প্রেম ও কাম পরস্পর সম্পর্কিত, দুটিই নারীপুরুষের জীবনের বিশেষ পর্বে প্রবলভাবে দেখা দেয়, যদিও জীবনে দুটির গুরুত্ব সমান নয়। প্রেম স্বল্পায়ু, মানুষ প্রেমে বাঁচে না, জীবনে প্রেম অপরিহার্য নয়; প্ৰেম বিশেষ বিশেষ সময়ে কোনো কোনো নরনারীর জীবনে জোয়ারের মতো দেখা দেয়, তাতে সব কিছু- অধিকাংশ সময় তারা নিজেরাই- ভেসে তলিয়ে যায়; তবে আজীবন মানুষ বাস করে নিম্প্রেম ভাটার মধ্যে। প্রেম তীব্র আবেগ, তা ঝড় জোয়ার বন্যা স্রোত ঘূর্ণির মতোই; ওগুলোর মতোই প্রেমও দীর্ঘস্থায়ী নয়, এবং ঘার বার দেখা দিতে পারে। তবে প্ৰেমকে অতিশায়িত ক’রে দেখা রোম্যান্টিক আন্দোলন-উত্তর কালের, পুরুষের, স্বভাব। প্রেমের থেকে কামের, আশ্লেষের, আয়ু অনেক বেশি কাম দোলনা থেকে কবর, চিতা পর্যন্ত বেঁচে থাকে। অপ্ৰেম জীবন দশকপরম্পরায় যাপন করে মানুষ, অধিকাংশের জীবনেই কখনোই প্রেমের ছোয়া লাগে না; কিন্তু কামহীন জীবন অসম্ভব। যাদের কাম আচরিতার্থ, যারা সঙ্গী পায় না। কামোর, তারাও একান্ত কামযাপন করে। প্ৰেম বলতে গত আড়াই শো বছর ধরে পশ্চিমের পৃথিবী যা বোঝে, এবং পশ্চিম থেকে ঋণ করে আমরা যা বুঝি এক শতাব্দী ধ’রে, তা রোম্যানটিকদের আবিষ্কার। পুরোনো পৃথিবীতে প্রেম ছিলো না; আজি আছে একটি বড়ো কিংবদন্তি হয়ে। যে-আবেগ প্ৰেম নামে নরনারীর মনে জেগে ওঠে বিপরীত লিঙ্গের কারো জন্যে, কিশোরতরুণের কাছে যা রক্তমাংসের অনেক ওপরের কোনো স্বপ্ন ব’লে মনে হয়, তা আসলে মাংসের জন্যে মাংসের সোনালি ক্ষুধা।

কিশোর বয়সে অভাব থাকে মাংসের অভিজ্ঞতার, তাই প্রেমকে মনে হয় একান্ত হৃদয়ের; কিন্তু অভিজ্ঞতার পর তা হৃদয়াবেগ রূপে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, দুপুরের হৃদয় সন্ধ্যায়ই মাংসের উল্লাস হয়ে দেখা দেয়। প্রেম ও কাম একই জিনিশের সূচনা ও সমাপ্তি; সূচনার সঙ্গে জড়িত কাতরতা, যন্ত্রণা, আত্মোৎসর্গপরায়ণতা, মর্ষকামিতা, ব্যর্থতাবোধ; পরিণতির সঙ্গে জড়িত সম্ভোগ, সুখ, বিজয়, ধর্ষকামিতা। প্রেম উত্তেজনাপর্ব, যখন নারীপুরুষের মনে জগতে থাকে আবেগ; কাম হচ্ছে পুলকপর্ব, যখন শরীরের সাথে শরীরের ঘর্ষণে ওই আবেগ ছোয় চুড়ো; আর পরবর্তী জীবন হচ্ছে নিবৃত্তিপর্ব। প্রেম একটি মানসিক অবস্থা, এবং খুব স্বাভাবিক অবস্থা নয়; তা স্বাভাবিকতা থেকে পতন। বাঙলায় যে বলা হয় ‘প্রেমে পড়া’, তা নির্দেশ করে স্বাভাবিকতা থেকে ওই বিদ্যুতিকেই। প্রেমের উপসর্গগলোর মধ্যে রয়েছে অনিদ্রা, অন্যমনস্কতা, ক্ষুধাহীনতা, কাতরতা। প্রেমিকপ্রেমিকার চোখ ভ’রে থাকে তাদের প্ৰেমাস্পদ, তারা বাস করে অস্বাভাবিকতার মধ্যে। তবে প্রাপ্তির সম্ভাবনা তাদের কিছু কালের জন্যে সুখে ভরে দেয়। যাকে চাই তাকে না পাওয়া প্রেম, তাকে পাওয়া কাম।

মানুষ পেতে চায়, তাই কাম বা যৌনতা জীবনের খাদ্য ও পানীয়। কামচরিতার্থতা অনেকটা জীবনচরিতার্থতা। যার কামজীবন পরিতৃপ্ত নয়, সে সুস্থ নয়, খুব ভেতরে তার নিরন্তর দংশন চলতেই থাকে। একটি পুলকপ্লাবিত সঙ্গম নারীপুরুষকে যা দিতে পারে, তা আর কিছু দিতে পারে না; জন্মজন্মান্তরের আচরিতার্থ প্রেমের থেকে একবার পুলকিত সঙ্গম উত্তম। সঙ্গম বাইরের দিক থেকে রুচিকর নয়; সভ্য সংস্কৃত মানুষ কীভাবে মেতে উঠতে পারে অমন বন্যতায়, তা ভেবে অনেক মনীষী বিস্মিত হয়েছেন, এবং প্রায় সমস্ত কিশোরকিশোরী বোধ করে ঘৃণা। আমার মাবাবাও এমন করে, এমন করে আমার শিক্ষক অধ্যাপকও?-এসব প্রশ্ন জাগে তাদের মনে; এবং ঘেন্নায় তারা শিউরে নিঃশব্দে চিৎকার করে-না, না, তারা এমন করে না; তারা এতো খারাপ নয়। কিন্তু কামের কাছে কেউ বাবামা শিক্ষক অধ্যাপক মহাপুরুষ দেবদূত নয়; কামে সবাই মানুষ। পুংসকতার সাথে আদিমতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে ব’লেও অনেকের বিশ্বাস; লরেন্স বিশ্বাস করতেন যে বুর্জোয়ারা এতো সংস্কৃত যে তারা নপুংসক ক্লীব বন্ধ্যা; তাই তাদের উর্বর করার জন্যে দরকার অসংস্কৃত বর্বরের বীর্য। কাম মানবিক, কাম মানুষের সমান বয়সী।

পুরুষতন্ত্র প্রেমের জয়গান গায়, তবে প্রেমে বিশ্বাস করে না; আর কামের নিন্দা করে, তবে বিশ্বাস করে কামে। পুরুষতন্ত্রের প্রধান বিশ্বাসগুলোর প্রধানটি সম্ভবত কাম; তার বিধানগুলোতে কামকে যেটুকু নিন্দ করা হয়েছে, তা পুরুষের অংশগ্রহণের জন্যে নয়, নারীর অংশ গ্রহণের জন্যে। পুরুষ নিজের সম্ভোগের সমস্ত পথ খোলা রেখে নারীকে দীক্ষিত করেছে। সতীত্ত্বে, ঘরে রেখেছে। সতী আর বাইরে রেখেছে। পতিতা। পুরুষ নারীর কামকে নিরুদ্ধ করার জন্যে নারীকে অবরোধে, পর্দায়, জেনানায় বন্দী করেছে, তাকে সূর্যের আলো দেখতে না দিয়ে তার নাম রেখেছে অসূৰ্যম্পশ্যা, তার ভগাঙ্কুর ছিন্ন করেছে, তাকে সতীত্ববন্ধ পরিয়েছে; কিন্তু নিজের কামের তৃপ্তি খুঁজেছে নারী থেকে নারীতে। চীনের তাওবাদ- “প্রকৃতির দিকে পরম পথ”- দার্শনিক সত্যে পৌচেছে যে ‘একটি পুরুষ যতো বেশি নারীর সাথে সঙ্গম করবে ততো বেশি কল্যাণ হবে তার; যদি পুরুষ একরাতে দশটির বেশি নারীর সাথে সঙ্গম করতে পারে, তাহলে তাই সর্বোত্তম” [দ্র ট্যানাহিল (১৯৮০, ১৫৬)]। ইসলাম পুরুষের জন্যে বহুবিবাহের, এবং ক্রীতদাসীসম্ভোগের বিধান রেখে স্বীকৃতি দিয়েছে পুরুষের কামকে, আর নারীকে সতী রাখার সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। পুরুষতন্ত্র নারীর জন্যে রেখেছে প্রেম, পুরুষের জন্যে রেখেছে কাম; নারীকে দিয়েছে প্রেমের মর্ষকামিতা উপভোগ, পুরুষের জন্যে রেখেছে কামের উদ্দীপনা। যার জীবনে কিছু নেই প্রেমই তার আশ্রয়, যার জীবনে রয়েছে সাফল্য প্রেম তার জীবনের মনে-না-পড়ার মতো খণ্ডাংশ। নারী হয়ে উঠেছে প্রেমের শিকার; নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে তার কাম, যদিও পুরুষতািন্ত্র বিশ্বাস করে আগুন আর রক্কের ক্ষুধা কখনো মেটে না। সত্য হচ্ছে সভ্যতার কয়েক হাজার বছর ধরে নারী পুরুষের প্রেমে নিজের জীবন ব্যর্থতায় ভরে তুলেছে, কিন্তু তার কাম চরিতার্থতা লাভ করে নি। লৈঙ্গিক রাজনীতির সূচনাই হয় শয্যায়; শয্যায় নারীকে পরাভূত ক’রে তাকে পরাজিত করা হয়েছে জীবনের সমস্ত এলাকায়। সমস্ত কামসূত্র লেখা হয়েছে পুরুষের জন্যে; তার কামবাসনাকে চূড়ান্তরূপে পরিতৃপ্ত করার জন্যে।

নারীর জীবনে অতিশায়িত করা হয়েছে প্রেমকে। তবে তাও বৈধ প্ৰেম, যে-পুরুষের সে আশ্রিত নারীর প্রেম শুধু তারই জন্যে। যে-নারীরা বৈধ প্রেমের পথে না গিয়ে গেছে অবৈধ প্রেমের পথে, তারা নিন্দিত হয়েছে, শাস্তি পেয়েছে, তাদের জীবন বিপদ ও যন্ত্রণায় ভ’রে উঠেছে; তবে বৈধ-অবৈধ সব প্রেমই মূলত নারীর জন্যে ব্যর্থতা। পুরুষ নারীর প্রেমে দেখতে চেয়েছে মর্ষকামের প্রকাশ; পীড়িত হয়েই তারা স্মরণীয় হয়েছে। বায়রনের একটি উক্তি হচ্ছে ‘প্ৰেম পুরুষের জীবনের একটি অংশ, আর নারীর সমগ্র অস্তিত্ব।’ নারীর জীবনে কোনো সাফল্য নেই, তাই নারীর সমগ্র অস্তিত্ব সংকৃচিত হয়ে পড়ে একটি আবেগে, বা পুরুষতন্ত্র চায় নারীর সমগ্র অস্তিত্ব সংকুচিত হোক পুরুষের জন্যে আবেগে, আর সে-ই ততো মহীয়সী যে সহ্য করে যতো বেশি পীড়ন। তবে মহাপ্রেম কিংবদন্তি; প্ৰেম প্ৰধান ব্যাধি হয়ে থাকে শুধু তাদেরই জীবনে, যাদের কামনা মেটে নি। পুরুষের মতো প্ৰেম নারীর জীবনেরও অংশমাত্র; প্রেম তার জীবনে প্রধান নয়, তবে তার জীবন সংকীর্ণ, ব্যৰ্থ বলে তাকে থাকতে হয়েছে প্রেমের অসুস্থতার মধ্যেই। এখনো কি থাকে? ভাবালুতার যুগের উপন্যাসে যে-নায়িকাদের পাওয়া যায়, তাদের জীবনে প্রেম ও পুরুষ ছাড়া আর কিছু ছিলো না, তাই তারা কেঁদে বালিশ ভেজাতো, তাদের চোখ থেকে অবিরল বেরিয়ে আসতো অশ্র, আজ তেমন ঘটে না। বিরাহিণীও আজকাল দুগ্ধপ্ৰাপ্য, কিন্তু এককালে নারীমাত্রই ছিলো বিরাহিণী, আর তার নানা দশারও শেষ ছিলো না। বিরহের একেক দশায় সে ভোগ করতো একেক ধরনের পীড়ন। প্রেম ও নারীর অচ্ছেদ্য সম্পর্ক সম্বন্ধে যতো উপকথা প্রচলিত রয়েছে, তা জৈবিক নয়; তা সামাজিক পরিস্থিতিরই পরিণতি। নিটশে বলেছেন [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৬৫২) :

‘পুরুষ ও নারীর কাছে একই শব্দ প্ৰেম বোঝায় দু-জিনিশ। নারী প্রেম বলতে যা বোঝে, তা খুবই স্পষ্ট : তা শুধু ভক্তি নয়, তা প্রত্যাশাহীন নিঃশর্ত সম্পূর্ণ দেহমান সমর্পণ। তার প্রেমের শর্তহীনতার বৈশিষ্ট্য তার প্ৰেমক পরিণত করে এক ধরনের ধর্মবিশ্বাসে; এবং এই তার একমাত্র বিশ্বাস। পুরুষ যখন ভালোবাসে কোনো নারীকে, তখন সে নারীর কাছে চায় প্ৰেম;..যদি কোনো পুরুষ বোধ কবে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের বাসনা, তাহলে, আমার কথা হচ্ছে, সে পুরুষ নয়।‘

পুরুষ ধরেই নেয় যে নারী যখন প্রেমে পড়ে, তখন সে ভুলে যায় তার অস্তিত্ব, তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব; কেননা প্রেমে পুরুষ ঈশ্বর আর নারী ভক্ত। ভক্ত যেমন নিজেকে সম্পূর্ণ সমৰ্পণ করে প্রভুর পদতলে, নারীও করে তাই; কেননা প্ৰভু ছাড়া নারী নিরস্তিত্ব। পুরুষতন্ত্র নারীর আত্মোৎসর্গ আত্মসমর্পণপরায়ণতাকে মনে করে প্রাকৃতিক; মনে করে প্রকৃতিই নারীকে সৃষ্টি করেছে এভাবে। কিন্তু এর সাথে প্রাকৃতিক বা জৈববিধির কোনো সম্পর্ক নেই; এখানেও কাজ করে সামাজিক সূত্র। পুরুষ নারীকে শিখিয়েছে আত্মোৎসর্গ করতে, তাকে বাধ্য করেছে আত্মসমৰ্পণ করতে। নারী ও পুরুষের পরিস্থিতি ভিন্ন বলে তারা সব কিছুই দেখে ভিন্নভাবে, ভিন্নভাবে দেখে প্রেমকেও। নারী অস্বায়ত্তশাসিত, সমাজ তাকে কোনো কিছুর কর্তা হয়ে উঠতে দেয় না, তাই নারী প্ৰেমেও আত্মতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে না। নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া তার উপায় নেই; প্রেমে তাই সে নিজেকে সমর্পণ করে সমাজপতি পুরুষের কাছে। নারী সমৰ্পণ করে নিজের দেহ ও আত্মা পরম সত্তার কাছে, ওই পরম সত্তা কখনো পুরুষ কখনো বিধাতা। নারী জানে পরনির্ভরতাই তার নিয়তি, তাই তার জন্যে ভালো হচ্ছে কোনো দানবের বদলে কোনো দেবতাকে পুজো করা। তাই প্রেমকে নারী ক’রে তোলে ধর্ম, আত্মসমৰ্পণ ক’রে সে করতে চায় আত্মরক্ষা। নারী তার প্রেমে পড়ে, যে তাকে উন্নীত করতে পারে নিজের অবস্থান থেকে; সে পুজো করে পৌরুষের. সম্পদের, সামজিক অবস্থানের। যে-নারী নিজের থেকে নিম্ন অবস্থানের কারো জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে, সে বেছে নেয় চরম মর্ষকামিতা।

নারীর জীবনে প্রেমের অবকাশ খুবই কম। তার রয়েছে স্বামী, সংসার, সন্তান, গৃহস্থলি, কাম, এবং অনেকের রয়েছে পেশা! কাম জৈবিক, প্রেম সাংস্কৃতিক; নারী প্রেম শেখে প্রেমের অতি প্রচারের ফলেই। প্ৰেম এখন সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপিত পণ্য, অন্যান্য পণ্যের মতো এরও প্রধান ক্রেতা নারী। তবে অধিকাংশ সংস্কৃতিই নারীর জন্যে প্রেম নিষিদ্ধ ক’রে রেখেছে, তাদের জন্যে রেখেছে। বিবাহিত প্ৰেম, যা বিশেষ দরকারে পড়ে না। অনেক কিশোরীতিরুণী বিশেষ বয়সে প্রেমের স্বপ্ন দেখে : তাদের ওই স্বপ্নের পেছনে রয়েছে তাদের শরীরের প্ররোচনা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ। মনোবিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেন নারী প্রেমিকের মধ্যে খোজে পিতাকে। আসলে তারা পিতা নয়, খোজে। পুরুষকেই; যে তাকে দিতে পারে মহিমা। পুরুষ নারীর চোখে মহিমান্বিত, বাল্যকাল থেকেই তারা দেখে পুরুষের মহিমা; প্রেমিক বা স্বামীর মধ্যে তারা দেখতে চায় তা। পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজে নারী পুরুষের কাছে নিজেকে মনে করে শিশু, প্রেমিক যখন তাকে ডাকে “মিষ্টি মেয়ে’, ‘ময়না’, ‘আমার পাখি’, তখন তা তার হৃদয় স্পর্শ করে। পুরুষের বাহুতে আবার বালিকা হয়ে ওঠার আনন্দ তাদের অসীম। নারীর আত্মসমৰ্পণ। তার টিকে থাকার অভিলাষের প্রকাশ; ধর্মে ভক্ত বিধাতার কাছে আত্মসমৰ্পণ ক’রে নিজের জন্যে একটি অসামান্য স্থান ক’রে নেয়, নারীও তেমনি প্রেমে স্থান ক’রে নেয় নিজের জন্যে। দেবতার পদতলে সে হয়ে ওঠে নৈবেদ্য। প্রেমে নারীর আচরণ সামাজিক ব্যবস্থারই ফল, বাঙালি-সৌদি-মার্কিন নারীর প্রেম-আচরণ এক রকম নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ নারী কখনো প্রেমের আবেগ বোধ করে নি।

প্রেম অপরিহার্স নয়; তবে কাম অপরিহার্য। অধিকাংশ সমাজেই প্ৰেম নিষিদ্ধ, তবে কাম নিষিদ্ধ নয়। নারীর জীবনে সাধারণত কাম আসে বিয়ের মধ্য দিয়ে, বিয়েই তাদের জন্যে কামের কানাগলি। তবে নারীর বিয়ে নিজের কামের জন্যে নয়, পুরুষের কামের জন্যে; নারীর বিয়ে নারীর আত্মরক্ষার জন্যে! কোনো সংস্কৃতিই নারীর কামতৃপ্তিকে মূল্য দেয় নি, ববং বহু যত্নে লিখেছে তার কাম দমন করার বিধান। পুরুষ নারীকে চিরকাল ভয় করেছে তার কামশক্তির জন্যে, পুরুষ বুঝতে পেয়েছে কামবাসনা ৩ার য৩োই প্রবল হোক স্থলনের পর তার আর কোনো উদ্যম থাকে না; কিন্তু নারী যেনো অনন্তকাল লিপ্ত হয়ে থাকতে পারে। আরবরা নারীকে ফিৎনা বা বিশৃঙ্খলা ব’লে ভয় করে; তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে; হিন্দুরা তার কামশক্তি দেখে হয়েছে আতংকিত। পুরুষ নিজের কামকে বিরামহীনভাবে চরিতাৰ্থ করেছে, কিন্তু নারীর কামতৃপ্তির কথা ভাবে নি। পুরুষের কাছে সতী সে, যে সঙ্গমের সময়ও নড়াচড়া করে না; ভিক্টোরীয় এক পুরোহিত বলেছিলেন, ‘নোড়ো না, নারী।’ নারীর কাম সম্পর্কে পুরুষতন্ত্র দুটি বিরোধী ধারণা পোষণ ও প্রচার করে; একটি হচ্ছে নারীর কাম ক্ষুধার শেষ নেই, কিছুতেই ওই আগুন নেভে না; অন্যটি হচ্ছে নারী কাম পছন্দ করে না, নারী প্রাকৃতিকভাবেই একপুরুষে পরিতৃপ্ত। দুটিই অপপ্রচার; কেননা নারী তৃপ্ত হয়, এবং নারী কাম পছন্দ করে, নারী জৈবিকভাবে একপুরুষের সতী নয়। একাধিক পুরুষের সাথে কামসংসর্গে তার আপত্তি নেই, তবে পুরুষতন্ত্রের ভয়ে অধিকাংশ নারীই তা স্বীকার করে না। একপতিপত্নী প্রথার উদ্ভব সম্পর্কে বাখোফেন বলেছেন যে নারীরাই উদ্যোগ নিয়েছিলো একটি পুরুষের সাথে সঙ্গমের অধিকার পাওয়ার, কেননা বহু পুরুষের সাথে সঙ্গম তাদের ভালো লাগে নি। তার এ-মত সমর্থন করেছেন বিপ্লবী এঙ্গেলসও (১৮৮৪, ২১০); তিনি বলেছেন বহু পুরুষের সাথে সঙ্গমের পীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আগ্রহের সঙ্গে পরিত্রাণ হিসাবে তারা অবশ্য পাতিব্ৰত্যের অধিকার, একটি পুরুষের সঙ্গে অস্থায়ী বা স্থায়ী বিবাহ চেয়ে থাকবে।’ তাঁর এ-সিদ্ধান্তের মূলে আছে ভিক্টোরীয়বাদ, যার সিদ্ধান্ত হচ্ছে নারীরা কাম পছন্দ করে না। নারীরা কাম পছন্দ কবে না বলে একটি পুরুষের শয্যায় নিষ্ঠার সাথে পালন করতে চেয়েছে পাতিব্ৰত্য, এবং নারীদের আগ্রহেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একপতিপক্ট বিয়ে, এ-মত ঠিক নয়। পুরুষ চেয়েছে ব’লই এটা ঘটেছে; পুরুষ তার বহুসম্ভোগেব পথ খোলা রেখে নারীকে নিজের একান্ত সম্ভোগের বস্তু ক’রে তোলার জন্যেই সৃষ্টি করেছে একপতি(বহু)পত্নী বিয়ে। নারী কাম পছন্দ করে, খুবই উপভোগ করে। একনিষ্ঠতা জৈবিক নয়, সামাজিক; আর তা মনে চলতে বাধ্য হয়। শুধু নারী। পুরুষ কখনোই একনিষ্ঠতাকে মনপ্ৰাণে স্বীকার করে নি; রাজ্যের সাধুতম পুরুষটিও অভ্যন্তরে অত্যন্ত লোলুপ।

বাঙালির কামজীবন এক নিষিদ্ধ গোপন এলাকা, যদিও বাঙালি পুরুষ কামে চিংড়ির মতোই উৎসাহী। বাঙালির সামাজিক জীরনে কাম বেশ প্রবল ভূমিকা পালন ক’রে থাকে, বাঙালি পুরুষেরা একত্ৰ হ’লেই কামালাপে মেতে ওঠে, এবং তাদের সমস্ত আচরণেই কামলোলুপতা প্রকাশ পায়। বাঙালি সমাজকে অবদমিত কাম-দিয়ে-ঘেরা সমাজও বলা যায়; এবং ওই অবদমন নিয়মিতভাবে প্ৰকাশ পায় ধর্ষণরূপে। তবে শয্যায় তাদের আচরণ সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। বাঙালি নারীপুরুষের কামজীবন সম্পর্কে কিন্সে ও অন্যান্যের পুরুষের যৌন আচরণ (১৯৪৮), নারীর যৌন আচরণ (১৯৫৩), বা মাস্টার্স ও জনসনের মানুষের যৌন সাড়ার (১৯৬৬) মতো বই লেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে এ-বিষয়ে যে কিছুই লেখা হয় নি, তাতে বোঝা যায় বাঙালির কামজীবন সুস্থ নয়। যা গোপন ক’রে রাখা হয়, তা সাধারণত অসুস্থ হয়ে থাকে। এটা নিষিদ্ধ বিষয়; আর এর পীড়ন ভোগ করে নারী। বাঙালি নারীর যৌনজীবন বলাৎকার ও চরম বিবক্তিকর অবসাদের সমষ্টি। উচ্চশিক্ষিত কিছু নারী আমাকে জানিয়েছেন তারা পুলক সম্পর্কে কিছু জানেন না, তাদের স্বামীরা লাফ দিয়ে উপসংহারে পৌঁছেন, এই তাদের চাঞ্চল্যকর কামজীবন। দরিদ্র অশিক্ষিত নারীরা সাধারণত ভোগ করে স্বামীর বলাৎকার। বাঙলাদেশে প্রতিটি শয্যাকক্ষ, যদি থাকে, নারীর জন্যে বলাৎকার বা বিরক্তিকর অবসাদকক্ষ।

নারীর জীবনে কাম এক প্রধান ব্যাপার, তবে নারী যেমন তার জীবনকেই সমৰ্পণ করে কোনো পুরুষের কাছে, তেমনই সমৰ্পণ করে তার কামকেও। তার শরীর তার অধিকারে নয়, তার কামও তার অধিকারে নয়; মাৰ্গারেট স্যাংগার বলেছেন, ‘কোনো নারী নিজেকে স্বাধীন বলতে পারে না, যে তার নিজের শরীরের মালিক ও নিয়ন্ত্রক নয়।’ নারী মালিক আর নিয়ন্ত্রক নয়। তার কামেরও। ক্যাথেরিন ম্যাককিনন (১৯৮২, ১) বলেছেন, মার্ক্সবাদে যেমন শ্রম নারীবাদে তেমন কাম : যা মানুষের একান্ত আপন, কিন্তু যা হরণ করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি।’ নারীর কামকে অপরিতৃপ্ত রাখাই পুরুষতন্ত্রের রীতি। নারী কামে সক্রিয় সম্ভোগী হতে পারে না, কোনো সংস্কৃতিই চায় না। কামে নারী উদ্যোগী ভূমিকা নিক; সব সংস্কৃতিই চায় নিজের কাম দিয়ে নারী সেবা করবে। পুরুষের। নারীর জন্যে বিয়ে হচ্ছে কাম দিয়ে পুরুষের সেবা। নারী পুরুষের ভোগ্যসামগ্ৰী। কামে নারী ও পুরুষের ভিন্নতা অসীম জৈবিক সামাজিক মনস্তাত্ত্বিকভাবে : সব সংস্কৃতি চায় যে কামে পুরুষ থাকবে কর্তা, পুরুষই নিয়ন্ত্রণ করবে শয্যা; পুরুষই স্থির করবে। কখনও কতোটা কামের প্রয়োজন, কীভাবে তা পরিতৃপ্ত করা হবে। কামে পুরুষ ভূমিকা পালন করে সক্রিয় কর্তার, পুরুষের কাম তার দেহ থেকে ধাবিত হয় নারীর শরীরের দিকে, নারীর শরীর পুরুষের কামের শিকার। দ্য বোভোয়ার বলেছেন (১৯৪৯, ৩৯৪), ‘নারীকে বিদ্ধ ও উর্বর করা হয় তার যোনি দিয়ে, যা শুধু পুরুষের মধ্যবর্তীতার ফলেই পরিণত হয় কামকেন্দ্রে, এবং এটা সব সময়ই এক ধরনের বলাৎকার।’ পুরুষতন্ত্র নারীর ওই রন্ধটিকেই মনে করে নারীর কামের আকার, যেনো ওই রন্ধটিতে কয়েক মুহূর্ত কাজ করলেই নারীর কাম পরিতৃপ্ত হয়ে যায। আধুনিক যৌনবিজ্ঞান ও নারীবাদীরা দেখিয়েছেন কামসূখের জন্যে ওটি উত্তম নয়; কেননা যোনির দেয়ালের স্পর্শকাতরতা কম। নারীর রয়েছে একটি অনন্য কামপ্রত্যঙ্গ, ভগাঙ্কুর, যেটি নারীকে পৌঁছে দিতে পারে চরম পুলকে। তবে পুরুষতন্ত্র এটিকে শুধু উপেক্ষাই করে না, অনেক অঞ্চলে এটিকে উচ্ছেদও করে, যাতে নারী কখনো কাম বোধ না করে। তাই নারীর জন্যে অবধারিত বলাৎকার; বলাৎকারের ফলেই বালিকা নারী হয়ে ওঠে। পৃথিবী জুড়ে রখনো নারীর জন্যে বিবাহিত বা অবিবাহিত প্রথম সঙ্গম বলাৎকার। বাঙলাদেশের যে-কিশোরীকে আত্মীয়রা খাটের সাথে বেঁধে বাধ্য করে বাসর রাত কাটাতে, যে-কিশোরী জানে না তার শরীরকে, যে প্রস্তুত হয় নি নিজের ভেতরে কোনো শিশুগ্রহণের জন্যে, এটা তার জন্যে যেমন বলাৎকার, তেমনই বলাৎকার শিক্ষিত তরুণীর জন্যেও, কেননা তার ভেতরেও একইভাবে ঠেলে ধাব্ধিয়ে ভেঙেচুড়ে ছিড়ে ফেড়ে ঢোকে একটি অচেনা উদ্যত অবিবেচক শিশ্ন। অধিকাংশ সমাজে লৈঙ্গিক রাজনীতির হিংস্র রূপটি- বলাৎকার বা ধর্ষণ- দেখা দেয় বাসর শয্যায়। প্রথম রাতেই ছিন্নভিন্ন ওই নারীরা আর খাপ খাওয়াতে পারে না কামের সাথে, কাম হয়ে ওটে তাদের জীবনের ভীতি, অবৰ্ণনীয় অবসাদ।

কামে নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর; পুরুষই নেয় আক্রমণাত্মক ভূমিকা, নারী নিজেকে সমর্পণ করে তার আগ্রাসনের কাছে। পুরুষ, যদি সে নিজে প্রস্তুত থাকে, নারীর ভেতরে ঢুকতে পারে যে-কোনো সময়, তাই শুধু পুরুষই করতে পারে ধর্ষণ: নারী প্রস্তুত কিনা তা পুরুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বা পুরুষ মনে করে নারী সব সময়ই প্রস্তুত। চিরকালই অধিকাংশ নারী পুরুষকে তার ভেতরে গ্রহণ করেছে অপ্ৰস্তৃত অবস্থায়; তীব্ৰ পীড়নে ঘুম ভেঙে তারা দেখে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। পুরুষ, অসুস্থ অবস্থায়ও তারা বাধ্য হয় পুরুষকে প্রবেশাধিকার দিতে। নারী পুরুষকে অপ্ৰস্তুত অবস্থায় ব্যবহার করতে পারে না; কিন্তু পুরুষ পারে অপ্ৰস্তুত নারীর ভেতরে ঠেলে ঢুকতে। পুরুষ চাইলে লাশের সাথেও সঙ্গম করতে পারে। সঙ্গমে অধিকাংশ সমাজে নারীর অনুমতি বা আগ্রহের প্রয়োজন হয় না; পুরুষের কাছে নারী নিজের শস্যক্ষেত্র, ওই খেতে পুরুষ যে-কোনো সময় যে-কোনো দিক দিয়ে ঢুকতে পারে। পুরুষ নিজের কামের প্রহরীরূপে স্বর্গীয় সত্তাদেরও নিয়োগ করতে দ্বিধা করে না; হাদিসে আছে স্বামী যদি সঙ্গম চায় আর স্ত্রী না চায়, তাতে কামোর্ত স্বামীটি যদি জেগে রাত কাটায়, তবে ফেয়েশতাদের অভিশাপ সারা রাত বৰ্ষিত হয় পাপী নারীটির মাথার ওপর [দ্র পিতৃতন্ত্রের খড়গ’। এতো গুরুত্বপূর্ণ পুরুষের কাম, নারী আছে ওই কামের খাদ্য হওয়ার জন্যে। এ-জন্যেই সঙ্গমকে অনেকে মনে কবেন নারীর পরাজয, সঙ্গমের আসনেও প্রকাশিত দেখেন পুরুষাধিপত্য। দ্য বোভোয়ারও (১৯৪৯, ৪০৫-৪০৬) বলেছেন :

‘তরুণীর নিজের বলতে আছে শুধু দেহখানি : এটি তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ; যে-পুরুষটি তার ভেতরে প্রবেশ করে, সে এটি গ্রহণ করে তার থেকে;.যে-অপমান সে আশংকা করেছে তা পরিণত হয়। সত্যে : তাকে পরাভূত করা হয়, সম্মত হতে বাধ্য করা হয়, জয় করা হয়। অধিকাংশ প্রজাতির মাদিটির মতো, সঙ্গমের সময় সে থাকে পুরুষটির নিচে। অ্যাডলাব এ থেকে উৎপন্ন হীনমন্যতার চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাল্যকাল থেকেই উচ্চমন্যতা ও হীনমন্ট, তার ধারণা দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; উঁচু গাছে ওঠা কৃতিত্ব; স্বর্গ পৃথিবীর ওপরে, নরক নিচে; পড়ে যাওয়া, নিচে নামা ব্যর্থতা; ওপরে ওঠা সাফল্য; কুস্তিতে জিততে হলে প্রতিপক্ষের কােধ মাটির সাথে লাগিয়ে দিতে হয়। এতে, নারীটি পড়ে থাকে পরাজয়ের ভঙ্গিতে: তার চেয়েও খারাপ হচ্ছে পুরুষটি তার ওপর চড়ে থাকে যেভাবে সে চাবুক হাতে বল্পা ধ’রে চড়ে কোনো পশুর ওপর। সে নিজেকে সব সময় বোধ করে অক্রিয়; তাকে শৃঙ্গার করা হয়, বিদ্ধ করা হয়; সে ভোগ করে সঙ্গম, আর পুরুষটি নিজেকে প্রয়োগ করে সক্রিয়ভাবে।’

সঙ্গমের আসনও আধিপত্য-অধীনতার প্রকাশ? অসুস্থ সভ্যতায় সব কিছুই যেখানে রাজনীতি, সব কিছুই যেখানে নির্দেশ করে আধিপত্য-অধীনতার সম্পর্ক, সেখানে অন্তরঙ্গতম ব্যাপারটিও হয়ে ওঠে আধিপত্য-অধীনতার প্রতীক। বাইবেলের ভাষ্যকারেরা বুঝেছিলেন এর রাজনীতিটুকু, পুরুষ ওপরে নারী নিচেই তাঁদের মনে হয়েছে প্রাকৃতিক বিধিবদ্ধ আসন। নুহের প্লাবনের কারণ হিশেবে তাঁরা দেখিয়েছেন নারীপুরুষের বিপরীত বিহারকে, যাতে ‘নারীরা প্ৰভুত্ব করে পুরুষের ওপর’ [দ্র ফিজেস (১৯৭০, ৫১)]।

পুরুষতন্ত্রে প্রধান পুরুষের কাম; তবে নারীর রয়েছে কামসুখভোগের অধিকতর শক্তি। কাম অনেকাংশে পুরুষের একটি প্রত্যঙ্গের কাজ; কয়েক মুহূর্তে স্থলিত হ’তে পারলেই পুরুষ মুক্তি পায়। কিন্তু নারীর কাম তার পরিস্থিতির মতোই জটিল বহুস্তরিক। কোনো স্থলনে যেহেতু তার কামনার সমাপ্তি ঘটে না, তার কাম যেহেতু তার সমগ্ৰ শরীর ও চেতনায় ছড়িয়ে পড়ে, সে যেহেতু হঠাৎ জ্বলে উঠে৷ হঠাৎ নিভে যায় না, তার সূচনা থেকে সমাপ্তি যেহেতু ধীরমন্থর জলস্রোতের মতো, তাই সুখ। যেমন তাকে পরিষ্যাপ্ত করতে পারে, তেমনই সুখের অভাবও তাকে জ্বালাতে পারে দীর্ঘ সময় ধ’রে। সঙ্গমে চূড়ান্ত আত্মবিলোপ ঘটে নারীর; সে ডুবে যায় অক্রিয় অবসন্নতায়, তার চোখ বুজে আসে, যেনো ভেসে যায় ঝড় প্লাবনে অনন্ত অন্ধকারের ভেতর দিয়ে, প্রবেশ করে মাংস, জরায়ু, কবরের অন্ধকারে। নারীর মতো চূড়ান্ত আত্মবিলুপ্তির মধ্যে কাম পুরুষ কখনো উপভোগ করতে পারে না; পুরুষকে থাকে সচেতন, তার সচেতনতা তার বড়ো বাধা। নারীর জন্যে সঙ্গম ধ্যান, ধ্যানে আত্মসচেতনতা বিঘ্নকর; পুরুষের জন্যে সঙ্গম কাজ, কাজে আত্মসচেতনতা অপরিহার্য। তাই ওই ধ্যানের সময় নারীকে ডাকলে, কেমন লাগছে জানতে চাইলেও সে বিরক্ত বোধ করে; কেননা অনির্বাচনীয়কে সে উপলব্ধি করতে চায় অনির্বাচনীয়রূপেই। ষাটের দশকে নারীর কাম সম্পর্কে মাস্টার্স ও জনসনের (১৯৬৬) গবেষণা পশ্চিমে নারীকে অনেকখানি মুক্তি দেয়। পুরুষের কােমাধিপত্য থেকে; এবং নারীবাদীরা ঘোষণা করেন তাদের কামসার্বভৌমত্বের কথা। কয়েক দশক আগে ভোটাধিকার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তাদের কাছে, ষাটের দশকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কামাধিকার। এর ফলে পশ্চিম মুক্তি পায় ভিক্টোরীয়বাদ নামের রোগ থেকে, নারী অনেক বেশি উপভোগ করে তার শরীর। ষাটের দশকে নারী ফিবে পায় তার শরীর।

মাস্টার্স ও জনসন নারীর যৌন সাড়াকে ভাগ করেছেন চারটি পর্বে : উত্তেজনাপর্ব, অধিত্যকাপর্ব, পুলকপির্ব, ও শমাপর্ব। পুরুষও যায় এ-চারটি পর্বের ভেতর দিয়ে; তবে তাদের প্রত্যঙ্গের ভিন্নতা অনুসারে উপভোগ করে ভিন্ন অভিজ্ঞতা।

উত্তেজনাপর্ব : এর সূচনা ঘটে কোনো পুরুষের শরীরসংস্পর্শে, তবে কোনো পুরুষকে দেখেও এবা সূচনা ঘটতে পারে। বিভিন্ন নারী বছরের বিভিন্ন সময় বোধ করে বিশেষ উত্তেজনা; কেউ ঋতুকালে, কেউ চক্রের মধ্যভাগে, কেউ ঋতুসূচনার আগে বোধ করে তীব্ৰ কাম-উত্তেজনা। সব ধর্মেই ঋতুকালে সঙ্গম নিষিদ্ধ, যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অনেক নারী এ-সময়েই বেশি কাম বোধ করে। এ-সময়টা নিরাপদও, গর্ভসূচনার কোনো সম্ভাবনা নেই। নারীর উত্তেজনাপর্ব পুরুষের উত্তেজনাপর্বের থেকে দীর্ঘ, পুরুষ যতো সহজে উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে নারী তেমন হয় না। এ-পর্বে স্তনবৃন্ত খাড়া হয়ে ওঠে, ভগাঙ্কর আয়তনে বাড়ে, ‘ওষ্ঠগুলো’ কোমল পুরু হয়ে স্ফীত হয়, যোনি সিক্ত হয়; এবং রক্তপ্রবাহের ফলে তুকে দেখা দিতে পারে ঝিলিক, যাকে বলা হয় ‘কাম ঝিলিক’।

অধিতাক পৰ্ব : উত্তেজনাপর্বেরই সম্প্রসারণ অধিত্যকাপর্ব, উত্তেজনাপর্বে যা কিছুর সূচনা ঘটে, এ-পর্বে সে-সব পেঁৗছে তুঙ্গে। নারী এ-পর্বে ভেতরে চায় শিশ্ন। এ-পর্বে জরায়ুর গ্ৰীবা বৃদ্ধি পায়, যোনিরন্ধও বাড়ে। এর ফলে যোনির গভীরদেশে তৈরি হয় একটি থলের মতো এলাকা, যেখানে ঘটবে বীর্যপাত। এ-সময় যোনির বাইরের দিকটা বেড়ে এ-এলাকাটির ব্যাস হ্রাস পায়। মাস্টার্স ও জনসন একে বলেছেন ‘পুলকমঞ্চ’। অধিত্যকাপর্ব যতো দীর্ঘ হয় ততোই সুখকর নারীর জন্যে।

পুলকপর্ব: পুলক শরীরমিলনের লক্ষ্য। পুলক এক অনির্বচনীয় অনুভূতি; নারী এ-পর্বে বোধ করে তীব্রতম সুখ, যা প্রতি নারীর জন্যে অনন্য। পুলকই কাম্য, কেননা তা নরনারীকে পৌঁছে দেয় সুখের শিখরে; একে ভয়ও পায় অনেকে। ফরাশিরা একে বলে ‘ছোটো মৃত্যু’। নারীর পুলকের সূচনা হয় শ্রোণীদেশে, পরে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। এর সূচনা ঘটে স্তব্ধতায়, তারপর ঘটে। অদম্য পেশিসঞ্চালন, শিহরণ, ভাসমানতার অনুভূতি, উষ্ণতা, মানসিক উত্তেজনামুক্তি, ও উল্লাস। পুলক ঘটে প্রতিবর্তীতার ফলে। ভগাঙ্কুরের সাথে শিশ্ন, ওষ্ঠ বা আঙুলের ঘর্ষণের ফলে উত্তেজনার সংবাদ পৌঁছে সুষুম্নাকাণ্ডে; সেখান থেকে তা পৌঁছে দেয়া হয় নারীর শ্রোণীনিয়ন্ত্রক স্নায়ুরাশিতে। এর ফলে ঘটে পুলক। তবে সব নারীর সব সময় পুলক নাও ঘটতে পারে। ঘটবে কী ঘটবে না, তা নির্ভর করে ওই প্রতিবর্তীতায় তার মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণের মাত্রার ওপর। যে-নারী কোনো যৌননিষেধগ্রস্ত নয়, সে হয়তো সহজেই পৌঁছোয় পুলকে; কিন্তু যে নারী যৌননিষেধগ্রস্ত, সে হয়তো কখনোই পৌঁছোয় না। কেউ কেউ পুলকের সময় আলোড়িত ক’রে তোলে তার শরীর ও পরিবেশকে, শীৎকারে ভরে দেয় চারপােশ, কেউ কেউ থাকে স্তব্ধ। পুরুষের সাথে নারীর পুলকের পার্থক্য হচ্ছে নারীর কোনো বীৰ্যপাত ঘটে না।

আগে মনে করা হতো পুলক রয়েছে দু-ধরনের; একটি ভগাঙ্কুরীয়, আরেকটি যোনীয়। এ-ধারণার মূলে রয়েছে ফ্রয়েডের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সূত্র। তাঁর বিশ্বাস ছিলো যে ভগাঙ্কুরীয় পুলক নারীর বিকাশহীনতার পরিচায়ক, কেননা তা হস্তমৈথুনেই লাভ করা যায়, বালিকাও তা লাভ করতে পারে; আর যোনীয় পুলক নারীর কাম ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের পরিচায়ক, কেননা এতে বাল্যের কাম ভগন্ধুর থেকে স্থানান্তরিত হয় যোনিতে। ফ্রয়েডীয় সিদ্ধান্ত প্রথাগত কুসংস্কারের প্রকাশ : পুলক হচ্ছে পুলক, কীভাবে তার উৎপত্তি ঘটেছে তা বিবেচনার বিষয় নয়। কেউ যদি কবিতা পড়ে, সূর্যস্ত দেখে, জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় নিজের নামে শ্লোগান শুনে পুলক বোধ করে, তাও চমৎকার! এটা নিশ্চিত যে পুলকের উৎস ভগাঙ্কর, উত্তেজিত ভগান্ধুরই শুরু করে ঘটনাটি, তবে যোনিও এতে কিছুটা অংশ নেয়। ষাটের দশক থেকে নারীর কামে যোনির মর্যাদা কমে গেছে, প্রধান হয়ে উঠেছে ভগান্ধুর। কারো কারো ভগাঙ্কুর এতো প্রতিভাশালী যে একের পর এক, মেশিনগানের মতো, পুলক বোধ করতে পারে; কেউ কেউ পঞ্চাশটি পুলকের সংবাদও দিয়েছে! তবে সম্প্রতি নারীর পুলককেও পুরুষ ব্যবহার করছে নারীকে নতুন ধরনের দাসী ক’রে তুলতে; পুরুষ দাবি করছে সে যখন শিশ্ন চালাবে, তখন নারীকে বাধ্যতামূলকভাবে পেতে হবে পুলকের পর পুলকের পর পুলক। নারীর একটি দায়িত্ব হয়ে উঠেছে পুলক অর্জন করা, যে-নারী পুলক অর্জন করে না পুরুষ তাকে মনে করে প্রতারক; তাই পশ্চিমে নারী এখন পুরুষকে কামসেবা করতে গিয়ে বাধ্য হচ্ছে পুলকলাভের অভিনয় করতে। পুরুষ এখন মনে করছে নারী হচ্ছে পুলকলাভের যন্ত্র, তার কাজ শয্যাকে পুলকে পুলকে প্লাবিত করা [দ্র ক্লাইন ও স্পেন্ডার (১৯৮৭, ১১০-১২৪)]। নারীর পুলকও পুরুষেরই জন্যে!

শমপর্ব: শমাপর্ব পুলকোত্তর বা পুলকহীন সঙ্গমোেত্তর পর্ব, যখন নারীপুরুষ ফিরে যায় তাদের প্রাক-উত্তেজনা অবস্থায়। এ-পর্বে ঘটে সব কামনার নিবৃত্তি বা দেখা দেয় ব্যৰ্থতার ফলে যন্ত্রণা। পুলকের পর পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে যোনি নীরস হয়ে ওঠে, তবে উত্তেজিত করা হ’লে নারী আবার পুলকের পর পুলক পেতে পারে। নারী যদি অধিত্যকাপর্বের পর কোনো পুলক অনুভব না করে, বা ব্যর্থ সঙ্গমের পর হস্তমৈথুন করে পুলক বোধ না করে, তবে তার শান্ত অবস্থায় ফিরতে অর্ধেক দিনরাত কেটে যেতে পারে। বার বার উত্তেজনা ও পুলকলাভে ব্যর্থতা নারীর জীবনে নিয়ে আসতে পারে হতাশা ক্লান্তি অবসাদ, দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা। পৃথিবী জুড়ে অধিকাংশ নারী পুলকের অভাবে অবসাদগ্ৰস্ত।

ষাটের দশকে পশ্চিমে নারীবাদ নানা মুক্তির সাথে ঘটায় নারীর কামেরও মুক্তি; প্রধান হয়ে ওঠে পুলক, ভগাঙ্কর; কামে প্রথাগত রীতির বদলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আরেক রীতি— মুখসঙ্গম। পুলক একটি শ্লোগানে, মহান ভাবাদর্শে, পরিণত হয়। ফ্রয়েড সৃষ্টি ক’রে গিয়েছিলেন ভগাঙ্কুর ও যোনির বিরোধ; তাঁর কাছে ভগাঙ্কুর ছিলো অবিকাশের আর যোনি বিকাশের পরিচায়ক। তাঁর মতে প্রকৃত নারীকে সুখ বোধ করতে হবে যোনিতে, ভগাঙ্গুরে নয়। যদি করে, তবে সে রয়ে গেছে বালিকা; তার বিকাশ ঘটে নি, তার চিকিৎসা দরকার। এটা ইহুদি-খ্রিস্টান ধারণার ছদ্মবৈজ্ঞানিক রূপ; তিনি উচ্ছেদ না ক’রে সম্পন্ন করেন নারী খৎনা। ষাটের দশকে নারীবাদীরা ফ্রয়েডকে বাতিল করেন, বাতিল করেন অনেকটা যোনিকেও। তাদের মতে ভগান্ধুরই সুখবোধের অনন্য প্রত্যঙ্গ, এটির সাহায্যেই পুলক বোধ করে নারী; যোনি গৌণপ্রত্যঙ্গ। মাস্টার্স ও জনসন (১৯৬৬, ৪৫) বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ মানব অঙ্গসংস্থানে ভগাঙ্কুর অনন্য। এর কাজ ইন্দ্ৰিয় উদ্দীপনা গ্রহণ ও বৃদ্ধি করা। তাই নারীর রয়েছে এমন একটি প্রত্যঙ্গ, যার শারীরিক ভূমিকা শুধু যৌন উত্তেজনার সূচনা ও বৃদ্ধি করার মধ্যেই সীমিত। পুরুষের দেহসংস্থানে এমন কোনো প্রত্যঙ্গ নেই।’ কিন্তু যোনি কি বাতিল, এটা কি সম্পূর্ণরূপেই একটি নির্বোধ চামড়ার থলে? গ্রিয়ার (১৯৭০, ৪৩) প্রতিবাদ ক’রে বলেছেন, ‘এটা বাজে কথা যে পুরুষ যখন যোনিতে শিশ্ন চালায় তখন নারী কোনো কিছু অনুভব করে না; শূন্য যোনির বদলে যখন যোনির ভেতর একটি শিশ্ন ভরা থাকে তখন পুলক গুণগতভাবেই ভিন্ন।’ যোনি একেবারে অনুভূতিহীন নয়, এটিও সক্রিয় হতে পারে; অনেক যোনি শিশ্নকে ওষ্ঠ ও জিভের মতো চুষতে পারে। নারীবাদীরা ষাটের দশকেই মেটানি যোনি ও ভগাঙ্কুরের ফ্রয়েডীয় বিরোধ; তবে প্রধান ক’রে তোলেন ভগাঙ্কুরকেই। এর ফলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মৌখিক সঙ্গম। পশ্চিমে নারীরা অনেকটা ফিরে পেয়েছে তাদের শরীর, কিন্তু গ্রহ জুড়ে নারীর শরীর এখনো পুরুষের জমিদারি।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x