‘Can you make no use of nothing, nuncle?
Why, no, boy; nothing can be made out of nothing’.
— Shakespeare, King Lear
ছোটবেলায় এক পাগলাটে শিক্ষক ছিলেন আমাদের স্কুলে। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কি বলতেন আপন মনে। উসকোখুসকো চুল,কোনদিন আঁচড়াতেন কিনা সন্দেহ, অনেকগুলো উকুন পরিবার সেখানে নিরাপদ বাসা করেছিল নিশ্চয়ই। বিয়েথা করেননি জীবনে, পোশাকআশাক আলুথালু,ময়লা,এখানে ওখানে তালি দেওয়া। হেডমাস্টার সাহেব সুযোগ পেলেই তাঁকে ধমকাতেন,চাকরি খোয়াবার হুমকি দিতেন,অন্যান্য শিক্ষকরা তাঁর সংসর্গ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু ছাত্রদের কাছে এই শিক্ষকটিই ছিলেন সবচেয়ে প্রিয়। তিনি ক্লাসে এসে অন্যান্য শিক্ষকদের মত বই খুলে গড়গড় করে পড়ে যেতেন না,বা বোর্ডের ওপর লিখতে শুরু করতেন না। গল্প করতেন,দেশবিদেশের মজার মজার গল্প,নানা যুগের নানা দেশের উত্থান ও পতনের গল্প। কেমন করে মানুষ গড়ে নতুন জিনিস, আবার কেমন করে সেই একই মানুষ তা নিজের হাতে ভেঙ্গে ফেলে। এসব আশ্চর্য,অবিশ্বাস্য গল্প। আমরা চুপ করে শুনতাম,মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।
তিনি আমাদের ইংরেজি ব্যাকরণ আর রচনা শেখাতেন।
একদিন ক্লাসে এসে গল্পসল্প না করে রচনা লিখতে বললেন আমাদের। রচনার বিষয়? একটা অর্থমূলক হাসি দিয়ে বললেনঃ “কিছু না”।
আমরা থ। বেকুব। পরস্পর চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। ‘কিছু না’র ওপর লেখার কী আছে? কিছু না তো কিছুই না, অস্তিত্বহীন। নাথিং,নট,ননএক্সিস্টেন্ট। শূন্য। আমাদের মধ্যে একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করল,স্যার,যা নাই তার ওপর কী লিখব আমরা?
বললেন, তোমাদের কল্পনা কোথায় গেল? যা নেই তার মধ্যে ‘কিছু’কে সৃষ্টি করা,কল্পনা তো তাকেই বলে। অস্তিত্বহীনকে অস্তিত্ব দাও,সুন্দর করে তোলো নিজের মনের মতো করে,তখনই বুঝবে কিছু না থাকার কী শক্তি।
আমরা খেই হারিয়ে অথৈ সাগরে ভাসছি তখন। মাথা চুলকাচ্ছি। কল্পনার ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে ছোটাবার চেষ্টা করছি। আমাদের দুরবস্থা দেখে উনার একটু মায়া হলো হয়তো। বললেন, অঙ্কের ক্লাসে ‘শূন্য’ শিখেছ নিশ্চয়ই। সেই শূন্য নিয়ে লেখো। শূন্যকে তোমরা কিভাবে দেখো তা নিয়ে লেখো।
এর চেয়ে পাগল আর কে হতে পারে, বলুন।
বলা বাহুল্য, সেদিন আমরা সবাই লাড্ডু মেরেছিলাম। আমি (মী.র) নিজে কী লিখেছিলাম, মনে নেই। ওই বয়সের ওটুকু জ্ঞানে কীই বা লেখা যায়। কোনো রকমে পৃষ্ঠা ভরামাত্র। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
তার অনেক অনেক কাল পর যখন আমি (মী.র) নিজেই শিক্ষা-পেশাতে মোটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত,দু-চারজন জ্ঞানীগুণী মানুষের সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয়েছে, দু-চারটে ভালো বই পড়বার সুযোগ পেয়েছি,পুরাকালের দু-চারটে সভ্যতার উত্থান-পতনের ইতিহাস জানবার অবকাশ হয়েছে,তখন হঠাৎ একদিন সেই পাগল শিক্ষকটার কথা মনে পড়ে গেল। উনি হয়তো এক গরিব স্কুলের ছোটখাটো শিক্ষক ছাড়া আর কিছু হতে পারেননি জীবনে, কিন্তু তাঁর ছাত্রদের মনের পর্দায় দূরদিগন্তের রঙ ছড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন,মহাকাশের বিপুল শূন্যতার বুকে কান পেতে তার নীরব বার্তা শুনতে শিখিয়েছিলেন,আমাদের অজান্তে তিনি প্রতিটি ছাত্রের অন্তরে জাগিয়ে দিয়েছিলেন অজানার পিপাসা,বাজিয়েছিলেন অচেনার বাদ্য। তাঁর জ্ঞান অবশ্যই বড় বড় পণ্ডিতদের সমতুল্য ছিল না,কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল ঋষিতুল্য। আজকে,এত দিন পরে আমরা বুঝি, ‘শূন্য’মোটেও শূন্যগর্ভ নয়,তার একটা নিজস্ব সত্তা আছে। আছে দৃঢ় ব্যক্তিত্ব। আজকে আমরা জানি, শূন্যের মতো শক্তিশালী জিনিস সংসারে বেশি নেই। শূন্য একটা সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে, তারপর সেই ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে। ইতিহাসে তার নজিরও রয়েছে। শূন্য আর অসীম,এরা একে অন্যের যমজ। যেখানে শূন্য সেখানেই সীমাহীনতা। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবলে যেখানে কিছু নেই, সেখানেই সবকিছু। শূন্য দ্বারা বৃহৎকে পূরণ করুন,বৃহৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই একই শূন্য দ্বারা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রকে ভাগ করুন, ক্ষুদ্র অসীমের অঙ্গ ধারণ করবে। শূন্য সবকিছু শুষে নিয়ে অসীমের দরবারে পাঠিয়ে দেয়। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? শুনুন তাহলে…
♦ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ শূণ্যের ভীতি
♦ তৃতীয় অধ্যায়ঃ পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে
♦ চতুর্থ অধ্যায়ঃ শূন্য এল ইউরোপে
♦ পঞ্চম অধ্যায়ঃ প্রকৃতির শূন্যবিদ্বেষ ?
♦ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিজ্ঞানে শূন্যের আভাস
♦ সপ্তম অধ্যায়ঃ আইনস্টাইনের বিশ্ব
♦ অষ্টম অধ্যায়ঃ শূন্যতার শক্তি
♦ নবম অধ্যায়ঃ মহাবিস্ফোরণের কথা
♦ দশম অধ্যায়ঃ বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?
♦ একাদশ অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম শূন্যতা ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি
♦ দ্বাদশ অধ্যায়ঃ হিগস কণার খোঁজে
♦ ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি
♦ চতুর্দশ অধ্যায়ঃ অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধান শূন্য ও অসীমের মেলবন্ধন
♦ পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি: কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?
“শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ