শ্লোক ১৪
অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ ।
প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যরং চতুর্বিধম্ ॥ ১৪ ॥
অহম্—আমি; বৈশ্বানরঃ— জঠরাগ্নি; ভূত্বা হয়ে; প্রাণিনাম — প্রাণীগণের দেহ- দেহ, আশ্রিতঃ– আশ্রয় করে, প্রাণ প্রাণবায়ু, অপান – অপান বায়ু; সমাযুক্তঃ- সংযোগে; পচামি— পরিপাক করি; অন্নম্ খাদ্য; চতুর্বিধম্— চার প্রকার।
গীতার গান
আমি বৈশ্বানর হই দেহমাত্রে বসি ।
প্রাণাপান বায়ুযোগে ভক্ষ্য দ্রব্য কবি ।।
অনুবাদঃ আমি জঠরাগি রূপে প্রাণীগণের দেহ আশ্রয় করে প্রাণ ও অপান বায়ুর সংযোগে চার প্রকার খাদ্য পরিপাক করি।
তাৎপর্যঃ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, জঠরে এক রকমের অগ্নি আছে যা সমস্ত খাদ্যদ্রব্যকে হজম করতে সাহায্য করে। সেই অগ্নি যখন প্রজ্বলিত না থাকে, তখন ক্ষুধা থাকে না এবং সেই অগ্নি যখন ঠিকমতো জ্বলতে থাকে, তখন আমরা ক্ষুধার্ত হই। মাঝে মাঝে সেই অগ্নি যখন ঠিকমতো না জ্বলে, তখন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সে যাই হোক, এই অগ্নি হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতিনিধি। বৈদিক মন্ত্রেও (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৫/৯/১) প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান বা ব্রহ্ম অগ্নিরূপে উদরে অবস্থিত হয়ে সব রকমের খাদ্য বা পরিপাক করছেন (অয়মগ্নিবৈশ্বানরো যোহয়মন্ত পুরুষে যেনেদং অনং পচাতে)। সুতরাং, যেহেতু তিনি সব রকমের খাদ্যদ্রব্য পরিপাক করতে সাহায্য করছেন, তাই আহারের ব্যাপারেও জীব স্বাধীন নয়। পরমেশ্বর ভগবান যদি
পরিপাকের ব্যাপারে তাকে সাহায্য না করেন, তা হলে তার পক্ষে আহার করার কোন সম্ভাবনা থাকে না। এভাবেই তিনি খাদ্যশস্য উৎপাদন করেন এবং পরিপাক করেন এবং তার কৃপার প্রভাবে আমরা আমাদের জীবন উপভোগ করতে পারি। বেদান্তসূত্রেও (১/২/২৭ ) সেই কথা প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে, শব্দাদিভ্যোহতঃ প্রতিষ্ঠানাচ্চ—ভগবান শব্দের মধ্যে ও শরীরের মধ্যে, বায়ুতে এমন কি উদার পরিপাক শক্তিরূপে অধিষ্ঠিত। খাদ্যদ্রব্য চার প্রকারের—চর্ব্য, চোষ্য, লেহা ও পেয় এবং এই সব রকমের খাদ্যেরই পরিপাক করার শক্তি হচ্ছেন তিনি।
শ্লোকঃ ১৫
সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো
মত্তঃ স্মৃতিজ্ঞানমপোহনং চ ।
বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো
বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্ ।। ১৫ ৷।
সর্বস্য— সমস্ত জীবের; চ–এবং; অহম্—আমি: হৃদি – হৃদয়ে; সন্নিবিষ্টঃ- অবস্থিত, মত্তঃ—আমার থেকে, স্মৃতিঃ – স্মৃতি, জ্ঞানম্—জ্ঞান; অগোহস্- বিলোপ, চ—এবং; বেদৈঃ – বেদসমূহের দ্বারা; চ–ও; সর্বৈঃ- সমস্ত অহম্- আমি; এব—অবশ্যই; বেদ্যঃ – জ্ঞাতব্য; বেদান্তকৃৎ- বেদান্তকর্তা, বেদবিৎ- বেদজ; এর—অবশ্যই; চ—এবং, অহম্ — আমি ।
গীতার গান
সবার হৃদয়ে আমি, সন্নিবিষ্ট অন্তর্যামী,
আমা হতে স্মৃতি জ্ঞান মন ।
আমি সে জাগাই কারে, আমি সে ভুলাই তারে,
আমা হতে হয় অপোহন ।।
যত বেদ পৃথিবীতে, আমার সে তল্লাসেতে,
আমি হই সব বেদবেদ্য ।
আমি সে বেদান্তবিৎ, আমি সে বেদান্তকৃৎ,
বেদান্তের কথা শুন অদ্য ।।
অনুবাদঃ আমি সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত এবং আমার থেকেই স্মৃতি, জ্ঞান ও বিলোপ হয়। আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ ।
তাৎপর্যঃ ভগবান পরমাত্মারূপে সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করেন এবং তাঁর থেকে সমস্ত কর্মের সূচনা হয়। জীব তার পূর্ব জীবনের সব কথা ভুলে যায়, কিন্তু তাকে সমস্ত কর্মের সাক্ষী পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করে যেতে হয়। সুতরাং, তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে সে কর্ম করতে শুরু করে। সেই জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন ভগবান তাকে তা দান করেন। তিনি তাকে স্মৃতি দান করেন এবং তার পূর্ব জীবন সম্বন্ধে বিস্মৃতিও দান করেন। এভাবেই, ভগবান কেবল সর্বব্যাপ্তই নন, তিনি প্রতিটি জীবের অন্তরেও বিরাজমান। তিনি নানা রকম কর্মফল দান করেন। তিনি নির্বিশেষ ব্রহ্মরূপে, পরম পুরুষোত্তম ভগবান রূপে বা হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা রূপেই কেবল আরাধ্য নন, বেদের অবতাররূপেও তিনি আরাধ্য। বেদ মানুষকে সঠিক নির্দেশ প্রদান করে, যাতে তারা যথাযথভাবে তাদের জীবনকে গড়ে তুলতে পারে এবং তাদের প্রকৃত আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে পারে। বেদ পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে জ্ঞান দান করে এবং শ্রীকৃষ্ণ ব্যাসদের রূপে অবতীর্ণ হয়ে বেদান্তসূত্র প্রণয়ন করেন। ব্যাসদেবের বেদান্তসূত্রের ভাষা শ্রীমদ্ভাগবতই হচ্ছে বেদান্তসূত্রের যথার্থ তত্ত্ব-উপলব্ধি। পরমেশ্বর ভগবান এতই পূর্ণ যে, বন্ধ জীবের উদ্ধারের জন্য তিনি হচ্ছেন তার খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহকারী, পাচনকারী, তার কর্মের সাক্ষী, বেদরূপে তার জ্ঞান প্রদাতা এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণরূপে ভগবদ্গীতার শিক্ষক। তিনি বদ্ধ জীবাত্মার আরাধ্য। এভাবেই ভগবান সর্ব মঙ্গলময় এবং তিনি পরম দয়াময়।
অন্তঃপ্রবিষ্টঃ শাক্তা জনানাম্ । দেহ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে জীব সব কিছু ভুলে যায়। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সে আবার তার কর্ম শুরু করে। যদিও সে তার পূর্বজন্মের সব কথা ভুলে যায়, তবুও যেখানে সে তার কর্ম শেষ করেছিল, সেখান থেকে আবার শুরু করবার জন্য ভগবান তাকে বুদ্ধি দান করেন। সুতরাং, হৃদয়ে অবস্থিত পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে জীব যে কেবল জাগতিক সুখ-দুঃখ ভোগ করে তা নয়, তার কাছ থেকে বৈদিক জ্ঞান উপলব্ধি করার সুযোগও সে পায়। কেউ যদি বৈদিক জ্ঞান লাভে গভীরভাবে প্রয়াসী হয়, তা হলে শ্রীকৃষ্ণ তাকে উপযুক্ত বুদ্ধিও দান করেন। আমাদের উপলব্ধির জন্য কেন তিনি বৈদিক জ্ঞান দান করেছেন? কারণ, ব্যক্তিগতভাবে শ্রীকৃষ্ণকে জানা জীবের প্রয়োজন। বৈদিক শাস্ত্রে সেই সম্বন্ধে প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে— যোহসৌ সর্বৈবেদেশীয়তে। চতুর্বেদ থেকে শুরু করে বেদান্তসূত্র, উপনিষদ, পুরাণ আদি সমস্ত শাস্ত্রে পরমেশ্বর ভগবানের যশ কীর্তিত হয়েছে। বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান অনুশীলন করার ফলে, বৈদিক দর্শন আলোচনা করার ফলে এবং ভক্তিযোগে ভগবানের আরাধনা করার ফলে তাঁকে লাভ করা যায়। সুতরাং, বেদের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে জানা। বেদ আমাদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করার নির্দেশ দেয় এবং পথ প্রদর্শন করে। পরম পুরুষোত্তম ভগবান হচ্ছেন পরম লক্ষ্য। সেই কথা প্রতিপন্ন করে বেদান্তসূত্র (১/১/৪) বলছে— তৎ তু সমন্বয়াৎ। তিনটি পর্যায়ে পরিপূর্ণতা অর্জন করা যায়। বৈদিক শাস্ত্র উপলব্ধি করার মাধ্যমে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে নিত্য সম্পর্কের কথা জানতে পারা যায়, বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ভগবানের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় এবং অবশেষে জীবনের পরম লক্ষ্য পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে উপনীত হওয়া যায়। এই শ্লোকে বেদের উদ্দেশ্য, বেদের উপলব্ধি এবং বেদের লক্ষ্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
শ্লোকঃ ১৬
দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ ।
ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কূটস্থোহক্ষর উচ্যতে ॥ ১৬ ৷৷
দ্বৌ—দুই; ইমৌ—এই; পুরুষৌ—জীব; লোকে জগতে; ক্ষরঃ — বিনাশী; চ এবং; অক্ষরঃ—অবিনাশী; এব— অবশ্যই; চ–এবং ; ক্ষরঃ – বিনাশী, সর্বাণি — সমস্ত ভূতানি—জীব; কূটস্থঃ—একভাবে স্থিত; অক্ষরঃ —অবিনাশী; উচ্যতে বলা হয়।
গীতার গান
বদ্ধ মুক্ত পুরুষ সে হয় দ্বি-প্রকার ।
দুই নামে পরিচিত সে ক্ষর অক্ষর ।।
বদ্ধ জীব যত হয় তার ক্ষর নাম ।
অক্ষর কূটস্থ জীব নিত্য মুক্তধাম ৷।
অনুবাদঃ ক্ষর ও অক্ষর দুই প্রকার জীব রয়েছে। এই জড় জগতের সমস্ত জীবকে ক্ষর এবং চিৎ-জগতের সমস্ত জীবকে অক্ষর বলা হয়।
তাৎপর্যঃ পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, ব্যাসদেব রূপে অবতরণ করে ভগবান বেদান্তসূত্ৰ প্ৰণয়ন করেন। এখানে ভগবান সংক্ষেপে বেদান্তসূত্রের সারমর্ম বর্ণনা করেছেন। তিনি বলছেন যে, জীব যা সংখ্যায় অনন্ত, তাদের দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়— ক্ষর ও অক্ষর। জীব হচ্ছে ভগবানের সনাতন বিভিন্নাংশ। তারা যখন জড় জগতের সংস্পর্শে থাকে, তখন তাদের বলা হয় জীবভূত এবং সংস্কৃত ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কথাটির অর্থ হচ্ছে তারা ক্ষর। কিন্তু যাঁরা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে একাত্মভাবে যুক্ত, তাঁদের বলা হয় অক্ষর। একাত্মভাবে যুক্ত কথাটির অর্থ এই নয় যে, তাঁদের কোন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য্য নেই, কিন্তু তার অর্থ হচ্ছে যে, তাঁরা ভগবানের থেকে বিচ্ছিন্ন নন। সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে তাঁরা সকলেই মেনে নিয়েছেন। অবশ্য, চিৎ-জগতে সৃষ্টি বলে কিছু নেই, তবে বেদান্তসূত্রের বর্ণনা অনুসারে, পরম পুরুষোত্তম ভগবান হচ্ছেন সমস্ত সৃষ্টির উৎস, তাই সেই ধারণাই এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বর্ণনা অনুসারে দুই রকমের জীব আছে। বেদেও তার প্রমাণ আছে। সুতরাং, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহই নেই। যে সমস্ত জীব এই জগতে মন ও পঞ্চ ইন্দ্রিয় নিয়ে সংগ্রাম করছে, তাদের জড় দেহ আছে, যা তাদের বদ্ধ অবস্থায় প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। জীব যতক্ষণ বদ্ধ থাকে, জড়ের সংস্পর্শে আসার ফলে তার দেহের পরিবর্তন হয়। জড় দেহের পরিবর্তন হয়, তাই মনে হয় যেন জীবের পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু চিৎ-জগতে জড় পদার্থ দিয়ে শরীর তৈরি হয় না। তাই সেখানে কোন পরিবর্তন নেই। জড় জগতে জীবের ছয়টি পরিবর্তন হয়—জন্ম, বৃদ্ধি, স্থিতি, বংশবৃদ্ধি, ক্ষয় ও বিনাশ। এগুলি জড় শরীরের পরিবর্তন। কিন্তু চিৎ-জগতে দেহের কোন পরিবর্তন হয় না। সেখানে জরা নেই, জন্ম নেই এবং মৃত্যু নেই। সেখানে সব কিছুই একত্বভাবে অবস্থান করে। ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি — পিতামহ ব্রহ্মা থেকে শুরু করে একটি ছোট পিঁপড়ে পর্যন্ত যে এই জড় জগতের সংস্পর্শে এসেছে, তারা সকলেই দেহ পরিবর্তন করছে। তাই তারা সকলেই মর। চিৎ-জগতে সকলেই একত্বভাবে সর্বদা অক্ষর বা মুক্ত।