শ্লোকঃ ২৮
সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্ ।
বিনশ্যৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি ॥ ২৮ ॥
সমম্—সমভাবে; সর্বেষু — সমস্ত ভূতেষু — জীবে; তিষ্ঠন্তম্—অবস্থিত, পরমেশ্বরম্ — পরমাত্মাকে বিনশ্যংসু – বিনাশশীলদের মধ্যে, অবিনশান্তম্ — অবিনাশী, যঃ— যিনি; পশ্যতি দর্শন করেন; সঃ- তিনি; পশ্যতি — যথার্থ দর্শন করেন।
গীতার গান
সে সব ভূতেতে সমস্থিত ভগবান ৷
দর্শন করিতে পারে কোন ভাগ্যবান ।।
ভগবান অবিনশ্যৎ বস্তু তাহার ভিতরে ৷
বিনশ্যৎ ধর্ম তিনি স্বীকার না করে ৷।
অনুবাদঃ যিনি সর্বভূতে সমানভাবে অবস্থিত বিনাশশীল দেহের মধ্যেও অবিনাশী পরমাত্মাকে দর্শন করেন, তিনিই যথার্থ দর্শন করেন।
তাৎপর্যঃ সাধুসঙ্গের প্রভাবে যিনি দেহ, দেহী বা জীবাত্মা ও জীবাত্মার বন্ধু—এই তিনটি তত্ত্বের সমন্বয় দর্শন করতে পারেন, তিনিই যথার্থ জ্ঞান লাভ করেছেন। যে পারমার্থিক বিষয়ে প্রকৃত জাতার সঙ্গ করে না, সে এই তিনটি জিনিস দেখতে পায় না। যারা তেমন সঙ্গ লাভ করে না, তারা অজ্ঞ হয়েই থাকে। তারা কেবল দেহটিই দর্শন করে এবং দেহটির যখন বিনাশ হয়ে যায়, তখন মনে করে যে, সব কিছুই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটি তা নয়। দেহের বিনাশ হলেও আত্মা ও পরমাত্মা উভয়ই বর্তমান থাকেন এবং তাঁরা অনাদি কাল ধরে অসংখ্য স্থাবর ও জঙ্গম শরীরে ভ্রমণ করতে থাকেন। পরমেশ্বর এই সংস্কৃত শব্দটিকে কখনও কখনও ‘জীবাত্মা’ বলে অনুবাদ করা হয়, কারণ আত্মা হচ্ছে দেহের প্রভু এবং দেহের বিনাশের পরে সে অন্য একটি রূপ গ্রহণ করে। এভাবেই সে হচ্ছে প্রভু। কিন্তু পরমেশ্বর শব্দটিকে ‘পরমাত্মা’ বলে অন্যেরা ব্যাখ্যা করে থাকেন। দুটি ক্ষেত্রেই, পরমাত্মা ও জীবাত্মা উভয়েই থাকেন। তাঁদের বিনাশ হয় না। এভাবেই যিনি দর্শন করতে পারেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে কি ঘটছে তা বুঝতে পারেন।
শ্লোকঃ ২৯
সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্ ।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্ ॥ ২৯ ॥
সমম্—সমভাবে; পশ্যন্ — দর্শন করে, হি – অবশ্যই; সর্বত্র — সর্বত্র, সমবস্থিতম— সমভাবে অবস্থিত; ঈশ্বরম্ — পরমাত্মাকে। ন— করেন না; হিনস্তি —অধঃপতন; আত্ম ।—মনের দ্বারা; আত্মানম্ — আত্মাকে, ততঃ– সেই হেতু, যাতি — লাভ করেন; পরাম্—পরম, গতিম্ গতি।
গীতার গান
সকলের মধ্যে সম থাকেন ঈশ্বর ।
দেখিতে সমর্থ হয় যেই তৎপর ৷।
যে আত্মাকে অধঃপাত কভু নাহি করে ।
কুপথগামী সে দুষ্ট মন দ্বারে ।।
অনুবাদঃ যিনি সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত পরমাত্মাকে দর্শন করেন, তিনি কখনও মনের দ্বারা নিজেকে অধঃপতিত করেন না। এভাবেই তিনি পরম গতি লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ জীবাত্মা তার জড়-জাগতিক অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে তার চিন্ময় অবস্থা থেকে ভিন্নতর অবস্থান লাভ করে। কিন্তু কেউ যখন বুঝতে পারে যে, পরমেশ্বর ভগবান তাঁর পরমাত্মা অংশ-প্রকাশরূপে সর্বত্র বিরাজিত, অর্থাৎ কেউ যখন সর্বভুতে পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করতে পারেন, তখন আর তিনি বিনাশী মনোভাব নিয়ে নিজেকে অধঃপতিত করেন না এবং তাই তিনি তখন ধীরে ধীরে চিন্ময় জগতের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। মন সাধারণত ইন্দ্রিয় তৃপ্তিমূলক ক্রিয়াকলাপে আসত থাকে, কিন্তু সেই মন যখন ভাবমুখী হয়, তখন পারমার্থিক উপলব্ধির পথে অগ্রসর হওয়া যায়।
শ্লোকঃ ৩০
প্রকৃত্যৈব চ কর্মাণি ক্রিয়মাণানি সর্বশঃ ।
যঃ পশ্যতি তথাত্মানমকর্তারং স পশ্যতি ॥ ৩০ ॥
প্রকৃত্যা—জড়া প্রকৃতির দ্বারা; এব—অবশ্যই; চ—ও; কর্মাণি—কর্মসমূহ; ক্রিয়মাণানি-ক্রিয়মাণ; সর্বশঃ—সর্বতোভাবে; যঃ – যিনি; পশ্যতি দর্শন করেন, তথা—এবং; আত্মানম্—আত্মাকে, অকর্তারম্—অকর্তা; সঃ – তিনি; পশ্যতি — যথাযথভাবে দর্শন করেন।
গীতার গান
প্রকৃতি প্রদত্ত দেহ ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা ।
প্রকৃতিই সাধে কর্ম জীবের সে সারা ॥
কিন্তু আত্মতত্ত্ব জীব কিছু নাহি করে ।
যাঁহার দর্শন সেই সে দেখিতে পারে ॥
অনুবাদঃ যিনি দর্শন করেন যে, দেহের দ্বারা কৃত সমস্ত কর্মই প্রকৃতির দ্বারা সম্পাদিত হয় এবং আত্মা হচ্ছে অকর্তা, তিনিই যথাযথভাবে দর্শন করেন।
তাৎপর্যঃ এই দেহটি পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে জড়া প্রকৃতি দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে এবং দেহের মাধ্যমে জীব যে সমস্ত কার্যকলাপ করে, সেগুলি সে নিজে করে না। সুখ অথবা দুঃখের জন্য সে যা-ই করুক, প্রকৃতপক্ষে তার দেহের গঠন অনুসারে সেটি করতে সে বাধ্য হয়। আত্মা কিন্তু সর্বদাই এই সমস্ত দৈহিক কার্যকলাপের ঊর্ধ্বে। কারও অতীত বাসনা অনুসারে তার দেহটি দেওয়া হয়েছে। কামনা-বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য জীব তার জড় দেহ প্রাপ্ত হয়, যার দ্বারা সে কর্ম করে। বস্তুত বলা যায় যে, দেহটি হচ্ছে একটি যন্ত্র, যা জীবের মনোবাসনা চরিতার্থ করবার জন্য ভগবান বানিয়েছেন। বাসনার ফলে দুঃখ অথবা সুখ ভোগ করবার জন্য জীব নানা রকম সংকটপূর্ণ অবস্থায় পতিত হয়। কিন্তু জীবের এই দিব্যদৃষ্টি যখন বিকশিত হয়, তখন সে তার দেহের কার্যকলাপ থেকে নিজেকে পৃথকরূপে দর্শন করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি যাঁর আছে, তিনি হচ্ছেন আসল দ্রষ্টা।