শ্লোকঃ ১৬

বহিরন্তশ্চ ভূতানামচরং চরমেব চ ।

সূক্ষ্মত্বাত্তদবিজ্ঞেয়ং দূরস্থং চান্তিকে চ ত‍ৎ ॥ ১৬ ॥

বহিঃ—বাইরে; অন্তঃ— অন্তরে, চ–ও, ভূতানাম্ — সমস্ত জীবের, অচরম্ স্থাবর, চরম্—জঙ্গম; এব; চ-এবং সূক্ষ্মত্বাৎ— সুক্ষ্মতা হেতু, তৎ– তা অবিজ্ঞেয়ন্—অবিজ্ঞেয়; দূরস্থ — দূরে অবস্থিত, চ–ও, অস্তিকে — নিকটে; চ এবং; তৎ—তা।

গীতার গান

সকল ভূতের তিনি অন্তরে বাহিরে ।

তাঁহা হতে হয় সব চর বা অচর ।।

অতি সূক্ষ্ম তত্ত্ব তাই অবিজ্ঞেয় ।

যুগপৎ বহু দূরে নিকটেতেও হয় ।।

অনুবাদঃ সেই পরমতত্ত্ব সমস্ত ভূতের অন্তরে ও বাইরে বর্তমান। তাঁর থেকেই সমস্ত চরাচর; অত্যন্ত সূক্ষ্মতা হেতু তিনি অবিজ্ঞেয়। যদিও তিনি বহু দূরে অবস্থিত, কিন্তু তবুও তিনি সকলের অভ্যন্ত নিকটে।

তাৎপর্যঃ বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ প্রতিটি জীবের অন্তরে ও বাইরে বিরাজ করছেন। তিনি চিন্ময় ও জড় উভয় জগতে রয়েছেন। যদিও তিনি অনেক অনেক দূরে, তবুও তিনি আমাদের অতি নিকটেই। এগুলি হচ্ছে বৈদিক শাস্ত্রের বর্ণনা। আসীনো দুরং ব্রজতি শরানো যাতি সর্বতঃ

( ফঠ উপনিষদ ১/২/২১)। আর যেহেতু তিনি সর্বদাই চিদানন্দময়, তাই আমরা বুঝতে পারি না কিভাবে তিনি তাঁর পূর্ণ ঐশ্বর্য উপভোগ করছেন। এই গড় ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে আমরা তা দেখতে পাই না বা বুঝতে পারি না। তাই বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, আমাদের জড় মন ও ইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে উপলব্ধি করা কখনই সম্ভব নয়। কিন্তু ভক্তি সহকারে কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন করার ফলে যাঁর মন ও ইন্দ্রিয় নির্মল হয়েছে, তিনি নিরন্তর তাঁকে দর্শন করতে পারেন। ব্রহ্মসংহিতাতে সেই সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, যে ভক্ত প্রেমভক্তিতে ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তিনি নিরন্তর তাঁকে দর্শন করতে পারেন। আর ভগবদ্গীতাতে ( ১১/৫৪) তা প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে, ভক্তিযোগের মাধ্যমেই কেবল তাঁকে দর্শন করা যায় এবং উপলব্ধি করা যায়। ভরা তুননায়া শক্যঃ।

শ্লোকঃ ১৭

অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্ ৷

ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ ॥ ১৭ ॥

অবিভক্তম্—অবিভক্ত; চ—ও; ভূতেষু — সর্বভূতে; বিভক্তম্ — বিভক্ত; ইব—মতো; চ—ও; স্থিতম্—অবস্থিত; ভূতভর্তৃ—সর্বভূতের পালক; চ–ও; তৎ—তা; জ্ঞেয়ম্ – জানবে, এসিষ্ণু—গ্রাসকারী, প্রভবিষ্ণু—প্রভুত্বকারী, চ—ও।

গীতার গান

অবিভক্ত হইয়াও বিভক্তের মত।

অখণ্ড সমষ্টি তিনি ব্যষ্টিরূপে স্থিত ।।

সর্বভূত ভর্তা তিনি সব জন্মদাতা ৷

তিনিই সবার পুনঃ সংহারের কর্তা ৷।

অনুবাদঃ পরমাত্মাকে যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবুও তাঁকে সংহার কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।

তাৎপর্যঃ পরমাত্মা রূপে ভগবান সকলেরই হৃদয়ে বিরাজমান। তা হলে তার অর্থ কি তিনি বিভক্ত হয়েছেন? না। প্রকৃতপক্ষে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। এই প্রসঙ্গে সূর্যের উদাহরণ দেওয়া হয় — মধ্যাহ্নকালীন সূর্য তার কক্ষপথে অবস্থিত থাকে। কিন্তু কেউ যদি পাঁচ হাজার মাইল পরিধি জুড়ে সকলকে জিজ্ঞেস করেন, “সূর্য কোথায় ?” তা হলে সকলেই বলবে যে, তার মাথার উপর জ্বল জ্বল করছে। বৈদিক শাস্ত্রে এই উদাহরণটির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, যদিও তিনি অবিভক্ত, তবুও মনে হয় যেন তিনি বিভক্তের মতো। বৈদিক শাস্ত্রে এই রকমও বলা হয়েছে যে, এক বিষ্ণু তাঁর অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে সর্বত্রই বিরাজমান, ঠিক যেমন সূর্য অনেক জায়গায় অনেকের কাছে প্রতিভাত হয়। তার পরমেশ্বর ভগবান যদিও সমস্ত জীবের পালনকর্তা, প্রলয়কালে তিনি সব কিছু গ্রাস করেন। সেই কথা একাদশ অধ্যায়ে প্রতিপন্ন করা হয়েছে, যখন ভগবান বলেছেন যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সমবেত সমস্ত যোদ্ধাদের গ্রাস করবার জন্য তিনি এসেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, কালরূপেও তিনি গ্রাস করেন। তিনি বিনাশকর্তা—সকলকে তিনি ধ্বংস করেন। সৃষ্টির সময় তিনি সব কিছুই তাদের আদি অবস্থা থেকে বিকাশ সাধন করেন এবং বিনাশের সময় তিনি তাদের গ্রাস করেন। বৈদিক শ্লোকে সেই সত্যকে প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে যে, তিনি সমস্ত জীবের উৎস এবং আশ্রয়। সৃষ্টির পরে সব কিছুই তাঁর সর্ব শক্তিমত্তাকে আশ্রয় করে স্থিত হয় এবং বিনাশের পরে সব কিছুই আবার তাঁর মধ্যে আশ্রয় নিতে তাঁর কাছে ফিরে যায়। সেই সম্বন্ধে বেদে বলা হয়েছে— যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে যেন জাতানি জীবন্তি যৎ প্রযতাভিসংবিশন্তি তদ্‌ ব্রহ্ম তদ বিজিজ্ঞাসস্ব। ( তৈত্তিরীয় উপনিষদ ৩/১)।

শ্লোকঃ ১৮

জ্যোতিষামপি তজ্জ্যোতিস্তমসঃ পরমুচ্যতে ।

জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্বস্য বিষ্ঠিতম্ ॥ ১৮ ॥

জ্যোতিষাম্—সমস্ত জ্যোতিষ্কের; অপি – ৩; তৎ—তা, জ্যোতিঃ – জ্যোতি; তমসঃ — অন্ধকারের, পরম্—অতীত; উচ্যতে বলা হয়; জ্ঞানম্—জ্ঞান; জ্ঞেয়ম্—জ্ঞেয়; জ্ঞানগম্যম—জ্ঞানগমা; হৃদি — হৃদয়ে; সর্বসা— সকলের; বিষ্ঠিত — অবস্থিত।

গীতার গান

সমস্ত জ্যোতির তিনি পরম আধার ।

চিন্ময় তাঁহার জ্যোতি জড় পর আর ।।

জ্ঞানময় রূপ তাঁর জ্ঞানগম্য জ্ঞেয় ।

সকলের হৃদিমাঝে তিনি অধিষ্ঠেয় ৷।

অনুবাদঃ তিনি সমস্ত জ্যোতিষ্কের পরম জ্যোতি। তাঁকে সমস্ত অন্ধকারের অতীত অব্যক্ত স্বরূপ বলা হয়। তিনিই জ্ঞান, তিনিই জ্ঞেয় এবং তিনিই জ্ঞানগম্য। তিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থিত।

তাৎপর্যঃ পরমাত্মা বা পরম পুরুষ ভগবান হচ্ছেন সূর্য, চন্দ, নক্ষত্র আদি সমস্ত জ্যোতিষ্কের জ্যোতির উৎস। বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, চিৎ-জাতকে আলোকিত করার জন্য সূর্য অথবা চন্দ্রের প্রয়োজন হয় না, কারণ সেই জগৎ পরমেশ্বরের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত। জড়া প্রকৃতিতে সেই ব্রহ্মজ্যোতি বা ভগবানের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটা জড়া প্রকৃতির মহৎ-তত্ত্বের দ্বারা আচ্ছাদিত। তাই, এই জড় জগৎকে আলোকিত করবার জন্য সূর্য, চন্দ্র ও বৈদ্যুতিক শক্তি আদির প্রয়োজন হয়। কিন্তু চিৎ-জগতে তাদের কোন প্রয়োজন হয় না। বৈদিক শাস্ত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর জ্যোতিটায় সব কিছুই উদ্ভাসিত। তাই এটি স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, তিনি জড় জগতে অবস্থান করেন না। তিনি অবস্থান। করেন চিৎ-জগতে, যা এই জগৎ থেকে অনেক অনেক দূরে চিদাকাশে অবস্থিত। বৈদিক শাস্ত্রে সেই সম্বন্ধে বলা হয়েছে, আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/৮)। তিনি সূর্যের মতো নিত্য জ্যোতির্ময়, কিন্তু তিনি এই তমসাচ্ছন্ন জড় জগৎ থেকে বহু বহু দূরে রয়েছেন।

তাঁর জ্ঞান দিবা। বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, ঘনীভূত দিব্যজ্ঞান হচ্ছে ব্রহ্মা। যিনি চিৎ-জগতে ফিরে যেতে আগ্রহী, তাঁকে সকলের হৃদরে বিরাজমান পরমেশ্বর ভগবান দিব্যজ্ঞান দান করেন। একটি বৈদিক মন্ত্রে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬ /১৮) বলা হচ্ছে—তং হ দেবমাত্মবুদ্ধিপ্রকাশং মুমুক্ষুর্বে শরণমহং প্রপদ্যে। কেউ যদি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করে, তা হলে তাকে অবশ্যই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। পরম জ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য সম্বন্ধেও বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে— তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি। “কেবলমাত্র তাঁকে জানার ফলেই মানুষ জন্ম-মৃত্যুর সীমানা অতিক্রম করতে পারে।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/৮) পরম নিয়ন্ত্ররূপে ভগবান সকলের হৃদয়ে অবস্থান করছেন। তাঁর হাত, পা সর্বত্রই রয়েছে, কিন্তু জীবাত্মা সম্বন্ধে সেই কথা বলা যায় না। সুতরাং ক্ষেত্রজ্ঞ দুজন—জীবাত্মা ও পরমাত্মা এবং সেই কথা স্বীকার করতেই হবে। জীবাত্মার হাত, পা কোন নির্দিষ্ট স্থানে রয়েছে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের হাত, পা সর্বত্রই রয়েছে। সেই সম্বন্ধে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৩/১৭) বলা হয়েছে— সর্বস্য প্রভুমীশানং সর্বসা শরণং বৃহৎ। সেই পরম পুরুষোত্তম ভগবান বা পরমাত্মা হচ্ছেন সর্ব জীবের প্রভু, তাই তিনি হচ্ছেন সমস্ত জীবের পরম আশ্রয়। সুতরাং পরমাত্মা ও জীবাত্মা যে সর্ব অবস্থাতেই ভিন্ন, সেই কথা কোন মতেই অস্বীকার করা যায় না।

error: Content is protected !!