শোকঃ ২২
পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুঙক্তে প্রকৃতিজান্ গুণান ।
কারণং গুণসঙ্গোহস্য সদসদযোনিজন্ম ৷৷ ২২ ॥
পুরুষঃ—জীব; প্রকৃতিস্থঃ – জড়া প্রকৃতিতে অবস্থিত হয়ে; হি—অবশ্যই, ভুক্তে- ভোগ করে; প্রকৃতিজান্ — প্রকৃতিজাত গুণান — গুণসমূহ; কারণম্ — কারণ; গুণসঙ্গঃ—প্রকৃতির গুণের সঙ্গ প্রভাবে; অস্য এই জীবের; সদসদ — ভাল ও মন্দ; যোনি — যোনিতে, জন্মসু — জন্ম হয়।
গীতার গান
প্রাকৃত হইয়া জীব ভুঞ্জে সেই গুণ ৷
প্রকৃতির গুণ সব প্রকৃতির দান ৷।
প্রাকৃত গুণের সঙ্গ উচ্চনীচ যোনি ।
সদসদ জন্ম হয় অন্য নাহি গণি ।।
অনুবাদঃ জড়া প্রকৃতিতে অবস্থিত হয়ে জীব প্রকৃতিজাত গুণসমূহ ভোগ করে। প্রকৃতির গুণের সঙ্গবশতই তার সৎ ও অসৎ যোনিসমূহে জন্ম হয়।
তাৎপর্যঃ জীব কিভাবে এক দেহ থেকে আর এক দেহে দেহান্তরিত হয় তা বোঝার জন্য এই শ্লোকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, পোশাক পরিবর্তন করার মতো জীব এক দেহ থেকে আর এক দেহে দেহান্তরিত হয়। জড় অস্তিত্বের প্রতি আসক্তিই হচ্ছে এই পোশাক পরিবর্তনের কারণ। জীব যতক্ষণ এই ভ্রান্ত প্রকৃতির দ্বারা মোহাচ্ছন্ন থাকে, ততক্ষণ তাকে এক দেহ থেকে আর এক দেহে দেহান্তরিত হতে হয়। জড় জগতের উপর আধিপত্য করার দুরাশার ফলে সে এই রকম অবাঞ্ছিত অবস্থায় পতিত হয়। জাগতিক কামনা-বাসনার প্রভাবে সে কখনও দেবতারূপে জন্মগ্রহণ করে, কখনও মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করে এবং কখনও পশু, পাখি, জলচর প্রাণী, পতঙ্গ, সাধুসন্ত অথবা পোকা-মাকড় অথবা ছাড়পোকা রূপে জন্মগ্রহণ করে। সর্বক্ষণই এই দেহান্তর ঘটে চলেছে আর সর্ব অবস্থাতেই জীব মনে করছে যে, সে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার নিয়ন্তা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সর্ব অবস্থাতেই সে জড়া প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণাধীন।
কিভাবে জীব বিভিন্ন শরীর প্রাপ্ত হয়, সেই কথা এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার বিভিন্ন শরীর প্রাপ্তির কারণ হচ্ছে, প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের সঙ্গে তার আসঙ্গ। তাই প্রকৃতির তিনটি গুণের ঊর্ধ্বে উন্নীত হয়ে গুণাতীত অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত হতে হবে। তাকেই বলা হয় কৃষ্ণচেতনা। কৃষ্ণচেতনায় অধিষ্ঠিত না হলে তার জড় চেতনা তাকে এক দেহ থেকে আর এক দেহে দেহান্তরিত হতে বাধ্য করবে, কারণ অনাদি কাল ধরে তার হৃদয়ে জড় কামনা-বাসনাগুলি রয়ে গেছে। তাই তার এই চেতনার পরিবর্তন করতে হবে। সেই পরিবর্তন সম্ভব হয় কেবল নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে একা করার মাধ্যমে। তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এখানে দেওয়া হয়েছে—অর্জুন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান শ্রবণ করেছেন। জীব যদি এই শ্রবণের পন্থা অবলম্বন করে, তা হলে সে জড় জগতের উপর আধিপত্য করার চির-পুরাতন বাসনা ত্যাগ করতে সক্ষম হয় এবং জড় জগতের উপর তার আধিপতা করার বাসনা যত কমতে থাকে, সেই অনুপাতে সে দিব্য আনন্দ অনুভব করে থাকে। একটি বৈদিক মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গ লাভে তার জান যতই বর্ধিত হয়, ততই সে নিত। আনন্দময় জীবন আস্বাদন কা থাকে।
শ্লোকঃ ২৩
উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেঽস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ ৷৷ ২৩ ৷৷
উপদ্রষ্টা — সাক্ষী, অনুমত্তা—অনুমোদনকারী; চ– ও, ভর্তা – পালক; ভোক্তা — ভোগকর্তা; মহেশ্বরঃ পরমেশ্বর, পরমাত্মা পরমাত্মা, ইতি—এভাবে চ~~এবং; অপি—ও; উক্তঃ—বলা হয়; দেহে—শরীরে: অস্মিন্—এই; পুরুষঃ- পুরুষ; পরঃ-পরম।
গীতার গান
সে জীবের বদ্ধরূপে পরমাত্মা সঙ্গে ।
উপদেষ্টা অনুমন্তা হন তিনি রঙ্গে ।।
মহেশ্বর তিনি ভোক্তা পুরুষে পরম
জীবের উদ্ধার লাগি তিনি সঙ্গে হন ।।
অনুবাদঃ এই শরীরে আর একজন পরম পুরুষ রয়েছেন, যিনি হচ্ছেন উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর এবং তাঁকে পরমাত্মাও বলা হয়।
তাৎপর্যঃ এখানে বলা হচ্ছে যে, পরমাত্মা যিনি সর্বক্ষণ জীবের সঙ্গে থাকেন, তিনি পরমেশ্বর ভগবানের প্রকাশ। তিনি একজন সাধারণ জীব নন। অদ্বৈতবাদী দার্শনিকেরা যেহেতু ক্ষেত্রজ্ঞকে এক বলে মনে করেন, তাই তাঁদের মতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সেই পার্থক্য স্পষ্টভাবে বোঝাবার জন্য ভগবান এখানে বলেছেন যে, তিনি পরমাত্মা রূপে প্রতিটি দেহে বিরাজ করেন। জীবাত্মা থেকে তিনি পৃথক; তিনি পর অর্থাৎ প্রপঞ্চাতীত। জীবাত্মা কোন বিশেষ ক্ষেত্রের কার্যকলাপ উপভোগ করে থাকেন। কিন্তু পরমাত্মা সীমিত ভোক্তা বা দেহের কর্মফলের ভোক্তারূপে থাকেন না, তিনি বিরাজ করেন সাক্ষী, পর্যবেক্ষক, অনুমোদনকারী ও পরম ভোক্তারূপে। তাঁর নাম চ্ছে পরমাত্মা, জীবাত্মা নয়। তিনি প্রপঞ্চাতীত। এখানে স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে যে আত্মা ও পরমা ভিন্ন। পরমাত্মার হস্ত ও পদ সর্বত্রই আছে, কিন্তু জীবের তা নেই। যেহেতু পরমাত্মা পরমেশ্বর ভগবান, তাই তিনি প্রতিটি জীবের অন্তরে থেকে জীবাত্মার ভোগ বাসনাগুলি মঞ্জুর করেন। পরমাত্মার অনুমোদন ব্যতীত জীবাত্মা কিছুই করতে পারে না। জীবাত্মা হচ্ছে ভুক্ত বা প্রতিপালিত এবং ভগবান হচ্ছেন ভোক্তা ব প্রতিপালক। অসংখ্য জীব আছে এবং তিনি তাদের পরম সুহৃদরূপে তাদের অন্তরে বিরাজ করেন।
প্রতিটি স্বতন্ত্র জীব হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের সনাতন বিভিন্নাংশ এবং তারা উভয়েই একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু জীবের মধ্যে ভগবানের অনুমোদন প্রত্যাহার করার প্রবণতা রয়েছে এবং সে স্বাধীনভাবে জড়া প্রকৃতির উপর আধিপত্য করার বাসনা করে। যেহেতু তার এই প্রবণতা রয়েছে, তাই তাকে বলা হয় পরমেশ্বর ভগবানের তটস্থা শক্তি। জীব ভগবানের জড়া শক্তি নতুবা তাঁর পরা শক্তিতে অবস্থান করতে পারে। যখন সে ছড়া শক্তির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে. তখন পরমেশ্বর ভগবান তাকে তাঁর পরা প্রকৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তার পরম বন্ধু পরমাত্মা রূপে তার সঙ্গে সঙ্গে থাকেন। ভগবান জীবকে পরা প্রকৃতিতে নিয়ে যাবার জন্য সর্বদাই উদ্গ্রীব, কিন্তু জীব তার যৎপরোনাস্তি ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্র্যের প্রভাবে প্রতিনিয়ত পরম চিন্ময় জ্যোতিস্বরূপ ভগবানের সঙ্গ প্রত্যাখ্যান করছে। তার স্বাতন্ত্রের অপব্যবহার করার ফলেই জীব এই জড়া প্রকৃতিতে সংসার-দুঃখ ভোগ করছে। ভগবান তাই সর্বক্ষণ তার অন্তরে থেকে এবং বাইরে থেকে উপদেশ দিচ্ছেন। বাইরে থেকে তিনি ভগবদ্গীতা রূপে উপদেশ দিচ্ছেন এবং অন্তর থেকে তিনি জীবের দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদন করার চেষ্টা করছেন যে, এই জড় জগতে তার কোন কর্ম আনন্দ দানের পক্ষে উপযোগী নয়। তিনি বলছেন, “এই সব কিছু পরিত্যাগ করে আমার প্রতি বিশ্বাসভাজন হও, তা হলেই তুমি সুখী হতে পারবে।” এভাবেই বুদ্ধিমান বাক্তি পরমাত্মা বা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি তাঁর বিশ্বাস অর্পণ করে সৎ-চিৎ-আনন্দময় জীবনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন।
শ্লোকঃ ২৪
য এবং বেত্তি পুরুষং প্রকৃতিং চ গুণৈঃ সহ ।
সর্বথা বর্তমানোঽপি ন স ভূয়োঽভিজায়তে ॥ ২৪ ৷৷
যঃ—যিনি; এব—এভাবেই; বেত্তি—জানেন; পুরুষম্ — পুরুষকে, প্রকৃতি — জড়া প্রকৃতিকে, চ–এবং; গুণৈঃ— গুণ; সহ — সহ; সর্বথা— সর্বতোভাবে: বর্তমানঃ- বিদ্যমান হয়ে; অপি—ও; ন–না, সঃ— তিনি; ভূয়ঃ—পুনরায়, অভিজায়তে— জন্মগ্রহণ করেন।
গীতার গান
সেই সে জ্ঞানের দ্বারা পুরুষ প্রকৃতি ।
পুরুষের যে প্রাকৃত গুণের স্বীকৃতি ৷।
যে বুঝিল বৰ্তমান হইয়া সর্বথা ।
পুনর্জন্ম নাহি তার নহে সে অন্যথা ৷।
অনুবাদঃ যিনি এভাবেই পুরুষকে এবং গুণাদি সহ জড়া প্রকৃতিকে অবগত হন, তিনি জড় জগতে বর্তমান হয়েও পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করেন না।
তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতি, পরমাত্মা, জীবাত্মা এবং তাদের পরস্পরের সম্পর্ক সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারলে মুক্তি লাভের যোগ্যতা অর্জন করা যায় এবং এই জগতে পুনরাবর্তিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা অতিক্রম করে চিৎ-জগতে প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করা যায়। এটিই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞানের পরিণতি। জ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, জীব যে ঘটনাচক্রে এই জড় জগতের বন্ধনে পতিত হয়েছে, তা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার প্রভাবে, সাধু, গুরু ও বৈষ্ণবের সঙ্গ করার ফলে মানুষ তার স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হতে পারে এবং প্রতিটি মানুষেরই কর্তব্য হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের মুখনিঃসৃত ভগবদ্গীতার যথাযথ তাৎপর্য উপলব্ধি করে ভগবৎ-চেতনা বা কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করা। তা হলে তাকে আর জড় জগতের বন্ধনে ফিরে আসতে হয় না। সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। তখন তিনি সচ্চিদানন্দময় জীবন লাভ করবার জন্য চিন্ময় জগতে ফিরে যাবেন।