প্রলয়
‘সৃষ্টি রহস্য’ পুস্তকে প্রলয় বা ধংস রহস্যের অবতারণা কিছু অপ্রাসঙ্গিক বোধ হয়। কিন্তু জন্মের সঙ্গে মৃত্যুর যেমন অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ, সৃষ্টির সঙ্গে প্রলয়ের তেমনই। কাহারও জীবনী লিখিতে হইলে যেমন তাহার জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্তই লিখিতে হয়, নচেৎ জীবনী থাকে অসম্পূর্ণ, সৃষ্টির সঙ্গে প্রলয়ের কিছু বিবরণ না থাকিলে বোধ হয় তেমন সৃষ্টি রহস্যও থাকিবে অসম্পূর্ণ।
দিনান্তে রাত্রি, শীতান্তে গ্রীষ্ম, জন্মান্তে মৃত্যু ইত্যাদি যেমন চিরন্তন বিধি, তেমনি “সৃষ্টির শেষে প্রলয়” –ইহাতে মানুষ বিশ্বাসী। যদিও মৃত্যু একটি চিরন্তন ঘটনা, তথাপি কোনো ব্যক্তিই বলিতে পারে না যে, তাহার মৃত্যু কখন এবং কিভাবে হইবে। কিন্তু প্রলয় কখন কিভাবে হইবে, তাহা অনেকেই বলিয়া থাকেন, তবে মতামতগুলি একরূপ নহে।
সৃষ্টিরহস্যের প্রায় সমস্তই অতীতের ঘটনা, যাহা জানিবার ও বুঝিবার অনেক উপায় মানুষের আয়ত্তে আছে। যেমন –প্রত্নতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব ইত্যাদি। কিন্তু প্রলয়রহস্যটি একেবারেই ভবিষ্যতের ব্যাপার। যেখানে অতীতকে লইয়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতানৈক্যের অন্ত নাই, সেখানে ভবিষ্যতকে লইয়া যে কত হাঙ্গামা, তাহা সহজেই অনুমান করা চলে। প্রলয় সম্বন্ধে বহু মতবাদ প্রচলিত আছে। এইখানে আমরা বিশেষ কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিব।
ইরানীয়দের মত
ইরানীয়দের জেল-আভেস্তা গ্রন্থের ভেন্দিদাদ অংশে ও বুন্দেহেশ গ্রন্থে প্রলয় সম্বন্ধে লিখিত আছে, “… অবশেষে একটি জ্বলন্ত ধূমকেতু পৃথিবীতে নিপতিত হইয়া পৃথিবীকে ভস্মীভূত করিয়া ফেলিবে। গলিত ধাতুনিঃস্রাবের ন্যায় পর্বতসমূহ অগ্নত্তাপে গলিয়া যাইবে। সৎ-অসৎ সকল মনুষ্যই উত্তপ্ত বন্যাস্রোতমধ্যে ভাসিয়া ভাসিয়া পবিত্ৰীকৃত হইয়া আসিবে…” ইত্যাদি।
ধূমকেতু পতনের ফলে পৃথিবী জ্বলিয়া ও পাহাড়াদি গলিয়া যাইবে –এই যুগে উহা আর বিশ্বাস্য নহে। কেননা ধূমকেতু অতিশয় পাতলা ও হালকা বাষ্পমাত্র। ধূমকেতুর দেহে পদার্থ বলিতে কিছু নাই বলিলেই চলে। কোনো কোনো ধূমকেতুর লেজ ১০ কোটি মাইল পর্যন্ত লম্বা হইতে দেখা যায়। অথচ উহার দেহের ওজন নিতান্ত অল্প। বিজ্ঞানাচার্য জগদানন্দ রায় বলিয়াছেন, “গোটা ধূমকেতুর লেজ নিক্তিতে ওজন করিলে আধসের-তিনপোয়ার বেশি হইবে না।” (ধূমকেতুর বিশেষ বিবরণ অত্র পুস্তকের পূর্ববর্তী অংশে দ্রষ্টব্য)
হিন্দুদের মত
মহাভারতের অষ্টাশীত্যধিক শততম অধ্যায়ের মার্কণ্ডেয় নারায়ণ সংবাদে সপ্তসূর্যের খরতর তাপে সংহারের ভীষণ বিবরণ দেখিতে পাওয়া যায়। সেই বর্ণনার কিয়দংশ এইরূপ — “সেই সহস্র চতুর্থণর অবসানে লোকের আয়ুক্ষয় সময়ে বহুবৎসর কাল অনাবৃষ্টি হইবে। … তাহাতে ভূমিষ্ঠ প্রাণীবর্গ অল্পসার ও ক্ষুধিত হইয়া পৃথিবীতে সংহারপ্রাপ্ত হইতে লাগিল। তদনন্তর সপ্ত সূর্য উদিত হইয়া সরিৎ ও সরিৎপতির (নদী ও সাগরের) সমস্ত সলিল শোষণ করিতে লাগিল। শুষ্ক বা আর্দ্র যে কিছু তৃণ-কাষ্ঠ সকলই ভস্মীভূত দৃষ্ট হইতে লাগিল। তৎপরে বায়ুবাহিত সংবর্তক বহ্নি আদিত্য কর্তৃক পূর্বশোষিত পৃথিবীমধ্যে প্রবিষ্ট হইল। সেই অগ্নি অধঃস্থলে, নাগলোকে ও পৃথিবীতলে যে-কিছু বস্তু ছিল, তৎসমুদয় ক্ষণমধ্যে দগ্ধকরত বিনষ্ট করিয়া ফেলিল। সহস্র যোজন এই জগত সেই অশুভ বায়ুসহ সংবর্তবহ্নি কর্তৃক দগ্ধ হইয়া গেল। সেই প্রদীপ্ত বিভু বহ্নিদেব অসুর, রক্ষ, গন্ধর্ব, যক্ষ, উরগ ও রাক্ষসগণের সহিত সমুদয় জগত একেবারে দগ্ধ করিয়া ফেলিল।”
মৎস্য পুরাণের দ্বিতীয় অধ্যায়েও অনুরূপ উক্তি দৃষ্ট হয়। সেখানে মৎস্য বলিতেছেন, “অদ্য হইতে মহীমণ্ডলে একশত বৎসর পর্যন্ত অনাবৃষ্টি হইবে। অনাবৃষ্টির ফলে অচিরেই ঘোর দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। অনন্তর দিবাকরের সুদারুণ সপ্তরশ্মি প্রতপ্ত অঙ্গাররাশি বর্ষণকরত ক্রমশ প্রাণীগণের সংহার সাধন করিবে। যুগক্ষয়ের উপক্রম বাড়বানল বিকৃত হইবে।” ইত্যাদি।
উপরোক্ত বর্ণনায় জানা যায় যে, প্রথমত অনাবৃষ্টির ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে এবং তাহাতে মনুষ্যগণ মারা যাইবে। তৎপর সাতটি সূর্যের উদয় হইবে এবং তাহার তেজে নদী ও সাগরাদির জল শুকাইয়া যাইবে, বৃক্ষাদি ও প্রাণীগণ ভস্মীভূত হইবে এবং পাতালের সর্পকূল, অসুর, রক্ষ, গন্ধর্ব, যক্ষ, উরগ ও রাক্ষসগণ দগ্ধ হইয়া মারা যাইবে। হিন্দুদের দার্শনিক মতে যাহাই থাকুক, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রাদি বিশ্ববিলয়ের আলোচনা এই মতে নাই।
ইহুদি ও খ্রীস্টানদের মত
পবিত্র বাইবেলের পুরাতন নিয়মের অন্তর্গত ইশিয়া নামক গ্রন্থখানা ইহুদি ও খ্রীস্টান, এই উভয় সম্প্রদায়েরই মাননীয় গ্রন্থ। ঐ গ্রন্থখানায় প্রলয় সম্বন্ধে বিবরণ এইরূপ — “সেই ভীষণ সংহারক্রিয়ার দিনে অত্যুচ্চ পর্বতসমূহ জলস্রোতে ভাসমান এবং মানুষের আবাসগৃহসমূহ ভূতলশায়ী হইবে। অধিকন্তু সেইদিন চন্দ্ররশ্মিতে সূর্যালোকের ন্যায় প্রখর জ্যোতি বিকীর্ণ করিবে। সূর্যের কিরণ বৃদ্ধি পাইবে ও সূর্যের এক দিনের তেজ সাত দিনের তেজের সমান হইবে। অর্থাৎ যেন সূর্য প্রদীপ্ত হইয়া পৃথিবীকে গ্রাস করিয়া ফেলিবে।”
ইশিয়ার উল্লিখিত বিবরণটি মহাভারত ও মৎস্য পুরাণের বিবরণের সাথে কতক সাদৃশ্যপূর্ণ। মহাভারতের সূর্য সাতটি আর ইশিয়ার সূর্য একটি, কিন্তু তাহার তেজ সাতটি সূর্যের সমান।
সচরাচর একটি সূর্য হইতে আমরা যে তাপ পাইতেছি, তাহার সাত গুণ বা সাতটি সুর্যের তাপ পাইলে জীবাদি দগ্ধ হইতে পারে। কিন্তু তাহার পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, জলস্রোতে অত্যুচ্চ পর্বতমালা ভাসমান ও মানুষের গৃহাদি ভূতলশায়ী হইবে। গৃহাদি ভূতলশায়ী হইতে হইলে প্রবল বন্যা আবশ্যক এবং পাহাড়াদি ভাসাইতে যে কতটুকু জলের আবশ্যক, তাহা সহজেই অনুমান করা যায়। উহাতে ভূপৃষ্ঠের কোনো কিছুই অনিমগ্ন থাকিতে পারে না। পক্ষান্তরে জলমগ্ন অবস্থায় উত্তাপের মাত্রা যতই বেশি হউক না কেন, উহাতে কোনো পদার্থই দগ্ন হইতে পারে না, পারে সিদ্ধ হইতে। অতএব বুঝা যায় যে, মহাভারতের প্রলয়ে জীবাদি জ্বলিয়া পুড়িয়া অঙ্গর হইবে এবং ইশিয়ার প্রলয়ে হইবে সিদ্ধ।
মুসলমানদের মত
মুসলমানদের মতে প্রলয় (কিয়ামত) ঘটিবার আগে দজ্জাল নামে এক ভীষণ জন্তুর আবির্ভাব। হইবে এবং পশ্চিমদিক হইতে সূর্যের উদয় হইবে। অতঃপর আল্লাহর আদেশে এস্রাফিল ফেরেশতা শিগায় ফুঁ দিবেন। শিগার ফুঁকে যুগপৎ বিকট শব্দ ও প্রলয়ঙ্করী বায়ুনিঃসারণ হইবে। উহাতে পৃথিবী কাপিয়া উঠিবে, ঘর-বাড়ি, গাছপালা, এমনকি পাহাড়াদি উড়িয়া যাইবে। এবং চন্দ্র-সূর্য ও নক্ষত্রসমূহ ধংসপ্রাপ্ত হইবে। সেই দিনের ভীষণতায় জননী শিশুকে ত্যাগ করিবে, কেহই আপন আপন মূল্যবান বা প্রিয় বস্তু ত্যাগ করিতে কুণ্ঠিত হইবে না। হিংস্র প্রাণীরা হিংস্রভাব ত্যাগ করিবে এবং পরিশেষে প্রাণ বিসর্জনে বাধ্য হইয়া সকলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে। স্বর্গ, মর্ত, জ্বীন, ফেরেশতা কিছুই থাকিবে না, এমনকি যে এস্রাফিল ফেরেশতা শিভঙ্গ যুঁকিবেন, তিনিও না। থাকিবেন একমাত্র আল্লাহ।
বিজ্ঞানীদের মত
ধর্মীয় মতে প্রলয়ের বর্ণনায় আমরা দেখিয়াছি যে, কোনো মতে লয় পাইবে শুধু জীবকুল, কোনো মতে জীবদিসহ পৃথিবী, আবার কোনো মতে লয় পাইবে পৃথিবীসহ চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সবই, অবশিষ্ট থাকিবেন একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। বিজ্ঞানীগণ প্রলয় ঘটিবার যে সমস্ত সম্ভাবনার কথা বলিয়া থাকেন, তাহার মধ্যে কয়েকটি এই —
১. কোনো কারণে যদি কখনও পৃথিবী কক্ষচ্যুত হইয়া পড়ে, তবে প্রলয়ের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ইহা সসীম। কেননা ইহাতে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ বা মহাবিশ্বের কোনো ক্ষতি হইবে না, ক্ষতি হইবে শুধু পৃথিবীর।
২. মহাকাশের কোনো নক্ষত্র যদি. সৌরজগতের খুব নিকটবর্তী হইয়া পড়ে, তবে সংঘর্ষের বা আকর্ষণের ফলে প্রলয় ঘটিতে পারে। কিন্তু এইরূপ কোনো ঘটনা ঘটিবে কি না, তাহার নিশ্চয়তা নাই এবং ঘটিলেও আগন্তুক নক্ষত্র ও সৌররাজ্য ব্যতীত অন্য কোনো নক্ষত্র বা মহাবিশ্বের কোনো ক্ষতি হইবে না।
৩. আলো এবং তাপের প্রধান ধর্মই হইল বিকীর্ণ হওয়া। বিকীর্ণ আলো বা তাপ কখনও তাহার উৎসক্ষেত্রে বা কেন্দ্রে ফিরিয়া আসে না, কাজেই এই অপচয় কখনও পূরণ হয় না। পৃথিবীর আলো নাই, কিন্তু তাপ আছে এবং উহা অহর্নিশ হ্রাস পাইতেছে। দৈনন্দিন পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে তাপমাত্রা কমিবার দরুন ভূপৃষ্ঠের সঙ্কোচনবশত পৃথিবীর কেন্দ্রপ্রদেশের অগ্নিময় তরল ধাতুর বিস্ফোরণ ঘটিতে পারে এবং তাহাতে পৃথিবীর অংশবিশেষ বা সমস্ত পৃথিবীও ধংস হইতে পারে, কিন্তু বিশ্বের অপর কিছু নহে।
৪. মহাবিশ্বের যাবতীয় জ্যোতিষ্ক অর্থাৎ সূর্য, নক্ষত্র, নীহারিকা ইত্যাদি সকলেই অতিশয় উষ্ণ পদার্থ এবং উহারা সকলেই নিয়ত তাপ ত্যাগ করিতেছে। জ্যোতিষ্কপুঞ্জ হইতে এইরূপ তাপ বিকিরণ হইতে হইতে এককালে এমন অবস্থা আসিতে পারে যখন মহাবিশ্বের কোথায়ও তাপের ন্যূনাধিক্য থাকিবে না। হয়তো তখন ঘটিবে বিশ্বব্যাপী মহাপ্রলয়। কিন্তু এইরূপ মহাপ্রলয় হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব না হইলেও উহা আদৌ ঘটিবে। কি না, আর ঘটিলেও তাহা কতকাল পরে ঘটিবে– কোনো বিজ্ঞানীই তাহার নিশ্চয়তা প্রদান করিতে পারেন না।
৫. এই পর্যন্ত প্রলয় সম্বন্ধে বিজ্ঞানভিত্তিক যে সমস্ত সম্ভাবনার বিষয়ে আলোচনা করা হইল, তাহার কোনোটির সম্বন্ধেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করিয়া কিছুই বলিতে পারেন না। ইহা ভিন্ন আর একটি সম্ভাবনা আছে, যে বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ তাহাদের হিসাবের খাতায় অকপাত করিতে পারেন। সেইটি হইল, সৌরতেজ নিঃশেষ হইয়া সৌরজগতে প্রলয় ঘটিবার সম্ভাবনা।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, অন্যান্য নক্ষত্রের মতো আমাদের সূর্যও একটি নক্ষত্র। তাই ইহার জন্ম-মৃত্যু ও চরিত্রাদি অন্যান্য নক্ষত্রের মতোই। আকাশে নানা বর্ণের নক্ষত্র দেখা যায়। আকাশ বিজ্ঞানীগণ নক্ষত্রসমূহের পৃষ্ঠদেশের তাপ ও বর্ণ ভেদে নিম্নলিখিতরূপ শ্রেণীবিভাগ করেন —
বর্ণালীর শ্রেণী বর্ণ তাপমাত্রা
O অতি নীল ২০ হাজার ডিগ্রীর উপরে নীল
B নীল ১৪ হাজার ডিগ্রী
A নীলাভ শাদা ১১ হাজার ডিগ্রী
F শাদা ৭ হাজার ৪ শত ডিগ্রী
G হলুদ ৫ হাজার ৮ শত ডিগ্রী
K নারাঙ্গি ৪ হাজার ৬ শত ডিগ্রী
M লাল ৩ হাজার ২ শত ডিগ্রী
জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, নক্ষত্রের বয়সের তারতম্যানুসারে উহাদের বর্ণের তারতম্য হইয়া থাকে। যে সকল নক্ষত্রের বর্ণ অতি নীল বা নীল, তাহাদের এখন পূর্ণ যৌবন এবং বয়সবৃদ্ধির সাথে সাথে বর্ণের পরিবর্তন হইয়া যথাক্রমে নীলাভ শাদা, শাদা, হলুদ ও নারাঙ্গি বর্ণ ধারণ করিয়া বার্ধক্যে হয় লাল। আকাশের লাল রঙের তারাগুলি এখন মরণপথের যাত্রী। এই লাল তারার দল আরও ঠাণ্ডা হইলে ছড়াইয়া দিবার মতো আলোর সম্বল তাহাদের ভাণ্ডারে থাকে না, তখন তাহারা আকাশে অদৃশ্য হইয়া যায়। ইহাই নক্ষত্রের মৃত্যু। এইরূপ মৃত নক্ষত্র আকাশে অনেক আছে।
কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে –মহাকাশে কোনো কোনো সময় একটি মৃত নক্ষত্রের সঙ্গে আর একটি মৃত নক্ষত্রের সংঘর্ষ হয়। কেননা উহাদের আলো তাপ না থাকিলেও গতি থাকে। সংঘর্ষে উভয় নক্ষত্রের দেহ চুর্ণ-বিচুর্ণ হইয়া বাপে পরিণত হয় ও আগুন জ্বলিয়া উঠে। ফলে জন্ম হয় একটি নূতন নক্ষত্রের। নক্ষত্রদ্বয়ের দেহের আংশিক সংঘর্ষের ফলে যে আগুন জ্বলিয়া উঠে, তাহা কয়েক দিন, কয়েক মাস বা কয়েক বৎসরেই নিভিয়া যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ গায়ে পড়া সংঘর্ষের ফলে যে আগুন জ্বলে, অর্থাৎ নক্ষত্রের জন্ম হয়, তাহা আকাশে টিকিয়া থাকে লক্ষ লক্ষ বৎসর, অতঃপর তাহাদেরও মৃত্যু। উহাদিগকে বলা হয় নেবুলা। হজরত মুসার জন্মের বৎসর মিশরবাসীরা আকাশে একটি নুতন তারা দেখিয়াছিলেন বলিয়া যে একটি প্রবাদ আছে, সম্ভবত তাহা একটি নেবুলা।
আমাদের সূর্য একটি হলুদ নক্ষত্র (G type)। ইহার বর্তমান তাপমাত্রা ৬ হাজার ডিগ্রী। নিরন্তর তাপ ও আলো ত্যাগ করিয়া উহা ক্রমে নারাঙ্গি ও পরে লাল বর্ণ ধারণ করিবে এবং তখন তাহার তাপমাত্রা দাঁড়াইবে প্রায় তিন হাজার ডিগ্রীতে। কালক্রমে যখন তাহার তাপ ও আলোর সমস্ত সম্বল ফুরাইয়া যাইবে, তখন হইবে তাহার মৃত্যু।
যে দুর্নিবার অগ্নিকাণ্ড সূর্যের ভিতর চলিতেছে, তাহার সামান্য আভাস পাই আমরা তাহার ছড়ানো তাপ ও আলোর তেজ হইতে। বিজ্ঞানীগণ বলেন, পদার্থের ন্যায় এই তেজেরও ওজন আছে। সূর্যের দেহ হইতে প্রতি সেকেণ্ডে যে পরিমাণ তেজ নিঃসৃত হয়, তাহার ওজন প্রায় ৪০ লক্ষ মণ। অর্থাৎ প্রতি সেকেণ্ডে সূর্যের ওজন ৪০ লক্ষ মণ কমিতেছে। আজ এই মুহূর্তে সূর্যের যে ওজন আছে, কাল ঠিক এই সময় তাহা হইতে ওজন কমিয়া যাইবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টন। নক্ষত্রের অভ্যন্তরে যে প্রলয়কাণ্ড চলিতেছে, তাহারই আঘাতে পরমাণুর বিনাশ ঘটিয়া তেজের উদ্ভব হইতেছে। ইহাতে পরমাণু লোপ পাইয়া যে সুতীব্র তেজের সৃষ্টি হয়, তাহার ওজন ঠিক পরমাণুর ওজনের সমান। নক্ষত্রদের ভাণ্ডার এতই বিশাল যে, তাহার মধ্যে পরমাণু ধংসের উদ্দামতা বহুকাল ধরিয়া চলিতে পারে। এই অপরিমিত লোকসানেও তাহাদের রিক্ত হইতে সময় লাগে বহু কোটি বৎসর। যে পরিমাণ পরমাণুর সঞ্চয় সূর্যের আছে, তাহাতে বর্তমান লোকসানের মাত্রা বজায় রাখিয়াও সে টিকিয়া থাকিবে ১৫ লক্ষ কোটি বৎসর। অতঃপর মহানির্বাণ।
পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটিবে কিন্তু সূর্য নিভিয়া যাইবার বহু কোটি বৎসর আগেই। জন্মাবধি তাপ ত্যাগ করিয়া পৃথিবী দৈনন্দিন ঠাণ্ডা হইতে চলিয়াছে, যদিও সূর্যপ্রদত্ত তাপ প্রাপ্তির ফলে ঘাটতির পরিমাণ অল্প; কিন্তু সূর্য যখন পৃথিবীর আবশ্যকীয় তাপের জোগান দিতে পারিবে না, তখন দ্রুত তাপ ত্যাগ করিয়া পৃথিবী অত্যন্ত ঠাণ্ডা হইয়া পড়িবে। তখন পৃথিবীতে কোথাও জলের নামগন্ধও থাকিবে না, থাকিবে শুধু তুষার। তখন বাতাস বহিবে না, মেঘ হইবে না, বৃষ্টি পড়িবে না, উদ্ভিদকুল জন্মিতে বা বাঁচিতে পারিবে না –ফলে জীবকুলের হইবে অবসান। কলরববিহীন পৃথিবী অন্ধকার আকাশে ভাসিতে থাকিবে অনন্তকাল।
৪৮. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১২৫-১৩০।