পৃথিবী আমাদের আপন গ্রহ, চাঁদ আমাদের চাঁদ- পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। মহাশূন্যের এ-দুটি অস্তিত্ব পরস্পরের সাথে জড়িয়ে আছে অচ্ছেদ্য যুগলের মতো । পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সূর্যের আলো দিকে দিকে ছড়িয়ে প’ড়ে তার আকাশ হয়ে ওঠে নীল, তাই একে নীল গ্রহও বলা হয়; আবার সূর্য থেকে দূরত্বে তৃতীয় স্থানে আছে ব’লে তৃতীয় গ্রহও বলা হয় পৃথিবীকে । মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে দেখায় অত্যন্ত উজ্জ্বল, তার কারণ পৃথিবীর অ্যালবেডো, তার আলো প্রতিফলনের শক্তি খুবই বেশি। পৃথিবী ও চাঁদকে যখন মহাশূন্য থেকে দেখা যায়, তখন পৃথিবীর আলোর পাশে নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে চাঁদ। মানুষের মনে হাজার হাজার বছর ধ’রে পৃথিবী সৃষ্টি ক’রে এসেছে প্রতিভাস, মানুষের মনে হয়েছে আমরা আছি পৃথিবীতে, বিশ্বের কেন্দ্রে; পৃথিবী একটি দূষিত অপবিত্র অচল স্থান; পবিত্র ও স্বর্গের জিনিশ হচ্ছে ওই চাঁদ, তারা, সূর্য। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা, তবে আজো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করে এ-ভুল ধারণায়। আমাদের উঠোনের মাটি, ধানখেত, নদী, আর নগর, এবং আমরা, চাঁদ, তারা, সূর্যের মতোই মহাশূন্যের অধিবাসী। পৃথিবী মহাশূন্যের একটি গ্রহ, এটি ঘুরছে সূর্যকে ঘিরে। চাঁদে বা মঙ্গলে বা অন্য কোনো গ্রহে যদি কেউ থাকতো, দেখতো পৃথিবী চাঁদের থেকেও অনেক বেশি ঝলমল করছে আকাশে; চাঁদ থেকে দেখতো আকাশে উঠছে বাঁকা আলোর পৃথিবী, দেখতো তার দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, সপ্তমী, পূর্ণিমা । মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর যে-সব অসামান্য সুন্দর বিস্ময়কর ছবি তোলা হয়েছে, সেগুলো দেখলে প্রথম মনে হয় যেনো দেখছি চাঁদের ছবি । এখন আমরা জানি শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি প্রভৃতির মতো পৃথিবীও একটি গ্রহ, এটিও প্রদক্ষিণ করছে সূর্যকে; আর এটিই একমাত্র গ্রহ, যেখানে আছে প্ৰাণ, নদী, ধানখেত, পদ্ম, মানুষ, কবিতা, বিজ্ঞান।

পৃথিবীকে কোনো পৌরাণিক বিধাতা বানিয়ে স্থির ক’রে রাখে নি মহাপ্রলয়ের অপেক্ষায়; সৌরজগতের উদ্ভবের সাথে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর উদ্ভবের ইতিহাস । পৃথিবী আজো সৃষ্টি হয়ে চলছে, পৃথিবী বিকাশমান, তার চলছে নানা বিকাশ । জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ও ভূতাত্ত্বিক অজস্র ব্যাপার থেকে বোঝা যায় পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিলো, তার সূচনা হয়েছিলো, ৪.৬ বিলিয়ন অর্থাৎ চারশো ষাট কোটি বছর আগে । এখন কালের ধারণা বেড়ে গেছে আমাদের, পুরোনো মানুষের এমন দীর্ঘ কালের ধারণা ছিলো না; এক হাজার বছরই তাদের কাছে মনে হতো অনন্তকাল। পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিলো এতো আগে, এটা আগের মানুষকে বোঝানো যেতো না, আজো বোঝানো যায় না তাদের, যারা বাস করে দেবতা বিধাতা স্বর্গ নরক দেবদূত প্রভৃতির পৌরাণিক যুগে। আজ যে আমরা পৃথিবীকে একটি অতি প্রাচীন এলাকা ব’লে নিশ্চিত হয়েছি, তাতে পৌঁছোতে অনেক সময় ও বিজ্ঞান লেগেছে । কয়েক শতক আগে পণ্ডিতেরা মনে করতেন পৃথিবী খুব পুরোনো, অর্থাৎ কয়েক হাজার বছরের পুরোনো; ধার্মিকেরা মনে করতো সব জ্ঞান ও সত্য আছে বাইবেলে ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে; আর্চবিশপ জেমস আশার বাইবেল অনুসারে হিশেব ক’রে বের করেছিলেন যে বিধাতা বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলো খ্রিপূ ৪০০৪ অব্দের ২৩ অক্টোবর, রোববার; আর মানুষ সৃষ্টি করেছিলো ২৮ অক্টোবর, শুক্রবার। আধুনিক সময় ধারণার পাশে এটা এক তুচ্ছ সময়, এবং সম্পূর্ণ ভুল। পৃথিবী ও পৃথিবীর সব কিছু হঠাৎ সৃষ্টি হয় নি, বিকশিত হয়েছে কোটি কোটি বছরে।

পৃথিবী, আমাদের গ্রহ। মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে এমন সুন্দর বিস্ময়কর দেখায়। দেখা যাচ্ছে মেঘের ঘর্ণি, ঝড়; নিচের দিকে সাহারা মরুভূমি । ছবিটি তুলেছেন অ্যাপোলো ১৭-র নভচারীরা।

পৃথিবী একটি ছোটো গ্রহ, তবে সবচেয়ে ছোটো নয়; ঘুরে চলছে সূর্য নামের একটি মাঝারি তারাকে ঘিরে, এবং প্রতিদিন ঘুরছে নিজের অক্ষের ওপর। এটি মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়, মহাবিশ্বে উড়ছে একটি ধুলোকণার মতো। কিন্তু এটি মহান, আমাদের গ্রহ, আমাদের নিয়ে অদ্বিতীয় মহাকাশযানের মতো ছুটছে মহাশূন্যের অন্ধকার সমুদ্রের ভেতর দিয়ে। আমরা রেখেছি এর বহু নাম : পৃথিবী, ধরা, ধরণী, বসুমতী, বসুমাতা, অবনী, মেদিনী, ভুবন, ভূলোক, বসুধা, বসুন্ধরা প্রভৃতি।

পৃথিবী আছে সূর্যের বেশ কাছাকাছি, সূর্য থেকে ১৪৯,৬০০,০০ কিলোমিটার (=১.০০০ জ্যোতি-একক) দূরে, সূর্য থেকে পৃথিবীর নিকটতম অবস্থানের দূরত্ব _(পেরিহেলিয়ন) ০.৯৮৩ জ্যোতি একক, দূরতম অবস্থানের দূরত্ব (আপহেলিয়ন) ১.০১৭ জ্যোতি-একক ; এবং পৃথিবী প্রায়-বৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ১ বছরে, অর্থাৎ ৩৬৫.২৫৬ দিনে; কক্ষপথে পৃথিবীর গতি প্রতি সেকেন্ডে ২৯.৮ কিমি । পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘোরে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪.১ সেকেন্ডে; এবং এর অক্ষরেখা কক্ষপথের ওপর হেলে আছে ২৩ ডিগ্রি ২৭ সেকেন্ড । পৃথিবীর বিষুবীয় ব্যাসার্ধ ৬,৩৭৮ কিমি, ব্যাস ১২,৭৩৬ কিমি, ৭৯০০ মাইল, মেরুব্যাসার্ধ ৬,৩৫৬ কিমি। পৃথিবীর ভর অর্থাৎ বস্তুর পরিমাণ ৬ X ১০২৪ কেজি; অর্থাৎ ৬-এর পর চব্বিশটি শূন্য বসিয়ে দেখা যাবে এর ভর ৬০০০ বিলিয়ন বিলিয়ন টন। এর গড় ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৫৫০০ কেজি, প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ৫.৫ গ্রাম। এটা পানির থেকে ৫.৫ গুণ ঘন। এ-ঘনত্ব থেকে বোঝা যায় পৃথিবী প্রধানত শিলা ও ধাতব বস্তুতে গঠিত। পৃথিবীর কেন্দ্রাঞ্চলের ঘনত্ব বাইরের স্তরের ঘনত্বের থেকে অনেক বেশি; সেখানকার ঘনত্ব সম্ভবত প্রতি ঘনমিটারে ১২,০০০ কেজি। এর অভিকর্ষ প্রতি বর্গসেকেন্ডে ৯৮০ সেন্টিমিটার, এর থেকে মুক্তির গতি প্রতি সেকেন্ডে ১১.৩ কিমি। পৃথিবীর অভিকর্ষ চাঁদের অভিকর্ষের ৬ গুণ। এর অ্যালবেডো বা আলো প্রতিফলনের শক্তি ০.৩৯ । পৃথিবীর ওপর ভাগের গড় তাপ ২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ২০০-৩০০ কেলভিন । এর আছে একটি উপগ্রহ চাঁদ।

পৃথিবী সবচেয়ে বিকশিত গ্রহ। এটি এক সক্রিয় গ্রহ; সক্রিয় আছে ৪. বিলিয়ন বছর আগে জন্মের সময় থেকে। এর বিকাশ ঘটেছে চারটি কালপর্বে। প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিলো ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে। তখন এটি ছিলো এক অণু-গ্রহ; কয়েক মিলিয়ন বছরে সৌর নীহারিকা থেকে বস্তু উপচয় বা সংগ্ৰহ ক’রে গ’ড়ে উঠেছিলো এটি । উপচয় ও তেজস্ক্রিয়ার ফলে তখন এর ভেতরভাগ ছিলো প্রচণ্ড উত্তপ্ত। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। তখন স্তরবিন্যাসের ফলে গঠিত হয় এর ভেতরের স্তরগুলো- কেন্দ্রাঞ্চল ও ভূত্বক, বিভিন্ন গ্যাস বেরিয়ে এসে সৃষ্টি করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। তৃতীয় পর্ব শুরু হয় ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে; তখন শুরু হয় তার ভেতরের স্তরে আলোড়ন, শক্ত হয় ভূত্বক, আর জলে ভ’র ওঠে সমুদ্রগুলো। ৬০০ মিলিয়ন বা ৬০ কোটি বছর আগে শুরু হয় পৃথিবীর চতুর্থ পর্ব; এ-পর্বের বিকাশ এখনো চলছে।

গোলগাল পৃথিবীকে খুঁড়ে খুঁড়ে ভেতরের দিকে গেলে দেখা যায় পৃথিবী স্তরে স্তরে বিন্যস্ত, এর অভ্যন্তরে আছে স্তরের পরে স্তর; পৃথকীকরণরীতিতে গ’ড়ে উঠেছে পৃথিবীর শরীর । পৃথিবীর কেন্দ্রাঞ্চল ধাতব, আর ওপরের স্তরগুলোর চাপে বা ভারে তা হয়ে উঠেছে আরো ঘন। পৃথিবীর বাইর থেকে ভেতর পর্যন্ত আছে তিনটি স্তর; এগুলোর মধ্যে কেন্দ্রে আছে সবচেয়ে ঘন বস্তুরাশি আর বাইরে আছে সবচেয়ে কম ঘন বস্তুরাশি। পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়ঃ অন্তস্তরঃ কোর, গুরুস্তরঃ ম্যান্টল, আর ভূত্বকঃ ক্রাস্ট। অন্তস্তর পৃথিবীর কেন্দ্রাঞ্চল, এটি ছড়িয়ে আছে কেন্দ্র থেকে পৃথিবীর বাইরের স্তরের অর্ধেক দূরত্ব জুড়ে। এটি গঠিত প্রধানত লোহা ও নিকেলে । অন্তস্তরের ওপরে আছে ২৯০০-কিমি পুরু গুরুস্তর; এটি গঠিত প্রধানত লোহা ও ম্যাগ্নেশিয়ামের মিশ্রণে গঠিত শিলায়। গুরুস্তরের আবরণের মতো আছে পৃথিবীর বাইরের স্তর- ভূত্বক । ভূত্বক ১৬ থেকে ৪০ কিমি পুরু। ভূত্বকের পদার্থরাশি সাধারণত গ’ড়ে উঠেছে আগ্নেয় শিলায়। পৃথিবী যখন সৃষ্টি হচ্ছিলো, তখন তার ভেতরভাগ ছিলো অত্যন্ত গরম, তার ফলে বিভিন্ন পদার্থ ছিলো গলিত অবস্থায়; তখন লোহা ও নিকেলের মতো ঘন পদার্থগুলো গিয়ে জমে পৃথিবীর কেন্দ্রে, ওপরের দিকে থাকে সিলিকেটের মতো লঘু পদার্থরাশি।

ভূবিজ্ঞানীরা তেজস্ক্রিয় কালনির্ণয়রীতিতেঃ রেডিওঅ্যাক্টিভ ডেটিং পদ্ধতিতে হিশেব ক’রে দেখেছেন যে পৃথিবীর বয়স এখন ৪.৬ বিলিয়ন বছর। পৃথিবীর বাইরের স্তরে সবচেয়ে প্রাচীন যে-শিলা পাওয়া গেছে, তার অবশ্য এতো বয়স নয়; পশ্চিম গ্রিনল্যান্ডে পাওয়া গেছে সবচেয়ে বয়স্ক শিলা, তার বয়স মোটামুটি ৪ বিলিয়ন অর্থাৎ ৪০০ কোটি বছর । এ-শিলা আদিতে ছিলো গলিত, পরে শীতল হয়ে পরিণত হয়েছে আগ্নেয় শিলায় । উল্কাপিণ্ডের বয়স হিশেব ক’রে দেখা গেছে তার বয়স ৪.৫৫ বিলিয়ন বছর, চন্দ্রশিলার বয়স ৪.৬ বিলিয়ন বছর; পৃথিবীর বয়সও তাই এমনই হবে। এগুলোর বয়সের মধ্যে যে-সমতা দেখা যায়, তাতে মনে করতে পারি যে সৌরজগত সৃষ্টি হয়েছিলো ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে।

পৃথিবীর অভিকর্ষ আছে, পৃথিবীর আভিকর্ষিক ক্ষেত্র পৃথিবী ছাড়িয়ে চাঁদকে পেরিয়ে গেছে; এবং পৃথিবীর আছে এক চৌম্বক ক্ষেত্র। চৌম্বক ক্ষেত্রটি ধরা পড়ে এ থেকে যে পৃথিবীতে কম্পাসের কাঁটা থাকে মোটামুটিভাবে উত্তর মেরুর অভিমুখে। কাঁটা ঠিক সত্যিকার উত্তর মেরুর অভিমুখে থাকে না, থাকে উত্তর চৌম্বক মেরুর দিকে, পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে ২০ ডিগ্রি পশ্চিমে। পৃথিবীর চৌম্বক মেরু বছরে বছরে কিছুটা স’রে যায়, এখন আছে ক্যানাডার উত্তরে উত্তর মেরুর দ্বীপপুঞ্জে; আর এর তীব্রতাও বাড়ে কমে। গত ৩.৫ মিলিয়ন বছরে পৃথিবীর চৌম্বক মেরুের সম্পূর্ণ বদল ঘটেছে ৯ বার; উত্তর মেরু হয়েছে দক্ষিণ মেরু, দক্ষিণ মেরু হয়েছে উত্তর মেরু। কী আছে পৃথিবীর চুম্বকত্বের মূলে? এর মূলে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগের লোহা ও নিকেলের স্তরটি। এটি একটি গলিত স্তর, এটি সৃষ্টি করতে পারে বিদ্যুৎপ্রবাহ। এটি একটি বিশাল ডায়নামো ও চুম্বকের মতো সৃষ্টি করে বিদ্যুৎ, তাতে তৈরি হয় চৌম্বক ক্ষেত্র। পৃথিবীর দৈনিক ঘূর্ণন উত্তেজিত ক’রে তোলে ভেতরের বিদ্যুৎপ্রবাহকে।

পৃথিবীকে আবৃত ক’রে আছে তার সুখকর বায়ুমণ্ডল। এর থেকে পাই আমরা নিশ্বাসপ্রশ্বাসের অম্লজান, এটি প্রতিরোধ করে সূর্যের ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, আর চাদরের মতো ঢেকে পৃথিবীকে রাখে উষ্ণ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আছে ৭৮% ভাগ নাইট্রোজেন, ২১% ভাগ অক্সিজেন বা অম্লজান, ০.৯% ভাগ আরগন, ০.০৩% ভাগ কার্বন ডাইঅক্সাইড, আর সামান্য নিয়ন, হিলিয়াম বা সূৰ্যক বা সৌরক, হাইড্রোজেন, মিথেন প্রভৃতি।

বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরগুলো নিচের স্তরগুলোর থেকে লঘু; ওপরের স্তরগুলোর চাপে ঘন হয়ে উঠেছে নিচের স্তরগুলো। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এক ধারাবাহিক ব্যাপার, তবে একে ভাগ করা হয় চারটি প্রধান মণ্ডলেঃ উষ্ণমণ্ডলঃ ট্রোপোস্ফেয়ার, অনুভূমিক মণ্ডলঃ স্ট্র্যাটোস্ফেয়ার, মেসোমণ্ডল মেসোস্ফেয়ার, ও তাপমণ্ডলঃ থার্মোস্ফেয়ার । বায়ুমণ্ডলগুলোর মধ্যে সবেচেয়ে নিচের মণ্ডল হচ্ছে উষ্ণমণ্ডল, এটা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর মাটি-জল থেকে ৮ থেকে ১০ কিমি ওপর পর্যন্ত; এ-মণ্ডলের যতোই ওপরে ওঠা যায় ততোই কমতে থাকে উষ্ণতা । এ-মণ্ডলেই উৎপন্ন হয় মেঘবৃষ্টিঝড়; এর ওপরের সীমানার জন্যেই ঘটে তারার ঝিকিমিকি। উষ্ণমণ্ডলের ওপরে ৫০ কিমি ওপর জুড়ে আছে অনুভূমিক মণ্ডল। উষ্ণমণ্ডলে বায়ু প্রবাহিত হয় খাড়াভাবে, আর এ-মণ্ডলে বায়ু অনুভূমিকভাবে প্রবাহিত হয় ব’লেই এর নাম স্ট্র্যাটোস্ফেয়ার বা অনুভূমিক মণ্ডল। অনুভূমিক মণ্ডলে আছে ওজোনস্তর । ওজোনস্তরের কাজ হচ্ছে সূর্যের অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয় বিকিরণ রোধ করা; আর এ-বিকিরণ রোধ করা হয়েছে ব’লেই পৃথিবীতে বিকাশ ঘটেছে প্রাণের । মেসোস্ফেয়ার ও তাপমণ্ডলের মাঝখানে, ৭৫ থেকে ৭০০ কিমি ওপরে, আছে আয়নমণ্ডল নামে একটি এলাকা । এ-মণ্ডলটি আছে ব’লেই পৃথিবীতে বেতার যোগাযোগ সম্ভব হয়, নইলে বেতার তরঙ্গ সরাসরি মহাশূন্যে মিলিয়ে যেতো । মেসোমণ্ডলে তাপ হ্রাস পায়, আবার বাড়ে তাপমণ্ডলে । সব গ্রহ ও উপগ্রহ জ্যোতি ছড়ায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে; পৃথিবীকেও মহাশূন্য থেকে একটি উজ্জ্বল আলোর গোলক মনে হয় । গ্রহ-উপগ্রহের আলো প্রতিফলনের শক্তিকে বলা হয় অ্যালবেডো। পৃথিবীর মেঘমণ্ডল প্রতিফলিত করে সূর্যের আলো; মোটামুটিভাবে সূর্যের ৩৫ ভাগ আলো প্রতিফলিত হয়ে আবার শূন্যে ফেরত যায়। বায়ুমণ্ডল আর পৃথিবীর তল শুষে নেয় বাকি ৬৫ ভাগ আলো।

পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন ঘটে; ঋতুতে ঋতুতে বদলে যায় তা পৃথিবীর রূপ পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন ঘটে সূর্যের চারদিকে বার্ষিক গতির ফলে। পৃথিবীর মেরুদণ্ড কক্ষপথের ওপর লম্বভাবে দাঁড়ানো নয়, এটি হেলে আছে ২৩১/২ ডিগ্রি; তাই পৃথিবী যখন সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে, তখন বিষুবরেখার উত্তর ও দক্ষিণের অঞ্চলগুলোতে সূর্যের তাপের ভিন্নতা ঘটে। পৃথিবীর উত্তর মেরু যখন হেলে থাকে সূর্যের দিকে, তখন গ্রীষ্মকাল আসে উত্তর গোলার্ধে; আর উত্তর মেরু যখন হেলে দূরে থাকে সূর্যের থেকে, তখন উত্তর গোলার্ধে ঘটে শীতকাল । পৃথিবী যেহেতু তার কক্ষপথের ওপর ২৩১/২ ডিগ্রি হেলে থাকে, তাই সূর্য পৃথিবীর বিষুবরেখার ২৩১/২ ডিগ্রি উত্তর ও দক্ষিণে মাথার ওপরে থেকে সরাসরি আলো দিতে পারে; এ-অঞ্চলকে বলা হয় গ্রীষ্মমণ্ডল। গ্রীষ্মমণ্ডলের বাইরের এলাকায় সূর্য মাথার ওপর থেকে সরাসরি তাপ দিতে পারে না ।

২১/২২ জুনের দিকে পৃথিবীর উত্তর মেরু হেলে থাকে সূর্যের সবচেয়ে কাছে, একে বলা হয় উত্তরায়ণ বা উত্তর অয়নান্ত বা কর্কট ক্রান্তিঃ সামার সোলস্টিস। এ-সময়ে ২৩১/২ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে দুপুরবেলা সূর্য থাকে মাথার ওপর; এটাই হচ্ছে সূর্যের সর্বাধিক উত্তরে অবস্থান। উত্তরায়ণের দিনে সারা উত্তর মেরুবৃত্তে – 23½ ডিগ্রি দক্ষিণ পর্যন্ত সারাদিন পড়ে সূর্যের আলো; তাই চব্বিশ ঘণ্টার দিন হয় সেখানে। এ-সময়ে দক্ষিণ মেরুবৃত্তে আলো পড়ে না ব’লে চব্বিশ ঘণ্টা ধ’রে থাকে রাত । উত্তরায়ণের পর উত্তর মেরুতে ধারাবাহিক দিন হয় ৬ মাস ধরে। ২১/২২ ডিসেম্বরের দিকে সূর্যের দিকে সবচেয়ে বেশি হেলে থাকে দক্ষিণ মেরু; একে বলা হয় দক্ষিণায়ন বা দক্ষিণ অয়নান্ত বা মকর ক্রান্তি : উইন্টার সোলস্টিস । এ-সময়ে ২৩১/২ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশে দুপুরবেলা সূর্য থাকে মাথার ওপর; এটাই হচ্ছে সূর্যের সর্বাধিক দক্ষিণে অবস্থান। দক্ষিণায়নের দিনে সারা দক্ষিণ মেরুবৃত্তে 23½ ডিগ্রি উত্তর পর্যন্ত সারাদিন পড়ে সূর্যের আলো; তাই চব্বিশ ঘণ্টার দিন হয় সেখানে ৷ পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলে সূর্য একবার স’রে যায় বিষুবরেখার উত্তরে, একবার স’রে যায় বিষুবরেখার দক্ষিণে । ২১ মার্চে সূর্য বিষুবরেখা পেরিয়ে যেতে শুরু করে উত্তরে, একে বলা হয় বসন্তবিষুব বা মহাবিষুব : ভেরনাল ইকুইনোক্স; আবার ২১ সেপ্টেম্বর সূর্য বিষুবরেখা পেরিয়ে যেতে শুরু করে দক্ষিণে, একে বলা হয় শারদবিষুব বা জলবিষুব : অটমনাল ইকুইনোক্স। এ-দু দিন উত্তর আর দক্ষিণ গোলার্ধে দিনরাত সমান হয়।

পৃথিবীর ওপরভাগে আছে এক কঠিন শিলামণ্ডল, তার নিচে আছে একটি তরল লঘু শিলামণ্ডল । শিলামণ্ডলে আলোড়নের ফলে পৃথিবীতে ঘটে ভূমিকম্প, সৃষ্টি হয় পাহাড়পর্বত। পৃথিবীর লঘুমণ্ডলের চাপে ওপরের কঠিন শিলামণ্ডলে মহাদেশের মতো বিশাল এলাকা জুড়ে ফাটল ধরে, একে বলা হয় প্লেট। লঘুমণ্ডলের আলোড়নের ফলে তার ওপরে ভাসমান প্লেটগুলো এদিকে-সেদিকে স’রে যায়, ধাক্কা লাগে পরস্পরের সাথে। প্লেটগুলোর ধারে যে-সব ফাটল থাকে, সেখানেই অবস্থিত সাধারণত অগ্নিগিরিগুলো, আর সেখানেই ঘটে ভূমিকম্প । আমেরিকি মহাদেশীয় প্লেটের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের সংঘর্ষে জন্মেছে সিয়েরা নেভাডা ও অ্যান্ডেজ পর্বতমালা। ভারতবর্ষ অবস্থিত যে-প্লেটের ওপর, সেটি হাজার হাজার বছর আগে উত্তর দিকে স’রে গিয়ে সংঘর্ষে পড়েছিলো এশীয় প্লেটের সাথে; তার ফলে সৃষ্টি হয়েছিলো হিমালয় পর্বতমালা। একটা ধর্মে বলা হয় যখন বিধাতা বানায় পৃথিবী, তখন পৃথিবী কাঁপছিলো থরথর ক’রে; তাই পৃথিবীকে স্থির করার জন্যে বিধাতা পাহাড়পর্বত তৈরি ক’রে পেরেকের মতো গেঁথে দেয়! এটা শুধু ভুল নয়, বদ্ধপ্রলাপ; পাহাড়পর্বত এমন হাস্যকর রীতিকে তৈরি হয় নি।

পৃথিবীতে আছে জলভরা বহু সাগর, যা নেই আর কোনো গ্রহে। কোটি কোটি বছরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও সাগরগুলো বদলে গেছে নানাভাবে, আর প্রভাবিত করেছে পৃথিবীর জৈববিবর্তনকে। যখন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিলো, ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে, তখন সম্ভবত পৃথিবীতে সাগর ছিলো না। সেই আদিপৃথিবী ছিলো প্রচণ্ড উত্তপ্ত, তার তাপমাত্রা ছিলো কয়েক হাজার কেলভিন; তাই সেখানে তরল জলের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা যখন ক’মে ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ৩৭৩ কেলভিনে নামে, তখন সম্ভবত জমে জল । তখন সম্ভবত ছিলো একটি কি দুটি মহাদেশ; বাকি অংশে ছিলো সামান্য জল। পরে সমুদ্রের জল আসে পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে । পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগের তরল শিলাকে বলা হয় ম্যাগমা; ওই ম্যাগমা যখন ভূত্বক ভেদ ক’রে ওঠে, তখন তার সাথে ওঠে বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্প । এই বাষ্প আটকে যায় পৃথিবীর ওপরস্তরে । এখন বছরে পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে জল বেরিয়ে আসে ১০১১ গ্রাম; ৪.৫ বিলিয়ন বছর ধ’রে এ-হারে জল বেরিয়ে এসেই ভ’রে তুলেছে সমুদ্রগুলো। সমুদ্রগুলো এখন পৃথিবীর ৭১% ভাগ স্থান অধিকার ক’রে আছে; আর এগুলোর গড় গভীরতা ৪ কিমি । সব মিলে সমুদ্রগুলোতে আছে ১০২১ কেজি বস্তু, যার বেশির ভাগই জল।

মহাবিশ্বে শুধু পৃথিবীতেই আছে প্রাণ, প্রাণী ও মানুষ। অন্য কোনো গ্রহে প্রাণ, বুদ্ধিমান প্রাণী, থাকতেও পারে; তবে মানুষ থাকার কোনো সম্ভাবনা একেবারেই নেই; সেখানে বাঘ থাকলেও সে বাঘ পৃথিবীর বাঘের মতো হবে না। আমরা বিকশিত হয়েছি পৃথিবীর বিশেষ পরিস্থিতিতে ও সূত্রে; কোনো বিধাতা আমাদের তৈরি ক’রে এখানে পাঠিয়ে দেয় নি। পৃথিবীতে অপ্রাণ বস্তু থেকে রাসায়নিক ও জৈব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে বিভিন্ন প্রাণী ও মানুষ । মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের উদ্ভবের রীতি আলোচনা করছি না; শুধু ভূতাত্ত্বিক কোন কালপর্বে কী উদ্ভূত হয়েছে, তার কিছু সংবাদ দিচ্ছি। পৃথিবী উদ্ভূত হয়েছিলো ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে; কিন্তু প্রাণের উৎপত্তি হ’তে লেগেছে অতি দীর্ঘ সময়। সম্ভবত ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে দেখা দিয়েছিলো উদ্ভিদ, ৪৬০ মিলিয়ন বছর আগে দেখা দিয়েছিলো মাছ, ২৮০ মিলিয়ন বছর আগে সরীসৃপ ও পতঙ্গ, ২৩৯ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসর, ১৮১ মিলিয়ন বছর আগে পাখি, ৬৩ মিলিয়ন বছর আগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো ডাইনোসররা, ৫৮ মিলিয়ন বছর আগে দেখা দিয়েছিলো স্তন্যপায়ীরা, ২ থেকে ৪ মিলিয়ন বছর আগে দেখা দেয় মানুষ । পৃথিবীর সমগ্র ইতিহাসকে এক বছরে সংহত করলে দেখা যায় প্রাণের সঞ্চার ঘটে মার্চ মাসে, কিন্তু বিকশিত হয়ে সমুদ্র থেকে স্থলভাগে উঠে আসতে নভেম্বর শেষ হয়ে আসে।

সূর্যের পরেই পৃথিবীর আকাশের বিখ্যাত বস্তু চাঁদ। চাঁদ, পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ, কোনো স্বৰ্গীয় পবিত্র বস্তু নয়; কিন্তু জ্যোৎস্নার জন্যে এটি সূর্যের থেকেও বেশি আলোড়িত করেছে মানুষকে। চাঁদের অনেক নাম : চন্দ্র, ইন্দু, বিধু, শশী, শশাঙ্ক, সুধাংশু, মৃগাঙ্ক, হিমাংশু, শীতাংশু, নিশাকর, নিশাপতি, নক্ষত্রেশ, রজনীকান্ত, তারানাথ, সোম, সুধাময়, রেবতীরমণ, ও আরো অনেক । এ-চাঁদ দেখেছে মহাদেশগুলোর বিচ্ছিন্ন হওয়া, জ্বলেছে ডাইনোসরদের চোখে, উজ্জ্বল করেছে আদিমানুষদের রাতগুলো; এ-চাঁদ দেখেছেন হোমার, হিপ্পারকাস, কালিদাস, টলেমি, আরিস্তারকাস, গ্যালিলিও, নিউটন । আজ চাঁদের গায়ে পড়েছে একটি ভিন্ন ছাপ, স্থির হয়ে আছে মানুষের পদচিহ্ন। আরিস্ততলের বিশুদ্ধ এলাকায় পড়েছে অশুদ্ধ মানুষের জুতোর দাগ। কোনো কোনো ধর্মীয় পুরাণে চাঁদ অতি পবিত্র; কিন্তু চাঁদ আমাদের উঠোনের মাটির থেকে একটুও বেশি একটুও কম পবিত্র নয় । চাঁদে পানি নেই, বায়ুমণ্ডল নেই, নীল আকাশ নেই, মেঘ নেই, জীবন নেই। চাঁদ এক নিষ্প্রাণ মৃত এলাকা; তাকে ঘিরে আছে মহাজাগতিক নির্জনতা।

চাঁদ, পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ, ঘুরছে পৃথিবীকে ঘিরে। চাঁদ শব্দটি দিয়ে উপগ্রহও বোঝাতে পারি, বলতে পারি মঙ্গলের আছে দুটি চাঁদ- ফোবোস ও ডিমোস । চাঁদের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ১/৪ ভাগ, ৩৪৭৬ কিমি; পৃথিবী থেকে এর গড়দূরত্ব ৩৮৪,৪০১ কিমি, ২৪০,০০০ মাইল, নিকটতম দূরত্ব ৩৬৩,২৯৭ কিমি, দূরতম দূরত্ব ৪০৫,৫০৫ কিমি। চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে ২৭ দিন ৭ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ১২ সেকেন্ডে, তবে চান্দ্র মাস হয় ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ৩ সেকেন্ডে। চাঁদে একদিন হয় পৃথিবীর ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ৩ সেকেন্ডে। চাঁদ কক্ষপথের ওপর হেলে আছে ৬ ডিগ্রি ৪১ মিনিট। এটি নিজের অক্ষের ওপর একবার আবর্তিত হয় ২৭.৩২ দিনে। চাঁদের ভর ৭.৩৫১০২৫ গ্রাম; ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ৩.৩৪ গ্রাম; এর অভিকর্ষ ০.১৬৫ পার্থিব অভিকর্ষ; এর থেকে মুক্তির গতি প্রতি সেকেন্ডে ২.৪ কিমি; এর ওপরতলের তাপমাত্রা দিনের দিকে ৪০০ কেলভিন, অন্ধকার দিকে ১০০ কেলভিন; এর অ্যালবেডে- সূর্যের আলো প্রতিফলনের শক্তি- ০.০৭। পূর্ণিমার চাঁদ মাথার ওপর যতোটা বড়ো দেখায় তার চেয়ে অনেক বড়ো দেখায় যখন থাকে দিগন্তের কাছাকাছি। অনেকেই জানে না বাঁকা চাঁদের শিং দুটি থাকে কোন দিকে, আর কখন ওঠে পূর্ণিমার চাঁদ। শুক্লপক্ষে বাঁকা চাঁদের শিং থাকে সামনের দিকে, কৃষ্ণপক্ষে থাকে পেছনের দিকে; আর পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে সন্ধ্যাকালে মধ্যরাতে নয়।

চাঁদ থেকে পৃথিবীর দৃশ্য। পৃথিবী যাচ্ছে তার ভূকলার মধ্য দিয়ে। একে চাঁদ বলে মনে হ'তে পারে, কিন্তু এটি চাঁদ নয়, পৃথিবী । ছবিতে দেখা যাচ্ছে একাদশীর পৃথিবী। ছবিটি তুলেছেন অ্যাপোলো ৮-এর মহাশূন্যচারীরা চাঁদের চারদিকে ঘোরার সময়।

চাঁদ সৃষ্টি হয়েছিলো কীভাবে? চাঁদে মানুষ নামার আগে চাঁদের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রচলিত ছিলো তিনটি তত্ত্ব। একটি হচ্ছে পৃথিবীর বাইরের স্তরটি থেকে বস্তু ছড়িয়ে প’ড়ে গ’ড়ে উঠেছিলো চাঁদ। আরেকটি হচ্ছে উপচয়ের ফলে পৃথিবীর সৃষ্টির সময়ই গঠিত হয়েছিলো চাঁদ । আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে সৌরজগতের অন্য কোথাও উৎপন্ন হয়েছিলো চাঁদ, তারপর এক সময় পৃথিবী চাঁদকে আটকে ফেলে তার চারদিকের কক্ষপথে । এগুলোর প্রত্যেকটিই ত্রুটিপূর্ণ। এখন অনেকে মনে করেন যে পৃথিবী যখন গঠিত হচ্ছিলো, তখন মঙ্গলের সমান আকারের কোনো আন্তগ্রহ বস্তু আঘাত করেছিলো পৃথিবীকে, তার ফলে পৃথিবী ও আঘাতকারী বস্তুটির ওপরভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো তপ্ত বস্তুরাশি, যা জমাট বেঁধে গঠিত হয়েছিলো চাঁদ।

চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে ঘোরে, আর ঘোরে নিজের অক্ষের ওপর। চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে ঘোরে ব’লেই আমরা দেখি চাঁদের কলা বা আকৃতি । মনে করা যাক ০ দিনে চাঁদ পেরিয়ে যায় পৃথিবী ও সূর্যের বরাবর রেখাটি। এ-সময় চাঁদ থাকে সূর্যের মুখোমুখি, চাঁদের যে-দিকে আলো পড়ে সেটা আমরা দেখতে পাই না, তার অন্ধকার দিকটা থাকে পৃথিবীর দিকে । তাই চাঁদ দেখা যায় না এদিন। এদিন চাঁদের অমাবস্যা। এদিনকে বলা হয় নতুন চাঁদের দিন। দু-এক দিন পর চাঁদ স’রে যায় সূর্যের মুখোমুখি অবস্থান থেকে, তখন সন্ধ্যায় এক ঝিলিক দেখা যায় বাঁকা চাঁদ। ৭ দিনের দিন চাঁদ ৯০ ডিগ্রি স’রে যায় সূর্য থেকে; তখন দেখতে পাই অর্ধেক চাঁদ। এর পর চাঁদ বাড়তে থাকে, ১৪ বা ১৫ দিনের দিন চাঁদ অবস্থান করে সূর্যের বিপরীত দিকে, তখন তাকে দেখা যায় পূর্ণ আলোকিত। এদিনও চাঁদ আগের মতোই অর্ধেক আলোকিত থাকে, কিন্তু আমরা পৃথিবী থেকে গোলাকার চাঁদকে দেখি পূর্ণ আলোকিত । একে বলা হয় পূর্ণিমা । এদিন চাঁদ সন্ধ্যায় উঠে আকাশকে ভ’রে দেয় আলোতে। পূর্ণিমার পর শুরু হয় কৃষ্ণপক্ষ, ক্ষয় পেতে থাকে চাঁদ; তার কলা কমতে থাকে। কৃষ্ণপক্ষে মধ্যরাতের পর চাঁদ উঠতে থাকে । ২২ দিনের দিন চাঁদ পৌঁছে তার কক্ষের ৩/৪ পথে, এবং আলোকিত দেখায় চাঁদের অর্ধেক । ২৯ দিনের দিন চাঁদ আবার ফিরে আসে তার ০ দিনের বা অমাবস্যার বা নতুন চাঁদের অবস্থানে । তারার পটভূমিতে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে চাঁদের সময় লাগে ২৭.৩ দিন; একে বলা হয় চাঁদের নাক্ষত্রিক কাল : সিডেরিয়েল পিরিয়ড। এ-সময়ে পৃথিবী নিজের কক্ষপথে এগিয়ে যায় ২৭ ডিগ্রি; তাই সূর্যের পটভূমিতে নিজের কলা পূরণ করার জন্যে চাঁদকে পরিভ্রমণ করতে হয় এই অতিরিক্ত ২৭ ডিগ্রি । এটা চাঁদ-পূরণ করে ২৯.৫ দিনে বা ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট সেকেন্ডে । একে বলা হয় চান্দ্র মাস ৷

যখনই তাকাই চাঁদের দিকে, দেখতে পাই লাভায় গঠিত তার এক অন্ধকার অঞ্চল, যাকে আমরা বলি ‘চাঁদের বুড়ি’, পশ্চিমে বলে ‘চাঁদের লোক’ বা ‘চাঁদের নারী’ । পৃথিবী থেকে আমরা সব সময় চাঁদের একটি পিঠই দেখি, পেছনের পিঠটি কখনো দেখি না ৷ চাঁদ সব সময় আমাদের দিকে তার একটি মুখই তুলে ধ’রে রাখে, অন্য মুখটি দেখায় না। এর কারণ কী? এটা ১৬৮০ অব্দে ব্যাখ্যা করেন ফরাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানী জি ডি কাসিনি । চাঁদ একবার পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে যতোটা সময় নেয় ঠিক ততোটা সময়ই নেয় নিজের অক্ষের ওপর একবার আবর্তিত হ’তে । একে বলা হয় ‘সমাবর্তন’ : সিনক্রোনাস রোটেশন। চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে একবার ঘোরে নিজের অক্ষের ওপর । অনেক লেখক ব’লে থাকেন ‘চাঁদের চির-অন্ধকার দিক’-এর কথা। তাঁরা মনে করেন চাদের যে-দিকটি আমরা দেখতে পাই না, সেটি থাকে চির-অন্ধকারে। এটা ঠিক নয়, চিরঅন্ধকার দিক নেই । চাঁদ পৃথিবীর দিকে একটি পিঠ স্থির ক’রে রাখলেও সূর্যের দিকে একটি পিঠ স্থির ক’রে রাখে না। যে-দিকটা আমরা দেখতে পাই না সে-দিকেও পড়ে সূর্যের আলো, সে-দিকেও হয় দিনরাত।

চাঁদ থেকে বাড়ি ফেরা। অ্যাপোলো ১১-র মূলনভযান থেকে এ-ছবিটি তুলেছেন মাইকেল কলিন্স। চাঁদে ঘোরার পর নভোচারীরা চন্দ্রযানে উঠে ফিরে আসছেন মূলনভোযানে, যাতে ক'রে তাঁরা যাত্রা করবেন ৪০০,০০০ কিমি দূরে আধো দৃশ্যমান পৃথিবীর অভিমুখে।

চাঁদের সমাবর্তনের জন্যে আমরা যে শুধু চাঁদের একটি পিঠ দেখি, তাই নয়; এজন্যে চাদের কাছের পিঠ থেকে সব সময়ই দেখা যায় পৃথিবীর একই অঞ্চল, মনে হয় পৃথিবীর একটি অঞ্চলই ঝুলে আছে চাঁদের আকাশে। চাঁদ যে একই পিঠ দেখায়, এটা কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়; এটা ঘটে অভিকর্ষের জন্যে। তবে আমরা চাঁদের অর্ধেক দেখতে পাই, তা নয়; বছরের পর বছর ধ’রে দেখলে আমরা দেখতে পাই চাঁদের ৫৯% ভাগ, কেননা চাঁদ ঘুরতে ঘুরতে তার শীর্ষ নাড়ায়। পৃথিবী-চাঁদ-সূর্যের সংশয়ের আভিকর্ষিক শক্তির ফলে ঘটে জোয়ারভাটা, এবং চাঁদ ও পৃথিবীর শরীরে স্ফীতি। পৃথিবীর অভিকর্ষের ফলে চাঁদের এক পিঠ সব সময় থাকে পৃথিবীর দিকে । শুধু চাঁদই নয়, সৌরজগতের সব উপগ্রহই তাদের মূলগ্রহের দিকে স্থির ক’রে রাখে একটি পিঠ।

৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে চাঁদ অনেক কাছে ছিলো পৃথিবীর, তারপর একটু একটু স’রে যেতে থাকে; এখনো খুব ধীরে দূরে স’রে যাচ্ছে। পৃথিবী তার অভিকর্ষ দিয়ে যেমন চাঁদের এক পিঠ স্থির ক’রে রেখেছে নিজের দিকে, তেমনি চাঁদও তার অভিকর্ষ দিয়ে গতি কমিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর আহ্নিক আবর্তনের । বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে যখন চাঁদ অনেক কাছে ছিলো পৃথিবীর, তখন পৃথিবী – আবর্তিত হতো দ্রুত; তার দিন হতো ৫ বা ৬ ঘণ্টায় । ২.৮ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে দিন হতো ১৭ ঘণ্টায় । পৃথিবীর দৈনিক আবর্তন কমছে, চাঁদ দূরে স’রে যাচ্ছে; একদিন পৃথিবীর অভিকর্ষ এতো ক’মে যাবে যে চাঁদ স’রে যাবে অনেক দূরে; এবং পৃথিবীকে ছেড়ে এটি ঘুরতে থাকবে সূর্যের চারদিকে।

সূর্যের চারদিকে ঘোরার আগে সূর্যের টানে পৃথিবীর দিন ও মাস হয়ে উঠবে সমান; তখন পৃথিবী ও চাঁদ উভয়েই সমাবর্তিত হবে। এক সময় পৃথিবীর দৈনিক আবর্তন এতো ক’মে যাবে যে দিন বড়ো হয়ে উঠবে মাসের থেকে; তখন চাঁদ এগিয়ে আসতে শুরু করবে পৃথিবীর দিকে। ১৮৫০ অব্দে এডওয়ার্ড রচ হিশেব ক’রে দেখিয়েছেন যদি কোনো বড়ো বস্তুর কাছাকাছি থাকে কোনো ছোটো বস্তু, তাহলে ছোটোটি চুরমার হয়ে যেতে পারে ভেঙেচুরে । এটা নির্ভর করে বহু কিছুর ওপর। চাঁদ পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে যখন পৌঁছবে ১৮,০০০ কিমির মধ্যে, তখন পৃথিবীর অভিকর্ষে এটি ভেঙেচুরে ঘুরতে থাকবে পৃথিবীকে ঘিরে।

১৬০৮ অব্দে দূরবিন আবিষ্কারের আগে মানুষ চাঁদে দেখেছে শুধু চাঁদের বুড়ি। অনেকে ভেবেছে চাঁদ তার জ্যোৎস্নার মতোই একটা ঘষামাজা মসৃণ সুন্দর রমণীয় এলাকা । প্রথম দূরবিন দিয়ে চাঁদ দেখেন টমাস হ্যারিয়ট (১৬০৯) ও গ্যালিলিও (১৬১০); তাঁরা দেখেন চাঁদ এক এবড়োখেবড়ো এলাকা; তার দিন ও রাতের সীমানার এলাকায় আছে বড়ো বড়ো গহ্বর ও পাহাড়। গ্যালিলিও লিখেছেন, চাঁদের ভূমি অবশ্যই মসৃণ নয়, তার ভূমি কর্কশ ও উচ্চাবচ। পরে উদ্ঘাটিত হয়েছে চাঁদের এলাকাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। চাঁদে উল্কাপাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছে বহু বিকট গহ্বর, যেগুলোর কোনো কোনোটির ব্যাস ১২০০ কিমি; আর আছে ছোটো ছোটো অনেক গর্ত। যে-এলাকাগুলোকে চাঁদের বুড়ির মতো অন্ধকার দেখায়, সেগুলোকে গ্যালিলিও সাগর ভেবে নাম দিয়েছিলেন ‘মারিয়া’ বা সাগর; তবে এগুলো সাগর নয়, কালো লাভার অঞ্চল। চাঁদের ১৫% ভাগ জুড়ে আছে এই লাভাঞ্চল । চাঁদের আলোকিত এলাকাগুলো হচ্ছে উল্কাপাতের ফলে গঠিত গহ্বর ও উচ্চাবচ উঁচু এলাকা।

চাঁদের বেশ যথাযথ মানচিত্র প্রথম তৈরি করেছিলেন ইয়োহানেস হেভেলিউস- ১৬৪৭ অব্দে । ১৬৫১ অব্দে ইতালীয় পুরোহিত রিকিওলি চাঁদের গহ্বরগুলোর নাম রাখতে শুরু করেন বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের নামানুসারে- যেমন, আরিস্তারকাস, কোপারনিকাস, টাইকো, প্লাতো প্রভৃতি। মারিয়াগুলোকে দেয়া হয় বেশ কাব্যিক নাম, যেমন- মারে ইমব্রিয়াম বা বৃষ্টির সাগর। চাঁদের পর্বতগুলোর নাম রাখা হয় পৃথিবীর পর্বতগুলোর নামানুসারে, যেমন, আস্ । চাঁদের পাহাড়গুলো গহ্বরের পার, ওগুলো বেঁকে ওঠা চাঁদস্তর নয়। আঠারো ও উনিশ শতকের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গভীর আগ্রহের সাথে পাঠ করেছিলেন চাঁদকে সেখানে অভাবিত কিছু পাবেন ব’লে। তাঁরা দেখতে পান চাঁদে নতুন কিছু ঘটছে না, কোনো অগ্ন্যুৎপাত নেই, নতুন গহ্বর নেই, উঠছে না কোনো কৃত্রিম জিনিশ। ১৬৪৯ অব্দে প্রথম ছবি তোলা –হয় চাঁদের; দেখা যায় সবই পুরোনো, কোনো পরিবর্তন নেই সেখানে। সেখানে—নতুন কিছু আবিষ্কারের নেই ব’লে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন চাঁদে; তাঁদের কাছে চাঁদ হয়ে ওঠে মহাশূন্যে উড্ডীন একটি নির্জীব ময়লার টুকরো।

মহাশূন্যে মানুষের প্রথম দীর্ঘ পদক্ষেপ চাঁদে অবতরণ; মানুষ এর আগে এতো দূরে যায় নি, পরে আরো বহু দূরে যাবে। মহাশূন্য যুগের সূচনা ঘটে ৪ অক্টোবর ১৯৫৭ অব্দে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম উৎক্ষেপণ করে মহাশূন্যযান স্পুটনিক ১। মানুষের তৈরি যে-নভোযানটি প্রথম চাঁদে পৌঁছে, সেটিও সোভিয়েত ইউনিয়নের; ১৯৫৯ অব্দে সেটি গিয়ে ভেঙে পড়ে চাঁদে। মার্কিন নভযান রেঞ্জার ৭ তোলে চাঁদের প্রথম নিকট ছবি; তাতে দেখা যায় চাঁদের ওপরতল ঢেকে আছে গুঁড়োমাটিতে, সেখানে ছড়িয়ে আছে পাথরের খণ্ড, ও নানা আকারের গহ্বর। চাঁদে ছড়ানো গুঁড়োমাটিকে বলা হয় শিলাস্তর : রেগোলিথ। চাঁদে প্রথম নভচারীসহ অবতরণ করে মার্কিন নভযান অ্যাপোলো ১১; ১৬ জুলাই ১৯৬৯-এ যাত্রা ক’রে চাঁদের মারে ট্র্যাংঙ্কুইলিটাটিস বা প্রশান্ত সাগরে নামে ২০ জুলাই ১৯৬৯-এ। চাঁদে প্রথম নেমেছিলেন নিল আর্মস্ট্রং, তিনি চাঁদে প্রথম মানুষ; তারপর নেমেছিলেন বাজ অ্যালড্রিন। তাঁদের সঙ্গী ছিলেন মাইকেল কলিন্স; তিনি নামেন নি, চালিয়েছিলেন মূল নভযানটি। এর পর আরো ৫ বার, ১৮ নভেম্বর ১৯৬৯ থেকে ১১ ডিসেম্বর ১৯৭২ পর্যন্ত, চাঁদে নামে ১২ জন মানুষ মার্কিন অ্যাপোলো ১২, অ্যাপোলো ১৪, অ্যাপোলো ১৫, অ্যাপোলো ১৬, অ্যাপোলো ১৭ নভযানে।

নভচারীরা সংগ্রহ করেছেন প্রচুর চন্দ্রশিলা; ওগুলো থেকে বোঝা যায় চাঁদের ওপরস্তর খুব প্রাচীন। চাঁদের বুড়ি বা মারিয়া এলাকা হচ্ছে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন বছর প্রাচীন ব্যাসাল্ট লাভার এলাকা। আলোকিত উঁচু এলাকাগুলো আরো পুরোনো, সৌরজগত যখন সৃষ্টি হচ্ছিলো ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে, তখনই সৃষ্টি হয়েছিলো এগুলো। চাঁদ থেকে যে-শিলাগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো ৪.৪ বিলিয়ন বছর থেকে ৩.২ বিলিয়ন বছর পুরোনো। পৃথিবীতে চান্দ্রশিলার মতো এতো পুরোনো শিলা নেই; এ-শিলা থেকে ধারণা করতে পারি পৃথিবীর বয়সের। শিলায় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে দীর্ঘ ইতিহাস; চাঁদের শিলায়ও লিপিবদ্ধ হয়ে আছে সৌরজগতের ইতিহাস । চাঁদের ও পৃথিবীর শিলার মধ্যে মিল আছে, তবে চাঁদে লোহার পরিমাণ কম। পৃথিবীর অভ্যন্তর যেমন স্তরবিন্যস্ত, চাঁদের অভ্যন্তর তেমন স্তরবিন্যস্ত নয়; চাঁদ সময় পায় নি পৃথিবীর মতো বিকশিত হওয়ার। চাঁদে গহ্বরগুলো তৈরি হয়েছিলো ৪ বিলিয়ন বছর আগে মহাশূন্যবস্তুর প্রচণ্ড আঘাতে। চাঁদ পৃথিবীর থেকে ছোটো ব’লে অনেক তাড়াতাড়ি শীতল হয়ে পড়েছিলো, তারপর থেকে মৃত নির্জীব স্তব্ধ হয়ে আছে। চাঁদের কোনো চৌম্বক ক্ষেত্র নেই, এর অর্থ হচ্ছে চাঁদের কেন্দ্রে তরল লোহা বেশি নেই । চাঁদে চন্দ্রকম্পনও ঘটে খুব কম, কেননা এটি এক নিষ্ক্রিয় নির্জীব নিস্পন্দ এলাকা। চাঁদ, প্রথমার ও পূর্ণিমায়, যতোই সুন্দর দেখাক, একটি করুণ মৃত জগত- মহাশূন্যে ভাসমান মৃতদেহ।

error: Content is protected !!