শ্লোকঃ ৫

নির্মানমোহা জিতসঙ্গদোষা

অধ্যাত্মনিত্যা বিনিবৃত্তকামাঃ।

দ্বন্দৈর্বিমুক্তাঃ সুখদুঃখসংজ্ঞৈ-

গচ্ছন্ত্যমূঢ়াঃ পদমব্যয়ং তৎ ॥ ৫॥

নিঃ- শূন্য, মান অভিমান; মোহাঃ – মোহ; জিত – বিজিত, সম দোষাঃ — দোষ; অধ্যাত্ম – পারমার্থিক জ্ঞানে; নিত্যাঃ— নিত্যত্ব; বিনিবৃত্ত – বর্জিত কামাঃ—কামনা-বাসনা; স্বদৈঃ—দ্বন্দসমূহ থেকে; বিমুক্তাঃ—মুক্ত; সুখদুঃখ-সুখ ও দুঃখ; সংত্তৈরঃ—নামক, গচ্ছন্তি – লাভ করেন; অমূঢ়াঃ — মোহমুক্ত ব্যক্তিগণ পদ—পদ; অব্যয়ম্—নিত্য; তৎ-সেই।

গীতার গান

নিরভিমান নির্মোহ সঙ্গদোষে মুক্ত ৷

নিত্যানিত্য বুদ্ধি যার কামনা নিবৃত্ত ।।

সুখ দুঃখ দ্বন্দু মুক্ত জড় মুঢ় নয় ৷

বিধিজ্ঞ পুরুষ পায় সে পদ অব্যয় ।।

অনুবাদঃ যাঁরা অভিমান ও মোহশূন্য, সঙ্গদোষ রহিত, নিত্য-অনিত্য বিচার-পরায়ণ, কামনা- বাসনা বর্জিত, সুখ-দুঃখ আদি দ্বন্দুসমূহ থেকে মুক্ত এবং মোহমুক্ত, তাঁরাই সেই অব্যয় পদ লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ শরণাগতির পন্থা এখানে খুব সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। তার প্রথম যোগ্যতা হচ্ছে গর্বের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন না হওয়া। কারণ, বদ্ধ জীব নিজেকে জড়া প্রকৃতির অধিপতি বলে মনে করে গর্বস্ফীত। তাই, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শ্রীচরণে আত্মসমর্পণ করা তার পক্ষে খুব কঠিন। যথার্থ জ্ঞান অনুশীলন করার মাধ্যমে তাকে জানতে হবে যে, সে জড়া প্রকৃতির অধিপতি নয়। অধিপতি হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। অহকার জনিত মোহ থেকে কেউ যখন মুক্ত হয়, তখন সে আত্মসমর্পণের পন্থা শুরু করতে পারে। যে সর্বদাই এই জড় জগতে সম্মানের আকাঙ্ক্ষা করে, তার পক্ষে পরমেশ্বর ভগবানের চরণে আত্মসমর্পণ করা সম্ভব নয়। মোহের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলেই অহঙ্কারের উদয় হয়; কারণ জীব যদিও অল্প দিনের জন্য এখানে আসে এবং তারপর বিদায় নিয়ে চলে যায়, তবুও মূর্খের মতো সে মনে করে যে, সে এই জগতের অধীশ্বর। এভাবেই সে সব কিছু জটিল করে তোলে এবং তার ফলে সে সর্বদাই দুর্দশাগ্রস্ত। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে সমস্ত জগৎ চালিত হচ্ছে। মানুষ মনে করছে যে, সারা পৃথিবীটাই মানব- সমাজের সম্পত্তি এবং মিথ্যা মালিকানার ভ্রান্তবোধে তারা পৃথিবীটাকে ভাগ করে নিয়েছে। মনুষ্য-সমাজ যে এই জগতের মালিক, সেই ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত হতে হবে। এই ধরনের ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত হলে পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়তা বোধের ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। এই সমস্ত মিথ্যা বন্ধনগুলি মানুষকে জড় জগতে আবদ্ধ করে রাখে। এই স্তর অতিক্রম করার পর দিব্যজ্ঞান অনুশীলন করতে হবে। যথার্থ জ্ঞানের মাধ্যমে তাকে জানতে হবে কোন জিনিসগুলি তার এবং কোনগুলি তার নয়। সব কিছু সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান লাভ হলে মানুষ সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার দ্বন্দ্বভাব থেকে মুক্ত হয়। সে যখন পূর্ণজ্ঞান লাভ করে, তখনই কেবল পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শ্রীচরণে আত্মসমর্পণ

করা সম্ভব হয় ।

শ্লোকঃ ৬

ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ ।

যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ॥ ৬॥

ন—না; তৎ—তা; ভাসয়তে – আলোকিত করতে পারে; সূর্যঃ–সূর্য; ন–না; শশাঙ্কঃ-চন্দ্ৰ; ন–না; পাবকঃ অগ্নি, বিদ্যুৎ, যৎ – যেখানে; গত্বা – গেলে; ন না, নিবর্তন্তে ফিরে আসে, তৎ ধাম – সেই ধাম, পরমম্ পরম, মম আমার।

গীতার গান

সে আকাশে জ্যোতির্ময়ে সূর্য বা শশাঙ্ক ৷

আবশ্যক নাহি তথা কিংবা সে পাবক ।।

সেখানে প্রবেশ হলে ফিরে নাহি আসে ।

নিত্যকাল মোর ধামে সে জন নিবাসে ।।

অনুবাদঃ সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি বা বিদ্যুৎ আমার সেই পরম ধামকে আলোকিত করতে পারে না। সেখানে গেলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।

তাৎপর্যঃ চিন্ময় জগৎ বা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধাম—কৃষ্ণলোক বা গোলোক বৃন্দাবন সম্বন্ধে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। চিদাকাশে সূর্যকিরণ, চন্দ্রকিরণ, অগ্নি অথবা বৈদ্যুতিক শক্তির কোন প্রয়োজন হয় না, কারণ সেখানে সব কয়টি গ্রহই জ্যোতির্ময়। এই ব্রহ্মাণ্ডে কেবল একটি গ্রহ সূর্য হচ্ছে জ্যোতিময়। কিন্তু চিদাকাশে সব কয়টি গ্রহই জ্যোতির্ময়। বৈকুণ্ঠ লোক নামক এই সমস্ত গ্রহে উজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা ব্রহ্মজ্যোতি নামক চিদাকাশ প্রকাশিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই ব্রহ্মজ্যোতি বিচ্ছুরিত হয় শ্রীকৃষ্ণের আলয় গোলোক বৃন্দাবন থেকে। সেই অত্যুজ্জ্বল জ্যোতির কিয়দংশ মহৎ-তত্ত্ব দ্বারা আচ্ছাদিত। সেটিই হচ্ছে জড় জগৎ। এই জড় জগৎ ছাড়া সেই জ্যোতির্ময় আকাশের অধিকাংশ স্থানই চিন্ময় গ্রহলোকসমূহে পরিপূর্ণ, যাদের বলা হয় বেকুণ্ঠ এবং তাদের সর্বোচ্চ শিখরে গোলোক বৃন্দাবন অবস্থিত।

জীব যতক্ষণ পর্যন্ত এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জড় জগতে থাকে, সে বদ্ধ জীবন যাপন করে। কিন্তু যখনই সে জড় জগতের মিথ্যা, বিকৃত বৃক্ষটি কেটে ফেলে চিৎ- জগতে প্রবেশ করে, তখনই সে মুক্ত হয়। তখন আর তাকে এখানে ফিরে আসতে হয় না। বদ্ধ অবস্থায় জীব নিজেকে জড় জগতের অধীশ্বর বলে মনে করে। কিন্তু মুক্ত অবস্থায় সে যখন ভগবানের রাজত্বে প্রবেশ করে, তখন সে পরমেশ্বর ভগবানের পার্ষদত্ব লাভ করে এবং সেখানে সে সৎ-চিৎ-আনন্দময় জীবন উপভোগ করে।

এই তত্ত্বজ্ঞানের প্রতি সকলেরই আকৃষ্ট হওয়া উচিত। বাস্তরের ভ্রান্ত প্রতিবিম্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে সেই নিত্য পরম ধামে ফিরে যাবার জন্য সকলেরই বাসনা করা উচিত। যারা এই জড় জগতের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত, তাদের পক্ষে সেই আসক্তি ছিন্ন করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু তারা যদি কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে, তা হলে সেই আসক্তির বন্ধন থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভগবদ্ভক্তদের সঙ্গ করা যে সমাজ ঐকান্তিকভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় উৎসর্গীকৃত, সেই রকম সমাজ খুঁজে বার করতে হবে এবং তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করার সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। এভাবেই মানুষ জড় জগতের প্রতি আসক্তি ছেদন করতে পারে। গেরুয়া কাপড় পরলেই কেবল জড় জগতের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করার প্রতি তাকে আসক্ত হতেই হবে। সুতরাং, প্রকৃত বৃক্ষের বিকৃত প্রতিফলনের থেকে মুক্ত হওয়ার যে পন্থা ভক্তিযোগ, যা দ্বাদশ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, তা গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। চতুর্দশ অধ্যায়ে জড়-জাগতিক সব কয়টি পন্থার দোষ প্রদর্শন করা হয়েছে। কেবলমাত্র ভক্তিযোগকে শুদ্ধ গুণাতীত বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

এই শ্লোকটিতে পরমং মম কথাটির ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে সব কিছুই ভগবানের সম্পত্তি, কিন্তু চিৎ-জগৎ হচ্ছে পরমম্, অর্থাৎ ড়ৈশ্বর্যপূর্ণ। ঠ উপনিষদে (২/২/১৫) বলা হয়েছে যে, চিৎ-জগতে সূর্যকিরণ, চন্দ্রকিরণ ও তারকা- মণ্ডলীর কোন প্রয়োজন নেই (ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকম্)। কারণ, সমগ্র চিদাকাশ পরমেশ্বর ভগবানের অন্তরঙ্গা জ্যোতিতে উদ্ভাসিত। পরম ধাম প্রাপ্ত হওয়া যায় কেবল ভগবানের চরণে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে। এ ছাড়া আর কোন উপায়ে তা সম্ভব হয় না।

শ্লোকঃ ৭

মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ।

মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কৰ্ষতি ॥ ৭॥

মম – আমার; এব—অবশ্যই; অংশঃ — বিভিন্নাংশ, জীবলোকে — জড় জগতে; জীবভূতঃ— বদ্ধ জীব; সনাতনঃ—নিত্য। মনঃ- -মন সহ, যষ্ঠানি― ছয়, ইন্দ্রিয়াণি- ইন্দ্রিয়গুলিকে, প্রকৃতি—জড়া প্রকৃতিতে; স্থানি—স্থিত: কর্ষতি কঠোর সংগ্রাম করছে।

গীতার গান

যত জীব মোর অংশ নহে সে অপর ।

সনাতন তার সত্তা জীবলোকে ঘোর ॥

এখানে সে মন আর ইন্দ্রিয়বন্ধনে ।

কর্ষণ করয়ে কত প্রকৃতির স্থানে ॥

অনুবাদঃ এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিন্নাংশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মন সহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতিরূপ ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্রাম করছে।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকটিতে জীবের যথার্থ পরিচয় সম্বন্ধে বর্ণনা করা হচ্ছে। সনাতনভাবে জীব হচ্ছে ভগবানের অতি ক্ষুদ্র বিভিন্নাংশ। এমন নয় যে, বদ্ধ অবস্থায় জীব স্বতন্ত্র হয়ে পড়ে এবং মুক্ত অবস্থায় সে ভগবানের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। সনাতনভাবেই জীবসত্তা ভগবানের অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ-স্বরূপ। সনাতনঃ কথাটি এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈদিক বর্ণনা অনুসারে ভগবান নিজেকে অনন্তরূপে প্রকাশ করেন, যার মুখ্য প্রকাশকে বলা হয় বিষ্ণুতত্ত্ব এবং গৌণ প্রকাশকে বলা হয় জীবসত্তা। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, বিষ্ণুতত্ত্ব হচ্ছে ভগবানের স্বাংশ-প্রকাশ এবং জীবসত্তা হচ্ছে বিভিন্নাংশ-প্রকাশ। তাঁর স্বাংশ প্রকাশে তিনি রামচন্দ্র, নৃসিংহদেব, বিষ্ণুমূর্তি এবং বিভিন্ন বৈকুণ্ঠলোকের অধীশ্বর আদি নানারূপে প্রকাশিত হন। বিভিন্নাংশ প্রকাশ জীবসমূহ ভগবানের নিত্যদাস। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের স্বাংশ-প্রকাশসমূহের স্বতন্ত্র স্বরূপগুলি নিত্য বৰ্তমান । তেমনই, বিভিন্নাংশ জীবদেরও স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে। ভগবানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ হবার ফলে, ভগবানের গুণাবলীর অণুসদৃশ অংশ জীবদের মধ্যেও রয়েছে, যার মধ্যে স্বাতন্ত্র হচ্ছে একটি। স্বতন্ত্র আত্মারূপে প্রতিটি জীবেরই ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য ও ক্ষুদ্র স্বাধীনতা রয়েছে। সেই ক্ষুদ্র স্বাধীনতার অপব্যবহার করার ফলে জীবাত্মা বদ্ধ হয়ে পড়ে এবং স্বাধীনতার যথাযথ সদ্ব্যবহার করলে সে সর্বদা মুক্ত থাকে। উভয় ক্ষেত্রেই সে পরমেশ্বর ভগবানের মতো গুণগতভাবে নিত্য। মুক্ত অবস্থায় সে জড় জগতের পরিবেশ থেকে মুক্ত এবং সর্বদাই পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত সেবায় যুক্ত। বন্ধ অবস্থায় সে জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত থাকে এবং অপ্রাকৃত ভগবৎ সেবার কথা সে ভুলে যায়। তার ফলে, এই জড় জগতে তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।

কেবল কুকুর, বেড়াল, মানুষই নয়, এমন কি জড় জগতের নিয়ন্ত্রণকারী— ব্রহ্মা, শিব এমন কি বিষ্ণু পর্যন্ত পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ-বিশেষ। তাঁরা সকলেই নিত্য, তাঁদের প্রকাশ সাময়িক নয়। এখানে কর্ষতি ( সংগ্রাম করা’ অথবা *জোর করে আঁকড়ে ধরা) কথাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। বদ্ধ জীব যেন লৌহ শৃঙ্খলের মতো অহারের দ্বারা শৃঙ্খলিত এবং তার মন হচ্ছে তার মুখ্য প্রতিনিধি, যে তাকে জড় অস্তিত্বের দিকে ধাবিত করছে। মন যখন সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত থাকে, তখন তার কার্যকলাপ শুদ্ধ হয়। মন যখন রজোগুণে অধিষ্ঠিত থাকে, তখন তার কার্যকলাপ পীড়াদায়ক হয় এবং মন যখন তমোগুণে থাকে, তখন সে নিম্নতর প্রজাতিরূপে বিচরণ করে। এই শ্লোকে এটি স্পষ্টভাবে বোবা যাচ্ছে যে, বন্ধ জীবাত্মা মন ও ইন্দ্রিয় সমন্বিত জড় দেহের দ্বারা আবৃত এবং সে যখন মুক্ত হয় তখন এই জড় আবরণ বিনাশ প্রাপ্ত হয়। কিন্তু তার স্বরূপ সমন্বিত চিন্ময় দেহ নিজস্ব সামর্থ্যে প্রকাশিত হয়। মাধ্যন্দিনায়ন শ্রুতিতে এই তথ্যগুলি প্রদান করা হয়েছে—স বা এষ ব্রহ্মনিষ্ঠ ইদং শরীরং মর্ত্যমতিসৃজ ব্রহ্মাভিসম্পদ্য ব্রহ্মণা পশ্যতি ব্রহ্মণ্য শৃণোতি ব্ৰহ্মণৈবেদং সর্বমনুভবতি। এখানে বলা হয়েছে যে, যখন জীবাত্মা তাঁর জড় আবরণ পরিত্যাগ করে চেতন জগতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর চিন্ময় শরীর পুনরুজ্জীবিত হয় এবং তাঁর চিন্ময় শরীরে তিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করেন। তিনি তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে কথা বলতে পারেন, তাঁর কথা শুনতে পারেন এবং যথাযথভাবে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারেন। স্মৃতি শাস্ত্রেও জানতে পারা যায় যে, বসন্তি যত্র পুরুষাঃ সর্বে বৈকুণ্ঠমূর্তয়ঃ—বৈকুণ্ঠলোকে সকলেই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের মতো রূপ নিয়ে বিরাজ করেন। সেখানে বিষ্ণুমূর্তির প্রকাশ এবং তাঁর বিভিন্নাংশ জীবাত্মাদের দেহের গঠনে কোন পার্থক্য নেই। পক্ষান্তরে বলা যায়, জীব মুক্ত হলে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কৃপায় দিবা শরীর প্রাপ্ত হন।

এখানে নমৈবাংশঃ (‘পরমেশ্বর ভগবানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ) কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পরমেশ্বর ভগবানের অণুসদৃশ অংশ কোন জড় পদার্থের ভাঙা অংশের মতো নয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি যে, আত্মাকে খণ্ড খণ্ড করে কাটা যায় না। এই অণুসদৃশ অংশকে জড় বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। এটি জড় পদার্থের মতো নয়, যা কেটে টুকরো টুকরো করা যায়, তারপর আবার জোড়া লাগিয়ে দেওয়া যায়। সেই ধারণা এখানে প্রযোজ্য নয়, কারণ এখানে সংস্কৃত সনাতন (‘নিত্য’) কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। ভগবানের অণুসদৃশ অংশগুলিও নিত্য। দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথমদিকে এটিও বলা হয়েছে যে, প্রতিটি দেহে ভগবানের অনুসদৃশ অংশ আত্মা বর্তমান থাকে (দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে)। সেই অণুসদৃশ অংশ যখন জড় দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়, তখন চিদাকাশে চিন্ময় গ্রহলোকে তার আদি চিন্ময় দেহ প্রাপ্ত হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গ লাভ করার আনন্দ উপভোগ করে। এখানে অবশ্য এটি বোঝা যাচ্ছে যে, পরমেশ্বর ভগবানের অণুসদৃশ অংশ হওয়ার ফলে জীব গুণগতভাবে ভগবানের সঙ্গে এক, যেমন সোনার একটি কণাও সোনা।

error: Content is protected !!