শ্লোকঃ ৩১

যদা ভূতপৃথগভাবমেরুস্থমনুপশ্যতি ।

তত এব চ বিস্তারং ব্রহ্ম সম্পদ্যতে তদা ॥ ৩১ ৷৷

যদা —যখন; ভূত—জীবগণের পৃথভাবম্ — পৃথক অস্তিত্ব: একস্থম—একই প্রকৃতিতে অবস্থিত। অনুপশ্যতি — দর্শন করেন; ততঃ এব—তা থেকে; চ—ও; বিস্তারম্—বিস্তার; ব্রহ্ম — ব্রহ্মভাব; সম্পদ্যতে — লাভ করেন; তদা — তখন।

গীতার গান

প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে যেবা একত্ব দর্শনে ৷

সর্বভূতের পৃথক ভাব সমৰ্থ সে মনে ॥

সৃষ্টি স্থিতি বিস্তার সেই যেবা জানে ।

সমর্থ সে জন দৃষ্টি ব্রহ্ম সম্পাদনে ॥

অনুবাদঃ যখন বিবেকী পুরুষ জীবগণের পৃথক পৃথক অস্তিত্বকে একই প্রকৃতিতে অবস্থিত এবং একই প্রকৃতি থেকেই তাদের বিস্তার দর্শন করেন, তখন তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন।

তাৎপর্যঃ কেউ যখন দর্শন করতে পারেন যে, জীব তার কামনা বাসনার ফলে নানা রকম জড় দেহ প্রাপ্ত হয় এবং আত্মার থেকে জড় দেহ পৃথক, তখনই তিনি যথাযথভাবে দর্শন করেন। জড়-জাগতিক জীবনে আমরা দেখি যে, কেউ দেবতা, কেউ মানুষ, কেউ কুকুর, কেউ বেড়াল ইত্যাদি। কিন্তু এটি হচ্ছে জড় দর্শন— যথার্থ দর্শন নয়। জীবন সম্বন্ধে জড় ধারণার ফলেই এই জড় বিভেদ প্রতিভাত হয়। জড় দেহের বিনাশ হয়ে যাবার পর, আত্মা একই থাকে। জড়া প্রকৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে আত্মা নানা প্রকার শরীর প্রাপ্ত হয়। কেউ যখন তা দর্শন করতে পারেন, তখন তিনি দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্ত হন। এভাবেই মানুষ, পশু, বড়, ছোট আদি পার্থক্য থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর চেতনা তখন পরিশুদ্ধ হয় এবং তিনি তখন তাঁর চিন্ময় স্বরূপে কৃষ্ণভাবনামৃতে উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হন। তখন তিনি কিভাবে সব কিছু দর্শন করেন, তা পরবর্তী শ্লোকে বর্ণনা করা হবে।

শ্লোকঃ ৩২

অনাদিত্বান্নির্গুণত্বাৎ পরমাত্মায়মব্যয়ঃ ।

শরীরস্থোঽপি কৌন্তেয় ন করোতি ন লিপ্যতে ॥ ৩২ ॥

অনাদিত্বাৎ— অনাদিত্ব হেতু, নির্গুণত্বাৎ— নির্গুণত্ব হেতু, পরম-জড়া প্রকৃতির অতীত; আত্মা—আত্মা; অয়ম্ –এই; অব্যয়ঃ— অবায়; শরীরস্থঃ অপি—শরীরে থেকেও; কৌন্তেয়—হে কুন্তীপুত্র; ন করোতি — কিছুই করে না; ন লিগাতে— লিপ্ত হয় না।

গীতার গান

ব্রহ্মজ্ঞানী জীব নিত্য পরম অব্যয় ।

নির্গুণ অনাদি তত্ত্ব নির্লিপ্ত সে রয় ॥

অনুবাদঃ ব্ৰহ্মভাব অবস্থায় জীব তখন দর্শন করেন যে, অব্যয় এই আত্মা অনাদি, নির্গুণ ও জড়া প্রকৃতির অতীত। হে কৌন্তেয়। জড় দেহে অবস্থান করলেও আত্মা কোন কিছু করে না এবং কোন কিছুতেই লিপ্ত হয় না।

তাৎপর্যঃ জড় দেহের জন্ম হওয়ার ফলে মনে হয় যেন জীবের জন্ম হল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জীব শাশ্বত, সনাতন, তার জন্ম হয় না এবং জড় দেহে স্থিত হলেও সে গুণাতীত ও শাশ্বত। তাই, তার কখনও বিনাশও হয় না। স্বভাবত সে হচ্ছে আনন্দময় । সে নিজে কোন রকম জড় কার্যে নিযুক্ত হয় না; তাই জড় শরীরের সংস্পর্শে আসার ফলে যে সমস্ত কার্য সম্পাদিত হয়, তা তাকে আবদ্ধ করতে পারে না।

শ্লোকঃ ৩৩

যথা সর্বগতং সৌক্ষ্ম্যাদাকাশং নোপলিপ্যতে ৷

সর্বত্রাবস্থিতো দেহে তথাত্মা নোপলিপ্যতে ॥ ৩৩ ৷।

যথা— যেমন; সর্বগতম—সর্বব্যাপ্ত; সৌক্ষ্ম্যাৎ -সূক্ষ্মতা হেতু, আকাশম— আকাশ; ন—না; উপলিপ্যতে—–লিপ্ত হয়; সর্বত্র — সর্বত্র; অবস্থিতঃ — অবস্থিত; দেহে- শরীরে, তথা — তেমন, আত্মা— আত্মা, ন–না, উপলিপ্যতে – লিপ্ত হয়।

গীতার গান

যেমন সর্বগত ব্যোম,     সূক্ষ্ম তত্ত্ব অনুপম,

সর্বত্র সম্ভব বিচরণ।

তথাপি সে লিপ্ত নহে,     নিজের স্বতন্ত্র রহে

সেইরূপ আত্ম বিচরণ ৷।

সর্বত্র ব্যাপিয়া দেহে,     কূটস্থ পৃথক রহে,

মহাভূতে নহে সে মিলন ।

তথা ব্ৰহ্মভূত জীব,     আত্মতত্ত্বে হয়ে শিব,

দেহধর্মে লিপ্ত নাহি হন ॥

অনুবাদঃ আকাশ যেমন সর্বগত হয়েও সূক্ষ্মতা হেতু অন্য বস্তুতে লিপ্ত হয় না, তেমনই ব্রহ্ম দর্শন-সম্পন্ন জীবাত্মা দেহে অবস্থিত হয়েও দেহধর্মে লিপ্ত হন না।

তাৎপর্যঃ জল, কাদা, বিষ্ঠা আদি সব কিছুতেই বায়ু প্রবেশ করে, কিন্তু তা হলেও কোন কিছুর সঙ্গে বায়ু মিশ্রিত হয় না। তেমনই, জীবাত্মা যদিও নানা রকম শরীরে অবস্থান করে, তবুও তার সূক্ষ্ম প্রকৃতির প্রভাবে সে সব কিছু থেকে পৃথক থাকে। তাই, জীবাত্মা যে কিভাবে এই শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং এই শরীরের বিনাশের পর সে যে কিভাবে এই শরীর থেকে চলে যায়, তা জড় চক্ষু দিয়ে দর্শন করা সম্ভব নয়। জড় বিজ্ঞানের মাধ্যমে কেউই তা বিশ্লেষণ করতে পারে না।

error: Content is protected !!