ধাক্কাটা খেলাম তরুণী সাংবাদিক দীপালি মিত্রের কাছ থেকে। “এই যে আপনারা এত বাঘ- সিংহ জ্যোতিষীদের টিভি ক্যামেরার সামনে নাস্তানাবুদ করছেন; তারপরও কিন্তু আপনাদের একটুও পাত্তা না দিয়ে শিয়ালদা চত্বর থেকে মফসসল স্টেশন এলাকায় রমরমিয়ে চলেছে গ্রহরত্নের ব্যাবসা। পাবলিক আপনাদের কথাকে পাত্তা দেবে কেন, যখন নিজের চোখে দেখছে পাথরের অদ্ভুত ক্ষমতা?”
দীপালি একটানে আমাদের আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনলেন। দীপালি যে পাথর ব্যবসায়ীদের কথা বলছেন, তাদের জানি। পাথরগুলোর গুণের কথাও। কোন্ পাথরটা আপনার ধারণ করা উচিত, তা পাথর-ই বলে দেবে। ভাগ্য পালটাতে কোন্ পাথর পরবেন, তা বলে দিতে নেই কোনও জ্যোতিষার। তাই জ্যোতিষীদের ভুলের প্রশ্ন নেই। সাত জ্যোতিষীর সাত রকম পাথর ধারণের প্রেসক্রিপশন নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রশ্ন নেই। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে পাথর কিনতে পারেন।
অসাধারণ এই পাথরগুলোর বৈশিষ্ট্য বড়ই বিচিত্র। হাতের তালুতে এক চামচ পরিমাণ জল নিন। তারপর শ’য়ে শ’য়ে পাথরের মধ্যে থেকে একটি পাথর বাছুন। পাথরটা তালুর জলে রাখুন। জলের রং কী বেগুনি হয়ে গেছে? না হওয়া পর্যন্ত ইচ্ছেমতো পাথর তুলুন ও গণ্ডুষ রাখতে থাকুন। আপনাকে সাহায্য করার জন্য পাথর সাজিয়ে বসা মানুষটি আছে। সেই চামচে করে জল নিয়ে আপনার গণ্ডুষ তৈরিতে সাহায্য করবে। জল চলকে পড়ে শেষ হয়ে গেলে আবার জল দেবে। আপনার নির্বাচিত পাথরটাই তুলে হাতে বসাবে। সেটা নামিয়ে রেখে আরও একটা পাথর বসাবে। যতক্ষণ না জলের রং বেগুনি হয়, এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।
আপনি হয়তো ভাবছেন—এর পিছনে বুজরুকি আছে। ভাবতেই পারেন। চারদিকে এত বুজরুক, পাথরের জল রঙিন করার মধ্যে বুজরুকি থাকতেই পারে। হতে পারে পাথরটা জলে রাখলে জলের রং পাল্টে যায়। সন্দেহ মিটিয়ে ফেলাই ভালো। অন্য কারো গন্ডুষে পাথরটা বসিয়ে দিন। দেখতে পাবেন, জল রং পাল্টায়নি।
আপনি হয়তো কারও কাছে ঠকে যাওয়াটা পছন্দ করেন না। কেউ আপনাকে ঠকিয়েছে— এটা সহ্য করতে পারেন না। আপনি সন্দেহ মেটাতে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। দেখলেন, আরও কয়েকজনের বেলায় পাথর জলের রং দিল পালটে। এমন দেখার পর পাথরটার জন্য ২০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত নিশ্চয়ই দিতে পারেন। আজ পকেটে পুরো টাকা না থাকলে কিছুটা অ্যাডভান্স দিয়ে পাথরটা বুক করে যেতে পারেন। না, ওরা ঠকায় না। বাকি টাকা মিটিয়ে দিলে ঠিক পাথরটি পেয়ে যাবেন। অ্যাডভান্স দিয়েছেন। কোনও রসিদ নেননি। তারপরও ঠকেননি।
পাথরটা পকেটে পুরে আপনার মন খুশি খুশি। খুশি মনে সারাদিন কাজ করে রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুমোবার আগে সারাদিনের কাজ-কর্ম কেমন হল ফিরে দেখুন। অন্য দিনের চেয়েও যেন ভালো হয়েছে, তাই না? এ সবের পর পাথরে অবিশ্বাস করাটাই বোকামি হয়ে যায়। নিকুচি করেছে প্রগতিশীল সাজতে জামার আড়ালে পাথর ঢাকতে। আপনি ভণ্ড নন, তাই পাথর দিয়ে আংটি করেন। আঙুলে পরেন।
এমন অদ্ভুত গুণের পাথর যারা বেচে, তারা কেন শহরের বুকে ঝকঝকে শো’রুম সাজিয়ে বসে না? ওদের-ই প্রশ্ন করুন। উত্তরটা কিন্তু শিয়ালদা থেকে বনগাঁ—সর্বত্র একই পাবেন। ওরা বলবে—আমাদের সে টাকা কই, যে বসব? বউবাজারে শোরুম করা মানে কোটি টাকার ব্যাপার। তার উপর রয়েছে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার খরচ, কর্মচারীদের মাইনে, এসি আর আলোর বন্যার জন্য বড় অংকের বিদ্যুৎ-বিল, ফোন-বিল, জ্যোতিষীদের পাথর বেচার কমিশন, আরও কত কী। যে পাথর এখন বেচি ১০০ টাকায়, তাই তখন বেচতে হবে ১০,০০০-এ। এই যে আপনাদের সেবায় লাগতে পারছি, আপনারা ভালো বাসছেন, এতেই খুশি। লোককে টুপি পরিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ার চেয়ে, ইজ্জতের খুদও ভালো
যে পাথর বিক্রেতা এত সুন্দর কথা বলেন, যে পাথরের এমন গুণ সে পাথর যে ঢেলে বিক্রি হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ক্রেতাদের মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাডভোকেট সবাই আছেন। এরপর এইসব গ্রহরত্নকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিলেই হল? যুক্তিবাদীরা প্রমাণ করুক না, ওদের বুজরুকিটা কোথায়?
স্বীকার করছি নিজেদের অক্ষমতা। ফুটের স্টোন-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারিনি । কেন পারোনি? উত্তর খুঁজতে আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজন।
আমাদের এই অক্ষমতার কারণ—দম্ভ। যে অলৌকিক রহস্য ভেদ করতে পৃথিবীর সব্বাই ব্যর্থ, সেখানে আমরা সফল। একবারের জন্যেও ব্যর্থতা আমাদের কালিমালিপ্ত করেনি। আমাদের নিয়ে ছবি করেছে বি বি সি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, লন্ডনের চ্যানেল ফোর। আমাদের নিয়ে পৃথিবী সব মিডিয়াই প্রচুর হই-চই করে। নিউইয়র্ক টাইমস-এ কাউকে নিয়ে এক কলম লেখা প্রকাশিত হওয়া, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার শামিল এমনটাই মনে করে তাবৎ পৃথিবীর মিডিয়াগুলো। আমাদের কাজকর্ম নিয়ে গোটা পৃষ্ঠা জুড়ে ছবিসহ খবর প্রকাশ করেছে ওরা। পৃথিবীর সবচেয়ে নামী ম্যাগাজিনের অন্যতম ‘টাইম’ আমাদের নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার পত্র-পত্রিকায় আমাদের সমিতির কর্মকাণ্ডের কথা প্রচারিত হয়েছে। এবং অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই হয়েছে। বিভিন্ন দেশের শ’খানেক ওয়েবসাইট খুললেই দেখা যাবে আমাদের নানা কথা, নানা ভেঞ্চার, নানা ভান্ডাফোড়ের কাহিনি। এইসব ওয়েবসাইটের অনেকগুলোই চালান পৃথিবীর বিভিন্ন নামী পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকরা।
এ’সব সত্যিই গর্বের কারণ। শ্রদ্ধেয় কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথায়—“কারও কারও গর্ব মানায়।” আমাদের মানায় কি না—জানি না। তবে এটা জানি, গর্বের আর এক পিঠ দম্ভ। আমরা বাঘ সিংহ জ্যোতিষীদের প্রতারণা ধরব, তাদের গ্রেপ্তার করাব, আর ফুটপাথের এই নিয়তির কারবারিদের তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দূরে ঠেলে রাখব—এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কোথাও গোলমাল আছে। আমাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওরা প্রতিদিন কত মানুষকে ভাগ্য-বিশ্বাসী করে তুলছে—কে জানে ?
দীপালি মিত্রকে ফোন করলাম। জানালাম, কাল আমরা পাথরের রহস্য ভেদ করতে যাব। শিয়ালদায় জনা চারেক বসে। আমাদের টার্গেট তাঁদেরই একজন। আপনি আসুন দেড়টা নাগাদ। যুক্তিবাদী সমিতির ক্রিক রো অফিসের ঠিকানা দিলাম ।
২৬ এপ্রিল শনিবার, ২০০৩। দুপুর ১টা। ক্রিক রো’র অফিসে আমরা অনেকেই হাজির। সবাইকে নিয়েই একটা টিমওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে। কার কী ভূমিকা, তারও একটা রিহার্সাল হয়ে গেল।
কোনও চ্যালেঞ্জ জিততে হলে দুটি বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন। একঃ প্রতিপক্ষকে কখনই হালকাভাবে দেখতে নেই। ছোট করে দেখতে নেই। আত্মতুষ্টিতে ভুগতে নেই। বিশ্ব পর্যায়ের অ্যাথেলেটরাও দৌড় ফিনিস করার চূড়ান্ত সময়ে স্লো হয়ে যান। একে অ্যাথেলেটের পরিভাষায় বলে ‘ডেঞ্জার টাইম’। ফুটবলের শেষ দেড়-দু মিনিট ‘ডেঞ্জার টাইম’। এই সময় আত্মতুষ্ট থাকার দরুন জেতা গেম ড্র হয়। তেমনই দুর্বল প্রতিপক্ষে বিরুদ্ধে আত্মতুষ্টি হল ‘ডেঞ্জার সিচুয়েশন’ দুইঃ প্রতিপক্ষের তুলনায় নিজেকে কখনই ছোট বলে ভাবতে নেই। এমন ভাবনার অর্থ, লড়াইয়ের আগেই হেরে বসে থাকা ।
ফুটবল টিম ময়দানে নামার আগে কোচ শেষবারের মতো পুরানো অনেক উপদেশ আবার নতুন করে প্লেয়ারদের মনে করিয়ে দেন, আমার মনে করিয়ে দেওয়াটা তেমনই কিছু । আজ পরিকল্পনা মতো আমি এই বুজরুকি ফাঁসে অংশ নেব না। আমার ভূমিকা হবে নেহাতই দর্শকের সে’জন্য হয় তো কিছুটা আশঙ্কা ছিল। শকুন্তলার দুষ্মন্তগৃহে যাত্রার সময় পালক পিতা ঋষি কণ্ব যেমন প্রিয়জনের অমঙ্গল আশঙ্কায় পীড়িত হচ্ছিলেন, আমার অবস্থা তেমনই
আজ সমিতির যারা অ্যাকশনে যাবে, তারা প্রত্যেকেই জানে পাথর বিক্রেতা পাথর ছাড়া আরও একটি জিনিস নিয়ে বসে। সেটা রাখে ক্রেতার চোখের আড়ালে। জিনিসটা হল এক ধনের রাসায়নিক দ্রব্য। নাম, ফেনলফ্থ্যালিন (Phenol pthalein)। ফেনলথ্যালিনের গুঁড়ো দেখতে সাদা পাউডারের মতো।
অনুমান করতে পারি, জল রঙিন করার এই কেমিক্যাল দর্শকদের নজর এড়িয়ে রাখতে কিছু কৌশল নেয় পাথরওয়ালা। কী সে কৌশল? নিশ্চিত ভাবে তা বলা সম্ভব নয়। তবে এমন হতে পারে— পোশাকের ভাঁজে, হাত ও পায়ের ভাঁজে, ঘাড়ে ফেলে রাখে ফেনলথ্যালিন পাউডার।
বাটিতে থাকে জল। একটা চামচ দিয়ে জল তুলে দেওয়া হতে থাকে। ওই জল কিন্তু সাধারণ জল নয়। বিশেষত্ব আছে। জলটা চুন জল। জলে চুন ডুবিয়ে রাখলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চুন কাদা কাদা হয়ে যায়। কাদা চুন জলের তলায় থিতিয়ে পড়ে থাকে। ওপরে থাকে টলটলে জল।
পাথর বিক্রেতা যখন জলে রং বেগুনি করতে চায়, তখন আঙুলের ডগায় তুলে নেয় ফেনলফথ্যালিন। তারপর পাথরটা ক্রেতার হাতের তালুবন্দি জলে রাখার সময় ওই বিশেষ আঙুলটি জলে ছুঁইয়ে দেয়। ব্যস, কাজ শেষ। চুন জলে ফেলনথ্যালিন মেশার সঙ্গে সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জলের রং হয়ে যায় বেগুনি। ওখান থেকে আপনি পাথর কিনে থাকলে একটা ছোট্ট পরীক্ষা করুন। গণ্ডুষে আপনার পাথরের আংটিটি রাখুন। দেখবেন জল রঙিন হচ্ছে না। গ্যারান্টি। কিন্তু কেনার সময় জল রঙিন হয়েছিল।
কোনও তথাকথিত অলৌকিক ঘটনার কার্য-কারণ সম্পর্কটা জানা না থাকলে, ঘটনাটা দেখেই ধরে ফেলা খুবই কঠিন। আবার রহস্যের কারণটা জানলেই যে ধরাটা সোজা হবে- এমনটা ভাবলে ভুল হবে। গোটা অপারেশনের জন্য নেতা বাছা হয়েছে দীপক ব্যাপারীকে। ওকে সাহায্যের জন্য রইল রানা, অতীশ, বিশ্বজিৎ, মৃণাল, মুন্না, সঞ্জয়, জয়দেব, শৃঙ্খল ও আরও অনেকে।
দুপুর দেড়টা। দীপালি এসে পড়লেন ই টি ভি নিউজের গাড়ি নিয়ে। সঙ্গে ফোটোগ্রাফার ও তাঁর সহকারী। দীপালির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। আমাদের টার্গেট শিয়ালদা ডেন্টাল কলেজের সামনে বসা পাথরওয়ালা। সমিতির ছেলেরা দু-চার মিনিট পর পর দু-একজন করে বেরিয়ে পড়তে লাগল। এই অপারেশনের জন্য ওদের প্রত্যেকেরই অঙ্গে শোভা পাচ্ছে তাগা- তাবিজ-আংটি। দীপালিও তাঁর টিম নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। শেষে শৃঙ্খল ও জয়দেব।
শৃঙ্খল ও জয়দেবকে দেখলেই বলে দেওয়া যায়— ব্যবসায়ী, জ্যোতিষে বিশ্বাসী, বর্তমানে কাঁচা পয়সা আছে। মধ্যবয়স্ক মানুষদুটোর লম্বা-চওড়া চেহারা ও ঝাঁ চক্চকে মোটরবাইক দেখে মনে হয় ব্যাবসাটা প্রোমোটিং। প্রমোটররা মোটরের চেয়ে বাইকে ঘোরাটাই পছন্দ করে।
আমি যখন স্পটে পৌঁছালাম, তখন বেশ বড়-সড় জটলা জমে গেছে। ই টিভি ছবি তুলছে, ভিড় তো জমবেই।
দীপালি সুন্দর ম্যানেজ করেছেন। পাথরওয়ালা খুশ-মেজাজে ছবি তুলতে দিচ্ছে। খুশি পাথরওলার দুই সঙ্গীও। দীপালিকে নিজের নাম জানাল পাথরওয়ালা। কৃষ্ণ দাস।
কৃষ্ণ দাস একটা পিঁড়িতে বসে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। জটলা কৃষ্ণকে ঘিরে। ওদের কেউ উবু হয়ে বসে, কেউ বা দাঁড়িয়ে। পিঁড়ির আশে-পাশের কিছুটা ফুটপাথ জল দিয়ে ধুইয়ে পরিষ্কার করা। বাঁ পাশে একটা পিতলের বিশাল রেকাবিতে কয়েক কিলো নানা রং-এর কাচের টুকরো বা পাথর ডাঁই করা। ফুটের রেলিংয়ে ঠেকনা দিয়ে দাঁড়িয়ে কালীঘাটের কালীর একটা বাঁধানো ছবি। ছবিতে জবা ও অপরাজিতার মালা পরানো। ছবির সামনে এক গোছা ধূপকাঠি জ্বলছে। ছবি ও ধূপদানি বসানো রয়েছে একটা লাল শালুর ওপর। তারও পাশে দুটো বড়ো বড়ো ব্যাগ। ব্যাগের পাশে নামানো রয়েছে দুটো দশ লিটারের ও একটা চার লিটারের কন্টেনার। কন্টেনারগুলোর গায়ে লেগে রয়েছে জল। আমি নিশ্চিন্ত। এর অন্তত একটায় চুন জল রয়েছে।
একজনের ভাগ্য পরীক্ষায় কৃষ্ণ তখন ব্যস্ত। তার হাতের তালুর জলে একের পর এক পাথর রাখছে। মুহূর্তে পাথরটা তুলে নিয়ে আবার একটা ছোট রেকাবিতে রাখছে। বড় রেকাবি থেকে তুলছে আবার একটা নতুন পাথর। গোটা দশেক পাথর বসানোর পর একটা পাথর হাতে রাখতেই জল বেগুনি। ফোটোগ্রাফার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রং পালটানো গণ্ডুষকে ক্যামেরাবন্দি করতে। বুঝতে পারলাম না, কখন কোথা থেকে ফেনলথ্যালিন নিল কৃষ্ণ। সত্যিই কৃষ্ণ নাম সার্থক। উপাখ্যানের কৃষ্ণের মতোই নিখুঁত জাদুকর।
রানা আমার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ক্রিক রো থেকে বেরিয়েছে। আমার ও সমিতির ছেলেদের মধ্যে যোগসূত্রের কাজ করবে ও। রানা ইতিমধ্যে আমাদের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, এর আগে আরও তিন জনের হাতের জল রং পালটেছে। দীপকরা কী তাহলে এখনও ধরতে পারেনি, কোথা থেকে নিচ্ছে ফেনলথ্যালিন? দীপক তো একা নয়। অনেকগুলো তৈরি চোখ নজর রাখছে। তাদের সব্বাইয়ের চোখকে ফাঁকি দিচ্ছে? কৃষ্ণর এলেম আছে, স্বীকার করতেই হচ্ছে।
ততক্ষণে শৃঙ্খলকে নিয়ে পড়েছে কৃষ্ণ। শৃঙ্খলের একটা পাথর রং পালটালো। ছবি উঠছে। শৃঙ্খল জানতে চাইলেন, পুজোর আগেই চার-চাকা হবে তো? ইনস্টলমেন্টে তো এখনই কিনতে পারি। ক্যাশে কিনতে চাই।
শৃঙ্খলের হাতের তালু মেলে ধরতে বলল কৃষ্ণ। হাতের রেখায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করল, “বাড়ি আছে?”
—হ্যাঁ, রিসেন্টলি ফ্ল্যাট কিনেছি।
—টাকা আসছে। রাখতে পারছেন না, খরচ হয়ে যাচ্ছে। শনি ভোগাচ্ছে। দাঁড়ান, একটা অ্যামিথিস্ট দিচ্ছি। লেগে গেলে ভাবতে হবে না। তিন মাসের মধ্যে গাড়ি হবেই ।
শৃঙ্খলের হাতের তালুর ঘেরাটোপে এক চামচ জল ঢালল কৃষ্ণ। একটা নীল পাথর নিয়ে বসাতেই জল বেগুনি। হ্যাঁ বুঝেছি। দীপকদের অপেক্ষায় রইলাম। ওরাও কি বুঝেছে?
না। ধরা যাচ্ছে না। দীপকদের আরও সময় দিতে শৃঙ্খল আরও একটা পাথর কেনার ফাঁদ পাতলেন। আবার একটা পাথর। আবার জলের রঙিন হওয়া। তিনটে পাথরের মোট দাম ১৬০০ টাকা। শৃঙ্খল তো পাথর কিনতে আসেননি। তাই টেনে সময়কে বাড়াতে চাইছিলেন। “পাথর যে খাঁটি, তার গ্যারান্টি কোথায়? জি এস আই-কে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে যদি দেখি পাথরগুলো পাথরই নয়, কাচ তবে কী হবে?” ইত্যাদি নানা রকম প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন শৃঙ্খল। এই শেষ সুযোগ— মনে করে দীপকরা কয়েকজন কৃষ্ণর ঘাড়ে, হাতের ভাঁজে, পায়ের ভাঁজে আঙুল বুলিয়ে বাটির জলে আঙুল ডোবার খেলায় মেতেছে। না, কিচ্ছু হচ্ছে না। জল জলেই আছে।
কৃষ্ণ বিপদের গন্ধ পেয়েছে। সতর্ক ওর দুই সঙ্গী। শৃঙ্খলের হাতেই ছিল পাথর তিনটে কৃষ্ণ এক ছোঁতে পাথর তিনটে তুলে নিল। বলল, “যান মশাই, আপনাকে পাথর বেচব না । এই সব গুটিয়ে ফেল তো।”
আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ। মুহূর্তে সাজানো দোকানপাট বেবাক ফক্কা। সব গুটনো হয়ে গেছে। অত্যন্ত নিরাশ দীপালিও গুটোতে শুরু করলেন। ক্যামেরা থেকে খোলা হয়ে গেছে বুমের কানেকশান।
আমি প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে ধমক দিলাম শৃঙ্খলকে। “আপনি ইয়ারকি পেয়েছেন? উনি ফুট পাথে পাথর বেচতে বসেছেন বলে কি ওঁকে কোনও মর্যাদা দেবেন না? পাথরগুলো নীলা, নাকি চুনী — তার গ্যারান্টি দিয়ে উনি আপনাকে পাথর গছাতে যাননি। জি এস আই-এর গ্যারান্টি দিচ্ছেন— এমন কথাও বলেননি। সুতরাং ফালতু কেন ও’সব কথা টানছেন? কেন তবে ওঁকে খাটালেন ? ফুটপাথে বসেছেন বলে, তাই না?”
আমার দাপুটে কথার সামনে শৃঙ্খল তোতলাচ্ছিলেন। যাঁরা কৃষ্ণের ঘাড়ে, হাতের ভাঁজে হাত বোলাচ্ছিলেন, তাঁদেরও ধমক দিলাম “আপনাদের লজ্জা করে না, একজন খেটে খাওয়া মানুষের পেশা নিয়ে চ্যাংড়ামো করতে?”
দীপকরা কাঁচুমাচু। কৃষ্ণের প্রাণে বল। আমি প্রায় ধমকে উঠে দাঁড়ানো শৃঙ্খলকে আবার বসালাম। কৃষ্ণ আবার তার গুটনো কারবার খুলে বসল। টিভি ক্যামেরার সামনে হৃত গৌরব ফিরে পেতে চাইল। আমার অনুরোধে এক উবু দর্শক হাত এগিয়ে দিলেন। কৃষ্ণ তাঁর তালুতে জল দিল। জলে দিল শৃঙ্খলের হাতের পাথরটাই। শৃঙ্খলের হাতের জল যে পাথরকে রঙিন করছে, সে পাথর এখন চুপ মেরে আছে।
দীপালি বুঝে গেছেন—কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ফোটোগ্রাফার এখন অতিমাত্রায় সপ্রতিভ। দীপালি অতি-তৎপর। দীপালি তাঁর হাতের বুম এগিয়ে ধরলেন কৃষ্ণের দিকে। প্রশ্ন, “এই যে একই পাথর কারও হাতের জল গোলাপী করছে, কারও বেলায় করছে না—এটা কী করে সম্ভব হচ্ছে? আপনি কী কোনও কেমিকেলের সাহায্য নিয়ে রং পাল্টে দিচ্ছেন? অর্থাৎ ম্যাজিক? তেমন হলে তো আপনি লোক ঠকাচ্ছেন?”
—“না না। এ কোনও ম্যাজিক নয়। এসবই পাথরের গুণ। এ পাথর যার নসিব পালটাবে, শুধু তার হাতের জলই রঙিন করে।” কৃষ্ণ প্রচণ্ড প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে চলেছে।
-“কোন জায়গা থেকে এ পাথর আনেন ?”
—“আজমির থেকে।”
—“আপনি কী বলতে চাইছেন, এর অলৌকিক ক্ষমতা আছে।”
—“যে পাথর জীবনের রং পালটে দেয়, যে পাথর ভাগ্য পালটে দেয়, তাকে আপনি যদি অলৌকিক পাথর বলতে চান, বলতে পারেন। কৃষ্ণ এখন ফুল ফর্মে। ও এখন আত্মতুষ্ট। এটাই ঠিক সময়।
আমার অনুরোধে শৃঙ্খলের হাত থেকে তুলে নেওয়া আরও একটা পাথর নিয়ে খেলা দেখাতে গেল কৃষ্ণ। আমার অনুরোধে ফোটোগ্রাফার ছবি তুলতে ‘অতি যত্নবান’ হলেন।
এবার আবার নতুন মানুষ। মানুষটির হাতের তালুতে প্রথমে জল, তারপর পাথর রাখল কৃষ্ণ। জল রং পালটালো না। আমি লোকটির হাত থেকে পাথর তুলতে যেতেই অবাক কাণ্ড ! জলের রং বেগুনি।
এবার একজন উবু বসে থাকা মানুষের হাত টেনে নিলাম। এক চামচ জল দিলাম। একটা পাথর তুলে জলে রাখলাম। জল জলই আছে। জলে ভেজা ফুটপাতে একটা আঙুল ঠেকিয়ে পাথর রাখা জলে ছোঁয়াতেই জল বেগুনি। অর্থাৎ ফুটপাথে ফেনলফ্থ্যালিন আছে। তবে গুঁড়ো নয়। তরল, যা দিয়ে ধোয়ানো হয়েছে ফুটপাথ।
গোটা প্রক্রিয়াটাই খুব ধীরেসুস্থে করে দেখালাম, যাতে ফুটে জমে যাওয়া শ’খানেক মানুষ বুজরুকিটা কোথায়, তা বুঝতে পারেন। আমাদের সমিতির ছেলেরা মেতে উঠেছে সাধারণ মানুষকে বিষয়টা হাতেকলমে ঘটিয়ে দেখাতে। ব্যাখ্যা করতে। মানুষ বুঝছেন, মানুষ প্রতিবাদ করছেন। মানুষ ওদের মারতে যাচ্ছেন। পাবলিকের আড়ং ধোলাই থেকে বাঁচতে কৃষ্ণ তখন আমাদেরই হাতে-পায়ে ধরছে। অবস্থা সুবিধের নয় বুঝে পাশের পর্নোবই বিক্রেতা বইয়ের পসরা ফেলে হাওয়া।
মুচিপাড়া থানায় ফোন করলাম। থানা থেকে পুলিশ ভ্যান এল মিনিট দশেকের মধ্যেই। সব জিনিস-পত্তর সমেত কৃষ্ণকে ভ্যানে তুললেন পুলিশ অফিসার নীলাদ্রি রায়। শ্যামনগরের সুরজিৎ বড়ুয়া কৃষ্ণের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেন। আই.পি.সি. ২৪০ ও ১২০বি ধারায় মামলা রুজু হল। পরের দিন রবিবার। সেদিনই কৃষ্ণকে হাজির করা হল ব্যাঙ্কশাল কোর্টে । পুলিশ আরও ১০দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের হেফাজতে রাখলেন ।
এখন অক্টোবর। ৬টা মাস পেরিয়ে এসেছি। শিয়ালদা চষে ফেলেও অদ্ভুত পাথর ব্যবসায়ীদের দেখা পাইনি আমরা। আপনি ?
যদি কোথাও পান, ওদের বুজরুকি ফাঁস করুন। থানায় ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করুন। একার বদলে অনেকে নিয়েই প্রতিরোধ গড়তে পারেন। আপনি নিশ্চয় পারেন এককে দুই ও দুইকে বহু করতে।
আপনারা সবাই আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইতে না নামলে আমাদের মিশন অধরা থেকে যাবে। আপনাকে-আপনাদের তাই বড়-ই প্রয়োজন।
প্রথম খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !
অধ্যায়ঃ তিন
♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা
অধ্যায়ঃ নয়
অধ্যায়ঃ দশ
♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !
অধ্যায়ঃ বারো
♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়
অধ্যায়ঃ তেরো
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !
অধ্যায়ঃ পনেরো
♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !
অধ্যায়ঃ ষোলো
অধ্যায়ঃ সতেরো
♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন
দ্বিতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !
অধ্যায়ঃ চার
♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…
অধ্যায়ঃ দশ
♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর
অধ্যায়ঃ বারো
♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা
অধ্যায়ঃ তেরো
তৃতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ
অধ্যায়ঃ দুই
♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন
চতুর্থ খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা
অধ্যায়ঃ দুই
♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল
অধ্যায়ঃ চার
♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি
অধ্যায়ঃ আট
♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’
অধ্যায়ঃ দশ
“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ