ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ওস্তাদ আসীন। তানপুরা-হস্তে বিপিন অত্যন্ত বেসুরা গলায় সা রে গা মা সাধিতেছেন। ভৃত্য আসিয়া খবর দিল, “একটি বাবু এসেছেন।”
বিপিন। বাবু? কিরকম বাবু রে?
ভৃত্য। বুড়ো লোকটি।
বিপিন। মাথায় টাক আছে?
ভৃত্য। আছে।
বিপিন। (তানপুরা রাখিয়া) নিয়ে আয়, এখনই নিয়ে আয়! ওরে, তামাক দিয়ে যা। বেহারাটা কোথায় গেল, পাখা টানতে বলে দে। আর দেখ্, চট্ করে গোটাকতক মিঠে-পানের দোনা কিনে আন্ তো রে। দেরি করিস নে, আর আধ সের বরফ নিয়ে আসিস, বুঝেছিস? (পদশব্দ শুনিয়া) রসিকবাবু, আসুন!
বনমালীর প্রবেশ
বিপিন। রসিকবাবু– এ যে সেই বনমালী!
বৃদ্ধ। আজ্ঞে হাঁ, আমার নাম বনমালী ভট্টাচার্য।
বিপিন। সে পরিচয় অনাবশ্যক। আমি একটু বিশেষ কাজে আছি।
বনমালী। মেয়ে দুটিকে আর রাখা যায় না– পাত্রও অনেক আসছে–
বিপিন। শুনে খুশি হলেম– দিয়ে ফেলুন, দিয়ে ফেলুন–
বনমালী। কিন্তু আপনাদেরই ঠিক উপযুক্ত হত–
বিপিন। দেখুন বনমালীবাবু,এখনো আপনি আমার সম্পূর্ণ পরিচয় পান নি– যদি একবার পান তা হলে আমার উপযুক্ততা সম্বন্ধে আপনার ভয়ানক সন্দেহ হবে।
বনমালী। তা হলে আমি উঠি, আপনি ব্যস্ত আছেন, আর-এক সময় আসব।
[প্রস্থান
বিপিন। (তানপুরা তুলিয়া লইয়া) সারেগা রেগামা গামাপা–
শ্রীশের প্রবেশ
শ্রীশ। কী হে বিপিন– এ কী? কুস্তি ছেড়ে দিয়ে গান ধরেছ?
বিপিন। (শিক্ষকের প্রতি) ওস্তাদজি, আজ ছুটি। কাল বিকেলে এসো।
[ওস্তাদের প্রস্থান
কী করব বলো, গান না শিখলে তো আর তোমার সন্ন্যাসীদলে আমল পাওয়া যাবে না।
শ্রীশ। আচ্ছা, তুমি যে সারেগামা সাধতে বসেছ, কুমারসভার সেই লেখাটায় হাত দিতে পেরেছ?
বিপিন। না ভাই, সেটাতে এখনো হাত দিতে পারি নি। তোমার লেখাটি হয়ে গেছে নাকি?
শ্রীশ। না, আমি হাত দিই নি। (কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া) না ভাই, ভারি অন্যায় হচ্ছে। ক্রমেই আমরা আমাদের সংকল্প থেকে যেন দূরে চলে যাচ্ছি।
বিপিন। অনেক সংকল্প ব্যাঙাচির লেজের মতো, পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে আপনি অন্তর্ধান করে। কিন্তু যদি লেজটুকুই থেকে যেত, আর ব্যাঙটা যেত শুকিয়ে, সে কি-রকম হত? এক সময়ে একটা সংকল্প করেছিলেন বলেই যে সেই সংকল্পের খাতিরে নিজেকে শুকিয়ে মারতে হবে, আমি তো তার মানে বুঝি নে।
শ্রীশ। আমি বুঝি। অনেক সংকল্প আছে যার কাছে নিজেকে শুকিয়ে মারাও শ্রেয়। অফলা গাছের মতো আমাদের ডালে-পালায় প্রতিদিন যেন অতিরিক্ত পরিমাণ রসসঞ্চার হচ্ছে এবং সফলতার আশা প্রতিদিন যেন দূর হয়ে যাচ্ছে। আমি ভুল করেছিলুম ভাই বিপিন! সব বড়ো কাজেই তপস্যা চাই; নিজেকে নানা ভোগ থেকে বঞ্চিত না করলে, নানা দিক থেকে প্রত্যাহার করে না আনতে পারলে, চিত্তকে কোনো মহৎ কাজে সম্পূর্ণভাবে নিযুক্ত করা যায় না। এবার থেকে রসচর্চা একেবারে পরিত্যাগ করে কঠিন কাজে হাত দেব, এইরকম প্রতিজ্ঞা করেছি।
বিপিন। তোমার কথা মানি। কিন্তু সব তৃণেই তো ধান ফলে না; শুকোতে গেলে কেবল নাহক শুকিয়ে মরাই হবে, ফল ফলবে না। কিছুদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে আমরা যে সংকল্প গ্রহণ করেছি সে সংকল্প আমাদের দ্বারা সফল হবে না, অতএব আমাদের স্বভাবসাধ্য অন্য কোনোরকম পথ অবলম্বন করাই শ্রেয়।
শ্রীশ। এ কোনো কাজের কথা নয়। বিপিন, তোমার তম্বুরা ফেলো–
বিপিন। আচ্ছা, ফেললুম, তাতে পৃথিবীর কোনা ক্ষতি হবে না।
শ্রীশ। চন্দ্রবাবুর বাসায় আমাদের সভা তুলে নিয়ে যাওয়া যাক–
বিপিন। উত্তম কথা।
শ্রীশ। আমরা দুজনে মিলে রসিকবাবুকে একটু সংযত করে রাখব।
বিপিন। তিনি একলা আমাদের দুজনকে অসংযত করে না তোলেন।
দ্বিতীয় ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য। একটি বুড়ো বাবু এসেছেন।
বিপিন। বুড়ো বাবু? জ্বালালে দেখছি। বনমালী আবার এসেছে।
শ্রীশ। বনমালী? সে যে এই খানিকক্ষণ হল আমার কাছেও এসেছিল।
বিপিন। ওরে, বুড়োকে বিদায় করে দে।
শ্রীশ। তুমি বিদায় করলে আবার আমার ঘাড়ের উপর গিয়ে পড়বে। তার চেয়ে ডেকে আনুক, আমরা দুজনে মিলে বিদায় করে দিই। (ভৃত্যের প্রতি) বুড়োকে নিয়ে আয়।
রসিকের প্রবেশ
বিপিন। এ কী! এ তো বনমালী নয়, এ যে রসিকবাবু!
রসিক। আজ্ঞে হাঁ– আপনাদের আশ্চর্য চেনবার শক্তি– আমি বনমালী নই। ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী–
শ্রীশ। না, রসিকবাবু, ও-সব নয়, রসালাপ আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।
রসিক। আঃ, বাঁচিয়েছেন!
শ্রীশ। অন্য সকল-প্রকার আলোচনা পরিত্যাগ করে এখন থেকে আমরা একান্তমনে কুমারসভার কাজে লাগব।
রসিক। আমারও সেই ইচ্ছে।
শ্রীশ। বনমালী বলে একজন বুড়ো কুমোরটুলির নীলমাধব চৌধুরির দুই কন্যার সঙ্গে আমাদের বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। আমরা সংক্ষেপে তাকে বিদায় করে দিয়েছি– এ-সকল প্রসঙ্গও আমাদের কাছে অসংগত বোধ হয়।
রসিক। আমার কাছেও ঠিক তাই। বনমালী যদি দুই বা ততোধিক কন্যার বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে উপস্থিত হতেন তবে বোধ হয় তাঁকে নিষ্ফল হয়ে ফিরতে হত।
বিপিন। রসিকবাবু, কিছু জলযোগ করে যেতে হবে।
রসিক। না মশায়, আজ থাক্। আপনাদের সঙ্গে দুটো-একটা বিশেষ কথা ছিল, কিন্তু কঠিন প্রতিজ্ঞার কথা শুনে সাহস হচ্ছে না।
বিপিন। (সাগ্রহে) না না, তাই বলে কথা থাকলে বলবেন না কেন?
শ্রীশ। আমাদের যতটা ঠাওরাচ্ছেন ততটা ভয়ংকর নই। কথাটা কি বিশেষ করে আমার সঙ্গে?
বিপিন। না, সেদিন যে রসিকবাবু বলছিলেন আমারই সঙ্গে ওঁর দুটো-একটা আলোচনার বিষয় আছে।
রসিক। কাজ নেই, থাক্।
শ্রীশ। বলেন তো আজ রাত্রে গোলদিঘির ধারে–
রসিক। না শ্রীশবাবু, মাপ করবেন।
শ্রীশ। বিপিন ভাই, তুমি একটু ও ঘরে যাও-না, বোধ হয় তোমার সাক্ষাতে রসিকবাবু–
রসিক। না না, দরকার কী–
বিপিন। তার চেয়ে রসিকবাবু, তেতালার ঘরে চলুন– শ্রীশ এখানে একটু অপেক্ষা করবেন এখন।
রসিক। না, আপনারা দুজনেই বসুন– আমি উঠি।
বিপিন। সে কি হয়! কিছু খেয়ে যেতে হবে।
শ্রীশ। না, আপনাকে কিছুতেই ছাড়ছি নে। সে হবে না।
রসিক। তবে কথাটা বলি। নৃপবালা-নীরবালার কথা তো পূর্বেই আপনারা শুনেছেন–
শ্রীশ। শুনেছি বৈকি– তা নৃপবালার সম্বন্ধে যদি কিছু–
বিপিন। নীরবালার কোনো বিশেষ সংবাদ–
রসিক। তাঁদের দুজনের সম্বন্ধেই বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে পড়েছে।
উভয়ে। অসুখ নয় তো?
রসিক। তার চেয়ে বেশি। তাঁদের বিবাহের সম্বন্ধ–
শ্রীশ। বলেন কী রসিকবাবু? বিবাহের তো কোনা কথা শোনা যায় নি–
রসিক। কিচ্ছু না– হঠাৎ মা কাশী থেকে এসে দুটো অকালকুষ্মাণ্ডের সঙ্গে মেয়ে দুটির বিবাহ স্থির করেছেন–
বিপিন। এ তো কিছুতেই হতে পারে না রসিকবাবু!
রসিক। মশায়, পৃথিবীতে যেটা অপ্রিয় সেইটেরই সম্ভাবনা বেশি। ফুলগাছের চেয়ে আগাছাই বেশি সম্ভবপর।
বিপিন। কিন্তু মশায়, আগাছা উৎপাটন করতে হবে–
শ্রীশ। ফুলগাছ রোপণ করতে হবে–
রসিক। তা তো বটেই, কিন্তু করে কে মশায়?
শ্রীশ। আমরা করব। কী বল বিপিন?
বিপিন। নিশ্চয়ই।
রসিক। কিন্তু, কী করবেন?
বিপিন। যদি বলেন তো সেই ছেলে দুটোকে পথের মধ্যে–
রসিক। বুঝেছি, সেটা মনে করলেও শরীর পুলকিত হয়। কিন্তু বিধাতার বরে অপাত্র জিনিসটা অমর– দুটো গেলে আবার দশটা আসবে।
বিপিন। এদের দুটোকে যদি ছলে বলে কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারি তা হলে ভাববার সময় পাওয়া যাবে।
রসিক। ভাববার সময় সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। এই শুক্রবারে তারা মেয়ে দেখতে আসবে।
বিপিন। এই শুক্রবারে!
শ্রীশ। সে তো পরশু!
রসিক। আজ্ঞে, পরশুই তো বটে– শুক্রবারকে তো পথের মধ্যে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।
শ্রীশ। আচ্ছা, আমার একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে।
রসিক। কিরকম, শুনি!
শ্রীশ। সেই ছেলে দুটোকে কেউ চেনে?
রসিক। কেউ না।
শ্রীশ। তারা বাড়ি চেনে?
রসিক। তাও না।
শ্রীশ। তা হলে বিপিন যদি সেদিন তাদের কোনোরকম করে আটকে রাখতে পারেন আমি তাদের নাম নিয়ে নৃপবালাকে–
বিপিন। জানই তো ভাই, আমার কোনোরকম কৌশল মাথায় আসে না, তুমি ইচ্ছে করলে কৌশলে ছেলে দুটোকে ভুলিয়ে রাখতে পারবে– আমি বরঞ্চ নিজেকে তাদের নামে চালিয়ে দিয়ে নীরবালাকে–
রসিক। কিন্তু মশায়, এ স্থলে তো গৌরবে বহুবচন খাটবে না; দুটি ছেলে আসবার কথা আছে, আপনাদের একজনকে দুজন বলে চালানো আমার পক্ষে কঠিন হবে–
শ্রীশ। ও, তা বটে।
বিপিন। হাঁ, সে কথা ভুলেছিলেম।
শ্রীশ। তা হলে তো আমাদের দুজনকেই যেতে হয়। কিন্তু–
রসিক। সে দুটোকে ভুল রাস্তায় চালান করে দিতে আমিই পারব। কিন্তু আপনারা–
বিপিন। আমাদের জন্যে ভাববেন না রসিকবাবু!
শ্রীশ। আমরা সব-তাতেই প্রস্তুত আছি।
রসিক। আপনারা মহৎ লোক– এরকম ত্যাগস্বীকার–
শ্রীশ। বিলক্ষণ! এর মধ্যে ত্যাগস্বীকার কিছুই নেই।
বিপিন। এ তো আনন্দের কথা।
রসিক। না না, তুব তো মনে আশঙ্কা হতে পারে যে, কী জানি নিজের ফাঁদে যদি নিজেই পড়তে হয়।
শ্রীশ। কিছু না মশায়, কোনো আশঙ্কায় ডরাই নে।
বিপিন। আমাদের যাই ঘটুক তাতেই আমরা সুখী হব।
রসিক। এ তো আপনাদের মহত্ত্বের কথা, কিন্তু আমার কর্তব্য আপনাদের রক্ষা করা। তা আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, এই শুক্রবারের দিনটা আপনারা কোনোমতে উদ্ধার করে দিন– তার পরে আপনাদের আর কোনো দিন বিরক্ত করব না– আপনারা সম্পূর্ণ স্বাধীন হবেন– আমরাও সন্ধান করে ইতিমধ্যে আর দুটি সৎপাত্র জোগাড় করব।
শ্রীশ। আমাদের বিরক্ত করবেন না এ কথা শুনে দুঃখিত হলেম রসিকবাবু!
রসিক। আচ্ছা, করব।
বিপিন। আমরা কি নিজের স্বাধীনতার জন্যেই কেবল ব্যস্ত? আমাদের এতই স্বার্থপর মনে করেন?
রসিক। মাপ করবেন– আমার ভুল ধারণা ছিল।
শ্রীশ। আপনি যাই বলুন, ফস্ করে ভালো পাত্র পাওয়া বড়ো শক্ত!
রসিক। সেইজন্যেই তো এতদিন অপেক্ষা করে শেষে এই বিপদ। বিবাহের প্রসঙ্গমাত্রই আপনাদের কাছে অপ্রিয়, তবু দেখুন আপনাদের সুদ্ধ–
বিপিন। সেজন্যে কিছু সংকোচ করবেন না–
শ্রীশ। আপনি যে আর-কারো কাছে না গিয়ে আমাদের কাছে এসেছেন, সেজন্যে অন্তরের সঙ্গে ধন্যবাদ দিচ্ছি।
রসিক। আমি আর আপনাদের ধন্যবাদ দেব না। সেই কন্যা দুটির চিরজীবনের ধন্যবাদ আপনাদের পুরস্কৃত করবে।
বিপিন। ওরে পাখাটা টান।
শ্রীশ। রসিকবাবুর জন্যে জলখাবার আনাবে বলেছিলে–
বিপিন। সে এল বলে! ততক্ষণ এক গ্লাস বরফ-দেওয়া জল খান–
শ্রীশ। জল কেন, লেমনেড আনিয়ে দাও-না। (পকেট হইতে টিনের বাক্স বাহির করিয়া) এই নিন রসিকবাবু, পান খান।
বিপিন। ও দিকে হাওয়া পাচ্ছেন? এই তাকিয়াটা নিন-না।
শ্রীশ। আচ্ছা, রসিকবাবু, নৃপবালা বুঝি খুব বিষণ্ন হয়ে পড়েছেন–
বিপিন। নীরবালাও অবশ্য খুব–
রসিক। সে আর বলতে।
শ্রীশ। নৃপবালা বুঝি কান্নাকাটি করছেন?
বিপিন। আচ্ছা, নীরবালা তাঁর মাকে কেন একটু ভালো করে বুঝিয়ে বলেন না–
রসিক। (স্বগত) ঐ রে, শুরু হল। আমার লেমনেডে কাজ নেই। (প্রকাশ্যে) মাপ করবেন, আমায় কিন্তু এখনই উঠতে হচ্ছে।
শ্রীশ। বলেন কী?
বিপিন। সে কি হয়?
রসিক। সেই ছেলে দুটোকে ভুল ঠিকানা দিয়ে আসতে হবে, নইলে–
শ্রীশ। বুঝেছি, তা হলে এখনই যান!
বিপিন। তা হলে আর দেরি করবেন না!
“প্রজাপতির নির্বন্ধ” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ