প্রথম পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমারের শ্বশুর হিন্দুসমাজে ছিলেন, কিন্তু তাঁহার চালচলন অত্যন্ত নব্য ছিল। মেয়েদের তিনি দীর্ঘকাল অবিবাহিত রাখিয়া লেখাপড়া শিখাইতেছিলেন। লোকে আপত্তি করিলে বলিতেন, আমরা কুলীন, আমাদের ঘরে তো চিরকালই এইরূপ প্রথা।
তাঁহার মৃত্যুর পর বিধবা জগত্তারিণীর ইচ্ছা, লেখাপড়া বন্ধ করিয়া মেয়েগুলির বিবাহ দিয়া নিশ্চিন্ত হন। কিন্তু তিনি ঢিলা প্রকৃতির স্ত্রীলোক, ইচ্ছা যাহা হয় তাহার উপায় অন্বেষণ করিয়া উঠিতে পারেন না। সময় যতই অতীত হইতে থাকে আর পাঁচজনের উপর দোষারোপ করিতে থাকেন।
জামাতা অক্ষয়কুমার পুরা নব্য। শ্যালীগুলিকে তিনি পাস করাইয়া নব্যসমাজের খোলাখুলি মন্ত্রে দীক্ষিত করিতে ইচ্ছুক। সেক্রেটারিয়েটে তিনি বড়োরকমের কাজ করেন, গরমের সময় তাঁহাকে সিমলা পাহাড়ে আপিস করিতে হয়। অনেক রাজঘরের দূত, বড়ো সাহেবের সহিত বোঝাপড়া করাইয়া দিবার জন্য বিপদে-আপদে তাঁহার হাতে-পায়ে আসিয়া ধরে। এই-সকল নানা কারণে শ্বশুরবাড়িতে তাঁহার পসার বেশি। বিধবা শাশুড়ি তাঁহাকেই অনাথা পরিবারের অভিভাবক বলিয়া জ্ঞান করেন। শীতের কয় মাস শাশুড়ির পীড়াপীড়িতে তিনি কলিকাতায় তাঁহার ধনী শ্বশুরগৃহেই যাপন করেন। সেই কয় মাস তাঁহার শ্যালী-সমিতিতে উৎসব পড়িয়া যায়।
সেইরূপ কলিকাতা-বাসের সময় একদা শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী পুরবালার সঙ্গে অক্ষয়কুমারের নিম্নলিখিত মতো কথাবার্তা হয়–
পুরবালা। তোমার নিজের বোন হলে দেখতুম কেমন চুপ করে বসে থাকতে! এতদিনে এক-একটির তিনটি-চারটি করে পাত্র জুটিয়ে আনতে! ওরা আমার বোন কিনা–
অক্ষয়। মানব-চরিত্রের কিছুই তোমার কাছে লুকোনো নেই। নিজের বোনে এবং স্ত্রীর বোনে যে কত প্রভেদ তা এই কাঁচা বয়সেই বুঝে নিয়েছ। তা ভাই, শ্বশুরের কোনো কন্যাটিকেই পরের হাতে সমর্পণ করতে কিছুতেই মন সরে না– এ বিষয়ে আমার ঔদার্যের অভাব আছে তা স্বীকার করতে হবে।
পুরবালা সামান্য একটু রাগের মতো ভাব করিয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, “দেখো, তোমার সঙ্গে আমার একটা বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে।”
অক্ষয়। একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তো মন্ত্র পড়ে বিবাহের দিনেই হয়ে গেছে, আবার আর-একটা!
পুরবালা। ওগো, এটা তত ভয়ানক নয়। এটা হয়তো তেমন অসহ্য না হতেও পারে।
অক্ষয় যাত্রার অধিকারীর মতো হাত নাড়িয়া বলিল, “সখী, তবে খুলে বলো!”
বলিয়া ঝিঁঝিটে গান ধরিল–
কী জানি কী ভেবেছ মনে,
খুলে বলো ললনে!
কী কথা হায় ভেসে যায়
ওই ছলছল নয়নে!
এইখানে বলা আবশ্যক, অক্ষয়কুমার ঝোঁকের মাথায় দুটো-চারটে লাইন গান মুখে মুখে বানাইয়া গাহিয়া দিতে পারিতেন। কিন্তু কখনোই কোনো গান রীতিমত সম্পূর্ণ করিতেন না। বন্ধুরা বিরক্ত হইয়া বলিতেন, “তোমার এমন অসামান্য ক্ষমতা, কিন্তু গানগুলো শেষ কর না কেন?” অক্ষয় ফস করিয়া তান ধরিয়া তাহার জবাব দিতেন–
সখা শেষ করা কি ভালো?
তেল ফুরোবার আগেই আমি নিবিয়ে দেব আলো!
এইরূপ ব্যবহারে সকলেই বিরক্ত হইয়া বলে, অক্ষয়কে কিছুতেই পারিয়া উঠা যায় না।
পুরবালাও ত্যক্ত হইয়া বলিলেন, “ওস্তাদজি, থামো! আমার প্রস্তাব এই যে দিনের মধ্যে একটা সময় ঠিক করো যখন তোমার ঠাট্টা বন্ধ থাকবে– যখন তোমার সঙ্গে দুটো-একটা কাজের কথা হতে পারবে!”
অক্ষয়। গরিবের ছেলে, স্ত্রীকে কথা বলতে দিতে ভরসা হয় না, পাছে খপ্ করে বাজুবন্দ চেয়ে বসে।
আবার গান–
পাছে চেয়ে বসে আমার মন
আমি তাই ভয়ে ভয়ে থাকি,
পাছে চোখে চোখে পড়ে বাঁধা
আমি তাই তো তুলি নে আঁখি।
পুরবালা। তবে যাও!
অক্ষয়। না না, রাগারাগি না! আচ্ছা, যা বল তাই শুনব! খাতায় নাম লিখিয়ে তোমার ঠাট্টানিবারণী সভার সভ্য হব! তোমার সামনে কোনোরকমের বেয়াদবি করব না! তা, কী কথা হচ্ছিল! শ্যালীদের বিবাহ! উত্তম প্রস্তাব!
পুরবালা গম্ভীর বিষণ্ন হইয়া কহিল, “দেখো, এখন বাবা নেই। মা তোমারই মুখ চেয়ে আছেন। তোমারই কথা শুনে এখনো তিনি বেশি বয়স পর্যন্ত মেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। এখন যদি সৎপাত্র না জুটিয়ে দিতে পার তা হলে কী অন্যায় হবে ভেবে দেখো দেখি!”
অক্ষয় দুর্লক্ষণ দেখিয়া পূর্বাপেক্ষা কথঞ্চিৎ গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “আমি তো তোমাকে বলেইছি তোমরা কোনো ভাবনা কোরো না। আমার শ্যালীপতিরা গোকুলে বাড়ছেন।”
পুরবালা। গোকুলটি কোথায়?
অক্ষয়। যেখান থেকে এই হতভাগ্যকে তোমার গোষ্ঠে ভরতি করেছ। আমাদের সেই চিরকুমার-সভা।
পুরবালা সন্দেহ প্রকাশ করিয়া কহিল, “প্রজাপতির সঙ্গে তাদের যে লড়াই!”
অক্ষয়। দেবতার সঙ্গে লড়াই করে পারবে কেন? তাঁকে কেবল চটিয়ে দেয় মাত্র। সেইজন্যে ভগবান প্রজাপতির বিশেষ ঝোঁক ঐ সভাটার উপরেই। সরাচাপা হাঁড়ির মধ্যে মাংস যেমন গুমে গুমে সিদ্ধ হতে থাকে– প্রতিজ্ঞার মধ্যে চাপা থেকে সভ্যগুলিও একেবারে হাড়ের কাছ পর্যন্ত নরম হয়ে উঠেছেন– দিব্যি বিবাহযোগ্য হয়ে এসেছেন– এখন পাতে দিলেই হয়। আমিও তো এক কালে ঐ সভার সভাপতি ছিলুম!
আনন্দিতা পুরবালা বিজয়গর্বে ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কিরকম দশাটা হয়েছিল!”
অক্ষয়। সে আর কী বলব! প্রতিজ্ঞা ছিল স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করব না, কিন্তু শেষকালে এমনি হল যে,মনে হত শ্রীকৃষ্ণের ষোলোশো গোপিনী যদি-বা সম্প্রতি দুষ্প্রাপ্য হন অন্তত মহাকালীর চৌষট্টি হাজার যোগিনীর সন্ধান পেলেও একবার পেট ভরে প্রেমালাপটা করে নিই– ঠিক সেই সময়টাতেই তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল আর কি!
পুরবালা। চৌষট্টি হাজারের শখ মিটল?
অক্ষয়। সে আর তোমার মুখের সামনে বলব না! জাঁক হবে। তবে ইশারায় বলতে পারি মা কালী দয়া করেছেন বটে! এই বলিয়া পুরবালার চিবুক ধরিয়া মুখটি একটুখানি তুলিয়া সকৌতুকে স্নিগ্ধ প্রেমে একবার নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন। পুরবালা কৃত্রিম কলহে মুখ সরাইয়া লইয়া কহিলেন, “তবে আমিও বলি, বাবা ভোলানাথের নন্দীভৃঙ্গীর অভাব ছিল না, আমাকে বুঝি তিনি দয়া করেছিলেন!”
অক্ষয়। তা হতে পারে, সেইজন্যেই কার্তিকটি পেয়েছ!
পুরবালা। আবার ঠাট্টা শুরু হল?
অক্ষয়। কার্তিকের কথাটা বুঝি ঠাট্টা? গা ছুঁয়ে বলছি ওটা আমার অন্তরের বিশ্বাস!
এমন সময় শৈলবালার প্রবেশ। ইনি মেজো বোন। বিবাহের এক মাসের মধ্যে বিধবা। চুলগুলি ছোটো করিয়া ছাঁটা বলিয়া ছেলের মতো দেখিতে। সংস্কৃত ভাষায় অনার দিয়া বি| এ| পাস করিবার জন্য উৎসুক।
শৈল আসিয়া বলিল, “মুখুজ্যেমশায়, এইবার তোমার ছোটো দুটি শ্যালীকে রক্ষা করো।”
অক্ষয়। যদি অরক্ষণীয়া হয়ে থাকেন তো আমি আছি। ব্যাপারটা কী?
শৈল। মার কাছে তাড়া খেয়ে রসিকদাদা কোথা থেকে একজোড়া কুলীনের ছেলে এনে হাজির করেছেন, মা স্থির করেছেন তাদের সঙ্গেই তাঁর দুই মেয়ের বিবাহ দেবেন।
অক্ষয়। ওরে বাস্রে! একেবারে বিয়ের এপিডেমিক! প্লেগের মতো! এক বাড়িতে একসঙ্গে দুই কন্যাকে আক্রমণ! ভয় হয় পাছে আমাকেও ধরে। বলিয়া কালাংড়ায় গান ধরিয়া দিলেন–
বড়ো থাকি কাছাকাছি
তাই ভয়ে ভয়ে আছি।
নয়ন বচন কোথায় কখন বাজিলে বাঁচি না বাঁচি।
শৈল। এই কি তোমার গান গাবার সময় হল?
অক্ষয়। কী করব ভাই! রোশনচৌকি বাজাতে শিখি নি, তা হলে ধরতুম। বল কী, শুভকর্ম! দুই শ্যালীর উদ্বাহবন্ধন! কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কেন?
শৈল। বৈশাখ মাসের পর আসছে বছরে আকাল পড়বে, আর বিয়ের দিন নেই।
পুরবালা নিজের স্বামীটি লইয়া সুখী, এবং তাহার বিশ্বাস যেমন করিয়া হোক স্ত্রীলোকের একটা বিবাহ হইয়া গেলেই সুখের দশা। সে মনে মনে খুশি হইয়া বলিল, “তোরা আগে থাকতে ভাবিস কেন শৈল, পাত্র আগে দেখা যাক তো।”
ঢিলা লোকেদের স্বভাব এই যে, হঠাৎ একদা অসময়ে তাহারা মন স্থির করে, তখন ভালোমন্দ বিচার করিবার পরিশ্রম স্বীকার না করিয়া একদমে পূর্বকার সুদীর্ঘ শৈথিল্য সারিয়া লইতে চেষ্টা করে। তখন কিছুতেই তাহাদের আর এক মুহূর্ত সবুর সয় না। কর্ত্রী ঠাকুরানীর সেইরূপ অবস্থা। তিনি আসিয়া বলিলেন, “বাবা অক্ষয়!”
অক্ষয়। কী মা!
জগৎ। তোমার কথা শুনে আর তো মেয়েদের রাখতে পারি নে!
ইহার মধ্যে এইটুকু আভাস ছিল যে, তাঁহার মেয়েদের সকল প্রকার দুর্ঘটনার জন্য অক্ষয়ই দায়ী।
শৈল কহিল, “মেয়েদের রাখতে পার না বলেই কি মেয়েদের ফেলে দেবে মা!”
জগৎ। ঐ তো! তোদের কথা শুনলে গায়ে জ্বর আসে। বাবা অক্ষয়, শৈল বিধবা মেয়ে, ওকে এত পড়িয়ে পাস করিয়ে কী হবে বলো দেখি। ওর এত বিদ্যের দরকার কী?
অক্ষয়। মা, শাস্ত্রে লিখেছে, মেয়েমানুষের একটা-না-একটা কিছু উৎপাত থাকা চাই– হয় স্বামী, নয় বিদ্যে, নয় হিস্টিরিয়া। দেখো না, লক্ষ্মীর আছেন বিষ্ণু, তাঁর আর বিদ্যের দরকার হয় নি, তিনি স্বামীটিকে এবং পেঁচাটিকে নিয়েই আছেন– আর সরস্বতীর স্বামী নেই, কাজেই তাঁকে বিদ্যে নিয়ে থাকতে হয়!
জগৎ। তা যা বল বাবা, আসছে, বৈশাখে মেয়েদের বিয়ে দেবই!
পুরবালা। হাঁ মা, আমারও সেই মত। মেয়েমানুষের সকাল-সকাল বিয়ে হওয়াই ভালো।
শুনিয়া অক্ষয় তাহাকে জনান্তিকে বলিয়া লইল, “তা তো বটেই! বিশেষত যখন একাধিক স্বামী শাস্ত্রে নিষেধ, তখন সকাল-সকাল বিয়ে করে সময়ে পুষিয়ে নেওয়া চাই।”
পুরবালা। আঃ কী বকছ! মা শুনতে পাবেন।
জগৎ। রসিককাকা আজ পাত্র দেখাতে আসবেন, তা চল্ মা পুরি, তাদের জলখাবার ঠিক করে রাখিগে।
আনন্দে উৎসাহে মার সঙ্গে পুরবালা ভাণ্ডার অভিমুখে প্রস্থান করিল।
মুখুজ্যেমশায়ের সঙ্গে শৈলর তখন গোপন কমিটি বসিল। এই শ্যালী-ভাগিনীপতি দুটি পরস্পরের পরম বন্ধু ছিল। অক্ষয়ের মত এবং রুচির দ্বারাই শৈলের স্বভাবটা গঠিত। অক্ষয় তাঁহার এই শিষ্যাটিকে যেন আপনার প্রায় সমবয়স্ক ভাইটির মতো দেখিতেন– স্নেহের সহিত সৌহার্দ্য মিশ্রিত। তাহাকে শ্যালীর মতো ঠাট্টা করিতেন বটে, কিন্তু তাহার প্রতি বন্ধুর মতো একটি সহজ শ্রদ্ধা ছিল।
শৈল কহিল, “আর তো দেরি করা যায় না মুখুজ্যেমশায়। এইবার তোমার সেই চিরকুমার-সভার বিপিনবাবু এবং শ্রীশবাবুকে বিশেষ একটু তাড়া না দিলে চলছে না। আহা, ছেলে দুটি চমৎকার। আমাদের নেপ আর নীরর সঙ্গে দিব্যি মানায়। তুমি তো চৈত্রমাস যেতে-না-যেতে আপিস ঘাড়ে করে সিমলে যাবে, এবারে মাকে ঠেকিয়ে রাখা শক্ত হবে।”
অক্ষয়। কিন্তু তাই বলে সভাটিকে হঠাৎ অসময়ে তাড়া লাগালে যে চমকে যাবে। ডিমের খোলা ভেঙে ফেললেই কিছু পাখি বেরোয় না। যথোচিত তা দিতে হবে, তাতে সময় লাগে।
শৈল একটুখানি চুপ করিয়া রহিল; তার পরে হঠাৎ হাসিয়া বলিয়া উঠিল, “বেশ তো, তা দেবার ভার আমি নেব মুখুজ্যেমশায়।”
অক্ষয়। আর একটু খোলসা করে বলতে হচ্ছে।
শৈল। ঐ তো দশ নম্বরে ওদের সভা? আমাদের ছাদের উপর দিয়ে দেখন-হাসির বাড়ি পেরিয়ে ওখানে ঠিক যাওয়া যাবে। আমি পুরুষবেশে ওদের সভার সভ্য হব, তার পরে সভা কতদিন টেকে আমি দেখে নেব।
অক্ষয় নয়ন বিস্ফারিত করিয়া মুহূর্তকাল স্তম্ভিত থাকিয়া উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। কহিল, “আহা, কী আপসোস যে, তোমার দিদিকে বিয়ে করে সভ্য নাম একেবারে জন্মের মতো ঘুচিয়েছি, নইলে দলবলে আমি সুদ্ধ তোমার জালে জড়িয়ে চক্ষু বুজে মরে পড়ে থাকতুম। এমন সুখের ফাঁড়াও কাটে। সখী, তবে মনোযোগ দিয়ে শোনো (সিন্ধুভৈরবীতে গান)–
ওগো হৃদয়-বনের শিকারি!
মিছে তারে জালে ধরা যে তোমারি ভিখারি;
সহস্রবার পায়ের কাছে আপনি যে জন মরে আছে,
নয়নবাণের খোঁচা খেতে সে যে অনধিকারী।”
শৈল কহিল, “ছি মুখুজ্যেমশায়, তুমি সেকেলে হয়ে যাচ্ছ। ঐ-সব নয়ন-বাণ-টানগুলোর এখন কি আর চলন আছে? যুদ্ধবিদ্যার যে এখন অনেক বদল হয়ে গেছে।”
ইতিমধ্যে দুই বোন নৃপবালা, নীরবালা– ষোড়শী এবং চতুর্দশী প্রবেশ করিল। নৃপ শান্ত স্নিগ্ধ, নীরু তাহার বিপরীত, কৌতুকে এবং চাঞ্চল্যে সে সর্বদাই আন্দোলিত।
নীরু আসিয়াই শৈলকে জড়াইয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মেজদিদি ভাই, আজ কারা আসবে বলো তো?”
নৃপবালা। মুখুজ্যেমশায়, আজ কি তোমার বন্ধুদের নিমন্ত্রণ আছে? জলখাবারের আয়োজন হচ্ছে কেন?
অক্ষয়। ঐ তো! বই পড়ে পড়ে চোখ কানা করলে– পৃথিবীর আকর্ষণে উল্কাপাত কী করে ঘটে সে-সমস্ত লাখ দু-লাখ ক্রোশের খবর রাখ, আর আজ ১৮ নম্বর মধুমিস্ত্রির গলিতে কার আকর্ষণে কে এসে পড়ছে সেটা অনুমান করতেও পারলে না!
নীরবালা। বুঝেছি ভাই সেজদিদি!– বলিয়া নৃপর পিঠে একটা চাপড় মারিল এবং তাহার কানের কাছে মুখ রাখিয়া অল্প একটু গলা নামাইয়া কহিল, “তোর বর আসছে ভাই, তাই সকালবেলা আমার বাঁ চোখ নাচছিল।”
নৃপ তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া কহিল, “তোর বাঁ চোখ নাচলে আমার বর আসবে কেন?”
নীরু কহিল, “তা ভাই, আমার বাঁ চোখটা নাহয় তোর বরের জন্যে নেচে নিলে তাতে আমি দুঃখিত নই। কিন্তু মুখুজ্যেমশায়, জলখাবার তো দুটি লোকের জন্যে দেখলুম, সেজদিদি কি স্বয়ম্বরা হবে না কি?”
অক্ষয়। আমাদের ছোড়দিদিও বঞ্চিত হবেন না।
নীরবালা। আহা মুখুজ্যেমশায়, কী সুসংবাদ শোনালে! তোমাকে কী বকশিশ দেব। এই নাও আমার গলার হার, আমার দু-হাতের বালা।
শৈল ব্যস্ত হইয়া বলিল, “আঃ ছিঃ, হাত খালি করিস নে।”
নীরবালা। আজ আমাদের বরের অনারে পড়ার ছুটি দিতে হবে মুখুজ্যেমশায়।
নৃপবালা। আঃ কী বর-বর করছিস। দেখো তো ভাই মেজদিদি!
অক্ষয়। ওকে ঐজন্যেই তো বর্বরা নাম দিয়েছি। অয়ি বর্বরে, ভগবান তোমাদের কটি সহোদরাকে এই একটি অক্ষয় বর দিয়ে রেখেছেন তবু তৃপ্তি নেই?
নীরবালা। সেইজন্যেই তো লোভ আরো বেড়ে গেছে।
নৃপ তাহার ছোটো বোনকে সংযত করা অসাধ্য দেখিয়া তাহাকে টানিয়া লইয়া চলিল। নীরু চলিতে চলিতে দ্বারের নিকট হইতে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “এলে খবর দিয়ো মুখুজ্যেমশায়, ফাঁকি দিয়ো না। দেখছ তো সেজদিদি কিরকম চঞ্চল হয়ে উঠেছে।”
সহাস্য সস্নেহে দুই বোনকে নিরীক্ষণ করিয়া শৈল কহিল, “মুখুজ্যেমশায়, আমি ঠাট্টা করছি নে– আমি চিরকুমার-সভার সভ্য হব। কিন্তু আমার সঙ্গে পরিচিত একজন কাউকে চাই তো। তোমার বুঝি আর সভ্য হবার জো নেই?”
অক্ষয়। না, আমি পাপ করেছি। তোমার দিদি আমার তপস্যা ভঙ্গ করে আমাকে স্বর্গ হতে বঞ্চিত করেছেন।
শৈল। তা হলে রসিকদাদাকে ধরতে হচ্ছে। তিনি তো কোনো সভার সভ্য না হয়েও চিরকুমার ব্রত রক্ষা করেছেন।
অক্ষয়। সভ্য হলেই এই বুড়োবয়সে ব্রতটি খোওয়াবেন। ইলিশ মাছ অমনি দিব্যি থাকে, ধরলেই মারা যায়– প্রতিজ্ঞাও ঠিক তাই, তাকে বাঁধলেই তার সর্বনাশ।
এমন সময়, সম্মুখের মাথায় টাক, পাকা গোঁফ, গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি, রসিকদাদা আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অক্ষয় তাঁহাকে তাড়া করিয়া গেল; কহিল, “ওরে পাষণ্ড, ভণ্ড, অকালকুষ্মাণ্ড!”
রসিক প্রসারিত দুই হস্তে তাহাকে সম্বরণ করিয়া কহিলেন, “কেন হে, মত্তমন্থর কুঞ্জকুঞ্জর পুঞ্জ-অঞ্জনবর্ণ!”
অক্ষয়। তুমি আমার শ্যালীপুষ্পবনে দাবানল আনতে চাও?
শৈল। রসিকদাদা, তোমারই বা তাতে কী লাভ?
রসিক। ভাই, সইতে পারলুম না, কী করি! বছরে বছরেই তোর বোনদের বয়স বাড়ছে, বড়োমা আমারই দোষ দেন কেন? বলেন, দু-বেলা বসে বসে কেবল খাচ্ছ, মেয়েদের জন্যে দুটো বর দেখে দিতে পার না! আচ্ছা ভাই, আমি না খেতে রাজি আছি, তা হলেই বর জুটবে– না তোর বোনদের বয়স কমতে থাকবে? এ দিকে যে দুটির বর জুটছে না তাঁরা তো দিব্যি খাচ্ছেন-দাচ্ছেন। শৈল ভাই, কুমারসম্ভব পড়েছিস, মনে আছে তো?–
স্বয়ং বিশীর্ণদ্রুমপর্ণবৃত্তিতা
পরা হি কাষ্ঠা তপসস্তয়া পুনঃ।
তদপ্যপাকীর্ণমতঃ প্রিয়ংবদাং
বদন্ত্যপর্ণেতি চ তাং পুরাবিদঃ॥
তা ভাই, দুর্গা নিজের বর খুঁজতে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে তপস্যা করেছিলেন, কিন্তু নাৎনীদের বর জুটছে না বলে আমি বুড়োমানুষ খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেব, বড়োমার এ কী বিচার! আহা শৈল, ওটা মনে আছে তো?– তদপ্যপাকীর্ণমতঃ প্রিয়ংবদাং–
শৈল। মনে আছে দাদা, কিন্তু কালিদাস এখন ভালো লাগছে না।
রসিক। তা হলে তো অত্যন্ত দুঃসময় বলতে হবে।
শৈল। তাই তোমার সঙ্গে পরামর্শ আছে।
রসিক। তা, রাজি আছি ভাই। যেরকম পরামর্শ চাও, তাই দেব। যদি “হাঁ’ বলাতে চাও “হাঁ’ বলব, “না’ বলাতে চাও “না’ বলব। আমার ঐ গুণটি আছে। আমি সকলের মতের সঙ্গে মত দিয়ে যাই বলেই সবাই আমাকে প্রায় নিজের মতোই বুদ্ধিমান ভাবে।
অক্ষয়। তুমি অনেক কৌশলে তোমার পসার বাঁচিয়ে রেখেছ, তার মধ্যে তোমার এই টাক একটি।
রসিক। আর একটি হচ্ছে– যাবৎ কিঞ্চিন্ন ভাষতে। তা, আমি বাইরের লোকের কাছে বেশি কথা কই নে–
শৈল। সেইটে বুঝি আমাদের কাছে পুষিয়ে নাও।
রসিক। তোদের কাছে যে ধরা পড়েছি।
শৈল। ধরা যদি পড়ে থাক তো চলো– যা বলি তাই করতে হবে।
বলিয়া পরামর্শের জন্য শৈল তাঁহাকে অন্য ঘরে টানিয়া লইয়া চলিল।
অক্ষয় বলিতে লাগিল, “অ্যাঁ, শৈল! এই বুঝি! আজ রসিকদা হলেন রাজমন্ত্রী। আমাকে ফাঁকি!”
শৈল যাইতে যাইতে পশ্চাৎ ফিরিয়া হাসিয়া কহিল, “তোমার সঙ্গে আমার কি পরামর্শের সম্পর্ক মুখুজ্যেমশায়? পরামর্শ যে বুড়ো না হলে হয় না।”
অক্ষয় বলিল, “তবে রাজমন্ত্রী-পদের জন্যে আমার দরবার উঠিয়ে নিলুম।” বলিয়া শূন্য ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে খাম্বাজে গান ধরিলেন–
আমি কেবল ফুল জোগাব
তোমার দুটি রাঙা হাতে,
বুদ্ধি আমার খেলে নাকো
পাহারা বা মন্ত্রণাতে।
বাড়ির কর্তা যখন বাঁচিয়া ছিলেন তিনি রসিককে খুড়া বলিতেন। রসিক দীর্ঘকাল হইতে তাঁহার আশ্রয়ে থাকিয়া বাড়ির সুখদুঃখে সম্পূর্ণ জড়িত হইয়া ছিলেন। গিন্নি অগোছালো থাকাতে কর্তার অবর্তমানে তাঁহার কিছু অযত্ন-অসুবিধা হইতেছিল এবং জগত্তারিণীর অসংগত ফরমাশ খাটিয়া তাঁহার অবকাশের অভাব ঘটিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার এই-সমস্ত অভাব-অসুবিধা পূরণ করিবার লোক ছিল শৈল। শৈল থাকাতেই মাঝে মাঝে ব্যামোর সময় তাঁহার পথ্য এবং সেবার ত্রুটি হইতে পারে নাই; এবং তাহারই সহকারিতায় তাঁহার সংস্কৃতসাহিত্যের চর্চা পুরাদমেই চলিয়াছিল।
রসিকদা শৈলবালার অদ্ভুত প্রস্তাব শুনিয়া প্রথমটা হাঁ করিয়া রহিলেন, তাহার পর হাসিতে লাগিলেন, তাহার পর রাজি হইয়া গেলেন। কহিলেন, “ভগবান হরি নারী-ছদ্মবেশে পুরুষকে ভুলিয়েছিলেন, তুই শৈল যদি পুরুষ-ছদ্মবেশে পুরুষকে ভোলাতে পারিস তা হলে হরিভক্তি উড়িয়ে দিয়ে তোর পুজোতেই শেষ বয়সটা কাটাব। কিন্তু মা যদি টের পান?”
শৈল। তিন কন্যাকে কেবলমাত্র স্মরণ করেই মা মনে মনে এত অস্থির হয়ে ওঠেন যে, তিনি আমাদের আর খবর রাখতে পারেন না। তাঁর জন্যে ভেবো না।
রসিক। কিন্তু সভায় কিরকম করে সভ্যতা করতে হয়, সে আমি কিছুই জানি নে।
শৈল। আচ্ছা সে আমি চালিয়ে নেব।
“প্রজাপতির নির্বন্ধ” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ