কিংবদন্তী বক্সার ক্যাসিয়াস ক্লে ওরফে মহম্মদ আলি তাঁর সোনালী দিনগুলোয় দুনিয়া কাঁপিয়েছিলেন স্ব-উদ্ভাসিত ‘রোপ-এ-ডোপ’ কৌশলে। আবার কাঁপালেন বড়দিনের ঠিক পরের দিনই।

মঙ্গলবার বড়দিনের রাতেয়ালি কলকাতায় পৌঁছেন। কলকাতায় আসার আগে আলি কালিকট ও বোম্বাই গিয়েছিলেন বিভিন্ন সমাজসেবী ধর্মীয় সংস্থাকে উৎসাহিত করতে। গত কয়েকটা বছর আলিকে দেখা গেছে ধর্মীয় ও সমাজসেবী সংস্থাগুলোর পাশে। অধ্যাত্মবাদী চিন্তা যে তাঁকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে, অধ্যাত্ম-জগতেই যে তিনি চুবে থাকতে চান, তা তাঁর জীবনচর্যা থেকে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। আকাশ-ছোঁয়া উচ্চতা থেকে আলি নেমে এসেছিলেন মানুষ দেবতাদের কাছাকাছি। আর্ত ও শিশুদের সেবার মধ্যেই আল্লার সেবা করতে চেয়েছিলেন, আল্লাকে পেতে চেয়েছেন আপন করে। এমনই এক সন্ধিক্ষণে আলি এমন এক বিশ্ব-কাঁপানো ঘটনা ঘটালেন, যা তাঁকে রাতারাতি মানুষের দেবতা করে দিল। দীর্ঘদেহী আলি শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোরে নিজেকে শূন্যে ভাসিয়ে রেখে বুঝিয়ে দিলেন- মাটির বুকে নেমে এসেও রয়ে গিয়েছেন সবার চেয়ে কিছুটা উপরে। যে কথা বারংবার শুনিয়েছেন পৃথিবীর মানুষকে, “আলি ইজ আলি। আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট।” সে কথাটাই আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন বক্সিং জগৎ থেকে অধ্যাত্মিক জগৎ ও সেবার জগৎ-এ প্রবেশ করে।

২৭ ডিসেম্বর ৯০ বিভিন্ন ভাষাভাষী পত্র-পত্রিকাগুলোয় বিশাল গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হল আলির শূন্যে ভেসে থাকার অসাধারণ কাহিনী। পাঠক-পাঠিকাদের কৌতূহল মেটাতে নমুনা হিসেবে ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা আনন্দবাজার থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি। খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম পৃষ্ঠাতেই আলির বিশাল ছবি সহ বিরাট করে।

বিশ্বাস, বিশ্বাসই স্ব, বলেন আলি

স্টাফ রিপোর্টারঃ ছয় ফুটের উপরে লম্বা, সে অনুপাতে চওড়া শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মহম্মদ আলি। হাত দুটি ছড়িয়ে দিলেন দেহের সমান্তরালে। কয়েক সেকেন্ড পরে উপস্থিত সাংবাদিক, আলোকচিত্রীদের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে হোটেলের ঘরে মেঝে থেকে ইঞ্চি দুয়েক উপরে উঠে গেলেন তিনি। প্রায় নির্ভার একটি পালকের মতো কয়েক সেকেন্ড শূন্যে ভেসে থাকলেন বক্সিংয়ের কিংবদন্তী নায়ক। তারপরে মাটি ছুঁলো তাঁর পা। হতবাক দর্শকদের দিকে ফিরে অস্ফুটে বললেন আলিঃ বিশ্বাস, বিশ্বাসই সব, বিশ্বাসই আসল।” …”আকাশ ছোঁয়া উচ্চতা থেকে নেমে এসেছেন মাটির কাছাকাছি। তবুও সাধারণ মানুষদের মধ্যে থেকেও নেই তিনি”, …শূন্যে ভেসে থেকে তিনি সেটাই বোঝালেন সবাইকে।”

আলির শূন্যে ভাসা নিয়ে তোলপাড় শুরু হতেই রহস্যভেদের আমন্ত্রণ এলো ‘আজকাল’ পত্রিকার তরফ থেকে। আমন্ত্রণ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে পেলাম তাঁদের অকুন্ঠ সহযোগিতা।

বিশ্বাসের জোরে, স্রেফ বিশ্বাসের জোরে আলি ভেসে ছিলেন!! মেনে নিতে মন চায় না। যতই প্রত্যক্ষদর্শী থাকুক, নিজের চোখে একবার না দেখে আমার পক্ষে মেনে নেওয়াটা… না, কিছুতেই পারলাম না। বারবারই মনে হতে লাগলো ফাঁকিটা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় কিছু কিছু ফাঁক থেকেই যায়। তবু প্রাথমিক একটা ধারণা গড়ে তুলতে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। এই সাংবাদিক বললেন, “আলি একটা অন্য ব্যাপার। উনি যখন এসে দাঁড়ালেন, ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল ওঁর সারা শরীর থেকে যেন একটা জ্যোতি বেরুচ্ছে। এখনও ভাবতে গেলে গা শিরিশির করে। ও এখন অন্য জগতের মানুষ। খুব কাছ থেকে ওঁর শূন্যে ভাসা দেখেছি। না স্টেজ, না আলোর কারসাজি, উনি শূন্যে ভেসে রইলেন। না না, এতে কোনও কৌশল-টৌশলের ব্যাপার ছিল না।”

আর এক সাংবাদিক বন্ধু জানালেন, “আলি তো অলৌকিক ক্ষমতার দাবী করেননি। যোগ ক্ষমতার দ্বারা তো এমনটা কর যায়ই। আমাদের দেশে এ তো নতুন কিছু নয়। অনেক সাধু-সন্তরাই যোগ ক্ষমতায় এমনটা ভেসে দেখিয়েছেন। এমনটা যে ভেসে থাকা যায় সে তো প্রমাণ হয়েই গেছে।”

এক সাহিত্যিক বন্ধু তো একটা গল্পই শোনালেন। একটি বিখ্যাত সাধকদের জীবন-গ্রন্থে নাকিয়া আছে, কোনও এক সাধু গভীর ঈশ্বর বিশ্বাসে ভর করে হেঁটে উত্তাল নদী পার হচ্ছিলেন। সাধু হেঁটে চলেছেন ঈশ্বর বিশ্বাসে বুঁদ বয়ে, নেশাগ্রস্থ মানুষের মত। পাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ সাধু হুঁশ ফিরে পেলেন- আমি অতটা পায়ে হেঁটে চলে এসেছি। শেষ পথটুকু পার হতে পারব তো? যেমনি ভাবা, অমনি টুপ করে এক টুকরো পাথরের মতই ডুবে গেলেন। আসলে বিশ্বাসই সব। ঈশ্বরে অন্ধ বিশ্বাস রাখলে অমন অনেক কিছুই ঘটে, ঘটান যায়- যেগুলো সাধারণ মানুষদের চোখে ‘অলৌকিক’ বলেই প্রতিভাত হয়।

স্টেজে নয়, হোটেলের ফ্লোরে মোট দু’বার সাংবাদিকদের শূন্যে ভেসে দেখিয়েছেন আলি। কি এমন কৌশল!! যার ফলে একজন মানুষ একটু একটু করে উঠে পড়েন শূন্যে? যে সব তথাকথিত অবতাররা শূন্যে ভাসেন বলে কথিত আছে তাঁদের সে-সব কৌশল আমার অজানা নয় (উৎসাহী পাঠক-পাঠিকাদের অবগতির জন্য জানাই ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ –এর প্রথম খন্ডে সেইসব গোপন-কৌশল নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি বহু ছবি সহ। তাঁরা কেউই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শূন্যে উঠে পারেননি। এ এক নতুন ভাবে শূন্যে ভাসা, নতুন পদ্ধতিতে শূন্যে ভাসা!

২৯ ডিসেম্বর শনিবার দুপুরে আমাদের সমিতির জ্যোতি মুখার্জীকে সঙ্গী করে তাজ বেঙ্গল হোটেলে পৌঁছলাম। তখন হোটেলের লাউঞ্জে আলির খবর সংগ্রহ করতে সাংবাদিক ও চিত্র-সাংবাদিকদের ভিড়। শুনলাম, তিনদিন ধরে সকাল থেকে রাত ওঁরা ঘাঁটি গেড়ে রয়েছেন। কিন্তু আলিকে যারা এদেশে এনেছেন তাঁদের হার্ডেল টপকে ৩২৪ নম্বর ঘরে ঢুকে আলির সঙ্গে আলাপ জমাবার সুযোগ পাননি কেউই। আলি একতলার রেস্তোরাঁয় এলে বা আলির সঙ্গে আলাপ জমাবার সুযোগ পাননি কেউই। আলি একতলার রেস্তোরাঁয় এলে বা বাইরে বেরুলে আলিকে ফিল্ম বন্দী করার সুযোগ পাঔয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু নিশ্ছিদ্র পাহারা এড়িয়ে কথা বলার তেমন সুযোগ জুটছে না।

‘আজকাল’-এর সাংবাদিক অনুরূপ ভৌমিক ও চিত্র-সাংবাদিক সজল মুখার্জির দেখা পেলাম হোটেল লাউঞ্জেই। তারপর প্রতীক্ষা। আলির মুখোমুখি হতে পারলেও তাঁর মত বিশাল ব্যক্তিত্ব আমার অনুরোধকে মর্যাদা দিয়ে আবার শূন্যে ভেসে দেখাবেন কি না, এ বিষয়ে আমারও সন্দেহ ছিল। কিন্তু এখানে এসে দেখছি- প্রবেশাধিকারের হার্ডেলই এভারেস্টের উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এরই ফাঁকে আলাপ হল আলির জীবনী নিয়ে গড়ে ওঠা ‘দ্য হোল স্টোরি’র পরিচালক লিন্ডসে ক্লেনেল-এর সঙ্গে। জানালেন, ‘দ্য হোল স্টোরি’র শুটিং উপলক্ষেই তাঁর ভারতে আগমন। ছবিটির প্রযোজক মহমেডান ক্লাবের সহ-সভাপতি মির মহম্মদ ওমরের দাদা। খরচ হবে কয়েক লক্ষ ডলার। সারা পৃথিবীতে ছবিটি মুক্তি পাবে।

মির মহম্মদ ওমরের সহযোগিতায় ৩২৪ নম্বর ঘরে আলির মুখোমুখি হলাম। তখনও দুটো হার্ডল অতিক্রম করা বাঁকি। একঃ আলির শূন্যে ভাসা দেখা, দুইঃ শূন্যে ভাসার রহস্যভেদ। শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছিল? না, আমি আর মুখ খুলছি না। আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি ৩০ ডিসেম্বর ‘আজকাল’-এর প্রথম পৃষ্ঠায়। আমি এবং আমার ছবি সহ প্রতিবেদনটি থেকে কিছুটা অংশ তুলে দিচ্ছি।

ফেরার দিন ম্যাদিক দেখলেন, দেখালেনও

আজকালের প্রতিবেদনঃ মুহম্মদ আলি আবার শূন্যে ভেসে উঠলেন। একবার নয়, পাঁচবার। এবং এবার পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল ব্যাপারটা অলৌকিক নয়। যতবার শূন্যে উঠলেন একটা দিকে কাউকে থাকতে দেননি। ব্যালে নর্তকীর মত সেদিকে মুখ করে এক পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে ভর দিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য মাটি থেকে উঠলেন, দূর থেকে বোঝার উপায়ও নেই, পা মাটি স্পর্শ করে আছে। বোঝা যেতও না, যদি না প্রবীর ঘোষ থাকতেন। শনিবার আলি ফিরে এলেন। তাঁর আগে দুপুরে তাঁর কাছে

মুহম্মদ আলি ও লেখক

গিয়েছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রবীর ঘোষ, যিনি নিজে ম্যাজিকের ভান্ডার এবং যার কাজ অলৌকিক ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার। তিনিই ধরলেন ম্যাজিকটা। পরে হোটেলের লাউঞ্জে নিজে করেও দেখালেন। আধঘণ্টা আলির সঙ্গে ছিলেন ভদ্রলোক। জমে উঠল দারুণ আড্ডা। দুজনে মেটে উঠলেন ম্যাজিক বিনিময়ে। আলি বের করলেন ম্যাজিক বক্স। দুটো ছোট স্পঞ্জের বল নিয়ে একটা নিজের বাঁ হাতে রেখে অন্যটি দিলেন প্রবীরবাবুর হাতে। প্রবীরবাবু এক টাকার মুদ্রা ঢুকিয়ে ফেললেন সরু মুখের একটা বোতলের মধ্যে। আবার বের করে আনলেন বোতল ও মুদ্রা অক্ষত রেখে। পরে বিস্মিত আলিকে রহস্যটা ফাঁস করে দিলেন প্রবীর ঘোষ- মুদ্রাটা বিশেষভাবে নির্মিত, ভাঁজ করে সরু করা যায়। আলিকে কয়েকটা উপহার দিলেন। আলি আরও অবাক একটা মুদ্রা থেকে দুটো হওয়া দেখে।

error: Content is protected !!