শ্লোকঃ ৫
ঋষিভির্বহুধা গীতং ছন্দোভিবিবিধৈঃ পৃথক্ ।
ব্রহ্মসূত্রপদৈশ্চৈব হেতুমদ্ভিবিনিশ্চিতৈঃ ॥ ৫॥
ঋষিভিঃ — ঋষিগণ কর্তৃক; বহুধা—বহু প্রকারে; গীতম্—বর্ণিত হয়েছে; ছন্দোভিঃ — বৈদিক ছন্দের দ্বারা, বিবিধেঃ — বিধি; পৃথক্ – পৃথকভাবে; ব্রহ্মসূত্র – বেদান্তের গদৈঃ—সূত্রের দ্বারা; চ–ও; এব – অনশাই হেতুমণ্ডিঃ — যুক্তিযুক্ত; বিনিশ্চিতৈঃ — নিশ্চিতভাবে।
গীতার গান
দার্শনিক ঋষি কত করেছে বিচার ।
স্মৃতি ছন্দে কত বলে নাহি তার পার ।।
কিন্তু বেদান্ত বাক্যে যুক্তির সহিত ।
যে বিচার করিয়াছে লাগি লোকহিত ।।
সেই সে বিচার জান সুসিদ্ধান্ত মত ।
সকলের গ্রহণীয় ছাড়ি অন্য পথ ।।
অনুবাদঃ এই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের জ্ঞান ঋষিগণ কর্তৃক বিবিধ বেদবাক্যের দ্বারা পৃথক পৃথকভাবে বর্ণিত হয়েছে। বেদান্তসূত্রে তা বিশেষভাবে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত সহকারে বর্ণিত হয়েছে।
তাৎপর্যঃ এই তত্ত্বজ্ঞান বিশ্লেষণ করার ব্যাপারে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তবুও চিরাচরিত প্রথা অনুসারে, পণ্ডিত ও আচার্যেরা সর্বদাই পূর্বতন আচার্যদের নজির দিয়ে থাকেন। আত্মা ও পরমাত্মা সম্পর্কে অত্যন্ত বিতর্কমূলক দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য গ্রন্থ বেদান্ত শাস্ত্রের উল্লেখ করেছেন। প্রথমে তিনি বিভিন্ন ঋষিদের মতের উল্লেখ করেছেন। সমস্ত ঋষিদের মধ্যে বেদান্ত-সূত্রের প্রণেতা ব্যাসদেব হচ্ছেন মহর্ষি এবং বেদান্ত-সুত্রে দ্বৈতবাদকে পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনিও ছিলেন একজন মহর্ষি এবং তাঁর প্রণীত ধর্মশাস্ত্রে তিনি লিখেছেন, অহং তং চ তথানো….”আমরা, আপনি, আমি এবং অন্য সমস্ত জীব— জড় দেহে থাকলেও জড়াতীত। এখন আমরা আমাদের বিভিন্ন কর্ম অনুসারে জড় জগতের তিনটি গুণের মধ্যে পতিত হয়েছি। তার ফলে, কেউ উচ্চ স্তরে আছে, আবার কেউ নিম্ন স্তরে। অজ্ঞানতার ফলে উচ্চ ও নিম্ন প্রকৃতি বিদ্যমান হয় এবং অগণিত জীবের মধ্যে তা প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু পরমাত্মা, যিনি অচ্যুত, তিনি কখনই তিন গুণের দ্বারা কলুষিত হন না এবং তিনি হচ্ছেন গুণাতীত।” তেমনই, আদি বেদে, বিশেষ করে কন্ঠ উপনিষদে আত্মা, পরমাত্মা ও দেহের পার্থক্য নিরূপণ করা হয়েছে। বহু মুনি-ঋষি এর ব্যাখ্যা করেছেন এবং পরাশর মুনিকে তাঁদের মধ্যে প্রধান বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।
ছন্দোভিঃ শব্দটির দ্বারা বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্রাদিকে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, যজুর্বেদের একটি শাখা তৈত্তিরীয় উপনিষদে প্রকৃতি, জীবসত্তা ও পরম পুরুষোত্তম ভগবানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, ক্ষেত্র বলতে বোঝায় কর্মের ক্ষেত্র এবং দুই ধরনের ক্ষেত্রজ্ঞ আছেন—স্বতন্ত্র জীবাত্মা ও পরম আত্মা। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (২/৯) বলা হয়েছে—ব্রহ্ম পুচ্ছ প্রতিষ্ঠা। পরমেশ্বর ভগবানের ‘অন্নময়’ নামে একটি শক্তির প্রকাশ হয়, যার ফলে জীব তার জীবন ধারণের জন্য অন্নের উপর নির্ভর করে। এটি পরমেশ্বর সম্বন্ধে একটি জড় উপলব্ধি। তারপর ‘প্রাণময়’, অর্থাৎ ভান্নের মধ্যে পরমেশ্বরকে উপলব্ধি করার পর প্রাণের লক্ষণের মধ্যে তাকে উপলব্ধি করা। প্রাণময় লক্ষণের অতীত ‘জ্ঞানময়’ উপলব্ধি চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তারপর ব্রহ্ম-উপলব্ধিকে বলা হয় ‘বিজ্ঞানময়, যার ফলে জীবের মন ও প্রাণের লক্ষণগুলি থেকে জীবকে স্বতন্ত্র বলে উপলব্ধি করা যায়। তার পরে পরম স্তর হচ্ছে ‘আনন্দময়’ অর্থাৎ সর্ব আনন্দময় প্রকৃতির উপলব্ধি। ব্রহ্ম- উপলব্ধির এই পাঁচটি স্তর আছে, যাকে বলা হয় ব্রহ্ম পুচ্ছম্। এর মধ্যে প্রথম তিনটি—অন্নময়, প্রাণময় ও জ্ঞানময় জীবের কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই সমস্ত কর্মক্ষেত্রের ঊর্ধ্বে হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, যাঁকে বলা হয় ‘আনন্দময়’। বেদান্ত- সূত্রেও পরমেশ্বর ভগবানকে বলা হয়েছে আনন্দময়োহভ্যাসাৎপরমেশ্বর ভগবান স্বভাবতই আনন্দময়। তাঁর সেই দিব্য আনন্দ উপভোগ করার জন্য তিনি নিজে বিজ্ঞানময়, প্রাণময়, জ্ঞানময় ও অন্নময়রূপে প্রকাশিত হন। কর্ম করবার এই ক্ষেত্রে জীবকে ভোক্তা বলে মনে করা হয় এবং আনন্দময় তার থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ, জীব যদি আনন্দময়ের সেবায় ব্রতী হয়ে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আনন্দ লাভের প্রয়াসী হয়, তা হলেই তাঁর অস্তিত্ব সার্থক হয়। পরম ক্ষেত্রজ্ঞরূপে, জীবের অধস্তন ক্ষেত্রজ্ঞরূপে এবং কর্মক্ষেত্রের প্রকৃতিরূপে পরমেশ্বর ভগবানের এই হচ্ছে প্রকৃত আলেখা। এই তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করার জন্য বেদান্তসূত্র কিংবা ব্রহ্মসূত্রের অভান্তরে প্রবেশ করতে হয়।
এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্রহ্মাসূত্রের অনুশাসনগুলি কার্য-কারণ অনুসারে অতি সুচারুভাবে সাজানো আছে। কতকগুলি সূত্র হচ্ছে—ন বিষদ্ অশ্রুতেঃ (২/৩/২), নাত্মা শ্রুতেঃ (২/৩/১৮) এবং পরাৎ তু ততেঃ (২/৩/৪০) । প্রথম সূত্রটিতে কর্মক্ষেত্রের কথা বলা হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে জীবসত্তার কথা বলা হয়েছে এবং তৃতীয়টিতে বিবিধ সভার সকল প্রকার অভিপ্রকাশের আশ্রয় পরমেশ্বর ভগবানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্লোকঃ ৬-৭
মহাভূতান্যহঙ্কারো বুদ্ধিরব্যক্তমেব চ।
ইন্দ্রিয়াণি দশৈকং চ পঞ্চ চেন্দ্রিয়গোচরাঃ ।। ৬ ।।
ইচ্ছা দ্বেষঃ সুখং দুঃখং সংঘাতশ্চেতনা ধৃতিঃ ।
এতৎ ক্ষেত্রং সমাসেন সবিকারমুদাহৃতম্ ॥ ৭॥
মহাভূতানি—মহাভূতসমূহ; অহঙ্কারঃ — অহঙ্কার; বুদ্ধিঃ—বুদ্ধি; অব্যক্তম্—অব্যক্ত; এর—অবশ্যই, চ—ও; ইন্দ্রিয়াণি — ইন্দ্রিয়সমূহ, দশৈকম্ — একাদশ, চ—ও; পঞ্চ — পাঁচ; চ—ও; ‘ইন্দ্রিয়গোচরাঃ — ইন্দ্রিয়ের বিষয়; ইচ্ছা— ইচ্ছা ; দ্বেষঃ– দ্বেষ, সুখম্ সুখ, দুঃখম্ — দুঃখ; সংঘাতঃ — সমষ্টি; চেতনা— চেতনা, ধৃতিঃ – ধৈর্য, এতৎ—এই সমস্ত, ক্ষেত্র—ক্ষেত্র; সমাসেন – সংক্ষেপে সবিকার — বিকারযুক্ত; উদাহৃতম্ — বর্ণিত হল।
গীতার গান
ক্ষিতি, অপ, তেজ, বায়ু, ব্যোম মহাভূত।
অহঙ্কার, বুদ্ধি আর মন অব্যক্ত সম্ভূত ।।
চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক যাহা জানি ।
পায়ু, পাদ, পেট, লিঙ্গ আর যাহা পাণি ৷।
সেই দশ বাহ্য—আর মন সে অন্তরে ।
একাদশ ইন্দ্রিয় সে শাস্ত্রের বিচারে ।।
রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ যে বিষয় ।
চব্বিশ সে তত্ত্ব বুঝ ক্ষেত্র পরিচয় ।।
ইহাদের যে বিচার করে বিশ্লেষণে ।
ক্ষেত্রতত্ত্ব সেই বিজ্ঞ ভালরূপ জানে ।।
ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ আর যে সঙ্ঘাত ।
স্থূল দেহ পরিমাণ পঞ্চ মহাভূত ।।
চেতনা শক্তি যে হয় জীবের আধার ৷
তার সঙ্গে ধৃতি জান ক্ষেত্রের বিকার ।।
অতএব এই সব একত্রে সে ক্ষেত্র ।
স্কুল সূক্ষ্ম জড় বিদ্যা সেই যে সৰ্বত্ৰ ।।
অনুবাদঃ পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি, অন্যক্ত, দশ ইন্দ্রিয় ও মন, ইন্দ্রিয়ের পাঁচটি বিষয়, ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত অর্থাৎ পঞ্চ মহাভূতের পরিণামরূপ দেহ, চেতনা ও ধৃতি—এই সমস্ত বিকারযুক্ত ক্ষেত্র সংক্ষেপে বর্ণিত হল।
তাৎপর্যঃ মহর্ষিদের প্রামাণ্য বাক্য, বৈদিক ছন্দ ও বেদান্তসূত্র থেকে এই জগতের মৌলিক উপাদানগুলি জানতে পারা যায়। প্রথমে মৃত্তিকা, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ। এদের বলা হয় পঞ্চমহাভূত। তা ছাড়া আছে অহঙ্কার, বুদ্ধি ও প্রধান (অব্যক্ত অবস্থায় প্রকৃতির তিনটি গুণ)। তারপর আছে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। তারপর পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়—বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ। তারপর ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে আছে মন, যাকে অস্তরিন্দ্রিয় বলা যেতে পারে। সুতরাং, মনকে নিয়ে ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা হচ্ছে একাদশ। তারপর আছে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের বিষয় বা তন্মাত্র — রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শ। এই চব্বিশটি তত্বকে সমষ্টিগতভাবে বলা হয় কর্মক্ষেত্র। কেউ যদি এই চব্বিশটি বিষয়ের বিশদ বিশ্লেষণ করেন, তা হলে তিনি কর্মক্ষেত্র সম্বন্ধে খুব ভালভাবে বুঝতে পারবেন। তারপর আছে ইচ্ছা, দেখ, সুখ ও দুঃখ, যা হচ্ছে স্থূল দেহের অন্তর্গত পঞ্চ-মহাভূতের পারস্পরিক ক্রিয়া বা অভিব্যক্তি। জীবনের লক্ষণ চেতনা ও ধৃতি হচ্ছে মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার দ্বারা গঠিত সূক্ষ্মদেহের প্রকাশ। এই সূক্ষ্ম উপাদানগুলিও কর্মক্ষেত্রের অন্তর্গত।
পঞ্চ-মহাভূতগুলি হচ্ছে অহঙ্কারের স্কুল অভিবাতি। সেগুলিই আবার অহঙ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে ‘তামস-বুদ্ধি’ অর্থাৎ বুদ্ধিরূপী অজ্ঞানতার জড়-জাগতিক অভিব্যক্তিরূপে পরিগণিত হয়। এটি আবার জড়া প্রকৃতির ত্রৈগুণ্যের অব্যক্ত তররূপে অভিব্যক্ত হয়। জড়া প্রকৃতির অব্যক্ত তিনটি গুণকে বলা হয় ‘প্রধান’।
যদি কেউ এই চব্বিশটি তত্ত্ব সম্বন্ধে এবং তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া সম্বন্ধে আরও বিশদভাবে জানতে চান, তা হলে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সাংখ্য-দর্শন অধ্যয়ন করা কর্তব্য। ভগবদ্গীতাতে কেবল তার সারাংশ উল্লেখ করা হয়েছে।
দেহ হচ্ছে এই সব কয়টি উপাদানের অভিব্যক্তি এবং দেহের পরিবর্তন হয়। দেহের এই পরিবর্তন ছয় রকমের দেহের জন্ম হয়, বৃদ্ধি হয়, স্থিতি হয়, বংশ বৃদ্ধি হয়, তারপর তার ক্ষয় হয় এবং অবশেষে তা বিনাশ প্রাপ্ত হয়। তাই ক্ষেত্র হচ্ছে অস্থায়ী জড় বস্তু, তবে ক্ষেত্রের মালিক ক্ষেত্রজ্ঞ হচ্ছেন ভিন্ন।
শ্লোকঃ ৮-১২
অমনিত্বমতম্ভিত্বমহিংসা ক্ষান্তরার্জবম।
আচার্যোপাসনং শৌচং স্থৈর্যমাত্মবিনিগ্রহঃ ।। ৮ ।।
ইন্দ্রিয়ার্থেষু বৈরাগ্যমনহঙ্কার এব চ ।
জন্মমৃত্যুজরাব্যাধিদুঃখদোষানুদর্শনম্ ॥ ৯॥
অসক্তিরনভিষুঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু ।
নিত্যং চ সমচিত্তত্বমিষ্টানিষ্টোপপত্তিষু ॥ ১০॥
ময়ি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী ।
বিবিক্তদেশসেবিত্বমরতির্জনসংসদি ॥ ১১॥
অধ্যাত্মজ্ঞাননিত্যত্বং তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম্ ।
এতজজ্ঞানমিতি প্রোক্তমজ্ঞানং যদতোহন্যথা ॥ ১২ ॥
অমানিত্বম্মানশূন্যতা; অদস্তিত্বম্ — দন্তহীনতা, অহিংসা – অহিংসা : কা:- সহিষ্ণুতা; আর্জনম্ — সরলতা, আচার্যোপাসনম্ – সদ্গুরুর সেবা, শৌচম্— শৌচ, স্থৈর্য—স্থৈর্য: আত্মবিনিগ্রহঃ – আত্মসংযম, ইন্দ্রিয়ার্থে — ইন্দ্রিয়-বিষয়ে: বৈরাগ্য-বিরক্তি; অনহঙ্কারঃ অহঙ্কারশূন্য; এব— অবশ্যই; চ—ও; জন্ম জন্ম; মৃত্যু—মৃত্যু, জরা—বার্ধক্য, ব্যাধি—ব্যাধি, দুঃখ–দুঃখের, দোষ – দোষ; অনুদর্শনম্——দর্শন; অসক্তিঃ — আসক্তি-রহিত; অনভিযুগঃ- অভিনিবেশ রহিত; পুত্র-পুত্র, দার—পত্নী, গৃহাদিষু — গৃহ আদিতে, নিত্যম্—সর্বদা; চ—ও; সমচিত্তত্বম্—সম ভাবাপন্ন: ইষ্ট—বাঞ্চিত; অনিষ্ট— অবাঞ্ছিত: উপপত্তিযু— লাভ করে; ময়ি—আমাতে; চণ্ড; অনন্যযোগেন — অনন্য নিষ্ঠা সহকারে, ভক্তিঃ- ভক্তি, অব্যভিচারিণী—অপ্রতিহতা; বিবিক্ত — নির্জন; দেশ— স্থান; সেবিত্বম্— প্রিয়তা; অরতিঃ—অরুচি; জনসংসদি— জনাকীর্ণ স্থানে, অধ্যাত্ম – অধ্যাত্ম; জ্ঞান — জ্ঞানে; নিত্যত্বম্—নিত্যতা, তত্ত্বজ্ঞান — তত্ত্বজ্ঞানের, অর্থ—প্রয়োজন; দর্শনম্- অনুসন্ধান; এতৎ—এই সমস্ত জ্ঞানম্—জ্ঞান; ইতি—এভাবে: প্রোক্তম্ — কথিত হয়; অজ্ঞানম্—অজ্ঞান; যৎ- যা; অতঃ–এর থেকে; অন্যথা — বিপরীত।
গীতার গান
অনাশিত্ব, অনাস্তিত্ব, অহিংসা যে ক্ষান্তি ।
সরলতা, গুরুসেবা, শৌচ, ধৈর্য, শান্তি ।।
আত্মার নিগ্রহ যাহা ইন্দ্রিয় বিষয়ে ।
বৈরাগ্য নিরহঙ্কার সকল আশয়ে ।।
জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি দুঃখের দর্শন ।
অনাসক্তি স্ত্রী পুত্রেতে গৃহের প্রাঙ্গণ ॥
উদাসীন পরিবারে সুখেতে দুঃখেতে ।
নিত্য সমচিত্ত ইষ্ট অনিষ্ট মধ্যেতে ।।
আমাতে অনন্যভক্তি অব্যভিচারিণী ।
নির্জন স্থানেতে বাস গ্রাম্য নিবারণী ।।
অধ্যাত্ম জ্ঞানের করে নিত্যত্ব স্বীকার ।
তত্ত্বজ্ঞান লাগি করে দর্শন বিচার ।।
সেই সে জ্ঞানের চর্চা বিকারে নাশ ।
অজ্ঞানতমের নাম অন্যথা প্রকাশ ।।
অনুবাদঃ অমানিত্ব, দন্তশূন্যতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতা, সরলতা, সদগুরুর সেবা, শৌচ, স্থৈর্য, আত্মসংযম, ইন্দ্রিয়-বিষয়ে বৈরাগ্য, অহঙ্কারশূন্যতা, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-দুঃখ আদির দোষ দর্শন, স্ত্রী-পুত্রাদিতে আসক্তিশূন্যতা, স্ত্রী-পুত্রাদির সুখ-দুঃখে ঔদাসীন্য, সর্বদা সমচিত্তত্ব, আমার প্রতি অনন্যা ও অব্যভিচারিণী ভক্তি, নির্জন স্থান প্রিয়তা, জনাকীর্ণ স্থানে অরুচি, অধ্যাত্ম জ্ঞানে নিত্যত্ববুদ্ধি এবং তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন অনুসন্ধান—এই সমস্ত জ্ঞান বলে কথিত হয় এবং এর বিপরীত যা কিছু তা সবই অজ্ঞান !
তাৎপর্যঃ যথার্থ জ্ঞান লাভের এই প্রক্রিয়াকে অনেক সময় অন্ন-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা ভ্রান্তিবশত ক্ষেত্রের মিথষ্ক্রিয়া বলে মনে করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটিই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান আহরণের পছা । এই পন্থা অবলম্বন করার মাধ্যমেই কেবল পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা সম্ভব হতে পারে। এটি চরিশটি মৌলিক তত্ত্বের পারস্পরিক ক্রিয়া নয়, যা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটি হচ্ছে ঐ উপাদানগুলির বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া। চরিশটি তত্ত্বের দ্বারা গঠিত একটি পিঞ্জরের মতো দেহের মধ্যে দেহধারী আত্মা আবদ্ধ হয়ে আছে এবং এখানে বর্ণিত জ্ঞান অর্জনের পন্থাই হচ্ছে এর থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায়। জ্ঞান লাভের যে সমস্ত পন্থা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি একাদশ শ্লোকের প্রথম ছত্রে বর্ণনা করা হয়েছে। ময়ি চাননাযোগেন ভক্তির ব্যভিচারিণী—এই জ্ঞান পরিণামে ভগবানের প্রতি অনন্য ভক্তিতে পর্যবসিত হয়। সুতরাং কেউ যদি ভগবানের প্রতি ভক্তি লাভ না করে, অথবা লাভ করার প্রয়াসী না হয়, তা হলে অন্য উনিশটি গুণের কোন মূল্য থাকে না। কিন্তু কেউ যদি সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করেন, তা হলে এই উনিশটি ভ্রুণ তাঁর মধ্যে আপনা থেকেই বিকশিত হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/১৮/১২) বলা হয়েছে, যস্যাক্তি ভক্তিভগবত্যকিঞ্চনা সর্বৈগুণৈস্তত্ব সমাসতে সুরাঃ। যিনি ভগবৎ-সেবার পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন, তাঁর মধ্যে জ্ঞানের সকল প্রকার সদ্গুণই বিকশিত হয়ে ওঠে। তত্ত্বজ্ঞানী গুরুদেবের আনুগত্য স্বীকার করে তাঁর সেবা করার যে নির্দেশ অষ্টম শ্লোকে দেওয়া হয়েছে, তা অতি গুরুত্বপূর্ণ। এমন কি যাঁরা ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করছেন, তাঁদের পক্ষেও এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সদগুরুর আনুগত্য স্বীকার করার মাধ্যমে পারমার্থিক জীবনের শুরু হয়। পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টভাবে এখানে বলছেন যে, জ্ঞানের এই পন্থা হচ্ছে যথার্থ পন্থা। এ ছাড়া যদি অন্য আর কোন পন্থা অনুমান করা হয়, তা হলে তা নিছক বাজে কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।
যে জ্ঞানের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে, তার বিষয়গুলি নিম্নলিখিতভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। অমানিত্বের অর্থ হচ্ছে যে, অপরের কাছ থেকে সম্মান লাভের আকাঙ্ক্ষা করে আত্মতৃপ্তির জন্য উদ্বিগ্ন না হওয়া। বৈষয়িক জীবনে আমরা অপরের কাছ থেকে মান-সম্মান পাওয়ার জন্য খুব আগ্রহী হই, কিন্তু যিনি পূর্ণজ্ঞান লাভ করেছেন, যিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, তাঁর জড় শরীরটি তাঁর স্বরূপ নয়, তাঁর কাছে জড় দেহগত সম্মান ও অসম্মান উভয়ই নিরর্থক। জড়-জাগতিক এই মোহের প্রতি লালায়িত হওয়া উচিত নয়। মানুষ তার ধর্মের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করতে অত্যন্ত আগ্রহী এবং পরিণামে অনেক সময় দেখা যায় যে, ধর্মের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত না হয়ে সে কোন দলভুক্ত হয়ে পড়ে এবং যথাযথভাবে ধর্মের নীতিগুলিকে অনুসরণ না করে, সে নিজেকে ধর্মের কর্ণধার বলে প্রচার করতে থাকে। পারমার্থিক তত্ত্বজ্ঞান লাভে কে কতটা উন্নতি সাধন করছে তা এই সমস্ত বিষয়গুলির মাধ্যমে বিচার করা উচিত।
অহিংসা কথাটির সাধারণ অর্থ হচ্ছে হত্যা না করা বা দেহ নষ্ট না করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অহিংসার অর্থ হচ্ছে অপরকে ক্লেশ না দেওয়া। অজ্ঞানতার প্রভাবে সাধারণ মানুষ জড়-জাগতিক জীবনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং তাই তারা নিরন্তর সংসার-দুঃখ ভোগ করছে। সুতরাং মানুষকে যদি পারমার্থিক জ্ঞানের স্তরে উন্নীত না করা হয়, তা হলে হিংসার আচরণ করা হয়। সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে মানুষকে যথাসাধ্য তত্ত্বজ্ঞান দান করা, যার ফলে তারা দিব্যজ্ঞান লাভ করে এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে। সেটিই হচ্ছে অহিংসা।
ক্ষান্তি বা সহনশীলতার অর্থ হচ্ছে অপরের কাছ থেকে অসম্মান অথবা অপমান সহ্য করার ক্ষমতা। কেউ যখন পারমার্থিক উন্নতি সাধনে ব্রতী হন, তখন অনেকেই তাঁকে নানাভাবে অপমান বা অসম্মান করে থাকে। সেটিই স্বাভাবিক, কারণ জড় জগতের ধরনটাই এমন। এমন কি প্রহ্লাদের মতো একটি শিশু, যিনি পাঁচ বছর বয়সে পরমার্থ সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন, তখন তাঁর বাবাই এই ভক্তির পথে সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং নানাভাবে তাঁর অনিষ্ট করবার চেষ্টা করেছিল, এমন কি নানাভাবে তাঁকে হত্যা করারও চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রহ্লাদ তার সমস্ত অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। সুতরাং, পারমার্থিক জীবনে অগ্রসর হতে হলে নানা রকম প্রতিবন্ধক আসতে পারে, কিন্তু সেগুলি সহ্য করতে হবে এবং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
সরলতার অর্থ হচ্ছে কূটনীতি না করে নিষ্কপট হওয়া, যাতে শত্রুর কাছেও যথার্থ সত্য খুলে বলা যায়। সেই জন্য গুরু গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন, কারণ সদ্গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ না করলে পারমার্থিক জীবনে অগ্রসর হওয়া যায় না। নম্রতা ও বিনয়ের সঙ্গে সদগুরুর সমীপবর্তী হতে হয় এবং সর্বতোভাবে তাঁর সেবা করতে হয়, যাতে তাঁর প্রসন্নতা সাধনের মাধ্যমে তাঁর আশীর্বাদ লাভ করা যায়। সদগুরু হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি। তিনি যদি তাঁর শিষ্যকে কৃপা করেন, তা হলে তাঁর শিষ্য সমস্ত শাস্ত্রবিধির অনুশীলন না করেই তৎক্ষণাৎ প্রভূত উন্নতি লাভ করতে পারেন। অথবা, যিনি নিষ্কপটে শ্রীগুরুদেবের সেবা করেছেন, পারমার্থিক বিধি-নিষেধগুলি তাঁর কাছে অত্যন্ত সরল হয়ে যাবে।
পারমার্থিক জীবনে উন্নতি লাভের জন্য শৌচ অত্যন্ত প্রয়োজন। শৌচ দুই রকমের—বাইরের ‘ও অন্তরের। বাহিরের গুচিতা হচ্ছে স্নান করা। কিন্তু অন্তরের শুচিতার জন্য সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করতে হবে এবং হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—.. — এই মহামন্ত্র কীর্তন করতে হবে। এই প্রক্রিয়া পূর্বকৃত কর্মের ফলে সঞ্চিত চিত্তের সমস্ত আবর্জনা পরিষ্কার করে দেয় ।
স্থৈর্য অর্থ হচ্ছে পারমার্থিক জীবনে উন্নতি সাধনে দৃঢ় সংকল্প হওয়া। এই ধরনের দৃঢ় সংকল্প ছাড়া যথার্থ উন্নতি সাধন করা সম্ভব নয়। আত্মবিনিগ্রহ মানে হচ্ছে পারমার্থিক উন্নতির পথে যা ক্ষতিকর তা গ্রহণ না করা। পারমার্থিক উন্নতি সাধনের পথে যা বিরোধী তা বর্জন করে, এগুলি গ্রহণ করার অভ্যাস করা উচিত। সেটিই হচ্ছে যথার্থ বৈরাগ্য। ইন্দ্রিয়গুলি এত প্রবল যে, তারা সর্বদাই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আকাঙ্ক্ষা করে। ইন্দ্রিয়ের এই সমস্ত নিরর্থক দাবিগুলি বরদাস্ত করা উচিত নয়, কারণ সেগুলি অনাবশ্যক। ইন্দ্রিয়গুলিকে কেবল ততটুকুই সুখ দেওয়া উচিত যার ফলে শরীর সুস্থ ও সবল থাকে এবং পারমার্থিক জীবনে উন্নতি সাধন করার জন্য কর্তব্যগুলি সম্পাদন করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্দমনীয় ইন্দ্রিয় হচ্ছে জিহ্বা। কেউ যদি জিহ্বাকে জয় করতে পারে, তা হলে অন্য ইন্দ্রিয়গুলি জয় করার পূর্ণ সম্ভাবনা থাকে। জিহ্বার কাজই হচ্ছে স্বাদ গ্রহণ করা এবং স্পন্দন করা। তাই, তাকে দমন করবার বিধি হচ্ছে সর্বদাই কৃষ্ণাসাদ গ্রহণ করা এবং হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করা। দর্শনেন্দ্রিয় চক্ষুকে জয় করার পন্থা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব সুন্দর রূপ ছাড়া তাকে আর কিছু দেখতে না দেওয়া। তার ফলে দর্শনেন্দ্রিয় চক্ষু সংযত হয়। তেমনই, কান দুটিকে সর্বদা কৃষ্ণকথা শ্রবণে এবং নাবকে শ্রীকৃষ্ণের চরণে অর্পিত ফুলের ঘ্রাণ গ্রহণে নিযুক্ত রাখতে হবে। এটিই হচ্ছে ভক্তিযোগের পন্থা এবং এখানে বুঝতে পারা যায় যে, ভগবদ্গীতা কেবল ভক্তিযোগের বিজ্ঞানকথা ঘোষণা করছে। ভক্তি হচ্ছে মুখ্য উদ্দেশ্য। ভগবদ্গীতার কিছু নির্বোধ ভাষ্যকারেরা ভগবদ্গীতার ভ্রান্ত ভাষ্য রচনা করে পাঠককে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভগবদ্গীতায় ভগবদ্ভক্তি ছাড়া আর কোন বিষয়েরই উল্লেখ করা হয়নি।
অহঙ্কারের অর্থ হচ্ছে জড় শরীরটিকে নিজের স্বরূপ বলে মনে করা। কেউ যখন বুঝতে পারেন যে, তাঁর স্বরূপে তিনি তার জড় শরীর নন, তার স্বরূপ হচ্ছে তাঁর আত্মা, সেটিই হচ্ছে যথার্থ তাহতার । অহঙ্কার থাকেই। মিথ্যা অহঙ্কার বর্জনীয়, কিন্তু যথার্থ অহঙ্কার বর্জনীয় নয়। বৈদিক শাস্ত্রে (বৃহদারণ্যক উপনিষদ (১/৪/১০) বলা হয়েছে, অহং ব্রহ্মাস্মি—আমি ব্রহ্ম, আমি আত্মা। এই ‘আমি’ হচ্ছে আত্মানুভূতি। এই আত্মানুভূতি আত্ম-উপলব্ধির মুক্ত অবস্থাতেও বর্তমান থাকে। ‘আমি’ সম্বন্ধে এই অনুভূতিকে বলা হয় অহঙ্কার, কিন্তু এই আত্মানুভূতি যখন বাস্তব বস্তুতে বা আত্মাতে প্রয়োগ হয়, তখন সেটিই হচ্ছে যথার্থ অহঙ্কার। অনেক দার্শনিক আছেন যাঁরা বলেন, আমাদের অহঙ্কার বর্জন করা উচিত। কিন্তু আমাদের এই অহঙ্কার আমরা ত্যাগ করতে পারি না, কারণ অহঙ্কার হচ্ছে আমাদের পরিচয়। তবে অবশ্যই জড় দেহ নিয়ে যে পরিচয়, তা পরিত্যাগ করতেই হবে। জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি সমন্বিত যে দুঃখ-দুর্দশা, সেই কথা বুঝতে হবে। বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্রে জন্ম সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতে জন্মের পূর্বে মাতৃজঠরে শিশুর অবস্থান যে কত দুঃখময়, তা অতি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। জন্ম যে কত ক্লেশদায়ক, তা পূর্ণরূপে জানতে হবে। মাতৃজঠরে কি পরিমাণ দুঃখ-দুর্দশা আমরা ভোগ করেছি, তা ভুলে যাওয়ার ফলেই আমরা জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত থেকে নিস্তার পাওয়ার কোন চেষ্টা করি না। তেমনই, মৃত্যুর সমরো নানা রকম যন্ত্রণাভোগ করতে হয় এবং প্রামাণ্য শাস্ত্রাদিতে তারও বর্ণনা আছে। সেগুলি আলোচনা করা উচিত। আর জরা ও ব্যাধি যে কত যন্ত্রণাদায়ক, সেই সম্বন্ধে প্রতিটি জীবেরই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। কেউই ব্যাধিগ্রস্ত হতে চায় না এবং কেউই জরাগ্রস্ত হতে চায় না। কিন্তু তবুও এগুলির হাত থেকে নিস্তার নেই। জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি সমন্বিত জড় জীবন যে দুঃখময় তা বুঝতে না পারলে পারমার্থিক উন্নতি সাধনে প্রেরণা পাওয়া যায় না।
স্ত্রী, পুত্র, গৃহের প্রতি অনাসক্ত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তাদের প্রতি কোন অনুভূতি থাকবে না। তাদের প্রতি স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তারা যদি পারমার্থিক উন্নতি সাধনের অনুকূল না হয়, তা হলে তাদের প্রতি আসক্ত হওয়া উচিত নয়। গৃহকে আনন্দময় করে তোলবার শ্রেষ্ঠ প্রক্রিয়া হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার অনুশীলন। কেউ যদি পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় হন, তা হলে তিনি অনায়াসে তাঁর গৃহকে অতি মনোরম সুখের আলয়ে পরিণত করতে পারেন। কারণ, কৃষ্ণভক্তির এই পন্থা অতি সরল। কেবলমাত্র প্রয়োজন হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—এই মহামন্ত্র কীর্তন করা, কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করা, ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবত আদি শাস্ত্র আলোচনা করা এবং ভগবানের শ্রীবিগ্রহ অর্চনা করা। এই চারটি বিধি অনুশীলন করলে অনায়াসে সুখী হওয়া যায়। পরিবারের প্রতিটি লোককে এই শিক্ষা দেওয়া উচিত। পরিবারের সকলের কর্তব্য সকালে ও সন্ধ্যায় একত্রে বসে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—এই মহামন্ত্র কীর্তন করা। এই চারটি নিয়ম পালন করার মাধ্যমে কেউ যদি তাঁর পরিবারকে কৃষ্ণভাবনাময় করে গড়ে তুলতে পারেন, তা হলে তাঁকে গৃহ ত্যগ করে সন্ন্যাস নিতে হয় না। কিন্তু তা যদি তাঁর পারমার্থিক উন্নতির অনুকূল না হয়, উপযোগী না হয়, তা হলে সেই গৃহ ত্যাগ করা উচিত। কৃষ্ণ-তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য অথবা কৃষ্ণসেবার জন্য সব কিছু উৎসর্গ করা উচিত, ঠিক যেমন অর্জুন করেছিলেন। অর্জুন তাঁর আত্মীয় পরিজনদের হত্যা করতে নারাজ ছিলেন, কিন্তু তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, তাঁর সেই আত্মীয় পরিজনেরা তাঁর কৃষ্ণভক্তির প্রতিবন্ধক, তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ শিরোধার্য করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন এবং তাদের হত্যা করলেন। সর্ব অবস্থাতেই মানুষকে সাংসারিক জীবনের সুখ ও দুঃখ থেকে অনাসক্ত থাকা উচিত। কারণ, এই জগতে কেউই সম্পূর্ণভাবে সুখী হতে পারে না, তেমনই আবার কেউ সম্পূর্ণভাবে দুঃখীও হতে পারে না।
সুখ ও দুঃখ হচ্ছে ভড় জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। ভগবদ্গীতার উপদেশ অনুসারে এগুলিকে সহ্য করতে চেষ্টা করা উচিত। সুখ ও দুঃখ আসে যায় এবং তাদের আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সুতরাং, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে জড়- জাগতিক জীবনের প্রতি অনাসক্ত হওয়া, তা হলে এই সুখ ও দুঃখ উভয়েরই প্রতি সমভাবাপন্ন হওয়া সম্ভব। সাধারণত, যখন আমরা আমাদের কাম্য বস্তু অর্জন করি, তখন আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হই এবং যখন আমরা অবাঞ্ছিত কোন কিছু প্রাপ্ত হই, তখন আমরা দুঃখিত হই। কিন্তু আমরা যদি যথাযথভাবে পারমার্থিক স্তরে অধিষ্ঠিত থাকি, তা হলে এই বিষয়গুলি আমাদের বিচলিত করতে পারবে না। এই স্তরে অধিষ্ঠিত হতে হলে আমাদেরকে ভক্তিযোগে নিরন্তর ভগবানের সেবা করতে হবে। অবিচলিতভাবে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার অর্থ হচ্ছে শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, বন্দন, অর্জন, পাদসেবন, দাস্য, সখ্য ও আত্মনিবেদন — এই নববিধা ভক্তির অনুশীলন করা, যা নবম অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই পদ্ধতি মেনে চলা উচিত।
কেউ যখন পারমার্থিক জীবন লাভ করেন, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই বৈষয়িক লোকেদের সঙ্গে আর মেলামেশা করতে চাইবেন না। সাধুসঙ্গ তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। অসাধুসঙ্গ বর্জন করে নির্জন বাসের প্রতি কতটা অনুরাগ এসেছে, তার মাধ্যমে নিজেকে পরীক্ষা করা যেতে পারে। খেলাধুলা, সিনেমা, সামাজিক অনুষ্ঠান আদিতে ভক্তের স্বাভাবিকভাবেই কোন রুচি থাকে না। কারণ তিনি বুঝতে পারেন যে, এগুলি কেবল সময়েরই অপচয় মাত্র। অনেক গবেষক ও দার্শনিক আছেন, যাঁরা যৌন বিজ্ঞান অথবা সেই ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু ভগবদ্গীতার উপদেশ অনুসারে সেই সমস্ত গবেষণা ও দার্শনিক অনুমানগুলির কোন মূল্য নেই। সেগুলি এক রকম নিরর্থক প্রয়াস মাত্র। ভগবদগীতার নির্দেশ অনুসারে, তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে গবেষণা করা উচিত। নিজেকে জানার জন্য গবেষণা করা উচিত। সেই নির্দেশই এখানে দেওয়া হয়েছে।
আত্ম-উপলব্ধি সম্বন্ধে এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ভক্তিযোগের পন্থা বিশেষভাবে বাস্তব সম্মত। ভক্তিযোগ বলতে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সম্পর্ক বুঝতে হবে। জীবাত্মা ও পরমাত্মা কখনই এক হতে পারে না – অন্তত ভক্তিমার্গে। পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার এই সেবা নিতা। সেই কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সুতরাং ভক্তিযোগ নিত্য। এই তত্ত্বজ্ঞানে দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন হওয়া উচিত। শ্রীমদ্ভাগবতে (১/২/১১) এই সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বদন্তি ততত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজ্ঞজ্ঞানমদ্বয়ম্। “যারা যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী তাঁরা জানেন যে, অদ্বয় পরমতত্ত্ব ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান—এই তিনরূপে উপলব্ধ হন।” পরম-তত্ত্বের চরম উপলব্ধি হচ্ছেন ভগবান। সুতরাং, সেই চরম স্তরে উন্নীত হয়ে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করা উচিত এবং ভক্তিযোগে তাঁর সেবায় নিযুক্ত হওয়া উচিত। সেটিই হচ্ছে জ্ঞানের পূর্ণতা।
অমানিত্ব থেকে শুরু করে পরমতত্ত্ব পরম পুরুষ ভগবানকে উপলব্ধি করার স্তর পর্যন্ত এই পন্থাটি একটি সিঁড়ির মতো, যেন একতলা থেকে শুরু হয়ে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। এখন এই সিঁড়িতে বহু লোক আছেন, যাঁরা একতলা, দুতলা অথবা তিনতলা আদিতে পৌঁছে গেছেন, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না সর্বোচ্চ তলায় পৌঁছানো যাচ্ছে, যা হচ্ছে কৃষ্ণ উপলব্ধি, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা জ্ঞানের নিম্নপর্যায়েই অবস্থিত। কেউ যদি ভগবানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পারমার্থিক উন্নতি লাভ করতে চায়, তা হলে তার সে আশা ব্যর্থ হবে। এখানে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, অমানিত্ব ব্যতিরেকে উপলব্ধি সত্যিই সম্ভব নয়। নিজেকে ভগবান বলে মনে করা মিথ্যা অহঙ্কারের চরম প্রকাশ। প্রকৃতির কঠোর শাসনে জীব যদিও প্রতিনিয়তই পদদলিত হচ্ছে, তবুও অজ্ঞানতার প্রভাবে সে মনে করছে, “আমি ভগবান।” সেই জন্যই জ্ঞানের সূচনা হচ্ছে অমানিত্ব। সকলেরই উচিত নম্র হওয়া এবং সর্ব অবস্থাতেই নিজেকে ভগবানের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে মনে করা। পরমেশ্বর ভগবানের আধিপত্য স্বীকার না করে বিদ্রোহী হওয়ার ফলেই আমরা জড়া প্রকৃতির অধীনস্থ হয়ে পড়েছি। এই তত্ত্বকে উপলব্ধি করে, তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস থাকা উচিত।