ত্রয়োদশ অধ্যায়
প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
শ্লোকঃ ১-২
অর্জুন উবাচ
প্রকৃতিং পুরুষং চৈব ক্ষেত্রং ক্ষেত্রজ্ঞমেব চ ।
এতদ্ বেদিতুমিচ্ছামি জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চ কেশব ।৷ ১ ।৷
শ্রীভগবানুবাচ
ইদং শরীরং কৌন্তেয় ক্ষেত্রমিত্যভিধীয়তে ৷
এতদ্ যো বেত্তি তং গ্রাহুঃ ক্ষেত্রজ্ঞ ইতি তদ্বিদঃ ॥ ২ ॥
অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন, প্রকৃতি – প্রকৃতি; পুরুষম্ — পুরুষ; চ—ও; এর—অবশ্যই: ক্ষেত্র-ক্ষেত্র; ক্ষেত্রজ্ঞম – ক্ষেত্রজ্ঞ; এর—অবশ্যই; চ–ও; এতৎ—এই সমস্ত; বেদিতুম্——জানতে, ইচ্ছামি—ইচ্ছা করি; জ্ঞানম্—জ্ঞান, জ্ঞেয়ম্ জ্ঞেয়; চ—ও, কেশৰ – হে কৃষ্ণ, শ্রীভগবান্ উবাচ— পরমেশ্বর ভগবান বললেন; ইদম্—এই; শরীরম্—শরীর, কৌন্তেয়—হে কুন্তীপুত্র; ক্ষেত্ৰম -ক্ষেত্র; ইতি—এভাবে, অভিধীয়তে – অভিহিত হয়, এবং এই; যঃ – যিনি, বেত্তি— জানেন; তম্—তাঁকে, গ্রাহঃ- বলা হয়; ক্ষেত্রজ্ঞ-ক্ষেত্রজ্ঞ, ইতি—এভাবে: তবিদঃ – যিনি জানেন।
গীতার গান
অর্জুন কহিলেনঃ
প্রকৃতির আর পুরুষ ক্ষেত্র যে ক্ষেত্রজ্ঞ ৷
জানিবার ইচ্ছা মোর আমি নহি বিজ্ঞ ।।
সেইরূপ জ্ঞান আর বিজ্ঞান কি হয় ।
কেশব আমাকে কহ করিয়া নিশ্চয় ।।
শ্রীভগবান কহিলেনঃ
হে কৌন্তেয় ! এ শরীর ক্ষেত্র নাম তার ৷
ইহার যে জ্ঞাতা সেই ক্ষেত্রজ্ঞ বিচার ॥
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন – হে কেশব। আমি প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞের—এই সমস্ত তত্ত্ব জানতে ইচ্ছা করি।
পরমেশ্বর ভগবান বললেন – হে কৌন্তেয়। এই শরীর ক্ষেত্র নামে অভিহিত এবং যিনি এই শরীরকে জানেন, তাঁকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলা হয়।
তাৎপর্যঃ অর্জুন প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয়র বিষয় সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন। এই সম্বন্ধে তিনি যখন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে বললেন যে, এই দেহকে বলা হয় ক্ষেত্র এবং যিনি এই ক্ষেত্র সম্বন্ধে জ্ঞাত তাঁকে বলা হয় ক্ষেত্রজ্ঞ। এই দেহ হচ্ছে বন্ধ জীবের কর্মক্ষেত্র। বদ্ধ জীব মাত্রই জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জড়া প্রকৃতির উপরে আধিপত্য করার চেষ্টা করে। আর তাই, জড়া প্রকৃতির উপর আধিপতা করার ক্ষমতা অনুসারে সে একটি কর্মক্ষেত্র প্রাপ্ত হয়। সেই কর্মক্ষেত্রটি হচ্ছে তার দেহ। এই দেহটি কি? দেহটি ইন্দ্রিয়গুলি দিয়ে তৈরি। বদ্ধ জীব ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে চায় এবং তার ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার ক্ষমতা অনুসারে সে একটি শরীর বা কর্মক্ষেত্র প্রাপ্ত হয়। তাই শরীরকে বলা হয় ক্ষেত্র অথবা বদ্ধ জীবের কর্ম করার ক্ষেত্র। এখন, যে ব্যক্তি তার দেহের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞাত তাকে বলা হয় ক্ষেত্রজ্ঞ। ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রকে এবং দেহ ও দেহের জ্ঞাতা এদের পার্থক্য বুঝতে পারা খুব একটা কঠিন নয়।
যে কেউই বিবেচনা করে দেখতে পারেন যে, শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তার দেহে কত পরিবর্তন দেখা যায়, কিন্তু তবুও দেহের যে দেহী তাঁর কোন পরিবর্তন হয় না। তিনি সব সময় একই থাকেন। এভাবেই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রতের পার্থক্য উপলব্ধি করা যায়। এভাবেই বদ্ধ জীব বুঝতে পারে যে, সে তার দেহ থেকে ভিন্ন। ভগবদ্গীতার প্রথম দিকেই বর্ণনা করা হয়েছে, দেহিনোংস্মিন্ অর্থাৎ দেহের দেহী আছে এবং দেহ কৌমার থেকে যৌবনে এবং যৌবন থেকে বার্ধক্যে পরিবর্তন হচ্ছে এবং যে ব্যক্তি এই দেহের মালিক তিনি জানেন যে, দেহের পরিবর্তন হচ্ছে। দেহের এই মালিকই হচ্ছেন ক্ষেত্রজ্ঞ। কখনও আমরা মনে করে থাকি যে, “আমি সুখী,” “আমি একটি পুরুষ”, “আমি একটি মহিলা,” “আমি একটি কুকুর”, “আমি একটি বেড়াল।” এগুলি হচ্ছে ক্ষেত্রজ্ঞের দেহগত উপাধি । কিন্তু ক্ষেত্রজ্ঞ দেহ থেকে ভিন্ন। যদিও আমরা অনেক জিনিস ব্যবহার করে থাকি, যেমন আমাদের কাপড় চোপড় আদি। আমরা একটু ভাবলেই বুঝতে পারি যে, এই সমস্ত ব্যবহৃত জিনিসগুলি থেকে আমরা স্বতন্ত্র। তেমনই, একটু চিন্তা করার ফলে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের দেহ থেকে আমরা স্বতন্ত্র। দেহের মালিক আমি, তুমি অথবা যে কেউই হচ্ছি ক্ষেত্রজ্ঞ এবং দেহটিকে বলা হয় ক্ষেত্র বা কর্মক্ষেত্র।
ভগবদ্গীতার প্রথম ছয়টি অধ্যায়ে দেহের জ্ঞাতা বা জীব এবং তার স্থিতি, যার দ্বারা সে পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে পারে, তা বর্ণিত হয়েছে। ভগবদ্গীতার মধ্যবর্তী ছয়টি অধ্যায়ে পরমেশ্বর ভগবান এবং ভক্তিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে। পরমেশ্বর ভগবানের পরমপদ এবং তাঁর নিত্য সেবকরূপে জীবের যে স্বাভাবিক স্বরূপ তা এই অধ্যায়গুলিতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। জীব সর্ব অবস্থাতেই অধীনতত্ত্ব, কিন্তু ভগবানকে ভুলে যাওয়ার ফলে তারা দুঃখকষ্ট ভোগ করছে। শুভ কর্ম বা সুকৃতির প্রভাবে যখন তাদের চেতনার উন্মেষ হয়, তখন তাঁরা আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানীরূপে ভগবানের অনুগামী হন। সেই কথাও বর্ণিত হয়েছে। এখন ত্রয়োদশ অধ্যায় থেকে বর্ণনা করা হচ্ছে জীব কিভাবে জড় জগতের সংস্পর্শে আসে এবং ভগবানের কৃপার প্রভাবে সে কিভাবে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির মাধ্যমে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়, সেই সমস্ত বিষয়ে এখানে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। জীব যদিও তাঁর জড় দেহ থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন, তবুও সে তার জড় দেহের সঙ্গে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে। সেই কথাও এখানে ব্যখ্যা করা হয়েছে।
শ্লোকঃ ৩
ক্ষেত্রজ্ঞং চাপি মাং বিদ্ধি সর্বক্ষেত্রেষু ভারত ৷
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োজ্ঞানং যজ্ঞজ্ঞজ্ঞানং মতং মম ॥ ৩ ॥
ক্ষেত্রজ্ঞম্—ক্ষেত্রজ্ঞ; চ–ও, অপি – অবশ্যই; মাম্—আমাকে; বিদ্ধি — জানবে; সর্ব— সমস্ত ক্ষেত্রে — ক্ষেত্রে; ভারত – হে ভারত; ক্ষেত্র-ক্ষেত্র (শরীর); ক্ষেত্রজ্ঞয়োঃ-ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞানম্—জ্ঞান; যৎ – যে, তৎ— সেই; জ্ঞানম্ –জ্ঞোন, মতম্—অভিমত; মম — আমার ।
গীতার গান
আমিও ক্ষেত্রজ্ঞ বুঝ সকল শরীরে ।
হে ভারত, অন্তর্যামী কহে সে আমারে ॥
সেই ক্ষেত্র আর ক্ষেত্রজ্ঞের যেবা জ্ঞান ।
আমার বিচারে হয় সেই শুদ্ধ জ্ঞান ৷৷
অনুবাদঃ হে ভারত ! আমাকেই সমস্ত ক্ষেত্রের ক্ষেত্র বলে জানবে এবং ক্ষেত্র ও ক্ষেত্র সম্বন্ধে যে জ্ঞান, সেই জ্ঞানই আমার অভিমত।
তাৎপর্যঃ আমরা যখন দেহ ও দেহের জ্ঞাতা, আত্মা ও পরমাত্মা সম্বন্ধে আলোচনা করি, তখন আমরা তিনটি আলোচনার বিষয় দেখতে পাই — ভগবান, জীব ও জড় পদার্থ । প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে বা প্রতিটি দেহে দুটি আত্মা আছে— জীবাত্মা ও পরমাত্মা। যেহেতু পরমাত্মা হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই প্রকাশ, তাই শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “আমিও ক্ষেত্রজ্ঞ, কিন্তু আমি দেহের অণু ক্ষেত্রজ্ঞ নই, আমি হচ্ছি পরম ক্ষেত্রজ্ঞ। পরমাত্মা রূপে আমি প্রতিটি শরীরেই অবস্থান করি। “
কেউ যদি ভগবদ্গীতার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করেন, তা হলে তিনি জ্ঞান লাভ করতে পারবেন। ভগবান বলছেন, “আমি প্রতিটি দেহের ক্ষেত্রজ্ঞ।” জীবাত্মা তার নিজের দেহের ক্ষেত্রজ্ঞ হতে পারে, কিন্তু অন্য শরীর সম্বন্ধে তার কোন জ্ঞান নেই। পরমেশ্বর ভগবান যিনি পরমাত্মা রূপে প্রত্যেক শরীরে বর্তমান, তিনি সমস্ত শরীর সম্বন্ধে প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেক যোগ সর্বতোভাবে অবগত। তিনি দেবতা, মানুষ, পশু, কীট, পতঙ্গ, বৃক্ষ, লতা আদি সমস্ত প্রজাতির শরীর সম্বন্ধেই সর্বতোভাবে অবগত। কোন নাগরিক যেমন শুধু তার নিজের জমিটি সম্বন্ধেই অবগত, কিন্তু রাজা কেবল তাঁর রাজপ্রাসাদ সম্বন্ধেই অবগত নন, তিনি তাঁর রাজ্যের প্রতিটি নাগরিকের সমস্ত সম্পত্তি সম্বন্ধেও অকাত। তেমনই, কেউ তাঁর নিজের দেহের মালিক হতে পারেন, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সমস্ত শরীরের মালিক। রাজা হচ্ছেন তাঁর রাজ্যের মুখ্য মালিক এবং নাগরিকেরা হচ্ছেন গৌণ মালিক। তেমনই, পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সমস্ত শরীরের মুখ্য মালিক।
দেহ গঠিত হয় ইন্দ্রিয়গুলি দিয়ে। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন হৃষীকেশ, যার অর্থ হচ্ছে ‘সমস্ত ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্তা’। রাজা যেমন রাজ্যের সমস্ত কার্যকলাপের মুখ্য নিয়ন্তা এবং তাঁর প্রজারা হচ্ছে গৌণ নিয়ন্তা, তেমনই পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রধান নিয়ন্তা। ভগবান বলেছেন, “আমিও ক্ষেত্রজ্ঞ”। এর অর্থ হচ্ছে যে, তিনি হচ্ছেন পরম ক্ষেত্রজ্ঞ; জীবাত্মা কেবল তার নিজের শরীরটির ক্ষেত্রজ্ঞ। বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
ক্ষেত্রাণি হি শরীরাণি বীজং চাপি শুভাশুভে।
তানি বেত্তি স যোগাত্মা ততঃ ক্ষেত্রজ্ঞ উচ্যতে ॥
এই দেহকে বলা হয় ক্ষেত্র এবং এই দেহের মধ্যেই বাস করেন দেহের মালিক। পরমেশ্বর ভগবান এই দেহ ও দেহের মালিক উভয়কেই জানেন। তাই, তাঁকে সর্বক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ বলা হয়। এভাবেই কর্মক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ ও পরম ক্ষেত্রজ্ঞের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়েছে। দেহের স্বরূপ, জীবাত্মার স্বরূপ ও পরমাত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞানকে বৈদিক শাস্ত্রে জ্ঞান বলা হয়েছে। সেটিই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের মত। জীবাত্মা এবং পরমাত্মাকে এক কিন্তু তবুও স্বতন্ত্র বলে বুঝতে পারাটাই হচ্ছে জ্ঞান। যিনি ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ সম্বন্ধে অবগত নন, তিনি যথার্থ জ্ঞান প্রাপ্ত হননি। প্রকৃতি, পুরুষ এবং প্রকৃতি ও পুরুষের পরম নিয়ন্তা পরম ক্ষেত্রজ্ঞ ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের জানতে হবে। এই তিনের বিশেষত্ব সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। চিত্রকার, চিত্র ও চিত্র অঙ্কনের ফলক সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। এই জড় জগৎ, যা হচ্ছে কর্মক্ষেত্র, তা হচ্ছে প্রকৃতি আর এর ভোক্তা হচ্ছে এবং এই উভয়ের ঊর্ধ্বে পরম নিয়ন্তা হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। বৈদিক শাস্ত্ৰে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ১/১২) বলা হয়েছে— ভোক্তা ভোগাং প্রেরিতার চ মহা/ সর্বং প্রোক্তং ত্রিবিধং ব্রহ্মমেতৎ। ব্রহ্মকে তিনভাবে উপলব্ধি করা যায়- কর্মক্ষে রূপে প্রকৃতিই হচ্ছে ব্রহ্ম, জীবও ব্রহ্ম এবং সে জড়া প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করছে এবং এই উভয়েরই নিয়তাও হচ্ছেন ব্রহ্মা, কিন্তু তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত নিয়ন্তা।
এই অধ্যায়ে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করা হবে যে, এই দুই ক্ষেত্রজ্ঞের মধ্যে একজন হচ্ছেন ভ্রান্ত এবং অপর জন অভ্রান্ত। একজন ঊর্ধ্বভন, অপর জন অধস্তন। যারা মনে করে যে, এই উভয় ক্ষেত্রসই এক এবং অভিন্ন, তারা পরমেশ্বর ভগবানের বিরুদ্ধাচরণ করে। এখানে তিনি অতি স্পষ্টভাবে বলেছেন, “আমিও ক্ষেত্রজ্ঞ”, রজ্জুকে যার সর্ণ ভ্রম হয়, তার যথার্থ জ্ঞান নেই। ভিন্ন ভিন্ন শরীর আছে এবং সেই সমস্ত শরীরে ভিন্ন ভিন্ন শরীরী বা মালিক আছেন। যেহেতু প্রতিটি স্বতন্ত্র আত্মার এই জড় জগতের উপর আধিপত্য করার ব্যক্তিগত ক্ষমতা আছে, তাই তাদের ভিন্ন ভিন্ন শরীর আছে। কিন্তু পরম নিয়ন্তারূপে পরমেশ্বর ভগবানও সেই সমস্ত শরীরে বর্তমান। চ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ, কেন না তার মাধ্যমে সমস্ত শরীরকে উল্লেখ করা হয়েছে। সেটিই হচ্ছে শ্রীল বলদের বিদ্যাভূষণের অভিমত। প্রতিটি শরীরে আত্মা ছাড়াও পরমাত্মা রূপে শ্রীকৃষ্ণ রয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ এখানে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, কর্মক্ষেত্র ও তার সীমিত ভোক্তা উভয়েরই নিয়ন্তা হচ্ছেন পরমাত্মা ।
শ্লোকঃ ৪
তৎ ক্ষেত্রং যচ্চ যাদৃক্ চ যদ্বিকারি যতশ্চ যৎ।
স চ যো যৎপ্রভাবশ্চ তৎ সমাসেন মে শৃণু ॥ ৪ ॥
তৎ— সেই; ক্ষেত্র-ক্ষেত্র, ত্যা: চ—ও, যাদ— যে রকম; চত্ত; য— যেরূপ, বিকারি — বিকার; যতঃ — যার থেকে; চণ্ড; যা সঃ— তিনি; চ ও; যঃ যিনি; যৎ- যেরূপ প্রভাবঃ – প্রভাব; চ– ; তৎ- সেই; সমাসেন— সংক্ষেপে; মে—-আমার থেকে; শুধু শ্রবণ কর।
গীতার গান
সেই ক্ষেত্র আর ক্ষেত্রত্ত্বের বিচার ।
কি তার স্বরূপ কিংবা কি তার বিচার ॥
কি তার প্রভাব কিংবা কোথা হতে হয় ৷
শুন তুমি কহি আমি করিয়া নিশ্চয় ।।
অনুবাদঃ সেই ক্ষেত্র কি, তার কি প্রকার, তার বিকার কি, তা কার থেকে উৎপন্ন হয়েছে, সেই ক্ষেত্রজ্ঞের স্বরূপ কি এবং তার প্রভাব কি, সেই সব সংক্ষেপে আমার কাছে শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। এই শরীর কিভাবে গঠিত হয়েছে, তার গঠনের উপাদানগুলি কি, কার নিয়ন্ত্রণাধীনে এই শরীর কাজ করে চলেছে, কিভাবে তার পরিবর্তন হচ্ছে, কোথা থেকে এই পরিবর্তনগুলি আসছে, তার কারণ কি, তার উদ্দেশ্য কি, প্রতিটি স্বতন্ত্র আত্মার পরম লক্ষ্য কি এবং স্বতন্ত্র আত্মার প্রকৃত রূপ কি, সেই সম্বন্ধে জানতে হবে। জীবাত্মা ও পরমাত্মার পার্থক্য, তাঁদের বিভিন্ন প্রভাব এবং তাঁদের শক্তি আদি সম্বন্ধে জানতে হবে। পরমেশ্বর ভগবানের বর্ণনা অনুসারে সরাসরিভাবে এই ভগবদ্গীতা উপলব্ধি করতে হবে, তখন সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হবে। কিন্তু আমাদের সতর্ক হতে হবে, সকলের দেহে অবস্থিত পরমেশ্বর ভগবানকে জীবাত্মার সঙ্গে এক বলে যেন মনে না করি। এটি অনেকটা শক্তিমান ও শক্তিহীনকে সমান বলে মনে করারই সামিল।