শ্লোকঃ ১৩
জ্ঞেয়ং যত্তৎপ্রবক্ষ্যামি যজজ্ঞাত্মামৃতমশ্নুতে ৷
অনাদি মৎপরং ব্রহ্ম ন সত্তন্নাসদুচ্যতে ॥ ১৩॥
জ্ঞেয়ম্—জ্ঞাতব্য বিষয়; যৎ – যা, তৎ–তা, প্রবক্ষ্যামি — আমি এখন বলব; যৎ- যা; জ্ঞাত্মা— জোনে; অমৃতম্—অমৃত, অণুতে লাভ হয়; অনাদি – আদিহীন; মৎপরম্—আমার আশ্রিত; ব্রহ্ম — ব্রহ্ম; ন–নয়; সৎকারণ; তৎ- তা ন অসং—কার্য, উচ্যতে—বলা হয়।
গীতার গান
জ্ঞানের জ্ঞাতব্য যাহা তাহা বলি শুন ।
জানিতে সে তত্ত্ব হবে অমৃতের পান ।।
সেই ব্ৰহ্মতত্ত্বজ্ঞান আমার আশ্রিত ।
অনাদি সে সৎ আর অসৎ অতীত ।।
অনুবাদঃ আমি এখন জ্ঞাতব্য বিষয় সম্বন্ধে বলব, যা জেনে অমৃতত্ব লাভ হয়। সেই জ্ঞেয় বস্তু অনাদি এবং আমার আশ্রিত। তাকে বলা হয় ব্রহ্ম এবং তা কার্য ও কারণের অতীত।
তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবান ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি ক্ষেত্রজ্ঞকে জানবার পন্থাও ব্যাখ্যা করেছেন। এখন এখানে তিনি জ্ঞাতব্য বিষয় আত্মা ও পরমাত্মা উভয়ের সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছেন। আত্মা ও পরমাত্মা এই উভয় ক্ষেত্রজ্ঞ সম্বন্ধে জানবার মাধ্যমেই জীবনে অমৃতের আস্বাদন করা যায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, জীব নিত্য। এখানেও সেই তত্ত্ব প্রতিপন্ন করা হয়েছে। জীবের জন্ম তারিখ খুঁজে পাওয়া যায় না। পরমেশ্বর ভগবানের থেকে কিভাবে জীবাত্মার প্রকাশ হল, তারও কোন ইতিহাস নেই। তাই তা অনাদি। বৈদিক শাস্ত্রে তার সত্যতা প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে—ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিৎ (কঠ উপনিষদ ১/২/১৮) । দেহের জ্ঞাতার কখনও জন্ম হয় না, কখনও মৃত্যুও হয় না এবং সে পূর্ণ জ্ঞানময়।
পরমাত্মা রূপে পরমেশ্বর ভগবান সম্বন্ধেও বৈদিক শাস্ত্রে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/১৬) বলা হয়েছে, প্রধানক্ষেত্রগতিগুণেশঃ—প্রধান ক্ষেত্রজ্ঞ এবং জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের নিয়ত্তা। স্মৃতি শাস্ত্রে বলা হয়েছে— দাসভূতো হরেরের নান্যস্যৈব কদাচন। জীব নিত্যকাল ধরে পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করে চলেছে। সেই কথা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও তাঁর উপদেশাবলীতে প্রতিপন্ন করেছেন। তাই এই শ্লোকে যে ব্রহ্মের উল্লেখ করা হয়েছে, তা জীবাত্মা সম্বন্ধীয়। জীবাত্মাকে যখন ব্রহ্মা বলে উল্লেখ করা হয়, তখন বুঝতে হবে যে, তা হচ্ছে বিজ্ঞান ব্রহ্ম, যার বিপরীত হচ্ছে আনন্দ ব্রহ্মা। আনন্দ রক্ষা হচ্ছেন পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর ভগবান।
শ্লোকঃ ১৪
সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখম্ ।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি ৷৷ ১৪ ৷৷
সর্বতঃ— সর্বত্র; পাণি – হস্ত; পাদম্পদ; তৎ- তা সর্বতঃ — সর্বত্র; অক্ষি——চক্ষু; শিরঃ—মন্ত্রক, মুখম্ —মুখ, সর্বতঃ— সর্বত্র, শ্রুতিমৎ— কর্ণবিশিষ্ট, লোকে — জগতে সর্বম্—সব কিছু: আতা — পরিব্যাপ্ত করে; তিষ্ঠতি—স্থিত আছেন।
গীতার গান
সর্বস্থানে হস্তপদ নহে নিরাকার ।
সর্বস্থানে চক্ষু শির কত মুখ তার ।।
সর্বত্র শ্রবণ সর্ব আবরণ স্থান ।
তিনি ছাড়া ত্রিভুবনে নাহি কিছু আন ৷।
অনুবাদঃ তাঁর হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ সর্বত্রই এবং তিনি সর্বত্রই কর্ণযুক্ত। জগতে সব কিছুকেই পরিব্যাপ্ত করে তিনি বিরাজমান ।
তাৎপর্যঃ সূর্য যেমন অনন্ত কিরণ বিকিরণ করে বিরাজমান, পরমাত্মা বা পরমেশ্বর ভগবানও তেমনই তাঁর সর্বব্যাপ্ত রূপে বিরাজমান। ব্রহ্মা থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র পিপীলিকা পর্যন্ত সমস্ত জীবই তাঁকে আশ্রয় করে আছে। তাঁর সেই সর্বব্যাপী রূপের মধ্যে অসংখ্য মস্তক, পদ, হস্ত, চক্ষু এবং অসংখ্য জীবাত্মা রয়েছে। সবই পরমাত্মার মধ্যে ও উপরে বিরাজ করছে। তাই পরমাত্মা সর্বব্যাপ্ত। কিন্তু জীবাত্মা কখনও বলতে পারে না যে, তার হাত, পা, চোখ আদি সর্বব্যাপ্ত। তা কখনও সম্ভব নয়। যদি সে তা মনে করেও, তার অজ্ঞানতার ফলে সে এখন বুঝতে পারছে না যে, তার হস্ত পদ সর্বব্যাপ্ত। কিন্তু যখন সে যথার্থ জ্ঞান লাভ করবে, তখন অনুভব করতে পারবে যে, তার এই চিন্তাধারা পরস্পর-বিরোধী। তার অর্থ হচ্ছে যে, জড়া প্রকৃতির দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ার ফলে জীব পরম সত্তা নয়। পরমেশ্বর জীবাত্মা থেকে ভিন্ন। পরমেশ্বর ভগবান সীমা ছাড়িয়ে তাঁর হাত বর্ধিত করতে পারেন, কিন্তু জীবাত্মা তা পারে না। ভগবদ্গীতায় ভগবান বলছেন যে, যদি কেউ তাঁকে ফুল, ফল অথবা জল নিবেদন করেন, তা হলে তিনি তা গ্রহণ করেন। ভগবান যদি দূরে থাকেন, তা হলে কি করে তিনি তা গ্রহণ করেন। সেটিই হচ্ছে ভগবানের সর্বশক্তিমত্তা—এমন কি যদিও তিনি এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে তাঁর নিজ ধামে রয়েছেন, তবুও তিনি তাঁর হস্ত প্রসারিত করে তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত নৈবেদ্য গ্রহণ করতে পারেন। এমনই হচ্ছে তার অচিন্তা শক্তি। ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৭) বলা হয়েছে, গোলোক এর নিবসত্তাধিনাত্মভূতঃ— যদিও তিনি সর্বদাই তাঁর চিন্ময় ধাম গোলোক বৃন্দাবনে অপ্রাকৃত লীলা বিলাস করছেন, তবুও তিনি সর্বত্রই বিরাজমান। জীবাত্মা কখনই দাবি করতে পারে না যে, সে সর্বত্রই বিরাজমান। তাই এই শ্লোকে বর্ণনা করা হচ্ছে যে, পরমাত্মা পরমেশ্বর ভগবান জীবাত্মা নন।
শ্লোকঃ ১৫
সর্বেপ্রিয়গুলাজানং সর্বেপ্রিয়বিবর্জিত ।
অসক্তং সর্বভুচৈব নির্গুণং গুণভোক্ত চ ॥ ১৫ ॥
সর্ব-সমস্ত ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয়ের গুণ গুণের; আভাসম্—প্রকাশক: সর্ব— সমস্ত ইন্দ্রিয়—ইন্দ্রিয়; বিবর্জিতম্ — রহিত; অসক্তম্ — আসত্তি রহিত; সর্বভূৎ—সকলের পালক; চ—ও; এর—অবশ্যই নির্গুণম্—দড় গুণরহিত, গুণভোত্ত্ব — সমস্ত গুণের ঈশ্বর; চ—ও।
গীতার গান
তাঁহা হতে ইন্দ্রিয়াদি হয়েছে প্রকাশ ।
জড়েন্দ্রিয় নাহি তাঁর সর্বগুণাভাস ॥
অনাসক্ত সর্বভূৎ তিনি সে নির্গুণ ৷
সকল গুণের ভোক্তা তিনি চিরন্তন ॥
অনুবাদঃ সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক, তবুও তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত। যদিও তিনি সকলের পালক, তবুও তিনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত। তিনি প্রকৃতির গুণের অতীত, তবুও তিনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।
তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবান যদিও সমস্ত জীবের সমস্ত ইন্দ্রিয়ের আধার, কিন্তু তা বলে তাদের মতো জড় ইন্দ্রিয় তাঁর নেই। প্রকৃতপক্ষে, জীবাত্মারও চিন্ময় ইন্দ্রিয় আছে, কিন্তু বদ্ধ অবস্থায় তারা জড় গুণের দ্বারা আচ্ছাদিত। তাই, জড়ের মাধ্যমে চেতন ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ প্রকাশ হতে দেখা যায়। পরমেশ্বর ভগবানের ইন্দ্রিয়গুলি এই রকম আচ্ছাদিত নয়। তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি অপ্রাকৃত এবং তাই তাদের বলা হয় নির্গুণ। গুণ হচ্ছে প্রকৃতির বৃত্তি, কিন্তু ভগবানের ইন্দ্রিয়গুলি জড় আবরণ থেকে মুক্ত। আমাদের হৃদয়ঙ্গম করতে হবে যে, তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি ঠিক আমাদের মতো নয়। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়জাত কর্মের উৎস যদিও তিনি, কিন্তু তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি দিব্য ও কলুষমুক্ত। সেই কথা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৩/১৯) অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা— এই শ্লোকে খুব সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। পরমেশ্বর ভগবানের জড়-জাগতিক কলুষযুক্ত কোন হাত নেই, কিন্তু তবুও তাঁর হাত আছে এবং সেই হাত দিয়ে তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত সমস্ত নৈবেদ্য গ্রহণ করেন। এটিই হচ্ছে বদ্ধ জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে পার্থক্য। ভগবানের জড় চক্ষু নেই, কিন্তু তাঁর চক্ষু আছে—তা না হলে তিনি দেখতে পান কি করে? তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—সব কিছু দেখতে পান। তিনি সমস্ত জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন এবং অতীতে আমরা কি করেছি, এখন আমরা কি করছি এবং আমাদের ভবিষ্যতে কি হবে, তা সবই তিনি জানেন। ভগবদ্গীতাতেও সেই কথা প্রতিপন্ন হয়েছে— তিনি সব কিছু জানেন, কিন্তু তাঁকে কেউ জানে না। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, ভগবানের আমাদের মতো পা নেই, কিন্তু তিনি সর্বত্র মহাশূন্যে বিচরণ করতে পারেন, কারণ তাঁর পা অপ্রাকৃত। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, ভগবান নির্বিশেষ নন, নিরাকার নন, ব্যক্তিত্বহীন নন। তাঁর চোখ আছে, পা আছে, হাত আছে এবং সব কিছুই আছে। যেহেতু আমরা ভগবানের বিভিন্নাংশ, তাই আমরাও এই সমস্ত অঙ্গগুলি অর্জন করেছি। কিন্তু তাঁর হাত, পা, চোখ ও ইন্দ্রিয়গুলি কখনই জড়া প্রকৃতির দ্বারা কলুষিত হয় না।
ভগবদ্গীতায় আরও বলা হয়েছে যে, যখন পরমেশ্বর ভগবান এই জড় জগতে অবতরণ করেন, তখন তিনি তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির প্রভাবে তাঁর স্বরূপে আবির্ভূত হন। তিনি কখনই জড়া প্রকৃতির দ্বারা কলুষিত হন না, কারণ তিনি হচ্ছেন জড়া প্রকৃতির অধীশ্বর। বৈদিক শাস্ত্রে আমরা জানতে পারি যে, তাঁর সমগ্র সত্তা চিন্ময়। তাঁর রূপ নিত্য — তিনি সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ। তিনি পূর্ণ ঐশ্বর্যময়। তিনি হচ্ছেন সমস্ত সম্পদের মালিক এবং সমস্ত শক্তির অধীশ্বর। তিনি সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং পূর্ণ জ্ঞানময়। এগুলি হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কয়েকটি লক্ষণ। তিনি সমস্ত জীবের পালনকর্তা এবং তাদের সমস্ত কর্মের সাক্ষী। বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, পরমেশ্বর ভগবান সর্বদাই জড়াতীত। আমরা যদিও তাঁর মস্তক, মুখমণ্ডল, হস্ত অথবা পদ দেখতে পাই না, তবুও তার এগুলি আছে এবং আমরা যখন চিন্ময় স্তরে উন্নীত হই, তখন আমরা ভগবানের রূপ দর্শন করতে পারি। জড় জগতের সংস্পর্শে আসার ফলে যেহেতু আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি কলুষিত হয়ে পড়েছে, তাই আমরা তাঁর রূপ দেখতে পাই না। সেই জন্য নির্বিশেষবাদীরা, যারা এখনও জড় গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রয়েছে, তারা পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে পারে না।