এক সময় অন্ধকার যুগের অবসান হয়, আবার জ্বলে দীপশিখা বাঙলা সাহিত্যের আঙ্গিনায়। এবার যে-দীপ জ্বলে ওঠে, তা আর কোনো দিন নেভে নি, সে-শিখা ধারাবাহিক অবিরাম জ্বলে যেতে থাকে। অন্ধকার যুগের অবসানে নতুন নতুন সাহিত্য রচিত হতে থাকে বাঙলা ১৮ লাল নীল দীপাবলি ভাষায়; অসংখ্য কবি এসে হাজির হন বাঙলা সাহিত্যের সভায়। তাঁদের কণ্ঠে শুধু গান আর গান। কবিদের বীণা বেজে ওঠে নানা সুরে। শুরু হয় বাঙলা সাহিত্যে মধ্যযুগ; চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে। এ-মধ্যযুগের শুরুতেই রচিত হয় একটি দীর্ঘ অসাধারণ কাব্য, যার নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এ-কাব্যটি যিনি রচনা করেন, তাঁর নাম বড়ু চণ্ডীদাস। একাব্যটির সংবাদও আমাদের অনেক দিন জানা ছিলো না। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি বাঁকুড়ার এক গৃহস্থের গোয়ালঘর থেকে উদ্ধার করেন শ্রীবসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ। কাব্যটির নায়কনায়িকা কৃষ্ণ ও রাধা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর কবি বড় চণ্ডীদাস বাঙলা ভাষার প্রথম মহাকবি। তিনি আমাদের প্রথম রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু মধ্যযুগ যে-কাব্যগুলোর জন্যে বিখ্যাত, সেগুলোকে বলা হয় মঙ্গলকাব্য। মধ্যযুগের শুরু থেকে অসংখ্য কবি রচনা করতে থাকেন মঙ্গলকাব্য, আর এ-রচনা শেষ হয়। মধ্যযুগের শেষপ্রান্তে এসে। মঙ্গলকাব্য হচ্ছে মধ্যযুগের উপন্যাস; এ-কাব্যগুলোতে কবিরা অনেক বড় বড়ড়া কাহিনী বলেছেন। তবে এ-কাহিনী আমাদের মতো মানুষের কাহিনী নয়, এগুলো দেবতাদের কাহিনী। দেবতারা জুড়ে থাকে এ-কাব্যগুলোর অধিকাংশ, মানুষ আসে গৌণ হয়ে। এ-কাব্যগুলোকে কেনো বলা হয় মঙ্গলকাব্য? কেউ বলেন, দেবতাদের কাছে মঙ্গল কামনা করে এ-কাব্যগুলো রচিত হয়েছে বলে এগুলোর নাম মঙ্গলকাব্য। আবার কেউ বলেন, এ-কাব্যগুলো গাওয়া হতো এক মঙ্গলবার থেকে আরেক মঙ্গলবার পর্যন্ত, তাই এগুলোর পরিচয় মঙ্গলকাব্য বলে। আবার অনেকে বলেন, এগুলো গাওয়া হতো যে-সুরে, সে-সুরের নাম মঙ্গল; তাই এগুলোর নাম মঙ্গলকাব্য। এগুলোকে আমরা কাহিনীকাব্য বলতে পারি।
প্রায় পাঁচশো বছর ধরে মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। নানা শ্রেণীর মঙ্গলকাব্য রয়েছে বাঙলা সাহিত্যে। এ-কাব্যগুলোর রয়েছে অনেকগুলো সাধারণ রূপ। যেমন : প্রতিটি কাব্যেই দেখা যায় স্বর্গের কোনো এক দেবতা নিজের কোনো অপরাধের জন্যে শাপগ্রস্ত হয়। তখন তাকে স্বর্গে আর বসবাস করতে দেয়া হয় না। সে এসে জন্ম নেয় পৃথিবীতে কোনো সাধারণ মানুষের সাধারণ ঘরে। তার স্ত্রীও চলে আসে মাটির পৃথিবীতে, জন্ম নেয় কোনো সাধারণ মানুষের কন্যা হয়ে। এক সময় তাদের বিয়ে হয়। স্বর্গের কোনো দেবতা এসে হাজির হয় তাদের সামনে, বলে, আমার পুজো তোমরা প্রচার করো পৃথিবীতে। তারা সে-দেবতার পুজো প্রচার করে মানুষের মধ্যে, এবং এভাবে তারা কাটিয়ে ওঠে তাদের শাপ। অবশেষে একদিন মহাসমারোহে তারা আবার স্বর্গে ফিরে যায় দেবতার মতো।
নানা রকমের মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে বাঙলা ভাষায়, সকলের রূপ প্রায় একই রকম। একই বিষয়ে অসংখ্য কবি কাব্য লিখেছেন। তাই কালে কালে এ-কাব্যগুলো হয়ে উঠেছিলো ক্লান্তিকর। কাব্যগুলোর নাম হতো যে-দেবতার পুজো প্রচারের জন্যে কাব্যটি রচিত, সে-দেবতার নামানুসারে। তাই চণ্ডীর পুজো প্রচারের জন্যে যে-মঙ্গলকাব্য, তার নাম চণ্ডীমঙ্গলকাব্য’, মনসা দেবীর পুজো প্রচারের জন্যে যে-কাব্য রচিত, তার নাম মনসামঙ্গলকাব্য। শিবের পুজো প্রচারের জন্যে যে-কাব্য তার নাম শিবমঙ্গলকাব্য। এরকম আরো অনেক মঙ্গলকাব্য রয়েছে; যেমন— ‘অন্নদামঙ্গলকাব্য’, ‘ধর্মমঙ্গলকাব্য, ‘কালিকামঙ্গলকাব্য’, শীতলামঙ্গলকাব্য ইত্যাদি। একই বিষয়ে অসংখ্য কবি কাব্য লিখেছেন। ধরা যাক চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের কথা। একজন বা দুজন কবি যদি এ-বিষয়ে কাব্য লিখতেন, তাহলে বেশ হতো। কিন্তু এ-একই বিষয়ে কাব্য রচনা করেছেন অসংখ্য কবি, যাদের সকলের নামও আজ আর জানা নেই। সেকালে কবিরা নিজেরা মৌলিক গল্প বানাতেন না, পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া গল্প নিয়ে মেতে থাকতেন তাঁরা। এতে তাঁদের কোনো মনপীড়া ছিলো না, বরং পূর্বপুরুষের গল্প আবার লিখতে আনন্দ পেতেন সে-কবিরা। অধিকাংশ সময়ে তাঁদের হাতে আগের কাহিনী আরো দুর্বল হয়ে পড়তো। মঙ্গলকাব্যে তা খুব বেশি পরিমাণে হয়েছে।
যে-সকল কবি মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন, তাঁদের কিছু নাম বলছি। মনসামঙ্গলকাব্য লিখেছেন হরি দত্ত, নারায়ণ দেব, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস এবং আরো অনেকে। চণ্ডীমঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন মাণিক দত্ত, দ্বিজ মাধব, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ রামদেব, ভারতচন্দ্র রায় প্রমুখ। ধর্মমঙ্গলকাব্য লিখেছেন ময়ূরভট্ট, মাণিকরাম, রূপরাম, সীতারাম, ঘনরাম, এবং আরো বহু কবি। অনেক কবি একই বিষয়ে কাব্য লিখেছেন বলে অনায়াসে শ্রেষ্ঠ কাব্যটি পড়ে নিলেই হয়, সবগুলো পড়ার কোনো দরকার করে না। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের ফিরে ফিরে পুনরুক্তি দেখে মধ্যযুগের ওপর ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক কালের একজন বড়ো কবি, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি অনেকটা রেগেই বলেছেন, বাঙলা সাহিত্যে মধ্যযুগ অপাঠ্য। আসলে কিন্তু একে, মঙ্গলকাব্যকে, অপাঠ্য বলে বাতিল করে দেয়া যায় না। কোনো কোনো মঙ্গলকাব্যে ভালো কবিতার যাদু আছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছে সেকালের জীবনের পরিচয়। বাঙলাদেশের মধ্যযুগের সামাজিক ইতিহাস জানতে হলে মঙ্গলকাব্য না পড়ে উপায় নেই।
মঙ্গলকাব্যগুলো দেবতাদের নিয়ে লেখা। এ-দেবতারা বড়ো নিষ্ঠুর, ভক্তের ওপর তারা সহজেই রেগে ওঠে, রেগে মানুষের ভীষণ সর্বনাশ করে, আবার সামান্য পুজো পেলে খুশিতে বাগবাগ হয়ে ভক্তের গৃহ সোনারুপোয় ছেয়ে দেয়। এ-দেবতাদের আচরণ দেখে মনে হয় এরা আসল দেবতা নয়, অভিজাত দেবতা নয়; এরা নিম্নশ্রেণীর দেবতা, যাদের মানুষ পুজো করতে চায় না। তাই তারাও ক্ষমাহীন, অত্যাচার করে লোভ দেখিয়ে বার বার বিপদে ফেলে তারা মানুষের পুজো ভক্তি আদায় করে নেয়। এদের সাথে অনেকটা মিল আছে আমাদের দেশের এককালের জমিদারদের, যারা মানুষকে উৎপীড়ন করে নিজেদের সম্মান বাড়াতে চাইতো। যেমন মনসাদেবী। তার ছিলো এক চোখ কানা, তার ওপরে সে মেয়ে। তার ইচ্ছে হয় সমাজের অভিজাত চাঁদ সদাগরের পুজো পাওয়ার। চাঁদ সদাগর বিরাট ধনী, সমাজে মান্যগণ্য, তার দেবতাও অভিজাত। সে কিছুতেই রাজি নয়, একচোখ কানা, তার ওপরে মেয়ে, দেবতার পুজো করতে। মনসা রেগে ওঠে, চাঁদের বাণিজ্যতরী ড়ুবিয়ে দেয় পানিতে, চাঁদের ছেলে লখিন্দরকে বাসরঘরে মেরে ফেলে। তারপর একদিন সে লাভ করে চাঁদ সদাগরের পুজো।
মঙ্গলকাব্যের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে চণ্ডীমঙ্গল, আর মনসামঙ্গল। চণ্ডীমঙ্গলকাব্য লিখেছেন অনেক কবি; তাঁদের মধ্যে দু’জন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবিদের সারিতে আসন পান। তাঁরা হলেন কবিকঙ্কন মুকুন্দরায় চক্রবর্তী, এবং রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। মনসামঙ্গলের দুজন সেরা কবি হলেন বিজয়গুপ্ত, এবং বংশীদাস। চণ্ডীমঙ্গলের আছে দুটি চমৎকার কাহিনী; একটি ব্যাধ কালকেতু-ফুল্লরার, অপরটি ধনপতি-লহনার। মনসামঙ্গলের কাহিনী একটি, তা হচ্ছে বেহুলা-লখিন্দরের। কালকেতু ও ফুল্লরার গল্প মনোরম, কীভাবে তারা চণ্ডীদেবীর আশীর্বাদ লাভ করলো, পুজো প্রচার করলো চণ্ডীর, তারপরে ফিরে গেলো স্বর্গে, এ-গল্পে তার আনন্দমধুর কাহিনী রয়েছে। কিন্তু বেহুলা ও লখিন্দরের গল্প বড়ো করুণ, পড়তে পড়তে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এ-কাহিনী যিনি প্রথম রচনা করেছিলেন তাঁকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ গল্পকার বলা যায়। এ-গল্পে মানবজীবনের রূপ ভয়াবহ বেদনাকরুণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলকাব্য রচিত পদ্যে, ছন্দে গাঁথা এ-কাব্যগুলো। তবু এগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় যেন গদ্য পড়ছি। কবিতায় বেশি কথা বললে তা আর কবিতা থাকে না। কবিতায় আমরা কামনা করি বিশেষ মুহূর্তের অনুভূতি বা আবেগ, কবিতায় জীবনের সব কথা সবিস্তারে বলা যায় না। কিন্তু মঙ্গলকাব্যে কবিরা বলেছেন জীবনের প্রতিদিনের সকল কথা, নায়কের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যা কিছু ঘটেছে সবকিছু বলতে চেয়েছেন কবিরা। তাই মঙ্গলকাব্যে লেগেছে গদ্যের ভার, তা হয়ে উঠেছে শ্লথ, পুনরুক্তিময়। এগুলো মধ্যযুগের উপন্যাস। উপন্যাসে দেখা যায় নায়কনায়িকার জীবনকে বিস্তৃতভাবে বলার চেষ্টা, লেখক উপন্যাসে কিছু পরিত্যাগ করতে চান না। নায়ক সুখে আছে বেদনায় কাঁপছে, এর সামান্য চিত্র দিলেই উপন্যাসের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, উপন্যাস তার পাত্রপাত্রীদের পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে চায়। মঙ্গলকাব্যগুলোতেও তাই হয়েছে। চণ্ডীমঙ্গলের কালকেতুর কথা ধরা যাক। কবি মুকুন্দরাম স্বর্গে কালকেতু কী ছিলো, তা বলেছেন, পৃথিবীতে এসে কোথায় জন্ম নিলো, কীভাবে বেড়ে উঠলো, সব বলেছেন। এর ফলে কাব্য দীর্ঘ হয়েছে, কবিতা হয়েও একে মনে হয় গদ্য।
মঙ্গলকাব্যের কবিরা সাধারণত যে-দেবতার নামে কাব্য লিখেছেন, সে-দেবতার ভক্ত ছিলেন। তাই কাব্যের শুরুতে সবাই বর্ণনা করেছেন তাঁরা কেনো কাব্য রচনা করলেন, সেকথা। সব কবি বলছেন একই রকম কথা। তাঁরা বলেছেন, দেবতা স্বপ্নে আদেশ দিয়েছেন আমাকে কাব্য লিখতে, তাই আমি কাব্য লিখছি। একথা কি আজ বিশ্বাস হয়? বিশ্বাস হয়।
এ ছিলো তখনকার রীতি, দেবতার কথা না বললে মানুষ কাব্য শুনবে না ভেবেই বোধ হয় কবিরা একথা বলতেন। সেকালে কাব্যের উদ্দেশ্য আজকের মতো ছিলো না, কাব্যের জন্যে কাব্য লেখার প্রচলন তখন ছিলো না, ধর্ম প্রচারের জন্যে সবাই কাব্য রচনা করতেন। তাই মধ্যযুগের সমস্ত সাহিত্য ধর্মভিত্তিক, দেবতাকেন্দ্রিক। দেবতার কথার ফাঁকে ফাঁকে এসেছে মানুষ।
“লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী” উপন্যাস বা প্রবন্ধ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ প্রদীপ জ্বললো আবারঃ মঙ্গলকাব্য
♦ কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
♦ উজ্জ্বলতম আলোঃ বৈষ্ণব পদাবলি
♦ দেবতার মতো দুজন এবং কয়েকজন অনুবাদক
♦ গদ্যের জনক ও প্রধান পুরুষেরা