মোশতাক সরকার গঠিত হবার পর খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে সেনা পরিষদ তাদের নিজস্ব প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।

১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বিজয়কে আপামর দেশবাসী স্বতঃস্ফুর্তভাবে অভিনন্দন জানালেও পরাজিত বাকশালী চক্র ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী মহল সহজে এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারছিল না। তারা জনসমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষভাবে এই বিপ্লবের বিরোধিতা করতে না পেরে গোপনে তাদের হারানো স্বর্গ ফিরে পাবার আশায় তাদের বিদেশী প্রভুদের যোগসাজসে চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করে বিপ্লবের পরমুহুর্ত থেকেই। তাদের এ ধরণের তৎপরতা সম্পর্কে আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হচ্ছিল। বিপ্লবের পর পরাজিত শক্তিকে সমূলে বাংলাদেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলার জন্য আমরা সচেষ্ট ছিলাম। সর্বদলীয় সরকার কায়েম করে তার তত্ত্বাবধানে যতশীঘ্র সম্ভব নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। একই সাথে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে proper screening এর পর সেনাবাহিনীর সাথে একত্রীভূত করে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর পুর্নগঠন করে বিপ্লবের স্বপক্ষ শক্তিকে সুসঙ্গবদ্ধ করার। সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে এই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। বিপ্লবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দানকারী জেনারেল ওসমানীকে নিয়োগ করা হয় প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা। তাঁর মূল দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের উপেক্ষিত সামরিক বাহিনীর সার্বিক কাঠামো নতুন করে জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ধাঁচে গড়ে তোলা। সেনাবাহিনীর পুর্নগঠনের কাজটি তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে ছিল খুবই জটিল এবং দূরহ্ একটি কাজ। রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বাছাই করে তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করতে হবে। সেনাবাহিনী থেকে বাকশালীমনা, দুর্নীতিপরায়ন এবং উচ্চাভিলাসীদের বের করে দিতে হবে। প্রয়োজনমত ইউনিটগুলোর পুর্নবিন্যাশ করতে হবে। কমান্ড স্ট্রাকচারে প্রচুর রদবদল করতে হবে। সর্বোপরি সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিককে বিপ্লবের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এ সমস্ত কাজে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের সেনা পরিষদের সদস্যরাই ছিল জেনারেল জিয়ার মূল শক্তি। তাদের সার্বিক সাহায্যের উপর ভিত্তি করেই জেনারেল জিয়া তার দায়িত্ব পালন করে চলেছিলেন। আওয়ামী-বাকশালী আমলে অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত অফিসারদের সামরিক বাহিনীতে পুনর্বহালের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় এবং এই নীতি কার্যকরী করার দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। তিনি প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তার দায়িত্ব পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই সাথে আমরা তখন দেশের দেশপ্রেমিক-জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল, গ্রুপ এবং ব্যক্তিবর্গের সাথে দেশের ভবিষ্যত রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয় সরকার, নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে মত বিনিময় করছিলাম। এই প্রক্রিয়াটাও ছিল ভীষণ জটিল। বিগত ঐক্য প্রক্রিয়ার মত এ সমস্ত বিষয়ে আলোচনাকালে সব রাজনৈতিক দলই তাদের দলীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছিলেন। এমনকি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবটি খন্দোকার মোশতাক আহমদও প্রথমে মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি চাইছিলেন সরকার প্রধান থেকে একটি নিজস্ব দল গঠন করে তার অধিনস্থ অস্থায়ী সরকারের অধিনেই নির্বাচন করতে। কিন্তু আমাদের জোরালো যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মেনে নিতে হয়েছিল জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব। যে সংসদ গণতন্ত্রের বলি দিয়ে বাকশাল কায়েম করেছিল তাদের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পর মোশতাক সরকার ও গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম আমরা। বামপন্থী রাজনৈতিক অনেক দলই বিশেষ করে জাসদ চাচ্ছিল একটি বিপ্লবী সরকার কায়েম করে তাদের দলীয় কর্মসূচী আমরা বাস্তবায়ন করি। কিন্তু তাদের সেই সব প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়ে তাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করার কোন ইচ্ছা নেই আমাদের এমনকি রাজনীতিতে সরাসরিভাবে সেনাবাহিনীর অংশ গ্রহণের বিরুদ্ধে সেনা পরিষদ। জাতীয় কিংবা নির্দলীয় সরকার গঠন করা হবে কোন বিশেষ দলের কর্মসূচী কার্যকরী করার জন্য নয়। তাদের দায়িত্ব হবে দেশে একটি সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। দলীয় কর্মসূচী বাস্তবায়নের অধিকার অর্জন করবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দল।

 

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে

জেনারেল জিয়া জানালেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল তার কাজে বাঁধার সৃষ্টি করছে। কিছু বাকশালীমনা অফিসার তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল। তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে কিছু বাকশালপন্থী অফিসার। ব্রিগেডিয়ার খালেদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু ভীষণ উচ্চাভিলাসী। তার উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার জন্য অতি কৌশলে যুদ্ধের সময় থেকেই তিনি তার শক্তি এবং প্রভাব বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা করে আসছিলেন। মুজিব সরকার ও বাকশালীদের সহানুভূতিও ছিল তার প্রতি। আচমকা বাকশালী সরকারের পতনের ফলে তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়৷ তাই তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে কোন উপায়েই তার পরিকল্পনা কার্যকরী করে তার উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করতে। তার এই হীন চক্রান্তমূলক কার্যকলাপ থেকে তাকে কিছুতেই নিরস্ত্র করতে পারছিলেন না জেনারেল জিয়াউর রহমান। ক্ষমতার প্রতি ব্রিগেডিয়ার খালেদের এই দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিল বাকশালী চক্র এবং তাদের মুরুব্বী সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের দোসর ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ। ১৫ই আগষ্ট পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে আগষ্ট বিপ্লবের পূর্ব অবস্থায় দেশকে নিয়ে যাবার এক গভীর ষড়যন্ত্রের সূচনা ঘটানো হল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রির্পোটেও এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যেতে লাগল। ব্রিগেডিয়ার খালেদের প্রধান উস্কানিদাতা ছিল কর্নেল শাফায়াত। শেখ মুজিবের প্রতি অন্ধ এই অফিসার কিছুতেই বাকশালী সরকারের পতনকে মেনে নিতে পারছিলেন না। কুখ্যাত আত্রাই অপারেশনের চ্যাম্পিয়ন কর্নেল শাফায়াত জামিল যাকে পরে ঢাকায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ করে শেখ মুজিব পুরস্কৃত করেছিলেন; সেই শাফায়াত জামিলের অধিনস্থ ঢাকা ব্রিগেডই মুজিব সরকারের পতন ঘটালো এই humiliation তার পক্ষে কিছুতেই সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে এই গ্ল্যানি তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। এর জন্যই সে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে মোশতাক সরকার এবং জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে তাকে বাকশালী চক্র ও তাদের বিদেশী প্রভুদের ক্রিয়াণকে পরিণত করেছিল। তাদের সাথে জোট বেধেছিল রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আগরতলা মামলার আসামীদের কয়েকজন অফিসার। প্রথমত: আমরা এবং কর্নেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এ ধরণের আত্মঘাতী এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হতে পারেন সেটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু ক্রমে যখন বিভিন্ন সেনা নিবাসগুলো থেকে সেনা পরিষদের সদস্যরাও একই ধরণের খবর পাঠাতে লাগল তখন বিষয়টি চিন্তার কারণ হয়ে উঠল। বোঝা যাচ্ছিল সংকট ঘনিয়ে আসছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে এ ধরণের সর্বনাশা চক্রান্ত থেকে সরে দাড়াবার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও বিশেষ ফল হল না।

 

৩৬ জন সেনা অফিসারকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়

কোন অঘটন ঘটাবার চক্রান্ত বানচাল করার লক্ষ্যেই ঐ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

পরিশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হল, ব্রিগেডিয়ার খালেদ, কর্নেল শাফায়াত এবং তাদের সহযোগিদের অবিলম্বে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করতে হবে। দেশ এবং জাতিকে দাসত্বের হাত থেকে বাচানোর আর কোন উপায়ই ছিল না।

অনেক বিচার-বিবেচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হল- অসৎ এবং কট্টর বাকশালপন্থী অফিসারদের সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। সর্বমোট ৩৬জন অফিসারকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

কাজটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ; কারণ স্বাধীনতা সংগ্রামের সব যোগ্য কমান্ডারদের প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষন এবং আনুগত্য ছিল তাদের অধিনস্ত যোদ্ধাদের। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াতকে চাকুরিচ্যুত করলে সেনাবাহিনীতে একটা প্রতিক্রিয়া হতে পারে কিন্তু আমরা নিশ্চিত ছিলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার তার দোসরদের চক্রান্তের আসল উদ্দেশ্য সৈনিকদের সামনে তুলে ধরলে ব্যক্তিগত আনুগত্য যাদের আছে তারাও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী হীন চক্রান্তকে সমর্থন করবে না। আমাদের তরফ থেকে সিদ্ধান্তের কথাটা জেনারেল জিয়াই জেনারেল ওসমানীকে জানালেন৷ সব শুনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না খালেদ এবং শাফায়াত এ ধরণের ন্যাক্কারজনক কাজে লিপ্ত হতে পারে ! কিন্তু গোয়েন্দা বিভাগীয় প্রধানরা যখন বিস্তারিত রির্পোট তার সামনে পেশ করলেন তখন অসহায় আক্ষেপে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

 

বৃহত্তর চক্রান্তের বড়ে খালেদচক্র

ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার দোসররা বৃহত্তর চক্রান্ত বড়ে হিসেবেই শুধুমাত্র ব্যবহারিত হচ্ছিল। গোয়েন্দা রির্পোট থেকে বোঝা যাচ্ছিল তাজুদ্দিন আহমদ পরবর্তী সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

গোয়েন্দা রির্পোটগুলো থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল, এই চক্রান্ত হাত রয়েছে বাকশালীদের একটি চক্র এবং তাদের সার্বিকভাবে মদদ যোগাচ্ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন চেষ্টা চালাচ্ছে আর্মির মধ্যে কিছু লোকের মাধ্যমে একটা প্রতি বিপ্লবী ঘটনা ঘটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভক্তি সৃষ্টি করে দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে ২৫ বছরের আওতায় বাংলাদেশে সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপ করে জনাব তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে একটি অনুগত সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে আবার একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা। রিপোর্ট থেকে আরও জানা গেল, এই নীল নকশা বাস্তবায়নে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাস যৌথভাবে অত্যাধিক মাত্রায় তৎপর রয়েছে। তাদের পরামর্শে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ভাই সাবেক সাংসদ বাকশালী নেতা জনাব রাশেদ মোশাররফ সংশ্লিষ্ট মহল এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এই চক্রান্তের সম্পর্কে পরবর্তিকালে জনাব এনায়েতউল্লাহ খানের পত্রিকা সাপ্তাহিক হলিডে-তে এক বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। “Bangladesh The Unfinished Revolution” গ্রন্থে জনাব লিফ্‌স্যুলজ লিখেছেন, “রয়টার সংবাদদাতা জনাব আতিকুল আলমের হাতে ভারতীয় হাই কমিশনার জনাব সমর সেনের কাছে অভ্যুত্থান বিষয়ক জনাব তাজুদ্দিনের স্বহস্তে লিখিত একটি চিঠি পৌঁছেছিল।” জনাব জিল্লুর রহমান খান ‘Leadership crisis in Bangladesh’ গ্রন্থে লিখেছেন, “খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের বিষয়ে জেলে চার নেতা অবহিত ছিলেন। এটা ছিল একটি মুজিবপন্থী পাল্টা অভ্যুত্থান। কারণ চার নেতা বীরদর্পে জেল থেকে বের হয়ে এসে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ”

 

জেনারেল জিয়া নিজের অজ্ঞাতেই সতর্ক ঘন্টা বাজিয়ে দিলেন

৩৬ জনের মধ্যে মাত্র দু’জন- কর্নেল রউফ এবং কর্নেল মালেকের অব্যাহতি ফাইল সই করিয়ে নিলেন তিনি প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে।

একই সাথে মুজিব আমলে অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত অফিসারদের পুনর্বহালের প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করার জন্য জেনারেল জিয়াকে অনুরোধ জানানো হয়। এর কয়েকদিন পরেই আমরা আবার চাকুরিতে পুনর্বহাল হই। এতে করে সেনাবাহিনীতে বিপ্লবের স্বপক্ষ শক্তি বৃদ্ধি পায়। জেনারেল জিয়ার হাতও এতে করে তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে। জেনারেল জিয়া অবিলম্বে আমাদের সবাইকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোতে নিয়োগ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আমাদের সেনাবাহিনীতে পূর্ণবাসনের ফলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও তার সমর্থকরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা বুঝতে পারেন, সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসলে তাদের কোন ষড়যন্ত্রই কার্যকরী করা সম্ভব হবে না। তারা এটাও বুঝতে পারলেন যে, তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে। তাই তারা অস্থির হয়ে উঠলেন মরণ কামড় দেবার জন্য। ঐ সময়ে একদিন জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কাছ থেকে কর্নেল রউফ (শেখ মুজিবের আমলে তার বিশেষ আস্থাভাজন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান) এবং কর্নেল মালেকের চাকুরিচ্যুতির ফাইল স‍ই করিয়ে নিয়ে সেনাবাহিনী থেকে তাদের অবসর প্রদানের আদেশ জারি করলেন। ব্যাপারটা জানতে পেরেই আমি শংকিত হয়ে পড়লাম। ছুটে গেলাম জেনারেল জিয়ার কাছে,

– স্যার এটা আপনি কি করলেন! কথা ছিল ৩৬ জনকে একই সাথে অবসর প্রদান করা হবে। সেটা না করে মাত্র দু’জনকে অবসর প্রদান করে বাকি ষড়যন্ত্রকারীদের হুশিয়ার করে দিলেন আপনি। এটা কি ঠিক হল?

জবাবে জেনারেল জিয়া আমাকে বললেন,

– Don’t worry, let me move step by step. Things would be all right. Let me handle the affairs in my own way.

 

একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা

একটি তরুণ প্রতারক আমার নাম ভাঙ্গিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করে।

একদিন রাতে ক্যাবিনেট মিটিং শেষ হবার পর মন্ত্রীমহোদয়গণ বঙ্গভবনের করিডোরে বেরিয়ে এসেছেন। হঠাৎ মন্ত্রী জনাব রিয়াজুদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া আমাকে ডেকে একটু নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বললেন,

– ডালিম, তোমার পাঠানো লোকটার কাজটা করে দিয়েছি। কালই পারমিটটা ইস্যু করে দেবার জন্য সেক্রেটারী সাহেবকে অর্ডার দিয়েছি।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম।

– চাচা, আমিতো কোন লোককে পাঠাইনি আপনার কাছে। ব্যাপারটা একটু খুলে বলুনতো? আমার জবাবে তিনি একটু বিব্রত হলেন। বললেন,

– এক যুবক সকালে আমার অফিসে এসে বলল, তুমি তাকে পাঠিয়েছ অনুরোধ জানিয়ে তাকে যাতে ৫০ লক্ষ টাকার একটা কাঠের পারমিট দিয়ে দেয়া হয় যত শীঘ্র সম্ভব।

সব শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! আমাকে বেচার চেষ্টা করছে কেউ! লোকটা কে জানার একটা কৌতুহল হল। বললাম,

– এক কাজ করেন চাচা, আগামীকাল লোকটা যখন পারমিটটা নিতে আসবে তখন আপনি আমাকে জানাবেন, আমি আসব দেখার জন্য লোকটা কে! আপনি আমার পরিচয় দেবেন আপনার দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয় বলে। বাকিটা ঘটনাস্থলেই দেখবেন কি হয়।

পরদিন সকালে যুবক পৌঁছামাত্র আমি ফোন পেলাম। আমি কয়েকজন আইবির লোক সঙ্গে করে উপস্থিত হলাম মন্ত্রী সাহেবের দফতরে। চেম্বারে ঢুকে দেখি এক কেতাদুরস্থ তরুণ চাচার মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছে। আমি সালাম জানিয়ে বসলাম যুবকের পাশেই। যুবকটি আমার পরিচিত নয়। চাচাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

– স্যার, আপনি বলেছিলেন আজ আসতে আমার ছোট ভাই এর আর্মিতে অফিসার র‍্যাঙ্কে ভর্তির ব্যাপারে। আপনি বলেছিলেন মেজর ডালিমের খুব ঘনিষ্ঠ কেউ আসবে আজ যার মাধ্যমে কাজটা করিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন আপনি।

আমার কথার ধরণ বুঝে নিয়ে মিনিষ্টার সাহেব বললেন,

– হ্যাঁ, এই ভদ্রলোকই সেই ব্যক্তি।

বলেই আমাকে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে পরিচয় করিয়ে অনুরোধ জানালেন,

– ভাই সাহেব, এর ছোট ভাই কমিশন র‍্যাঙ্কের জন্য আইএসএসবির অপেক্ষায় আছে। বুঝতেইতো পারেন এদেশে সুপারিশ ছাড়া কিছুই হয় না; আপনি মেজর সাহেবের খাস লোক তাই অনুরোধ জানাচ্ছি ওর কাজটা যদি করে দিতেন তবে খুবই উপকার হত। কথা শেষ হতেই যুবক বলল,

– কি যে বলেন মিনিষ্টার সাহেব, এতো খুবই সামান্য একটা কাজ। এর জন্য মেজর ডালিমের প্রয়োজন নেই। জেনারেল জিয়া কিংবা ব্রিগেডিয়ার খালেদকে বলে দিলেই যথেষ্ট।

কথা শেষ করে যুবক আমার দিকে ফিরে তার একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলল,

– আমার সাথে দেখা করবেন। আপনার সামনেই জেনারেল জিয়া এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদকে

ফোন করে আপনার সমস্যার সমাধান করে দেবো। তার সাহস ও আত্মপ্রত্যয় দেখে আমরা সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। রিপোর্টে ঠিক বোঝা যায়নি সমস্ত ব্যাপারটা একটা ঠগবাজী প্রতারণা ছিল নাকি এর পিছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল। ঘটনাটি হাতে নাতে ধরা না পড়লে আমার নামে দুর্নীতির অভিযোগ রটানো যেত অবশ্যই। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রচার মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে এধরণের প্রতারণার ব্যাপারে সচেতন থাকার জন্য আবেদন জানানো হয়েছিল। আমরাও বিশেষভাবে সতর্ক হয়ে উঠেছিলাম। চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হবে।

 

আবেদুর রহমান অতি কৌশলে ঘুষ দেবার ধৃষ্টতা দেখান

প্রত্যেক ধনী ব্যক্তিই মনে করে যেকোন জিনিষই টাকায় কেনা যায়।

অক্টোবরের শেষাশেষি ঘটলো আরেকটি ঘটনা। এক সন্ধ্যায় মেজর শাহরিয়ার রেডিও কন্ট্রোল থেকে জরুরী ফোন করে ডেকে পাঠালো।

– হ্যালো স্যার, আসসালামু আলাইকুম।

– ওয়ালাইকুম আসসালাম।

– আজ রাতে আবেদুর রহমানকে custody থেকে বের করে লন্ডন পাঠাবার বন্দোবস্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট; এ বিষয়ে আপনি কিছু জানেন কি? বলল শাহরিয়ার।

– না তো; এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।

– স্যার, দুর্নীতির অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের এভাবে বিনা বিচারে ছেড়ে দেয়া হলে এ সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন হবে। লোকজন বলাবলি করবে আবার সেই পুরনো খেলাই শুরু হল, টাকা-পয়সার লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজরা নিজেদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

– তুমি ঠিকই বলছো শাহরিয়ার। তোমার খবর যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে কিছুতেই আবেদুর রহমানকে বিদেশে যেতে দেয়া ঠিক হবে না। তুমি পুনরায় তাকে আটক করার ব্যবস্থা করো। তাকে ধরতে হবে এয়ারপোট থেকে; যাতে করে এর পিছনের মূল ব্যক্তিদের পরিচয় পাওয়া যায়। অভিযুক্ত কাউকে ছেড়ে দেবার অধিকার কারো নেই। After you get him let me know.

– OK Sir, I shall do everything that is necessary. টেলিফোন রেখে দিল শাহরিয়ার।

মাঝ রাতের লন্ডনগামী ফ্লাইটে বিশেষ ব্যবস্থায় তুলে দেয়া হয়েছিল আবেদুর রহমানকে। প্লেনের ভিতর থেকেই off load করে ধরে এনেছিল শাহরিয়ারের পাঠানো টাস্কফোর্স। খবর পেয়ে আমি গিয়ে উপস্থিত হলাম শাহরিয়ারের কন্ট্রোল রুমে। আইজি জনাব নূরুল ইসলাম এবং গ্রেফতারকৃত বিশেষ ব্যক্তিদের ইনচার্জ ডিআইজি জনাব ই.এ. চৌধুরীকেও ডেকে আনা হল। কারণ, খবর পাওয়া গিয়েছিল এ ব্যাপারে তাদের হাত রয়েছে। জনাব ই.এ. চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলাম,

– স্যার, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের দায়িত্বে তো আপনিই রয়েছেন তাই না?

– জ্বী হ্যাঁ। জবাবে বললেন জনাব চৌধুরী।

– সেক্ষেত্রে জনাব আবেদুর রহমানকে ছাড়পত্র দিয়ে প্লেনে তুলে দেবার বন্দোবস্ত করলেন কার হুকুমে

আমার অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে কিছুটা ভড়কে গেলেন জনাব চৌধুরী। আমতা আমতা করে বললেন,

– আইজি সাহেবের হুকুমেই এ ব্যবস্থা করেছিলাম আমি।

– আইজি সাহেব আপনি কি করে এ ধরণের হুকুম দিলেন ? থতমত খেলেন আইজি সাহেব।

– প্রেসিডেন্টের কথামত কাজ করেছি আমি।

– প্রেসিডেন্ট সাহেব এ ব্যাপারে কোন লিখিত অর্ডার দিয়েছেন কি? প্রশ্ন করলাম।

– জ্বী না। টেলিফোনে বলেছিলেন।

– টেলিফোনের কথা যদি এখন প্রেসিডেন্ট অস্বীকার করেন তখন আপনার অবস্থা কি হবে আইজি সাহেব? আইনের রক্ষক হয়ে এ ধরণের কাজ করাটা ঠিক হয়েছে কি আপনার? আমার কথায় ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেলেন পুলিশের জাদরেল অফিসার জনাব ইসলাম। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন,

– মেজর সাহেব, উপরওয়ালাদের ইচ্ছা আমাদের মত জুনিয়রদের জন্য হুকুমেরই সমান ।

– বাহ ! বেশ বলেছেন ! ঔপনিবেশিক আমলাদের এই বিশেষ গুনটি ভালোই জানা আছে আপনার। কিন্তু বাংলাদেশতো একটি স্বাধীন দেশ। এক্ষেত্রে এমন একটি আইন বিরোধী কাজ করতে এতটুকুও বাধলোনা আপনার! বাধবেই বা কেন? ঘুনে ধরা ব্যবস্থার শিকার আপনারা আমরা সবাই। স্বাধীনতা পূর্বকালে ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করে তৃতীয় বিশ্বের সব দেশেই শোষণ কায়েম রেখেছিল বিদেশী শাসকরা। তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের পর সেই আমলাতন্ত্রের অবকাঠামো অটুট রেখে দেশকে লুটেছে সাদা চামরার জায়গায় জাতীয় ব্রাউন সাহেবরা! তাদের ঐ অপশাসন-শোষণে সবসময়েই মদদ যুগিয়ে এসেছে ভাগীদার হিসাবে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র। অসৎ রাজনীতিবিদ এবং আমলাতন্ত্রের মাঝে জাতীয় সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে এসেছে সব আমলেই। কিন্তু এই লুটপাটের দায়-দায়িত্ব কখনোই বহন করতে হয়নি আমলাতন্ত্রকে, সব দায় বহন করতে হয়েছে শুধু রাজনীতিবিদদেরই। আমলারা হেফাজতে থেকেছেন সব সময়েই back stage player হিসাবে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু সেই অপকর্মের ধারাবাহিকতা বজায়ে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ কিংবা আগষ্ট বিপ্লব হয়নি। এই দু’টো সংগ্রামই করা হয়েছে জাতীয় পরিসরে সর্বক্ষেত্রে গণমুখী পরিবর্তন আনার জন্য। সেক্ষেত্রে সময়ের দাবিতে আমাদের মন-মানসিকতা বদলাতে হবে তা না হলে সব কিছুই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আইজি সাহেব প্রেসিডেন্ট যদি আপনাকে সে ধরণের কোন কথা বলেও থাকেন তখন একজন অভিজ্ঞ অফিসার হিসাবেতো আপনার বলা উচিত ছিল যে, কাজটা বেআইনী বিধায় করা ঠিক হবে না; তাই নয় কি? আশা করি আগামীতে এধরণের ঘটনা আর ঘটবে না। আবেদুর রহমানকে ধরে আনা হয়েছে যাবার সময় তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আইন সবার জন্যই সমান; কথাটা কাজেও প্রমাণিত হওয়া উচিত; কি বলেন?

তাদের সাথে আলাপ শেষ করে জনাব আবেদুর রহমানকে ডাকিয়ে আনা হল। আমাদের সামনে এসেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে বলতে লাগলেন,

– স্যার, আমি জীবনে অনেক অন্যায় কাজ করেছি। যথেষ্ট টাকা-পয়সাও অর্জন করেছি অসৎ উপায়ে। আমি তার প্রায়ঃশ্চিত্ত করতে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দেন আপনারা। বলেই বিদেশী একটি ব্যাংকের চেক বুক বের করে তার কয়েকটা ব্ল্যাঙ্ক পাতায় সই করে সেটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বললেন,

– বিদেশে আমার যা গচ্ছিত আছে তার সবটাই আমি আপনাদের দিয়ে দিতে চাই স্বেচ্ছায়। কি সাংঘাতিক লোক ! প্রকারন্তরে ঘুষ দিতে চাচ্ছেন তিনি। উপস্থাপনাটা অতি অভিনব এবং চমৎকার। তার সাথে আর কোন কথা বলতে রুচিতে বাধলো। শাহরিয়ারকে বললাম,

– আমি চললাম, অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি আবেদুর রহমান সাহেবকে আইজি সাহেবকে হ্যান্ড ওভার করে দাও বলে ফিরে এসেছিলাম।

 

টিপিক্যাল আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা

পররাষ্ট্র সচিব আমার শ্বশুড় মহাশয়ের চাকুরির মেয়াদ বাড়িয়ে দেবার সুপারিশ করে আমাকে খুশি করতে চাইলেন।

একদিন পররাষ্ট্র সচিব কাজে এসেছিলেন বঙ্গভবনে। মিলিটারি সেক্রেটারীর ঘরে আমাকে দেখেই বলে উঠলেন,

– এই যে মেজর সাহেব, আপনাকেই খুঁজছি।

– কেন বলুনতো ? জানতে চাইলাম।

– আপনার শ্বশুড় জনাব আরআই চৌধুরী আমার বিশেষ বন্ধু। তিনি এ মাসেই রিটায়ার করছেন। তার মত একজন অভিজ্ঞ লোকের খুবই প্রয়োজন আমাদের লন্ডন মিশনে; বিশেষ করে এই সময়ে। তাই ভাবছি প্রেসিডেন্ট সাহেবকে বলে তিন বছরের একটা এক্সটেনসন করিয়ে দেই, কি বলেন? প্রেসিডেন্টের বিশেষ কারণে যেকোন অফিসারকেই সর্বাধিক তিন বছর পর্যন্ত এক্সটেনসন দেবার ক্ষমতা রয়েছে।

ধৈর্য্য সহকারে তার কথা শুনে বললাম,

– স্যার, আমার শ্বশুড় সরকারি চাকুরির নিয়মানুযায়ী রিটায়ার করছেন। তাকে এক্সটেনসন দেবার প্রয়োজন আছে কিনা সেটা আপনার departmental affairs, সেটা আপনিই ভালো বুঝবেন। এক্ষেত্রে আমার মতামত কিংবা পরামর্শ নেবার যৌক্তিকতাটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।

আমার জবাবে সেক্রেটারী সাহেব কেমন যেন একটু দমে গেলেন; কিন্তু ঝানু লোক যেতে যেতে বলে গেলেন,

– না মানে ব্যাপারটা আপনাকে জানিয়ে রাখা আর কি; এছাড়া আর কিছুই নয়।

উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তিনি আমাকে জানান দিয়ে গেলেন, আমার শ্বশুড়ের extension-টা হচ্ছে তারই উদ্যোগে। তিনি পরে ঠিকই প্রেসিডেন্টের কাছে ফাইলটা পাঠিয়েছিলেন strongly recommend করে। তবে আমিই সেটা হতে দেইনি প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করে। আমার যুক্তি ছিল, সাধারণভাবে সরকারের নীতি যেখানে extension এর বিরুদ্ধে সেখানে আমার শ্বশুড়কে extension দিলে লোকজন কথা বলার সুযোগ পাবে।

 

তোষামোদকারীরা রাষ্ট্রপতিকে খুশি করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছিল

সাধারণভাবে মানব চরিত্র তোষামোদের প্রতি দুর্বল হয়ে থাকে। মোসাহেবদের দল মানুষকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে।

একদিন দেখি জাতীয় ব্যাংকের গভর্ণর জোরেশোরে লবি করে চলেছেন নতুন নোট যেটা ছাপাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাতে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের ছবিই ছাপানো উচিত। কয়েকজন পদস্থ আমলাও কোরাসে যোগ দিয়ে একই কথা বলে বেড়াচ্ছেন। এক ফাঁকে আমি গভর্ণর সাহেবকে কাছে পেয়ে বললাম, “স্যার, অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতির ছবি ছাপানোর জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছেন কেন?” আমার প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব খুঁজে না পেয়ে কিছু না বলেই কেটে পড়লেন। এমনিভাবে একদিন শুনতে পারলাম, কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু আমলা বিতর্কের ঝড় তুলেছেন আমাদের কোন নির্দিষ্ট জাতীয় পোষাক নেই। একটা জাতীয় পোষাক নির্ধারণ করতে হবে; পোষাক যেটাই সাব্যস্ত হোক না কেন ‘মোশতাক টুপি’-কে অবশ্যই জাতীয় পোষাকের অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। মুসলমান হিসাবে জাতীয় পোষাকে টুপি থাকতে পারে যুক্তিসঙ্গত কারণেই; কিন্তু সেটা ‘মোশতাক টুপি’ হতেই হবে কোন যুক্তিতে; সেটাই বোধগম্য হচ্ছিল না। তাই একদিন তদবীরকারীদের একজন জাদরেল নেতাকে অনুরোধ করেছিলাম যুক্তিটা আমাকে বুঝিয়ে দিতে। তিনি তেমন কোন ঠোস যুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এরপর হঠাৎ করেই এই তদবীরে ভাটা পরেছিল যে কোন কারণেই হোক। সব জায়গাতেই কেমন যেন পচঁনের দুর্গন্ধ। ধসে পড়ছে চারিত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধ। যেকোন রাষ্ট্রের জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র হল মেরুদন্ড। সেখানে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত পচঁন ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। সেই ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ছে জাতীয় পরিসরে। সেখানে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে কতটুকু পরিবর্তন আনা সম্ভব সেটা একটা কঠিন প্রশ্ন ও ভাবনার বিষয়। দ্রুত এই পচন ও অবক্ষয়ের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচানো অত্যন্ত দুরহ কাজ। অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রক্রিয়া শুরু করার পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব ঐতিহাসিকভাবেই আজ আমাদের উপর বর্তেছে। এই গুরু দায়িত্ব পালনের আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি আমরা পাহাড় সমান প্রতিবন্ধকতার মুখে। জানি না কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব এই প্রক্রিয়াকে! এ সমস্ত ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরেছিলাম।

পরদিন অভ্যাস মতো ভোর ৬টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করে কাপড় পরছিলাম সেই সময় প্রেসিডেন্টের আরদালী এসে জানাল প্রেসিডেন্ট সাহেব নাস্তার জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তার কামড়ায় গিয়ে দেখলাম আমাদের প্রায় সবাই সেখানে উপস্থিত। আমি একটা খালি চেয়ারে বসলাম প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিয়ে। ভাবছিলাম, প্রেসিডেন্ট গতরাতে আবেদুর রহমানের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবেন। কিন্তু সে বিষয়ের কোন উল্লেখ না করে হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, “বাবা, আমগো মইধ্যে কম্যুনিষ্ট কেডা কেডা?” অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটা করেই তিনি আমাদের সবাইকে দেখতে লাগলেন তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিয়ে। মুখে ছিল তার স্বভাবসিদ্ধ রহস্যময় হাসি। আমাদের কেউই তার প্রশ্নের জবাবে কিছুই বলল না। তিনিই আমাদের সবাইকে নিশ্চুপ দেখে আবার বললেন, “যারাই কম্যুনিষ্ট হওনা কেন; তোমরা জাইন্যা রাইখো আমি সবচেয়ে বড় কম্যুনিষ্ট।” এরপর আর বিশেষ কোন কথাবার্তা হল না। নাস্তা শেষে আমরা সবাই বেরিয়ে এলাম। মনে খটকা লাগল, প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করে এমন একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করলেন কেন? তবে কি তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নেতৃবৃন্দ ও ব্যক্তিদের সাথে আমাদের বিশেষ করে আমার গোপন যোগাযোগের বিষয়ে কিছু জানতে পেরেছেন? নাকি তিনি ঈঙ্গিতে আমাদের কাছে নিজেকে প্রগতিবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করলেন কিছুই ঠিক বুঝতে পারলাম না। তার সেই উক্তি রহস্যাবৃত্তই রয়ে গেল আমাদের সবার কাছে।

 

মেজর নূর পেল শেষ আলটিমেটাম

মেজর হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন ইকবাল জেনারেল জিয়াকে চীফ অফ স্টাফের পদ থেকে সরানোর ব্যাপারে তাদের শেষ কথা জানিয়ে দেয়।

এদিকে আমাদের চাকুরিতে পুনর্বহালের Gazette notification বেরুলেও পোষ্টিং অর্ডার তখন পর্যন্ত বেরোয়নি। লিষ্টেড অফিসারদের চাকুরিচ্যুতির ফাইলটিও সই হয়ে আসেনি প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। বুঝতে পারলাম বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের কূটচালের পরিপ্রেক্ষিতেই এই দু’টো বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিলম্বিত হচ্ছে। গলদটা যে কোথায় সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেও কোন হদিস পেলাম না আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচের গোলক ধাঁধাঁয়। সংকট ঘণীভূত হতে থাকলো।

সেপ্টেম্বরের শেষে এক দুপুরে মেজর নূর এসে উপস্থিত হল আমার ঘরে।

– কী ব্যাপার নূর; তোমাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে?

– চিন্তারই বিষয় স্যার। গত দু’দিন যাবৎ মেজর হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন ইকবালের সাথেই আছি। শেষবারের মত ওরা আমার মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছে, তাদের প্রস্তাবটা উপেক্ষা না করে পুর্নবিবেচনা করার জন্য। ওরা চুড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জেনারেল জিয়াকে আর্মি চীফ অফ স্টাফের পদ থেকে সরাবার প্রস্তাব সেনা পরিষদ যদি মেনে না নেয় তবে তারাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

নূরের কথায় বুঝতে পারলাম, বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। যে কোন সমঝোতার ভিত্তিতেই হোক হাফিজ ও ইকবাল ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে এক হতে চলেছে। ১ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর বিশেষ প্রভাব রয়েছে হাফিজ ও ইকবালের। ১ম ইষ্টবেঙ্গলকে হাত করতে পারলেই সম্ভব হবে ব্রিগেডিয়ার খালেদের পক্ষে ঢাকায় জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে কোন প্রতি বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া আর সেটা হবারই আলামত দেখা যাচ্ছে। মেজর নূরের কাছে তাদের প্রকাশিত মনোভাব সেই ঈঙ্গিতই বহন করছে। চিন্তিতভাবেই নূরকে বলেছিলাম,

– ওদের বলে দিও, যা ইচ্ছে তাই ওরা করতে পারে, তাতে বাধা দিতে না পারলেও সমর্থন আমরা কিছুতেই দিতে পারব না। এ বিষয়ে মিটিং-এ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটাই বলবৎ থাকবে।

– আমিও আপনার সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত স্যার। দেশের স্বার্থে আর কিছু করতে না পারলেও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী যেকোন চক্রান্তের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই চালিয়ে যাব শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে; তবু নীতির প্রশ্নে অটল থাকতে হবে আমাদের। আপনি জেনারেল জিয়াকে সাবধান হতে বলেন স্যার। যেকোন সময় চরম একটা কিছু ঘটে যেতে পারে।

নূরের সাথে আলাপের পর সেদিনই ছুটে গিয়েছিলাম জেনারেল জিয়ার কাছে। তার বাসার লনে বসেই কথা হচ্ছিল,

– স্যার, কি অবস্থা সেনানিবাসের ?

– খালেদ ও শাফায়াতের ঔদ্ধত্যের মাত্রা সকল সীমা ছড়িয়ে যাচ্ছে। ওদের সন্দেহমূলক আচরনের খবরা-খবর আসছে সব দিক থেকেই। তাদেরকে কি করে হ্যান্ডেল করা যায় সেটাই ভাবছি।

– স্যার, শুনতে পাচ্ছি ব্রিগেডিয়ার খালেদ নাকি ১ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে হাত করার চেষ্টা করছেন? এ ব্যাপারে আপনার সতর্ক হওয়া উচিত। ১ম বেঙ্গলকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারলে ঢাকায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ যে কোন একটা চুড়ান্ত অঘটন ঘটিয়ে ফেলার ঝুঁকি নিতে পারে।

– Don’t you worry. The advanced party of the 1st Field Regiment has already arrived from Comilla and the mainbody is on the way. They should be here just within a few days.

– ১ম ইষ্টবেঙ্গল সম্পর্কে ভেবো না। ওটাতো আমারই নিজস্ব ব্যাটালিয়ন। How could Khaled lay his hand on it? স্বভাবসিদ্ধ আত্মপ্রত্যয়ের সাথে জবাব দিলেন জেনারেল জিয়া।

– তবুও সাবধানের মার নেই স্যার। সবদিকেই সার্বক্ষণিক নজর রেখে চলতে হবে আপনাকে এখন থেকে। Please don’t under estimate your opponent. ভালো কথা, আমাদের পোষ্টিং অর্ডারগুলো এখনো বেরুচ্ছে না কেন? এ ব্যাপারে গড়িমসি করছে কেন MS branch. Our postings at the different strategically important units would immensely strengthen your hand to deal with Brig. Khaled & Co, particularly in the present complex and explosive situation. You should have been able to get the retirement orders signed by the President by now. I tell you Sir, time is running out and you must exert yourself to get these things done before it is too late.

– I understand ! জবাব দিলেন জেনারেল জিয়া।

বাইরে প্রকাশ না করলেও তিনি যে বিশেষভাবে উদ্বিঘ্ন সেটা আমি তাকে একান্তভাবে জানি বলেই বুঝতে পারছিলাম। এভাবেই সেদিন আমাদের আলাপ শেষ হয়েছিল। সেটাই ছিল ২-৩রা নভেম্বরের আগে তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ।

 

আসন্ন বিপর্যয় মোকাবেলার রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় সেনা পরিষদ

বিপর্যয় ঠেকাবার জন্য সব মহলের কাছ থেকেই রাজনৈতিক সহযোগিতা ও সমর্থন আদায় করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়।

আসন্ন বিপর্যয়ের মোকাবেলা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করছিল সেনা পরিষদ। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম; যেকোন প্রতিবিপ্লবের মোকাবেলা করার জন্য বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জাতীয়তাবাদী এবং দেশপ্রেমিক সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করা উচিত। আলোচনা হল সাম্যবাদী দলের নেতা তোহা ভাই, সর্বহারা পার্টির মাহবুব, জাসদের মেজর জলিল এবং গণবাহিনীর নেতা কর্নেল তাহেরের সাথে।

সোভিয়েত-ভারত মদদপুষ্ট যেকোন প্রতিবিপ্লবী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন সবাই। সব কিছু জানার পর কর্নেল তাহের বলেছিলেন, “এই মুহুর্তে জেনারেল জিয়ার বিরোধিতা করা দেশদ্রোহিতারই সমান কারণ, বর্তমান অবস্থায় সেনাবাহিনীর পুর্নঃগঠন এবং ঐক্যের প্রয়োজনে জেনারেল জিয়ার কোন বিকল্প নাই৷ তাছাড়া যেকোন বৈদেশিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার জন্য জিয়ার ভাবমুর্তি, ব্যক্তিত্ব এবং ভাবমুর্তিও বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। তাই জিয়াকে আমাদের যে করেই হোক না কেন; বাঁচিয়ে রাখতে হবে বিপ্লবের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে। তিনি দ্ব্যার্থহীনভাবে আরো বলেছিলেন, “অবশেষে খালেদ যদি সত্যিই জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবিপ্লবী পপদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে তার নেতৃত্বাধীন গণবাহিনী সেনা পরিষদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে সেই চক্রান্তের বিরোধিতা করবে। আবার আমরা শুরু করব সমাজ পরিবর্তনের অসমাপ্ত বিপ্লব। বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্বার্থে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে হবে অন্যান্য সব জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতিশীল দলগুলোর সাথে।” এ ব্যাপারে আমাদের বিভিন্ন মহলের সাথে আলোচনার কথা শুনে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। সেদিন আমাদের আলাপ হচ্ছিল পুরনো বন্ধুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে। একান্ত বিশ্বাস এবং নির্ভরশীলতার সাথে আলোচনা করেছিলাম আমরা। সেদিন কোন বিশেষ দলের নেতা হিসাবে কথা বলছিলেন না কর্নেল তাহের। তার অঙ্গীকারে খুঁজে পেয়েছিলাম নিষ্কলুশ-নিবেদিত প্রাণ, দেশপ্রেমিক একজন সাচ্চা মুক্তিযোদ্ধার আন্তরিক উৎকন্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে একদিন কোয়েটা থেকে একত্রে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা প্রণয়নে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল সেই একই অনুপ্রেরণায় আজ আবার জাতির এক মহা ক্রান্তিলগ্নে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলাম জাতীয় স্বার্থ বিরোধী যেকোন চক্রান্তের মোকাবেলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। রাজনৈতিক দর্শন এবং লক্ষ্য হাসিলের পদ্ধতিতে আমাদের মাঝে কোন কোন ক্ষেত্রে মতবিরোধ থাকলেও সেটা দেশ ও জাতীয় স্বার্থের উর্ধ্বে নয়। সে প্রশ্নে আমরা এক ও অভিন্ন। সিদ্ধান্ত নেয়া হল, যেকোন হুমকির মোকাবেলা করার জন্য সেনা পরিষদ এবং গণবাহিনীকে যৌথভাবে প্রস্তুত করে তুলতে হবে অতি সতর্কতার সাথে। কর্নেল তাহের এবং আমাদের মাঝে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের বন্দোবস্ত করা হল।

♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত

♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ

♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার

♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন

♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ

♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার

♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী

♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম

♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান

♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ

♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব

♦ রাষ্ট্রদূত লেঃ কর্নেল (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তম

“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

error: Content is protected !!