শ্লোকঃ ২৫

ধ্যানেনাত্মনি পশ্যন্তি কেচিদাত্মানমাত্মনা ।

অন্যে সাংখ্যেন যোগেন কর্মযোগেন চাপরে ॥ ২৫ ॥

ধ্যানেন — ধ্যানের দ্বারা, আত্মনি— অন্তরে, পশ্যন্তি—দর্শন করেন; কেচিৎ—কেউ কেউ; আত্মানম্—পরমাত্মাকে; আত্মনা—মনের দ্বারা; অন্যে — অনোরা; সাংখোন যোগেন—সাংখ্য-যোগের দ্বারা: কর্মযোগেন — কর্মযোগের দ্বারা; চ—ও; অপরে- অন্যেরা।

গীতার গান

ভক্তগণ চিদাশ্রয়ে সদা ধ্যানে রত ।

প্রেমচক্ষে পরমাত্মাকে দর্শন সতত ।।

সাংখ্যযোগী জ্ঞান দ্বারা আলোচনা করে ।

কর্মযোগী ভগবানে কর্মার্পণ করে ৷।

অনুবাদঃ কেউ কেউ পরমাত্মাকে অন্তরে ধ্যানের দ্বারা দর্শন করেন, কেউ সাংখ্য-যোগের দ্বারা দর্শন করেন এবং অন্যেরা কর্মযোগের দ্বারা দর্শন করেন।

তাৎপর্যঃ ভগবান অর্জুনকে বলছেন যে, আত্মজ্ঞান লাভের অনুসন্ধানী বদ্ধ জীবাত্মাদের দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যারা নাস্তিক, অজ্ঞাবাদী এবং সন্দেহবাদী, তারা সর্বতোভাবে তত্ত্বজ্ঞানশূন্য। কিন্তু যারা পারমার্থিক বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, তাদের বলা হয় অন্তদর্শী ভক্ত, দার্শনিক ও নিষ্কাম কর্মী। যারা সর্বদা অদ্বৈতবাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করে, তাদেরও নাস্তিক ও অজ্ঞাবাদী বলে গণ্য করা হয়। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, ভগবদ্ভক্তেরাই কেবল পারমার্থিক উপলব্ধির উন্নত ভরে অধিষ্ঠিত। কারণ তাঁরা জানেন যে, এই জড়া প্রকৃতির ঊর্ধ্বে চিন্ময় ভগবৎ-ধাম রয়েছে, যেখানে পরম পুরুষ ভগবান নিত্য বিরাজমান এবং তিনি পরমাত্মা রূপে নিজেকে বিস্তার করে প্রতিটি জীবের অন্তরে বিরাজমান। তিনিই হচ্ছেন সর্বব্যাপী ভগবান। অবশ্য অনেক অধ্যাত্মবাদী আছেন, যারা জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরাও বিশ্বাসীদের দ্বিতীয় শ্রেণীভূক্ত। নাস্তিক সাংখ্য দার্শনিকেরা জড় জগৎকে চরিশটি তত্ত্বরূপে বিশ্লেষণ করেন এবং তাঁরা জীবাত্মাকে পঞ্চবিংশতি তত্ত্বরূপে বিশ্লেষণ করেন। যখন তাঁরা বুঝতে পারেন যে, জীবাত্মার প্রকৃতি হল জড়াতীত, তখন তাঁরা এটিও বুঝতে পারেন যে, জীবাত্মার ঊর্ধ্বে রয়েছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। সেই ভগবান হচ্ছেন ষড়বিংশতি তত্ত্ব। এভাবেই ক্রমান্বয়ে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে তাঁরাও ভগবদ্ভক্তির স্তরে উন্নীত হন। যাঁরা নিষ্কাম কর্মী বা কর্মযোগী, তাঁরাও ঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছেন। কালক্রমে তাঁরাও কৃষ্ণভাবনায় ভক্তিযোগের স্তরে উন্নীত হবার সুযোগ পান। এখানে বলা হয়েছে যে, কিছু মানুষ আছেন যাঁদের চিত্তবৃত্তি নির্মল এবং তাঁরা ধ্যানের মাধ্যমে পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন। তাঁরা যখন হৃদয়ে পরমাত্মাকে খুঁজে পান, তখন তাঁরা চিন্নায় স্তরে অধিষ্ঠিত হন। তেমনই, অনেকে আছেন, যাঁরা জ্ঞানের মাধ্যমে পরমাত্মাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। কেউ আবার হঠযোগ অভ্যাস করার মাধ্যমে ভগবানকে জানতে চান এবং কেউ আবার শিশুসুলভ কার্যকলাপের মাধ্যমে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করেন।

শ্লোকঃ ২৬

অন্যে ত্বেবমজানন্তঃ শ্রুত্বান্যেভ্য উপাসতে

তেঽপি চাতিতরন্ত্যেব মৃত্যুং শ্রুতিপরায়ণাঃ ॥ ২৬ ॥

অন্যে অন্যেরা; তু কিন্তু; এবম্ – এভাবেই, অজানন্তঃ – না জেনে, শ্রুত্বা — শরণ করে; অন্যেভ্যঃ— অন্যদের কাছ থেকে; উপাসতে— উপাসনা করেন; তে— তারা; অপি—ও; চ–এবং; অতিতরস্তি — অতিক্রম করেন; এব— অবশাই, মৃত্যুম্ মৃত্যুময় সংসার, শ্রুতিপরায়ণাঃ – শ্রবণ- পরায়ণ হয়ে।

গীতার গান

অন্য সাধারণ লোক বুঝে না সে কিছু।

শ্রবণান্তর উপাসনা তারা করে কিছু ॥

তারাও ত্বরিয়া যায় এ সংসার হতে ।

যদি শ্রুতিপরায়ণ সাধুর সঙ্গেতে ॥

অনুবাদঃ অন্য কেউ কেউ এভাবেই না জেনে অন্যদের কাছ থেকে শ্রবণ করে উপাসনা করেন। তাঁরাও শ্রবণ-পরায়ণ হয়ে মৃত্যুময় সংসার অতিক্রম করেন।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকটি আধুনিক সমাজের পক্ষে বিশেষভাবে প্রযোজ্য, কারণ বর্তমান সমাজে বাস্তবিকপক্ষে পারমার্থিক বিষয় সম্বন্ধে কোন রকম শিক্ষাই দেওয়া হয় না। কিছু কিছু লোককে নাস্তিক অথবা অজ্ঞাবাদী অথবা দার্শনিক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের কোন রকম দার্শনিক জ্ঞানই নেই। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে, কোন মানুষ যদি পুণ্যাত্মা হন, তা হলে শ্রবণ করার মাধ্যমে তিনি পরমার্থ সাধনের পথে একটি সুযোগ পেতে পারেন। এই শ্রবণের পন্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, যিনি বর্তমান জগতে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করে গেছেন, তিনি ভগবানের কথা শ্রবণ করার উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। কারণ, সাধারণ মানুষ যদি কেবল সাধু, গুরু, বৈষ্ণবের কাছ থেকে ভগবানের কথা শ্রবণ করেন, তা হলে পারমার্থিক পথে অগ্রসর হতে পারেন, বিশেষ করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে তাঁরা যদি অপ্রাকৃত শব্দ তরঙ্গ – হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে— — নিষ্ঠার সঙ্গে শ্রবণ করেন। তাই বলা হয়েছে যে, সকলেরই উচিত আত্মজ্ঞানী পুরুষের কাছে ভগবানের কথা শ্রবণ করা এবং তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করার যোগ্যতা অর্জন করা। তখন তাঁরা আপনা থেকেই পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা শুরু করবেন। সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন যে, এই কলিযুগে কাউকেই তার অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে না। তবে অনুমানের মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করার সব রকম চেষ্টা পরিত্যাগ করতে হবে। যাঁরা ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছেন, তাঁদের সেবক হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কেউ যদি অসীম সৌভাগ্যের ফলে কোন শুদ্ধ ভক্তের চরণাশ্রয় লাভ করেন, তাঁর মুখারবিন্দ থেকে আত্মজ্ঞান শ্রবণ করেন এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, তা হলে তিনি ধীরে ধীরে শুদ্ধ ভক্তের পর্যায়ে উন্নীত হবেন। এই শ্লোকে শ্রবণ করার পন্থা বিশেষভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এই শ্রবণের পন্থা খুবই যথাযথ। সাধারণ মানুষ যদিও তথাকথিত দার্শনিকদের মতো দক্ষ নাও হন, তবুও শ্রদ্ধা ভরে সাধু-গুরু-বৈষ্ণবের মুখারবিন্দ থেকে ভগবানের কথা শ্রবণ করার ফলে তাঁরা এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তাঁদের প্রকৃত জালয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যাবেন।

শ্লোকঃ ২৭

যাবৎ সংজায়তে কিঞ্চিৎ সত্ত্বং স্থাবরজঙ্গমম্ ।

ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞসংযোগাৎ তদ্বিদ্ধি ভরতর্ষভ ৷৷ ২৭ ॥

যাবৎ—যা কিছু: সংজায়তে—উৎপন্ন হয়; কিঞ্চিৎ — কোন কিছু; সত্ত্বা — অস্তিত্ব স্থাবর-স্থাবর জঙ্গমম্—-জঙ্গম; ক্ষেত্র— দেহ; ক্ষেত্র— ক্ষেত্রজ্ঞের; সংযোগাৎ- সংযোগ থেকে; তৎ-তা, বিদ্ধি — জানবে, ভরতর্ষত – হে ভারতশ্রেষ্ঠ।

গীতার গান

স্থাবর জঙ্গম যত জন্মেছে জন্মাবে।

ক্ষেত্র ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগ প্রভাবে ।।

অনুবাদঃ হে ভারতশ্রেষ্ঠ! স্থাবর ও জঙ্গম যা কিছু অস্তিত্ব আছে, তা সবই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলে জানবে।

তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতি ও জীব উভয়েই সৃষ্টির পূর্বে বর্তমান ছিল, তাদের সম্বন্ধে এই শ্লোকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তা কেবল জড়া প্রকৃতি ও জীবের সমন্বয় মাত্র। প্রকৃতিতে গাছপালা, পাহাড় ও পর্বতের মতো অনেক কিছু আছে, যা স্থাবর বা গতিশীল নয় এবং অনেক কিছু আছে যা জঙ্গম বা গতিশীল। তারা সকলেই জড়া প্রকৃতি এবং পরা প্রকৃতি জীবাত্মার সমন্বয় ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতি জীবাত্মার সংস্পর্শ ছাড়া কোন কিছুরই বিকাশ হতে পারে না। জড়া প্রকৃতির সঙ্গে পরা প্রকৃতির যে সম্পর্ক তা নিতাকাল ধরে চলে আসছে এবং তাদের সমন্বয় সম্পাদিত হয় পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছার প্রভাবে। তাই, তিনি উৎকৃষ্টা ও অনুৎকৃষ্টা উভয় প্রকৃতিরই নিয়ন্তা। তিনি জড়া প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন এবং উৎকৃষ্টা পরা প্রকৃতিকে তিনিই জড়া প্রকৃতিতে স্থাপন করেছেন এবং তার ফলে এই সমস্ত কিছু প্রকাশিত হয়েছে এবং সক্রিয় হয়েছে।

error: Content is protected !!