁর মনে হতো অভিকর্ষ হয়তো একদিন সৌরজগতকে টেনে ভেঙেচুরে বিনষ্ট ক’রে ফেলবে। মেনে নেয়া যায় কি এই শোচনীয় ধ্বংসকাণ্ড? এটা রোধের কোনো সূত্র বের করতে পারেন নি নিউটন; অসহায় নিউটন সাহায্য নিয়েছেন বিধাতার- বিজ্ঞান থেকে চ’লে গেছেন অপবিশ্বাসে। তাঁর বাক্সভর্তি যে-সব পুরোনো কাগজপত্র পাওয়া গেছে, তা ভীত করে বিজ্ঞানমনস্কদের, তাতে দেখা যায় নিউটন শুধু এক বিশাল বিজ্ঞানীই ছিলেন না, ছিলেন এক বড়ো অপবিশ্বাসীও; তাঁর এসব কাগজপত্র প’ড়ে কেইনস বলেছেন, ‘যুক্তির যুগের প্রথম পুরুষ ছিলেন না নিউটন, তিনি ছিলেন যাদুকরদের মধ্যে শেষজন, বেবিলনীয় ও সুমেরীয়দের শেষজন।’ ঘড়ির মতো যে-বিশ্বকাঠামো তৈরি করেছেন তিনি, তাকে বিপর্যয় থেকে কে বাঁচাবে? তাঁর মনে হয়েছে বিশ্বঘড়ি বিকল হয়ে যেতে থাকলে এগিয়ে আসবে বিধাতার হাত, মেরামত করবে একে;- খুবই হাস্যকর কল্পনা। নিউটনের মহাবিশ্ব অনন্ত, যত্নের সাথে তৈরি করা ঘড়ির মতো; এ-ঘড়ি চলে তাঁর অভিকর্ষতত্ত্ব ও গতির তিনটি সূত্রে। তাঁর সুত্রগুলো এতো ভালোভাবে কাজ করেছে যে কেউ প্রশ্ন তোলে নি; কিন্তু বিশশতকে দেখা দেন আরেক মহাবিজ্ঞানী- আইনস্টাইন, যিনি ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন নিউটনের অভিকর্ষের, বদলে দেন মহাবিশ্বের রূপ।
ঘড়ির মতো চাবি দেয়া নিউটনের মহাবিশ্বকাঠামো, তাঁর মহাজাগতিক অভিকর্ষ ও গতির সূত্র, সাফল্যের পর সাফল্য অর্জন করে দু-শতক ধ’রে; একে এক সময় মনে করা হতো মহাবিশ্বের চূড়ান্ত বিধান ব’লে । তবে তাঁর অভিকর্ষের বিরোধীও ছিলেন অনেকে, ইউরোপের মহাদেশীয় অনেক বিজ্ঞানী পরিহাস করতেন তাঁর রহস্যময় অভিকর্ষ নিয়ে, যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কিন্তু যাদুর মতো কাজ করে মহাবিশ্ব জুড়ে । আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) অনুরাগী ছিলেন নিউটনীয় মহাসংশ্লেষণের, তবে তাঁর মনে প্রশ্ন ছিলোঃ মহাবিশ্ব সম্পর্কে কি শেষ কথা বলা হয়ে গেছে? বেশ কয়েকটি সমস্যা তো রয়ে গেছে, নিউটনীয় সূত্র যা ব্যাখ্যা করতে পারছে না; যেমন বুধগ্রহটি কক্ষপথে চলতে চলতে তার শীর্ষ নাড়ে এপাশে-ওপাশে, তা ব্যাখ্যা করতে পারে না নিউটনের সূত্র। তাছাড়া নিউটন অভিকর্ষ কী, তার প্রকৃতি কী, তা ব্যাখ্যা করতে পারেন নি; তিনি শুধু অভিকর্ষের ক্রিয়াকলাপ নির্দেশ করেছেন। আইনস্টাইন অভিকর্ষ সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে বিস্মিত হন আলোর স্বভাব দেখেও। দুটি অসম্পর্কিত ব্যাপার, একটি অভিকর্ষ আরেকটি আলো, এ-দুটি ব্যাপার থেকে আইনস্টাইন পৌঁছেন এক নতুন বিশ্বদৃষ্টিতে- আপেক্ষিকতাতত্ত্বে। আইনস্টাইন পৌঁছেন এক বিস্ময়কর সিদ্ধান্তে;- তাঁর তত্ত্বে অভিকর্ষ আর বল নয়। যে-বল টেনে ঠিকঠাক রাখছে নিউটনের মহাবিশ্বকে, ঘোরাচ্ছে গ্রহ-উপগ্রহগুলোকে, ডাল থেকে পাড়ছে আপেল, তা-ই নেই আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে! এমন একটা মহাজাগতিক শক্তি হঠাৎ অনুপস্থিত হয়ে যায় মহাবিশ্ব থেকে! আইনস্টাইনের তত্ত্বে স্থান, সময়, ভর আর পদার্থিক গতি জড়িত হয় এক নতুন সম্পর্কে, এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে সৃষ্টি হয় এক নতুন ধারণা; মহাবিশ্ব আর ঘড়ির মতো থাকে না, বিকশিত হয়ে চলে মহাবিশ্ব।

নিউটনের অভিকর্ষতত্ত্ব ও গতির সূত্রগুলো বাড়িয়ে দেয় পদার্থবিজ্ঞানের সীমা, সেগুলো দিয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা করা যায় সৌরজগত; আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের সীমা আরো বাড়িয়ে দেন, বাড়িয়ে দেন সৌরজগত ছাড়িয়ে অসীমে, তাঁর আপেক্ষিকতাতত্ত্বের সাহায্যে পদার্থবিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে অনেক দ্রুত গতির ব্যাপারগুলো, বহু দূরকে, মহাবিশ্বের নক্ষত্রপুঞ্জের অতিতীব্র শক্তিকে । নিউটনের এলাকা ছিলো নক্ষত্র ও গ্রহের এলাকা, আইনস্টাইনের এলাকা সমগ্র মহাবিশ্ব । বিজ্ঞানের সীমা বাড়াতে গিয়ে আইনস্টাইন ছেড়ে দেন নিউটনের স্থান ও কালের ধারণা। নিউটনের দৃষ্টিতে স্থান ও কাল স্থির অটল, তাতে কোনো পরিবর্তন নেই; তাঁর মতে, ‘ধ্রুব, সত্য ও গাণিতিক সময় (কাল) নিজে, ও নিজের স্বভাবে, অপরিবর্তিত রূপে প্রবাহিত হয় বাইরের কোনো কিছুর সাথে সম্পর্ক না রেখে।’ এ-ধারণা বাদ দেন আইনস্টাইন, একে তাঁর মনে হয় অগভীর ও বিভ্রান্তিকর। তিনি উদ্ঘাটন করেন মহাবিশ্বের এক নতুন রূপ। এ-কাজ করেন তিনি দু-ধাপে; প্রথমে “বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব’-এর সাহায্যে, তারপর সাধারণ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব’-এর সাহায্যে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্বের সারকথা হচ্ছে : সুষম গতিশীল সব দর্শকের জন্যে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্ররাশি অভিন্ন। এ-তত্ত্বেই রয়েছে তাঁর বিখ্যাত সমীকরণটি, ই=এমসি২, তবে এর যে-ধারণাটি সাধারণের কাছে বেশ অবোধ্য মনে হয়, তা হচ্ছে স্থানকালের ধারণা। সাধারণ বোধে স্থান ও কাল দুটি ভিন্ন ধারণা, কিন্তু বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্বে ধারণা দুটি সমন্বিত- দুটি কাজ করে এক সাথে, একটি ছাড়া আরেকটি নেই।
আগে বিজ্ঞানীদের, এবং সকলের, কাছে স্থান ও কাল ছিলো মহাবিশ্বের দুটি পৃথক বৈশিষ্ট্য, যে-দুটির মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, স্থান আছে স্থানের জায়গায় কাল আছে কালের জায়গায়। নিউটনের কাছে এ-দুটি সম্পূর্ণ পৃথক ব্যাপার; কিন্তু আইনস্টাইনের কাছে মহাবিশ্বের সব ঘটনা ঘটে বিশেষ স্থানকালে, স্থানের সাথে সব সময়ই জড়িয়ে থাকে কাল; স্থান ও কাল পরস্পর অচ্ছেদ্য । মনে হ’তে পারে এটা আর এমন কী ব্যাপার, ঘটনা ঘটার তো একটা সময় থাকবেই, আর কোনো-না-কোনো স্থান লাগবেই; কিন্তু আইনস্টাইনের কাছে কোনো ঘটনা ঘটে বিশেষ স্থানকালে, স্থান ও কাল উভয়েরই ভেতরে। তিনি এমন সংঘটনকে বলেন ‘ঘটনা’। আমরা কোনো ঘটনাকে চিহ্নিত করি এটা দেখে যে ঘটনাটি কোথায় (স্থান) ঘটলো, আর কখন (কাল) ঘটলো। এই ঘটনাগুলো সৃষ্টি করে ‘স্থানকাল’। স্থানকাল হচ্ছে চারমাত্রিক এক সংশয়, যাতে আছে স্থানের তিনটি মাত্রা (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ) আর কালের একটি মাত্রা। স্থানকালের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক প্রথমে বেশ ধাঁধার মতো লাগে- বোঝা যায় না; বোঝার জন্যে একটি বিষয় বিবেচনা করা যাক। আমরা কোনো বিশেষ সময়ে ঘটতে দেখি যে-সব ঘটনা, সেগুলো কি আসলেই একই সময়ে ঘটে? আমরা কোনো কিছু দেখি ওই বস্তু থেকে চোখে আলো এসে ঢুকলে । আলো অত্যন্ত দ্রুত চলে, তবে তার গতিরও সীমা আছে । তাই বহু বহু দূরে যে-সব ঘটনা ঘটে, সেগুলো আমরা কখনো একই সময়ে দেখতে পাই না। অতিশয় দূরের বস্তুকে দেখি অতীতে তারা যেমন ছিলো, তেমন; এখন যেমন আছে, তেমন নয়। যখন চাঁদের দিকে তাকাই, দেখতে পাই এক মিনিট আগের চাঁদ; সূর্যের দিকে তাকালে দেখি আট মিনিট আগের সূর্য । তারার দিকে তাকালে দেখতে পাই অনেক অনেক বছর আগের পুরোনো তারা। সিরিয়াস বা লুব্ধক তারাটির দিকে তাকালে দেখতে পাই আট বছর আগে তারাটি যেমন ছিলো। তাই যখন মহাশূন্যের দিকে তাকাই, আমরা তাকাই অতীতের দিকে।
১৯০৫ থেকে ১৯১৫ অব্দের মধ্যে আইনস্টাইন সীমা বাড়িয়ে দেন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্বের; তিনি গ্রহণ করেন ‘ত্বরিত দর্শক’, অর্থাৎ যে-দর্শক স্থির হয়ে নেই এক স্থানে, যার ঘটছে ত্বরণ (বিশেষ সময়ে গতি পরিবর্তনের হার) ও বিকাশ ঘটান সাধারণ আপেক্ষিকতাতত্ত্বের । এ-তত্ত্বে তিনি বিচার করেন অভিকর্ষঃ প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন নিউটনের ভর ও জাড্য ধারণা দুটি সম্পর্কে;- দেখেন নিউটন ভরকে একভাবে গ্রহণ করেছেন অভিকর্ষতত্ত্বে, এবং অন্যভাবে গ্রহণ করেছেন গতির দ্বিতীয় সূত্রে। নিউটন গতির দ্বিতীয় সূত্রে কোনো বস্তুর ওপর বিশেষ বল প্রয়োগ ক’রে বস্তুটির ত্বরণ মেপে নির্ণয় করেন বস্তুটির ডর; একে বলেন বস্তুটির ‘জাড্যভর’। আবার ওই বস্তুটিকে তিনি ওজন করেন। ওজন এক ধরনের বল; কেননা বস্তুটির ওজন (এক কেজি, এক টন প্রভৃতি) হচ্ছে সেই অভিকর্ষ, যা দিয়ে পৃথিবী বস্তুটিকে টানছে নিজের দিকে । ওজন হচ্ছে অভিকর্ষ । এভাবে তিনি বস্তুটির যে-ভর মাপেন, তাকে বলা হয় বস্তুটির ‘আভিকর্ষিক ভর’। নিউটন মনে করতেন বস্তুর জাড্যভর ও আভিকর্ষিক ভর একই জিনিশ । গ্যালিলিও ও তাঁর নিজের নিরীক্ষা থেকে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন যে পৃথিবীর কাছাকাছি সব ভর একই ত্বরণে নিচের দিকে পড়ে। জাড্যভর আর আভিকর্ষিক ভর যে একই জিনিশ এটা কি কোনো আকস্মিক ব্যাপার? এটা প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে আইনস্টাইনের মনে ৷ তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়; এটা মহাবিশ্বের এক মৌল সত্য । তিনি এটাকে ‘সমতুল্যতানীতি’ নাম দিয়ে গ্রহণ করেন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাতত্ত্বে।
মনে করা যাক জানালাহীন একটি মহাকাশযানে আছে একটি লোক, এবং মহাকাশযানটি এখনো আছে পৃথিবীতে। সে তার হাত থেকে মহাকাশযানে কয়েকটি জিনিশ ফেলে, সেগুলোর ত্বরণ মাপে, দেখতে পায় সেগুলো নিচে পড়ছে একই ত্বরণে । এবার মনে করা যাক লোকটিসহ, এবং লোকটির অজান্তে, একই ত্বরণে মহাকাশযানটিকে পাঠিয়ে দেয়া হলো মহাশূন্যে । লোকটি তখনও হাত থেকে জিনিশগুলো ফেলছে, সেগুলোর ত্বরণ মাপছে, দেখতে পাচ্ছে ত্বরণের কোনো বদল হচ্ছে না । লোকটি শুধু যদি জানালা দিয়ে তাকাতে পারে তাহলেই সে বুঝবে সে পৃথিবী ছেড়ে গেছে। তার পক্ষে পরীক্ষানিরীক্ষা ক’রে অভিকর্ষের বলের ক্রিয়া ও রকেটের ইঞ্জিনের বলের ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য বোঝা সম্ভব হবে না। আবার মনে করা যাক একটি লোক মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখছে একটি জিনিশ নিচে পড়ছে। স্থানকালে তার কাছে মনে হবে জিনিশটি নিচে পড়ছে একটি বক্ররেখায় । কেনো এমন মনে হবে? তার কারণ জিনিশটির ত্বরণ ঘটছে ৷ এখন মনে করা যাক যে লোকটিও নিচে পড়ছে জিনিশটির সাথে । তখন লোকটির মনে হবে জিনিশটি বক্ররেখায় নিচে না প’ড়ে পড়ছে সরলরেখায় । জিনিশটি ও লোকটি একই সাথে একই ত্বরণে নিচে পড়ছে ব’লে লোকটির মনে হবে জিনিশটির ত্বরণ ঘটছে না । সমতুল্যতার এ-নীতি বেশ সরল, কিন্তু এর ফলাফল অসামান্য । নিউটন মনে করেছিলেন সব অবস্থায়ই অভিকর্ষ বল; কিন্তু অবাধ মুক্তভাবে নিচে পড়লে মনে হবে অভিকর্ষ ব’লে কিছু নেই । নিউটনের কাছে অভিকর্ষ ছিলো।
রহস্যপূর্ণ ব্যাপার, তবে তিনি তার ক্রিয়া বর্ণনা করেছিলেন; আর আইনস্টাইনের কাছে নিচ দিকে পড়া কোনো রহস্যপূর্ণ ব্যাপার নয়। তাঁর কাছে নিচে পড়া হচ্ছে স্থানকালে বস্তুর স্বাভাবিক গতি । তাই তাঁর কাছে অভিকর্ষ কোনো বল নয় । কিন্তু তাহলে চাঁদ কেনো ঘুরছে পৃথিবীর চারদিকে? আর পৃথিবীর চারদিকে ঘোরাই হয় যদি চাঁদের স্বাভাবিক গতি, তাহলে চাঁদ কেনো সরল রেখায় না চ’লে ঘুরছে বক্রভাবে? এটা বোঝার জন্যে যেতে হবে জ্যামিতিতে।
নিউটন জানতেন জ্যামিতি আছে একটিই, সেটি ইউক্লিডীয়; তাই মহাবিশ্বের জ্যামিতি ইউক্লিডীয়; তবে আইনস্টাইন এমন কোনো পূর্বধারণা পোষণ করেন নি, তিনি মনে করেছেন মহাবিশ্বের জ্যামিতি কেমন, তা বের করতে হবে নিরীক্ষা ক’রে। পুরোনো মিশরীয়দের জমি পরিমাপের রীতিনীতি দেখে জ্যামিতির বিকাশ ঘটিয়েছিলো গ্রিকরা, যা বিধিবদ্ধ করেন ইউক্লিড । অনেক শতাব্দী ধ’রে ইউক্লিডের জ্যামিতিই ছিলো একমাত্র ও চূড়ান্ত জ্যামিতি । ইউক্লিডীয় জ্যামিতি হচ্ছে সমতলীয় জ্যামিতি, যাতে সমান্তরাল রেখা চিরসমান্তরাল, আর ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি । ১৮২৯ অব্দে নিকোলাই লোবাশেভস্কি বিকাশ ঘটান অন্য একরকম জ্যামিতি, যার নাম ‘পরাবৃত্তিক জ্যামিতি’। এ-জ্যামিতি বাঁকা; আর এতে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি সব সময়ই ১৮০ ডিগ্রির কম । পরাবৃত্তিক জ্যামিতি অসীম, কেননা এর সমান্তরাল রেখা কখনো মিলিত হয় না। পরাবৃত্তিক ও সমতল জ্যামিতিকে বলা হয় ‘মুক্ত জ্যামিতি’। ১৮৫৪ অব্দে গিয়র্গ রাইমান বের করেন আরেক জ্যামিতি, যাতে সমান্তরাল রেখা বাড়তে বাড়তে গিয়ে মিলিত হয় এক স্থানে । এটা বোঝা যাবে পৃথিবীর অক্ষ ও দ্রাঘিমা রেখার কথা ভাবলে । বিষুবরেখার ওপর যদি দুটি লম্বরেখা নিই, তাদের বাড়াতে থাকি সমান্তরালভাবে, এক সময় দেখা যাবে ওই সমান্তরাল রেখা দুটি মিলিত হয়েছে মেরুবিন্দুতে। এখানে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রির থেকে বেশি। এ-জ্যামিতিকে বলা হয় ‘বতুল জ্যামিতি’, বা ‘বদ্ধ জ্যামিতি’। তাই আইনস্টাইনের সামনে ছিলো তিন রকম জ্যামিতি, যেখানে নিউটনের সামনে ছিলো একটি । এ-তিন রকম জ্যামিতির মধ্যে কোনটি খাটে মহাবিশ্বের সাথে, আর সেটির সাথে অভিকর্ষের সম্পর্ক কেমন?
নিউটন ধ’রে নিয়েছিলেন মহাবিশ্ব সমতল, তাই মহাবিশ্বে দেখেছিলেন এক রহস্যপূর্ণ বল, যাকে তিনি বলেছেন অভিকর্ষ; আইনস্টাইন মনে করেন মহাবিশ্ব বক্র, বক্র ব’লেই মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তু ঘোরে বক্রপথে, তাই তাঁর মহাবিশ্বে অভিকর্ষের দরকার পড়ে না। এটা শুধু তাঁর অনুমান নয়, নিরীক্ষার সাহায্যে এটা প্রমাণ করা সম্ভব, ও প্রমাণিত হয়েছে । মহাবিশ্বের স্থানকালের বক্রতা কেমন, এবং কেনোই বা তা বক্র? আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাতত্ত্বে স্থানকালের জ্যামিতি নির্ধারিত হয় ভরের বণ্টন ও শক্তির দ্বারা । কোনো বিশাল ভরের বস্তু তার সন্নিকট স্থানকালে সৃষ্টি করে বক্রতা। ওই বক্রতার ফলেই ঘটে ত্বরিত গতি । নিউটন বলেন ত্বরণ ঘটে অভিকর্ষের ফলে; আর আইনস্টাইন বলেন স্থানকাল বক্র ব’লেই ঘটে ত্বরণ; এটা কোনো রহস্যপূর্ণ অভিকর্ষের ফলে ঘটে না । আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব এও ভবিষ্যদ্বাণী করে যে স্থানকালের বক্রতার ফলে বেঁকে যাবে আলোকরশ্মিও, সরলরেখায় চলতে পারবে না । নিরীক্ষার সাহায্যে এ-ভবিষ্যদ্বাণীও প্রমাণিত হয়েছে, দেখা গেছে সূর্যের ভরের ফলে সুদূর তারার আলোকরশ্মি সূর্যের কাছাকাছি বেঁকে যায়। গ্রহগুলোর কক্ষপথ কেনো বক্র? আইনস্টাইনের তত্ত্বানুসারে গ্রহগুলো স্থানকালে তাদের স্বাভাবিক-গতিতে সরল রেখায়ই চলে; কিন্তু আমরা তাদের কক্ষপথগুলোকে বাঁকা দেখি, যেহেতু স্থানকালই বাঁকা। সূর্যের কাছাকাছি গ্রহগুলোর কক্ষপথ বেশি বাঁকা; সূর্য থেকে যতো দূরে যাওয়া যায়, বক্রতা কমতে থাকে; তাই পৃথিবীর কক্ষপথ অনেক বেশি বাকা বৃহস্পতির কক্ষপথের থেকে।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাতত্ত্ব শুধু সৌরলোকেই খাটে না, খাটে সারা মহাবিশ্বেই । এর সাহায্যে আমরা ধারণা করতে পারি, এমনকি কল্পনায় দেখতে পারি মহাবিশ্বের জ্যামিতি । আমরা জানি জ্যামিতি আছে তিন রকম – পরাবৃত্তিক, বতুল, আর সমতল; এর মধ্যে কোন জ্যামিতি প্রয়োগ করতে হবে মহাবিশ্বে, সে-সম্পর্কে আইনস্টাইন কিছু বলেন নি, শুধু বলেছেন এটা দেখতে হবে পরীক্ষা ক’রে । ১৯১৭ অব্দে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতাতত্ত্ব প্রয়োগ ক’রে তৈরি করেন মহাবিশ্বের একটি বদ্ধরূপ, বদ্ধ জ্যামিতির মহাবিশ্ব; এতে মহাবিশ্ব অনন্ত অসীম নয়, বদ্ধ সসীম । খুবই বড়ো, প্রকাণ্ড, ভুল করেছিলেন এ-মহাবিজ্ঞানী; একে পরে তিনি বলেন তাঁর জীবনের প্রধানতম ভুল। নিউটনের মহাবিশ্ব অসীম অনন্ত; আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব অনেকটা আরিস্ততলের মহাবিশ্বের মতো বদ্ধ, সসীম আপেক্ষিকতাতত্ত্ব যদিও নির্ভুল, কিন্তু তা তিনি প্রয়োগ করেন ভুলভাবে; এবং তৈরি করেন একটি বদ্ধ মহাবিশ্বকাঠামো। তবে তাঁর ওই বদ্ধমহাবিশ্বকাঠামো প্রস্তাবের কয়েক বছরের মধ্যেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে সম্প্রসারিত হচ্ছে মহাবিশ্ব। এটা ধরা পড়ে যখন তাঁরা গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রপুঞ্জগুলোর বেগ ও দূরত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯১২ অব্দে ভেস্টো এম স্নিফার (১৮৭৫-১৯৬৯) আবিষ্কার করেন যে অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জটি আমাদের দিকে সেকেন্ডে ১৭০ কিলোমিটার বেগে ছুটে আসছে। ১৯২৮ অব্দের মধ্যে স্লিফার হিশেব করেন ৪০টিরও বেশি নক্ষত্রপুঞ্জের বেগ, এবং দেখেন অধিকাংশ নক্ষত্রপুঞ্জই দূরে চলে যাচ্ছে আমাদের মিল্কি ওয়ে নক্ষত্রপুঞ্জ বা ছায়াপথ থেকে। একই সময়ে এডুইন পি হাবেল (১৮৯৯-১৯৫৩) হিশেব করেন কয়েকটি নক্ষত্রপুঞ্জের দূরত্ব। তিনি নক্ষত্রপুঞ্জগুলোর দূরে স’রে যাওয়ার একটি সূত্রও আবিষ্কার করেন, যাকে বলা হয় ‘হাবেলের সূত্র’। তাঁর সূত্র বলে যে-নক্ষত্রপুঞ্জগুলো যতো বেশি দূরে সেগুলো দূরে স’রে যায় ততো বেশি বেগে । এ-নক্ষত্রগুঞ্জগুলো মহাগর্জনের সময় থেকেই ছুটে চলছিলো বেশি বেগে, তাই বেশি দূরে চ’লে গেছে, এবং ছুটছে বেশি বেগে ৷ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়ে চলছে আজো, বেড়ে চলছে মহাবিশ্ব; একবার কেউ তৈরি ক’রে একে চিরকালের জন্যে স্থির অটল বদ্ধ ক’রে রাখে নি।
“মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ