শ্লোকঃ ১৭
উত্তমঃ পুরুষস্তন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ
যো লোকত্ৰয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ ॥ ১৭ ॥
উত্তমঃ—উত্তম; পুরুষঃ—পুরুষ; তু—কিন্তু; অন্যঃ – অন্য; পরম- পরম; আত্মা— আত্মা; ইতি—এভাবে; উদাহৃতঃ বলা হয়; যঃ – যিনি; লোক — ভুবনে, ত্রয়ম্ তিন; আবিশ্য—প্রবিষ্ট হয়ে, বিভর্তি — পালন করছেন; অব্যয়: — অব্যয়, ঈশ্বরঃ—ঈশ্বর।
গীতার গান
তাহা হতে যে উত্তম পুরুষ প্রধান ।
ঈশ্বর সে পরমাত্মা থাকে সর্বস্থান ।।
অনুবাদঃ এই উভয় থেকে ভিন্ন উত্তম পুরুষকে বলা হয় পরমাত্মা, যিনি ঈশ্বর ও অব্যয় এবং ত্রিজগতের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে পালন করছেন।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকটির ধারণা কঠ উপনিষদ (২/২/১৩) ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৬/১৩) খুব সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বদ্ধ ও মুক্ত অনন্ত কোটি জীবের ঊর্ধ্বে হচ্ছেন পরম পুরুষ, যিনি হচ্ছেন পরমাত্মা। উপনিষদের শ্লোকটি হচ্ছে—নিতে নিআনাং চেতনশ্চেতনানাম্। এর তাৎপর্য হচ্ছে যে, বদ্ধ ও মুক্ত উভয় প্রকার জীবের মধ্যেই একজন পরম প্রাণময় পুরুষ রয়েছেন। তিনি হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান, যিনি তাদের প্রতিপালন করেন এবং তাদের ভিন্ন ভিন্ন কর্ম অনুসারে আনন্দ উপভোগ করবার সমস্ত সুযোগ সুবিধা দান করেন। সেই পরম পুরুষোত্তম ভগবান সকলের হৃদয়ে পরমাত্মা রূপে অবস্থান করেন। যে জ্ঞানী পুরুষ তাঁকে উপলব্ধি করতে পারেন, তিনিই কেবল যথার্থ শান্তি লাভের যোগ্য, অন্য কেউ নয়।
শ্লোকঃ ১৮
যস্মাৎ ক্ষরমতীতোহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ
অতোহস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ ।। ১৮ ৷।
যক্ষ্মাৎ- যেহেতু, ক্ষরম্—ক্ষরের, অতীতঃ – অতীত, অহম্ – আমি; অক্ষরাৎ- অক্ষর থেকে; অপি–ত; চ–এবং; উত্তমঃ— উত্তম; অতঃ– অতএব; অস্মি— হই; লোকে—জগতে, বেদে — বৈদিক শাস্ত্রে; চ–এবং; প্রথিতঃ — বিখ্যাত পুরুষোত্তমঃ —পুরুষোত্তম নামে ।
গীতার গান
ক্ষর বা অক্ষর হতে আমি সে উত্তম ।
অতএব ঘোষিত নাম পুরুষোত্তম ।।
অনুবাদঃ যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর থেকেও উত্তম, সেই হেতু জগতে ও বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত ।
তাৎপর্যঃ পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কেউই অতিক্রম করতে পারে না—বদ্ধ জীবেও না, মুক্ত জীবেও না। অতএব, তিনি হচ্ছেন পুরুষদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তম পুরুষ। এখন স্পষ্টভাবে এখানে বোঝা যাচ্ছে যে, জীব ও পরম পুরুষোত্তম ভগবান উভয়েই স্বতন্ত্র। পার্থক্যটি হচ্ছে যে, বদ্ধ অবস্থাতেই হোক অথবা মুক্ত অবস্থাতেই হোক, জীবেরা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের অচিন্তা শক্তিসমূহকে কোন পরিমাণেই অতিক্রম করতে পারে না। পরমেশ্বর ভগবান ও জীবকে সমপর্যায়ভুক্ত বা সর্বতোভাবে সমান বলে মনে করা ভুল। তাঁদের ব্যক্তিসত্তায় সর্বদাই ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনের প্রশ্ন থেকে যায়। উত্তম শব্দটি এখানে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। পরমেশ্বর ভগবানকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না।
লোকে কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে ‘পৌরুষ আগমে (স্মৃতিশাস্ত্র)। নিরুক্তি অভিধানে প্রতিপন্ন করা হয়েছে, লোকাতে বেদার্থেহিলেন— “ বেদের উদ্দেশ্য স্মৃতি শাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।”
পরমেশ্বর ভগবান তাঁর পরমাত্মারূপী প্রাদেশিক প্রকাশরূপে বেদেও বর্ণিত হয়েছেন। বেদে (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৮/১২/৩) নিম্নলিখিত শ্লোকটি উল্লেখ করা হয়েছে— তাবদ্যে সংগ্রসাদোহ স্মাচ্ছরীরাৎ সমুখায় পরং জ্যোতিরূপং সংপদ্য নে রূপেণাভিনিষ্পদ্যতে স উত্তমঃ পুরুষঃ। “দেহ থেকে বেরিয়ে এসে পরমাত্মা নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতিতে প্রবেশ করেন। তখন তিনি তাঁর চিন্ময় স্বরূপে অবস্থান করেন। সেই পরম ঈশ্বরকে বলা হয় পরম পুরুষ।” অর্থাৎ, পরম পুরুষ তাঁর চিন্ময় জ্যোতি প্রদর্শন ও বিকিরণ করেন, যা হচ্ছে পরম জ্যোতি। সেই পরম পুরুষোত্তমই পরমাত্মা রূপে সকলের হৃদয়ে বিরাজ করেন। সত্যবর্তী ও পরাশরের সন্তান ব্যাসদেব রূপে অবতীর্ণ হয়ে তিনি বৈদিক জ্ঞান দান করেছেন।
শ্লোকঃ ১৯
যো মামেবমসংমূঢ়ো জানাতি পুরুষোত্তমম্ ।
স সর্ববিদ ভজতি মাং সর্বভাবেন ভারত ॥ ১৯ ॥
যঃ– যিনি; মাম্—আমাকে; এব—এভাবে অসংমূঢ়ঃ— নিঃসন্দেহে; জানাতি- জানেন; পুরুষোত্তমম্—পরমেশ্বর ভগবান; সঃ— তিনি; সর্ববিৎ—সর্বজ্ঞ; ভজতি— ভজনা করেন; মাম্—আমাকে; সর্বভাবেন— সর্বতোভাবে, ভারত – হে ভারত।
গীতার গান
যে মোরে বুঝিল শ্রেষ্ঠ সে পুরুষোত্তম ।
সকল সন্দেহ ছাড়ি হইল উত্তম ৷।
সে জানিল সর্ব বেদ নির্মল হৃদয় ৷
হে ভারত! সর্বভাবে সে মোরে ভজয় ।।
অনুবাদঃ হে ভারত ! যিনি নিঃসন্দেহে আমাকে পুরুষোত্তম বলে জানেন, তিনি সর্বজ্ঞ এবং তিনি সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন।
তাৎপর্যঃ পরমতত্ত্ব ও জীবের স্বরূপ সম্বন্ধে নানা রকম দার্শনিক অনুমান আছে। এখন এই শ্লোকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, যিনি জানেন শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষ, তিনি প্রকৃতপক্ষে সর্বজ্ঞ। যে অনভিজ্ঞ, সে পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে কেবল অনুমানই করে চলে, কিন্তু যথার্থ জ্ঞানী তাঁর অমূল্য সময়ের অপচয় না করে সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তিতে নিজেকে নিযুক্ত করেন। সমগ্র ভগবদ্গীতায় সর্বত্রই এই তত্ত্বের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তবুও ভগবদ্গীতার বহু উদ্ধত হঠকারী ভাষ্যকারেরা মনে করে যে, পরমতত্ত্ব ও জীব এক ও অভিন্ন।
বৈদিক জ্ঞানকে বলা হয় শ্রুতি অর্থাৎ শ্রবণের মাধ্যমে শিক্ষা। প্রামাণিক সূত্র শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর প্রতিনিধির কাছ থেকেই কেবল বৈদিক জ্ঞান লাভ করা উচিত। এখানে শ্রীকৃষ্ণ খুব সুন্দরভাবে সব কিছুর পার্থক্য বর্ণনা করেছেন এবং এই সূত্র থেকে সকলেরই শ্রবণ করা উচিত। নির্বোধের মতো কেবল শ্রবণ করাই যথেষ্ট নয়, সাধু, গুরু, বৈষ্ণবের কৃপা লাভ করে তা উপলব্ধি করতে হবে। এমন নয়। যে, কেবল কেতাবি বিদ্যার উপর নির্ভর করে শুধুমাত্র অনুমান করলেই চলবে। বিনীতভাবে ভগবদ্গীতা থেকে শ্রবণ করতে হবে যে, জীব সর্বদাই পরম পুরুষ ভগবানের অধীন তত্ত্ব। পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বর্ণনা অনুসারে যিনি এই তত্ত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনিই বেদের যথার্থ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত হতে পেরেছেন, তা ছাড়া আর কেউই বেদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত নয়।
তজতি শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরমেশ্বর ভগবানের সেবা সম্পর্কে অনেক জায়গায় ভজতি শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে। কেউ যখন পূর্ণ কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভগবদ্ভক্তিতে নিযুক্ত হন, তখন বুঝতে হবে যে, তিনি ইতিমধ্যেই সমস্ত বৈদিক জ্ঞান উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বৈষ্ণব পরম্পরায় বলা হয় যে, কেউ যখন ভক্তিযোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত হন, তখন তাঁকে পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করার জন্য অন্য কোন আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া অনুশীলন করতে হয় না। তিনি ইতিমধ্যেই সেই স্তরে উপনীত হয়েছেন, কারণ তিনি ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত। তাঁর পক্ষে ভগবৎ-তত্ত্ব উপলব্ধির সব কয়টি প্রারম্ভিক প্রক্রিয়ার সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি শত সহস্র জীবন ধরে ভগবৎ-তত্ত্ব সম্বন্ধে কেবল অনুমান করে শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান রূপে উপলব্ধির পর্যায়ে উপনীত না হয় এবং তার শ্রীপাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করতে না পারে, তা হলে বহু বর্ষ ধরে তার যে এত সমস্ত অনুমান, তা কেবল সময়েরই অপচয় মাত্র।