শ্লোকঃ ১১
যতন্তো যোগিনশ্চৈনং পশ্যন্ত্যাত্মন্যবস্থিতম্ ।
যতন্তোহপ্যকৃতাত্মানো নৈনং পশ্যন্ত্যচেতসঃ ॥ ১১॥
যতন্তঃ—যত্নশীল, যোগিনঃ – যোগিগণ, চ–ও, এনম্—এই; পশ্যস্তি—দর্শন করতে পারেন; আত্মনি—আত্মায়; অবস্থিতম্—অবস্থিত, যতন্তঃ– যত্নপরায়ণ হয়ে, অপি—ও; অকৃতাত্মানঃ— আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান রহিত; ন–না; এনম্—এই; পশান্তি— দেখতে পায়, অচেতসঃ – অবিবেকীগণ।
গীতার গান
কত যোগী বৈজ্ঞানিক চেষ্টা বহু করে ।
আত্মজ্ঞান অভাবেতে বৃথা ঘুরি মরে ।।
কিন্তু সেনা আত্মজ্ঞানী আত্মাবস্থিত ।
দেখিতে সমর্থ হয় শুদ্ধ অবহিত ।।
অনুবাদঃ আত্মজ্ঞানে অধিষ্ঠিত যত্নশীল যোগিগণ, এই তত্ত্ব দর্শন করতে পারেন। কিন্তু আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান রহিত অবিবেকীগণ যত্নপরায়ণ হয়েও এই তত্ত্ব অবগত হয় না।
তাৎপর্যঃ আত্মজ্ঞান লাভের প্রয়াসী বহু সাধক আছেন। কিন্তু যে আত্মজ্ঞান লাভ করেনি, সে জীবদেহে সমস্ত কিছুর পরিবর্তন কিভাবে হচ্ছে তা দেখতে পায় না। এই সূত্রে যোগিনঃ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। আধুনিক যুগে তথাকথিত অনেক যোগী আছে এবং তথাকথিত বহু যোগাশ্রম আছে। কিন্তু আত্ম-তত্ত্বজ্ঞানের ব্যাপারে তারা বাস্তবিকই অন্ধ। তারা কেবল এক ধরনের শরীরচর্চা প্রণালী সংক্রান্ত ব্যায়ামে অভ্যস্ত এবং দেহ যদি সুস্থ-সুন্দর থাকে, তা হলেই তারা সন্তুষ্ট হয়। এ ছাড়া আর অন্য কোন তথ্য তাদের জানা নেই। তাদের বলা হয় যতন্তোহ প্যকৃতাত্মানঃ । যদিও তারা তথাকথিত যোগ পন্থায় প্রচেষ্টা করছে, কিন্তু তারা তত্ত্বজ্ঞানী নয়। এই ধরনের লোকেরা আত্মার দেহান্তর সম্বন্ধে কিছুই বুঝতে পারে না। যাঁরা যথার্থ যোগপন্থা অনুসরণ করছেন, তারাই কেবল আত্মা, জগৎ ও পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, কৃষ্ণভাবনায় শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তিতে নিযুক্ত ভক্তিযোগীই কেবল উপলব্ধি করতে পারেন কিভাবে সব কিছু ঘটছে।
শ্লোকঃ ১২
যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ ভাসয়তেঽখিলম্ ।
যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তত্তেজো বিদ্ধি মামকম্ ॥ ১২ ৷৷
যৎ— যে, আদিত্যগতম্ –সূর্যস্থিত, তেজঃ– জ্যোতি, জগৎ – বিশ্বকে, ভাসয়তে— প্রকাশিত করে; অখিলম্ — সমগ্র; সৎ – যে, চন্দ্রমসি — চন্দ্রে; যৎ – যে; চ–৩; অগ্নী—অগ্নিতে; তৎ— সেই; তেজঃ– (তেজ; বিদ্ধি— জানবে; মামকম্ — আমার ।
গীতার গান
এই যে সূর্যের তেজ অখিল জগতে ৷
চন্দ্রের কিরণ কিংবা আছে ভালমতে ।।
আমার প্রভাব সেই আভাস সে হয় ।
আমি যাকে আলো দিই সে আনো পায় ।।
অনুবাদঃ সূর্যের যে জ্যোতি এবং চন্দ্র ও অগ্নির যে জ্যোতি সমগ্র জগতকে উদ্ভাসিত করে, তা আমারই তেজ বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ যারা নির্বোধ, তারা বুঝতে পারে না কিভাবে সব কিছু ঘটছে। ভগবান এখানে যা ব্যাখ্যা করেছেন, তা উপলব্ধি করার মাধ্যমেই যথার্থ জ্ঞানের সূচনা হয়। সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক শক্তি সকলেই দেখতে পায়। মানুষকে কেবল এটি বুঝতে চেষ্টা করতে হবে যে, সূর্যের উজ্জ্বল জ্যোতি, চন্দ্রের স্নিগ্ধ কিরণ, বৈদ্যুতিক আলোক ও অগ্নির দীপ্তি সবই আসছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের থেকে। জীবনের এই ভাবধারায়, কৃষ্ণভাবনার সূচনা এই জড় জগতে বদ্ধ জীবের প্রগতি অনেক অংশে নির্ভর করে। জীব অপরিহার্যরূপে পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য বিভিন্ন অংশ এবং এখানে তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন কিভাবে তারা তাদের আপন আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে পারে।
এই শ্লোকটির মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, সূর্য সমস্ত সৌরমণ্ডলকে আলোকিত করছে। অনেক অনেক ব্ৰহ্মাণ্ড আছে এবং সৌরমণ্ডল আছে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন সূর্য রয়েছে, চন্দ্র রয়েছে এবং গ্রহ রয়েছে। তবে প্রত্যেক ব্রহ্মাণ্ডে একটি মাত্র সূর্যই আছে। ভগবদ্গীতায় (১০/২১) বলা হয়েছে যে, চন্দ্র হচ্ছে নক্ষত্রদের মধ্যে অন্যতম (নক্ষত্রাণামহং শশী।। সূর্যরশ্মির প্রকাশ হয় চিদাকাশে ভগবানের চিন্ময় জ্যোতির প্রভাবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে মানুষের কার্যকলাপ বিন্যস্ত করা হয়েছে। আগুন জ্বালিয়ে তারা রান্না করে, আগুন জ্বালিয়ে তারা কারখানা চালায় ইত্যাদি। আগুনের সাহায্যে কত কিছু করা হয়, তাই সূর্যোদয়, অগ্নি ও চন্দ্রকিরণ জীবদের কাছে এত মনোরম। তাদের সাহায্য ব্যতীত জীব বেঁচে থাকতে পারে না। তাই কেউ যখন বুঝতে পারে যে, সূর্য, চন্দ্র, অগ্নির আলোক ও জ্যোতির উৎস হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তখন তার কৃষ্ণচেতনা শুরু হয়। চন্দ্র-কিরণের দ্বারা সমস্ত বনস্পতির পুষ্টিসাধন হয়। চন্দ্রকিরণ এতই মনোরম যে, মানুষ অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারে যে, তারা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপার ফলেই জীবন ধারণ করছে। তাঁর কৃপা ব্যতীত সূর্যের উদয় হতে পারে না, তাঁর কৃপা ব্যতীত চন্দ্রের প্রকাশ হতে পারে না, তাঁর কৃপা ব্যতীত অগ্নির প্রকাশ হতে পারে না এবং সূর্য, চন্দ্র ও অগ্নির সহায়তা ব্যতীত কেউই বাঁচতে পারে না। এই চিন্তাগুলি বদ্ধ জীবের কৃষ্ণচেতনা জাগিয়ে তোলে।
শ্লোকঃ ১৩
গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা ।
পুষ্ণামি চৌষধীঃ সর্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ ॥ ১৩॥
গাম্—পৃথিবীতে, আশ্যি — প্রবিষ্ট হয়ে, চ–ও, ভূতানি—জীবসমূহকে; ধারয়ামি—ধারণ করি; অহম্ — আমি; ওজসা— আমার শক্তির দ্বারা; পুষ্ণামি—পুষ্ট করছি; চ—এবং; ঔষধীঃ—ধান, যব আদি ওষধি; সর্বাঃ— সমস্ত; সোমঃ-চন্দ্র; ভূত্বা হয়ে, রসাত্মকঃ রসময়।
গীতার গান
এই যে পৃথিবী যথা বায়ুমধ্যে ভাসে ।
আমার সে শক্তি ধরে সবেতে প্রবেশে ।।
আমি সে ঔষধি যত পোষণ করিতে ।
চন্দ্ররূপে রশ্মিদান করি সে তাহাতে ।।
অনুবাদঃ আমি পৃথিবীতে প্রবিষ্ট হয়ে আমার শক্তির দ্বারা সমস্ত জীবদের ধারণ করি এবং রসাত্মক চন্দ্ররূপে খান, মব আদি ওষধি পুষ্ট করছি।
তাৎপর্যঃ ভগবানের শক্তির প্রভাবেই যে সমস্ত গ্রহগুলি মহাশূন্যে ভাসছে, তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। ভগবান প্রতিটি অণুতে, প্রতিটি গ্রহে এবং প্রতিটি জীবে প্রবিষ্ট হন। ব্রহ্মসংহিতাতে সেই সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের অংশরূপে পরমাত্মা গ্রহগুলিতে, ব্রহ্মাণ্ডে, জীবে, এমন কি অণুতে প্রবিষ্ট হন। সুতরাং, তিনি প্রবিষ্ট হন বলেই সব কিছু যথাযথভাবে প্রকাশিত হয়। দেহে যখন আত্মা থাকে, তখন মানুষ জলে ভেসে থাকতে পারে, কিন্তু আত্মা যখন এই দেহ থেকে চলে যায় এবং দেহটির যখন মৃত্যু হয়, তখন দেহটি ডুবে যায়। অবশ্যই সেটি যখন পরে পচে ফেঁপে-ফুলে ওঠে, তখন তা শুকনো খড়কুটা বা পাতার মতো ভাসতে থাকে, কিন্তু যেইমাত্র মানুষটির মৃত্যু হয়, সে তৎক্ষণাৎ জলে ডুবে যায়। তেমনই এই সমস্ত গ্রহগুলি মহাশূন্যে ভাসছে এবং তা সম্ভব হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের পরম শক্তি তাতে প্রবিষ্ট হয়েছে বলে। তাঁর শক্তি সমস্ত গ্রহগুলিকে এক মুঠো ধূলিকণার মতো ধারণ করে আছে। কেউ যদি এক মুঠো ধূলিকণা ধরে রাখে, তা হলে সেই ধূলিকণাগুলি পড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না, কিন্তু কেউ যদি সেগুলিকে বায়ুর মধ্যে নিক্ষেপ করে, তা হলে তা পড়ে যাবে। তেমনই, এই সমস্ত গ্রহগুলি যা মহাশূন্যে ভাসছে, তা প্রকৃতপক্ষে পরমেশ্বর ভগবানের বিশ্বরূপের মুষ্টিতে ধৃত। তার বীর্য ও শক্তির প্রভাবে স্থাবর-জঙ্গম সব কিছুই তাদের যথাস্থানে অবস্থিত থাকে। বৈদিক মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের জন্যই সূর্য আলোক দান করছে এবং গ্রহগুলি নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরে চলেছে। তিনি না হলে ধূলিকণার মতো সমস্ত গ্রহগুলি মহাশূন্যে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত এবং বিনাশ প্রাপ্ত হত। তেমনই, চন্দ্র যে সমস্ত বনস্পতির পুষ্টি সাধন করছে, তাও পরম পুরুষোত্তম ভগবানেরই জন্য। চন্দ্রের প্রভাবের ফলেই বনস্পতিরা সুস্বাদু হয়। চন্দ্রকিরণ ব্যতীত বনস্পতিরা না পারে বর্ধিত হতে, না পারে রসাল স্বাদযুক্ত হতে। মানব-সমাজ কর্ম করছে, আরাম উপভোগ করছে এবং আহার্যের স্বাদ উপভোগ করছে, পরমেশ্বর ভগবান সেগুলি সরবরাহ করছেন বলেই। তা না হলে মানুষ বাঁচতে পারত না। রসাত্মকঃ কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পরমেশ্বর ভগবানের প্রতিনিধি চন্দ্রের প্রভাবে সব কিছু সুস্বাদু হয়ে ওঠে।