প্রথম খণ্ড
ভাগ : ২ – ইতিহাস
পরিচ্ছেদ – ৫
এটা প্রত্যাশা করা খুবই স্বাভাবিক ছিলো যে বিপ্লব বদলে দেবে নারীর ভাগ্য। কিন্তু এটি তেমন কিছুই করে নি। মধ্যবিত্তের বিপ্লব শ্রদ্ধাশীল ছিলো মধ্যবিত্তের সংস্থাগুলো ও মূল্যবোধের প্রতি, এবং এটা সম্পন্ন হয়েছিলো প্রায়-পুরোপুরিই পুরুষদের দ্বারা। এ-সত্যটির ওপর জোর দেয়া দরকার যে প্রাচীনব্যবস্থা ভরে শ্রমজীবী শ্ৰেণীগুলোর নারীরাই স্ত্রীলিঙ্গদের মধ্যে উপভোগ করেছে সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা। তারা ব্যবসা চালাতে পারতো এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সব আইনগত অধিকার তাদের ছিলো। তাদের বস্তুগত স্বাধীনতা তাদের অধিকার দিতে বিপুল স্বাধীন আচরণের : জনগণের নারী বাইরে যেতে পারতো, যেতে পারতো সরাইখানায়, পুরুষদের মতো ইচ্ছেমতো সম্ভোগ করতে পারতো নিজেদের দেহ; তারা ছিলো স্বামীদের সহচর ও সমান। লৈঙ্গিক স্তরে নয়, তারা পীড়ন ভোগ করতো আর্থনীতিক স্তরে। পল্লীতে চাষীনারীরা খামারের কাজে বেশ বড়ো অংশ নিতো; তাদের গণ্য করা হতো ভৃত্য বলে; অনেক সময় তারা স্বামী ও পুত্রদের সাথে বসে খেতে পেতো না, যদিও খাটতো তাদের থেকে বেশি, এবং তাদের অবসাদের সঙ্গে যুক্ত হতো মাতৃত্বের বোঝা। তবে প্রাচীন কৃষিসমাজের মতোই পুরুষের কাছে তারা দরকারি ছিলো বলে মর্যাদা পেতো স্বামীর কাছে; ঘরে তাদের ছিলো প্রবল কর্তৃত্ব। তবে সাধারণ মানুষেরা বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় নি এবং তার ফলও ভোগ করে নি।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীদের কথা বলতে গেলে, তাদের কিছু প্রবল উৎসাহে কাজ করেছেন মুক্তির পক্ষে, যেমন মাদাম রোলা এবং লুসিল দেসমুলি। এঁদের মধ্যে একজন ঘটনাক্রমের ওপর ফেলেছিলেন গভীর প্রভাব, তিনি শার্লৎ কোর্দা, যখন তিনি আততায়িত করেন মারাৎকে। নারীদের কিছু বিক্ষোভও প্রদর্শিত হয়েছিলো, অলিম্প দ্য গজে ১৭৮৯-এ প্রস্তাব করেছিলেন ‘নারীর অধিকার ঘোষণা’, যেটি সমতুল্য ছিলো ‘মানবাধিকার ঘোষণা’র, যাতে তিনি পুরুষের সমস্ত সুযোগসুবিধা লোপের দাবি করেন; এবং অবিলম্বে শেষ হন বধ্যমঞ্চে। তখন নানা ক্ষীণায়ু সাময়িকী বেরোয়, এবং কিছু নারী চালান রাজনীতিক কর্মকাণ্ডের নিস্ফল প্রয়াস।
১৭৯০-এ উত্তরাধিকার লাভে বয়োজ্যষ্ঠ পুরুষের বিশেষ অধিকার লোপ পায়; এক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা সমান হয়ে ওঠে। ১৭৯২-এ গৃহীত হয় বিবাহবিচ্ছেদ আইন; এতে শিথিল হয় বৈবাহিক দাসত্ব। তবে এগুলো ছিলো তুচ্ছ বিজয়। মধ্যবিত্ত নারীরা পরিবারে এতো খাপ খেয়ে গিয়েছিলো যে তারা নিজেদের মধ্যে লিঙ্গ হিশেবে কোনো সংহতি বোধ করে নি; তারা অধিকারের দাবি আরোপ করার মতো কোনো স্বতন্ত্রজাত ছিলো না : আর্থনীতিকভাবে তারা যাপন করতে পরগাছার অস্তিত্ব। আর্থিক ক্ষমতা যখন আসে শ্রমিকদের হাতে, তখন শ্রমজীবী নারীদের পক্ষে সম্ভব হয় এমন সব অধিকার ও সুবিধা আদায় করে নেয়া, যা কখনো সম্ভব হয় নি ওই পরগাছা নারীদের, অভিজাত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, পক্ষে অর্জন করা।
বিপ্লবের সময় নারীরা পেয়েছিলো এক ধরনের নৈরাজ্যমূলক মুক্তি। কিন্তু সমাজ যখন আবার সংগঠিত হয়, নারী নতুনভাবে আবদ্ধ হয় কঠোর দাসত্ববন্ধনে। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্রান্স এগিয়ে ছিলোঅন্যান্য দেশ থেকে; কিন্তু আধুনিক ফরাশি নারীর দুর্ভাগ্য এই যে তার মর্যাদা স্থির হয় এক সামরিক একনায়কত্বের কালে; নেপলিয়নি বিধি, তার ভাগ্যকে এক শতাব্দীর জন্যে বিধিবদ্ধ করে, তার মুক্তিকে বিপুলভাবে শ্লথ করে দেয়। সব সামরিক ব্যক্তির মতো নেপলিয়ন নারীর মধ্যে দেখতে পছন্দ করতে একটি মা; কিন্তু একটি বুর্জোয়া বিপ্লবের উত্তরাধিকারীরূপে সে এমন লোক ছিলো না যে বিপর্যস্ত করবে সমাজের সংস্থিতি, এবং মাকে দেবে স্ত্রীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব। সে পিতৃত্ব খোঁজা নিষিদ্ধ করে; অবিবাহিত মা ও অবৈধ সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেয় কঠোর শর্ত। তবে বিবাহিত নারী নিজে কোনো মর্যাদা পায় নি মা হিশেবে; সামন্ততান্ত্রিক অসঙ্গতিকে দেয়া হয় স্থায়িত্ব। বালিকা ও স্ত্রীকে বঞ্চিত করা হয় নাগরিক অধিকার থেকে, যার ফলে তার পক্ষে সম্ভব হয় না আইনব্যবসা ও অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করা। তবে কুমারী নারী, চির-আইবুড়ো, ভোগ করতো সমস্ত নাগরিক অধিকার, কিন্তু বিয়েতে বজায় থাকতো সে-পুরোনো পরনির্ভরতা। স্ত্রী বাধ্য থাকতো স্বামীর অনুগত থাকতে; ব্যভিচারের অপরাধে স্বামী তাকে একলা ঘরে বন্দী করে রাখতে পারতো এবং বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারতো; যদি ব্যভিচারের কাজের সময় স্বামী ধরতে পারতো স্ত্রীকে, খুন করতো স্ত্রীকে, আইনের চোখে সে ক্ষমার্হ হতো; আর স্বামী যদি বাড়িতে নিয়ে আসতো রক্ষিতা, তাহলে তার হতো সামান্য দণ্ড; এবং এ-ঘটনার জন্যেই শুধু স্ত্রী স্বামীর কাছে থেকে পেতে পারতো বিবাহবিচ্ছেদ। স্ত্রীর দেহ ও সম্পদ ছিলো কঠোর বৈবাহিক নিয়ন্ত্রণের অধীন।
উনিশ শতকে আইনশাস্ত্র চাপিয়ে দেয় ওই বিধির কঠোর প্রয়োগ। ১৮২৬-এ লুপ্ত হয় বিবাহবিচ্ছেদ, এবং ১৮৮৪-র আগে আর পুনপ্রবর্তিত হয় নি; তখনও এটা ছিলো কঠিন। ঘোষণা করা হয় যে নারী তৈরি হয়েছে পরিবারের জন্যে, রাজনীতির জন্যে নয়; গৃহস্থালির জন্যে, সামাজিক কাজের জন্যে নয়। অগাস্ত কোঁৎ ঘোষণা করেন বিশেষভাবে মানবপ্রজাতিতে, শারীরিক ও নৈতিকভাবে, নারী ও পুরুষের মধ্যে রয়েছে মৌল পার্থক্য, যা তাদের করে তুলেছে গভীরভাবে ভিন্ন। নারীত্ব ছিলো এক ধরনের ‘প্রলম্বিত শৈশব’, যা তাকে পৃথক করে তুলেছে ‘জাতির আদর্শরূপ থেকে’ এবং তার মনকে করেছে দুর্বল। তিনি গৃহের বাইরে নারীর শ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন। নৈতিকতা ও প্রেমে নারীকে মনে করা যেতে পারে শ্রেষ্ঠতর; কিন্তু পুরুষ করতো কাজ, যখন নারী আর্থিক বা রাজনীতিক অধিকারহীন হয়ে থাকতো বাড়িতে।
বালজাক আরো নৈরাশ্যজনক ভাষায় প্রকাশ করেছেন একই বিশ্বাস। ফিজিয়লজি দি মারিয়াজ-এ তিনি লিখেছেন : ‘পুরুষের হৃদয়কে স্পন্দিত করাই নারীর নিয়তি ও একমাত্র গৌরব… সে এক অস্থাবর সম্পত্তি এবং ঠিকভাবে বললে সে পুরুষের পাশে এক গৌণ জিনিশ’। এখানে তিনি আঠারো শতকের অনুমোদন ও এ-সময়ের ভীতিকর প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে কথা বলছেন নারীবিরোধী মধ্যবিত্ত শ্ৰেণীটির পক্ষে। বালজাক দেখিয়েছেন প্রেমহীন বুর্জোয়া বিয়ে স্বাভাবিকভাবেই এগোয় ব্যভিচারের দিকে, এবং তিনি স্বামীদের পরামর্শ দিয়েছেন শক্তহাতে বল্গা ধরে রাখতে, স্ত্রীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি না দিতে, তাদের যতোখানি সম্ভব অসুন্দর রাখতে। মধ্যবিত্ত শ্ৰেণীটি নারীদের রান্নাঘরে ও বাড়িতে বন্দী করে রেখে, তাদের আচরণের ওপর সতর্ক চোখ রেখে, তাদের পুরোপুরি নির্ভরশীল করে রেখে মেনে চলেছে এ-কর্মসূচি। ক্ষতিপূরণ হিশেবে তাদের দেয়া হতো সম্মান এবং তাদের সঙ্গে করা হতো চরম ভদ্র ব্যবহার। ‘বিবাহিতা নারী এক দাসী, যাকে বসিয়ে রাখতে হবে সিংহাসনে’, বলেছেন বালজাক। অধিকাংশ বুর্জোয়ানারী গ্রহণ করেছিলো এ-কারুকার্যমণ্ডিত বন্দীত্ব; আর অল্পসংখ্যক যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁদের কথা শোনা হয় নি। বার্নার্ড শ বলেছেন মানুষকে শেকলমুক্ত করার থেকে শৃঙ্খলিত করা সহজ, যদি শেকল হয় লাভজনক। মধ্যবিত্ত নারী আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো তার শেকল, কেননা সে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো তার শ্ৰেণীর সুযোগসুবিধা। পুরুষের হাত থেকে মুক্ত হয়ে নিজের জীবিকার জন্যে কাজ করতে হতোতাকে; সে শ্রমজীবী নারীর সাথে কোনা সংহতি বোধ করে নি, এবং তার বিশ্বাস ছিলো বুর্জোয়া নারীর মুক্তির অর্থ হচ্ছে তার শ্রেণীর বিনাশ।
তবে ইতিহাসের অগ্রগতি এসব একগুঁয়ে প্রতিরোধে থেমে থাকে নি; যন্ত্রের আগমন ধ্বংস করে ভূসম্পত্তিশালীদের এবং নারীদের সাথে শ্রমজীবীদের মুক্তিকেও ত্বরান্বিত করে। সব ধরনের সমাজতন্ত্র, পরিবার থেকে নারীদের জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে, প্রশস্ত করে নারীর মুক্তি। প্লাতো স্বপ্ন দেখেছিলেন এক ধরনের সংঘব্যবস্থার এবং তাদের দিতে চেয়েছিলেন এমন স্বায়ত্তশাসন, যা উপভোগ করতো স্পার্টার নারীরা। সাৎ-সিমো, ফুরিয়ে, ও কাবের ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রের সাথে জন্ম নেয় ‘মুক্তনারী’র ইউটোপিয়া; বিলুপ্ত করা হয় শ্রমিক ও নারীর দাসত্ব, কেননা নারীরাও পুরুষের মতো মানুষ। দুর্ভাগ্যক্রমে এ-যৌক্তিক ভাবনা সাৎ-সিমোবাদী ধারায় প্রাধান্য লাভ করে নি। ফুরিয়ে, উদাহরণস্বরূপ, গোলমাল পাকিয়ে তোলেন নারীমুক্তি ও মাংসের পুনর্বাসনের মধ্যে, তিনি দাবি করেন যে প্রতিটি মানুষকে সাড়া দিতে হবে তার কামনার ডাকে এবং বিয়ের স্থান নেবে প্রেম; তিনি নারীকে মানুষ হিশেবে গণ্য করে দেখেছেন শুধু তার কামমূলক ভূমিকা। কাবে নারীপুরুষের সম্পূর্ণ সাম্যের প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু তিনি নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে বাধা দেন। অন্যরা নারীমুক্তি না চেয়ে দাবি করেন নারীদের সুশিক্ষা। নারী যে এক পুনর্জীবনদাত্রী শক্তি, এ-ধারণা টিকে ছিলো উনিশ শতক ভরে এবং আবার দেখা দেয় ভিক্তর উগোতে। নারীপক্ষীয়দের অযোগ্যতার ফলে নারীর আন্দোলন হারিয়ে ফেলে তার সুনাম। বিভিন্ন সংঘ, সাময়িকী, প্রতিনিধিদল, ‘ব্লুমারবাদ’-এর মতো আন্দোলনগুলো–সবই হয়ে ওঠে হাস্যাস্পদ। তখনকার সবচেয়েমেধাবী নারী মাদাম দ্য স্তেল ও জর্জ সাঁ নিজেদের স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করে দূরে থাকেন এসব আন্দোলন থেকে। তবে উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলন সাধারণভাবে ছিলো নারীবাদের পক্ষে, কেননা এটা চেয়েছিলো সাম্যের মধ্যে সুবিচার। প্রধো ছিলো এক অসাধারণ ব্যতিক্রম। সে নারীদের নিকৃষ্টতা দেখাতে চেয়ে ভঙ্গ করে নারীবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে মৈত্রি, সতীনারীকে ঠেলে দেয় গৃহে, ও পুরুষনির্ভরতায়। সে বেছে নিতে বলে ‘গৃহিণীকে অথবা বেশ্যা’কে। তবে সব নারীবিরোধীর মতোই পুরুষের দাসী ও দর্পণ ‘প্রকৃত নারী’র প্রতি সে নিবেদন করে অতি আকুল প্রার্থনাগীতি। তবে এ-গভীর ভক্তি সত্ত্বেও সে ব্যর্থ হয়নিজের স্ত্রীকে সুখী করতে : মাদাম প্রধোর পত্রাবলি এক দীর্ঘ বিলাপ।
এসব তাত্ত্বিক বিতর্ক ঘটনাক্রমের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে নি : এগুলো বরং যা ঘটছিলো, এগুলো ছিলো তার দ্বিধাগ্রস্ত প্রতিফলন। নারীরা পুনরুদ্ধার করে এমন এক আর্থিক গুরুত্ব, যা তারা হারিয়েফেলেছিলো প্রাগৈতিহাস কাল থেকে, কেননা তারা মুক্তি পায় চুলো থেকে এবং কারখানায় উৎপাদনের ক্ষেত্রে পায় একটি নতুন ভূমিকা। যন্ত্রই সম্ভব করে তোলে এ-অভ্যুত্থানকে, কেননা অনেকাংশেই লোপ পায়নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের শারীরিক বলের পার্থক্য। কলকারখানার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে দরকার পড়ে অনেক বড়ো শ্রমশক্তি, যা শুধু পুরুষের পক্ষে যোগানো সম্ভব হয় নি, তাই দরকার হয়ে পড়ে নারীদের সহযোগিতা। এটাই ছিলো উনিশ শতকের মহাবিপ্লব, যা রূপান্তরিত করে দেয় নারীদের ভাগ্য, এবং তাদের জন্য সূচনা করে এক নতুন যুগের। মার্ক্স ও এঙ্গেলস পরিমাপ করেন এর সম্পূর্ণ বিস্তারটি, এবং তারা সর্বহারার মুক্তির মধ্যে দেখতে পান নারীর মুক্তি। আসলে, ‘নারীও শ্রমিকদের এখানেই মিল : তারা উভয়ই নির্যাতিত’, বলেছেন বেবেল। এবং প্রাযুক্তিক বিবর্তনের ফলে তাদের শ্ৰম যে-গুরুত্ব পাবে, তাতে উভয়েই নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে একই সাথে। এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে নারীর ভাগ্য শক্তভাবে বাঁধা ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির সাথে; একটি বিপর্যয় মাতৃধারার স্থানে বসিয়েছিলো পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এবং নারীকে বেঁধে ফেলেছিলো উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তির দাসত্বে। তবে শিল্পবিপ্লব ছিলো ওই অধিকারহানির বিপ্রতীপমূর্তি এবং যা নিয়ে যায় নারীমুক্তির দিকে।
উনিশ শতকের শুরুতে নারীদের লজ্জাকরভাবে শোষণ করা হয়েছে পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায়। ঘরে নারীশ্রমকে ইংরেজেরা বলতো ‘ঘর্মায়ণ পদ্ধতি’; নিরন্তর শ্রম সত্ত্বেও নারীশ্রমিকেরা তাদের অভাব মেটানোর মতো আয় করতে পারতো না। জুলে সিমো তাঁর লইউভরিয়েতে এবং এমনকি রক্ষণশীল লিয়োয়-বয়লো ১৮৭৩-এ প্রকাশিত তাঁর ল্য ত্রাভেল দে ফেমে ও ১৯-এ, নিন্দা করেছেন এ-হীন পীড়নের; পরেরজন বলেছেন যে ফ্রান্সের দু-লক্ষেরও বেশি নারীশ্রমিক দিনে পঞ্চাশ সাঁতিমের থেকেও কম আয় করে। মালিকেরা অনেক সময় পুরুষদের থেকে বেশি পছন্দ করতো নারীদের। ‘তারা কম মজুরিতে বেশি কাজ করে’। এ-নিরাশাজনক সূত্র আলোকিত করে তোলে নারীশ্রমের নাটকটিকে। কেননা শ্রমের মধ্য দিয়েই মানুষ হিশেবে নারী জয় করেছে তার মর্যাদা; তবে এটা ছিলো একটা অতি কষ্টার্জিত ও প্রলম্বিত বিজয়।
সুতো কাটা ও কাপড় বোনার কাজ করতে হতো শোচনীয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। ব্লকু লিখেছেন, ‘লায়নে ফিতার কারখানায় নারীদের কাজ করতে হয় অনেকটা দোয়ালে ঝুলে থেকে, যখন তারা উভয় পা ও হাত দিয়ে কাজ করে’। ১৮৩১-এ রেশম শ্রমিকেরা গ্রীষ্মকালে কাজ করতো ভোর তিনটে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, শীতকালে কাজ করতে ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত, দৈনিক সতেরো ঘন্টা; ‘এমনকারখানায় যা অধিকাংশ সময়ই হতো অস্বাস্থ্যকর, যেখানে কখনো সূর্যালোক ঢুকতো না,’ বলেছেন নৰ্বার ত্রুকি।
তাছাড়া, পুরুষ শ্রমিকের বিশেষ সুবিধা আদায় করে নিতে তরুণী শ্রমিক মেয়েদের ওপর। অনেক সময় নারীরা কারখানায় কাজের সাথে খামারের কাজও করতো। তারা শোষিত হতো পীড়াদায়কভাবে। ডাস কাপিটাল-এর এক টীকায় মার্ক্স বর্ণনা করেছেন এটা : ‘উৎপাদনকারী, মিঃ ই., আমাকে জানিয়েছেন তিনি তার তাঁতকলে শুধু নারীদেরই নিয়োগ করেন, তিনি অগ্রাধিকার দেন বিবাহিত নারীদের, আবার তাদের মধ্যে সে-নারীদের, বাড়িতে যাদের ভরণপোষণের জন্যে আছে পরিবার, কেননা তারা অবিবাহিতদের থেকে বেশি মনোযোগী আর বশমানা; এবং পরিবারের ভরণপোষণের জন্যে তারা তাদের শক্তির শেষকণাটি ক্ষয় করে কাজ করে’। জি দারভিল লিখেছেন : ‘পোষাপ্রাণী বা ভারবাহী পশু : এই হচ্ছে আজকাল নারী। যখন সে কাজ করে না তখন তার প্রতিপালন করে পুরুষ আর সে এখনও প্রতিপালিত হয়পুরুষ দিয়ে যখন সে কাজ করতে করতে মারা যাচ্ছে’। তাদের এ অবস্থার আংশিক কারণ হচ্ছে নারীরা প্রথমে বুঝতে পানি কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হয় এবং নিজেদের সংগঠিত করতে হয় সংঘে।
১৮৮৯-৯৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে ফ্রান্সে নারীশ্রমিকেরা দৈনিক মজুরি হিশেবে পেতে পুরুষের মজুরির অর্ধেক। ১৯০৮-এর এক অনুসন্ধান অনুসারে ঘণ্টাপ্রতি শ্রমিকদের সর্বোচ্চ মজুরি বিশ সাতিমের বেশি হতো না এবং কখনো কখনো কমে দাঁড়াতে পাঁচ সাতিম; তাই এভাবে শোষিত কোনো নারীর পক্ষে ভিক্ষা করা বা কোনো রক্ষক ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। ১৯১৮তে আমেরিকায়একজন নারীশ্রমিক পেতো পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক মজুরি। এ-সময়ে জর্মন কয়লাখনিতে একজন নারীশ্রমিক সমপরিমাণ কয়লা খোঁড়ার জন্যে মজুরি পেতো একজন পুরুষ শ্রমিকের থেকে শতকরা পঁচিশ ভাগ কম। ১৯১১ থেকে ১৯৪৩-এর মধ্যে ফ্রান্সে নারীশ্রমিকদের মজুরি পুরুষ শ্রমিকদের থেকে অনেক বেশি দ্রুত বাড়ানো হয়, তারপরও তাদের মজুরি থাকে অনেক কম।
কম মজুরি নিতো বলে নারীশ্রমিকদের পছন্দ করতে নিয়োগদাতারা, আর এটাই জাগাতো পুরুষ শ্রমিকদের বিরোধিতা। বেবেল ও এঙ্গেলস যেমন দাবি করেছেন তেমন কোনো অব্যবহিত সংহতি ছিলো না সর্বহারার স্বার্থের সাথে নারীর স্বার্থের। একই সমস্যা দেখা দেয় যুক্তরাষ্ট্রে নিগ্রো শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। শোষণকারীরা সাধারণত অস্ত্র হিশেবে তাদের নিজেদের শ্রেণীরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সমাজের সবচেয়ে শোষিত সংখ্যালঘুদের; তাই তাদের শ্রেণীর কাছে প্রথমে সংখ্যালঘুদের মনে হয় শত্রু; কালো ও শাদাদের স্বার্থ, নারীশ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিকদের স্বার্থ, পরস্পরের বিরোধী না হয়ে যে লাভ করতে পারে সংহতি, এর জন্যে দরকার পরিস্থিতিকে অনেক বেশি গভীরভাবে অনুধাবন করা। এটা সহজবোধ্য যে পুরুষ শ্রমিকেরা প্রথমে এই হ্রাসমূল্যে ছাড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে দেখেছিলো এক প্রচণ্ড বিপদ, তাই তারা দেখিয়েছিলো এর বিরুদ্ধে শত্রুতা। শুধু যখন নারীরা শ্রমিক সংগঠনে সুসংহত হয়েছে, তখনই শুধু তারা রক্ষা করতে পেরেছে নিজেদের স্বার্থ এবং সমগ্র শ্রমিক শ্রেণীর জন্যে বিপজ্জনক হওয়া থেকে বিরত করতে পেরেছে নিজেদের।
নারীর এক মৌলিক সমস্যা হচ্ছে প্রজননগত ভূমিকার সাথে তার উৎপাদনশীল শ্রমের সামঞ্জস্যবিধান। ইতিহাসের সূচনা থেকে যে-মৌল সত্য গৃহকর্মে নিযুক্ত করে শেষ করে দিয়েছে নারীকে এবং তাকে বাধা দিয়েছে বিশ্বকে বদলে দেয়ার কাজে অংশ নিতে, সেটা হচ্ছে প্রজননগত ভূমিকার কাছে তার দাসত্ব। স্ত্রীপশুদের আছে একটা জৈবিক ও ঋতুগত স্পন্দ, যা তাদের রক্ষা করে শক্তি ক্ষয় থেকে; কিন্তু নারী, বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবিরতি পর্যন্ত, কতোবার গর্ভবতী হবে তার কোনো সীমা ঠিক করে দেয় নি প্রকৃতি। কোনো কোনো সভ্যতা বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করে, এবং কথিত আছে যে কিছু ভারতি গোত্রে রীতি আছে দুটি প্রসবের মধ্যে অন্তত দু-বছরের জন্যে নারীদের বিশ্রাম দেয়ার; তবে সাধারণভাবে বহু শতাব্দী ধরে নারীর উর্বরতা থেকেছে অনিয়ন্ত্রিত। প্রাচীন কাল থেকেই অস্তিত্ব আছে জন্মনিরোধকের, যা সাধারণত গ্রহণ করে নারীরা : বিষোপচার, ভেষজ নিবেশ্য, যোনিপটি; তবে ওগুলো থেকে গেছে বেশ্যা ও চিকিৎসকদের গুপ্তকথা। সম্ভবত এসব গুপ্তকথা অবক্ষয়ের কালের রোমের নারীদের জানা ছিলো, যাদের বন্ধ্যাত্ব ছিলোব্যঙ্গলেখকদের আক্রমণের লক্ষ্য। তবে মধ্যযুগের ইউরোপে অজানা ছিলো জন্মনিরোধক; আঠারো শতক পর্যন্ত ওগুলোর একটি টুকরোও পাওয়া যায় নি। ওই সময়ে নারীর জীবন ছিলো অব্যাহত গর্ভের পর গর্ভ; এমনকি সহজ সতীত্বের নারীরাও তাদের অবাধ প্রেমের মূল্য শোধ করতো ঘনঘন গর্ভধারণ করে।
কোনো কোনো পর্বে মানুষ জনসংখ্যা কমানোর তীব্র প্রয়োজন বোধ করেছে; তবে একই সময়ে রাষ্ট্র ভয় পেয়েছে দুর্বল হয়ে যাওয়ার। সংকট ও দুর্যোগের সময় হয়তো জন্মহার কমিয়েছে দেরিতে বিয়েরমাধ্যমে, তবে সাধারণ নিয়ম থেকেছে অল্প বয়সে বিয়ে করা এবং নারীর পক্ষে যতো বেশি সন্তান উৎপাদন সম্ভব ততো সন্তান উৎপাদন; শিশুমৃত্যুই শুধু হ্রাস করতো জীবিত সন্তানের সংখ্যা। সতেরো শতকেই আবে দ্য পির প্রতিবাদ করেছিলেন নারীদের ‘প্রেমে পেটফোলা রোগ’-এ দণ্ডিত করার বিরুদ্ধে; এবং মাদাম দ্য সেভিএ তাঁর কন্যাকে উপদেশ দিয়েছিলেন ঘনঘন গর্ভবতী না হওয়ার। তবে আঠারো শতকে ফ্রান্সে বিকশিত হয় মালথাসীয়বাদ। প্রথমে উচ্চবিত্ত শ্রেণীগুলো, তারপর সাধারণ জনগণ পিতামাতার অবস্থানুসারে সন্তানের সংখ্যা কমানোকে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করে, এবং শুরু হয় জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া। প্রথমে বহিরপাত রীতি ছড়িয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে, তারপর গ্রামবাসী ও শ্রমিকদের মধ্যে। ফ্রান্সে নিষিদ্ধ ছিলো জন্মনিয়ন্ত্রণমূলক প্রচারণা ও যোনিপটি ও এধরনের অন্যান্য জিনিশ বিক্রি; তবে বেশ ব্যাপকভাবেই চলতো ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ’।
গর্ভপাত কোথাও আইনে সরকারিভাবে অনুমোদিত ছিলো না। রোমান আইন ভ্রূণজীবনের জন্যে কোনো বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নি; এ-আইন প্রসব্যকে মায়ের শরীরের অংশ বলেই গণ্য করতো, মানুষ হিশেবে নয়। অবক্ষয়ের কালে গর্ভপাত এক স্বাভাবিক প্রচল হয়ে উঠেছিলো। যদি স্বামীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গর্ভপাত ঘটাতো স্ত্রী, সে স্ত্রীকে শাস্তি দিতো, তবে ওটা তার অবাধ্যতার অপরাধের জন্যে। সমগ্র প্রাচ্যদেশীয় ও গ্রেকো-রোমান সভ্যতায় গর্ভপাত অনুমোদিত ছিলো।
খ্রিস্টধর্ম ভ্রূণকে একটি আত্মা দিয়ে নৈতিক বিপ্লব ঘটায়; এর পর থেকে গর্ভপাত হয়ে ওঠে ভ্রূণের বিরুদ্ধে অপরাধ। সেইন্ট অগাস্টিনের মতে, ‘যে-নারী তার পক্ষে যতোগুলো সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব ততোগুলো সন্তান জন্ম দেয় না, সে ততোগুলো হত্যাকাণ্ডের অপরাধে অপরাধী, ঠিক তেমনই অপরাধী সে-নারী, যে গর্ভধারণের পর আহত করে নিজেকে’। যাজকীয় আইন বিকশিত হয় ধীরেধীরে, তারা অন্তহীন আলোচনা করে এ-প্রশ্ন নিয়ে যে আসলে ঠিক কখন আত্মা প্রবেশ করে ভ্রূণের দেহে। সেইন্ট টমাস ও অন্যরা ঠিক করেন পুরুষের বেলা আত্মা ঢোকে চল্লিশ দিনের দিন আর মেয়ের বেলা ঢোকে আশি দিনের দিন। মধ্যযুগে গর্ভপাতের জন্যে নানা মাত্রার অপরাধ নির্দিষ্ট হয় গর্ভপাতের সময় ও কারণ অনুসারে : ‘যে-গরিব নারী প্রতিপালন করতে পারবে না বলে শিশু ধ্বংস করে এবং যার লাম্পট্যের অপরাধ লুকোনো ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নেই, তাদের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে,’ প্রায়শ্চিত্ত পুস্তক বলেছে একথা। উনিশ শতকে গর্ভপাত হত্যাকাণ্ড এ-ধারণা লোপ পায়; একে গণ্য করা হয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ বলে। ক্যাথলিক গির্জা তাঁর কঠোরতা হ্রাস করে নি; ১৯১৭তে গির্জা গর্ভপাতে জড়িত সবাইকে ধর্ম থেকে বহিষ্কার করার বিধান দেয়। পোপ এই সম্প্রতিও ঘোষণা করেছেন যে মায়ের জীবন ও শিশুর জীবনের মধ্যে উৎসর্গ করতে হবে আগেরটিকে : অবশ্য মায়ের যেহেতু অপ্সুদীক্ষা হয়েছে, সে স্বর্গে প্রবেশাধিকার পেতে পারে। কিন্তু মজার কথা যে নরক কখনো এসব হিশেব করে না। আর ভ্রূণ অনন্তকাল কাটাতে থাকবে লিম্বোতে। গর্ভপাত সরকারিভাবে স্বীকৃত হয়েছিলো শুধু অল্পকালের জন্যে : জর্মানিতে নাটশিবাদের আগে, এবং ১৯৩৬-এর আগে রাশিয়ায়। কিন্তু ধর্ম ও আইস সত্ত্বেও সব দেশেই এটা অধিকার করে আছে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
নারীর অবস্থার বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে হবে দুটি কারণের একযোগে কাজ হিশেবে : উৎপাদনশীল শ্রমে অংশগ্রহণ ও প্রজননের দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ। এঙ্গেলস যেমন আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, রূপান্তরিত করে দিতে হবে নারীর সামাজিক ও রাজনীতিক মর্যাদা। নারীবাদী আন্দোলন, ফ্রান্সে যার রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন কদরসে, ইংল্যান্ডে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট তার ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওম্যান-এ, এবং উনিশ শতকের শুরুতে যা আবার শুরু করেছিলেন সাৎ-সিমোবাদীরা, তা কোনো সুস্পষ্ট ফল লাভ করতে ব্যর্থ হয়, কেননা তার অভাব ছিলো বাস্তব ভিত্তির। কিন্তু এখন, যখন নারীরা স্থান নিয়েছে কলকারখানায় এবং বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে, তখন তাদের দাবি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তির মাধ্যমেই নারী শক্তভাবে বাঁধা ছিলো স্বামীর সঙ্গে; বিষয়সম্পত্তি অতীতের ব্যাপার হয়ে ওঠায় স্বামী-স্ত্রী শুধুই স্থাপিত হয় পাশাপাশি; এমনকি সন্তানেরাও তাদের ততোটা শক্তভাবে বেঁধে রাখতে পারে না যেমন বেঁধে রাখতে সম্পত্তির স্বার্থ। এভাবে ব্যক্তি মুক্তি পায়দল থেকে।
এ-প্রক্রিয়াটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় আমেরিকায়, যেখানে জয়ী হয়েছে আধুনিক পুঁজিবাদ : বিবাহবিচ্ছেদ বাড়তে থাকে এবং স্বামীস্ত্রীরা সাময়িক সহচরের বেশি কিছু থাকে না। ফ্রান্সে এ-বিবর্তন শ্লথগতিতে ঘটতে বাধ্য হয়, কেননা এখানে পল্লীর জনগণ এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং নেপলিয়নি বিধি বিবাহিত নারীকে রেখেছে অন্যের কর্তৃত্বে। ১৮৮৪তে পুনপ্রবর্তিত হয় বিবাহবিচ্ছেদ; স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ পেতে পারতোযদি স্বামী ব্যভিচার করতো। তবে দণ্ডশাস্ত্রে রক্ষিত হয় লিঙ্গভিন্নতা : ব্যভিচার ছিলো আইনত অপরাধ, যদি করে স্ত্রী। ১৯০৭-এ দেয়া হয় ন্যাসরক্ষকের কিছুটা ক্ষমতা, যা পুরোপুরি দেয়া হয় ১৯১৭তে। ১৯১২তে অনুমোদিত হয় স্বাভাবিক পিতৃত্ব নির্ণয়ের অধিকার। ১৯৩৮ ও ১৯৪২-এ সংশোধিত হয় বিবাহিত স্ত্রীর মর্যাদা : আনুগত্যের কর্তব্য বাতিল করা হয়, যদিও পিতাই থাকে পরিবারের প্রধান। সে-ই ঠিক করে। বাসস্থান, যদি যথেষ্ট কারণ থাকে তাহলে স্ত্রী তার পছন্দের বিরোধিতা করতে পারে। তার আইনগত ক্ষমতা বাড়ানো হয়; কিন্তু এ-গোলমেলে বিবৃতিতে : ‘বিবাহিত স্ত্রীর সমস্ত আইনগত ক্ষমতা রয়েছে। শুধু বিয়ের চুক্তি ও আইনানুসারেই এসব ক্ষমতা খর্ব করা সম্ভব,’ এ-ধারার শেষাংশ প্রথমাংশের বিরোধী। স্বামীস্ত্রীর সাম্য তখনও অর্জিত হয় নি।
বলতে পারি ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ও যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিক অধিকার সহজে অর্জিত হয় নি। ১৮৬৭ অব্দে জন স্টুয়ার্ট মিল ইংরেজি সংসদে নারীদের ভোটাধিকারের পক্ষে প্রথম বক্তৃতা করেন, এটাই নারীরভোটাধিকারের পক্ষে প্রথম সরকারিভাবে প্রদত্ত বক্তৃতা। তাঁর লেখায় তিনি পরিবারে ও সমাজেষীপুরুষের সাম্যের জন্যে প্রবলভাবে দাবি জানান। ‘আমি নিশ্চিত যে-সামাজিক ব্যবস্থা আইনের দ্বারা এক লিঙ্গকে অধীন করে আরেক লিঙ্গের, সেটা সহজাতভাবেই খারাপ এবং সেটা মানুষের প্রগতির বিরুদ্ধে একটা বড়ো বাধা; আমি নিশ্চিত ওগুলো স্থান ছেড়ে দেবে বিশুদ্ধ সাম্যের জন্যে’। তাঁর অনুসরণে মিসেম ফসেটের নেতৃত্বে ইংরেজ নারীরা নিজেদের রাজনীতিকভাবে সংগঠিত করে, ফরাশি নারীরা জড়ো হয় মারিয়া দারাইসেঁর পেছনে, যিনি ১৮৬৮ থেকে ১৮৭১ র মধ্যে একরাশ সম্মেলনে আলোচনা করেন নারীর অবস্থা। লিয়ো রিশিয়ে, যিনি ছিলেন নারীবাদের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা, ১৮৬৯-এ প্রকাশ করেন ‘নারীর অধিকার’, এবং ১৮৭৮-এ এ-সম্পর্কে আয়োজন করেন আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনের। তখনও নারীদের ভোটাধিকারের প্রশ্নটি তোলা হয় নি, নারীরা নাগরিক অধিকার দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে নিজেদের। তিরিশ বছর ধরে ফ্রান্সে ও ইংল্যান্ডে এ-আন্দোলন থেকেছে খুবই ভীরু। স্থাপিত হয়েছে অসংখ্য সংঘ, কিন্তু অর্জন হয়েছে সামান্যই, কেননা লিঙ্গ হিশেবে নারীদের ছিলো সংহতির অভাব।
ভোটাধিকার পেতে ফরাশি নারীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৪৫ পর্যন্ত।
নিউজিল্যান্ড নারীদের পূর্ণ অধিকার দেয় ১৮৯৩-এ; অস্ট্রেলিয়া ১৯০৮-এ। ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় ভোটাধিকার লাভ ছিলো খুবই কঠিন। ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ড নারীদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো গৃহের ভেতরে; জেন অস্টিন লেখার জন্যে গোপনে লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে; বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছিলেন নারীরা ‘এক উপপ্রজাতি, যাদের কাজ হচ্ছে প্রসব করা’। সেখানে ১৯০৩ পর্যন্ত নারীবাদ ছিলো ভীরু, যখন প্যাংখারস্ট পরিবার লন্ডনে স্থাপন করে নারীদের সামাজিক ও রাজনীতিক সংঘ, এবং নারীবাদী আন্দোলন ধরে এক অনন্য ও উগ্র রূপ। ইতিহাসে এই প্রথম নারীদের দেখা যায় নারী হিশেবে কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করতে। ১৯১২তে গৃহীত হয় আরো হিংস্র কৌশল : তারা বাড়িতে আগুন লাগায়, চিত্রকলা নষ্ট করে, পায়ে পিষে লণ্ডভণ্ড করে ফুলের কেয়ারি, পুলিশের দিকে পাথর ছোড়ে, বারবার প্রতিনিধিদল পাঠিয়েঅ্যাসকুইথ ও স্যার অ্যাডওয়ার্ড গ্রেকে ঘিরে ফেলে, জনসভার বক্তৃতায় ব্যাঘাত ঘটায়। মাঝখানে ঘটে মহাযুদ্ধ। ১৯১৮ অব্দে ইংরেজ নারীরা পায় নিয়ন্ত্রিত ভোটাধিকার, এবং ১৯২৮এ অনিয়ন্ত্রিত ভোটাধিকার। তাদের সাফল্য অনেকাংশে সম্ভব হয়েছিলো যুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালনের ফলে।
শুরু থেকেই আমেরিকার নারীরা অনেক বেশি মুক্ত ছিলো ইউরোপীয় বোনদের থেকে। উনিশ শতকের শুরুতে পুরুষদের সঙ্গে নারীদের করতে হয়েছিলো নতুন দেশে বসতি স্থাপনের কঠোর কাজ; পুরুষের পাশে থেকে তারা লড়াই করেছে; পুরুষের থেকে সংখ্যায় তারা ছিলো অনেক কম, এবং এটা তাদের খুব মূল্যবান করে তুলেছিলো। তবে ক্রমশ তাদের অবস্থা হয়ে ওঠে তাদের পুরোনো বিশ্বের নারীদের মতোই; তাদের খুব ভক্তি করা হতো এবং তারা পরিবারে ছিলো কর্তৃত্বশীল, তবে সামাজিক কর্তৃত্ব পুরোপুরিই ছিলো পুরুষের হাতে। ১৮৩০ এর দিকে কিছু নারী রাজনীতিক অধিকার দাবি করতে থাকে; এবং তারা প্রচারাভিযান চালাতে থাকে নিগ্রোদের পক্ষে। কুয়েকারনেত্রী লুক্রেশিয়া মোট স্থাপন করেন আমেরিকান নারীমুক্তি সংঘ, এবং ১৮৪০-এর এক সম্মেলনে ঘোষণা করেন কুয়েকার-অনুপ্রাণিত এক ইশতেহার, যা ঠিক করে দেয় আমেরিকার সব নারীমুক্তি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। ‘পুরুষ ও নারীকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, স্রষ্টা তাদের ভূষিত করেছে কতিপয় হস্তান্তরঅযোগ্য অধিকারে.. সরকার স্থাপিত হয়েছে শুধু এসব অধিকার রক্ষা করার জন্যে… পুরুষ বিবাহিত নারীকে এক নাগরিক শবে পরিণত করেছে… সে জোর করে নিজে অধিকার করেছে জিহোভার সমস্ত অধিকার, দাবি করেছে যে নারীর জন্যে এক পৃথক এলাকা বরাদ্দ করা তার অধিকার’। তিন বছর পরে হ্যারিয়েট বিশার স্টো লেখেন আংকেল টমস কেবিন, যা নিগ্রোদের পক্ষে গড়ে তোলে জনমত। এমার্সন ও লিংকন নারীমুক্তি আন্দোলন সমর্থন করেন। গৃহযুদ্ধের পর নারীবাদীরা নিষ্ফলভাবে দাবি করেন যে-সংশোধনী নিগ্রোদের ভোটাধিকার দিয়েছে সেটা যেনো নারীদেরও ভোটাধিকার দেয়; দ্ব্যর্থকতার সুযোগ নিয়ে সুজ্যান বি অ্যান্থনি ও তার চোদ্দোজন সঙ্গী রস্টারে ভোট দেন; তাঁকে একশো ডলার দণ্ডিত করা হয়। ১৮৬৯-এ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নারী ভোটাধিকারের জন্যে জাতীয় সংঘ; এবং একই বছরে ওইমিংগে নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। ১৮৯৩-এ ভোটাধিকার দেয়া হয়কোলোরাডোতে, তারপর ১৮৯৬-এ আইডাহো ও ইউটাতে।
তারপর অগ্রগতি ঘটে খুব ধীরে; তবে আর্থিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা ইউরোপের নারীদের থেকে অনেক বেশি সাফল্য লাভ করে। ১৯২০-এ নারীর ভোটাধিকার দেশের আইনে পরিণত হয়।
লাতিন দেশগুলো, প্রাচ্যদেশগুলোর মতো, আইন দিয়ে যতোটা অধীনে রাখে। নারীদের তারচেয়ে বেশি রাখে প্রথার কঠোরতা দিয়ে। ইতালিতে ফ্যাশিবাদ যথারীতি বাধা দিয়েছে নারীবাদের অগ্রগতিতে। গির্জার সাথে মৈত্রি চেয়ে, পরিবারকে যেমন ছিলো তেমন রেখে, নারীদাসত্বের ধারা বজায় রেখে ফ্যাশিবাদী ইতালি নারীকে বন্দী করে দ্বিগুণ দাসত্বে : শাসক কর্তৃপক্ষের কাছে এবং তার স্বামীর কাছে। জর্মনিতে ঘটনাক্রম ছিলো খুবই ভিন্ন। হিপেল নামক এক ছাত্র ১৭৯০-এ জোরে ছুঁড়ে দিয়েছিলো প্রথম নারীবাদী ইশতেহার, এবং উনিশ শতকের শুরুতে বিকশিত হতে থাকে এক ধরনের ভাবালুতাপূর্ণ নারীবাদ, যা স্বভাবে ছিলো জর্জ সার নারীবাদের সগোত্র। ১৮৪৮-এ প্রথম জন নারীবাদী নারী লুইজা ওটো জাতীয়বাদের চরিত্র সংস্কারে নারীর অংশগ্রহণের অধিকার দাবি করেন এবং ১৮৬৫তে স্থাপন করেন নারীসংঘ। জর্মন সমাজতন্ত্রবাদীরা অনুকূলে ছিলো নারীবাদের, এবং ১৮৯২-এ দলের নেতাদের মধ্যে ছিলেন ক্লারা জেটকিন। নারীরা ১৯১৪তে যুদ্ধে অংশ নেয়; এবং জর্মনির পরাজয়ের পর নারীরা পায় ভোটাধিকার এবং সক্রিয়হয় রাজনীতিতে। রোজা লুক্সেমবার্গ স্পার্টাকাস সংঘে লড়াই করেন এবং আততায়িত হন ১৯১৯-এ। অধিকাংশ জর্মন নারী সমর্থন করে শৃঙ্খলার দলকে; অনেকে রাইসস্টাগেও আসন গ্রহণ করেন। এ-মুক্তনারীদের ওপর হিটলার নতুনভাবে চাপিয়ে দেয় নেপলিয়নি আদর্শ : কাইস, কির্স, কিন্টার–রান্নাঘর, গির্জা, শিশু। এবং সে ঘোষণা করে যে ‘নারীর উপস্থিতি রাইসস্টাগকে অপমানিত করবে’। নাটশিবাদ ছিলো ক্যাথলিকবিরোধী ও বুর্জোয়াবিরোধী, তাই এটা মাতৃত্বকে দেয় এক সুবিধাপ্রাপ্ত স্থান, অবিবাহিত মাদের ও অবৈধ সন্তানদের বিশেষ নিরাপত্তা দিয়ে এটা নারীকে বিয়ের বন্ধন থেকে অনেকটা বের করে আনে। স্পার্টায় যেমন, এখানে নারী কোনো বিশেষ পুরুষের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নির্ভরশীল ছিলো রাষ্ট্রের ওপর; এটা তাকে পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যবিত্ত নারীর থেকে বেশি স্বাধীনতা দিয়েছিলো।
সোভিয়েত রাশিয়ায় নারীবাদী আন্দোলন লাভ করেছে ব্যাপকতম অগ্রগতি। উনিশ শতকের শেষভাগে এটা দেখা দেয় শিক্ষার্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে, এমনকি তখনই তারা জড়িত ছিলো হিংস্র বিপ্লবাত্মক কর্মকাণ্ডের সাথে। রুশ-জাপান যুদ্ধের সময় অনেক কাজে নারীরা দখল করে পুরুষের স্থান এবং সাম্যের জন্যে সংঘবদ্ধ দাবি জানায়। ১৯০৫-এর পর তারা অংশ নেয় রাজনীতিক ধর্মঘটে, সৃষ্টি করে অবরোধ; এবং বিপ্লবের কিছু দিন আগে ১৯১৭তে তারা পিটার্সবার্গে প্রদর্শন করে এক গণবিক্ষোভ, দাবি করে রুটি, শান্তি, ও তাদের পুরুষদের প্রত্যাবর্তন। অক্টোবর অভ্যুত্থানে এবং পরে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে, তারা পালন করে এক বড় ভূমিকা। মার্ক্সীয় ধারার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে লেনিন শ্রমিকের মুক্তির সাথে যুক্ত করেন নারীর মুক্তিকে; তিনি তাদের দেন রাজনীতিক ও আর্থনীতিক সাম্য।
নারীর মর্যাদা বিষয়ক জাতিসংঘ কমিশন সম্প্রতি এক বৈঠকে সব দেশে দু-লিঙ্গের সাম্যকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়েছে, এবং এটি এ-আইনি ধারাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্যে গ্রহণ করেছে কয়েকটি প্রস্তাব। তাই মনে হতে পারে যে খেলায় জিৎ হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ আরো গভীর গভীরতরভাবে নারীদের অঙ্গীভূত করবে আমাদের একদা পুংলৈঙ্গিক সমাজে।
এ-ইতিহাসের দিকে সাধারণভাবে তাকালে আমরা দেখতে পাই এর থেকে বেরিয়ে আসছে কয়েকটি সিদ্ধান্ত। সবার আগে আছে এটি : নারীর সম্পূর্ণ ইতিহাস পুরুষের তৈরি। ঠিক যেমন আমেরিকায়কোনো নিগ্রো সমস্যা নেই, বরং আছে এক শাদা সমস্যা; ঠিক যেমন ‘ইহুদিবিদ্বেষ ইহুদির সমস্যা নয়; এটা আমাদের সমস্যা’; ঠিক তেমনি নারী সমস্যা সব সময়ই ছিলো একটি পুরুষের সমস্যা। আমরা দেখেছি শুরু থেকেই কেননা পুরুষের শারীরিক শক্তির সাথে ছিলো নৈতিক শক্তি; তারা সৃষ্টি করেছে মূল্যবোধ, লোকাচার, ধর্ম; ওই সাম্রাজ্য নিয়ে নারী কখনো পুরুষের সাথে বিবাদ করে নি। কয়েকজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি–সাফো, ক্রিস্তিন দ্য পিসা, মেরি ওলস্টোনক্রাফট, অলিপ দ্য গজে–তাদের নিয়তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, এবং কখনো কখনো গণবিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে; তবে রোমান মাতৃরা সফল হয় নি ওপ্পিয়ান আইনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে, অ্যাংলো-স্যাক্সন ভোটাধিকার দাবিকারীরাও চাপ দিয়ে সফল হয় নি, যতোদিন না পুরুষকে বাধ্য করা হয়েছে নতি স্বীকারে। পুরুষ সব সময়ই নিজ হাতে ধরে রেখেছে নারীর ভাগ্য; এবং এটা কী হওয়া উচিত তা ঠিক করেছে পুরুষ, তবে তা নারীর স্বার্থে করে নি, করেছে নিজেদের পরিকল্পনা, ভীতি, ও প্রয়োজন অনুসারে। যখন তারা দেবী মহামাতাকে ভক্তি করেছে, তারা তা করেছে প্রকৃতিকে ভয় করেছে বলে; যখন ব্রোঞ্জের হাতিয়ার আবিষ্কারের ফলে তারা দৃপ্তভাবে প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়ায়, তারা প্রতিষ্ঠা করে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা; তারপর পরিবার ও রাষ্ট্রের বিরোধ স্থির করে দেয়নারীর মর্যাদা; খ্রিস্টানের ঈশ্বর, বিশ্ব, ও নিজ দেহের প্রতি তার মনোভাব প্রতিফলিত হয় নারীর পরিস্থিতিতে, যা সে নির্ধারিত করে নারীর জন্যে; মধ্যযুগে যাকে বলা হতো ‘নারী নিয়ে ঝগড়া’, সেটা ছিলোযাজকশ্রেণী ও সাধারণ পুরুষের মধ্যে বিবাহ ও কৌমার্য নিয়ে ঝগড়া : সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা অনুসারে যে-সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা বিবাহিত নারীর জন্যে নিয়োগ করে অভিভাবক, এবং আজ পুরুষের অর্জিত প্রযুক্তিগত বিবর্তন মুক্ত করেছে নারীকে। পুরুষের নীতিবোধের রূপান্তরের ফলেই জন্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিবারের আকার কমানো সম্ভব হয়েছে, এবং নারী আংশিক মুক্ত হয়েছে মাতৃত্বের দাসত্ব থেকে। নারীবাদ কখনই কোনো স্বায়ত্তশাসিত আন্দোলন ছিলো না : অংশত এটা ছিলো রাজনীতিবিদদের হাতের এক হাতিয়ার, অংশত ছিলো একটি অন্তপ্রপঞ্চ, যা প্রতিফলিত করে গভীর সামাজিক নাটককে। নারী কখনো কোনো পৃথক জাত সৃষ্টি করে নি, সত্য কথা বলতে কী লিঙ্গ অনুসারে তারা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের কথাও ভাবে নি। অধিকাংশ নারী কোনো কর্মোদ্যোগ গ্রহণের বদলে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে নিজেদের; আরা যারা এটা বদলে দিতে চেয়েছেন, তাঁরা নিজেদের বিশেষ অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে বন্দী থেকে একে জয়ী করতে চান নি, বরং এর থেকে ওপরে উঠতে চেয়েছেন। যখন তারা বিশ্বের কর্মকাণ্ডে ঢুকেছেন, তারা তা করেছেন পুরুষের সাথে খাপ খাইয়ে, পুরুষের প্রেক্ষাপটে।
যে-শ্ৰেণীগুলোর মধ্যে নারী কিছুটা আর্থিক স্বাধীনতা ভোগ করেছে এবং অংশ নিয়েছে উৎপাদনে, সেগুলো ছিলো শোষিত শ্রেণী, এবং নারীশ্রমিক বেশি দাসত্বে বন্দী হয়েছিলো পুরুষ শ্রমিকদের থেকে। শাসক শ্রেণীগুলোর মধ্যে নারী ছিলো পরগাছা এবং এজন্যে অধীনে ছিলো পুরুষের বিধিবিধানের। উভয় ক্ষেত্রেই নারীর পক্ষে কোনো কর্মোদ্যোগ গ্রহণ ছিলো বাস্তবিকভাবে অসম্ভব। আইন আর লোকাচার অনেক সময় সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো না, এবং এ-দুয়ের মধ্যে এমনভাবে স্থাপিত হতো ভারসাম্য যে নারী কখনোই বস্তুগতভাবে মুক্ত থাকতো না। প্রাচীন রোমান প্রজাতন্ত্রে আর্থিক অবস্থা মাতৃদের দিয়েছিলো বস্তুগত ক্ষমতা, কিন্তু তাদের কোনো আইনগত স্বাধীনতা ছিলো না। কৃষিসভ্যতায় ও নিম্ন ব্যবসায়ী মধ্যবিত্ত শ্রেণীতেও নারীর অবস্থা ছিলো অনেক সময় একই রকম : গৃহিণী, গৃহের দাসী, কিন্তু সামাজিকভাবে অপ্রাপ্তবয়স্ক।বিপরীতভাবে, সামাজিক বিপর্যয়ের পর্বগুলোতে নারী পেয়েছে মুক্তি, কিন্তু পুরুষের অনুগত দাসী না হওয়ায় সে হারিয়েছে তার ফিফ; সে পেয়েছে শুধু এক নেতিবাচক স্বাধীনতা, যা প্রকাশ পেয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষতিকর আমোদপ্রমোদে। একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে সমাজে বিবাহিত নারীর একটি স্থান ছিলো, কিন্তু তার কোনো অধিকার ছিলো না; কিন্তু অবিবাহিত নারীর, সতী হোক বা বেশ্যা হোক, ছিলোপুরুষের মতো সব আইনগত অধিকার, তবে এ-শতাব্দী পর্যন্ত তারা ছিলো সামাজিক জীবন থেকে বর্জিত।
আইনগত অধিকার ও সামাজিক প্রথার এ-বিরোধ থেকে, আরো অনেক কিছুর সাথে, দেখা দিয়েছে এ-অসঙ্গতিটি : অবাধ যৌনপ্রেম আইনে নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু ব্যভিচার অপরাধ; কিন্তু যে-তরুণী ‘ভুল পথ’-এ গেছে,তাকে অনেক সময়ই নিন্দিত করা হয়, কিন্তু স্ত্রীর অসদাচরণকে দেয়া হয় প্রশ্রয়; এবং এজন্যে সতেরো শতক থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত অনেক তরুণী বিইয়ে করেছে শুধু অবাধে প্রেমিক নেয়ার জন্যে। যে-সব নারী পুরুষের সমতুল্য সাফল্য অর্জন করেছেন, তাঁরা উন্নীত হয়েছেন সব ধরনের লৈঙ্গিক বৈষম্যের উর্ধে অবস্থিত সামাজিক সংস্থাগুলোর শক্তি দিয়ে। রাণী ইসাবেলা, রাণী এলিজাবেথ, মহান ক্যাথেরিন পুরুষও ছিলেন না নারীও ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন সার্বভৌম শাসক। ধর্মও ঘটায় একই ধরনের রূপান্তর : সিয়েনার ক্যাথেরিন, সেইন্ট তেরেসা তাঁদের শারীরবৃত্তিক বিবেচনা পেরিয়ে ছিলেন সন্ত আত্মা।
বোঝা যায় অন্য নারীরা যে বিশ্বে গভীর ছাপ ফেলতে পারে না, তার কারণ তারা তাদের পরিস্থিতির সাথে শক্তভাবে বাঁধা। তারা নঞর্থক ও পরোক্ষভাবে ছাড়া কোনো কিছুতেই হাত দিতে পরে না। জুডিথ, শার্লট কর্দি, ফেরা জাসুলিস ছিলেন আততায়ী; ফ্রদোসরা ছিলেন ষড়যন্ত্রকারী; বিপ্লবের সময়, কমিউনের কালে নারীরা পুরুষের সাথে লড়াই করেছে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। অধিকারহীন, ক্ষমতাহীন মুক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যাখ্যানে ও বিপ্লবে অংশ নিতে দেয়া হয়েছে নারীদের, কিন্তু নিষিদ্ধ করা হয়েছে সদর্থক গঠনমূলক কাজে; বেশি হলে পরোক্ষ পথে তারা পুরুষের কাজে অংশ নিয়ে সফল হতে পেরেছে। আম্পাসিয়া, মাদাম দ্য মতেনো, রাজকন্যা দেস উরসি ছিলেন উপদেষ্টা, যাদের কথা গুরুত্বের সাথে শোনা হতো। তবে যদি এমন কেউ থাকতো, যে তাদের কথা শুনতে চাইতো। নারীরা যুদ্ধ বাধানোর উশকানি দিতে পেরেছে, যুদ্ধের কৌশল প্রস্তাব করতে পারে নি; তারা তখনই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে রাজনীতি যখন রাজনীতি নেমে গেছে যড়যন্ত্রের স্তরে; বিশ্বের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ কখনোই নারীর হাতে আসে নি; তারা কৌশল বা অর্থব্যবস্থার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি, তারা রাষ্ট্র ভাঙে নি গড়ে নি, তারা নতুন বিশ্ব আবিষ্কার করে নি। তাদের মধ্য দিয়ে ঘটেছে কিছু ঘটনার সূত্রপাত, তবে তাতে নারীরা ছিলো অজুহাত, সংঘটক নয়। লুক্ৰেতিয়ার আত্মহত্যার ছিলো শুধু প্রতীকী মূল্য। শহিদত্ব খোলা শোষিতের জন্যে; খ্রিস্টানদের পীড়নের কালে, সামাজিক বা জাতীয় পরাজয়ের প্রভাতে, নারীরা সাক্ষ্য দেয়ার এ-কাজটি করেছে; কিন্তু কখনোই কোনো শহিদ বিশ্বের মুখমণ্ডল বদলে দেয় নি। এমনকি নারী যখন কিছু শুরু করেছে এবং প্রদর্শন করেছে বিক্ষোভ, এসব কার্যক্রম তখনই গুরুত্ব লাভ করেছে যখন কোনো পুরুষের সিদ্ধান্ত তা সম্প্রসারিত করেছে। হ্যারিয়েট বিশার স্টোকে ঘিরে সমবেত নারীরা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সৃষ্টি করেছে তীব্র জনমত; তবে বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধের সত্যিকার কারণগুলো ভাবালুতাধর্মী ছিলো না। ১৯১৭ অব্দের ৮ মার্চের ‘নারীদিবস’ হয়তো রুশবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছে। তবে ওটা ছিলো একটি সংকেত মাত্র।
অধিকাংশ নারী বীরাঙ্গনারাই অস্বাভাবিক : সাহসিকারা ও আদিতমারা যতোটা উল্লেখযোগ্য তাদের কাজের গুরুত্বের জন্যে, তার চেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য তাদের নিয়তির অনন্যতার জন্যে। তাই আমরা যদি জোয়ান অফ আর্ক, মাদাম রোলা, ফ্লোরা লিস্তানকে তুলনা করি রিশলো, দাঁতো, লেনিনের সাথে, দেখতে পাই যে তাঁদের মহত্ত্ব প্রধানত আত্মগত : তারা ঐতিহাসিক সংঘটক নন, তার দৃষ্টান্তমূলক মানবমূর্তি। মহাপুরুষ উঠে আসেন জনগণ থেকে এবং পরিস্থিতি তাকে চালিয়ে নেয় সামনের দিকে; নারী জনমণ্ডলি থাকে ইতিহাসের প্রান্তদেশে এবং পরিস্থিতি প্রতিটি নারীর জন্যে প্রতিবন্ধক, স্প্রিংবোর্ড নয়। বিশ্বের মুখমণ্ডল বদলানোর জন্যে প্রথম দরকার সেখানে দৃঢ়ভাবে নোঙর পাতা; কিন্তু যে-নারীদের শেকড় সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত, তারা সমাজের অধীনস্থ; কোনো ঐশী শক্তি দিয়ে কর্মে প্রবর্তিত না হলে সেখানেই তারা নিজেদের দেখাতে পেরেছেন পুরুষের সমান বলে–উচ্চাভিলাষী নারী ও বীরাঙ্গনা হয়ে ওঠে অদ্ভুত দানব। যখন থেকে নারীরা পৃথিবীতে স্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে, তখন থেকেই শুধু আমরা দেখত পাচ্ছি রোজা লুক্সেমবার্গ, মাদাম কুরির মতো নারীর আবির্ভাব। তাঁরা দীপ্তভাবে দেখিয়েছেন যে নারীর নিকৃষ্টতা নারীকে ঐতিহাসিকভাবে তুচ্ছ করে তোলে নি বরং তাদের ঐতিহাসিক তুচ্ছতাই তাদের করেছে নিকৃষ্ট।
এ-সত্যটি উজ্জ্বলভাবে স্পষ্ট সে-এলাকায়, যেখানে নারী সবচেয়ে সফল হয়েছে নিজেদের দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করতে–অর্থাৎ, সংস্কৃতির এলাকায়। তাদের ভাগ্য গভীরভাবে জড়িয়ে আছে সাহিত্য ও শিল্পকলার ভাগ্যের সাথে; প্রাচীন জর্মনদের মধ্যে দৈবজ্ঞা ও যাজিকার ভূমিকা ছিলো একান্তভাবে নারীর যোগ্য কাজ। ইতালীয় রেনেসাঁসের কালে বিকশিত হয়েছিলো যে-প্রণয়মূলক অতীন্দ্রিয়তাবাদ, মানবতাবাদী ঔৎসুক্য, সৌন্দর্যম্পৃহা, সতেরো শতকের পরিমার্জিতি, আঠারো শতকের প্রগতিশীল আদর্শবাদ–সবগুলোই বিভিন্ন রূপে নারীত্বকে করেছে পরমায়িত। এভাবে নারী হয়ে ওঠে কবিতার ধ্রুবতারা, শিল্পকলার বিষয়বস্তু; অবসর তাকে সুযোগ দেয় চেতনার আনন্দের কাছে আত্মোৎসর্গ করতে; লেখকের প্রেরণা, সমালোচক, ও পাঠকগোষ্ঠি, সে হয়ে ওঠে তার প্রতিপক্ষ; নারীই মাঝেমাঝে সংবেদনশীলতার কোনো একটি রীতিকে প্রধান করে তোলে, তৈরি করে এমন নীতি, যা তৃপ্ত করে পুরুষচিত্তকে, এবং এভাবে সে হস্তক্ষেপ করে নিজের নিয়তির ওপর নারীর শিক্ষা ছিলো বৃহদংশে নারীর এক বিজয়। তবে বুদ্ধিজীবী নারীদের যৌথ ভূমিকা যতোই গুরুত্বপূর্ণ হোক-না-কেনো, তাদের ব্যক্তিগত অবদান সাধারণভাবে হয়েছে কম মূল্যবান। যে কিছু সৃষ্টি করতে চায় নতুনভাবে, তার জন্যে বিশ্বের প্রান্তদেশে বাস করাটা অনুকূল অবস্থান নয়: এখানে আবার, বিদ্যমান অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্যে, প্রথম দরকার অবস্থার মাঝে গভীরভাবে মূল প্রোথিত করা। যাদের সম্মিলিতভাবে রাখা হয়েছে নিকৃষ্ট পরিস্থিতিতে সে-মানব গোষ্ঠির মধ্যে থেকে ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জন প্রায় অসম্ভব। মারি বাশকির্তসেভ জানতে চেয়েছিলেন, ‘একজন কোথায় যেতে পারে, স্কার্ট পরে?’ স্তেদাল বলেছিলেন : ‘সব প্রতিভা, যারা জন্মেছেন নারী হয়ে, নষ্ট হয়েছেন জনগণের কল্যাণে’। সত্য বলতে কী, কেউ প্রতিভা হয়ে জন্মায় না : প্রতিভা হয়ে ওঠে; আজ পর্যন্ত নারীর পরিস্থিতি এই হয়ে ওঠাকে করে রেখেছে বাস্তবিকভাবে অসম্ভব।
নারীর ইতিহাস থেকে নারীমুক্তিবিরোধীরা বের করেন করেন দুটি পরস্পরবিরোধী যুক্তি : (১) নারী কখনো মহৎ কিছু সৃষ্টি করে নি; এবং (২) নারীর পরিস্থিতি মহৎ নারী ব্যক্তিত্বের বিকাশে কখনো বাধা দেয় নি। এ-মন্তব্য দুটিতে রয়েছে প্রতারণা; সুবিধাপ্রাপ্ত গুটিকয়েকের সাফল্য সম্মিলিত মানের নিম্নায়নের সাথে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে না বা তাকে অব্যাহতি দেয় না; এবং এ-সাফল্য যে এতো দুর্লভ ও সীমাবদ্ধ, তা-ই নির্ভুলভাবে প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি ছিলো তাদের প্রতিকূলে। ক্রিস্তিন দ্য পিসা, পোলি দ্য লা বার, কদরসে, জন স্টুয়ার্ট মিল,-এবং স্তেদাল যেমন মনে করেছেন, নারী সুযোগ পায় নি কোনোএলাকায়ই। এ-কারণেই আজকাল অসংখ্য নারী দাবি করে নতুন মর্যাদা; এবারও তারা দাবি করে না যে তাদের গৌরব দিতে হবে নারীত্বের জন্যে; তারা চায় তাদের মধ্যে, যেমন সমগ্র মানবমণ্ডলিতে, সীমাবদ্ধতার ওপর আধিপত্য করবে সীমাতিক্ৰমণতা; তারা চায় অবশেষে তাদের দিতে হবে বিমূর্ত অধিকার ও সম্ভবপরতা, যা একযোগে না মিললে মুক্তি হয়ে ওঠে একটা পরিহাস।
এ-বাসনা পূর্ণ হওয়ার পথে। কিন্তু যে-সময়ে আছি আমরা, সেটা এক ক্রান্তিকাল; এ-বিশ্ব, যা সব সময়ই ছিলো পুরুষের অধিকারে, আজো আছে তাদেরই অধিকারে; আজো টিকে আছে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার সংস্থা ও মূল্যবোধগুলোর বড়ো অংশ। সবখানে নারীকে সবগুলো বিমূর্ত অধিকার সম্পূর্ণরূপে দেয়া হয় নি : সুইজারল্যান্ডে এখনো তারা ভোট দিতে পারে না; ফ্রান্সে ১৯৪২-এর আইন আজো শীর্ণরূপে রক্ষা করে স্বামীর সুযোগসুবিধা। বিমূর্ত অধিকার, আমি একটু আগেই বলেছি, কখনোই নারীকে পৃথিবীর ওপর নিশ্চিত অধিকার দিতে সমর্থ হয় নি : আজো দু-লিঙ্গের মধ্যে সত্যিকার সাম্য বিরাজ করে না।
প্রথমত, বিয়ের বোঝার ভার পুরুষের থেকে নারীর ওপর অনেক বেশি। আমরা লক্ষ্য করেছি যে স্বীকৃত বা গুপ্ত জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে মাতৃত্বের কাছে দাসত্ব কমেছে; তবে এটা সর্বত্র ছড়ায় নি। গর্ভপাত যেহেতু সরকারিভাবে নিষিদ্ধ, তাই অনেক নারী তত্ত্বাবধানহীন গর্ভপাত করে নেয় স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বা বিধ্বস্ত হয় অসংখ্য গর্ভধারণে। গৃহকর্মের মতো সন্তান লালনপালনের কাজও প্রায় সবটাই করে নারী। বিশেষ করে ফ্রান্সে নারীমুক্তিবিরোধী ঐতিহ্য আজো এতো নাছোড়বান্দা যে পুরুষেরা আজো মনে করে নারীর কাজে সাহায্য করে তারা নিজেদের নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। এর ফল হচ্ছে পারিবারিক জীবনের সাথে কর্মজীবনের সামঞ্জস্য স্থাপন পুরুষের থেকে নারীর পক্ষে অনেক কঠিন। সমাজ যখন দাবি করে এ-প্রয়াস, তখন নারীর জীবন হয়ে ওঠে তার স্বামীর জীবনের থেকে অনেক কষ্টকর।
যে-সত্য নারীর বাস্তবিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা হচ্ছে অস্পষ্ট রূপরেখা নিয়ে দেখা দিচ্ছে যে-নতুন সভ্যতা, তার ভেতরে একগুঁয়েভাবে অতিশয় পুরোনো ঐতিহ্যের টিকে থাকা। এটাই সে-জিনিশ, যাকে ভুল বোঝে চটজলদি দর্শকেরা, যারা মনে করে নারীকে এখন দেয়া হচ্ছে যে-সব সম্ভাবনা, নারী তার উপযুক্ত নয়, অথবা আবার তারা, যারা এসব সম্ভাবনার মধ্যে দেখতে পায় শুধু ভয়ঙ্কর প্রলোভন। সত্য হচ্ছে নারীর পরিস্থিতি হয়ে পড়েছে ভারসাম্যহীন, এবং এ-কারণে তার সাথে খাপ খাওয়ানো নারীর পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা নারীর জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছি কলকারখানা, কর্মস্থল, অনুষদ, কিন্তু আমরা আজো বিশ্বাস করে চলছি যে বিয়েই নারীর জন্যে সবচেয়ে সম্মানজনক পেশা। যেমন আদিম সভ্যতাগুলোতে, আনন্দে নারী যে-সব কাজ করে, সে-কাজগুলোর জন্যে কমবেশি প্রত্যক্ষভাবে পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার তার আছে। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া, অন্তত রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ অনুসারে, সবখানেই আধুনিক নারীকে অনুমতি দেয়া হয় তার দেহকে শোষণের পুঁজি হিশেবে গণ্য করতে। বেশ্যাবৃত্তি সহ্য করা হয়, বীরপুঙ্গবতাকে উৎসাহিত করা হয়। এবং বিবাহিত নারীকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এটা দেখতে যে স্বামী তার ভরণপোষণ করছে কি না; এর সাথে তাকে দেয়া হয়েছে অবিবাহিত নারীর থেকে বেশি সামাজিক মর্যাদা। লোকাচার অবিবাহিত পুরুষকে কামচরিতার্থ করতে যতোটা সম্মতি দেয় তার সামান্য দেয় না অবিবাহিত নারীকে; বিশেষভাবে তার জন্যে মাতৃত্ব বাস্তবিকভাবে নিষিদ্ধ অবিবাহিত মাতা থাকে এক কেলেঙ্কারির বস্তুরূপে। কীভাবে সিন্ডেরেলার কিংবদন্তি হারাবে তার সব বৈধতা? আজো সব কিছুই তরুণীকে কঠিন ও অনিশ্চিত বিজয়ের চেষ্টার থেকে উৎসাহিত করে কোনো সুদর্শন রাজকুমারের কাছে থেকে সৌভাগ্য ও সুখ লাভ করতে। বিশেষ করে সে আশা করতে পারে ওই রাজকুমারের বদৌলতে সে উন্নতি লাভ করবে নিজের বর্ণের থেকে উচ্চবর্ণে, সারাজীবনের শ্রম দিয়েও সে কিনতে পারবে না যে-অলৌকিক ব্যাপারকে। তবে এ-আশা এক চরম অশুভ, কেননা এটা খণ্ডিত করে তার শক্তি ও তার স্বার্থকে, এ-বিভাজনই সম্ভবত নারীর প্রধানতম প্রতিবন্ধকতা। পিতামাতারা আজো কন্যাদের তাদের বিকাশের জন্যে বড়ো না করে বড়ো করে বিয়ের জন্যে; তারা এর মাঝে এতো বেশি সুবিধা দেখতে পায় যে তারা নিজেরাই এটা চাইতে থাকে; এর ফল হচ্ছে তারা সাধারণত হয় কম প্রশিক্ষিত, ভাইদের থেকে তাদের ভিত্তি হয় কম দৃঢ়, তারা তাদের পেশায় মন দেয় অনেক কম। এভাবে তারা নিজেদের নষ্ট করে, থেকে যায় নিম্ন স্তরে, হয় নিকৃষ্ট; এবং গড়ে ওঠে দুষ্টচক্র : পেশাগত নিকৃষ্টতা তাদের ভেতরে বাড়িয়ে তোলে একটি স্বামী লাভের আকাঙ্খা।
প্রতিটি সুবিধারই খারাপ দিক হিশেবে সব সময় থাকে কিছু ভার; তবে ভারটা যদি হয় খুবই বেশি, তখন ওই সুবিধাটিকে আর দাসত্বশৃঙ্খলের থেকে অন্য কিছু মনে হয় না। অধিকাংশ শ্রমিকের জন্যে আজ শ্রম হচ্ছে একঘেয়ে ধন্যবাদহীন ক্লান্তিকর খাটুনি, আর নারীর বেলা সুনির্দিষ্ট সামাজিক মর্যাদা, তার আচরণের স্বাধীনতা, বা আর্থিক মুক্তি লাভের মধ্যে দিয়ে এর ক্ষতিপূরণ ঘটে না; তাই অনেক নারী শ্রমিক ও কর্মচারীর পক্ষে কর্মের অধিকারকে মনে হতে পারে বাধ্যবাধকতা, যা থেকে বিয়ে তাদের পরিত্রাণ করবে। এ-কারণে যে নারী সচেতন হয়ে উঠেছে নিজের সম্পর্কে এবং যেহেতু সে একটি চাকুরি নিয়েনিজেকে মুক্ত রাখতে পারে বিয়ে থেকে, তাই সে আর ভীরুতার সাথে গার্হস্থ্য অধীনতা মেনে নেয় না। সে যা আশা করে, তা হচ্ছে পারিবারিক জীবন ও চাকুরির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে তাকে নিঃশেষকর, কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে না। তার পরও, যতো দিন থাকবে সুবিধার প্রলোভন আর্থনীতিক অসাম্য, যা বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে অনুগ্রহ করে এবং এ-সুবিধাপ্রাপ্ত কোনো একটি পুরুষের কাছে নারীর নিজেকে বিক্রি করার স্বীকৃত অধিকার। স্বাধীনতার পথ বেছে নেয়ার জন্যে পুরুষের থেকে নারীর দরকার হয় অনেক বেশি নৈতিক উদ্যোগ। এটা যথেষ্টরূপে অনুধাবন করা হয় নি যে প্রলোভনও প্রতিবন্ধকতা, এবং অতিশয় ভয়ঙ্করগুলোর একটি। এখানে আছে একটা ধোঁকাবাজি, কেননা প্রকৃতপক্ষে বিয়ের লটারিতে হাজার হাজারের মধ্যে বিজয় হবে একজন। আধুনিক কাল নারীদের আমন্ত্রণ জানায়, এমনকি বাধ্য করে কাজ করতে; কিন্তু এটি তাদের চোখের সামনে মেলে রাখে আলস্য ও প্রমোদের স্বর্গের সূলিক : যারা বাঁধা থাকে মাটির সাথে, তাদের থেকে এটা জয়ীদের উন্নত করে অনেক উর্ধ্বে।
আর্থিক জীবন, তাদের সামাজিক উপযোগিতা, বিয়ের মর্যাদা প্রভৃতিতে পুরুষ অধিকার করে আছে যে-সুবিধাজনক স্থান তাতে নারীরা উৎসাহ বোধ করে পুরুষদের খুশি করতে। নারীরা এখনো, অধিক অংশে, আছে অধীন অবস্থায়। তাই নারী নিজেকে দেখে না এবং তার পছন্দগুলোও করে না তার প্রকৃত স্বভাব অনুসারে বরং করে যেভাবে পুরুষ তাকে সংজ্ঞায়িত করে। তাই আমরা প্রথম নারীকে বর্ণনা করবোপুরুষ নারীকে স্বপ্নে যেমন দেখতে চেয়েছে, কেননা তার বাস্তব পরিস্থিতির একটি আবশ্যক কারণ হচ্ছে পুরুষের-চোখে-তাকে-কেমন-দেখায়।
“দ্বিতীয় লিঙ্গ- সিমোন দ্য বোভোয়ার” প্রবন্ধ বা উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
প্রথম খন্ডঃ তথ্য ও কিংবদন্তি
ভাগ – ১: নিয়তি
♦ ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ
ভাগ – ২ : ইতিহাস
♦ পিতৃতান্ত্রিক কাল ও ধ্রুপদী মহাযুগ
♦ মধ্যযুগব্যাপী থেকে আঠারো শতকের ফ্রান্স পর্যন্ত
♦ ফরাশি বিপ্লব থেকেঃ চাকুরি ও ভোট
ভাগ – ৩ : কিংবদন্তি
দ্বিতীয় খন্ডঃ আজ নারীর জীবন
ভাগ – ৪ : গঠনের বছরগুলো
ভাগ – ৫ : পরিস্থিতি
ভাগ – ৬ : যথার্থ প্রতিপাদন
ভাগ – ৭ : মুক্তির অভিমুখে