শৈশবে দেখতে পেয়েছি যে, পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিন সবদিকেই গ্রামগুলর ওধারে আকাশ যেনো মাটির সাথে মিশে গেছে। তখন মনে হয়েছে যে, আকাশ আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। হয়তো গ্রামের ওধারে গেলেই আকাশটাকে ধরা যাবে। তখন বড়োদের কাছে জানতে চেয়েছি আকাশ কি, গ্রামের ওধারে গেলে আকাশটাকে ধরা যায় কি-না, আকাশের উপরে ও মাটির নীচে কি আছে ইত্যাদি বিষয়গুলো এবং মুরুব্বিদের কাছে ওসবের জবাবও পেয়েছি। তাঁরা বলেছেন যে, আকাশ সাতটি। প্রথমটি জলের, দ্বিতীয়টি লৌহের, তৃতীয়টি তাম্রের, চতুর্থটি স্বর্ণের ইত্যাদি। তাঁরা আরো বলেছেন যে, পৃথিবীর উপরে অগুলো স্থাপিত আছে উপুর করা ডিশের মতো এবং অগুলোর গায়ে লটকানো আছে চন্দ্র, সূর্য ও তারকারা মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য। তাঁরা আরও বলেছেন যে, পৃথিবী থেকে প্রথম আকাশ ও তৎপরে প্রত্যেক আকাশ থেকে প্রত্যেক আকাশ পাঁচশত বছরের পথ দূরে দূরে অবস্থিত আছে। পৃথিবী থালার মতো গোল এবং এর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের দূরত্ব (মাশরেক-মাগরেব) পাঁচশ বছরের পথ। আর পৃথিবীর নীচে আছে মস্তবড়ো একটা গরু ও তার শিং-এর উপরে অবস্থিত এই পৃথিবী ইত্যাদি। নিঃসঙ্কোচে তখন উক্ত কথাগুলো উদরস্থ করেছি। কিন্তু তা হজম করতে পারিনি, ভুগেছি অজীর্ণ রোগে।
জীবনের প্রথম স্তরের চিন্তা-চেতনা সম্বন্ধে মুরুব্বিদের দেয়া ঐ সমস্ত সমাধানে বিশেষভাবে দ্বন্দ্ব জেগেছে আমার যৌবনে এবং তখন মনে জেগেছে বিবিধ প্রশ্ন। সে সমস্ত প্রশ্নের যথাযথ সমাধান আমার মুরুব্বিরা তথা পুরানপন্থীরা প্রদান করতে পারেননি।
জাগতিক নানা বিষয়ের বাস্তবভিত্তিক খুঁটিনাটি তথ্য জানার আগ্রহ আমার প্রবল থাকলেও তা জানার কোনো উপায় ছিলোনা। কেননা আধুনিক শিক্ষার কোনো সুযোগ মেলেনি আমার শৈশবে, মাত্র বাংলা বর্ণবোধ ছাড়া। যৌবনে কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের পুঁথিপাঠকদের সাথে পুঁথি পড়ে পড়ে আমাকে বাংলা ভাষা পড়বার ক্ষমতা অর্জন করতে হয় এবং তাতে প্রায় পাঁচ বছর কেটে যায়। পুঁথি সাহিত্যের অনেক আজগুবী কেচ্ছা-কাহিনীও আমাকে চমৎকৃত করে এবং ওগুলোর যথার্থ সম্বন্ধে মনে সন্দেহ জাগে। ২৫-৩০ বছর বয়সের সময় বাংলা ভাষা স্বচ্ছন্দে পড়বার ক্ষমতা অর্জিত হলে আমি স্থানীয় যুবকদের, যারা তখন শহরের স্কুল-কলেজে পড়তো, তাদের পুরোনো পাঠ্যবই এনে পড়তে শুরু করি।
কেন তা জানি না, তখন অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে বিজ্ঞানবিষয়ক পাঠ্য ও প্রবন্ধগুলোই আমার মনকে আকর্ষণ করতো সবচেয়ে বেশী। তবে ভূগোল, ইতিহাস, ভ্রমণ, জীবনী ইত্যাদি বিষয়গুলোও আমার কম প্রিয় ছিলো না। এ যাবত যে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনা আমাকে প্রশ্নমুখী করে রেখেছিলো, তার অনেকগুলো প্রশ্নের সন্তোষজনক সমাধান প্রাপ্ত হই আমি এ সময়ে স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইগুলোতে। তার মধ্যে কতিপয় প্রশ্ন ও সমাধান এখানে উল্লেখ করছি।
১. আকাশ কি? – মুরুব্বীদের নিকট এতোকাল শুনে এসেছি যে, আকাশ সাতটি এবং তা কোনো না কোনো পদার্থের তৈরি। আরও শুনেছি যে, ছাতে লটকানো আলোর মতো চন্দ্র, সূর্য ও তারকারা আকাশে লটকানো আছে। কিন্তু এ সময় জানতে পেলাম যে, ‘আকাশ’ কোনো পদার্থ নয়, তা হচ্ছে নিছক শূন্যস্থান। আর ‘শূন্যস্থান’-এর কোনো স্তরভেদ বা সংখ্যা থাকতে পারে না।
২. দিন ও রাতের কারণ কি?- মুরুব্বীদের কাছে শোণা যেতো যে, একখানা সোনার নৌকায় সূর্যকে রেখে স্বর্গদূতেরা টেনে নেয় পূর্ব থেকে অস্তাচলে। সূর্য সেখানে সারারাত ঈশ্বরের আরাধনায় মগ্ন থাকে এবং ভোরের দিকে স্বর্গদূতেরা পুনঃ নৌকাসমেত সূর্যকে টেনে নিয়ে পূর্ববৎ উদয় ও অস্ত ঘটায়। কিন্তু আমি এ সময় জানতে পারি যে, দিন ও রাত হয় পৃথিবীর আবর্তনে অর্থাৎ আহ্নিক গতির ফলে।
৩. পৃথিবী কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত? – বলা হতো যে, পৃথিবী একটি বলদের শৃঙ্গের উপর অবস্থিত, কেউ বলতেন জলের উপর অবস্থিত, আবার কেউ বলতেন মাছের উপর অবস্থিত ইত্যাদি। কিন্তু এ সময় জানতে পেলাম যে, পৃথিবী সূর্যের আকর্ষণে বাঁধা থেকে নির্দিষ্ট বজায় রেখে প্রায় গোলাকার কক্ষপথে ৩৬৫X১/২ দিনে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে এবং নিজে ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরপাক খাচ্ছে। পৃথিবীর স্বীয় আবর্তনে দিন-রাত এবং কক্ষাবর্তনে হয় বছর।
৪. ভূমিকম্প হয় কেন? – ছেলেবেলায় শুনেছি যে, পৃথিবীর ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পৃথিবীধারী বলদের শৃঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টার ফলে ভূমিকম্প হয়। কিন্তু এখন জানতে পেলাম যে, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ভূগর্ভস্থ অতিশয় উষ্ণ গলিত পদার্থের হঠাত শীতল স্পর্শে বাষ্পীয় রূপ ধারণে তা বিস্ফোরণের চেষ্টা বা অকস্মাৎ ভূস্তর ধ্বসে যাওয়া ইত্যাদি কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে।
৫. বজ্রপাত হয় কেন? – এ প্রশ্নটির জবাবে মুরুব্বিরা বলতেন যে, স্বর্গবাসী ফেরেস্তারা সময় সময় শয়তানের গায়ে তীর ছোঁড়ে, তাকেই ‘বজ্রপাত’ বলা হয়। এখন জানা যাচ্ছে যে, আকাশে মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হলে তন্নিম্ন ভূমিতে আরেক দফা বিদ্যুৎ আপনিই সৃষ্টি হয় এবং তাকে আবিষ্ট বিদ্যুৎ বলে। মেঘস্থিত বিদ্যুৎ ও মাটিস্থ আবিষ্ট বিদ্যুৎ একে অন্যকে আকর্ষণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় আকাশের বিদ্যুতের চেয়ে মাটিস্থ আবিষ্ট বিদ্যুতের আকর্ষণশক্তি বেশী হলে তা মেঘের বিদ্যুৎকে টেনে ভূপাতিত করে এবং তাকেই ‘বজ্রপাত’ বলে। বিদ্যুৎ পতনের তীব্র গতির পথে যে সকল বায়বীয় পদার্থ ও ধূলিকণা থাকে, তা জ্বলে তীব্র আলোর সৃষ্টি হয় এবং বায়ুর ঘর্ষণে হয় শব্দ।
৬. শীত-গ্রীষ্ম হয় কেন? – মুরুব্বিরা বলতেন যে, নরকের দ্বার যখন বন্ধ থাকে, তখন শীত ঋতু হয় এবং যখন খোলা থাকে, তখন হয় গ্রীষ্ম ঋতু। কিন্তু এ সময় জানতে পেলাম যে, সূর্যকে কেন্দ্র করে এক বর্তুলাকার কক্ষে ঈষৎ হেলান অবস্থায় (২৩X১/২ ডি.) থেকে পৃথিবী বারো মাসে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এতে সূর্যরশ্মি পৃথিবীর উপর কখনো খাড়াভাবে এবং কখনো তেরছাভাবে পড়ে। যখন খাড়াভাবে পড়ে, তখন গ্রীষ্ম ঋতু হয় এবং যখন তেরছাভাবে পড়ে, তখন হয় শীত ঋতু।
৭. জোয়ার-ভাটা হয় কেন? – এ প্রশ্নটির জবাবে মুরুব্বিরা বলতেন যে, পৃথিবীধারী বলদ যখন শ্বাসত্যাগ করে, তখন জোয়ার হয় এবং যখন শ্বাস টেনে নেয়, তখন হয় ভাটা। কিন্তু এ সময় জানতে পেলাম যে, জোয়ার-ভাটার একমাত্র কারণ হচ্ছে চন্দ্রের আকর্ষণ। পৃথিবীর যে কোনো স্থানে হোক, চন্দ্র যখন মধ্য আকাশে থাকে, তখন সেখানে জোয়ার হয় এবং দিগন্তে থাকলে তখন হয় সেখানে ভাটা।
৮. পৃথিবীর আকার কি ও আয়তন কত? – এ প্রশ্নটির জবাবে মুরুব্বিগণ বলতেন যে, পৃথিবীর আকার থালার মতো গোল এবং চতুর্দিকে ‘কোহেকাফ’ নামে এক পর্বতে ঘেরা। তার বহির্ভাগে কি আছে, কোনো মানুষ তা জানে না। কিন্তু এ সময় জানতে পেলাম না, পৃথিবী গোল বটে, তবে থালার মতো গোল নয়, ফুটবলের মতো গোল (উত্তর ও দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা)। গোলত্ব হেতু পৃথিবীর কোনো সীমান্ত নেই এবং কোহেকাফ বা ‘সীমান্ত পর্বত’ বলে কোনো পর্বত নেই। বলা হতো যে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। বোধহয় যে, হিসাবটি হাঁটাপথের। কিন্তু এ সময় জানতে পেলাম যে, পৃথিবীর পরিধি মাত্র পচিশ হাজার মাইল। আধুনিক যুগের জল, স্থল ও হাওয়াই যানে ভ্রমণের কথা বাদ দিলেও, সাগর পাহাড়ের বাধা না থাকলে এ দূরত্ব অতিক্রম করতে একজন লোকের (দৈনিক ২০ মাইল করে হেঁটে) সময় লাগে কিঞ্চিতাধিক ৩ বছর মাত্র।
আশৈশব প্রবল ছিলো আমার অজানাকে জানার স্পৃহা। তাই আমার মুরুব্বিদের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করেছি। কিন্তু জবাব যা পেয়েছি, তা মনঃপুত হয়নি। আধুনিক শিক্ষার্থীদের পুস্তকাদি পাঠ করে উপরোক্তরূপ কতিপয় বিষয়ের মনঃপুত সমাধান পেয়ে আমার পুস্তকপাঠের স্পৃহা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু আর্থিক অভাবের দরুন পুস্তকাদি খরিদ করতে না পেরে বরিশালের পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য হয়ে সেখানে পুস্তকাদি পাঠ শুরু করি আমি ১৩৪৪ (বাং) সাল থেকে।
আমার বাসস্থান (লামচরি গ্রাম) থেকে বরিশাল শহরের দূরত্ব প্রায় সাত মাইল। কোনোরূপ যানবাহন বা রাস্তা না থাকায় এক একখানা পুস্তক পড়বার জন্য আমাকে পথ হাঁটতে হয়েছে প্রায় চোদ্দ মাইল। তথাপি যথাসম্ভব পুস্তকাদি আদান-প্রদান ও অধ্যয়ন করেছি। লাইব্রেরীর সকল বিভাগের বই আমি সমভাবে অধ্যায়ন করিনি। গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি সামান্যই পড়েছি এবং বিশেষভাবে পড়েছি ভূগোল, ইতিহাস, ভ্রমণ, জীবনী, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ের বই। কিন্তু সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ ছিলো আমার বিজ্ঞান ও দর্শনে। বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার বই ওখানে যতো পেয়েছি, তা পড়বার চেষ্টা করেছি।
বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের দর্শন বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির সাহেবের সহায়তায় উক্ত কলেজ লাইব্রেরীর দর্শন ও বিজ্ঞানের বহু পুস্তক-পুস্তিকা অধ্যয়নের সুযোগ আমি লাভ করেছি এবং আমার বহু তৃষ্ণা মিটাচ্ছেন তিনি তাঁর বাচনিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে।
হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খৃস্টান ইত্যাদি জাতিসমূহের ধর্মতত্ত্ব জানার আগ্রহ নিয়ে বরিশালের শঙ্কর লাইব্রেরী ও ব্যাপ্টিস্ট মিশন লাইব্রেরীর কিছু কিছু পুস্তক অধ্যয়ন করেছি এবং ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে তত্ত্বালোচনায় সাহায্য নিয়েছি আমার পরিচিত কতিপয় বিশিষ্ট আলেমের।
উপরোক্তরূপে বিবিধ চেষ্টার ফলে এযাবত জগত, জীবন, সমাজ, দর্শন ও ধর্ম সম্বন্ধে আমার যে ধারণা জন্মেছে, এখন আমি স্থুলভাবে তার কিছু আলোচনা করবো – প্রথমত জগত ও ক্রমে অন্য ক’টি সম্বন্ধে।
অধ্যায়ঃ সত্যের সন্ধান
♦ দ্বিতীয় প্রস্তাবঃ ঈশ্বর বিষয়ক
♦ পঞ্চম প্রস্তাবঃ প্রকৃতি বিষয়ক
অধ্যায়ঃ অনুমান
অধ্যায়ঃ স্মরণিকা
♦ লামচরি গ্রামের অবস্থান ও পরিবেশ
♦ লাইব্রেরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও ৭৯ সালের বৃত্তি দান
♦ মানব কল্যাণের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত
♦ ১৯৮০ সালের বৃত্তিপ্রদান অনুষ্ঠান
♦ পুস্তক প্রদান অনুষ্ঠানের ভাষণ
♦ অবহেলিত একটি প্রতিভার স্বীকৃতি বাকেরগঞ্জ জিলা পরিষদ কর্তৃক বিশেষ পুরস্কার দান
♦ বার্ষিক অধিবেশন ও ৮১ সালের বৃত্তিপ্রদান
♦ আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরীর দানপত্র সংক্রান্ত দলিলসমূহের অনুলিপি
♦ কেন আমার মৃতদেহ মেডিক্যালে দান করছি
অধ্যায়ঃ আমার জীবনদর্শন
♦ জগত সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা
♦ জীবন সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা
“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ