শ্লোকঃ ২০
ইতি গুহ্যতমং শাস্ত্রমিদমুক্তং ময়ানঘ ।
এতদ্ বুদ্ধা বুদ্ধিমান্ স্যাৎ কৃতকৃত্যশ্চ ভারত ॥ ২০ ॥
ইতি—এভাবেই; গুহ্যতমম্ — সবচেয়ে গোপনীয়; শাস্ত্রম— শাস্ত্র; ইদম্—এই; উক্তস্—কথিত হল, ময়া – আমার দ্বারা, অনঘ – হে নিষ্পাপ, এতৎ—এই: বুদ্ধা অবগত হয়ে; বুদ্ধিমান – বুদ্ধিমান; স্যাৎ— হন; কৃতকৃত্যঃ কৃতার্থ; চ—এবং; ভারত-হে ভারত।
গীতার গান
এই সে শাস্ত্রের গূঢ় মর্ম কথা শুন ।
তুমি সে নিষ্পাপ হও শুদ্ধ তব মন ॥
ইহা যে বুঝিল ভাগ্যে হল বুদ্ধিমান ।
হে ভারত ! কৃতকৃত্য সে হল মহান ॥
অনুবাদঃ হে নিষ্পাপ অর্জুন। হে ভারত! এভাবেই সবচেয়ে গোপনীয় শাস্ত্র আমি তোমার কাছে প্রকাশ করলাম। যিনি এই তত্ত্ব অবগত হয়েছেন, তিনি প্রকৃত বুদ্ধিমান ও কৃতার্থ হন।
তাৎপর্যঃ ভগবান এখানে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, এটিই হচ্ছে সমস্ত দিব্য শাস্ত্রের সারমর্ম এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবান যেভাবে তা দান করেছেন, ঠিক সেভাবেই তা উপলব্ধি করা উচিত। তার ফলে মানুষের বুদ্ধি বিকশিত হবে এবং সে পূর্ণরূপে দিব্য জ্ঞান উপলব্ধি করতে পারবে। পক্ষান্তরে বলা যায়, এই ভগবৎ-দর্শন উপলব্ধি করার ফলে এবং ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হওয়ার ফলে সকলেই জড়া প্রকৃতির গুণের কলুষতা থেকে মুক্ত হতে পারে। ভক্তিযোগ হচ্ছে পূর্ণ তত্ত্বজ্ঞান লাভের পন্থা। যেখানেই ভক্তিযোগ সাধিত হয়, সেখানে জড় জগতের কলুষতা থাকতে পারে না। অভিন্ন, কারণ তাঁরা চিন্ময়।
ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা এবং ভগবান এক ও ভগবানের সেবা অনুষ্ঠিত হয় পরমেশ্বর ভগবানের
অন্তরঙ্গা শক্তির মাধ্যমে। ভগবানকে বলা হয় সূর্যের মতো এবং তাজ্ঞানতা হচ্ছে অন্ধকার। যেখানে সূর্যালোকের প্রকাশ হয়, সেখানে অন্ধকারের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। তাই, সদ্গুরুর উপযুক্ত তত্ত্বাবধানে যখন ভক্তিযোগের অনুশীলন করা হয়, তখন অজ্ঞানতার কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না।
সকলেরই উচিত এই কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনে ব্রতী হওয়া এবং বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ও নির্মলতা প্রাপ্তির জন্য ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হওয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ কৃষ্ণ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করছে এবং ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হচ্ছে, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে সে যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, সে যথার্থ বুদ্ধিমান নয়।
এই শ্লোকে অর্জুনকে যে অন্য বলে সম্বোধন করা হয়েছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার অর্থ হচ্ছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ সব রকম পাপ থেকে মুক্ত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারা সম্ভব নয়। মানুষকে সব রকমের পাপের কলুষতা থেকে মুক্ত হতে হবে। তখনই কেবল সে উপলব্ধি করতে পারবে। কিন্তু ভক্তিযোগ এতই শুদ্ধ ও শক্তিশালী যে, কেউ যখন একবার ভগবৎ সেবায় নিযুক্ত হয়, তখন সে আপনা থেকেই সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যায়।
পূর্ণ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে শুদ্ধ ভক্তসঙ্গে যখন ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করা হয়, তখন কতকগুলি প্রতিবন্ধককে সম্পূর্ণভাবে পরভূত করার প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হৃদয়ের দুর্বলতা। প্রথম অধঃপতনের মূল কারণ হচ্ছে জড়া প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করার অভিলাষ। এভাবেই জীব পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমভক্তি পরিত্যাগ করে। হৃদয়ের দ্বিতীয় দুর্বলতা হচ্ছে জড় জগতের উপর আধিপত্য করার প্রবণতা। এই প্রবণতা যতই বৃদ্ধি পায়, ততই সে জড়ের প্রতি আসক্ত হয় এবং সে জড়ের উপর তার আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। এই হৃদয়ের দুর্বলতাগুলিই হচ্ছে জড় অস্তিত্বের কারণ। এই অধ্যায়ের প্রথম পাঁচটি শ্লোকে হৃদয়ের এই সমস্ত দুর্বলতা থেকে মানুষকে মুক্ত হওয়ার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে এবং এই অধ্যায়ের বাকি অংশে ষষ্ঠ শ্লোক থেকে শেষ পর্যন্ত পুরুষোত্তম-যোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ।
শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ৷।
ইতি—পরম পুরুষের যোগতত্ত্ব বিষয়ক ‘পুরুষোত্তম-যোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত ।