(৪)
এক বডিগার্ড দরোজায় টোকা দিয়ে বলে, ‘হুজুর, ঢাকা থিকা জিহাদিরা আইসছেন।’
আমি বলি, ‘জিহাদিদের বসতে বলো, কোক ফান্টা সেভেন আপ দাও।’
আমি ওজু করে, পাজামাপাঞ্জাবি পারে বাইরে বেরোই, দেখি একদল জিহাদি ব’সে আছে, তিরিশজনের মতো।
জিহাদিদের আমি যতোই দেখি ততোই বিস্মিত হই।
আমাকেও পুরোপুরি ওদের মতো হ’তে হবে, সাম্যবাদ ও সর্বহার করেও আমি ওদের মতো হয়ে উঠতে পারি নি, কিন্তু পারতে হবে; খুন করার সময় ওরা ছুরির থেকেও ধারালো আর নিষ্ঠুর, ছহবতের সময় ওরা লোহার মতো শক্ত, শক্ত হতেও সময় নেয় না, ক্ষরণেও সময় নেয় না, আবার শক্ত হয়, বিছমিল্লা বলে আবার শুরু করে; এবং বিনয়ের সময় ওরা পা ধ’রে ছালাম করতেও দ্বিধা করে না, পায়ে পড়ে যায় অবলীলায়, পচা ময়লার মতো প’ড়ে থাকে।
এটা খুবই দরকার, দীক্ষিত করতে হ’লে এমনই দীক্ষা দরকার।
ওরা সবাই মাদ্ৰাছার তালেবেলেম, ওরাও পরীক্ষা দেয়, পরীক্ষায় নকল করার সময় ওরা আশমানি কেতাবের পাতা জুতোর ভেতর ঢুকিয়ে নেয়, একটুও ভয় পায় না, যদিও সাম্যবাদ করার পরও এটা আমি কোনো দিনই করতে পারবো না, আবার খুনের সময় ওরা দশগুণ শিমার ও মুহম্মদি বেগ, ছুরি হাতে পথে পথে ছুটতে পারে।
আমার এক দোস্ত, হারামজাদা এক সময় সাম্যবাদ করতো, পরে বিসিএস দিয়ে আমলা হয়ে গেছে, তবে ওর বাড়িটা এক সময় ছিলো আমার বড়ো আশ্ৰয়, কিছু হ’লেই গিয়ে ওর বাসায় উঠতাম। একদিন গিয়ে দেখি হারামজাদা বাসায় নেই, হারামজাদার না কি অনেক মিটিং।
ভাবি বলেন, ‘কি হে মহামতি কার্লমার্ক্স, কমরেড লেনিন, কমরেড স্ট্যালিন, কমরেড চে গুয়েভারা, খতমি হক সাহেব? বিপদ হয়েছে না কি?’
ভাবিটি বাঙলার ছাত্রী ছিলেন, পরিহাস করতে পারেন যখন তখন; তাঁর পরিহাস আমার ভালোই লাগে, আর বুকে একটু কষ্ট লাগে।
আমি বলি, ‘না, ক্ষুধা লেগেছে; আর ওই ট্রেইটরটা কই?’
ভাবি বলেন, ‘ট্রেইটরটা তার উপজেলায় মাদ্ৰাছার হিশেবে করতে গেছে, আর ফাজিল দাখিল কামিল কাহিল কুহিল পরীক্ষার সেন্টার দেখতে গেছে।’
আমি বলি, ‘ট্রেইটরটা এখন মাদ্ৰাছা নিয়েই আছে?’
ভাবি বলেন, ‘ক্ষুধা কেমন লেগেছে?’
আমি বলি, ‘দুই চারটি হাতি খেতে পারি।’
ভাবি বলেন, ‘তাহলে খেয়ে ঘুম দিন, সন্ধ্যায় ট্রেইটরের সঙ্গে দেখা হবে।’
অনেক দিন পর পেট ভ’রে ভাত খাই। মুরগির গোস্ত, লাউডগা দিয়ে কই মাছ, গোলশা, চিংড়ির ভর্তা দিয়ে কয়েক থাল ভাত খেয়ে একটি লম্বা ঘুম দিই, সন্ধ্যার পর উঠে দেখি ট্রেইটরটা এসেছে। দেখি ট্রেইটরটার সব কিছুই আগের থেকে ভালো, বউটা ভালো—ভাবিকে আমি আগে থেকেই চিনি, তাঁর জন্যেই তো সাম্যবাদীটা ট্রেইটর হয়ে গেলো,–চেহারাটা আরো ভালো হয়েছে, জিপটাও ভালো, একটা মেয়ে হয়েছে, সেটিও ভালো।
সাম্যবাদ। আমাকে ভালো কিছু দেয় নি।
আমি বলি, ‘আই ট্রেইটর, তুই না কি এখন মাদ্ৰাছায় মাদ্ৰাছায় ঘুরিস?’
ট্রেইটর বলে, ‘এই ইছলামেরর পাণ্ডাগুলো আমাকে পাগল ক’রে দিচ্ছে, ইচ্ছে হয় আবার সর্বহারা হয়ে যাই।’
আমি বলি, ‘কী হয়েছে?’
ট্রেইটর বলে, ‘সাত দিন ধ’রে আমার কাজ পড়েছে আমার উপজেলায় আসলে কটি সরকারি মাদ্ৰাছা আছে, কজন হুজুর আছে, তার হিশেবে বের করা। তারপর আবার এখন ফাজিল কামিল দাখিল কাহিল কুহিল পরীক্ষা চলছে, ওই সব পরীক্ষার হলে গিয়ে নকল ধরতে হচ্ছে।’
আমি বলি, ‘কী দেখছিস?’
ট্রেইটর বলে, ‘সন্ধ্যার পরই তুই তা দেখতে পাবি।’
সমাজের সঙ্গে তো আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না, সমাজ কীভাবে কাজ করে তা আমি জানি নি; আমি জানতাম সমাজ হচ্ছে শ্রেণীদ্বন্দ্বের ব্যাপার, আর আমাদের কাজ হচ্ছে শোষণকারীদের শোধন ও নিধন করা। এর জন্যে দরকার অস্ত্ৰ, কাটা রাইফেল, চাইনিজ রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড, বোমা, মাইন প্রভৃতি, এবং নিউজপ্রিন্টের অজস্র ইশতেহার। সন্ধ্যা হতে হয় না, বিকেলেই দেখি টুপি দাড়ি নিয়ে একদল ঢুকছে ট্রেইটরের ড্রয়ি রুমে।
সবাইকে সে ঢুকতে দেয় না, অধিকাংশই দাড়িয়ে থাকে বাড়ির বাইরে গাছতলায়; কেউ কেউ গাছতলায় গামছা পেতে নামাজ পড়তে থাকে।
ট্রেইটর ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই জনদশেক বুড়ো মওলানা মৌলভি তার পায়ে পড়ে যায়, তার পায়ে চুমো খায়, সেজদা দেয়ার মতো পড়ে থাকে। আমি সর্বহারা হ’লেও এতে একটু কেঁপে উঠি; কিন্তু আমার ট্রেইটরটা এরই মাঝে সমাজকে বুঝে ফেলেছে, সে কাঁপে না, সে তাদের পা থেকে উঠতে বলে না, যেনো তার পা দুটি ওদের পড়ে থাকার জন্যেই সরকার বাহাদুর দিয়েছেন; ট্রেইটর একবার আমার দিকে তাকায়, যেনো বলছে, ‘দ্যাখো।‘
ট্রেইটর, যদিও জানে এরা কারা, তবু বলে, ‘আপনারা কারা?’
তারা এবার মাথা নিচু ক’রে দাঁড়ায়, দাঁড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, ‘ছার, হুজুর, আমরা আপনের অধীনের মাদ্ৰাছার হুজুর।’
ট্রেইটর বলে, ‘আপনারা কেনো এসেছেন?’
হজুররা বলে, ‘ছার, আমরা শুনছি আপনে আমাগো মাদ্ৰাছা ভিজিটে গেছিলেন, আমরা সেই সোম এবাদত বন্দেগি করতেছিলাম, তাইতে আপনে আমাগো পান নাই, ছার আপনে আমাগো বাচান।’
ট্রেইটর বলে, ‘তখন তো এবাদতের সময় ছিলো না।’
হুজুররা বলে, ‘ছার, আমরা সব সোমই আল্লার এবাদত বন্দেগি করি, এবাদত বন্দেগি সব সোমাই করন যায়।’
ট্রেইটর বলে, ‘কিন্তু আপনাদের তো বেতন দেয়া হয় পড়ানোর জন্যে, সব সময় এবাদতের জন্যে নয়।’
হজুররা বলে, ‘ছার, আল্লা রছুলের পরই আপনে আমাগো মালিক, এইবার আমাগো মাফ কইর্যা দ্যান, আল্লায় আপনেরে ভেস্ত দিবো।’
ট্রেইটর বলে, ‘আমার উপজেলায় কাগজেকলমে ১৫০টি মাদ্ৰাছা আছে, আমি ভিজিটে গিয়ে দেখেছি আছে পাঁচটি; অন্য কোনোটির নাম হিজল গাছের ডালে, কোনোটির নাম আমগাছের ডালে, কোনোটির নাম মুদিদোকানের চালে, ওই সব মাদ্রাছা আমি দেখতে পাই নি।‘
হজুররা বলে, ‘হুজুর, আমরা গুনাহর কাম করছি, আমাগো মাফ কইর্যা দেন, নাইলে পোলাপান লইয়া মরুম।’
ট্রেইটর বলে, ‘কিন্তু বেহেশতে তো ভালো থাকবেন, হুর আর গেলমান পাবেন বলে শুনেছি।’
গেলমান শব্দটি আমি ওই প্ৰথম শুনি, বুঝতে পারি ট্রেইটর বিসিএস হওয়ার জন্যে অনেক কিছু শিখেছে গাইড বই প’ড়ে।
হজুররা বলে, ‘কে ভেস্ত পাইব আর না পাইব, তা কি কওন যায়, ছার? তয় দুনিয়ায় ভাতকাপড় না আইলে বাচন যায় না। দুনিয়ায় বউ পোলাপান ভাত না পাইলে হুরে গোলমানে কি হইব?’
ট্রেইটর বলে, ‘১৫০টি মাদ্ৰাছায় আপনারা কতোজন হুজুর আছেন?’
হজুররা বলে, ‘গড়ে পাঁচজন কইর্যা ধরলেও ৭৫০জন আছি, হুজুর।’
ট্রেইটর বলে, ‘আপনাদের বেতন কতো?’
ট্রেইটর বলে, ‘চার হাজার ক’রে ধরলে ৭৫০জনের বেতন কতো হয়?’
তারা হিশেবে করতে শুরু করে, হিশেবে করে উঠতে পারে না; কিন্তু আশ্চৰ্য, তারা কোটি কোটি ছোয়াব সহজে হিশেব করতে পারে।
হজুররা বলে, ‘হিছাব করতে পারতেছি না, হুজুর।’
ট্রেইটর বলে, মাসে তিরিশ লক্ষ টাকা, আর ওই টাকাটা আপনারা ফাঁকি দিয়ে নিচ্ছেন; দেশকে ফাঁকি দিচ্ছেন, আল্লাকে ফাঁকি দিচ্ছেন।’
হজুররা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, নাউজুবিল্লা।’
ট্রেইটর বলে, ‘আমি রিপোর্ট দিচ্ছি যে পাঁচটি মাদ্ৰাছা রেখে অন্যগুলো বন্ধ করে দিতে, কারণ ওগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।’
হুজুররা আবার ট্রেইটরের পায়ে পড়ে হুহু ক’রে কেঁদে ওঠে।
ট্রেইটরটা বয়সে আমার সমান, ওর পায়ে পড়ছে এতোগুলো হুজুর, যারা ওর পিতার সমান, এটা দেখে ট্রেইটরটাকে আমি শ্ৰদ্ধা করতে শুরু করি। আমি অবশ্য ট্রেইটর হতে পারবো না, রাইফেল হাতে নিয়ে শ্রেণীশক্ৰ খতম করতে গিয়ে আমি নিজেকে অনেক আগেই খতম করেছি।
হজুররা বলে, ‘ছার, পোলাপান লইয়া আমরা মারা যামু, আপনে আমাগো বাচান, আপনে আমাগো বাপের মতন।’
ট্রেইটর বলে, ‘আমার তো কিছু করার নেই, সরকার জানতে চেয়েছে, আমার কাজ হচ্ছে সত্য রিপোর্ট দেয়া, মিথ্যে বললে তো আমি দোজগে যাবো। আপনারা কি চান আমি দোজগে পুড়ি?’
আবার হুজুররা তার পায়ে পড়ে, হুহু ক’রে কেঁদে ওঠে।
হজুররা বলে, ‘না, না, হুজুর, আপনে দোজগে যাইবেন না, আমরা বালবাচ্চা লইয়া মইর্যা যামু, আমগো বাচান। ‘
আমি দেখি ট্রেইটর খুব পাকা হয়ে উঠেছে, বুড়ো হুজুরগুলো ওর পায়ে পড়ছে, হুহু ক’রে কাঁদছে, কিন্তু সে অটল থাকছে সততায়। ট্রেইটর বিস্ময়কররূপে সৎ হয়ে উঠেছে, সততায় সে অটল।
ট্রেইটর বলে, ‘কী ক’রে বাঁচাবো, বলুন, আপনারা তো ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, আল্লার বিরুদ্ধে কাজ করছেন, আমাদের পাক আল কোরানে তো মানুষকে সৎ থাকতে বলা হয়েছে।’
হজুররা বলে, ‘হুজুর, আমরা মমিন মুছলমান থাকতে পারি নাই, আল্লাপাকের কোছে গুনাহ্ করছি, তয় আপনে আমাগো বাচাইতে পারেন, আল্লা রজুলের পরই আমাগো কাছে আপনে৷’
ট্রেইটর বলে, ‘কী করে বাঁচাবো?’
হুজুররা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলোচনা করে। একটি ব্যাপার আমাকে বেশ বিস্মিত করে, আমরা দুজন সোফায় বসে আছি, কিন্তু ট্রেইটর ওই বুড়োগুলোকে একবারও বসতে বলে নি। হুজুররা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে মনে হয়, আমরা দুজন তখন চা খাচ্ছি।
এক হজুর বলে, ‘ছার, হুজুর, আমাগো একটা আরজি আছে আপনের কাছে, আপনে মাফ করলে আরজিটা আপনারে কইতে পারি।‘
ট্রেইটর বলে, বলুন।’
হজুর বলে, ‘আপনের শ্ৰদ্ধেয় বন্ধুর সামনেই বলুম?’
ট্রেইটর বলে, ‘বলুন।’
হুজুর বলে, ‘আমাগো তিরিশ লোকের থিকা পনর লাক আপনে রাইকা দেন, বাকিটা আমাগো দেন, তাতেই আমরা বালবাচ্চা লইয়া বাচতে পারুম।‘
ট্রেইটর বলে, ‘রিপোর্ট আমি দু-একদিনের মধ্যে দেবো, তার আগেই আপনারা সব ব্যবস্থা করবেন।’
‘জি হুজুর’ বলে হুজুররা ট্রেইটরের পায়ে চুমো খেয়ে, বারবার পদধুলো নিয়ে, অনেকে আমার পায়েও চুমো খেয়ে, খুশিতে ‘আলহামদুলিল্লা’ বলতে বলতে বেরিয়ে যায়।
আমি একদল জীর্ণ মেরুদণ্ডহীন ভাঙা গাধাকে বেরিয়ে যেতে দেখি।
ট্রেইটর আমাকে বলে, ‘এরা দরকার হ’লে পায়ে চুমো খেতে পারে, দরকার হ’লে খুনও করতে পারে, তবে ওরা আমাকে খুন করবে না; ওরা সেজদা দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।’
আমি ট্রেইটরের দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হই, সম্ভবত শিক্ষা নিই।
আমি সাম্যবাদ করেছি, সর্বহারা করেছি, খুন করেছি, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, কিন্তু এতোটা দক্ষতা কখনো দেখাতে পারি নি, আমলারা দক্ষতায় পবিত্ৰ শয়তানের থেকেও নিপুণ; কিন্তু আমার মধ্যে দক্ষতা দেখানোর একটি স্বপ্ন জেগে ওঠে। কিন্তু কী করে আমি এটা পারবো? আমার নেতারা একের পর শ্রেণীসংগ্ৰাম ছেড়ে একনায়কদের বুটের নিচে পড়ছে, আমি বুটের কাছাকাছিও যেতে পারছি না; কিন্তু আমি ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। আমাকে। আমি তো খারাপ ছাত্র ছিলাম না, স্টার ছিলো মাধ্যমিকে উচ্চমাধ্যমিকে, আর আমার এই প্রিয় ট্রেইটর আমার থেকে খুব বেশি ভালো ছাত্র ছিলো না; মনোয়ারা নামে একটি তরুণী তাকে তুলে আনে সাম্যবাদ, সর্বহারা থেকে, নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়; তখন মনোয়ারা বাঙলায় অনার্স পড়তো, গ্রিনরোডে তাদের বাসা ছিলো; ট্রেইটরটি ওই বাড়িতে ঢুকে আর বেরোয় নি। মনোয়ারা তাকে শ্রেণীসংগ্রামের থেকে বেশি দিয়েছে; আমাকে কোনো মনোয়ারা উদ্ধার করে নি, পৃথিবীতে আমার জন্যে কোনো মনোয়ারা আনোয়ারা সালেহা জন্মে নি; একটি আগুন আমার বুকে জ্বলছিলেই; আমাকে একদিন নিয়ন্ত্রক হ’তে হবে।
কিছুক্ষণ পরে দেখি মঞ্চে অন্য মঞ্চনাটক, আমলারা নিপুণ অভিনেতা।
পিয়ন সংবাদ দিতেই আমার প্রিয় ট্রেইটর দৌড়ে গিয়ে আঙিনা থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোককে নিয়ে আসে। এবারও আমি অবাক হই, একদল বুড়ো হুজুরকে যে পদতলের বেশি দেয় নি, সে-ই একজন ভদ্রলোককে দৌড়ে বাইরে গিয়ে ‘স্যার, স্যার’ ব’লে নিয়ে আসে! ট্রেইটর তাঁকে বারবার ‘স্যার, স্যার’ বলছে দেখে আমিও উঠে সালাম দিই।
তাঁকে সালাম দিতে আমার কোনো দ্বিধা হয় না; বেশ শুভ্ৰ সুন্দর মার্জিত মানুষ, কথা বলছেন চমৎকার বাঙলায়, মুখে সুন্দর শাদা দাড়ি।
তাঁকে দেখেই আমার মনে দাড়ি রাখার স্বপ্ন জাগে, তাঁর মতো দাড়ি; যখন বুড়ো হবো তখন আমাকে হয়তো তাঁর মতো দেখাবে। ভদ্রলোক কে, আমি জানি না; কিন্তু আমার ট্রেইটর তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে ‘স্যার, স্যার’ করছে দেখে বুঝি তিনি শক্তিমান কেউ। কিন্তু তাঁর কথায় কোনো শক্তির আভাস পাচ্ছিলাম না, পাচ্ছিলাম একটু মহত্ত্বকে, যা আমি কোনো দিন পাই নি। ভদ্রলোকের সঙ্গে আরো কয়েকজন এসেছে, তাদেরও আমার বেশ ভদ্ৰ মনে হয়।
ট্রেইটর ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার সঙ্গে।
বলে, ‘স্যার, আমার উপজেলার সবচেয়ে মান্যগণ্য ব্যক্তি, স্যারকে আমি শ্রদ্ধা করি’, আর আমার সম্পর্কে বলে, ‘আমার প্রিয় বন্ধু।’
ট্রেইটর বলে, ‘স্যার, আমাকে ডাকলেই আমিই যেতাম আপনার কাছে, আপনি কেনো এতো কষ্ট করে এলেন?’
ভদ্রলোক বলেন, ‘আপনাকে ডাকা অনুচিত হতো, আপনাকে ডাকার মতো পাওয়ারেও আমি নেই, আমি এসেছি আমার একটি দরকারে।’
ট্রেইটর বলে, ‘কী দরকার, স্যার?’
ভদ্রলোক বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পাঁচটি মাদ্ৰাছা আছে, আজ ওদের পরীক্ষা ছিলো। আপনি না কি পরিদর্শনে গিয়ে সব ছেলেকে বহিষ্কার করেছেন?’
ট্রেইটর বলে, ‘জি, স্যার, বহিষ্কার করেছি; কেন্দ্ৰ বন্ধ করে দিয়েছি।’
ভদ্রলোক বলেন, ‘এবারের মতো ওদের একটু মাফ করে দিন।’
ট্রেইটর বলে, ‘জি, স্যার, মাফ ক’রে দেবো, যদি আপনি বলেন; কিন্তু তারা যে-অপরাধ করেছে, তা একটু আপনাকে শুনতে হবে।’
ভদ্ৰলোক বলেন, ‘কী অপরাধ করেছে?’
ট্রেইটর বলে, ‘স্যার, গিয়ে দেখি ওরা সবাই জুতোর ভেতরে কোরান হাদিসের পাতা ঢুকিয়ে নিয়ে এসেছে; আমি ওদের জুতো খুলে রেখেছি, জুতোয় ওদের নাম লিখে রেখেছি। চলুন স্যার, জুতোগুলো আপনাকে দেখাবো।’
ভদ্রলোক ‘নাউজুবিল্লা’, ‘আস্তাগাফেরুল্লা’ বলে চিৎকার ক’রে দাঁড়িয়ে যান, বলেন, ‘ওইগুলি কাফেরের থেকে কাফের, পাক কিতাবের পাতা ওরা জুতার ভিতর ঢুকিয়ে এনেছে? ওইগুলোকে আপনি শাস্তি দিন, আমার কিছু বলার নেই, আমি নিজেই ওইগুলোকে জুতা দিয়ে পিটাবো।’
শান্ত স্নিগ্ধ ভদ্রলোক আগুনের মতো দাউদাউ ক’রে ওঠেন।
তার কিছু দিন পরই আমি জামাঈ জেহাদে যোগ দিই। আমি বুঝতে পারি ওখানে গেলে আমি নেতা হতে পারবো।
আমি ঢাকা থেকে আসা জিহাদিদের সঙ্গে কথা বলি, টাকার বান্ডিলটি নিয়ে ভেতরে রাখি, ভৈরব দিবসে কী করতে হবে, সব বুঝিয়ে দিই: ওরা সহজেই বোঝে, বুঝতে বুঝতেই ওরা এসেছে। ওরা ওদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে, আর ওরা নিজেরাই অস্ত্ৰ। ওদের জন্যে খাওয়ার, থাকার ব্যবস্থা ঠিক করা আছে; ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেছি, মাদ্রাছার দশজন তালেবানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওদের খাওয়ানোর, দেখাশোনা করার। মাদ্ৰাছার পশ্চিমে মসজিদে ওরা থাকবে, যেনো মুসাফির; ওরা প্ৰথমে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে।
ওদের ব্যবস্থা ক’রে ঘরে ঢুকে গিয়ে দেখি কণাকলতা জেগে উঠেছে। অল্প ঘুমে ওর মুখটি দ্বিগুণ কণকলতা হয়ে উঠেছে।
আমি আমার পাক পবিত্র কিতাবরাশির পেছন থেকে একটি বোতল বের করি; সিভাস রিগ্যালই আমার একটু বেশি পছন্দ। আহা, যখন সাম্যবাদী সর্বহার লেনিন স্ট্যালিন ট্রটস্কি গুয়েভারা ছিলাম, তখন একঢোক ধেনোও পেতাম না, মেথরপট্টিতে যেতাম, পেলে মনে হতো স্বর্গীয় শারাব পেয়েছি, এখন ব্ল্যাক লেভেল আমার কাছে ট্যাপের পানির মতো। পরম করুণাময় গফুরুর রাহিম কখন কাকে কী দেবেন, তা কে বলতে পারে?
কণকলতা বলে, ‘বতলটি তো খুব সোন্দর, হুজুর, এমুন বতল ত আগে কহনও দেহি নাই।‘
আমি বলি, ‘তোমার দেহখানির মতো সুন্দর নয়, তোমার দেহটি হচ্ছে স্বর্গের বোতল, আর ওই বোতলভরা অমৃত।‘
আমি গ্লাশে রিগ্যাল ঢালি, একটু পানি মেশাই, রঙটা সোনার মতো হয়ে ওঠে; কণকলতার মতো হয়ে ওঠে, তবে কণাকলতা আরো সোনালি।
আমি প্রথমে কণকলতার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি, ‘একটু খেয়ে দ্যাখো, ভালো লাগবে।’
কণকলতা বিছমিল্লা’ বলে চুমুক দিয়েই বলে, ‘কী যে ঝাঁজ, তয় অনেক মজার, কী কোক এইটা, হুজুর? এইটা কি আমরিকার কোক?’
আমি বলি, ‘কতোটা মজার?’
কণকলতা বলে, ‘হুজুরের ছ্যাপের মতই মজার।’
কণকলতা আর আমি নগ্ন শুয়ে একটু একটু পান করতে থাকি, কণকলতার দেহটি পান করবো না সিভাস রিগ্যাল পান করবো বুঝতে পারি না; এক সঙ্গে দুই রকমের সিভাস রিগ্যাল পেলে কোনটি বেশি উৎকৃষ্ট, তা ঠিক করতে আমার মতো জ্ঞানীরও কষ্ট হয়। আমি কণকলতা থেকে সিভাস রিগ্যালে, সিভাস রিগ্যাল থেকে কণকলতায় যেতে থাকি। কণকলতাকেই আমার বেশি অ্যালকোহলময় মনে হয়, ১০০% ভলিউম।
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনে আমার সোয়ামি।’
আমি বলি, ‘তোমাকে একদিন আমি মুছলমান বানাবো।’
কণকলতা বলে, ‘সোয়ামি, আপনের ওই বান্ডিলটায় কী?’
আমি বলি, ‘সোনা।’
কণকলতা বলে, ‘আমি দেখুম?’
আমি বাণ্ডিলটা এনে ওকে খুলে দেখাই, লাখ লাখ টাকার নতুন নোট দেখে ও কাঁপতে থাকে, বলে, ‘হুজুর, আপনের এতো ট্যাকা?’
আমি পঞ্চাশ হাজারের একটা বান্ডিল তুলে বলি, ‘কণকলতা, এই বাণ্ডিলটা কি আমি তোমার সোনার খনিতে ঢুকাবো?’
কণকলতা বলে, ‘তাইলে আমি মইর্যা যামু, হুজুর, বাণ্ডিলটা আমার হুজুরের হুজুরজির থিকাও মোডা, আর আমার খনিডা ত ট্যাকার খনি না, এইডা তো সোনালি ব্যাংক না, অগ্রণী ব্যাংক না, ইছলামি আরব-দুবাই ব্যাংক না, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবাৰ্গও না, এইডা হইল হুজুরের মধুর খনি, হুজুর ছাড়া আর কিছু ঢুকবো না।’
তবু আমি একটা বান্ডিল ঢুকোতে চেষ্টা করি। কণকলতা চিৎকার করে ওঠে; সব কিছু সব জায়গায় ঢোকে না, যা ঢোকার তা ঢোকে। না ঢুকবে না, কিন্তু আমি এটা ওকে দিতে চাই।
কণকলতা বলে, ‘বান্ডিলডা। আমার দুধের মাঝখানে থোন।’
আমি নিজে খনিতে ঢুকতে থাকি; কণকলতা বলে, ‘বিছমিল্লা শয়তানের রাজিম কইলেন না, হুজুর?’
আমি বলি, ‘বান্ডিলটা তোমার, যাওয়ার সময় নিয়ে যেও; এটা তোমার তিন নম্বর ব্রেস্ট, তবে আসল দুটো আমার।‘
কণকলতা বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, এমুন ব্রেস্ট মাঝেমইদ্যে দিয়েন, হুজুর, আমি পুরা আলকোরান মোখস্থ কইর্যা ফেলুম, মুছলমান হইয়া যামু। কিন্তু হুজরি, এত ট্যাক দিয়া আমি কি করুম?’
আমি বলি, ‘টাকা হাতে এলেই দেখবে করার কাজের অভাব নেই, তখন দেখবে কতো কিছু করার আগে, কিন্তু হাতে টাকা নেই।’
কণকলতা বলে, ‘তাই না কি, হুজুর? বাবায় আমারে দুই মাস আগে এক শ ট্যাকা দিছিল, অহনও অইডা বালিশের নিচে পইর্যা আছে।‘
কণকলতা সুখের খনি, আমার দিলকে সুখে ভরে দিয়েছে; তাকে শুধু পঞ্চাশ হাজার দিয়ে আমি সুখ পাই না। ড্রয়ার থেকে আমি সবচেয়ে দামি সোনার হারটি বের করি, ওটি কণকলতার মতোই কণকলতা।
কণকলতা ওটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
আমি বলি, ‘কণকলতা, এটিও তোমার জন্যে।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আমার গলায় পরাই দ্যান, বিবি। অইয়া যাই।’
আমি বলি, ‘গলার থেকেও সুন্দর জায়গায় এটি পরাবো, সোনার খনিতে থাকবে এই সোনার হার।’
কণকলতা বলে, ‘সেইটা আবার কি?’
আমি বলি, ‘তুমি কণকলতার মতো ঘুমিয়ে পরো।’
কণকলতা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে; আমি সোনার হারটি কণকলতার সোনার খনিতে ধীরেধীরে বিলুপ্ত করি, কণকলতা সুখে কেঁপে কেঁপে ওঠে। সোনার হারও কি তাহলে এক ধরনের শিশ্ন?
আমি বলি, ‘কণকলতা, তোমার খনিতে সোনা আছে, তুমি খনন করে সোনা বের করে নাও, এই সোনা তোমার।’
কণকলতা সেটি বের করে চমকে ওঠে, চোখ ভরে তার সোনা জ্বলতে থাকে, বলে, ‘হুজুর, এইটা আমার গলায় পরাই দ্যান।’
আমি পরিয়ে দিই; কণকলতা আমাকে নমস্কার করে বলে, ‘হুজুর, আইজ থিকা আমি আপনের বিবি হইলাম; আর কেও এই দ্যাহ পাইব না।’
আমি বলি, ‘এর আগে কে পেয়েছে?’
কণকলতা বলে, ‘কতজনে পাইতে চাইছে, কেরেও দেই নাই; কুত্তাগো লগে গাইট বান্ধনের কতা মনে আইলেই আমার ঘিন্না লাগছে।’
আমি বলি, ‘আমিও তো কুত্তা।’
কণকলতা বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, আপনে আমার দিল, আমার সোয়ামি, আমরা বাগদাদের বাদশাহ হারুনর রশিদ, দিল্লির সম্রাট শাজাহান। হুজুর, আমি মইর্যা গেলে আপনে আমারে কবর দিয়েন, কবরডার নাম দিয়েন কণকমহল।’
কণকলতা ও বকুলমালা দুই জিনিশ, দুই ফুল, দুই রকম তাদের গন্ধ, দুই রকম তাদের স্বাদ। কণকলতার দেহে আর কথায় কথায় মধুর রস, এই রসটা আমি পছন্দ করি, তার রস অমৃতসমান, নিজেকে আমার পুণ্যবান মনে হয়।
হরিপদ আচ্ছালতু খায়রুম মিনাননাউমের আগেই এসেছে, হয়তো সারারাত মাদ্ৰাছার পাশে নদীর পারেই ব’সে ছিলো। হরিপদটা আহম্মক, ব্যবসা বোঝে, কিন্তু বকুলমালা ও কণকলতাকে বোঝে না।
আমরা সকাল নটার সময় ‘ওমর দিবস’ শুরু করবো, ভৈরবের নাম আজ বদলে দেবো; যেমন উতরিবের নাম বদলে দেয়া হয়েছিলো। মুরতাদ আর ইহুদিদের খতম করবো, একবারে না হ’লেও ধীরেধীরে; আমি নিশ্চিত জানি, একবার কোনো মহান কাজ শুরু হ’লে তা বিপত্তির মুখে পড়তে পারে, কিন্তু তার জয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না; আমাদেরটিও কেউ পারবে না।
সকাল থেকেই আমার তিনটি মোবাইল (নাউজুবিল্লা, এগুলোও কাফেররা, নাছারারা তৈরি করেছে, তা তো করবেই, ওই শয়তানগুলো আমাদের পাক কিতাব থেকে গোপনে এসব বানানোর নিয়ম শিখে আমাদের ফতুর করে দিয়েছে) পাগল হয়ে ওঠে, জ্যাম হয়ে যেতে চায়; ঢাকা থেকে নেতারা, কয়েকটি সেক্রেটারি, কয়েকটি মিনিস্টার আমাদের মোবারকবাদ জানায়, আমাদের সঙ্গে তারা আছে; কলের পর কােল আসতে থাকে চট্টগ্রাম, মাইজদি, সিলেট, দিনাজপুর, যশোর, লালমনিরহাঠ থেকে।
তারা আমাদের দিকে, আমার দিকে, তাকিয়ে আছে।
এখান থেকেই তো শুরু হ’তে যাচ্ছে পাক সার জমিন সাদ বাদ।
মিনিস্টার আব্দুল হান্নান মোল্লা বলেন, ‘আমিও তো তোমার মতো সাম্যবাদ করতাম, মিনিস্টার হওয়ার জইন্যে এখন এই মেইন পার্টিতে আছি, কিন্তু আল্লার রহমতে মনে মনে আছি তোমার সঙ্গেই, একদিন জামাঈ জিহাদে জয়েন করবো। আজকের দিনটাকে সাকসেকফুল করতেই হইব, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড, রাহমানির রাহিম আল্লা ইজ উইথ ইউ, দারোগাপুলিশ বাস্টার্ডগুলিরে আমি ম্যানেজ করব।’
আমি বলি, ‘দোয়া করবেন।‘
তিনি বলেন, ‘দোয়া তোমারে সব সময়ই করি, তোমার উপর আল্লার রহমত বর্ষিত হোক, তুমি পারবা, তুমি দ্যাশটারে ট্র্যান্সফর্ম কইর্যা দিবা। তোমার বড় নেতাগুলি গ্ৰেইট মুছলমান, তবে দে ল্যাক ব্রেইন।’
সেক্রেটারি কাদির জিনালি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লা, আই উইশ ইউ অল সাকসেস, উই মাস্ট রিইস্টাবলিশ পাক সার জমিন সাদ বাদ। তুমি দ্যাকতেই ত পাইতেছ কোনো গভর্নমেন্ট ফাংশনে ওই ব্লাডি সোনার বাংলাটা বাজতেছে না; ওইটা চালাইলেই দশ লাখ টাকার প্লেয়ার ব্ৰেক্স ডাউন, ইলেকট্ৰিছিটি বন্দী হইয়া যায়। গ্রেইট আব্দুল্লা দি গাফরুর রাহিম ডাস নট লাইক দ্যাট ব্লাডি সোনার বাঙলা আই ফাক ইউ রিটেন বাই এ মালাউন বাস্টার্ড; উই নিড পাক সার জমিন সাদ বাদ ইন অর্ডার টু গেট হিজ ব্লেসিং।’
সেক্রেটারি সাহেব এখন একটি নতুন পেয়ারে পড়েছেন, তিনি মনে করেন আল্লার রহমত ছাড়া যুবতী মেয়েটির সঙ্গে তিনি ছহবত করতে পারবেন না। আমাকে তাঁর একটু দরকার: প্রথম ছহাবতটার জন্যে তিনি পাগল হয়ে উঠেছেন। যুবতীটি আবার রেস্ট হাউজে যেতে চায় না, তার প্যালেসেই প্ৰথম ছহবত করতে চায়; এটা একটু ডিফিকাল্ট।
জামাঈ জিহাদের, আমাদের, বড়ো নেতা ফোন ক’রে বলেন, ‘কয়টারে কতল করব? কয়টা জ্বালাইবা? সব আগে থিকা আব্দুল্লার রহমতে ঠিক করছ ত?’
আমি বলি, ইনশাল্লা গোটা তিনেক, আর জ্বালাতে হবে গোটা দশেক, ভাঙতে হবে গোটা পাঁচেক৷’
তিনি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লা, সোভানাল্লা।‘
তিনটি মোবাইল আমাকে পাগল ক’রে তোলে।
কেউ বাদ নেই, সবাই ফোন করে মোবারক বাদ জানাচ্ছে। ৩টি ভিসি, ৭টি প্রোভিসি ফোন করেছে, তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে :
৮টি অ্যামবোসাডর, ১১ এনজিরও ডোনার ফোন করেছে;
২০টি ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, ৩টি ইছলামি ব্যাংকের অনিছলামি এমডি,
২৫টি খাটি মুছলমান স্মাগলার, ৫টি পরহেজগার রাজস্বের
কালেক্টর, ৪টি ইছলামি অভিনেতা, ৫টি সেক্সি হিজাবপছন্দ নায়িকা,
আর আমেরিকা, কানাডা, উইকে, সুইডেন, জার্মানি, ইটালি,
সিডনি থেকেও ফোন আসছে; সৌদি, আমিরাত, সিরিয়া, পাকিস্তান, লিবিয়া।
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া। কোরিয়া থেকে আসছে। ভেবেছিলাম মহাথির মহম্মদ, ওসামা বিন লাদেনও ফোন করবে, ব্যাটারা ফোন করে নি।
আমাদের নেটওয়ার্কটি বড়ো, অনেকেই টের পায় না, যারা ফোন করছে, তারাও জানে না কতো বড়ো নেট পাতা হয়েছে।
সটুপিড আমেরিকা জানে না আমরা কতোটা শক্তিশালী, ওদের আরো কতো দালানে আমাদের প্লেন পড়বে।
সকাল আটটার মধ্যেই মাদ্রাছা-হ-মদিনাতুন্নবির সামনের রাস্তা ভ’রে যায়।
সারা এলাকার মাদ্ৰাছার তালেবানরা এসেছে সালোয়ার, পাকিস্থানি পাঞ্জাবি, মাথায় সুন্দর মাদানি টুপি প’রে; আর আছে আমাদের মদিনাতুন্নবি এলাকার জিহাদিরা; সব মিলে হাজার পাঁচেক হবে। সবার হাতেই ফেস্টুনপ্ল্যাকার্ড: আরবিতে সুন্দর করে লেখা ‘আল্লাহু আকবর’, আর বাঙলায় আরবির মতো পেঁচিয়ে লেখা ভৈরব হচ্ছে কাফেরি নাম, তার নাম হইবে ওমরপুর’, ‘ইহুদিদের ধ্বংস কর’, ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউনদের বিদায় করো’, ‘মালাউনদের দালালদের খতম করো’।
‘পাকিস্থান জিন্দাবাদ’ প্ল্যাকার্ডও কতকগুলো তৈরি করেছিলো আহাম্মক মোঃ হাফিজুদিন; কিন্তু সেগুলো রাস্তায় দেখানোর সময় এখনো আসে নি। আমি ওগুলি নদীতে ফেলে দিতে বলি।
বড়ো বড়ো দশটি পেতলের ফলকে খোদাই ক’রে লেখা হয়েছে ‘ওমরপুর’।
একেকটি অক্ষর তিন ফুট উঁচু। আগের ভৈরব নামের ফলকগুলো ভেঙে ফেলে ওগুলো শহরের নানা জায়গায় শক্ত পেরেক মেরে লাগানো হবে; এতো শক্ত করে লাগানো হবে যে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। এখন থেকে লোকজন কাফেরি ভৈরভে ঢুকলেই দেখবে পবিত্র ‘ওমরপুর’, বেরোতেই দেখবে ‘ওমরপুর’; ভৈরব আর দেখবে না; ঢোকার সময় তাদের দিল জান্নাতের সুখে জ্যোতিতে ভ’রে উঠবে, বেরোবার সময় তারা দিল ভ’রে নিয়ে যাবে জান্নাতের সুখ আর জ্যোতি।
ফলকগুলোর ডিজাইন মনের মতো করে, জ্যোতি মিশিয়ে, আমিই ক’রে দিয়েছিলাম, কিন্তু বায়তুল মোকাররামের নিচের তলার লোকটি যে এতো সুন্দর এতো খুবসু্রত ক’রে ফলক তৈরি করবে, তা আমি ভাবি নি। ওই লোকটিও আমাদের জামাঈদ জিহাদে ইছলামের সদস্য কি না। আমি জানি না; তবে ফলকগুলো দেখেই বুঝতে পারি তার বুকেও জিহাদ জ্বলছে।
বুকে জিহাদ না থাকলে হাত এতো সুন্দর কাজ করে না; যেমন আমাদের বুকে জিহাদ আছে বলেই আমরা আজ সুন্দর কাজ করতে যাচ্ছি, আজ আমরা সুন্দরকে পয়দা করবো।
‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হবে ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস কর’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’ আওয়াজ তুলতে তুলতে আমরা সামনের দিকে এগোই; বলা যায় সামনের দিকটিই আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। চারদিকে, আশমানে জমিনে, তাকিয়ে দেখি সমস্ত শহর থেমে গেছে, স্তব্ধ হয়ে গেছে, আনন্দে ঝলমল করছে, ভয়ে কাঁপছে, বেহেশতের বাদ্য শুনছে, ইচ্ছাফিলের শিঙ্গা শুনছে।
একবার থানার অসি এসে আমার সঙ্গে কথা বলে, কথা বলে ধন্য হয়, তারপর চলে যায়, এটাই আমাদের কথা ছিলো; আমরা শহরকে মহান আল্লার নামে মুখর ক’রে তুলি, আল্লার নামে নিস্তব্ধ করে তুলি। তিনিই সমস্ত মুখরতার মালিক, তিনিই সমস্ত স্তব্ধতার মালিক।
রাস্তায় একবার আমরা নীরব নিস্তব্ধ হয়ে দাড়াই; তারপর পাঁচ রোকাত সালাত আদায় করি। কোনো যে পাঁচ রাকাত বেছে নিলাম, তা আমি জানি না; হয়তো গফুরুর রাহিম রাহমানির রাহিমের এটাই ছিলো ইচ্ছে। সালাত সব সময় আদায় করা যায়; মহৎ সব কাজের আগেই সালাত আদায় ক’রে নিলে কাজ আরো মহৎ হয়ে ওঠে। সালাত আদায়ের সময় আমি মদিনাকে দেখতে পাই, উতরিব থেকে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ইহুদিরা, সেই দৃশ্য দেখতে পাই; আমার দিল খুশিতে ভ’রে ওঠে। দেখতে পাই পাথরের ঘরগুলো ছেড়ে ইহুদিরা পালাচ্ছে, অনেকে কতল হয়ে যাচ্ছে, ওদের বউ আর মেয়েগুলোকে শেকল দিয়ে বঁধেছি, বন্ধনের মধ্যেও ওদের সুন্দর দেখাচ্ছে, সৌন্দৰ্য সব সময়ই পীড়নে আরো সুন্দর হয়ে ওঠে; দেখতে পাই লম্বা গর্ত খুঁড়ছি, তাতে মাটি চাপা দিচ্ছি কয়েক হাজার ইহুদিকে। আমি জানি ভৈরবের মালাউন ইহুদিগুলো এখন ভয়ে নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে মাটির ভেতর ঢুকতে চাচ্ছে, তার তাদের দালাল ইবলিশগুলো কাঁপছে, একদিন ওই দালালগুলো আমাদের কাঁপাতো।
আমার দিল উতরিব থেকে মন্দিনায়–মদিনাতুন্নবিতে, মদিনা থেকে উতরিবে অবিরাম যাতায়াত করতে থাকে; ইহুদিদের আর্তনাদে আমার দিলে আঙুরের রসের ঝর্না বইতে থাকে; ইহুদি যুবতীগুলোকে দেখি, শেকল দিয়ে তাদের বেঁধে নিয়ে যাচ্ছি, কয়েকটি ইহুদি যুবতী আমার দিলে ঢুকছে, ওদের দিলের গর্তে ঢুকোচ্ছি, আর পুরুষগুলোকে গর্ত খুঁড়ে জ্যান্ত মাটিচাপা দিচ্ছি, তারা শব্দও করতে পারছে না।
আমি ৬২২-এর পবিত্র মদিনাকে দেখতে পাই, আমার রক্ত জ্বলতে থাকে।
দেখি শয়তান অবিশ্বাসী ইহুদি গোত্রগুলো—বানু-আল নাদির, বানু কুরাইজা, এবং বানু কাইনুকাকে। আমার মনে হয় এখনো তারা আমাদের ঘিরে আছে, মদিনা থেকে তাদের আমরা বিতাড়িত করেছিলাম, তারা এখন জুড়ে বসেছে। এদেশে, তাই দেশকে পাক স্তান করতে হবে, যেমন করেছিলাম ১৪০০ বছর। আগে। মনে হয় যেনো আমি ঢুকছি। উতরিবে, নাপাক অঞ্চলে, আমার প্রথম কাজ হচ্ছে ইহুদিদের খতম করা, আজ আমি তা করবো।
আমি দেখতে পাই মালাউন ও তাদের দালালদের কয়েকটি ছিন্ন মাথা আমার পায়ের নিচে পড়ে আছে, যা কয়েক কোটি টাকার থেকেও মূল্যবান। আমি দেখতে পাই আল নাদের দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে, ওকবা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে, এবং আমি ছিন্নভিন্ন করছি তাদের।
আমার বুক থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছে ‘আল্লাহু আকবর’।
সালাত শেষ ক’রে কাফেরি ভৈরবের নানা পথের প্রান্তে প্ৰান্তে স্থাপিত নাম ফলকগুলোর দিকে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হবে ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস কর’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’, ‘মুরতাদদের ধ্বংস করো’ আওয়াজ তুলে এগোতে থাকি।
জিহাদি মোঃ হাফিজুদ্দিনকে ভার দেয়া হয়েছে ভৈরবের নামফলকগুলো তুলে ফেলে সেখানে নতুন নামফলক ওমরপুর লাগানোর; এটা তার জন্যে একটি পুরস্কার, সে চিরদিন গৌরব করতে পারবে এগুলো তার নিজের হাতে লাগানো। যখন আমরা সব কিছু দখল করবো তখন হয়তো তাকে ভার দেয়া হবে এই নতুন পুরের, যার নামফলকের স্থপতি সে। মোঃ হাফিজুদিন পালোয়ান পুরুষ, মল্লযোদ্ধা, সে নিজের হাতেই ওগুলো টেনে খুলে ফেলতে চায়, বাহুতে জোশ তার উপচে পড়ছে, কিন্তু সে খুলতে পারছে না; সঙ্গে সে ভারি হাতুড়ি নিয়ে এসেছে, এগুলো আমাদের সব সময় দরকার হয়, তার সঙ্গে তালেবানরা একের পর এক ভাঙছে ভৈরব নামের ফলকগুলো, সেখানে লাগাচ্ছে ওমরপুরের ফলকগুলো, চারদিক জ্যোতিতে ভাস্বর হয়ে উঠছে; আর আওয়াজ উঠছে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হলো ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস হলো’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’।
আমি নিজেই থারথার করে কঁপিছি, অপূর্ব আবেগ ও জ্যোতিতে ভরে উঠছি, একটি উজ্জ্বল গুহার জ্যোতি দেখছি। লোকজন দূর থেকে আমাদের কাজ দেখছে, আমি তাদের চোখেও জ্যোতি দেখতে পাচ্ছি, তারাও জিহাদে পরিপূর্ণ, তারা নতুন যুগের সূচনা দেখছে। একে একে আমরা দশটি জায়গায় ‘ওমরপুর’ ফলক লাগাই; সারা শহর জ্যোতিতে ভ’রে ওঠে। এতো জ্যোতি আমি আগে কখনো দেখি নি; মাটির নিচের কূট অন্ধকারে যদি দশটি শামস জ্বলে ওঠে, তাহলে যে-জ্যোতি দেখা দিতে পারে, তা আমি দেখতে পাই।
এরপর শুরু হয় আমাদের প্রকৃত জিহাদ।
আমাদের জিহাদিরা উচ্চকণ্ঠে উঠছে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হলো ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস হলো’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’, ‘ইছলাম কায়েম করো’, ‘মুরতাদরা ধ্বংস হোক’ আওয়াজ তুলতে তুলতে বাজারের দিকে ছুটতে থাকে; জিহাদি মোঃ হাফিজুদিন আগে আগে এগোতে থাকে, সব সময়ই সে অগ্রপথিক, আমি আছি মাঝে, নেতাকে এখানেই থাকতে হয়। তারা দিকে দিকে বোমা ছুঁড়তে থাকে, মালাউনদের দশবারোটি দোকানে পেট্রোল ছড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়, মালাউনদের দালালদের দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়,–হরিপদর দোকান আর চাউল কল ঠিক থাকে–আমি আগেই নির্দেশ দিয়েছি। কয়েক জিহাদিকে ওগুলো পাহারা দিতে, আমি কথা দিলে কথা রাখি, যদি কথা দিই বুকের ভেতর থেকে; মোঃ হাফিজুদ্দিন গুলি করতে দক্ষ, দু-একটি গুলি না করলে, তাতে দু-চারটি খুন না হ’লে, সে সুখ পায় না। সে তার সুখকর কাজগুলো করতে থাকে।
আমি দেখতে পাই সে আগুনের মতো ঝড়ের মতো উটের মতো ছুটছে, গুলি করছে; দু-তিনটি মালাউন ও মালাউনদের একটি দালাল তার গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো: লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে আমার দিল ভরে উঠলো, লুটিয়ে পড়ার দৃশ্যের মতো সুন্দর দৃশ্য আর নেই।
আমাদের জিহাদিরা ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হলো ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস হলো’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’, ‘ইছলাম কায়েম করো’ আওয়াজ তুলছে, বোমা ছুঁড়ছে, গুলি করছে, আগুন জ্বালাচ্ছে: দাউদাউ আগুন উঠতে থাকে, আগুনের সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ হই, মহিমা বুঝতে পারি; বোমা ও গুলির শব্দে চারপাশ মুখর হয়ে ওঠে, যেনো অনবরত বজ্র এসে পড়ছে। শহরের ওপর।
মহান পরিবর্তনের সময় এমন ঘটনা চিরকালই ঘটেছে, চিরকালই ঘটব; রোমে ঘটেছে, গ্রিসে ঘটেছে, ভারতে ঘটেছে, আরবে ঘটেছে, বঙ্গদেশেও ঘটেছে, সিন্ধুতে ঘটেছে; আজ ঘটেছে ভৈরবে, বদলে যাচ্ছে ভৈরব, যেমন বদলে গিয়েছিলো উতরিব। দু-তিনটি মালাউন ও মালাউনদের একটি দালাল লুটিয়ে পড়েছে–আমি ওদের চিনি, তাতে কিছু যায় আসে না, তবু তো ওদের আমরা মাটিতে জ্যান্ত চাপা দিই নি, যদিও চাপা দিলেই আমার মন শান্তি পেতো; ওগুলোর হিশেবে কেউ পাবে না; আমাদের জিহাদিরা তাদের ব্লাড প্রুফ বস্তায় ভরে ফেলেছে, অন্য কেউ তাদের দেখতে পায় নি।
তাদের আমরা চিরকালের জন্যে নামপরিচয়হীন ক’রে দেবো।
তারপরই ঘটে বৃহত্তম ঘটনাটি। মোঃ হাফিজুদিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি এবার দৌড়ে তার কাছে যাই, দেখি তার হাত, মাথা উড়ে গেছে; জিহাদি মোঃ হাফিজুদ্দিন শহিদ হয়েছেন।
কে করতে পারে এই কাজ, কে আমাদের দিতে পারে একজন চিরঅমর শহিদ? আমি তা জানি, আর কেউ তা জানে না। যে-কজন জানে, তারাও কোনোদিন জানবে না; তারা চুপ থাকবে চিরকাল। অনেক মহান ঘটনা সামান্যরা কখনোই জানে না, তা জানা নিষিদ্ধ।
আমি জিহাদি মোঃ হাফিজুদিনের লাশের ওপর চিৎকার করে পড়ি, রক্তে ভিজে যাই; এবং বলি, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন জিন্দাবাদ’।
আমার সঙ্গে সঙ্গে সব জিহাদি। আওয়াজ তোলে গর্জন করে বজের আওয়াজ তোলে ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন জিন্দাবাদ’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’। দিকে দিকে সাড়া পড়ে যায়; শহর আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে যায়, কুঁকড়ে যায়, আকাশ ভেঙে পড়তে চায়, সূৰ্য গনগন করতে থাকে, সূৰ্য গ’লে পড়তে চায়। আমাদের জিহাদের এক অসাধারণ শাম্স্ দুপুরের আগেই ডুবে গেছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে; এতে মানুষ ও প্রকৃতি কেউ আর আগের মতো স্বাভাবিক থাকতে পারে না।
জোহরেই মাগরেব নেমেছে, কিছুই আগের মতো থাকবে না।
জিহাদিরা মসজিদ থেকে খাট এনে শাদা কাফন জড়িয়ে শহিদ হাফিজুদিনের ছিন্নভিন্ন লাশ খাটে রাখে, লাশ যতো ছিন্নভিন্ন হয় ততোই অমর হয়।
আমরা তার লাশ কাউকে দেখতে দিই না, তাতে রহস্য কমে যাবে; শহিদকে অমর করে রাখতে হলে তাকে রহস্যময় ক’রে রাখতে হয়। জিহাদিরা আওয়াজ তুলতে থাকে ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবিয়’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’,
এই আওয়াজ ওমরপুরের আকাশকে কাঁপিয়ে তোলে, শহরটি বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠে, পাশের নদীতে উচ্চ ঢেউ ওঠে, গাছপালার ভেতর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়, সমস্ত বাড়িঘরের ভেতর দিয়ে আগুনের ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়।
শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আমি একটি বক্তৃতা দিই। আমি বলি, ‘বিছমিল্লাহির রাহমানের রাহিম, সমস্ত প্ৰশংসা আল্লার প্রাপ্য, জিহাদি ভাইয়েরা, আমাদের সামনে এখন শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের পাক লাশ, শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন মরেন নাই, তিনি শহিদ হয়েছেন, ইসলামের জন্য চিরকাল মোঃ হাফিজুদিনের শহিদ হয়েছেন, আমরাও তাঁর মতো শহিদ হবো। আমরা শরিয়া কায়েম ক’রে ছাড়বো। শহিদ হওয়ার মতো গৌরবের আর কিছু নেই। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে গৌরবান্বিত শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন।’
জিহাদিরা আওয়াজ তুলতে থাকে ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’, ‘মালাউনদের খতম করো’, ‘মালাউনদের দালালদের খতম করো’, ‘মুরতাদদের খতম করো’।
আমি বলি, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন নিজের বুকের খুন দিয়ে এক নতুন নগর প্রতিষ্ঠা ক’রে গেছেন, যার নাম ‘ওমরপুর’। তাঁর রক্ত বৃথা যাবে না, শহিদের রক্ত বৃথা যায় না। তাঁর রক্ত থেকে সৃষ্টি হবে এক পাক পবিত্র স্তান, তার গান হবে পাক সার জমিন সাদ বাদ।’
আওয়াজ উঠতে থাকে ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’, ‘মালাউনদের খতম করো’, ‘মালাউনদের দালালদের খতম করো’।
আমি বলি, ‘বলেন ভাইয়েরা কে খুন করেছে, কারা খুন করেছে আমাদের প্রিয় জিহাদি শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনকে? বলেন জিহাদিরা, বলেন।’
জিহাদিরা আওয়াজ তোলে, ‘জিহাদি শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনকে খুন করেছে মালাউনরা আর মালাউনদের দালালরা।‘
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘এখন জিহাদি ভাইয়েরা, আপনাদের কি কর্তব্য? আপনারা এখন কি করবেন? এই ইহুদিদের মালাউনদের মালাউনদের দালালদের হাতে আপনারা কি এখনও খুন হবেন? আপনারা কি শুধু খুন হ’তে চান?’
তারা আকাশ ফাটিয়ে মাটি কাপিয়ে আওয়াজ তোলে, ‘আমরা কতল করব।
আওয়াজ উঠতে থাকে মালাউনগো কতল করো’, ‘দালালগো কতল করো’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’, ‘মালাউনদের খতম করো’, ‘মালাউনদের দালালদের খতম করো’।
জিহাদিরা দিকে দিকে ছুটতে থাকে।
যেমন ছুটেছে তারা উতরিবে, আলেকজান্দ্রিয়ায়, বাগদাদে, স্পেনে, বঙ্গদেশে, সিন্ধুদেশে; তারা মালাউন ও তাদের দালালদের ঘরবাড়ি দোকানে আগুন লাগাতে থাকে, কয়েকজনকে খুন করে বস্তায় ভ’রে ফেলে।
বিজয়ের নিয়ম হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ দিন ধরে তাণ্ডব চালাতে হবে।
পুরোনোকে সম্পূর্ণ ধ্বংস ক’রে নতুনকে সৃষ্টি করতে হবে, নাপাককে শেষ ক’রে পাককে শুরু করতে হবে; নাপাকের যেখানে শেষ পাকের সেখানে শুরু। আমরা যেতে থাকি স্কুল থেকে স্কুলে, কলেজ থেকে কলেজে; সেখানে যতো শহিদ মিনার ছিলো, সেগুলোকে একে একে ধ্বংস করি। শহিদ মিনার হচ্ছে মূর্তিপূজা, মূর্তিপূজা থেকে আমরা উদ্ধার করি আমাদের স্তানের প্রথম পুরকে। ভৈরব রূপান্তরিত হয় ওমরপুরে, আমাদের জিহাদ সাফল্য লাভ করে।
সারা শহর চুপ করে যায়; ভৈরব ভেদ করে ওমরপুর জেগে ওঠে।
মোবাইল এতোক্ষণ বন্ধ ছিলো; তিনটি মোবাইল আবার কলকল ক’রে ওঠে।
বড়ো নেতা ফোন করেছেন, ‘ফল কি হইল আলার রহমতে, আমরা জানার জইন্যে বেচইন হইয়া আছি, দিল কাপতেছে।‘
আমি বলি, ‘আলহামদুলিল্লা, আমরা বিপ্লব কায়েম করছি, ভৈরবের নাম এখন থেকে ওমরপুর, চিরকাল থাকবে ওমরপুর।’
তিনি বলেন, ‘সোভানাল্লা, আমি জানতাম আল্লার রহমতে তোমাগো জিহাদ কায়েম হইব, তুমি যেইখানে আছ সেইখানে জয় না হইয়া পারে না, আমরা এই হারাম দ্যাশরে পাক স্তান কইর্যা তুলুম।‘
আমি বলি, ‘আলহামদুলিল্লা।’
তিনি বলেন, ‘আর কি কি করলা?’
আমি বলি, ‘মালাউন আর মালাউনদের দালালদের ঘরবাড়ি পুড়েছে, কতল হয়েছে, সব শহিদ মিনার চুরমার হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সোভানাল্লা, এইডাই ত চাইছিলাম’।
আমি বলি, ‘তবে সবচেয়ে বড়ো একটি জিনিশ আমরা পেয়েছি।’
আমি বলি, ‘আমরা একজন মহান শহিদ পেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘শহিদ? ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না। কে শহিদ হইল?’
আমি বলি, ‘আমিই শহিদ হতে পারতাম, অল্পের জন্যে হই নি, শহিদ হয়েছেন জিহাদি মোঃ হাফিজুদ্দিন, আমার দুই নম্বর।’
তিনি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লা, আল্লায় আমাগো রহমত দিয়াছেন। আমাগো একজন মহান শহিদ দরকার আছিল। তিনি এখন ভেস্তে আছেন, সোভানাল্লা।’
আমি বলি, ‘আমি শহিদ হ’লেই ধন্য বোধ করতাম, পাক স্তানের জন্যে নিজের বুকের রক্ত দিয়ে ধন্য হতাম।’
তিনি বলেন, ‘না, না, তোমার এইখন শহিদ হইলে চলাব না, তোমার গাজি থাকতে হইব; তয় এইখন কি কর্মসূচি নিছ?’
আমি বলি, ‘একটা বড়ো কর্মসূচি হয়ে গেছে, শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের জানাজার পর আরো কর্মসূচি আছে।’
তিনি বলেন, ‘ঠিক কইর্যা কইরো, আল্লার রহমত আছে তোমার উপর।’
মোবাইলের পর মোবাইল।
মিনিস্টার আবদুল হান্নান মোল্লা বলেন, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স, তুমি সাকসেকফুল হইছ, এইটা আমারই সাকসেস; তবে অই অ্যাম শকড় অ্যান্ড সরি যে তোমাদের একজন শহিদ হয়েছে, মালাউন আর তাগো দালালদের দু-চারটি ফেলে দিতে পারলা না? উই আর উইথ ইউ অ্যান্ড ইছলাম।’
আমি বলি, আকাশে মাটিতে অনেক জিনিস আছে যার খবর আল্লা ছাড়া আর কেউ জানে না; দু-তিন দিনের মধ্যেই ঢাকা আসছি, তখন আপনাকে সব বলবো, আলহামদুলিল্লা।’
মিনিস্টার বলেন, ‘তুমি এখন বিজি, শহিদ মোঃ হাফিজুদিনরের শহরের শ্ৰেষ্ঠ জায়গায় কবর দিও, সে অমর, কয়েক দিন পর আমি জিয়ারত করতে আসব।’
আমি বলি, ‘আমি গিয়ে নিয়ে আসবো, আল্লা হাফেজ।’
সেক্রেটারি কাদির জিলানি অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে, আমি তার নামটা দেখতে পাচ্ছি মোবাইলে, কিন্তু ধরছি না; সে চেষ্টা করুক, কয়েকবার চেষ্টা করুক, তাহলে বুঝবে আমি কতো বড়ো মহৎ কাজে লিপ্ত রয়েছি।
সেক্রেটারি কাদির জিলানি বলেন, ‘মোবারকবাদ, কংগ্ৰেচুলেশন্স, তুমি তো সারা দেশরে কাপাই দিছ, ইউ আর নাও আওয়ার হিরো। দি নেম ভৈরব ওয়াজ শিয়ার আইডলেট্রি, নাউ উই হ্যাভ গট অ্যান ইছলামিক নেম–ওমরপুর। মেইন পার্টির নেতারাও টকিং অ্যাবাউট ইউ ফ্রম দি ভেরি ডন; বাট অই অ্যাম শকড় অ্যান্ড হ্যাপি দ্যাট নার ইউ হ্যাভ এ মার্টিয়ার, হো উইল গিভ উইটনেস টু আল্লা, দি রাহমানির রাহিম। ইছলাম ইজ নট ফার বিহাউন্ড।‘
আমি বলি, ‘শুকরিয়া।‘
তিনি বলেন, ‘ঢাকা এসেই প্লিজ ট্রাই টু মিট মি, ইট উইল বি মাই গ্রেটেস্ট প্লেজার টু সি ইউ ইন মাই অফিস অ্যান্ড ইন মাই প্যালেস ইন বারিধারা।’
আমি বলি, ‘ইনশাল্লা আসবো।’
আরো কতো মোবাইল, আরো কতো মোবাইল।
আমার ভয় হয় হয়তো শহিদ মোঃ হাফিজুদিনও মোবাইলে আমাকে বেহেশত থেকে কল করবে; তারও দুটি মোবাইল ছিলো।
মাইজদি থেকে, ‘মোবারকবাদ।’
নিউইয়র্ক থেকে, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
চট্টগ্রাম থেকে, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ।‘
সিডনি থেকে, ‘মারহাবা।‘
হেলসিংকি থেকে, ‘মোবারকবাদ।‘
ঢাকা থেকে, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
লস এঞ্জেলেস থেকে, ‘নারায়ে তকবির।’
জাকার্তা থেকে, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
কাতার থেকে, কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
আবু ধাবি থেকে, ‘মোবারকবাদ’।
জেদ্দা থেকে ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
আবু ধাবি থেকে, ‘মোবারক বাদ।’
কাবুল থেকে, কংগ্রেচুলেশন্স।’
এবং ঢাকা থেকে, এবং ঢাকা থেকে, এবং ঢাকা থেকে, এবং আরো, এবং আরো, এবং আরো। কোনো ফোনই আমাকে অবাক করে না।
একটি ফোন আমাকে চমকে দেয়, ওটি আমি আশা করি নি। নম্বরটি আমার অচেনা, কোনো নাম ভেসে ওঠে না।
তাহলে কি শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন বেহেশতে থেকে কল করলো? ওখানকার নম্বর হয়তো ভিন্ন; ওখানে হয়তো গ্রামীণ ফোনের, সিটি সেলের, অ্যাকটেলের নেটওয়ার্ক নেই।
আমি বলি, ‘হ্যালো।’
সে বলে, ‘হুজুর, আমি আপনের বিবি। কণকলতা।’
আমি বলি, ‘তুমি!’
সে বলে, ‘হুজুর, আপনে ভাল আছেন তো?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ।‘
সে বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, হুজুর, আপনেরে মোকারকবাদ ও ধন্যবাদ। আমরা ভাল আছি, বাবার কলডা, দোকান, আমরা ভাল আছি।‘
আমি বলি, ‘ভালো থাকবে।’
সে বলে, ‘আমারে ভুইল্যেন না হুজুর, আমি আপনের বিবি; আপনের কতা আমি দিনরাইত ভাবি, আপনের কতা ভাইব্যা। আমার কষ্ট অয়।’
আমি বলি, ‘এটা তোমার ফোন?’
সে বলে, ‘জি হুজুর, আমার শত সহস্ৰ কদমবুশি আর চুমা।’
কতকগুলো চুমোর শব্দ পাই, মোবাইলটিকে আমার কণকলতার জিভ ব’লে মনে হয়, আরেকটুকু হ’লেই আমার হুজুর রাজপথেই তালগাছ হয়ে উঠতো, কিন্তু দেখি আমার বুকটিও কাঁপছে, হাহাকার করছে।
আমি ওর নম্বরটি সেভ ক’রে রাখি।
দুপুরে, জোহরের নামাজের পর, ঈদগা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
সেখানে আমরা শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের জানাজা পড়ি।
ওমরপুর ভেঙে পড়েছে শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনের জানাজা পড়ার জন্যে।
আমার মনে হয়। পাক ফেরেশতারাও নেমে এসেছে; নইলে এতো লোক এলো কোথা থেকে? এখানে তো মালাউনরা আসে নি, তাদের দালালরা আসে নি; তাহলে যারা এসেছে, তারা সবাই কি জামাঈ জিহাদে ইছলামের? আমার তাই মনে হয়, সকলের বুকে এখন জিহাদ। সাধারণ মানুষ শুধু নয়, দারোগা পুলিশ অসি, ম্যাজিট্রেট, ইউএনও, ডিসি, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, উকিল, মুক্তার, চোর, ডাকাত, স্মাগলার কেউ বাকি নেই; সবাই এসেছে, তার জানাজার প্রাঙ্গণ গমগম করছে, আবার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে; আমি মনে মনে মোঃ হাফিজুদ্দিনকে দেখতে পাই, তাকে বলি, ‘দ্যাখো, মোঃ হাফিজুদ্দিন শহিদ হয়ে তুমি কতো মহৎ হয়ে উঠছো, আমাদের জামাঈ জিহাদ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, তুমি আমাদের প্রেরণা, কিন্তু তোমাকে আমি কখনো বিশ্বাস করি নি, তাই তুমি আজ শহিদ, তুমি অমর, তবে তুমি আমার কাছে কৃতজ্ঞ থেকো। তুমি জানো না কার বদৌলতে তুমি আজ অমর, তুমি আজ শহিদ, আজ আমাদের প্রেরণা। তুমি একটু বেশি এগিয়ে যেতে চেয়েছিলে, তবে শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন তোমার ঘিলু ছিলো না, তুমি সাম্যবাদ, সর্বহারা থেকে আসে নি, ইছলামেরও কিছু তুমি বুঝতে না, কোরান হাদিছ তুমি বুঝে পড়ে নি, অর্থ বোঝ নি, খোমেনির কিছুই তুমি পড়ে নি; তুমি খুন বুঝতে, রক্ত বুঝতে, পিস্তল বুঝতে, তার জন্যে আমি তোমাকে শ্ৰদ্ধা করি। তোমার কবর হবে ওমরপুরের প্রধান কবর, প্ৰধান দরগা, তোমাকে আমরা আমার ক’রে রাখবো, মিনার তুলবো; তোমার রক্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পবিত্র নগর, প্রতিষ্ঠিত হবে একটি পবিত্ৰ স্তান। ধন্য তুমি শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন, তোমাকে ছালাম।’
শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনকে দাফন করার পর নিয়ম মতো শহরটিকে আমরাপুনরায় পরিশুদ্ধ, পাকপবিত্র, করি; জিহাদিরা যতোটা পবিত্র তাণ্ডব সৃষ্টি ক’রে তাদের সৃষ্টিকে উপভোগ করতে চায়, ততোটা আমি করতে দিই না; তবে ওমরপুর অপবিত্র থাকতে পারে না। আমরা দিকে দিকে ছুটি, ঘোড়ার যুগ থাকলে চেঙ্গিশ বা ইখতিয়ারের মতো ঘোড়া ছোটাতাম, কিন্তু আমাদের দুই পা চার পায়ের থেকে কম নয়, অন্য দুটি পা আমাদের হাতে পরিণত হয়েছে তলোয়ার পিস্তল ধরার জন্যে, আগুন লাগানোর জন্যে; জিহাদিরা মালাউন ও দালালদের ঘরে দোকানে আগুন লাগায়, ছেলেমেয়েদের নাচগানের কুফরি তিনটি স্কুলকে ছাইয়ে পরিণত করে—নাচগান জিনার সমান; কিন্তু কতল করার মতো যোগ্য মালাউন আর দালান পাওয়া যায় না।
ওরা পবিত্রপুর ছেড়ে আগেই পালিয়েছে, যারা পড়ে আছে তারা জিম্মি।
জিম্মিদের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব, তাদের থেকে জিজিয়া আদায় করতে হবে, জিজিয়া ছাড়া আমাদের চলবে না, ধর্ম রক্ষার জন্য জন্যে জিজিয়া দরকার। ওমরপুর এখন পাক পবিত্র স্তান; তার বাতাসে ধুঁয়ো ও আগুনের গন্ধ, রক্তের গন্ধও আছে; কিন্তু তাতে কাফেরি নেই, মালাউন ও তাদের দালাল নেই। এই প্রথম আমি সম্পূর্ণ পাক নিশ্বাস নিই, আলহামদুলিল্লা। জিহাদিরা ক্লান্তিহীন পুরুষ, রক্ত ও আগুন তাদের প্রিয়, অনাহারে তারা দিনরাত জিহাদ করতে পারে, তাদের নিয়ে সারা দুনিয়াকে স্তানে পরিণত করা যাবে, তারা থামতে চায় না।
আমি বলি, ‘ওমরপুর জিন্দাবাদ।‘
তারা সহস্র কণ্ঠে বজ্রের আওয়াজ তোলে, ‘ওমরপুর জিন্দাবাদ’, আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘জামাঈ জিহাদ জিন্দাবাদ’।
আমি বলি, ‘তোমরা কি ক্লান্ত?’
বজ্ৰনিৰ্ঘোষে তারা বলে, ‘না।’
আমি বলি, ‘আমাদের ক্লান্ত হ’লে চলবে না, থামলে চলবে না; তবে আগামীকালও আমাদের মহৎ কর্মসূচি আছে, আগামীকাল আমরা শ্যামসিদ্ধির নাম বদলে দেবো, ওই কাফের গ্রামকে পাক ক’রে তুলবো, ওই মঠকে ধুলোয় গুড়িয়ে দেবো, তাই আমাদের আজ বিশ্রাম দরকার।’
তারা বলে, ‘আপনি আমাগো আদেশ করেন।‘
আমি বলি, ‘মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবিতে তোমাদের জন্যে খাবার তৈরি রয়েছে, সেখানে গিয়ে তোমরা আহার করে। তারপর যার যার মাদ্ৰাছায় ফিরে যাও, কিন্তু কুয়ৎ ঠিক রেখো। আগামীকাল সকাল আটটায় আবার সকলে জমায়েত হয়ো মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবির সম্মুখে।’
তারা আওয়াজ তোলে ‘ওমরপুর জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘জামাঈ জিহাদ জিন্দাবাদ’।
“পাক সার জমিন সাদ বাদ” উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ