মানুষের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শতাব্দীটিতে বাস করছি আমরা, আর এক বছর পর শেষ হবে বিশশতক; সমাপ্ত হবে একটি সহস্রকও। এ-শতাব্দীটিতে ঘটেছে বহু দুৰ্ঘটনা, শোচনীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছে দুটি— বাঁধিয়েছে বুড়ো অশুভ রাজনীতিকেরা, প্রাণ দিয়েছে তরুণেরা, অবর্ণনীয় দুর্গতি যাপন করেছে সংখ্যাহীন মানুষ; কিন্তু এতো স্বাধীনতা ও মুক্তি মানুষ আর কখনো যাপন করে নি, এতো অর্জনও আগে কখনো সম্ভব হয় নি মানুষের পক্ষে । সাহিত্য, শিল্পকলা সমৃদ্ধ করেছে এ-শতাব্দীকে, এবং একে সবচেয়ে সমৃদ্ধ করেছে বিজ্ঞান । বিজ্ঞান রূপান্তরিত ক’রে দিয়েছে বাস্তব জগতকে, সৃষ্টি করেছে নতুন বিশ্বদৃষ্টি, কিন্তু আজো আমরা বাস করছি এক পৌরাণিক বিশ্বেই। পুরাণের কাজ বিশ্বকে রহস্যে ভ’রে তোলা, সব কিছু ঘিরে রহস্যের জাল বোনা। আদি পুরাণরচয়িতারা বিস্মিত হয়েছিলেন বিশ্বকে দেখে, বুঝতে পারেন নি বিশ্বকে, তার নীল আকাশ ও সূর্য চাঁদ তারা তাঁদের চোখে সৃষ্টি করেছে বিভ্রম; তাঁরা বিশ্বের শৃঙ্খলা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন রহস্যময় ঘোলাটে কল্পনার সাহায্যে । কল্পনা অনেক সময় সুন্দর, এবং সাধারণত সত্য নয়। তাঁরা ক’রে গেছেন বিশ্বের রহস্যীকরণ; যা নেই, কখনো ছিলো না, কখনো থাকবে না, সে-সব সৃষ্টি ক’রে প্রচলন করেছেন তাদের পুজো। রহস্যীকরণের ধারা আজো থামে নি, বরং চলছে পুরোদমে; মানুষ নানাভাবে রহস্যীকরণ করেছে বিশ্বের; ধর্ম দর্শন সাহিত্য ও আরো বহু কিছু সৃষ্টি করে রহস্যে বা পুরাণে ভ’রে তুলেছে বিশ্ব । এখন কেউ আর বিশ্বাস করে না ইন্দ্র, শচী, জিউস, অ্যাপোলো, হেলিওস, থর, বৃহস্পতি, শনি, লাত, মানত, উজ্জা, দিউনিসিউস, ইশতার, তাম্বুজ, আইসিস, ইজানামিতে; এদের হটিয়ে নতুন নতুন পুরাণ অধিকার করেছে মানুষকে । কয়েকটি ধর্ম আজ খুব প্রভাবশালী, মানুষ এগুলোকে মনে করছে শাশ্বত, কিন্তু এগুলো অর্বাচীন পুরাণমাত্র। এগুলোতে কল্পনা করা হয়েছে নতুন নতুন বিধাতা বা দেবতা পুজো করছে তাদের পরম ভেবে; এমন বহু ধর্ম চার-পাঁচ হাজার বছর টিকে লোপ পেয়ো গেছে। বিশশতকের শেষ বছরের মানুষ উপহাস করে আইসিস ও ইশতারকে, কিন্তু পুজো করে তাদের দেবতাদের, মনে করে তাদের দেবতারা সত্য। লুপ্ত ধর্মগুলোর মতোই তাদের দেবতারা, একদিন লোপ পেয়ো যাবে। বিজ্ঞানের এই বিপুল সাফল্যের যুগেও দিকে দিকে বিশ্বের রহস্যীকরণ প্রক্রিয়া চলছে প্রচণ্ডভাবে।

বিজ্ঞান রহস্য সৃষ্টি করে না, দূর করে; বিজ্ঞান বের করে প্রকৃতির কর্মকাণ্ডের সূত্র, উদ্ভাবন করে অভিনব সামগ্রী। বিজ্ঞান বিশ্বকে বা মহাবিশ্বকে বের ক’রে আনে রহস্যের আবরণের ভেতর থেকে, দেখিয়ে দেয় তার পদার্থিক রূপ। বিজ্ঞান কখনো বলে না আমি সব জেনে গেছি, জানার আর কিছু নেই মহাবিশ্বে, কয়েকটি পুথিতে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে সব সত্য, এবং আমার সত্যকে পুজো করতে হবে । বিজ্ঞানের মূলকথা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমি উদ্ঘাটন করছি প্রকৃতির শৃঙ্খলা, চিরকাল এভাবেই উদ্ঘাটন ক’রে যাবো। বিজ্ঞান জানা সূত্র নতুনভাবে উদ্ঘাটন করে না, যা জানা হয় নি তারই সূত্র বের বরে । প্রচলিত শক্তিমান পুরাণ বা ধর্মগুলো বলে সব জানা হয়ে গেছে, জানার কিছু আর বাকি নেই, বিধাতারা সব জানিয়ে দিয়েছে, তার পাঠানো বইয়ে সব আছে, মানুষের কাজ হচ্ছে ওগুলোর পুজো করা । এর চেয়ে শোচনীয় আর কিছু হ’তে পারে না। পুরাণগুলো প্রথমে বিরোধিতা করে বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলোর, কিন্তু যখন পেরে ওঠে না, বুঝতে পারে বিজ্ঞানকে প্রতিরোধ করা যাবে না পুরোনো পুথির ক্রোধের সাহায্যে, তখন বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত রীতিগুলো না বুঝে দাবি করে যে তাদের বিধাতাদের বইতে বিজ্ঞানের সব কথা আছে । তখন তারা ওই সব বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে দেখতে পায় বিজ্ঞান । আগে দেখতে পায় না, পায় পরে; অভিকর্ষ আবিষ্কৃত ও গৃহীত হওয়ার পরে দেখতে পায় তাদের বইতেও আছে অভিকর্ষের তত্ত্ব। বিধাতার বইগুলোর তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিজ্ঞান নয়, ওগুলো ছদ্মবিজ্ঞান; বিজ্ঞানের মুখোশ প’রে ওগুলো প্রচার করে অন্ধতা।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের কাজ মহাবিশ্বকে রহসের মুখোশের ভেতর থেকে বের ক’রে আনা; খুঁজে দেখা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে মহাবিশ্ব, তার বিকাশ চলছে কী রীতিতে, আর মহাবিশ্ব জুড়ে কী আছে। কোপারনিকাসের পর জ্যোতির্বিজ্ঞান বদলে দিয়েছে মানুষের বিশ্বধারণা; আগে যা ছিলো একটি বদ্ধ ছোটো এলাকা, তা হয়ে উঠেছে অনন্ত মহাবিশ্ব, তাতে মানুষ এক ছোটো কিন্তু প্রতিভাবান সত্তা। মানুষ যা জেনেছে, তা জানে না তাদের বিধাতারা। মানুষ যেমন বিজ্ঞান চর্চা করে, তেমনি চর্চা করে কুসংস্কার; অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞানের থেকে কুসংস্কার চর্চাই করে বেশি, কুসংস্কারই তাদের শান্তি দেয় । তারা নেয় বিজ্ঞানের সুবিধাগুলো; জানে না। বিজ্ঞানের মূলকথা, জানলে বিরূপ হয়ে ওঠে বিজ্ঞানের ওপর। বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত বস্তুগুলো ব্যবহার করে তারা, কিন্তু ডুবে থাকে পৌরাণিক কুসংস্কারে; কুসংস্কারে এক ধরনের পাশবিক স্বস্তি আছে, কিন্তু প্রকৃত মানুষের মন কোনো স্বস্তি জানে না । জ্যোতির্বিজ্ঞানের মহাবিশ্বে আকাশমণ্ডলে কোনো স্থান নেই পৌরাণিক দেবতাদের, দেবদূতদের, শয়তানের, স্বর্গনরকের, পুনরুত্থানের; ওসব মানুষের অপকল্পনা । পৃথিবী নীল আকাশে ঢেকে আছে ব’লে, এবং আরো অনেক কারণে, আমরা সহজে বুঝে উঠতে পারি না আমরাও আকাশমণ্ডলেরই অধিবাসী; পৃথিবী ঘুরছে সূর্যকে ঘিরে, সূর্য ঘুরছে ছায়াপথকে ঘিরে; এবং ছায়াপথ ছুটে চলছে দূর থেকে দূরে । মহাবিশ্ব এক অনন্ত শূন্য শীতল অন্ধকার এলাকা, যদিও সেখানে আছে কোটি কোটি কোটি সূর্য । জ্যোতির্বিজ্ঞান কাজ করে মহাবিশ্ব নিয়ে; এটা গাড়ি বা খাবার ঠাণ্ডা রাখার যন্ত্র তৈরি করে না; তাই এ-সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই ৷ অধিকাংশ মানুষ জানেই না যে জ্যোতির্বিজ্ঞান ব’লে আছে এক অসামান্য বিজ্ঞান । তারা জানে না জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা, জানে জ্যোতিষশাস্ত্রের কথা; অনেকে দুটি সম্পূর্ণ বিরোধী ব্যাপারকে- জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রকে মনে করে অভিন্ন । জ্যোতির্বিজ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞান, আর জ্যোতিষশাস্ত্র কুসংস্কার।

জ্যোতিষশাস্ত্র অবৈধভাবে উৎসারিত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকেই । প্রাচীন কিছু অসাধারণ বিজ্ঞ মানুষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন আকাশমণ্ডলে গ্রহ নক্ষত্র সূর্য চন্দ্র প্রভৃতির অবস্থান, তাদের গতিবিধি, তাঁরা চর্চা করেছিলেন বিজ্ঞান; কিন্তু তা প্রথা আর কুসংস্কারে পরিণত হয়ে রূপ পায় জ্যোতিষশাস্ত্রের। কয়েক হাজার বছর অতীতে ফিরে গেলে এমন এক পৃথিবীর অধিবাসী হয়ে উঠি আমরা, যেখানে আকাশ হচ্ছে বার্ষিক দিনপঞ্জি আর প্রতিদিনের সংবাদপত্র । সে-পৃথিবীতে নক্ষত্র দেখে ঠিক করতে হতো কখন ফসল বুনতে হবে, নদীতে বন্যা আসবে কখন; এবং এর সাথে জড়িয়ে থাকতো নানা ভয় । দেশের রাজা মারা গেছে, মারা গেছে সে অসুখেই, কিন্তু তখন মিথুনরাশিতে হয়তো ছিলো মঙ্গলগ্রহ, বা আকাশে ধীরেধীরে এসে ঝুলে থাকছিলো একটি ধূমকেতু, এবং পুরোহিতেরা জানিয়ে দিচ্ছিলো ধূমকেতু এসেছে ব’লে বা মিথুনে মঙ্গল অবস্থান করেছে ব’লে মৃত্যু হয়েছে রাজার। ধূমকেতু আর মিথুনে মঙ্গলের বাসের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই রাজার মৃত্যুর; একটি মারাত্মক ভুল করেছে পুরোহিতেরা, কিন্তু একেই সত্য ব’লে মেনে নিতে হয়েছে । তারা দেখে আমরা বাস্তব কতকগুলো কাজ করতে পারি, বিশেষ মাসে আকাশের বিশেষ স্থানে থাকে বিশেষ তারামণ্ডল, কিন্তু পুরোনো কালে অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করে গ্রহনক্ষত্র নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের জীবনও। যুক্তিটি হচ্ছে যদি গ্রহনক্ষত্র নিয়ন্ত্রণ করে নদীর বন্যা, ঋতু পরিবর্তন, তাহলে কেনো নিয়ন্ত্রণ করবে না মানুষের জীবন? এ-কুসংস্কারের নামই জ্যোতিষশাস্ত্ৰ ৷

জ্যোতিষশাস্ত্র ছদ্মবিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের মুখোশপরা কুসংস্কার; উদ্ভব ঘটেছিলো এর ৩০০০ বছর আগে ব্যাবিলনে । জ্যোতিষশাস্ত্র যে ছদ্মবিজ্ঞান, তা ধরা পড়ে এর মূল খুঁজলেই । ছদ্মবিজ্ঞান এমন ব্যাপার, যাতে বিজ্ঞানের চমকপ্রদ ছলাকলাগুলো ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ব্যবহৃত হয় না বিজ্ঞানের রীতিনীতি পদ্ধতিগুলো; এতে থাকে না বিজ্ঞানের তত্ত্ব, পরীক্ষানিরীক্ষা, ও তত্ত্ব সংশোধনের উদ্যোগ । ধর্মের বইগুলোর বৈজ্ঞানিকতা প্রমাণ করার জন্যে যেমন পাতায় পাতায় নানা বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ও ধারণার উল্লেখ করে ছদ্মবৈজ্ঞানিকেরা, কিন্তু মেনে চলে না বিজ্ঞানের রীতিনীতি, জ্যোতিষশাস্ত্রেও ঘটে তাই। মোটামুটি ৩০০০ বছর আগে যখন উদ্ভব ঘটেছিলো জ্যোতিষশাস্ত্রের, এর সাথে জড়িয়ে ছিলো নানা যাদুবিশ্বাস। যাদুবিদ্যা প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলোর সাথে জড়িয়ে দিতো মানবিক ব্যাপারগুলো, যদিও প্রাকৃতিক ব্যাপারের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই মানবিক ব্যাপারের; যেমন, বর্ষা আসার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই কারো বিয়ের বা সন্তান প্রসবের, বা মৃত্যুর । বিলের ওপর দিয়ে পাখিদের উড়ে যাওয়া, বা জবাই করা পশুর অন্ত্রের ভাঁজ দেখে আজ কেউ নিজের ভাগ্য নির্ণয় করে না; কিন্তু ব্যাবিলন ও রোমে এটাই করা হতো যখন উদ্ভূত হচ্ছিলো জ্যোতিষশাস্ত্র । প্রাচীন মানুষদের সবাই নির্বোধ বা কুসংস্কারাচ্ছন্নও ছিলেন না; তাঁরা আকাশের গ্রহনক্ষত্র দেখে বিজ্ঞানীর মতোই নির্ধারণ করতেন সম্ভাব্য প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো। কোন নক্ষত্র উঠলে আসবে কোন ঋতু অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা তা নির্দেশ করতে পারতেন; যেমন, প্রাচীন মিশরের পুরোহিত- জ্যোতির্বিদেরা লুব্ধককে দেখে ব’লে দিতে পারতেন যে নীল নদে প্লাবনের সময় এসে গেছে, শুরু হবে বর্ষা। লুব্ধকের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই মানুষের জীবনের; তবে এটা ভাবা বেশ স্বাভাবিক ছিলো যদি নক্ষত্র নিয়ন্ত্রণ করে প্রাকৃতিক ঘটনা, তাহলে তা কেনো নিয়ন্ত্রণ করবে না মানুষের জীবন? গ্রহনক্ষত্র প্রাকৃতিক ঘটনাও নিয়ন্ত্রণ করে না, লুব্ধকের উদয়ে বর্ষা আসে না, আসে অন্য কারণে,- আসে পৃথিবী তার কক্ষপথের এক বিশেষ স্থানে থাকে ব’লে । মানুষ একটি ঘটনার পর আরেকটিকে ঘটতে দেখলে তাদের সম্পর্কিত করতে চায়, খোঁজে তাদের মধ্যে সম্পর্ক; মনে করে আগেরটির জন্যেই ঘটেছে পরেরটি । একটি লাতিন প্রবচন আছে- পোস্ট হক, এর্গো প্রোপ্টের হক : যেহেতু এর পরে, সেহেতু এর কারণে । কখনো কখনো এটা সত্য হ’তে পারে, এবং অনেক সময়ই সত্য নয় । জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূচনার সময় যা ছিলো বিজ্ঞান, পরে সেটা অধঃপতিত হয়ে পরিণত হয় পুরাণ ও ছদ্মবিজ্ঞানে । আগে যেখানে চর্চা হতো বিজ্ঞান, পরে সেখানে শুরু হয় যজ্ঞ পুজো আচার আনুষ্ঠানিকতা।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূচনার কালে কোনো জ্যোতির্বিদ হয়তো দেখেছিলেন মঙ্গল বা শুক্রকে, তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাদের অবস্থান; পরে ওই অবস্থানকে পরিণত করা হয়েছিলো পুরাণে। যেমন, খ্রিপূ ১৬০০ অব্দে লিপিবদ্ধ একটি পুথিতে শুক্রের গতিবিধি বর্ণনা করা হয়েছে, এটা বিজ্ঞান; কিন্তু তাতে শুক্রের গতিবিধির সাথে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে তখনকার ঐতিহাসিক ঘটনা, এবং বিশ্বাস করা হয়েছে যে ভবিষ্যতে যখন শুক্র এমন গতিবিধি পালন করবে, তখন পুনারবৃত্তি ঘটবে ঘটনাগুলোর- এটা জ্যোতিষশাস্ত্র, ছদ্মবিজ্ঞান । ওই পুথিতে বলা হয়েছে : যদি আবু মাসের ষষ্ঠ দিনে পুব দিকে আবির্ভূত হয় শুক্র, তাহলে আকাশমণ্ডলে বৃষ্টিপাত হবে এবং ঘটবে বিপর্যয়। থ্রি ৬৬৮ অব্দের এক আসিরীয় জ্যোতিষী রাজাকে জানিয়েছেন যদি তৃতীয় মাসে দেখা দেয় বৃহস্পতি, তাহলে ধ্বংস হবে দেশ এবং বৃদ্ধি পাবে খাদ্যের দাম; যখন বৃহস্পতি প্রবেশ করবে কালপুরুষমণ্ডলে দেবতারা খেয়ে ফেলবে দেশ। মেসোপটেমিয়ার জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রিসে এসে পরিণত হয় জনপ্রিয় হুজুগে । থ্রিপূ ৩৫০ অব্দের দিকে অনেক দার্শনিকও আকাশের তারামণ্ডলে দেখতে শুরু করেন দেবতাদের মুখ; অর্থাৎ তারামণ্ডলে আছে দেবতারা, তাই তারারা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের ভাগ্য । শুরু হয়ে যায় ভাগ্যগণনা, প্রথম রাজাদের, তারপর অমাত্যদের, তারপর সাধারণ মানুষের। জ্যোতিষশাস্ত্র ছড়িয়ে পড়ে ভারতে, চিনে; অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় ধর্মের। রাজারা খুবই স্পর্শকাতর ছিলো জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে, সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতো তারা নিজেদের ভাগ্য নিয়ে, নিয়োগ করতো রাজজ্যোতিষী; গণনা ভুল হ’লে অনেক সময় জ্যোতিষীকে দিতো মৃত্যুদণ্ড।

রাশিচক্র। জ্যোতিষীরা এ-ধরনের চক্রে লিপিবদ্ধ করে জাতকের কুষ্ঠি। এ-রাশিচক্রটিতে এক ব্যক্তির জন্মের সময় তারা ও গ্রহের অবস্থান দেখানো হয়েছে । আরো অনেক তথ্য দিয়ে জটিল ও পৌরাণিক ক'রে তোলা যেতো রাশিচক্রটিকে।

জ্যোতিষীরা কারো ভাগ্য গণনার জন্যে তৈরি করেন একটি রাশিচক্র। রাশিচক্র একটি চক্রাকার চিত্র, যাতে বিশেষ কোনো দিনে তারামণ্ডলের পটভূমিতে দেখানো হয় বিভিন্ন গ্রহ, সূর্য, ও চাঁদের অবস্থান। ওই অবস্থান অনুসারে নেয়া হয় সিদ্ধান্ত । পাশ্চাত্যে ভিনাস (শুক্র) প্রেমের দেবী, তাই ভিনাস যদি থাকে বিশেষ স্থানে, তাহলে জাতকের ওপর প্রেম ভর করবে ব’লে মনে করা হয়। ভারতীয় পুরাণে শুক্র অসুরদের গুরু; তাই তার প্রভাবে প্রেমাবেগের বদলে জাগার কথা হিংস্রতা। কোনো ব্যক্তি পশ্চিমের রাশিচক্র অনুসারে যখন ভুগবে প্রেমাবেগে, তখন ভারতীয় রাশিচক্র অনুসারে তার সে হয়ে উঠবে হিংস্র। জাতকের ওপর গ্রহনক্ষত্রের কী প্রভাব পড়বে, তা অনেক আগেই স্থির ক’রে গেছেন প্রাচীন জ্যোতিষীরা; এখনকার জ্যোতিষীরা অনুসরণ করেন পুরোনো বিধিই।

পুরোনো বিধি অবশ্য আজকের জ্যোতিষীদের জন্যে সৃষ্টি করেছে বিব্রতকর সমস্যা। তারার পটভূমিতে সূর্যের পথ অনুসারে ৪০০০ বছর আগের জ্যোতিষীরা স্থির ক’রে গেছেন ১২টি রাশি । তারার পটভূমিতে সূর্যের যাত্রাপথ ব্যাপারটি এক বিভ্রম, সূর্য তারাদের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করে না; তবু পশ্চিম থেকে পুব দিকে কল্পিত সূর্যপথটি আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে। যদি প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো মাসের পর মাস একেকটি তারামণ্ডল ডুবছে পশ্চিমে, এবং ঠিক ৩৬৫ দিন পর আগের স্থানে ফিরে এসেছে আগের তারামণ্ডলটি । এটি এক বিভ্রম; আমরা পৃথিবী থেকে সূর্যের দিকে তাকাই, পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘোরে, তাই আমরা সূর্যকে পেরিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেখতে পাই বিভিন্ন তারামণ্ডল । সূর্য ওই সব তারামণ্ডলের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করে না; বিভ্রমবশত আমাদের মনে হয় সূর্য ভ্রমণ করছে তারাদের ভেতর দিয়ে । সূর্য যে-১২টি তারামণ্ডলের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করে ব’লে মনে হয়, তাদের বলা হয় রাশি। জ্যোতিষীরা প্রত্যেক রাশিকে একেক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব’লে মনে করেন, এবং মনে করেন বিশেষ রাশির জাতকের ওপর পড়ে বিশেষ রাশির প্রভাব।

রাশির ভেতর দিয়ে সূর্যপথ। পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে বা পশ্চিম থেকে পুবে ঘোরে, তাই পৃথিবী থেকে মনে হয় সূর্য পশ্চিম থেকে পুব দিকে ভ্রমণ করছে রাশিমণ্ডলের ভেতর দিয়ে। এ-চিত্রে সূর্য আছে সিংহরাশিতে, একমাস পর যাবে কন্যারাশিতে, পরের মাসে তুলারাশিতে। সূর্য মাসে পেরোয় একটি ক'রে রাশি । সূর্য আসলে এভাবে ভ্রমণ করে না, এটা আমাদের দৃষ্টিবিভ্রমমাত্র।

সমস্যা হচ্ছে সূর্য রাশিচক্রের তারাদের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করে না; আর যদি ধ’রেও নিই যে সূর্য ভ্রমণ করে রাশির তারাদের ভেতর দিয়ে, তাহলে আরেকটি সমস্যা দেখা দেয় যে সূর্য চিরকাল একই রাশিতে উদিত হয় না। থ্রিপূ ১৮৬৭ অব্দের ২১ মার্চে (বসন্তবিষুব) সূর্য আকাশগোলকের বিষুবরেখা পেরিয়ে উত্তর গোলার্ধের যে-স্থানে প্রবেশ করে, সেখানে ছিলো মেষরাশি । তাই ২১ মার্চ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে যারা জন্মে, তারা মেষরাশির। তখনকার জ্যোতিষীরা মনে করেছিলেন সূর্য চিরকাল বসন্তবিষুবের সময় উদিত হয় মেষরাশিতে। খ্রিপূ ১৩০ অব্দে হিপ্পারকাস আবিষ্কার করেন যে পৃথিবীর শিরের অভিমুখ বদলে যায়, ঘটে পৃথিবীর শিরের অভিমুখবদল : প্রিসেশন; তাই আর বসন্তবিষুবে সূর্য মেষরাশিতে ওঠে না। ২০০০-এর কিছু বেশি বছর ধ’রে বসন্তবিষুবে সূর্য ওঠে একটি বিশেষ রাশিতে, তারপর ওঠে অন্য রাশিতে। পৃথিবীর শিরের অভিমুখবদলের ফলে ২৬,০০০ বছর পর সূর্য আবার ওঠে ২৬,০০০ বছর আগে যে-রাশিতে উঠতো, সে-রাশিতে । পৃথিবীর অভিমুখবদলের ফলে রাশি বদলায়, বদলায় ধ্রুবতারা। খ্ৰিপূ ১২৫০০ অব্দে সূর্য ছিলো কন্যায়, থ্রিপৃ ১০৮০০ অব্দে ছিলো সিংহে, এখন আছে মীনে । তাই এখন রাশিচক্রের রাশির সাথে সূর্যের রাশির মিল নেই।

টলেমির সময়ের জ্যোতিষীরা পৃথিবীর অভিমুখবদলের ব্যাপারটি বুঝেছিলেন, এবং সমস্যা সমাধানের উপায় বের করতে না পেরে সমস্যা সমাধান করেছিলেন জোর ক’রে । তাঁরা বসন্তবিষুব থেকে শুরু করে ৩০ ডিগ্রি পর পর নির্ধারণ করেছিলেন একেকটি রাশি; এবং দাবি করেছিলেন যে তাঁদের রাশিচক্রের রাশিই গুরুত্বপূর্ণ, সূর্য কোন তারামণ্ডলে আছে, তার কোনো মূল্য নেই! তাই এখনো ২১ মার্চ-১৯ এপ্রিলে যারা জন্মে, তারা মেষরাশির, যদিও সূর্য ওঠে মীনরাশিতে। আকাশের বাস্তবতার সাথেও আর সম্পর্ক নেই জ্যোতিষশাস্ত্রের। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এখন আমরা জানি তারাগুলো ছুটে চলছে তীব্র গতিতে; হাজার হাজার বছর পর বদলে যাবে তারামণ্ডলগুলোর আকৃতিও। তখন হয়তো জ্যোতিষীরা নতুন রাশি বের ক’রে সেগুলোর জন্যে খুঁজবেন নতুন বৈশিষ্ট্য। নভচারীরা যখন কয়েক বছরের মধ্যে পৌছোবেন মঙ্গলে, তারা দেখবেন সেখানে কোনো সমরদেবতা নেই; বরং তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন মঙ্গলের ওপরে। সেখান থেকে তাঁরা দেখবেন একটি নতুন গ্রহ- দেখবেন পৃথিবী পেরিয়ে যাচ্ছে রাশিচক্র। তখন মঙ্গলের জ্যোতিষীদের রাশিচক্র থেকে বাদ পড়বে একটি পুরোনো গ্রহ, যুক্ত হবে একটি নতুন গ্রহ।

জ্যোতিষশাস্ত্রকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরখ করে দেখা দরকার তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সত্যিই কাজ করে কি না। বিভিন্ন ব্যক্তির ভাগ্য, শুভাশুভ, সম্পর্কে জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী সব সময়ই বার্থ বা বিসাত্ত্বিকরভাবে সফল- প্রমাণ করা যায় না তা ঠিক হলো না ভুল হলো; তাই এখন জ্যোতির্থীরা ভবিষ্যদ্বাণীর বদলে সাধারণত দেন হিতোপদেশ। তাদের ভবিষ্যদ্বানী বারবার ব্যর্থ হয়েছে ব্যক্তির থেকে আরো বড়ো এলাকায় । ১১৮৬ অব্দে সব তাহ ভাড়ো হয়েছিলো তুলারাশিঙে; জ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বিশ্ব জুড়ে দেখা দেখে বিপর্যয়, কেননা জ্যোতিষশাস্ত্রে তুলারাশি বোঝায় ঝড়ঝঞ্ঝা। তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীতে ভয় পেয়ে জার্মনির লোকেরা খুঁড়েছিলো বহু আশ্রয়গহ্বর, ক্যান্টারবারির মহাপুরোহিত সবাইকে নির্দেশ দিয়েছিলো উপবাসের; বাইজেন্টিয়ামের রাজপ্রাসাদের চারদিকে তোলা হয়েছিলো শক্ত দেয়াল; অনেক দেশে লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো পাহাড়ের গুহায়। সে-বছর আকাশে গ্রহরা সংযোগে এসেছিলো, কিন্তু কোনো বিপর্যয় ঘটে নি । ১৫২৪ অব্দে সবগুলো গ্রহ জড়ো হয়েছিলো কুম্ভরাশিতে; জ্যোতিষীরা বলেছিলেন যে এবার ঘটবে দ্বিতীয় মহাপ্লাবন। কিন্তু কোনো বিপর্যয় ঘটে নি; বরং কিছুটা কম বৃষ্টিপাত হয়েছিলো সে-বছর। একইভাবে জ্যোতিষীরা বলেন যে ১৯৮২র মার্চ মাসে ঘটবে প্রচণ্ড ভূমিকম্প ও দুর্যোগ, কেননা বৃহস্পতি, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ অবস্থান করবে একই পংক্তিতে। এবারও কোনো বিপর্যয় ঘটে নি । জ্যোতিষী ও ছদ্মবিজ্ঞানীদের সব কিছুই ভুল ও বড়ো প্রতারণা।

জ্যোতিষশাস্ত্র প্রাচীন যাদুবিদ্যার আত্মীয়, তার রাশিচক্র বিশশতকের আকাশের তারামণ্ডলের সাথে সামঞ্জস্যহীন, তার ভবিষ্যদ্বাণী ভ্রান্ত; তাই আমরা বিশ্বাস করতে পারি না জ্যোতিষশাস্ত্রে, জীবনও পরিকল্পনা করতে পারি না তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে। বিজ্ঞানের এই অসাধারণ যুগে আমরা নিয়ন্ত্রিত হ’তে পারি না পুরোনো যাদুবিদ্যা দিয়ে । এটা নানাভাবেই ক্ষতিকর; জ্যোতিষশাস্ত্র নষ্ট করে মানুষের আত্মবিশ্বাস, এবং অপহরণ করে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ। হাজার হাজার বিভ্রান্ত মানুষ তাদের সামান্য আয়ের এক বড়ো অংশ ব্যয় ক’রে জ্যোতিষীদের কাছে থেকে ক্রয় করে প্রতারণা। এখন অনেক জ্যোতিষী গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান দেখার জন্যে ব্যবহার করেন কম্পিউটার; এটাও এক বড়ো ধাপ্পা- সাধারণ মানুষ বোঝে না যে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আর বিজ্ঞান এক জিনিশ নয়, তাই তারা জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞানসম্মত ভেবে প্রতারিত হয়।

বিজ্ঞান আমাদের বদলে দিয়েছে, মুক্ত করছে বহু বিভ্রান্তি থেকে, কিন্তু পৃথিবী আজো ডুবে থাকতে চাচ্ছে বিভ্রান্তিতে । জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতি বদল ঘটিয়েছে মানুষের অনেক প্রিয় ভ্রান্ত বিশ্বাসের; এখন আর আমরা মনে করি না আকাশের ওপরে আছে স্বর্গ, আর পৃথিবীর নিচে, পাতালে, আছে নরক; এখন আর আমরা বিশ্বাস করি না পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্র, তাকে ঘিরে ঘুরছে সূর্যতারা; আমরা মনে করি না আকাশমণ্ডল শাশ্বত চিরঅপরিবর্তনীয়। মনে করি না যে আকাশমণ্ডলে বিরাজ করছে বিচিত্র রকম বিধাতা, দেবতা, দৈত্য, দেবদূতেরা। আমরা জানি গ্রহগুলো ঘুরছে সূর্যকে ঘিরে, সূর্য ঘুরছে ছায়াপথ ঘিরে; জানি মানুষ বিরাট দীর্ঘ জৈবশেকলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে একদল মানুষ আছে, যারা বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো ভোগ করে, কিন্তু মেনে নিতে পারে না বিজ্ঞানের চেতনাকে । তারা অভিযোগ করে- অনেক সময়ই তাদের অভিযোগ হয়ে ওঠে অতি উগ্র- বিজ্ঞানের অগগ্রতি নষ্ট করছে মানুষের ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধগুলো; তাই নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো । তারা বিশেষভাবেই বিরোধী জৈববিবর্তনবাদের, এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানও তাদের বড়ো মর্মপীড়ার কারণ। তারা বিশ্বাস করে নানা ভ্রান্ত ভাবাদর্শে; এবং নিজেদের ভাবাদর্শ চাপিয়ে দিতে চায় বিজ্ঞানের ওপর।

বিজ্ঞানবিরোধীরা মাঝেমাঝে পেশ করে নানা প্রকল্পনা, যেগুলোকে তারা দাবি করে বিজ্ঞান ব’লে, কিন্তু গুগুলো ছদ্মবিজ্ঞান বা অ-বিজ্ঞান । আমরা পেশ করতে পারি যে-কোনো প্রকল্পনা, কিন্তু ওগুলোকে পরখ ক’রে নিতে হয়, দেখতে হয় ওগুলো উপাত্ত ব্যাখ্যা করতে পারে কিনা । ভালো প্রকল্পনা কোনো-না-কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করে প্রকৃতি সম্পর্কে; তার ভবিষ্যদ্বাণী যদি ভুল হয়, তাহলে সেটিকে বাতিল ক’রে দিতে হয়, বা সংশোধন করতে হয় । ছদ্মবিজ্ঞান এটা মানে না; তার প্রকল্পনাকে পরখ করে না, প্রকল্পনাকেই চরম সত্য ব’লে ঘোষণা করে। ছদ্মবিজ্ঞান হচ্ছে একরাশ প্রকল্পনা, যেগুলোকে প্রচারকারীরা ধ’রে নেয় সত্য ব’লে, কিন্তু তার পেছনে থাকে না কোনো পরীক্ষনিরীক্ষা বা তথ্যগত প্রমাণ। ছদ্মবিজ্ঞানের পেছনে থাকে সাধারণত ধর্মীয় ও আর্থিক প্রবর্তনা। ছদ্মবিজ্ঞানে এলোমেলোভাবে ব্যবহার করা হয় নানা বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয় সাড়াজাগানো বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো, উল্লেখ করা হয় নানা বিভ্রান্তিকর প্রমাণ, মনগড়া বহু কিছু চালিয়ে দেয়া হয় প্রমাণ ব’লে । কোনো প্রকল্পনা তার বিষয়ের জন্যে ছদ্মবিজ্ঞান হয়ে ওঠে না, ছদ্মবিজ্ঞান হয়ে ওঠে রীতিনীতিপদ্ধতির জন্যে- এগুলোর রীতিনীতি পদ্ধতি অবৈজ্ঞানিক । বিজ্ঞানচর্চার জন্যে নয়, বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রচারিত হয় ছদ্মবিজ্ঞান । ছদ্মবিজ্ঞান ক্ষতিকর; এগুলো চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারের নামে পেশ করে অতীন্দ্রিয়তা, যাদুবিশ্বাস, এবং অপহরণ করে পাঠকের অর্থ। এগুলো বিভ্রান্তিকরভাবে উপস্থাপন করে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষদের মনে, এবং গ’ড়ে তোলে মননশীলতাবিরোধী মনোভাব। ছদ্মবিজ্ঞান এমন ধারণা তৈরি করে যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো ধর্ম ও যাদুর সাহায্যেই সম্পন্ন করা যায়; বা তাদের ধর্মের বইয়ে এসব অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয়ে আছে।

ছদ্মবিজ্ঞানের একটি ধারা গ’ড়ে উঠেছিলো তথাকথিত অদ্ভুত অপার্থিব ঘটনার চাক্ষুষ বিবরণ ঘিরে; এটা খুব সাড়া জাগিয়েছিলো এক সময় । প্রকল্পনা করতে কোনো বাধা নেই যে পৃথিবীতে ঘটে অদ্ভুত অপার্থিব ঘটনা, এমনকি ভিন্ন গ্রহ থেকে হানা দিতে পারে আগন্তুকেরা; তবে প্রকল্পনাই যথেষ্ট নয়, বৈজ্ঞানিকভাবে পরখ ক’রে দেখা দরকার এসব অপার্থিব ঘটনা ঘটেছে কিনা, এবং ঘটা সম্ভব কিনা । এক সময় ‘ইউএফও’ বা ‘অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু’ দেখার হিড়িক পড়েছিলো পশ্চিমে । কেউ দেখতে পাচ্ছিলো উড়ন্ত পিরিচ বা সসার, কেউ দেখতে পাচ্ছিলো বিচিত্র আকারের আলোর ঝলক। বৈজ্ঞানিকভাবে পরখ ক’রে দেখা গেছে অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু সম্পর্কিত অধিকাংশ বিবরণ ও বই ছদ্মবিজ্ঞানমাত্র। এখন প্রমাণ হয়ে গেছে ইউএফও ছিলো একটি অপপ্রকল্পনা। তবে মানুষ যে আকাশে উড্ডীন অদ্ভুত বস্তু একেবারেই দেখে নি, তা নয়। সম্প্রতি মার্কিন সমরবাহিনী জানিয়েছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তারা অদ্ভুত আকৃতির অতিদ্রুতগতিশীল এবং অনেক উঁচুতে উড়তে পারে, এমন গোয়েন্দা বিমান তৈরির চেষ্টা করেছিলো। ওই সংবাদ জনগণকে জানানো হয় নি । তাদের কোনো কোনো বিমানকে আকস্মিকভাবে দেখতে পেয়েছে কেউ কেউ, ভালোভাবে কেউ দেখতে পায় নি; ওগুলোকেই জনগণ অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু ব’লে মনে করেছে, এবং তাদের গবেষণা যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জানতে না পারে সে-জন্যে তারাও প্রচার করেছে অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তুর কিংবদন্তি।

ছদ্মবিজ্ঞানের আরেকটি ধারা গ’ড়ে উঠেছিলো তথাকথিত আদিকালের নভচারীদের পৃথিবীতে আগমন ও বিভিন্ন জিনিশ তৈরির কল্পিত বিবরণে । এগুলো ছিলো সম্পূর্ণ বাজেকথা, কিন্তু সাড়া জাগিয়েছিলো বিশ্ব জুড়ে । জ্যোতির্বিজ্ঞান সৌরজগত ও মহাবিশ্বকে ভালোভাবেই উদ্ঘাটন করেছে, এবং এখন এটা নিশ্চিত যে সৌরগজতে পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব নেই। তাই অন্য কোনো গ্রহ থেকে আগন্তুক আসার কথা ওঠে না। দূর কোনো তারাকে ঘিরে প্রদক্ষিণরত কোনো গ্রহে কি আছে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব? এটা বের করার জন্যে ফ্র্যাংক ড্রেক উদ্ভাবন করেছেন একটি পদ্ধতি, তাকে বলা হয় ‘ড্রেক সমীকরণ’ । ওই সমীকরণ অনুসারে ১০১৪ (১০০ মিলিয়ন মিলিয়নে ১টিতে) তারার মধ্যে ১টি তারাকে ঘিরে প্রদক্ষিণরত কোনো গ্রহে থাকতেও পারে বুদ্ধিমান প্রাণী। যদি থাকে, তাহলে ওই বৃদ্ধিমান প্রাণীরা কতো দূরে আছে? খুব কাছে যদি থাকে, তাহলেও থাকবে ১৫ আলোক-বর্ষ দূরে। ওই বুদ্ধিমান প্রাণীদের আলোর গতিতে ছুটে পৃথিবীতে আসতে লাগবে ১৫ বছর । কিন্তু আলোর গতিতে ছোটা অসম্ভব । একদল বিজ্ঞানী মনে করেন এতো কাছে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর গ্রহ নেই; যদি থাকে, তাহলে আছে অন্য কোনো নক্ষত্রপুঞ্জে কমপক্ষে ১ কোটি আলোক-বর্ষ দূরে । রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনেক বছর ধ’রে চেষ্টা করছেন অন্য গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের সংকেত পাওয়ার, কিন্তু পান নি। যদি ধ’রে নিই ১ কোটি আলোক-বর্ষ দূরে আছে কোনো বুদ্ধিমান সভ্যতা, তারা আমাদের পাঠিয়েছে রেডিও সংকেত, তাহলে তা পৌঁছোতে লাগবে ১ কোটি বছর। তারা যদি কোনো মহাশূন্যযানে পৃথিবীর দিকে যাত্রা করে, তাদের যানের গতি যদি হয় আলোর গতির কম, তাহলে তারা কোনো দিন পৃথিবীতে এসে পৌঁছোবে না। তাই আদিকালে নভচারীরা এসেছিলো পৃথিবীতে অন্য কোনো গ্রহ থেকে, এটা সম্পূর্ণ বাজেকথা ৷

এক ধরনের ছদ্মবিজ্ঞান জন্মেছে বিবর্তনবাদের বিরোধিতা থেকে। একদল মানুষ এখনো মেনে নিতে পারে নি বিবর্তনবাদকে, তারা নিয়মিত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে, এবং সৃষ্টি করেছে এক ছদ্মবিজ্ঞান, যাকে তারা বলে বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্ব : সায়েন্টিফিক ক্রিয়েশনিজম। এর উদ্ভব ঘটেছে ডারউইনি বিবর্তনবাদকে মেনে নিতে না পারার ফলে। ডারউইনি বিবর্তনবাদের সাথে কোনো মিল নেই ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বের; পালেস্টাইন অঞ্চলের ধর্মগুলোতে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে স্বর্গে, তারপর তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে পৃথিবীতে; আর বিবর্তনবাদ অনুসারে মানুষ কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ফল। ধর্মের ওই বইগুলো অনুসারে মানুষ অন্য কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয় নি, পৃথিবীতে তাদের পাঠানো হয়েছে একেবারে আধুনিক কাঠামোতে; পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে । বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা কোনো বৈজ্ঞানিক রীতিতে বিশ্বাস করে না, কিন্তু তারা তাদের তত্ত্বকে দাবি করে ‘বৈজ্ঞানিক’ তত্ত্ব ব’লে; তারা কোনো প্রমাণেও বিশ্বাস করে না। তাদের তত্ত্বে মানুষ, সৌরজগত ও সব কিছু একবারে তৈরি করেছে বিধাতা, আর মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে শয়তান জীবাশ্ম তৈরি ক’রে রেখে দিয়েছে মাটির ভেতরে! সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের খুবই অধিকার আছে তাদের তত্ত্ব প্রস্তাব করার, কিন্তু প্রাকৃতিক প্রমাণের সাহায্যে তা পরখ করা দরকার; এবং তাতে উত্তীৰ্ণ হ’লে তা মেনে নিতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় । কিন্তু তাদের নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তারা বিশ্বাস করে ধর্মের বইয়ে সব উত্তর আছে, বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে ওই উত্তরগুলো নতুনভাবে বের করা। তাদের প্রকল্পনাগুলো ছদ্মবিজ্ঞান; ওগুলো বিভ্রান্ত করে মানুষকে, ক’রে তোলে অন্ধ, মননশীলতাবিরোধী। ধর্মের বইগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ধর্মও নয় বিজ্ঞানও নয়; এগুলো ছদ্মবিজ্ঞান, এবং ছদ্মধর্ম । ধর্ম উঠে যাবে, যেমন অনেক ধর্ম উঠে গেছে; বিজ্ঞান থাকবে, কেননা বিজ্ঞান আবিষ্কার করে প্রকৃতির সূত্র, এবং শক্তিশালী ক’রে তোলে মানুষকে।

error: Content is protected !!