পঞ্চদশ অধ্যায়

পুরুষোত্তম-যোগ

শ্লোকঃ ১

ঊর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্ ।

ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বেদ স বেদবিৎ ॥ ১॥

শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; ঊর্ধ্বমূলম্—ঊর্ধ্বমূল; অধঃ- নিম্নমুখী; শাখ—শাখাবিশিষ্ট, অশ্বত্থম্ অশ্বত্থ বৃক্ষ, প্রাহুঃ বলা হয়েছে; অব্যয়ম্—নিত্য; ছন্দাংসি — বৈদিক মন্ত্রসমুহ, যস্য – যার, পর্ণানি – পত্রসমূহ, যঃ—যিনি; ত্বম্—সেই; বেদ — জানেন; সঃ – তিনি; বেদবিৎ— বেদজ্ঞ ।

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

বেদবাণী কর্মকাণ্ডী সংসার আশ্রয় ।

নানা যোনি প্রাপ্ত হয় কভু মুক্ত নয় ॥

সংসার যে বৃক্ষ সেই অশ্বত্থ অব্যয় ৷

ঊর্ধ্বমূল অধঃশাখা নাহি তার ক্ষয় ॥

পুষ্পিত বেদের ছন্দ সে ব্রহ্মের পত্র ।

মোহিত সে বেদবাক্য জগৎ সর্বত্র ॥

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন — ঊর্ধ্বমূল ও অধঃশাখা বিশিষ্ট একটি অব্যয় অশ্বত্থ বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে। বৈদিক মন্ত্রসমূহ সেই বৃক্ষের পত্রস্বরূপ। যিনি সেই বৃক্ষটিকে জানেন, তিনিই বেদজ্ঞ।

তাৎপর্যঃ ভক্তিযোগের গুরুত্ব আলোচনা করার পর কেউ প্রশ্ন করতে পারে, তা হলে বেদের অর্থ কি? এই অধ্যায়ে বর্ণনা করা হচ্ছে যে, বেদ অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। সুতরাং যিনি কৃষ্ণভাবনাময়, যিনি ভগবানের ভক্তিযুক্ত সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, তিনি ইতিমধ্যেই বেদের পূর্ণ জ্ঞান আহরণ করেছেন।

জড় জগতের বন্ধনকে এখানে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যে সকান কর্মে রত, তার কাছে এই অশ্বথ বৃক্ষটির কোন শেষ নেই। সে এক ডাল থেকে আর এক ডালে, সেখান থেকে অন্য এক ডালে, আবার আর এক ডালে, এভাবেই সে ঘুরে বেড়ায়। এই জড় জগৎরূপী বৃক্ষটির কোন অন্ত নেই এবং যে এই বৃক্ষটির প্রতি আসক্ত, তার পক্ষে মুক্তি লাভের কোনই সম্ভাবনা নেই। মানুষকে ঊর্ধ্বমুখী করবার জন্য যে বৈদিক ছন্দ, তাকে এই বৃক্ষের পাতারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বৃক্ষের মূলটি ঊর্ধ্বমুখী, কারণ তার শুরু হয়েছে যেখানে ব্রহ্মা অধিষ্ঠিত সেখান থেকে, অর্থাৎ এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ গ্রহলোক থেকে। কেউ যখন মায়াময় এই অবায় বৃক্ষটির সম্বন্ধে অবগত হতে পারেন, তখন তিনি তার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারেন।

মুক্ত হওয়ার এই পন্থাটিকে ভালভাবে উপলব্ধি করা উচিত। পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার নানা রকম পন্থা বর্ণিত হয়েছে এবং ত্রয়োদশ অধ্যায় পর্যন্ত আমরা দেখেছি যে, ভক্তিযোগে পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করাই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এখন, ভক্তিযোগের মূল তত্ত্ব হচ্ছে জড়-জাগতিক কর্মে অনাসক্তি এবং ভগবানের অপ্রাকৃত সেবার প্রতি আসক্তি। এই অধ্যায়ের শুরুতে জড় জগতের প্রতি আসক্তির বন্ধন ছিন্ন করার পন্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এই জড় অস্তিত্বের মুল ঊর্ধ্বমুখী। তার অর্থ হচ্ছে, এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চলোকে মহৎ-তত্ত্বের জড়-জাগতিক অস্তিত্ব থেকে তার শুরু হয়। সেখান থেকে গ্রহমণ্ডলরূপী বিভিন্ন শাখা সারা ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তার ফল হচ্ছে জীবের কর্মফল, যেমন ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ।

এখন এই জগতে এমন কোন গাছের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, যার শাখা নিম্নমুখী আর মূল ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু সেটি আছে। সেই মাছ দেখতে পাওয়া যায় একটি জলাশয়ের ধারে। আমরা দেখতে পাই যে, জলাশয়ের তীরের বৃক্ষগুলির শাখা নিম্নমুখী ও মূল ঊর্ধ্বমুখী হয়ে জলে প্রতিনিষিত হয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, এই জড় জগতের বৃক্ষটি হচ্ছে চিৎ-জগতের বাস্তব বৃক্ষটির প্রতিবিদ। জলে যেমন বৃক্ষের ছায়া পড়ে, তেমনই চিৎ-লাতের ছায়া পড়ে আমাদের কাননার উপর। প্রতিবিম্বিত জড় আকাশে বস্তুর অবস্থিতির কারণ হচ্ছে কামনা-বাসনা। এই ভাড় অস্তিত্বের বন্ধন থেকে যে মুক্ত হতে চান, তাকে অবশ্যই পুখানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে এই বৃক্ষটি সম্বন্ধে যথার্থভাবে জানতে হবে। তা হলে তার বন্ধন সে ছিন্ন করতে পারে।

এই বৃক্ষটি বাস্তব বৃক্ষটির প্রতিবিম্ব হওয়ার ফলে, তার অবিকল প্রতিরূপ। চিৎ- জগতে সব কিছুই আছে। নির্বিশেষবাদীরা মনে করে যে, জড় জগৎরূপী বৃক্ষের মূল হচ্ছে ব্রহ্ম এবং সাংখ্য দর্শন অনুযায়ী, সেই মূল থেকে প্রকৃতি ও পুরুষ, তারপর প্রকৃতির তিনটি গুণ, তারপর পঞ্চমহাভূত, তারপর দশেন্দ্রিয়, মন আদির প্রকাশ হয়। এভাবেই তারা সমস্ত জড় জগৎকে চব্বিশটি উপাদানে বিভক্ত করে। ব্রহ্ম যদি সমস্ত প্রকাশের কেন্দ্র হন, তা হলে এই জড় জগতের প্রকাশ হচ্ছে কেন্দ্র থেকে ১৮০ ডিগ্রী বা একটি অর্ধবৃত্ত এবং অপর ১৮০ ডিগ্রী বা অপর অর্ধাংশ হচ্ছে চিৎ-জগৎ। জড় জগৎ যদি বিকৃত প্রতিবিশ্ব হয়, তা হলে চিৎ- জগতে অবশ্যই সেই একই ধরনের বৈচিত্র্য রয়েছে, কিন্তু তা রয়েছে বাস্তবভাবে। ‘প্রকৃতি’ হচ্ছে ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি এবং ‘পুরুষ’ হচ্ছেন ভগবান স্বয়ং। সেই কথা ভগবদ্গীতায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই প্রকাশ যেহেতু জড়, তাই তা অনিত্য, অস্থায়ী। প্রতিবিম্ব অস্থায়ী, কেন না কখনও কখনও তাকে দেখা যায়, আবার কখনও কখনও তাকে দেখা যায় না। কিন্তু তার উৎস, যেখান থেকে প্রতিবিম্ব প্রতিবিম্বিত হচ্ছে, তা নিত্য।

জড় আকাশে সেই বৃক্ষের জড় প্রতিবিম্বটি কেটে বাদ দিতে হবে। যখন বলা হয় যে, কেউ বেদ সম্বন্ধে জানেন, তখন অনুমান করা হয় যে, এই জড় জগতের আসত্তি কিভাবে ছিন্ন করা যায়, তা তিনি জানেন। এই পন্থা যিনি জানেন, তিনি হচ্ছেন যথার্থ বেদজ্ঞ। বেদের কর্মকাণ্ডের প্রতি যে আকৃষ্ট, বুঝতে হবে যে বৃক্ষটির সবুজ পত্রের প্রতি আকৃষ্ট। বেদের যথার্থ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সে অবগত নয়। বেদের উদ্দেশ্য পরম পুরুষ নিজেই বর্ণনা করেছেন, তা হচ্ছে, প্রতিবিম্ব বৃক্ষটি কেটে বাদ দিয়ে চিৎ-জগতের বাস্তব বৃক্ষটি লাভ করা।

শ্লোকঃ ২

অধশ্চোর্ধ্বং প্রসৃতাস্তস্য শাখা

গুণপ্রবৃদ্ধা বিষয়প্রবালাঃ।

অধশ্চ মূলান্যনুসন্ততানি

কর্মানুবন্ধীনি মনুষ্যলোকে ॥ ২॥

অধঃ নিম্নমুখী; চ–এবং ঊর্ধ্বম্ঊর্ধ্বমুখী, প্রমৃতাঃ — বিস্তৃত; তস্য—তার, শাখাঃ—শাখাসমূহ: গুণ – জড়া প্রকৃতির গুণসমূহের দ্বারা; প্রবৃদ্ধাঃ- পরিবর্ধিত, বিষয়— ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ; প্রবালাঃ – পল্লব; অধঃ— অধোমুখী, চ—এবং; মূলানি — মূলসমূহ, অনুসন্ততানি—প্রসারিত: কর্ম—কর্মের প্রতি; অনুবন্ধীনি—আবদ্ধ মনুষ্যলোকে নরলোকে ।

গীতার গান

বৃক্ষের সে শাখাগুলি ঊর্ধ্ব অধঃগতি ৷

গুণের বশেতে যার যথা বিধিমতি ।।

সে বৃক্ষের শাখা যত বিষয়ের ভোগ ।

নিজ কর্ম অনুসারে যত ভবরোগ ।।

বদ্ধজীব ঘুরে সেই বৃক্ষ ডালে ডালে ৷

মনুষ্যলোক সে ভুঞ্জে নিজ কর্মফলে ।।

অনুবাদঃ এই বৃক্ষের শাখাসমূহ জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা পুষ্ট হয়ে অধোদেশে ও ঊর্ধ্বদেশে বিস্তৃত। ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহই এই শাখাগণের পল্লব। এই বৃক্ষের মূলগুলি অধোদেশে প্রসারিত এবং সেগুলি মনুষ্যলোকে সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ।

তাৎপর্যঃ সেই অশ্বত্থ বৃক্ষটির বর্ণনা সম্বন্ধে এখানে পুনরায় ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তার ডালপালাগুলি চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে। তার নিম্নাংশে মানুষ, পশু, গরু, ঘোড়া, কুকুর, বেড়াল আদি বৈচিত্র্যময় জীবের বিভিন্ন প্রকাশ হয়েছে। এরা অধোমুখী শাখাগুলিতে অবস্থিত এবং ঊর্ধ্বমুখী শাখাগুলিতে রয়েছে দেবতা, গন্ধর্ব আদি উচ্চ প্রজাতির জীবসমূহ। বৃক্ষ যেমন জলের দ্বারা পুষ্ট হয়, তেমনই এই বৃক্ষটি পুষ্ট হয় জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা। কখনও কখনও আমরা দেখি যে, জলের অভাবে কোন কোন জমি অনুর্বর, আবার কোন কোন জমি খুব উর্বর, তেমনই জড়া প্রকৃতির গুণের মাত্রা অনুসারে বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন রকম প্রজাতির প্রকাশ হয়।

সেই বৃক্ষের পল্লবগুলি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ। প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের বিকাশের ফলে ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয়ের বিকাশ হয় এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা নানা রকম ইন্দ্রিয়ের বিষয় উপভোগ করি। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা আদি ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে ডালপালার ডগা, যা বিভিন্ন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলি উপভোগের প্রতি আসক্ত। তার পল্লবগুলি হচ্ছে শব্দ, রূপ, স্পর্শ আদি ইন্দ্রিয় বিষয় বা তন্মাত্র। তার শাখামূলগুলি হচ্ছে নানা রকম সুখ ও দুঃখজাত আসক্তি ও বিরক্তি। সর্বদিকে বিস্তৃত গৌণ মূলগুলি থেকে ধর্ম ও অধর্ম, পাপ ও পুণ্যকর্ম করার প্রবণতা উদয় হয়। মুখ্য মূলটি আসছে ব্রহ্মালোক থেকে এবং অন্যান্য মূলগুলি রয়েছে মনুষ্য গ্রহলোকগুনিতে। উচ্চতর লোকে গিয়ে পুণ্যকর্মের ফল ভোগ করার পর সে আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং পুনরায় ফলাশ্রয়ী কর্মের মাধ্যমে উন্নীত হতে চায়। এই মনুষ্যলোক হচ্ছে জীবের কর্মক্ষেত্র।

শ্লোকঃ ৩-৪

ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে 

নাস্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা ।

অশ্বত্থমেনং সুবিরূঢ়মূলম।

অসঙ্গশস্ত্ৰেণ দৃঢ়েন ছিত্ত্বা ॥৩॥

ততঃ পদং তৎপরিমার্গিতব্যং

যস্মিন্ গতা ন নিবর্তস্তি ভূয়ঃ ।

তমেব চাদ্যং পুরুষং প্রপদ্যে

যতঃ প্রবৃত্তিঃ প্রসৃতা পুরাণী ॥ ৪॥

ন—না; রূপম্ — রূপ; অস্য—এই বৃক্ষের; ইহ—এই জগতে, তথা—ও; উপলভ্যতে—উপলব্ধ হয়, ন–না; অন্তঃ— শেষ, ন না, চ–ও, আদিঃ শুরু; ন—না: চ–ও; সংপ্রতিষ্ঠা— সমাক স্থিতি, অশ্বত্থম্ — অশ্বত্থ বৃক্ষ; এনম্—এই; সুবিরূঢ়— সুদৃঢ়; মূলম্—মূল; অসঙ্গশাস্ত্রেণ — বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রের দ্বারা, দৃঢ়ন তীব্র; ছিত্ত্ব – ছেদন করে, ততঃ– তারপর, পদস্—পদ; তৎ- সেই; পরিমার্জিতব্যম্- অন্বেষণ করা কর্তব্য; যস্মিন্ — যেখানে গতাঃ —গমন করলে; ন-না: নিবর্তন্তি— ফিরে আসতে হয়; ভূয়ঃ— পুনরায়; জ্বম্—— তাঁকে; এর অবশ্যই; চাও; আদ্যম্- আদি পুরুষম্ — পুরুষের প্রতি; প্রপদ্যে— শরণ গ্রহণ কর; যতঃ —যাঁর থেকে; প্রবৃত্তিঃ— প্রবর্তন; প্রসৃতা — বিস্তৃত হয়েছে, পুরাণী — স্মরণাতিত কাল থেকে।

গীতার গান

ক্ষুদ্রবুদ্ধি মনুষ্য সে সীমা নাহি পায় ।

অনন্ত আকাশে তার আদি অন্ত নয় ।।

কিবা রূপ সে বৃক্ষের তাহা নাহি বুঝে ।

অনন্তকালের মধ্যে জীব যুদ্ধ যুঝে ।।

সে অশ্বত্থ বৃক্ষ হয় সুদৃঢ় যে মূল ৷

সে মূল কাটিতে হয় শত শত ভুল ।।

অনাসক্তি এক অস্ত্র সে মূল কাটিতে ।

সেই সে যে দৃঢ় অস্ত্র সংসার জিনিতে ।।

কাটিয়া সে বৃক্ষমূল সত্যের সন্ধান ।

ভাগ্যক্রমে যার হয় তাতে অবস্থান ৷।

সে যায় বৈকুণ্ঠলোকে ফিরে শাহি আসে ।

এ বৃক্ষের মূল যথা সে পুরুষ পাশে ।।

সে আদি পুরুষে অদ্য কর যে প্রপত্তি ।

জন্মাদি সে যাহা হতে প্ৰকৃতি প্ৰবৃত্তি ৷।

অনুবাদঃ এই বৃক্ষের স্বরূপ এই জগতে উপলব্ধ হয় না। এর আদি, অন্ত কোথায় তা কেউই বুঝতে পারে না। তীব্র বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রের দ্বারা দৃঢ়মূল এই বৃক্ষকে ছেদন করে সত্য বস্তুর অন্বেষণ করা কর্তব্য, যেখানে গমন করলে, পুনরায় ফিরে আসতে হয় না। স্মরণাতীত কাল হতে যাঁর থেকে সমস্ত কিছু প্রবর্তন ও বিস্তৃত হয়েছে, সেই আদি পুরুষের প্রতি শরণাগত হও।

তাৎপর্যঃ এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই অশ্বত্থ বৃক্ষের প্রকৃত রূপ এই জড় জগতের পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে পারা যায় না। যেহেতু তার মূল ঊর্ধ্বমুখী, তাই প্রকৃত বৃক্ষটির বিস্তার হচ্ছে অপর দিকে। সে বৃক্ষটি যে কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত তা কেউ দেখতে পার না এবং বৃক্ষটির শুরু যে কোথায় তাও কেউ দেখতে পায় না। তবুও তার কারণ খুঁজে বার করতে হবে। “আমি আমার পিতার পুত্র, আমার পিতা অমুক ব্যক্তির পুত্র ইত্যদি।” এভাবেই অনুসন্ধান করতে করতে মানুষ ব্রহ্মাতে এসে পৌঁছায়। ব্রহ্মার উৎপত্তি হয়েছে গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু থেকে। এভাবেই অবশেষে যখন কেউ পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছে পৌঁছায়, তখনই তার এই গবেষণার শেষ হয়। ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান সমন্বিত সাধুদের সঙ্গের মাধ্যমে এই বৃক্ষটির উৎস পরম পুরুষোত্তম ভগবানের অনুসন্ধান করতে হবে। তার ফলে যথার্থ জ্ঞানের প্রভাবে ধীরে ধীরে এই জড় জগতের বিকৃত প্রতিফলন থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। এভাবেই জ্ঞানের দ্বারা জড় জগতের সংযোগ ছিন্ন করে চিৎ-জগতের বাস্তব বৃক্ষে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়।

এই প্রসঙ্গে অসঙ্গ কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার এবং জড় জগতের উপর আধিপত্য করার আসক্তি অত্যন্ত প্রবল। তাই, প্রামাণ্য শাস্ত্রের ভিত্তিতে ভগবৎ-তত্ত্ব বিজ্ঞান আলোচনা করার মাধ্যমে এবং যথার্থ জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে ভগবানের কথা শ্রবণ করার মাধ্যমে বিষয়ের প্রতি অনাসক্ত হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ভক্তসঙ্গে এই ধরনের আলোচনা করার ফলে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সমীপবর্তী হওয়া যায়। তারপর সর্বপ্রথমে যা অবশ্য করণীয়, তা হচ্ছে তাঁর শ্রীচরণারবিন্দে আত্মসমর্পণ করা। সেই পরম ধামের বর্ণনায় এখানে বলা হয়েছে যে, একবার সেখানে গেলে এই প্রতিবিম্বরূপী বৃক্ষে আর ফিরে আসতে হয় না। পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আদি মূল, যাঁর থেকে সব কিছু প্রকাশিত হয়েছে। সেই পরমেশ্বর ভগবানের কৃপা লাভ করতে হলে কেবলমাত্র আত্মসমর্পণ করতে হবে। এই আত্মসমর্পণই হচ্ছে শ্রবণ, কীৰ্তন আদি নববিধা ভক্তি অনুশীলনের চরম পরিণতি। এই জড় জগতের বিস্তারের কারণ হচ্ছেন ভগবান। ভগবান নিজেই ইতিমধ্যে সেই সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, অহং সর্বস্য প্রভবঃ—“আমি সব কিছুরই উৎস”। সুতরাং, জড়-জাগতিক জীবনরূপ অত্যন্ত কঠিন এই অশ্বত্থ বৃক্ষের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হলে শ্রীকৃে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোন গতি নেই। শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করলে অনায়াসে এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়।

error: Content is protected !!