শ্লোকঃ ১৯
ইতি ক্ষেত্রং তথা জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চোক্তং সমাসতঃ ।
মদ্ভক্ত এতদ্বিজ্ঞায় মদ্ভাবায়োপপদ্যতে ৷। ১৯ ।।
ইতি—এভাবেই; ক্ষেত্র— ক্ষেত্র (দেহ); তথা — ৩; জ্ঞানম্—জ্ঞান; য়েম্ জ্ঞেয়; চ—ও; উত্তম্—বলা হল, সমাসতঃ সংক্ষেপে, মদ্ভক্তঃ – আমার ভক্ত, এতৎ— এই সমস্ত; বিজ্ঞায়— বিদিত হয়ে, মস্তুাবায় — আমার ভাব; উপপদ্যতে – লাভ করেন।
গীতার গান
এই কহিনু তত্ত্ব ক্ষেত্রজ্ঞান জ্ঞেয় ।
বিজ্ঞান তাহার নাম পণ্ডিতের প্রিয় ।।
এ বিজ্ঞান বুঝিয়া সে মোর ভক্ত হয় ।।
তত্ত্ব শুদ্ধি জ্ঞান হয় ভক্তির আশ্রয় ৷।
অনুবাদঃ এভাবেই ক্ষেত্র, জ্ঞান ও জ্ঞেয় —এই তিনটি তত্ত্ব সংক্ষেপে বলা হল। আমার ভক্তই কেবল এই সমস্ত বিদিত হয়ে আমার ভাব লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ ভগবান এখানে ক্ষেত্র (শরীর), জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই তিনটি তত্ত্বের সংক্ষিপ্তসার বর্ণনা করেছেন। এই জ্ঞান হচ্ছে তিনটি বিষয়ের জ্ঞাতা, জ্ঞাতব্য ও জ্ঞান আহরণের পন্থা। যুক্তভাবে এদের বলা হয় বিজ্ঞান। ভগবানের অনন্য ভক্ত সরাসরিভাবে শুদ্ধ জ্ঞান উপলব্ধি করতে পারেন, কিন্তু অন্যদের পক্ষে এই জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। অদ্বৈতবাদীরা বলে থাকেন যে, পরম স্তরে এই তিনটি বিষয় এক হয়ে যায়। কিন্তু ভগবদ্ভক্তেরা সেই কথা স্বীকার করেন না। জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিকাশের অর্থ হচ্ছে, কৃষ্ণভাবনামৃতের আলোকে নিজেকে উপলব্ধি করা। আমরা জড় চেতনার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি, কিন্তু আমরা যখনই আমাদের সমস্ত চেতনা কৃষ্ণোন্মুখী করে তুলি এবং শ্রীকৃষ্ণকে সর্ব কারণের পরম কারণরূপে উপলব্ধি করতে পারি, তখনই আমরা যথার্থ জ্ঞান প্রাপ্ত হই। পক্ষান্তরে বলা যায়, জ্ঞান হচ্ছে যথার্থভাবে ভগবদ্ভক্তি উপলব্ধি করার প্রারম্ভিক স্তর। পঞ্চদশ অধ্যায়ে এই বিষয়টি খুব পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হবে।
এখন, আলোচনার সারসংক্ষেপ করতে গেলে, বোঝবার চেষ্টা করতে হবে যে, মহাভূতানি থেকে শুরু করে চেতনা ধৃতিঃ পর্যন্ত ৬ ও ৭ শ্লোকে জড় উপাদানগুলি ও জীবন-লক্ষণের কয়েকটি অভিব্যক্তির বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এগুলির সমন্বয়ে দেহ অর্থাৎ কর্মক্ষেত্র গঠিত হয়। আর অমানিত্বম্ থেকে তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম্ পর্যন্ত ৮ থেকে ১২ শ্লোকে জীবাত্মা ও পরমাত্মা রূপী উভয় ক্ষেত্রজ্ঞের স্বরূপ উপলব্ধি অর্জনের উপযোগী জ্ঞান আহরণের পন্থা বিবৃত হয়েছে। তার পরে অনাদি মৎপরম্ থেকে আরম্ভ করে হৃদি সর্বস্য বিষ্ঠিতম পর্যন্ত ১৩ থেকে ১৮ শ্লোকে জীবাত্মা ও পরমেশ্বর ভগবান অর্থাৎ পরমাত্মার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
এভাবেই তিনটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে— ক্ষেত্র (শরীর), জ্ঞান উপলব্ধির পন্থা এবং জীবাত্মা ও পরমাত্মা। এখানে বিশেষভাবে বোঝানো হয়েছে যে, কেবলমাত্র ভগবানের শুদ্ধ ভক্তেরাই এই তিনটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন। সুতরাং, এই সব ভক্তদের কাছে ভগবদ্গীতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়; তারাই পরম লক্ষ্য পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের ভাব লাভ করতে পারেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, আর কেউ নয়, কেবলমাত্র ভক্ত-জনেরাই ভগবদ্গীতা বুঝতে পারেন এবং বাঞ্ছিত ফল লাভ করতে পারেন।
শ্লোকঃ ২০
প্রকৃতিং পুরুষং চৈব বিদ্ব্যনাদী উভাবপি ।
বিকারাংশ্চ গুণাংশ্চৈব বিদ্ধি প্রকৃতিসম্ভবান্ ।। ২০ ।।
প্রকৃতিম্—গড়া প্রকৃতি; পুরুষম্—পুরুষ, চ—ও; এব—অবশ্যই; বিদ্ধি — জানবে; অনাদী—আদিহীন, উভৌ—উভয়, অপি—ও; বিকারান্—বিকার, চ–ও, গুণান্ প্রকৃতির তিনটি গুণ; চ ও; এব—অবশ্যই; বিদ্ধি—জানবে; প্রকৃতি জড়া প্রকৃতি; সম্ভাবান্—উদ্ভূত।
গীতার গান
প্রকৃতি পুরুষ হয় অনাদি সে সিদ্ধ ৷
অনাদি কাল হতে উভয় সংবৃদ্ধ ।।
বিকারাদি গুণ যত প্রাকৃত সম্ভব ।
প্রাকৃত পুরুষ যেই তার অনুভব ৷।
অনুবাদঃ প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ই অনাদি বলে জানবে। তাদের বিকার ও গুণসমূহ প্রকৃতি থেকেই উৎপন্ন বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ে প্রদত্ত জ্ঞানের মাধ্যমে দেহ (কর্মক্ষেত্র) ও ক্ষেত্রজ (জীবাত্মা, পরমাত্মা উভয়ই) সম্বন্ধে জানা যায়। দেহ হচ্ছে কর্মক্ষেত্র এবং তা জড় উপাদান দিয়ে তৈরি। দেহে আবদ্ধ হয়ে কর্মফল ভোগ করছে যে স্বতন্ত্র আত্মা, সেই হচ্ছে, পুরুষ বা জীব। জীবাত্মাকে বলা হয় ক্ষেত্রজ্ঞ এবং অপর ক্ষেত্রজ্ঞ হচ্ছেন পরমাত্মা। আমাদের অবশ্য জানতে হবে যে, পরমাত্মা ও জীবাত্মা উভয়েই পরম পুরুষ ভগবানের বিভিন্ন প্রকাশ। জীব হচ্ছে তাঁর শক্তিতত্ত্ব এবং পরমাত্মা হচ্ছেন তাঁর স্বাংশ-প্রকাশ।
জড়া প্রকৃতি ও জীব উভয়েই নিত্য, অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বেও তাদের অস্তিত্ব ছিল। পরমেশ্বর ভগবানের শক্তি থেকেই জড়া প্রকৃতি প্রকাশিত হয়েছে এবং জীবও তেমনই। কিন্তু জীব হচ্ছে ভগবানের উৎকৃষ্ট শক্তিসম্ভূত। সৃষ্টির পূর্বে তারা উভয়েই ছিল। জড়া প্রকৃতি নিহিত ছিল পরমেশ্বর ভগবান মহাবিষ্ণুর মধ্যে এবং মহাবিষ্ণুর ইচ্ছার ফলে মহৎ-তত্ত্বের মাধ্যমে আবার তার প্রকাশ হয়। তেমনই, জীবেরাও তাঁর মধ্যে আছে, কিন্তু যেহেতু তারা বদ্ধ অবস্থায় রয়েছে, তাই তারা ভগবানের সেবাবিমুখ। তাই, তাদের চিদাকাশে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু জড়া প্রকৃতিতে আসার ফলে এই সমস্ত জীবকে আবার জড় জগতে কর্ম করবার সুযোগ দেওয়া হয়, যাতে তারা চিৎ-জগতে প্রবেশ করবার জন্য নিজেদের তৈরি করে নিতে পারে। সেটিই হচ্ছে এই জড় সৃষ্টির রহস্য। প্রকৃতপক্ষে জীব হচ্ছে মূলত ভগবানের চিন্ময় বিভিন্ন অংশ। কিন্তু তার বিদ্রোহীসুলভ প্রকৃতির জন্য সে এই জড়া প্রকৃতিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ভগবানের উৎকৃষ্টা শক্তিজাত এই সমস্ত জীব যে কেন এবং কিভাবে এই জড় জগতের সংস্পর্শে এলে তা নিয়ে মাথা ঘামাবার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু পরম পুরুষোত্তম ভগবান অবশ্য জানেন কেন এবং কিভাবে তা ঘটল। শাস্ত্রে ভগবান বলেছেন যে, যারা জড় জগতের প্রতি আকৃষ্ট, তারা জীবন ধারণের জন্য কঠোর সংগ্রাম করছে। কিন্তু এই কয়েকটি শ্লোকের মাধ্যমে আমাদের নিশ্চিতভাবে জানা উচিত যে, জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের প্রভাবে যে সমস্ত পরিবর্তন ঘটছে তা সবই জড়া প্রকৃতির দ্বারা পরিচালিত। জীবের সমস্ত রূপান্তর ও বৈচিত্র সবং দৈহিক। আত্মার পরিপেক্ষিতে সমস্ত জীবই এক রকম।
শ্লোকঃ ২১
কার্যকারণকর্তৃত্বে হেতুঃ প্রকৃতিরুচ্যতে ।
পুরুষঃ সুখদুঃখানাং ভোক্ত্রিত্বে হেতুরুচ্যতে ॥২১ ॥
কার্য—কার্য, কারণ—কারণ, কর্তৃত্বে — কর্তৃত্ব বিষয়ে, হেতুঃ— হেতু, প্রকৃতিঃ– জড়া প্রকৃতিকে; উচ্যতে বলা হয়; পুরুষঃ—জীবকে; সুখ—সুখ; দুঃখানাম্ দুঃখের, ভোতৃত্বে— ভোগ বিষয়ে; হেতুঃ—হেতু: উচ্যতে বলা হয়।
গীতার গান
কার্য বা কারণ হয় প্রকৃতির দান ।
ভোগের কারণ সেই পুরুষেই হন ॥
অনুবাদঃ সমস্ত জড়ীয় কার্য ও কারণের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিকে হেতু বলা হয়, তেমনিই জড়ীয় সুখ ও দুঃখের ভোগ বিষয়ে জীবকে হেতু বলা হয়।
তাৎপর্যঃ জীবের ভিন্ন ভিন্ন শরীর ও ইন্দ্রিয়ের প্রকাশ হয় জড়া প্রকৃতির প্রভাবে। চুরাশি লক্ষ বিভিন্ন প্রজাতির জীব আছে এবং তা প্রকৃতিরই সৃষ্টি। জীব তার ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন শরীর প্রাপ্ত হয়। ভিন্ন ভিন্ন শরীরে তখন সে বিভিন্ন রকমের সুখ ও দুঃখ অনুভব করে। তার এই সুখ ও দুঃখের কারণ তার জড় দেহ এবং সেই অনুভূতিগুলি তার নিজের নয়। তার স্বরূপে সে যে নিত্য আনন্দময়, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। তাই সেটি হচ্ছে তার স্বাভাবিক অবস্থা। কিন্তু জড় জগতের উপর আধিপত্য করার বাসনার ফলে জীব জড় জগতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। চিৎ-জগতে এই সমস্ত বন্ধনের কোন প্রশ্নই ওঠে না। চিৎ- জগৎ হচ্ছে চিরপবিত্র, কিন্তু জড় জগতে সকলেই তাদের দেহগত ইন্দ্ৰিয়সুখ উপভোগের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। আরও স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, এই দেহটি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের পরিণাম। ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার যন্ত্র। তাই দেহ ও যন্ত্রতুল্য ইন্দ্রিয়গুলি জড়া প্রকৃতির দান। পরবর্তী শ্লোকে বিশ্লেষণ করা হবে যে, জীব তার পূর্বকৃত কর্ম এবং বাসনা অনুসারে সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করে। জীবের কামনা ও কর্ম অনুসারে জড়া প্রকৃতি তাকে বিভিন্ন আবাসনে প্রেরণ করে। এই সমস্ত আবাসনগুলি অর্জনের জন্য জীব নিজেই দায়ী এবং সেই অনুসারে সে সুখ ও দুঃখ ভোগ করে থাকে। কোন বিশেষ জড় শরীর প্রাপ্ত হলেই জীব প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে, কারণ তার দেহটি জড় পদার্থ বলেই জড়া প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে তাকে পরিচালিত হতে হয়। তখন সেই নিয়ম পরিবর্তন করার কোন শক্তি জীবের থাকে না। যেমন, কোন জীবকে কুকুরের দেহে রাখা হল। যখনই তাকে কুকুরের দেহে রাখা হল, তখন তাকে কুকুরের মতোই আচরণ করতে হবে। অন্য কোন রকম আচরণ সে আর তখন করতে পারে না। অথবা কোন জীবকে যদি শুকরের দেহে রাখা হয়, তখন সে শূকরের মতো বিষ্ঠা খেতে আর সেভাবেই কাজ করতে বাধ্য হয়। তেমনই, কোন জীবকে যদি দেবতা শরীরে রাখা হয়, তখন তাকে তার সেই দেহ অনুসারে আচরণ করতে হয়। এটিই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু সর্ব অবস্থাতেই পরমাত্মা জীবাত্মার সঙ্গে রয়েছেন। বেদে (মুণ্ডক উপনিষদ ৩/১/১) তার ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে— দ্বা সুপর্ণা সবুজা সখায়া। পরমেশ্বর ভগবান জীবের প্রতি এতই দয়াশীল যে, তিনি সর্বদাই তার পরম বন্ধুর মতো পরমাত্মা রূপে তার সঙ্গে সঙ্গে থাকেন।