অর্থপেডিক সার্জন মাসুম রহমান অবাক হয়ে রোগীর দিকে তাকিয়ে আছেন। রোগীর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। চুলে পাক ধরেছে। ছোটখাটো মানুষ। চাপা নাক। বালক বালক চেহারা। রোগীর অস্থির আচরণ, ক্রমাগত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কপালে ঘাম নেই, কিন্তু একটু পরপরই কপালের ঘাম মোছার ভঙ্গি করছে। গলা খাঁকারি দিচ্ছে।
মাসুম রহমান বললেন, আপনার সমস্যাটা আরেকবার বলুন তো।
রোগী টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, আমি ছোট হয়ে যাচ্ছি।
ছোট হয়ে যাচ্ছেন?
জি স্যার। যে হারে ছোট হচ্ছি তাতে আঠার বছর ছমাস পর আমার উচ্চতা হবে এক ফুট দেড় ইঞ্চি।
আপনার নাম?
আসাদুজ্জামান চৌধুরী।
কী করেন?
স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। ক্রমাগত ছোট হচ্ছি–এই টেনশনের কারণে ছাত্র পড়াতে পারছি না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন ঘরে বসে আছি।
বিয়ে করেছেন?
জি। স্ত্রী পাঁচ বছর আগে গত হয়েছেন। একটাই মেয়ে। মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি। জামাই পল্লী বিদ্যুতে কাজ করে।
ছোট হতে শুরু করলেন কবে?
স্ত্রী-বিয়োগের পর। খুব শক পেয়েছিলাম। দুইদিন এক রাত না খেয়ে ছিলাম। আমার মনে হয় সেই শকে বডি সিস্টেমের কোনো গণ্ডগোল হয়ে গেছে।
চা খাবেন?
স্যার, আমি চা খাই না। তবে আপনি যখন বলছেন তখন খাব। স্যার কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?
না।
বিশ্বাস না করারই কথা। আমি মেডিসিনের এক প্রফেসরকে দেখিয়েছিলাম। উনি সরাসরি বলেছেন—
আপনার মানসিক সমস্যা। কোনো একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখান।
সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছিলেন?
জি-না। আমার কাছে মনে হয়েছে, কোনো একজন অর্থপেডিক ডাক্তার দেখানো ভালো। তিনি হাড় পরীক্ষা করে সহজেই ধরতে পারবেন সমস্যাটা কী। একজন মানুষ ছোট হতে হলে তার হাড় ছোট হতে হবে। লজিক তাই বলে। একজন অর্থপেডিক চিকিৎসক ব্যাপারটা সহজে ধরবেন।
মাসুম রহমান বেল টিপে চা দিতে বললেন। এই রোগী আজকের শেষ রোগী। ঘড়িতে বাজে নটা। বাড়ি ফিরে রিলাক্স করার সময়। আজ রাতে রেস্টুরেন্টে খাবার পরিকল্পনা ছিল। তার স্ত্রী হেনা টেলিফোন করে পরিকল্পনা বাতিল করেছে। তুমুল ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়বৃষ্টিতে বাইরে যেতে তার ইচ্ছা করছে না। ঘরেই বাদলা দিনের খাবার তৈরি হচ্ছে। ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ মাছের ডিম, গরুর মাংস।
চা চলে এসেছে।
আসাদুজ্জামান চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, স্যার, আমি যে ছোট হচ্ছি তার প্রমাণ সঙ্গে করে এনেছি। আপনি অনুমতি দিলে প্রমাণগুলি দেখাই।
কী প্রমাণ এনেছেন?
পাসপোর্ট নিয়ে এসেছি। পাসপোর্টে যে হাইট দেয়া এখনকার হাইট তারচেয়ে সাত পয়েন্ট দুই ইঞ্চি কম। স্যার, পাসপোর্টটা দেখাব?
না। পাসপোর্ট ছাড়া আর কী প্রমাণ আছে?
স্ত্রী-বিয়োগের সময়ের একটা প্যান্ট আর এখনকার একটা প্যান্ট নিয়ে এসেছি। পাশাপাশি ধরলেই বুঝবেন। মেলে ধরব স্যার?
দরকার নেই।
কাগজপত্রও সঙ্গে আছে। একবার শুধু যদি চোখ বুলাতেন! আপনার সময় নষ্ট করছি বুঝতে পারছি। আমি বিরাট সমস্যায় আছি। স্যার, কাগজপত্র দেখাব?
কী কাগজপত্র?
একটা চার্ট। আমি নিজেই গ্রাফের মতো করেছি। x অক্ষে হাইট, y অক্ষে বয়স। প্রায় সরলরেখা রিলেশনশিপ।
আপনি স্কুলে কী পড়াতেন? অংক?
জি স্যার। আমি B. Sc. টিচার। অংক আর সায়েন্স পড়াই। B. Sc.-তে উপরের দিকে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিলাম। M. Sc. পড়ার শখ ছিল। আর্থিক সংগতি ছিল না। চার্টটা কি দেখাব?
না।
আসাদুজ্জামান চা শেষ করেছেন। তিনি বললেন, আপনি অনুমতি দিলে একটা পান খাব স্যার। পান সঙ্গেই আছে। আগে পানি খাবার অভ্যাস ছিল না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পান খাওয়া ধরেছি। উনার একটা স্মৃতি ধরে রাখা। আমার স্ত্রীর জর্দা দিয়ে পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল। স্যার, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? Just one humble request.
কী রিকোয়েস্ট?
কাউকে দিয়ে আমার হাইটটা মাপাবেন। দুবছর পর মিলিয়ে দেখবেন।
মাসুম রহমান তার সহকারীকে ডেকে রোগীর হাইট মাপতে বললেন।
আসাদুজ্জামান বললেন, একটা কাগজে এই হাইটটা লিখে নামটা সিগনেচার। করে রাখুন। আর আমার কাছে দিন। আমি যত্ন করে রাখব। আপনি হারিয়ে ফেলবেন।
মাসুম রহমান বললেন, আমার কাছেই রেকর্ডটা থাকবে। আমি হারাব না।
দুই বছর অনেক সময় স্যার।
যত সময়ই হোক, আপনার হাইট লেখা কাগজটা আমার কাছে থাকবে। আর যদি হারিয়েও ফেলি হাইট মনে থাকবে। চার ফুট নয় ইঞ্চি। অর্থাৎ ফোর্টি নাইন। হাফ সেঞ্চুরির এক কম। ভাই, এখন যান। আপনি আমার অনেক সময় নষ্ট করছেন।
এই পৃথিবীতে আমি একাই ছোট হচ্ছি, নাকি আরো অনেকে হচ্ছে, আমার জানার ইচ্ছা। টাকা থাকলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতাম। বিজ্ঞাপনে লিখতাম, যাদের হাইট ক্রমাগত কমছে তারা যোগাযোগ করুন।
ভাই, আমি এখন উঠব।
আসাদুজ্জামানও উঠলেন। নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠলেন।
সিন্দাবাদের ভূতের প্রতীকী অর্থ আছে। অনেক সমস্যাই সিন্দাবাদের ভূতের মতো মানুষের ঘাড়ে চেপে থাকে। কিছুতেই সেই ভূত ঘাড় থেকে নামানো যায় না। আসাদুজ্জামান নামের মানুষটা মাসুম রহমানের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতোই চেপে বসল। কিছুদিন পর পর টেলিফোন। মাসে একবার চিঠি একটা চিঠির নমুনা–
জনাব অধ্যাপক মাসুম রহমান,
আসসালাম। আমি আসাদুজ্জামান চৌধুরী। শিবচর হাইস্কুলের প্রাক্তন অংক শিক্ষক। আশা করি আপনি আমাকে স্মরণে রেখেছেন। আমার উচ্চতাও আপনার মনে আছে, চার ফুট নয় ইঞ্চি। ফোর্টি নাইন। হাফ সেঞ্চুরির এক কম। এই তথ্য যেন ভুলে না যান সেই কারণেই পত্র দিলাম। একই সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজ একটা ছবিও দিলাম। যখন আপনার সঙ্গে। আবার দেখা করব তখন যদি চিনতে না পারেন, এই জন্যেই ছবি। বড়দের সালাম এবং ছোটদের শ্রেণীমতো দোয়া এবং স্নেহাশীষ দিবেন।
ইতি
আসাদুজ্জামান চৌধুরী
(ফোর্টি নাইন)
সমস্যা এখানেই শেষ না। মাসুম রহমান তার জন্মদিনে ফুলের তোড়া এবং কার্ড পাওয়াও শুরু করলেন। আসাদুজ্জামান অফিস থেকে তার জন্মদিনের তারিখ জেনেছে। কার্ডে লেখা থাকে–
জন্মদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা
ফোর্টি নাইন আসাদুজ্জামান
রোগী দেখার সময়ও প্রায়ই আসাদুজ্জামানকে দেখা যায়। রোগীদের সঙ্গে গুটিসুটি মেরে বসে পান খাচ্ছে। তবে দেখা করতে আসে না। ঘণ্টা দুই-তিন বসে থেকে চলে যায়। সে দূরে বসে থেকেও এমন একটা চাপ তৈরি করে যার ব্যাখ্যা চলে না। একজন মানসিক রোগী আশেপাশে আছে, তাকে লক্ষ রাখছে, ভাবতেই কেমন যেন লাগে।
দ্বিতীয় বছরে মাসুম রহমান রোগীর হাত থেকে বিশেষ উপায়ে মুক্তি পেলেন। সৌদি আরবে কিং ফয়সল হাসপাতালে চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। চাকরির তৃতীয় বছরে হঠাৎ কুরিয়ারে আসাদুজ্জামানের চিঠি।
স্যার,
আসসালাম। অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা জোগাড় করেছি। আপনার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হবার পর আমি আরো দ্রুততার সঙ্গে ছোট হতে শুরু করেছি। এখন আমাকে পিগমি মানবের মতো দেখায়। সঙ্গে ছবি পাঠালাম। বর্তমানের ছবি এবং পূর্বের ছবি। হাইট চার্ট জিরক্স করে পাঠালাম। এখন আমার কী করণীয়? বিষয়টির বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া উচিত। এমনও তো হতে পারে আমার ব্যাধি জীবাণু কিংবা ভাইরাসঘটিত। এক মানবদেহ থেকে আরেক মানবদেহে সংক্রামিত হওয়ার মতো।
যদি তাই হয় তাহলে এই ভয়াবহ ব্যাধি রোধ কল্পে ব্যাপক গবেষণা হওয়া উচিত।
প্লেগ সংক্রমণের সময় বিশ্বের বিশাল মানবগোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছিল। সেরকম পরিস্থিতি যদি হয় তাহলে দেখা যাবে মানবজাতি এক-দেড় ইঞ্চি সাইজে পরিণত হয়েছে। অবশ্য তার একটা সুবিধাও আছে–খাদ্যাভাব পুরোপুরি দূর হবে।
বিশাল দালানকোঠার প্রয়োজন হবে না। ম্যাচবক্সের সাইজের বাড়িঘরেই চলবে। নভোযানে চড়ে চন্দ্র এবং মঙ্গল। গ্রহের অভিযান তেমন ব্যয়বহুল হবে না। কারণ নভোযানের সাইজ হবে ছোট।
সমাজ বিজ্ঞানীদের উচিত বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করা।
স্যার, আপনার প্রতি আমার একটি বিশেষ অনুরোধ নিজের উচ্চতার প্রতি লক্ষ রাখবেন। আপনার সঙ্গে আমার নানানভাবে যোগাযোগ হয়েছে। খাটো হওয়া বিষয়টা ভাইরাসঘটিত হলে আপনার কিঞ্চিৎ আশঙ্কা আছে।
ইতি
আপনার স্নেহধন্য
ফোর্টি নাইন আসাদুজ্জামান
মাসুম রহমান সব কাগজপত্র ডাস্টবিনে ফেলে তিনবার বললেন, গাধা, গাধা, গাধা।
কী কুক্ষণেই না এই লোকের কথা মন দিয়ে শুনেছিলেন। তার উচিত ছিল প্রথম দিনেই তাকে কানে ধরে চেম্বার থেকে বের করে দেয়া। বদের বাচ্চা!
কিং ফয়সল হাসপাতালের চাকরি শেষ করে তিনি কানাডার একটা হাসপাতালে যোগ দিলেন। বেশকিছু বছর পার হলো। এর মধ্যে ফোর্টি নাইন আসাদুজ্জামান আর যোগাযোগ করল না। সম্ভবত ঠিকানা বের করতে পারে নি।
জানুয়ারি মাসের এক রাতের কথা। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। রিজার্ড হতে পারে এমন ঘোষণা আবহাওয়া অফিস দিয়েছে।
মাসুম রহমান স্ত্রীকে পাশে নিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসেছেন। তার হাতে বিয়ারের ক্যান। নিজেকে সুখী সুখী লাগছে। সুখী ভাবারই কথা। দুটি মেয়েরই ভালো বিয়ে দিয়েছেন। শেষ বয়সের জন্যে আলাদা করে রাখা সঞ্চয়ের পরিমাণও যথেষ্টই ভালো। স্ত্রী-ভাগ্যেও তিনি ভাগ্যবান। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে তার বড় ধরনের ঝগড়া হয়েছে এমন মনে করতে পারলেন না।
হেনা বলল, তোমাকে একটা কথা বলব?
মাসুম রহমান বললেন, কথা বলার অনুমতি লাগে না-কি!
অস্বস্তি বোধ করছি বলেই বলছি। অনেকদিন থেকেই বলতে চাচ্ছি কিন্তু বলতে পারছি না। আমার কেন জানি মনে হয় তুমি shrink করছ।
কী বললে?
তোমার হাইট কমছে। প্যান্টগুলি সব বড় লাগছে।
মাসুম রহমান বললেন, আসাদুজ্জামানের মতো কথা বলবে না।
হেনা বলল, আসাদুজ্জামানটা কে?
মাসুম রহমান বললেন, তোমার মতো একজন মূর্খ।
হঠাৎ রেগে গেলে কেন?
মূর্খের মতো কথা বললে রাগব না?
হেনা শান্ত গলায় বলল, আমি মোটেই মূর্খের মতো কথা বলছি না। তুমি যে shrink করছ এটা তুমি নিজেও জানো। তুমি সব জুতা ফেলে নতুন জুতা কিনছ। নতুন প্যান্ট কিনছ। আগের গুলি নিজে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছ।
মানুষ নতুন জুতা প্যান্ট কিনতে পারে না?
হেনা বলল, বাথরুমে ওজন মাপার যন্ত্র থাকে। হাইট মাপার কিছু থাকে না। তুমি গতমাসে হাইট মাপার যন্ত্র কিনে বাথরুমে রেখেছ।
মাসুম রহমান বললেন, শাট আপ ইউ বিচ।
রাগে মাসুম রহমানের হাত-পা কাঁপছে। বিয়ারের ক্যান স্ত্রীর মুখের উপর ছুড়ে মারতে ইচ্ছা করছে।
বাইরে রিজার্ভ শুরু হয়েছে। ঝড়ের প্রচণ্ড মাতামাতি।
হেনা বলল, আমি প্রতিদিন তোমাকে দেখছি বলে ধরতে পারছি না। তুমি কতটুকু খাটো হয়েছ বলবে? এটা কি কোনো নতুন রোগ? এর কি কোনো চিকিৎসা আছে?
মাসুম রহমান মুখ বিকৃত করে F অক্ষর দিয়ে কুৎসিত একটা ইংরেজি গালি দিলেন। তার হাইট ছিল পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। এখন হয়েছে চার ফুট নয় ইঞ্চি।
ফোর্টি নাইন।
“আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ” সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ