আশৈশব আমার বই-পুঁথি পড়া একটা নেশা এবং উহা সংগ্রহ করা একটা বাতিক। বন্ধু-বান্ধবদের কাছে যখন যে বই-পুঁথি পেয়েছি বা নিজে কিনেছি, পড়া শেষ করে তা জমিয়ে রেখেছি ঘরে। কেহ কেহ হয়তো বলতে পারেন যে, বই পড়লাম, বোঝলাম, রসভোগ ও শিক্ষা গ্রহণ করলাম; উহা সংগ্রহের দরকার কি? ইহা বলতে বা ভাবতে তারাই পারেন, যারা ভাসা-ভাসা বই পড়েন, জ্ঞান পিপাসুরা নয়।

পুস্তকাদি সংগ্রহের উপকারীতা অনেক। যেমন- (১) আলোচনা প্রসঙ্গে বা চিন্তা প্রসঙ্গে সময় সময় এমন কোন কোন বিষয় এসে পড়ে, কোনো পুস্তকের কোথায়ও দেখেছি বলে আবছা মনে পড়ে, পরিষ্কার ও বিস্তৃত ভাবে স্মরণে আসে না। তখন খুঁজে বইখানা দেখে নিতে পারলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। (২) প্রথম বার পড়ার চেয়ে এভাবে বই-পুঁথি পড়ায় স্মৃতিপটে দাগ কাটে ভাল। হয়তো আর বিস্মৃতি ঘটে না। (৩) এমন কতক বই আছে, যা একবার পড়ে তার ভাব বা মর্ম উদ্ধার করা যায় না, বার বার পড়তে হয়। বই আয়ত্বে থাকলে তা সম্ভব হয়। (৪) এরূপ বই অনেক আছে, যা দু একবার পড়ে তৃপ্তি মেটে না, বার বার পড়তে ইচ্ছে হয়। হাতের কাছে বই থাকলে সে ইচ্ছে পূরণ সম্ভব হয়। এরূপ নানা ভাবে পুস্তক সংগ্রহের উপকারীতা আছে। সংগ্রহশালা একটি সিন্দুক বিশেষ। কোন ধনী তাঁর যাবতীয় অর্থ পকেটে রাখেন না, রাখেন সিন্ধুকে এবং যথা সময়ে তা ব্যবহার করেন সিন্ধুক হ’তে। সংগ্রহশালা ঐরূপ একটি জ্ঞানের সিন্ধুক।

বিগত ১৩২৫ সাল থেকে আমি বন্ধু-বান্ধবদের কাছে যেখানে যত বই পেয়েছি বা নিজে কিনেছি, সব বই মজুত করে রেখেছি, গ্রন্থশালা হিসেবে সুশৃঙ্খল ভাবে নয়, এলোমেলো ভাবে। এ সময়ে একটি ক্ষুদ্র গ্রন্থশালা প্রতিষ্ঠার জন্য আমার আগ্রহ হ’ল। কিন্তু আমার পুস্তক সমূহ সাজিয়ে গুছিয়ে দেখা গেল যে, ওর ভেতর সকল বিভাগের পুস্তক নেই। আমি সচেষ্ট হলাম-বাংলা ভাষার সকল বিভাগের কিছু কিছু বই সংগ্রহের কাজে।

শিক্ষিত বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের ঘরে দু-একখানা বই পুঁথি ছিল, তাঁদের বলতে লাগলাম যে, আমি একটি ক্ষুদ্র গ্রন্থাগার বা পাঠাগার স্থাপনের মনন করেছি, আপনারা আমাকে কিছু কিছু বই বা পুঁথি দিয়ে আমার ইচ্ছে পূরণের সহায়তা করুন। দু-একখানা বই-পুঁথি ঘরে রেখে উহা অযত্নে প্রতিপালন করার চেয়ে নিত্য নূতন বই, পুঁথি পড়া উত্তম। আপনারা যিনি আমার পাঠাগারে অন্ততঃ একখানা পুস্তকও প্রদান করবেন, তিনি আমার পাঠাগারের একজন শরীক বা সদস্য হবেন এবং আমার পাঠাগার হতে যে কোন পুস্তক পাঠ করার সুযোগ পাবেন। ইহা শুনে আমার অনেক সুহৃদ ব্যক্তি পুস্তক প্রদান করলেন। পুস্তক দাতাগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চরমোনাই নিবাসী বাবু যামিনী কান্ত বিশ্বাস ও হরেন্দ্র নাথ সেন বক্সি। তাঁরা উভয়ে দান করলেন ধর্ম, দর্শন, উপন্যাস ও নাটকাদি বিভিন্ন বিভাগে (বাংলা) ৩৫ খানা বই। এর মধ্যে “মনুসংহিতা” নামক বৈদিক ধর্ম গ্রন্থ খানা সবচেয়ে মূল্যবান। কিছু সংখ্যক বই নিজে কিনে নিলাম।

এভাবে পুস্তকাদি সংগ্রহ করে ১৩৩৭ সালের ১৫ই আষাঢ় তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে আমার ক্ষুদ্র গ্রন্থাগারটি বা পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করলাম। এ সময় আমার সংগৃহীত পুস্তকের সংখ্যা হ’ল- সাহিত্য, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণ, পুঁথি ও মাসিক পত্রিকা সহ মোট ৭৮৭ খানা।

অনেকে আমার গ্রন্থাগারে এসে বই পুস্তক পড়তে বা নিতে ও দিতে শুরু করলেন এবং আমি (বই) আদান-প্রদানের খাতায় যথারীতি হিসাব লিখতে লাগলাম। যাবতীয় বইয়ের একখানা তালিকা তৈরি হচ্ছিল আগেই।

সংগৃহীত পুস্তকের সংখ্যা বাড়াবার জন্য নিরলস চেষ্টা চালাতে লাগলাম। বরিশাল কৃষি অফিস হ’তে কৃষি বিজ্ঞান’ বিষয়ক কিছু সংখ্যক বই পেলাম এবং ব্যাপটিস্ট মিশন হ’তে ধর্ম বিষয়ক কিছু বই গ্রহণ করলাম। অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত সহ দশ বছরে (১৩৪৭ সালে) আমার সংগ্রহীত বইয়ের সংখ্যা হ’ল ৯৬৬ খানা।

পরিতাপের বিষয় এই যে, আলমারী ছিলনা ব’লে বইগুলো রাখা হচ্ছিল আমার বৈঠকখানায় তাকে তাকে সাজিয়ে। ১৩৪৮ সালের ১২ই জৈষ্ঠ শুরু হ’ল সর্বনাশা ঘূর্ণি ঝড়। আমার বৈঠকখানা নিল উড়িয়ে, তৎসহ বইগুলোও। পরের দিন মাঠে-পথে পাওয়া গেল দু-একখানা ছেঁড়া পাতা। প্রায় বাইশ বছরের সাধনার ধন, হৃদয়ে রক্ত শুকিয়ে গেল। ব্যথা রোধ করতে পারিনি। যদিও প্রদাহটা আগের মত নেই, তথাপি হৃদয়ের ক্ষত আজও মোছেনি।

মনের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা কমাতে না পেরে আবার পুস্তক সংগ্রহ শুরু করলাম। প্রায় ১৮ বছরের প্রচেষ্টায় পৌনে চারশ বই সংগ্রহ করলাম। কিন্তু ১৩৬৫ সালের ৬ই কার্তিক ঘটল-১৩৪৮ সালের ১২ই জৈষ্ঠের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বন্যায় আমার জীর্ণ কুঁড়ে ঘরখানা ভেঙ্গে পড়ল এবং বইগুলো উধাও হয়ে গেল (মনে হয় যে, উড়ে মাঠে পড়ে বানের জলে ভসেসে গেছে)। সেদিন হ’তে হ’ল আমার প্রায় ৪০ (১৩২৫-১৩৬৫) বছরের সাধনার নিস্ফল পরিসমাপ্তি। তৎপর আর কখনো পুস্তক সংগ্রহ করবার উৎসাহ আমার মনে জন্মেনি।

 এখন শুধু মনে মনে ভাবি –

সাধনা হ’লনা সিদ্ধ     বিধাতার (প্রকৃতির) দোষে।

সুকর্মে মেলেনি ফল       দারিদ্রতা রোষে।

ভাগ্যবাদ ছেড়ে করি        কর্মবাদে ভক্তি,

তাই মম চির কাল         কর্মেতে আশক্তি।

করমে মেলেনা ফল      একই নহে ভাগ্য?

(তাই) চাহে মন কর্ম ত্যাজি    লভিতে বৈরাগ্য।

কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

নিবেদন

ভিখারীর আত্মকাহিনী- প্রথম খন্ড

চর পূর্বাভাস ও জন্ম (১১৫৮-১৩০৭)

ছবি ও জলের কল (১৩২২)

মুন্সি আহম্মদ দেওয়ান (১৩২৩

পলায়ন (১৩২৪)

মুন্সি আপছার উদ্দিন (১৩২৫)

আরবী শিক্ষায় উদ্যোগ (১৩২৬)

চিকিৎসা শিক্ষা (১৩৩০)

জীবন প্রবাহের গতি (১৩৩১)

ছুতার কাজ শিক্ষা (১৩৩১)

জরীপ কাজ শিক্ষা (১৩৩৩)

বস্ত্র বয়ন শিক্ষা (১৩৩৫)

উচ্চ শিক্ষার প্রচেষ্টা (১৩৩৫)

জাল বুনা শিক্ষা (১৩৩৬)

ভিখারীর আত্মকাহিনী- দ্বিতীয় খন্ড

জাল বোনা ও মৎস্য শিকার

মোসলেম সমিতিঃ স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকতা (১৩৩৬-১৩৪১)

মোসলেম সমিতিরঃ ভাঙ্গন

পাঠাগার স্থাপন (১৩৩৭)

পাখা তৈয়ার (১৩৩৯)

ইঞ্জিনিয়ারিং শিখার উদ্যোগ ও মাতৃবিয়োগ (১৩৩৯)

সীজের ফুল রচনা (১৩৪০)

বিশ্বাসের বিবর্তন (১৩৪১)

ডাইনামো তৈয়ার (১৩৪১)

ভিখারীর আত্মকাহিনী- তৃতীয় খন্ড

কৃষি বিদ্যা শিক্ষা 

জলঘড়ী তৈয়ার

বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর শিক্ষা 

সাইক্লোন

দুর্ভিক্ষ

অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদিরের সান্নিধ্যে

লাল গোলা যাতায়াত

ভিখারীর আত্মকাহিনী- পঞ্চম খন্ড

“ক্ষেত্র-ফল” রচনা

স্টেট বাটারা

আদেশাবলী

“সৃষ্টি – রহস্য” রচনা

“সত্যের সন্ধান” এর পান্ডুলিপ

সত্যের সন্ধান প্রকাশ

সন্তান-সন্ততি

ভূসম্পত্তি

দেশ সেবা

খোরাক-পোসাক

জীবন বাণী

“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

 

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x