যে কোন রকম ইঞ্জিন মেশিনের কল-কব্জাগুলো তন্ন তন্ন করে দেখা, আমার একটা স্বভাবজাত কৌতূহল। এ কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য আমি যখন যেখানে যে কল-কব্জা পেয়েছি, তা খুব লক্ষ্য করে দেখেছি (উহা আজো দেখে থাকি) জানতে চেষ্টা করেছি যে, ওর মূল শক্তি কোথায়, কোনটা চললে কোনটা চলে ইত্যাদি। কিন্তু ইঞ্জিন মেশিনের দেহ দর্শন ছাড়া ওর অন্তর্দর্শনের সৌভাগ্য আমার কখনো হয়নি। তবে ও সম্বন্ধে উৎসাহের বিরাম নেই আজো, যেমন দেখাবার, তেমন গড়বার।

আমার শৈশবের “কৃত্রিম জলের কল” বানাবার উৎসাহের মত একটা উৎসাহ হল “কৃত্রিম বৈদ্যতিক পাখা” বানাবার।

টিন কেটে তিনখানা পাতির সমন্বয়ে একখানা পাখা বানালাম বৈদ্যুতিক পাখার মতই এবং উপরে মোটর বক্সের মত একটা বাক্সও বানালাম। তবে তার মধ্যে আমি রাখলাম মোটরের পরিবর্তে দুটি ক্রাউন পিনিয়ন। ওর একটার সঙ্গে সংযুক্ত করলাম পাখাটি এবং অপরটার সাথে একটা শায়িত দন্ড, যার অপর প্রান্ত থাকল কোন স্থানে দূরে। সেই দূরপ্রান্তেও একটি বাক্সে দুটি ক্রাউন পিনিয়ন রাখলাম, যার একটার সঙ্গে যুক্ত করলাম পূর্বোক্ত শায়িত দন্ডটি এবং অপরটির সঙ্গে একটা সাড়া দন্ড। এই খাড়া দন্ডটির নিচেও অনুরূপ  একটি বাক্সে দুটি ক্রাউন পিনিয়াম রাখলাম যার একটির সাথে যুক্ত করলাম খাড়া দন্ডটি ও অপরটির সঙ্গে হাতল। এতো করে হাতলটি ঘুরালে পাখাটি ঘোরে। দন্ড দুটি বানালাম লোহার শিক দিয়ে আর পিনিয়ন, পিনিয়ন বক্স ও অন্যান্য অংশ তৈরি করলাম কাঠের দ্বারা। মাস খানেক সময় লাগল পাখাটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে।

১৩৩৯ সালের ১৬ই বৈশাখ তারিখে লাখুটিয়ার জমিদার ও পূর্ব বাংলা রেলওয়ের ডি, টি, এস মিঃ পরেশ লাল রায় (ঘুঘু বাবু বা ঘুঘু সাহেব) আসবেন, স্থানীয় রহম আলী মাতুব্বরের বাড়িতে। কয়েক দিন পূর্বে খাজনা আদায়ের জন্য তিনি এখানে এসেছেন বজড়া নিয়ে। তিনি কদম তলায় খালে বোট রেখে খাজনা তহশিল করছেন। মাতুব্বর বাড়িতে সাহেবের অভ্যর্থনার আয়োজন বিপুল। শুধু সাহেবের খোরাকির ফর্দেই পদের সংখ্যা ৮০টি।

মাতুব্বর সাব তাঁর বৈঠকখানা সাজাতে অনুরোধ জানালে আমি সম্মত হলাম এবং তিনি আমার ফরমায়স মত সাজ-সরঞ্জাম ও আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি কিনে দিলেন।

নির্ধারিত তারিখের ৫ দিন পূর্বে কতিপয় সহকারী নিয়ে ঘর সাজাতে শুরু করলাম। নানাবিধ রঙ্গিন কাগজ ও মিনাপাত কেটে বিবিধ রকম লতা-পাতা, ফুল ইত্যাদি বানিয়ে ঘরখানা সাজালাম, দরোজার প্রবেশ পথে গেট বানালাম। গেটের দুপাশে দাঁড় করালাম দুজন দারোয়ান।

দ্বারীদ্বয় কাগজের তৈরি। প্রথমতঃ কাগজে অঙ্কিত করলাম-পাঁচ ফুট লম্বা দুটি মানুষ, পরনে হাফ প্যাণ্ট, গায়ে জামা, পায়ে জুতো, মাথায় লাল রং এর পাগড়ী ও কাঁধে বন্ধুক। পরে ছবি দুটো পীজ বোর্ড কাগজে লাগিয়ে ছবির সাইজ মোতাবেক কেটে নিলাম। তৎপর গেটের দুপাশে দুটো খাম পুতে তাঁর সঙ্গে দাঁড় করালাম দারোয়ানদের। দূর হতে দেখে কেউ ভাবতেই পারল না যে, ওরা বাস্তব দারোয়ান কি না। অতঃপর আমার তৈরী কৃত্রিম বৈদ্যুতিক পাখাটি ফিট করলাম বৈঠক খানায়ে সাহেবের বসবার জায়গাটির সোজা উপরে। একজন যুবককে পাখাটি চালাবার কৌশল শিখিয়ে বলে রাখালাম, “সাহেব এসে বসা মাত্র চালিয়ে দিও”।

নির্ধারিত সময়ের অনেক পূর্বেই ওখানে বিস্তর ওখানে লোক-সমাগম হচ্ছিল। যথা সময় সাহেব আসলেন, সঙ্গে তাঁর সহধর্মিণী মিসেস ইন্দিরা দেবী (ইনি একজন প্রখ্যাত অভিনেত্রী। চলচ্চিত্রে “আলী বাবা” ছবি খানাতে ইনি মর্জিনার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন) ও পুত্র হ্যারিকেল। উহারা দরজায় এসে সাজ গোজ দখে কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেলেন। নতুন বা আজব কিছু দেখলেন বলে নয়, অশিক্ষিত কৃষক পল্লীতে ইহা অপ্রত্যাশিত বলে। বৈঠক খানার চেয়ার-টেবিল সাজানো ছিল। সাহেব সেখানে গিয়ে বসতেই মাথার উপরে পাখা চলতে শুরু করল। সাহেব হঠাত দাঁড়ালেন এবং দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন “ইলেক্ট্রিক ফ্যান? কারেন্ট কোথায় পেলে?” আঃ রহিম মৃধা সাব কাছে ছিলেন। তিনি বললেন যে, ওটা কারেন্টে চলে না, হাত দিয়ে চালাচ্ছে। পাখাটির চালক ছিল বাইরে এবং সংযোগকারী দন্ডটি ছিল আড়ালে। তাই পাখাটি চলার সূত্র ধরতে না পেরে সাহেব জানতে চাইলেন যে, ওর চালক কোথায়। মৃধা সা’ব বললেন “চালক বাইরে”। শুনে সাহেব দ্রুত বাইরে গেলেন, আমরাও গেলাম। তিনি পাখা চালানো দেখলেন, বাক্স খুলে পিনিয়নাদি ও ফিটিং প্রণালী দেখলেন; পরে বৈঠকখানায় বসে জানতে চাইলেন যে, ওটা বানিয়েছেন কে। মৃধা সা’ব আমাকে নির্দেশ করে দেখালেন আর বললেন যে পাখাটি উনি বানিয়েছে এবং ঘরদোর উনিই সাজিয়েছে; দারোয়ানের মূর্তি দুটোও বানিয়েছে উনি। উনি আমার জ্ঞাতি ভাই নাম আরজ আলী মাতুব্বর।

সাহেব একজন এ্যাংলো ইন্ডিয়ান। জন্মস্থান ইংল্যাণ্ড, মাতৃভাষা ইংরাজী। বাংলা ভাষা ভালোভাবে বলতে পারেন না। তিনি মৃধা সা’বকে বললেন “মৃঢা! টোমার ভাইকে হামার সাঠে ডেও, হামি ওকে ইঞ্জিনিয়ারিং শিখাবে”। মৃধা সা’ব বললেন যে, উনি গরীব মানুষ, কলকাতায় থেকে ট্রনিং দেওয়া ওনার পক্ষে সম্ভব নয়। সাহেব বললেন, “বাল্যকালটা ইন্ডিয়ান অটোমোবাইল ইন্সটিটিউটের হেড সা’ব হামার বন্টু আছে, ওখানে বেটন ডিটে হবে না, খাওয়া ও অন্য খরচা হামি ডেবে, রেল-স্টিমারে পাস ডেবে। বল, যাবে? মৃধা সাহেব আমার  মতামত জানতে চাইলে আমি বললাম, “মার কাছে জিজ্ঞেস না করে বলতে পারি না”। সাহেব বললেন “জিজ্ঞেস করে আস”। তৎক্ষণাৎ বাড়িতে এসে মা-কে উহা জানালে তিনি সম্মতি দিলেন এবং সাহেবের কাছে গিয়ে আমিও সম্মতি দিলাম। সাহেব বললেন যে, মফস্বলের কাজ সারতে তাঁর আরো প্রায় দুমাস সময় লাগবে, আষাঢ় মাসে তিনি কলকাতা যাবেন এবং তিন মাসের ছুটি নিয়ে লন্ডন বেড়াতে যাবেন (মামা বাড়ি)। পূজোর বন্ধের পর হয়ত কার্তিক মাসে তিনি পুনঃ কলকাতায় গেলে আমাকে ইন্ডিয়ান অটোমোবাইল ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হবে।

ঘণ্টা খানেক নানা আলোচনার পর সাহেব চলে গেলেন। তাঁর ভোজ্য সামগ্রী সমূহ বোটে পাঠানো হল। সাহেব যাবার সময় আমাকে পারিতোষিক দিলেন সব টাকা।

কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

নিবেদন

ভিখারীর আত্মকাহিনী- প্রথম খন্ড

চর পূর্বাভাস ও জন্ম (১১৫৮-১৩০৭)

ছবি ও জলের কল (১৩২২)

মুন্সি আহম্মদ দেওয়ান (১৩২৩

পলায়ন (১৩২৪)

মুন্সি আপছার উদ্দিন (১৩২৫)

আরবী শিক্ষায় উদ্যোগ (১৩২৬)

চিকিৎসা শিক্ষা (১৩৩০)

জীবন প্রবাহের গতি (১৩৩১)

ছুতার কাজ শিক্ষা (১৩৩১)

জরীপ কাজ শিক্ষা (১৩৩৩)

বস্ত্র বয়ন শিক্ষা (১৩৩৫)

উচ্চ শিক্ষার প্রচেষ্টা (১৩৩৫)

জাল বুনা শিক্ষা (১৩৩৬)

ভিখারীর আত্মকাহিনী- দ্বিতীয় খন্ড

জাল বোনা ও মৎস্য শিকার

মোসলেম সমিতিঃ স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকতা (১৩৩৬-১৩৪১)

মোসলেম সমিতিরঃ ভাঙ্গন

পাঠাগার স্থাপন (১৩৩৭)

পাখা তৈয়ার (১৩৩৯)

ইঞ্জিনিয়ারিং শিখার উদ্যোগ ও মাতৃবিয়োগ (১৩৩৯)

সীজের ফুল রচনা (১৩৪০)

বিশ্বাসের বিবর্তন (১৩৪১)

ডাইনামো তৈয়ার (১৩৪১)

ভিখারীর আত্মকাহিনী- তৃতীয় খন্ড

কৃষি বিদ্যা শিক্ষা 

জলঘড়ী তৈয়ার

বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর শিক্ষা 

সাইক্লোন

দুর্ভিক্ষ

অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদিরের সান্নিধ্যে

লাল গোলা যাতায়াত

ভিখারীর আত্মকাহিনী- পঞ্চম খন্ড

“ক্ষেত্র-ফল” রচনা

স্টেট বাটারা

আদেশাবলী

“সৃষ্টি – রহস্য” রচনা

“সত্যের সন্ধান” এর পান্ডুলিপ

সত্যের সন্ধান প্রকাশ

সন্তান-সন্ততি

ভূসম্পত্তি

দেশ সেবা

খোরাক-পোসাক

জীবন বাণী

“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

 

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x