শ্লোকঃ ৮
শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপ্যুৎক্রামতীশ্বরঃ ।
গৃহীত্বৈতানি সংঘাতি বায়ুর্গন্ধানিবাশয়াৎ ॥ ৮ ॥
শরীরম্― দেহ; যৎ- যেমন: অবাপ্নোতিপ্রাপ্ত হয়; যৎ- যা চ অপি – ; উৎক্রামতি — নিষ্ক্রান্ত হয়; ঈশ্বরঃ— দেহের ঈশ্বর; গৃহীত্বা—গ্রহণ করে; এতানি এই সমস্ত সংযাতি—এমন করে, বায়ুঃ — বায়ু; গন্ধা — গন্ধ: ইব—মতন: -আশয়াৎ—ফুল থেকে।
গীতার গান
বার বার কত দেহ সে যে প্রাপ্ত হয় ।
এক দেহ ছাড়ে আর অন্যে প্রবেশয় ।।
বায়ু গন্ধ যথা যায় স্থান স্থানান্তরে ।
কর্মফল সূক্ষ্ম সেই দেহ দেহাত্তরে ।।
অনুবাদঃ বায়ু যেমন ফুলের গন্ধ নিয়ে অন্যত্র গমন করে, তেমনই এই জড় জগতে দেহের ঈশ্বর জীব এক শরীর থেকে অন্য শরীরে তার জীবনের বিভিন্ন ধারণাগুলি নিয়ে যায়।
তাৎপর্যঃ এখানে জীবকে ঈশ্বর বা তার দেহের নিয়ন্তা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সে যদি ইচ্ছা করে, তা হলে সে তার দেহকে উচ্চতর শ্রেণীতে পরিবর্তন করতে পারে এবং সে যদি ইচ্ছা করে তা হলে নিম্নতর শ্রেণীতে অধঃপতিত হতে পারে। তার অতি ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্র্য এই ক্ষেত্রে আছে। তার শরীরের সমস্ত পরিবর্তন নির্ভর করে তার সেই স্বাতন্ত্র্যের উপর। তার চেতনাকে সে যেভাবে গড়ে তুলেছে, মৃত্যুর পর তা তাকে পরবর্তী শরীরে নিয়ে যাবে। তার চেতনাকে যদি সে একটি কুকুর বা একটি বেড়ালের চেতনার মতো করে গড়ে তোলে, তা হলে সে অবশ্যই কুকুর অথবা বেড়ালের শরীর প্রাপ্ত হবে। কেউ যদি তার চেতনাকে দিবা গুণাবলীতে ভূষিত করে, তা হলে সে দেবতাদের মতো শরীর প্রাপ্ত হবে এবং সে যদি কৃষ্ণভাবনাময় হয়, তা হলে সে অপ্রাকৃত কৃষ্ণলোকে স্থানান্তরিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গ লাভ করবে। দেহের নাশ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে দেহের সব কিছুরই নাশ হয়ে যায়, সেই ধারণা ভ্রান্ত। জীবাত্মা এক দেহ থেকে অন্য দেহে দেহান্তরিত হচ্ছে এবং তার বর্তমান শরীর ও বর্তমান কার্যকলাপ তার পরবর্তী শরীরের পটভূমি। কর্ম অনুসারে জীব একটি ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয় এবং যথা সময়ে তাকে সেই শরীর ত্যাগ করতে হয়। এখানে বলা হয়েছে যে, সূক্ষ শরীর, যা পরবর্তী শরীরের ধারণা বহন করে, তা পরবর্তী জীবনে অন্য একটি শরীরে বিকশিত হয়। এক দেহ থেকে অন্য দেহে দেহান্তরিত হবার এই পন্থা এবং দেহের সংগ্রামকে বলা হয় কৰ্ষতি বা জীবন-সংগ্রাম।
শ্লোকঃ ৯
শ্রোত্রং চক্ষুঃ স্পর্শনং চ রসনং ঘ্রাণমেব চ ।
অধিষ্ঠায় মনশ্চায়ং বিষয়ানুপসেবতে ॥ ৯॥
শ্রোত্রম্—কণ; চক্ষুঃ চক্ষু, স্পর্শন — ত্বক, চ- রসনম্ – জিহ্বা ঘ্রাণম্— ঘ্রাণশক্তি; এব—ও; চ–এবং; অধিষ্ঠায় আশ্রয় করে, মনঃ— নন, চ–৩; অয়ম্—এই জীব; বিষয়ান — ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ, উপসেবতে— উপভোগ করে।
গীতার গান
শরীরের অনুসার শ্রবণ দর্শন ।
স্পর্শন, রসন আর ঘ্রাণ বা মনন ॥
সে শরীরে জীব করে বিষয় সেবন ।
বদ্ধজীব করে সেই সংসার ভ্রমণ ॥
অনুবাদঃ এই জীব চক্ষু, কর্ণ, ত্বক, জিহ্বা, নাসিকা ও মনকে আশ্রয় করে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ উপভোগ করে।
তাৎপর্যঃ পক্ষান্তরে বলা যায়, জীব যদি তার চেতনাকে কুকুর-বেড়ালের প্রবৃত্তির দ্বারা কলুষিত করে তোলে, তা হলে পরবর্তী জীবনে সে কুকুর বা বেড়ালের মতো শরীর প্রাপ্ত হয়ে তাদের মতো দেহসুখ ভোগ করবে। চেতনা মূলত জলের মতো নির্মল। কিন্তু জলের সঙ্গে যদি কোন রং মেশান হয়, তা হলে জল রঙিন হয়ে যায় । অনুরূপভাবে, চেতনা নির্মল, কেন না আত্মা পবিত্র। কিন্তু জড়া প্রকৃতির গুণের সংস্রবে আসার ফলে চেতনা কলুষিত হয়ে পড়ে। প্রকৃত চেতনা হচ্ছে কৃষ্ণচেতনা। তাই কেউ যখন কৃষ্ণচেতনায় অধিষ্ঠিত হন, তখন তিনি তাঁর নির্মল জীবনে অবস্থান করেন। কিন্তু নানা রকম জাগতিক মনোবৃত্তির দ্বারা চেতনা যদি কলুষিত হয়ে পড়ে, তা হলে পরবর্তী জীবনে তিনি তদনুরূপ দেহ প্রাপ্ত হন। তিনি যে পুনরায় মনুষ্য-শরীর প্রাপ্ত হবেন, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তিনি কুকুর, বেড়াল, শূকর, দেবতা অথবা অন্য বহু শরীরের মধ্যে একটি শরীর প্রাপ্ত হতে পারেন। এই রকম চুরাশি লক্ষ বিভিন্ন প্রকার প্রজাতির শরীর রয়েছে।
শ্লোকঃ ১০
উৎনক্রামন্তং স্থিতং বাপি ভুঞ্জানং বা গুণান্বিতম।
বিমূঢ়া নানুপশ্যন্তি পশ্যন্তি জ্ঞানচক্ষুষঃ ॥ ১০॥
উৎক্রামন্তম্ — দেহ ত্যাগ করে; স্থিতম্—দেহে স্থিত; বা অপি—দুটির মধ্যে কোন একটি; ভুঞ্জানম্—উপভোগ করে; বা অথবা গুণান্বিতম্ — প্রকৃতির গুণের প্রভাবে আচ্ছন্ন; বিমূঢ়াঃ—মূঢ় লোকেরা, ন–না, অনুপশ্যন্তি — দেখতে পায়। পশ্যন্তি— দেখতে পান জ্ঞানচক্ষুষঃ জ্ঞান চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তিগণ।
গীতার গান
মূঢ়লোক না বিচারে কি ভাবে কি হয় ৷
উৎক্রান্তি স্থিতি ভোগ কার বা কোথায় ।।
যার জ্ঞানচক্ষু আছে গুরুর কৃপায় ।
ভাগ্যবান সেই জন দেখিবারে পায় ।।
অনুবাদঃ মূঢ় লোকেরা দেখতে পায় না কিভাবে জীব দেহ ত্যাগ করে অথবা প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিভাবে তার পরবর্তী শরীর সে উপভোগ করে। কিন্তু জ্ঞানচক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তিগণ সমস্ত বিষয় দেখতে পান।
তাৎপর্যঃ জ্ঞানচক্ষুষ্ণঃ কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জ্ঞান বিনা কেউই বুঝতে পারে না কিভাবে জীব তার বর্তমান শরীরটি ত্যাগ করে এবং পরবর্তী জীবনে সে কি রকম শরীর ধারণ করে। এমন কি এটিও বুঝতে পারে না, কেন সে একটি বিশেষ ধরনের শরীরে অবস্থান করছে। এই তত্ত্বসমূহ উপলব্ধি করবার জন্য গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন, যা সদ্গুরুর মুখারবিন্দ থেকে ভগবদ্গীতা ও তদনুরূপ শাস্ত্র শ্রবণ করার মাধ্যমে লাভ করা যায়। এই সমস্ত তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করার শিক্ষা যিনি লাভ করেছেন, তিনি অত্যন্ত ভাগ্যবান। প্রতিটি জীবই কোন বিশেষ অবস্থায় তার শরীর আগ করছে। কোন বিশেষ অবস্থায় সে জীবন ধারণ করছে এবং ছড়া প্রকৃতির মোহে আচ্ছন্ন হয়ে সে বিশেষ অবস্থায় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার চেষ্টা করছে এবং পরিণামে সে নানা রকমের সুখ ও দুঃখ ভোগ করছে। যারা অনন্তকাল ধরে কাম ও বাসনার দ্বারা মোহিত হয়ে আছে, তারা কেন এক বিশেষ দেহে অবস্থান করছে এবং কেনই বা সেই দেহ ত্যাগ করে অন্য দেহে দেহান্তরিত হচ্ছে তা উপলব্ধি করার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে। সেটি তাদের বোধগম্য হয় না। কিন্তু যাঁর হৃদয়ে দিব্যজ্ঞানের প্রকাশ হয়েছে, তিনি দর্শন করতে পারেন। যে, আত্মা দেহ থেকে ভিন্ন এবং সর্বদাই তাঁর দেহের পরিবর্তন হচ্ছে এবং চিন্ময় স্বরূপে তাঁর আত্মা নিত্য আনন্দ অনুভব করছে। এই জ্ঞান যিনি প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনিই বুঝতে পারেন, কিভাবে বন্ধ জীব এই জড় জগতে দুর্দশা ভোগ করছে। সুতরাং, কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি সাধনের ফলে যাদের চেতনা খুব উন্নত হয়েছে, তাঁরা জনসাধারণকে এই জ্ঞান দান করবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন, কারণ বন্ধ জীবের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা দেখে তাঁরা মর্মাহত হন। বদ্ধ জীবের অবস্থা অত্যন্ত ক্লেশদায়ক, তাই তাদের কর্তব্য হচ্ছে এই বদ্ধ অবস্থা অতিক্রম করে কৃষ্ণচেতনা লাভ করা এবং জড় জগতের বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে অপ্রাকৃত জগতে প্রত্যাবর্তন করা।