শ্লোকঃ ৩৪
যথা প্রকাশয়ত্যেকঃ কৃৎস্নং লোকমিমং রবিঃ ।
ক্ষেত্রং ক্ষেত্রী তথা কৃৎস্নং প্রকাশয়তি ভারত ॥ ৩৪ ॥
যথা— যেমন; প্রকাশয়তি প্রকাশ করে। একঃ – এক, কৃৎস্নম্ — সমগ্র, লোকস্ জগৎকে: ইমম্—এই: রবি: – সূর্য; ক্ষেত্রম—এই দেহকে; ক্ষেত্রী—আত্মা: তথা— সেই রকম; কৃৎস্নম্ – সমগ্র; প্রকাশয়তি — প্রকাশ করে, ভারত – হে ভারত।
গীতার গান
সূর্য যথা প্রকাশয়ে অখিল জগৎ ৷
এক দেশে একা থাকি সম্রাট মহৎ ॥
– প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেক যোগ
হে ভারত সেইরূপ ক্ষেত্রী প্রকাশয় ৷
একা একস্থানে থাকি ক্ষেত্র দেহময় ৷৷
অনুবাদঃ হে ভারত ! এক সূর্য যেমন সমগ্র জগৎকে প্রকাশ করে, সেই রকম ক্ষেত্রী আত্মাও সমগ্র ক্ষেত্রকে প্রকাশ করে।
তাৎপর্যঃ চেতনা সম্বন্ধে নানা রকম মতবাদ আছে। এখানে ভগবদ্গীতায় সূর্য ও সূর্যরশ্মির উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। সূর্য যেমন এক জায়গায় অবস্থিত, কিছু তার রশ্মি সারা জগৎকে আলোকিত করছে, তেমনই অণুসদৃশ জীবাত্মা যদিও শরীরের হৃদয়ে অবস্থিত, তবুও চেতনার দ্বারা সে সমস্ত শরীরকে আলোকিত করছে। এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, সূর্যরশ্মি বা আলোক যেমন সূর্যের অস্তিত্বের প্রমাণ, তেমনই চেতনা হচ্ছে আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ। দেহে যখন আত্মা থাকে, তখন সারা শরীর জুড়ে চেতনা থাকে, কিন্তু দেহ থেকে আত্মা যখনই চলে যায়, তখন আর চেতনা থাকে না। যে কোন বুদ্ধিমান মানুষ এটি সহজেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। সুতরাং, জড় পদার্থের সমন্বয়ের ফলে চেতনার উদ্ভব হয় না। চেতনা হচ্ছে জীবাত্মার লক্ষণ। জীবের চেতনা যদিও পরম চেতনার সঙ্গে গুণগতভাবে এক, তবুও তা পরম নয়। অংশীদার হতে পারে না। দেহে বিরাজ করছেন, তিনি সমস্ত শরীর সম্বন্ধে সচেতন। সেটিই হচ্ছে কিছুচৈতন্য ও অণুচৈতন্যের মধ্যে পার্থক্য।
শ্লোকঃ ৩৫
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োরেবমন্তরং জ্ঞানচক্ষুষা ।
ভূতপ্রকৃতিমোক্ষম চ যে বিদুর্যান্তি তে পরম্ ।। ৩ ।।
ক্ষেত্র— দেহ; ক্ষেত্রজ্ঞয়োঃ-ক্ষেত্রজ্ঞের; এবম—এভাবে; অন্তর জ্ঞানচক্ষুষা—জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা; ভূত— জীবের; প্রকৃতি—জড়া প্রকৃতি থেকে, মোক্ষম্—মুক্তি; চ—ও; যে যাঁরা, বিদুঃ — জানেন, মাস্তি — প্রাপ্ত হন; তে – তাঁরা; পরম্পরম পদ।
গীতার গান
ক্ষেত্র আর ক্ষেত্রজ্ঞের তত্ত্বজ্ঞান চক্ষে ।
দেখিবার শক্তি হয় সে যাহার পক্ষে ।।
এক ক্ষেত্রজ্ঞ সে জীব অন্য পরমাত্মা ।
উভয়ের ক্ষেত্রে বাস ক্ষেত্র বিশেষাত্মা ।।
তার মোক্ষ জড়নিষ্ঠ প্রবৃত্তি হইতে ৷
সুখে বাস পরব্যোমে জড় দেহ অন্তে ।।
অনুবাদঃ যাঁরা এভাবেই জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের পার্থক্য জানেন এবং জড়া প্রকৃতির বন্ধন থেকে জীবগণের মুক্ত হওয়ার পন্থা জানেন, তারা পরম গতি লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ এই ত্রয়োদশ অধ্যায়ের মূল কথা হচ্ছে যে, ক্ষেত্র (শরীর), ক্ষেত্রজ্ঞ (শরীরের মালিক) ও পরমাত্মার মধ্যে পার্থক্য সম্বন্ধে অবগত হওয়া উচিত। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্লোকে বর্ণিত মুক্তি লাভের পন্থা সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। তবেই পরম গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে।
যে মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধার উদয় হয়েছে, তাঁকে সর্ব প্রথমে সাধুসঙ্গে ভগবানের কথা শ্রবণ করতে হবে এবং এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি দিব্যজ্ঞান লাভ করবেন। যদি কেউ সদগুরুর চরণাশ্রয় গ্রহণ করেন, তা হলে তিনি জড় এবং চেতনের পার্থক্য নিরূপণ করতে সমর্থ হন এবং সেটিই হচ্ছে তাঁর পারমার্থিক উপলব্ধির পথে ক্রমোন্নতির উপায়। সদগুরু তাঁর শিষ্যকে নানা রকম সদুপদেশ দান করে। জড়-জাগতিক জীবনের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দান করেন। যেমন, ভগবদ্গীতায় আমরা দেখতে পাই, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জড়-জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত করবার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন।
এই দেহ যে জড় পদার্থ তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়; চব্বিশটি বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে তার বিশ্লেষণ করা যায়। দেহ হচ্ছে তার স্থুল প্রকাশ। তার সূক্ষ্ম প্রকাশ হচ্ছে মন ও বুদ্ধির ক্রিয়া। এই সমস্ত তত্ত্বের পারস্পরিক ক্রিয়া হচ্ছে জীবনের লক্ষণ। কিন্তু এদের ঊর্ধ্বে রয়েছে আত্মা ও পরমাত্মা। আত্মা ও পরমাত্মা হচ্ছেন দুজন। জড় জগতের সমস্ত ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে আত্মা ও চব্বিশটি তত্ত্বের সংযোগের ফলে। যিনি আত্মা ও জড় উপাদানের সমন্বয়কে জড় জগতের কারণরূপে উপলব্ধি করতে পারেন এবং পরমাত্মার অবস্থান দর্শন করতে পারেন, তিনি চিৎ-জগতে ফিরে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। এগুলি গভীরভাবে মনোনিবেশ ও উপলব্ধি করবার বিষয় এবং সকলেরই উচিত সদগুরুর কৃপার প্রভাবে এই অধ্যায়কে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা।
ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ৷
শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ॥
ইতি— ‘প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।