যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
এ অঘটন এড়ানো সম্ভব ছিল।
পাকিস্তানের মত একটি বহুজাতিক দেশের জন্য শুরু থেকেই প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার এলিট শ্রেণীর মধ্যে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল এবং পরিকল্পনা নির্ধারনের জন্য যে সহযোগিতা অতি আবশ্যক ছিল তা নিশ্চিত করার জন্য নিম্মে বর্নিত বিষয়গুলোর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা উচিত ছিল জাতীয় পরিসরে
১. সব জাতীয় এলিট শ্রেণীর সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিত্বকারী সরকার কায়েম করা।
২. বিভিন্ন জাতিসত্বার মধ্যে ঐক্যমত্য এবং একটি কার্যকরী ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৩. সর্বক্ষেত্রে একতা ভিত্তিক সহজলভ্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
৪. জাতির লক্ষ্য এবং আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার এলিট শ্রেণীর জনগণকে অনুপ্রানিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করা।
৫. যে কোন বিচ্ছিন্নবাদী প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়া; বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয় এবং তা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই।
৬. অর্থনৈতিক সুবিধাদি যাতে জনগণ পর্যন্ত পৌঁছে তা নিশ্চিত করা। আধুনিকীকরণ এবং উন্নয়নের সুফল সমভাবে যাতে সব জাতিগোষ্ঠিই উপভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জাতীয় এলিট শ্রেণীগুলো কর্তৃক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির জনগণের মাঝে জাতীয় সম্পদ ও সুবিধাদির সুষম বন্টন নিশ্চিত করা।
এ ধরণের কৌশল এবং পরিকল্পনা সব সমস্যার সমাধান অবশ্যই ছিল না, কিন্তু এর ফলে আশা করা যেত জাতীয় রাজনৈতিক অবকাঠামোতে বর্জনের পরিবর্তে ঐক্যের মাধ্যমে বহুজাতিক দেশের অখন্ডতা বজিয়ে রাখা।
ধারণা করা চলে, ন্যায্য অধিকার পাবার জন্য বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার জনগোষ্ঠি কিছুকাল হয়তো বা প্রলম্বিত শিল্পায়নের পরিকল্পনা এবং স্তিমিত আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াকেও মেনে নিত। যে কোন ব্যক্তির পক্ষে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজে দরিদ্র হয়ে থাকাটা সহনীয় হয় তখনই যখন তার পড়শীরা সমাজে অর্জিত ধন-সম্পদের বড়াই করার সুযোগ না পায়। একটি দেশ উন্নত হতে পারে শুধুমাত্র ঐক্যের ভিত্তিতে। বৈষম্য এবং বিভক্তি এক অথবা একাধিক জাতিগত রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠিরই হয় সমূহ ক্ষতি।
এ জন্যই বহুজাতিক একটি দেশের এলিট শ্রেণীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা অপরিহার্য হয়ে দাড়ায় শ্রেণী স্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ দু’টোই বজিয়ে রাখার জন্য। কোন এক বিশেষ পর্যায়ে তারা অবশ্যই নিজ নিজ জাতি স্বার্থে একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন। কিন্ত কোনক্রমেই তাদের একে অপরের সহ্যশক্তি ও বোঝাপড়ার ক্ষমতার প্রতি সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়। তেমনটি হলে বিচ্ছিন্নবাদের বিপদসংকুল একতরফা রাস্তা অবশ্যই খুলে যাবে।
তথাকথিত ইসলাম ও ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্বজাধারী পাঞ্জাবী-মোহাজের নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকার শুরু থেকেই বাঙ্গালীদের নিঃস্ব, হীনমনা এবং পশ্চাদমূখী জনগোষ্ঠি হিসাবে গন্য করে আসছিলেন। তারা মনে করতেন বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি পশ্চিম পাকিস্তানের উপর একটি বোঝাস্বরূপ। তারা বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে বাঙ্গালীর জাতিগত চেতনা এবং তাদের হিন্দুয়ানী মনোভাব সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
যাই হোক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে আইয়ূব খানের প্রণীত অর্থনীতির ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প উদ্যোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঐ সমস্ত উদীয়মান শিল্প উদ্যোগীরা সরকারি মদদ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠা পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ যারা আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তাদের সাথে হাত মেলান। সমস্তস বাঙ্গালী শিল্পপতিরা ইম্পোর্ট লাইসেন্স এবং বৈদেশিক মুদ্রার কোটা বাড়াবার জন্য ঐ আন্দোলনকে কেন্দ্রের উপর চাপ প্রয়োগকারী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন। শেষ পর্যায়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি বাঙ্গালী জাতির বিভিন্ন শ্রেণীকে একক একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী এলিট শাসক শ্রেণী অসঙ্গতভাবে তাদের বাঙ্গালী দোসরদের হীনমন্য, পশ্চাদমূখী এবং হিন্দু মনোভাবাপন্ন বলে চিহ্নিত করেন। এই ধরণের মনোভাব বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনার উম্মেষ ঘটাতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। তদপুরি শেখ মুজিবের বিচার দেশের নাজুক ঐক্যের উপর হানে চরম আঘাত। এখানে আবারও উল্লেখ করতে হয় মুজিবের ৬ দফায় কোন নতুন কিছু ছিল না। অতীতে বহুবার এ ধরণের দাবিসমূহ বাঙ্গালী সাংসদগন কেন্দ্রীয় সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্রের ঘোষণার সময়টি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ন। এ ঘোষণাটি করা হয় এমন এক সময় যখন সারা দেশ জুড়ে এক জটিল রাজনৈতিক সমস্যা বিরাজমান। দেশ জুড়ে জনগণ তখন আইয়ূব শাহীর নিষ্পেষন এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
আইয়ূব শাহী আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের কোন প্রচেষ্টাতো করেইনি বরং পাঞ্জাবী-মোহাজের এলিট শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থকে লালন করে তাদের আধিপত্যকে আরো সুসংহত করে তোলে। সামরিক শাসনকালে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বাঙ্গালীদের প্রতিনিধিত্ব একরকম ছিলনা বললেই চলে। ষাটের দশকে যখন বাঙ্গালীদের ধৈর্য্যের বাধঁ প্রায় ভেঙ্গে পড়ছিল ঠিক তখনই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠি কর্তৃক বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিশ্বাসঘাতক এবং শত্রুশক্তি ভারতের দালাল হিসাবে আখ্যায়িত করার ফলে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। বাংলাভাষী জনগণ যারা দ্ব্যার্থহীনভাবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন তারা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠির কাছ থেকে এ ধরণের ব্যবহার কখনোই প্রত্যাশা করেনি। পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। এ সত্যটিই অতি সহজে ভুলে গিয়েছিলেন পশ্চিমা শাসকগন। যদিও বাহ্যিকভাবে মুজিবের দাবিগুলো ছিল চরম প্রকৃতির। পাকিস্তান তখনও ছিল অতিপ্রিয় প্রতিটি বাঙ্গালীর কাছে। বাঙ্গালী জনগণ শুধু চেয়েছিল রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মত প্রকাশের ন্যায্য অধিকার। তারা চেয়েছিল সাম্য ও সংহতির উপর একটি রাজনৈতিক কাঠামো।
তারা চাইছিল স্বৈরাচারী একনায়কত্বের পরিবর্তে একটি গণতান্ত্রিক সরকার। স্বৈরাচারী একনায়কত্ব তাদের অতীতের হিন্দু আধিপত্য ও অত্যাচার এবং ঔপনিবেশিক শোষণকেই জোরালোভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিল। এ থেকে এটাই পরিষ্কারভাবে বলা চলে, বাঙ্গালীরা সুচিন্তিত কতগুলো লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্যই মূলতঃ সংগ্রাম করছিল। কোন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করার জন্য নয়। এটা জোর দিয়েই বলা চলে যে, আইয়ূব শাহীর পতনকালে পূর্ব পাকিস্তনের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াটা মোটেই অবধারিত পরিণতি ছিল না। জাতীয় রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে বাঙ্গালীদের অংশদারিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে ক্ষমতাধর শাসকচক্র বাঙ্গালী এলিট শ্রেণীকে জনগণের আন্দোলনের প্রতিই ঠেলে দিয়েছিল এবং তাদের নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈষম্যকে পুর্নঃজীবিত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে বাধ্য করেছিল জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে। এ থেকে পরিশেষে এটাই বলা চলে যে অসম উন্নয়নই বাধ্য করেছিল বাঙ্গালী এলিট শ্রেণীকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার পরিবর্তে বাঙ্গালীত্বকে উস্কে দিতে।
বাঙ্গালীত্বের চেতনাই তখন আঠারমত বাঙ্গালী এলিট শ্রেণীকে জনগণের সাথে এক অটুট বন্ধনে বেধেঁছিল। অসম উন্নয়ন, শোষণ, বঞ্চনা, এবং নৃতাত্ত্বিক চেতনা ঐ ধরণের লোভী জোঁক যা একে অপরকে শুষে বেচে থাকে সেই সময় অব্দি যখন সশস্ত্র সংঘাত অথবা গণঅভ্যুত্থানের বিকল্প কোন পথই খোলা থাকে না। দুঃখজনক হলেও সত্য পাকিস্তানও ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে পৌঁছে অপরিহার্য এক মহা বিপর্যয়ের অপেক্ষা করছিল ষাটের দশকের শেষে। অন্তিম অবস্থায় সামরিক জান্তা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান বন্দুকের জোরে করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয় ২৫-২৬শে মার্চ ১৯৭১ এর আর্মি ক্র্যাকডাউন। পাকিস্তান সেনা বাহিনী বাঙ্গালীদের আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য বর্বরোচিত সশস্ত্র অভিযান শুরু করে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে। এভাবেই অনিবার্য হয়ে উঠে দেশ বিভক্তি।
পাকিস্তান ১৯৪৭ – ১৯৭১
১৯৭১ এর মুক্তি সংগ্রাম পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহ।
পাকিস্তানের গঠন প্রকৃতিটিই ছিল কিছুটা অস্বাভাবিক। ভৌগোলিকভাবে এই দেশের দুই অংশের মধ্যে ১০০০ মাইল এর ব্যবধান সৃষ্টি করে রেখেছিল ভারত। ণূ-তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ভাষা এবং আর্থ-সামাজিক দিক দিয়েও এই দুই অংশের মাঝে ছিল বড় ধরনের ব্যবধান৷ এই সমস্ত ব্যবধানগুলো ক্রমশঃ বেড়ে যায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠিদের ছলে-বলে, কৌশলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নীতি গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠি তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি অন্যায়ভাবে গায়ের জোরে অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চায় যাতে করে রাজনৈতিকভাবে পুরো দেশের উপর তাদের প্রাধান্য বজিয়ে রাখা সম্ভব হয় এবং অর্থনৈতিকভাবে শোষণ কায়েম রাখা যায়।
পাকিস্তান সৃষ্টির জন্মলগ্নেই সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে যখন ১৯৪৮ সালে জনাব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গর্ভণর জেনারেল হিসেবে ঢাকায় এক জনসভায় ঘোষণা দেন উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ জানানো হয় বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠির পক্ষ থেকে যা পরবর্তিকালে জাতীয়তাবাদী চেতনার উম্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। এরপর ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় রক্তের বিনিময়ে পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার দৃঢ়তা ব্যক্ত করেন। যার ফলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ইউনাইটেড ফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। কিন্তু কেন্দ্রের ক্ষমতাসীনরা এদের হাতে ক্ষমতা দিতে নারাজ হয়ে নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা চালায়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। একের পর এক সরকারের পতন ঘটানোর তামাশা শুরু করা হয় অতি চতুরতার সাথে; যার অজুহাতে পরে ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ূব খান ক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন।
ষাটের দশকের ঘটনাবলী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হয় যে, পূর্ণ সায়ত্ব শাসন অর্জন করা ছাড়া আর অন্যকোন উপায়েই তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্টা করতে পারবে না। সবক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের উপর চলতে থাকে বৈষম্যমূলক আচরণ এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠিদের অবারিত শোষণের ফলে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের পশ্চাদভূমি হিসেবে দেউলিয়া হয়ে পরে পূর্ব পাকিস্তান।
১৯৬১-৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রচন্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
১৯৬৬ সালে সায়ত্বশাসন এবং ন্যায্য অধিকার অর্জন করার জন্য শেখ মুজিবর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ তাদের ৬ দফা প্রোগাম পেশ করে। এতে জাতীয়তাবাদী চেতনায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের অবকাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ সায়ত্বশাসনের অধিকার আদায়ের দাবি। এতে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠি আতংকিত হয়ে উঠে শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাথে জড়িত কর দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবন্দী করে। কিন্তু বাংলাদেশের সিংহপুরুষ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সারা দেশব্যাপী এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন যার ফলে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আইয়ূব সরকার তাকে ও তার সহকর্মীদের বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মার্চ মাসে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশেই আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের চাপে জেনারেল আইয়ূব ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচন করান। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কেন্দ্র এবং প্রাদেশিক সরকার গঠনের দাবিদার হয়ে উঠে। কিন্তু সামরিক জান্তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধূর্ত রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টোর যোগসাজসে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফন্দি-ফিকির করতে থাকেন। তাদের এ ধরনের কুটকৌশলের জবাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে ১৯৭১ এর ৩রা মার্চ থেকে। ২রা মার্চ পূর্ব বাংলার ছাত্র ও যুব সমাজের পক্ষ থেকে আসম আব্দুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তার এই উদ্যোগের জন্য শেখ মুজিব জনাব রবকে তিরষ্কার করেছিলেন। এর চাক্ষুষ সাক্ষী আজো অনেকেই বেচেঁ আছেন। ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শাহজাহান সিরাজ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করেন শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে। অপ্রত্যাশিত এই ঘটনার ফলে শেখ মুজিব ক্ষুদ্ধ হন এবং সভাশেষে শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘোষিত হয়েছিল সভাশেষে গণমিছিলের নেতৃত্ব দেবেন শেখ মুজিব। ৭ই মার্চ রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রে তার বহুল প্রচারিত বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম- আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।” কিন্তু বক্তৃতা শেষ করার সময় তিনি ঘোষণা দেন, “জয় বাংলা, জয় পাঞ্জাব, জয় সিন্ধু, জয় বেলুচিস্তান, জয় সীমান্ত প্রদেশ এবং জয় পাকিস্তান।” তার ঐ বক্তৃতা পরদিন সবক’টি দৈনিক পত্রিকাতেই ছাপানো হয়। অবশেষে ক্ষমতা হস্তান্তরের সব আলোচনাই যখন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল তখন সামরিক জান্তা অস্ত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের উপর ২৫-২৬শে মার্চ ১৯৭১ এর কালোরাতে। চালানো হয় পাশবিক শ্বেত সন্ত্ৰাস।
ছয় দফা
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ম্যানিফেষ্টো।
ছয় দফাঃ
১। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে। তাহাতে পার্লামেন্ট পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে। সংশোধিতঃ সরকারের চরিত্র হবে ফেডারেল এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক। জাতীয় এবং ফেডারেটিং ইউনিটসমূহতে প্রত্যক্ষ গণভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হবে। জনসংখ্যার অনুপাতে ফেডারেল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা হবে।
২। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র দুইটি বিষয় থাকিবে। প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট বিষয়সমূহ স্টেট বা প্রদেশসমূহের হাতে থাকিবে।
৩। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দুইটি পৃথক অথচ বিনিময় যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। অথবা দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে। শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকিবে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হইতে পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে।
সংশোধিতঃ ফেডারেল সরকার শুধুমাত্র পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং নিম্নে বর্ণিত শর্তসাপেক্ষে মুদ্রা সম্পর্কিত বিষয়াদির জন্য দায়ী থাকিবেন। বিষয়গুলো হলঃ –
(ক) দুই উইং এর জন্য দুইটি ভিন্ন কিন্তু পরিবর্তনশীল মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে হইবে
অথবা
১. সারা দেশের জন্য একটি মুদ্রা ব্যবস্থাও রাখা যাইতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আইন প্রবর্তন করিতে হবে যাতে করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ ও অর্থ পাচাঁর হইতে না পারে।
(খ) আলাদা ব্যাংকিং রিজার্ভ সৃষ্টি করিতে হইবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য; আলাদাভাবে আর্থিক এবং আয়-ব্যয় এবং হিসাব-নিকাশের ক্ষমতা থাকিবে পূর্ব পাকিস্তানের।
১. দুইটি ভিন্ন কিন্তু পরিবর্তশীল মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন করা প্রতিটি অংশে কিংবা অঞ্চলের জন্য অথবা একটি মুদ্রা ব্যবস্থাই চালু থাকিবে তবে কেন্দ্রিয় রিজার্ভ ব্যাংকিং সিষ্টেমের ভিতর আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক সৃষ্টি করিতে হইবে এবং এমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করিতে হইবে যাতে এক অঞ্চলের সম্পদ কিংবা অর্থ অন্য অঞ্চলে পাচাঁর করা সম্ভব না হয়।
৪। সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ধার্য্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত রেভিনিউর একটি অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের মূলধন হইবে।
সংশোধিতঃ আর্থিক লেনদেন, আয়-ব্যয় : এবং পরিকল্পনা হইবে ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর। ফেডারেটিং ইউনিটগুলো কেন্দ্রিয় সরকারকে বরাদ্দকৃত অর্থের যোগান দিবে প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকান্ডের জন্য। দেশের সংবিধানে নির্ধারিত বরাদ্দ আয় কেন্দ্র পাইবে যথাযথভাবে নির্ধারিত অনুপাতে। সংবিধানে এমন বিধান নির্ধারন করা হইবে যাতে কেন্দ্রিয় সরকার ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ পায় যাতে করে ফেডারেল ইউনিটগুলোর আয়-ব্যয় সংক্রান্ত নীতিগুলোর উপর ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রন রক্ষা করা সম্ভব হয়।
৫। দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আদায়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে। এইসব অর্থ আঞ্চলিক সরকারের এখতিয়ারে থাকিবে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল সমানভাবে দিবে অথবা সংবিধানের নির্ধারিত হারে আদায় হইবে। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি-রপ্তানীর অধিকার আঞ্চলিক সরকারের থাকিবে।
সংশোধিত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সব হিসাব প্রতিটি ফেডারেটিং ইউনিটের নিয়ন্ত্রনে পৃথক পৃথক ভাবে রাখার বিধান সংবিধানে রাখা হইবে। কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিটি ফেডারেটিং ইউনিট কি অনুপাতে প্রদান করে সেটা সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত থাকিবে। দেশের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারনের দায়িত্ব হবে কেন্দ্রিয় সরকারের। কিন্তু সেই নীতির আওতায় আঞ্চলিক সরকারগুলো বর্হিবাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে সরাসরি আলোচনা এবং চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে সেই বিধানও সংবিধানে থাকতে হইবে।
৬। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠন করা হইবে এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মনির্ভরশীল করিতে হইবে। সংশোধিতঃ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ফেডারেটিং ইউনিটগুলো নিজস্ব মিলিশিয়া অথবা প্যারামিলিটারী ফোর্স গঠন করিতে পারিবে।
পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারনের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটেছিল ৬ দফায়। ৬ দফার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল কিভাবে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছিল। যাই হউক তবুও বলতে হয় ৬ দফার ঘোষণার সময়টা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পরই ৬ দফা ঘোষিত হয়। সামরিক চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা পাকিস্তান সরকারের মনঃপুত ছিল না। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান আমেরিকান সরকারকে তার অসন্তুষ্টি জানিয়েছিল তাই নয়; বিকল্প উপায় হিসেবে আইয়ূব খান আমেরিকার শত্রু গণচীনের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
তার এই উদ্যোগকে আমেরিকান সরকার তাদের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করে। তাই আইয়ুবের ঔদ্ধত্বের উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য আমেরিকা আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা দিতে থাকে। এই চক্রান্তে মদদ যোগাবার জন্য যারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বিদগ্ধ হারুণ পরিবারের আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর ভাতাপ্রাপ্ত সদস্য শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম। ঐ চক্রান্তের ফসল হিসেবেই বেরিয়ে আসে ৬ দফা। যদিও বলা হয়ে থাকে বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবি এবং অর্থনীতিবিদ যথা: ডঃ কামাল হোসেন, ডঃ রেহমান সোবহান, ডঃ নুরুল ইসলাম, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখরাই ছিলেন ৬ দফার জন্মদাতা। কিন্তু যে সত্যটি কখনোই প্রকাশ করা হয়নি সেটা হলো ৬ দফা প্রণয়নে আমেরিকার কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ফোর্ড ফাউন্ডেশনের মদদপুষ্ট হয়ে এই ৬ দফা দাবি প্রণয়নে কাজ করেছিলেন। ৬ দফা পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার জন্য নয় শুধুমাত্র আইয়ূব খানকে তার বেয়াদবীর উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যই প্রণিত হয়েছিল। পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করতে কখনো কাউকে কোনরূপ সাহায্য আমেরিকা করেনি কারণ তারা কখনোই পাকিস্তান দ্বি-খন্ডিত হোক সেটা চায়নি। এ ব্যাপারে তৎকালীন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জে ফারল্যান্ড পরিষ্কারভাবে মুজিবকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক অবমৃশ্যতা থেকে একচ্ছত্র নেতায় পরিণতঃ
৬ দফা দাবির বর্হিপ্রকাশ ঘটার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিবের ভূমিকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
১৯৫৪ সালে রাজনীতিতে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটিয়ে মুজিব আকষ্মিকভাবে রাজনীতিতে আলোচ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের সংসদ অধিবেশন চলাকালে হঠাৎ করে শেখ মুজিব তার গুন্ডাপান্ডা নিয়ে অতর্কিতে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করে হৈ চৈ শুরু করে লাঠিবাজী এবং চেয়ার-টেবিল ছোড়াছুড়ি করে অধিবেশন পন্ড করে দেয়। ঐ তান্ডবলীলায় সংসদের স্পীকার মারা যান গুরুতররূপে আহত হয়ে। এই অপকর্মের নেপথ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ছিল। এই ঘটনা পরবর্তিকালে আইয়ূব খানকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার বিলুপ্ত করে সামরিক শাসন জারি করতে সুযোগ করে দেয়। ৬ দফায় কেন্দ্রিয় সরকার দেশদ্রোহিতার গন্ধ পায়। তাদের ধারনা হয় ৬ দফা দেশকে দ্বি-খন্ডিত করারই একটা কুটকৌশল। যদিও ৬ দফা ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির সনদপত্র। ৬ দফায় পরবর্তিকালে বর্ণিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রিয় শাসকদের দ্বারা কী ধরনের শোষণ চালানো হচ্ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। যা হোক, শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের বেশকিছু শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জড়িত করা হয় বিখ্যাত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়’; যদিও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব কিংবা তার দলীয় নেতারা কেউই জড়িত ছিলেন না। নেতাদের গ্রেফতারের ফলে ৬ দফা আন্দোলনে ভাটা পড়ে। সেই ক্রান্তিলগ্নে আবারও অগ্রণীর ভূমিকায় এগিয়ে আসে জাগ্রত ছাত্রসমাজ। বাংলার সিংহপুরুষ মাওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় তারা গঠন করেছিল ‘ইউনাইটেড এ্যাকশান কমিটি’ এবং এর নেতৃত্বে ১১ দফার আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তুলে দেশব্যাপী এক দুর্বার গণআন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করেছিল। ১১ দফা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল কারণ এর মূল বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধিকার ও স্বায়ত্বশাসনের দাবি। সারা পূর্ব পাকিস্তানে ১১ দফাকে কেন্দ্র করে সরকার বিরোধী আন্দোলনের যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রচন্ডতায় ম্লান হয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের ৬ দফা। মাওলানা ভাসানী এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার জন্য সামরিক শাসকরা শেখ মুজিব এবং তার দলীয় নেতাদের বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি পেয়ে রেসকোর্সে এক বিশাল জনসভায় মুজিব তার ভাষণে বলেছিলেন, “জেল থেকে মুক্তি পাবার পর আমি দেখলাম আওয়ামী লীগের ৬ দফা ছাত্রদের ১১ দফায় বিলীন হয়ে গেছে।”
জনগণের চাপে মুক্ত হয়ে মুজিব নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন। তিনি নিজেকে পেলেন সমগ্র বাংলাদেশী জনগণের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে। কিন্তু এমনটি হওয়ার পেছনে তার নিজস্ব কোন অবদান ছিল না। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে নেতারা সবাই সবকালে চলেছেন পেছনে কিন্তু জনগণ কখনোই কোন ক্রান্তিলগ্নে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। এটা এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা যার আবর্তে জাতি আজও ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই সময় জাতি উন্মুখ হয়ে উঠেছিল স্বাধিকার ও সায়ত্বশাসন পাওয়ার জন্য। তারা হয়ে উঠেছিল অস্থির, ধৈর্যহারা এবং বিষ্ফোরম্মুখ। কিন্তু তাদের প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করার মত আস্থাভাজন কোন জাতীয় নেতা ছিল না সামনে। বিষ্ফোরন্মুখ জাতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নিঃস্বার্থ চরিত্রের পরিক্ষিত একজন বিচক্ষণ নেতার প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল বিকল্পহীন। মাওলানা ভাসানী ছিলেন তেমন মাপের একমাত্র নেতা। কিন্তু বয়সের ভারে তিনি তখন অনেকটাই দুর্বল। নেতা হিসেবে তাকে জনগণ অবশ্যই জেনে এসেছে আপোষহীন বৃহত্তর গরীব জনগোষ্ঠির বন্ধু হিসেবে। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞতারও অভাব ছিল না। কিন্তু তার ছিল না সংগঠনভিত্তিক শক্তি। এ কারণেই এই বর্ষিয়ান নেতার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না গণআন্দোলনের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আন্দোলনকে ক্রমান্বয়ে বিপ্লবে রূপান্তরিত করে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে চরম বিজয় অর্জন করা তার পক্ষে শ্রদ্ধার ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেও এটা কার্যকরী করা তখন তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দৈবক্রমে শেখ মুজিবকে রাতারাতি এক কিংবদন্তির নায়কে পরিণত করেছিল। ভাসানীর সক্ষমতার মাওলানা নিজেই সবচেয়ে বেশি বুঝতেন তাই তারই আহ্বানে দেশের জনগণ মুজিবকেই একচ্ছত্র নেতা হিসেবে তখন গ্রহণ করে নিয়েছিল একান্ত বাধ্য হয়ে কোন বিকল্প না থাকায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা করেছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও। কিন্তু শেখ মুজিব কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কথা চিন্তা করেননি । তিনি স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানিয়েছিলেন মাত্ৰ ৷
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ধারা বিবরণী খবরের কাগজে প্রকাশিত করতে থাকে আইয়ূব-মোনেম চক্র। তারা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের ভারত বিরোধী মনোভাবকে তাদের স্বার্থে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, মানুষ যখন জানতে পারবে শেখ মুজিব ভারতের দালাল হয়ে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। কিন্তু পরিণাম হল সম্পূর্ণ উল্টোটাই। প্রকাশিত ধারা বিবরণীর মধ্যেই পরিস্ফুটিত হয়ে উঠল আইয়ূব-মোনেম চক্রের ঘৃণ্য চক্রান্ত। এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলাকে তখন বাঙ্গালীরা সমগ্র বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলেই ধরে নেয়। ফলে সারা বাংলার মানুষ আইয়ূব শাহীর বিরুদ্ধে রুদ্র আক্রোশে ফেটে পড়ল। এখানে আবারও উল্লেখ করতে হয় যে, আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানেও মুখ্য এবং অগ্রণী ভূমিকা ছিল ছাত্র সমাজের। তারা ইতিমধ্যেই সংগ্রামকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সংগ্রামে রূপ দেবার লক্ষ্যে ১১ দফার ভিত্তিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১১ দফার ভেতরেই বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রকৃত রূপ ফুটে উঠে। ১১ দফার ভিত্তিতেই বাংলার মাটিতে ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের জোয়ার এক প্রচন্ড রূপ ধারণ করে।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবিঃ
স্বৈরাচারী সরকারের দীর্ঘ দিনের অনুসৃত জনস্বার্থ বিরোধী নীতির ফলেই ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর জীবনে সংকট ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেছে। শাসন শোষনের নিপীড়নে অতিষ্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিয়াছেন। আমরা ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে নিম্নোক্ত ১১ দফা দাবিতে ব্যাপক ছাত্র গণআন্দোলনের আহ্বান জানাইতেছি –
১।
(ক) স্বচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং জগন্নাথ কলেজসহ প্রাদেশিকরণকৃত কলেজসমূহকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিতে হইবে।
(খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ স্থাপন করিতে হইবে এবং বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজসমূহকে সত্বর অনুমোদন দিতে হইবে। কারিগরী শিক্ষার প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে।
(গ) প্রদেশের কলেজসমূহে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আইএ, আইএসসি, আইকম ও বিএ, বিএসসি, বিকম এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে নৈশ এমএ ও এমকম ক্লাশ চালু করিতে হইবে।
(ঘ) ছাত্র বেতন শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করিতে হইবে। স্কলারশীপ ও স্টাইপেন্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং ছাত্র আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার অপরাধে স্কলারশীপ ও স্টাইপেন্ড কাড়িয়া লওয়া চলিবে না।
(ঙ) হল, হোস্টেলের ডাইনিং হল ও কেন্টিন খরচার ৫০ ভাগ সরকারি সাবসিডি হিসাবে প্রদান করিতে হইবে।
(চ) হল ও হোস্টেলের সমস্যা সমাধান করিতে হইবে।
(ছ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হইবে।
(জ) অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে।
(ঝ) মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে এবং অটোমেশন প্রথা বিলোপ, নমিনেশনে ভর্তি প্রথা বন্ধ, মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স বাতিল, ডেন্টাল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ কলেজে পরিণত করা প্রভৃতি মেডিকেল ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে। নার্স ছাত্রীদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
(ঞ) প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলোপ ১০% ও ৭৫% রুল বাতিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সুব্যবস্থা, প্রকৌশল ছাত্রদের শেষ বর্ষেও ক্লাশ লইতে হইবে।
(ট) পলিটেকনিক ছাত্রদের কন্ডেন্স কোর্সের সুযোগ দিতে হইবে এবং বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা বাতিল করিয়া একমাত্র সেমিষ্টার পরীক্ষার ভিত্তিতেই ডিপ্লোমা দিতে হইবে।
(ঠ) টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার টেকনোলজি এবং আর্ট কলেজ ছাত্রদের সকল দাবি অবিলম্বে মানিয়া লইতে হইবে। আইইআর ছাত্রদের ১০ দফা, সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্রদের, এমবিএ ছাত্রদের, ও আইন ছাত্রদের সমস্ত দাবি মানিয়া লইতে হইবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে আলাদা ফ্যাকাল্টি করিতে হইবে।
(ড) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানিয়া লইতে হইবে। কৃষি ডিপ্লোমা ছাত্রদের কন্ডেন্স কোর্সের দাবিসহ কৃষি ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
(ঢ) ট্রেনে, স্টীমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের আইডেন্টিটি কার্ড দেখাইয়া শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেসনে টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকেটেও এইরূপ সুবিধা দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোন স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলেও বাস যাতায়াতে ৫০% কন্সেসন দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুলে ও কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের ৫০% কন্সেসন দিতে হইবে।
(ণ) চাকুরীর নিশ্চয়তা বিধান করিতে হইবে।
(ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ন বাতিল করিতে হইবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্বশাসন দিতে হইবে।
(থ) শাসক গোষ্ঠির শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামান্য দলিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট সম্পূর্ন বাতিল এবং ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হবে।
২। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
৩। নিম্নলিখিত দাবিসমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পুর্ন স্বায়ত্বশাসন দিতে হইবে।
(ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ। এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।
(খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়েকটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।
(গ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতির প্রবর্তন করিতে হইবে।
(ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর ধার্য করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সংগে সংগে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে।
(ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বর্হিবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিবে এবং বর্হিবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারাধীন থাকিবে।
(চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মান ও নৌ বাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করিতে হইবে।
৪। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্বশাসন প্রদানকরতঃ সাব ফেডারেশন গঠন।
৫। ব্যাংক, বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহৎ ভারী শিল্প জাতীয়করন করিতে হইবে।
৬। কৃষকদের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋন মওকুফ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মনপ্রতি ৪০ টাকা নির্ধারন ও আখের ন্যায্যমূল্য দিতে হইবে।
৭। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী ও বোনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কায়দা-কানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে হইবে।
৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রন ও জন সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৯। জরুরী আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা ও আন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।
১০। সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোট বর্হিভূত স্বাধীন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি কায়েম করিতে হইবে।
১১। দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারী পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে ।
ইতিহাস বিকৃতির প্রথম পদক্ষেপ আওয়ামী লীগই গ্রহণ করে
শেখ মুজিবের নির্দেশেই মেজর জিয়া তার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেয় এ দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ আষাঢ়ে গল্পের উপস্থাপন করে।
সেই লোমহর্ষক ক্রান্তিলগ্নে নেমে আসে ২৫-২৬শে মার্চের সেই কালোরাত্রি। পাকিস্তান সেনা বাহিনী নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙ্গালী জাতিকে শায়েস্তা করার জন্য। ২৫শে মার্চের বর্বরতা আধুনিককালের সব নজীরকেই ছাড়িয়ে যায়। হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশুকে হত্যা করা হয় নির্বিচারে। সামরিক বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বাঙ্গালী সদস্যগণও রেহাই পাননি শ্বেত সন্ত্রাসের হত্যাযজ্ঞ থেকে। ঢাকা, চিটাগাং এবং খুলনাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্রই অভিযান চালানো হয়। নিষ্ঠুর অভিযান। প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হয় বাঙ্গালী জাতি। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে অনেক অনুরোধ ও আকুতি জানানো হয় শেখ মুজিবকে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবার জন্য। কিন্তু সব অনুরোধ উপেক্ষা করে জাতিকে মৃত্যু ও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়ে কাপুরুষের মতই তিনি কারাবরণ করে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। আত্মরক্ষার জন্যই অনন্যোপায় হয়েই শান্তিপ্রিয় বাঙ্গালী অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দানে অসম্মত শেখ মুজিব বলেছিলেন, “আমি গণতন্ত্রের রাজনীতি সারাজীবন করেছি, অস্ত্রের রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না।”
এ কি পরিহাস! সমগ্র বাঙ্গালী জাতি যার কথায় বিশ্বাস করে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, তাকে মেনে নিয়েছে একমাত্র নেতা হিসাবে; দীর্ঘ সংগ্রামে চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে নির্দ্বিধায়; সে নেতাই ক্রান্তিলগ্নে জাতিকে পিছে ফেলে রেখে খোঁড়া যুক্তি তুলে বহাল তবিয়তে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমালেন। ক্ষনিকের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল বাঙ্গালী জাতি। মুজিবের সুবিধাবাদী আচরনে হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছিল মুক্তিকামী জনতা। কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য মাত্র। আওয়ামী লীগের নেতারাও সব যার যার মত গা ঢাকা দিলেন প্রাণ বাচাঁবার প্রচেষ্টায়। মুজিব গ্রেফতার হওয়ার সাথে তারাও পালিয়ে হাফ ছেড়ে বাচঁলেন। এ অবস্থায় জনগণকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রতিরোধ সংগ্রামের দায়িত্ব নিজেদের হাতেই তুলে নিতে হয়েছিল। বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠে। গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশে। এ অবস্থায় ২৬শে মার্চ রাতে চিটাগাং এ অবস্থিত অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক অখ্যাত তরুণ মেজর জিয়াউর রহমান তার তরুণ বাঙ্গালী সহকর্মীদের পরামর্শ ও সহচার্যে তীব্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বেতার মাধ্যমে জাতির প্রতি আহ্বান জানান স্বাধীনতা সংগ্রামের। তার আহ্বানে আশার আলো দেখতে পেয়েছিল জাতি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তিকালে স্বাধীনতার লক্ষ্যে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তি সংগ্রাম।
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসে মেজর জিয়াউর রহমানের ক্ষীন কন্ঠ, “Under circumstances however, I hereby declare myself as the Provisional Head of the Swadhin Bangla Liberation Government.” অবশ্য পরবর্তী ঘোষণায় এর সাথে যোগ করা হয়, “Under guidance of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman.” স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সেই সময় চুলচেরা বিশ্লেষন করার ফুরসৎ কারও ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা সর্ম্পকে সরকার ও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে পর্যায়ক্রমে কয়েকটি কাহিনী প্রচার করা হয়।
প্রথম গল্পটি ছিলঃ ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে গ্রেফতারের পূর্বক্ষণে চট্টগ্রামের জহুর আমদ চৌধুরীকে টেলিফোনে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীটি পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু সামরিক অভিযানের প্রাক্কালে সকল প্রকার টেলিফোন যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অতএব ঐ গল্প ধোপে টিকেনি।
দ্বিতীয় গল্পে বলা হয়ঃ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে (?) চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থানরত একটি অষ্ট্রেলিয় জাহাজের ক্যাপ্টেনকে স্বাধীনতার ঘোষণা জানানো হয়। ঐ ক্যাপ্টেন নাকি জনাব জহুর আহমদকে শেখ মুজিবের সেই ঘোষণা বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন! চট্টগ্রামের কোন নোঙ্গর করা জাহাজের সাথে ঢাকায় বসে ওয়্যারলেস সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা কোনভাবেই তখন সম্ভব ছিল না। কারণ ঐ সময় চট্টগ্রাম বন্দরে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈনিকদের সাথে পাক বাহিনীর লড়াই চলছিল। তাছাড়া ঢাকার ওয়্যারলেস সেন্টারসহ সবগুলো যোগাযোগ কেন্দ্র তখন পুরো মাত্রায় খানসেনাদের অধিনে। সুতরাং এ গল্পও সারহীন প্রমানিত হয়।
শেষ গল্পে বলা হয়ঃ চট্টগ্রাম ইপিআর-কে জানানো হয়েছিল সারা দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা বা ‘স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস’ নামক প্রকাশনায় এই কাহিনীটিই নথিবদ্ধ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ইপিআর-কে জানানো হয়েছিল সারা দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা বা ‘স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস’ নামক প্রকাশনায় এই কাহিনীটিই নথিবদ্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু একটুখানি যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষন করলেই বুঝা যায় এ কাহিনীটিও আষাঢ়ে গল্প মাত্র। প্রথমতঃ ঢাকার সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যথাঃ- টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, ঢাকা বেতার, ওয়্যারলেস সমস্তই তখন সম্পূর্ণরূপে পাক বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে। এবার দেখা যাক ঢাকা ইপিআর এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম ইপিআর-কে নির্দেশ পাঠানোর প্রশ্নটি। ঢাকা ইপিআর যদি শেখ মুজিবের নির্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম পৌঁছাতে পারে তাহলে ঢাকা ইপিআর- থেকেইতো সারা বাংলাদেশে ঐ ঘোষণা প্রচার করার জন্য বলা যেত! তাছাড়া সবারই জানা ছিল ঢাকা ইপিআর-এর হেডকোয়ার্টার এবং পিলখানা সিগন্যাল সেন্টার ২৩শে মার্চেই আমি দখল করে নিয়েছিল। তারপরও কথা থাকে। চট্টগ্রামের ইপিআর-এর দায়িত্বে ছিলেন তখন বাঙ্গালী তরুণ অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। যে সমস্ত বাঙ্গালী অফিসারদের সাথে একত্র হয়ে মেজর জিয়াউর রহমান ২৬শে মার্চ রাতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন রফিক ছিলেন অন্যতম। পরবর্তী পর্যায়ে ১নং সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতার পর তাকে হঠাৎ করে সেনা বাহিনী থেকে অবসর দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের উপর ক্যাপ্টেন রফিক একাধিক গ্রন্থ লিখেছেন। কিন্তু কোথাও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী ঢাকা থেকে পাবার ব্যাপারে কিছু লেখেননি। কেন? সর্বোপরি স্বাধীনতার ঘোষণা সত্যি সত্যি ঢাকা থেকে পাঠানো হয়ে থাকতো সেই ক্ষেত্রে মেজর জিয়া তার প্রথম ভাষণে নিজেকে অস্থায়ী সরকার প্রধান হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন কোন যুক্তিতে? তারপরও প্রশ্ন থাকে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তৎকালীন আরেক নেতা আবদুল হান্নান যিনি ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকবার বক্তব্য প্রচার করেছেন, তিনিই বা কেন তার প্রচারণায় একবারও উল্লেখ করলেন না স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী ঢাকা থেকে পাবার কথা? অতএব, ২৬শে মার্চ মেজর জিয়াই যে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এই ধ্রুব সত্যকে শত চেষ্টা করেও কোন যুক্তি দিয়েই খন্ডানো সম্ভব নয়।
মহা পলায়ন
লেঃ মতি, সেকেন্ড লেঃ নূর এবং আমি সর্বপ্রথম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি।
জাতীয় রাজনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমি তখন কোয়েটায় ১৬ ডিভিশনের ৬২ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্টে পোস্টেড। আমার আবাস কিংস রোডের আর্টিলারী অফিসার্স মেসে। আমি ছাড়াও তখন কোয়েটাতে বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার বিভিন্ন রেজিমেন্ট ও ব্যাটালিয়নে পোস্টেড ছিলেন। কর্নেল দস্তগীর জিওয়ান ডিভ হেডকোয়ার্টাস, মেজর হাফিজ ৬২ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন শহীদ ৩৩ ক্যেভারলী, ক্যাপ্টেন শরফুল ৩৩ ক্যেভারলী, ক্যাপ্টেন মসীন বেলুচ রেজিমেন্ট, মেজর মালেক বি এম, মেজর কাদের ইঞ্জিনিয়ার্স, ক্যাপ্টেন মাওলা ইএমই ব্যাটালিয়ন, ক্যাপ্টেন আমছা আমিন ইনফ্যানট্রি স্কুল, ক্যাপ্টেন জাকের, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন শাফায়াত, লেফটেন্যান্ট হারুণ ২৬ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন ইফতেখার, ক্যাপ্টেন মাজহার উদ্দিন মোল্লা, লেফটেন্যান্ট কে বি ৬৩ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন জামাল এএমসি, ক্যাপ্টেন কাসেম এএসসি প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন বেশ কিছু সংখ্যক জেসিও, এনসিও ও জোয়ান ভাইরা স্কুল অফ ইনফ্যানট্রি এন্ড ট্যাকটিকস, ইএমই ব্যাটালিয়ন, সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন, ডিভ হেডকোয়ার্টাস, ষ্টাফ কলেজ এবং ৩৩ ক্যেভারলী রেজিমেন্টে।
কোয়েটায় বাঙ্গালীদের ছোট পরিবার ছিল একটি সুখী পরিবার। আমরা সবাই মিলেমিশে হাসি আনন্দে কাটাতাম দিনগুলো। প্রায়ই আমরা সমবেত হতাম কোথাও না কোথাও। চলতো আলাপ- আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা, গান-বাজনা, গল্প-গুজব। জাতীয় সংকট আমাদের মাঝের ব্যবধানকে কমিয়ে আনলো আরো। সবাই দেশ সম্পর্কে সচেতন, সবাই শংকিত। ভাবনায় আকুল, কি হচ্ছে? ঘটনা প্রবাহের পরিণাম কি? প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ক্ষমতা লিপ্সা কোথায় নিয়ে যাবে দেশটাকে? পাকিস্তান টিকে থাকবে কি করে? অন্যায়, অবিচার, শাসন-শোষণ শেষ হবে কবে? আইয়ূব খানের প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে সম্পূর্ণরূপে। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তিনি কি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেবেন আলোচনার মাধ্যমে? নাকি ক্ষমতার মোহে দেশকে আরো রসাতলে টেনে নিয়ে যাবেন? গোপনে আমরা মিলিত হই বিভিন্ন জায়গায়। আলোচনার মাধ্যমে খুঁজে পেতে চাই এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব। খবরা-খবরের আদান-প্রদান হয় নিজেদের মধ্যে। প্রতিটি নতুন খবর পর্যালোচনা করি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। খবর পাই দেশ থেকে আসা চিঠিপত্রের মাধ্যমে। মনযোগ দিয়ে শুনি বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, অল ইন্ডিয়া রেডিও, ভয়েস অফ অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি কেন্দ্রের প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলি। জাতীয় রেডিও এবং টিভি মাধ্যমের প্রচারিত খবর একপেশে হওয়ায় বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না৷ মাঝে মধ্যে সিগন্যালস্ সেন্টারের বাঙ্গালী ভাইরা নিয়ে আসে জিএইচকিউ থেকে প্রেরিত গোপন বার্তাসমূহের সারবস্তু। এ থেকে শাসকচক্রের মন মানসিকতা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেটাই বা কতটুকু। পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের প্রতি মুহুর্তের ঘটনাবলী জানার জন্য মন উদগ্রীব হয়ে থাকে তীর্থের কাকের মত। দেড় হাজার মাইল দূরত্বে বসে সীমিত মাধ্যমে ঘটনা প্রবাহের যতটুকু খবরা-খবরই পাচ্ছিলাম, তার চুলচেরা বিশ্লেষন করে অবস্থার সাথে নিজেদের যতটুকু সম্ভব সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করছিলাম আমরা। কিন্ত সবকিছুই করতে হচ্ছিল বিশেষ সতর্কতার সাথে। মনের দাহ ও আক্রোশ অতি কষ্টে চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবে দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলাম সবাই। নিজেদের সংযত রেখে ধৈৰ্য্য সহকারে অবস্থার মোকাবেলা করতে হবে সবাইকে; এ সিদ্ধান্তই গৃহিত হয় গোপন বৈঠকগুলোতে। আশা-নিরাশার এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় কাটছিল আমাদের প্রতিটা মুহুর্ত।
মার্চের ৩০ তারিখে আমরা বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, অল ইন্ডিয়া রেডিও, রেডিও অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি ষ্টেশনগুলো থেকে প্রচারিত নিবন্ধ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটা ২৫-২৬শে মার্চ রাতের ঘটনা ও পরবর্তী দিনগুলোর ঘটনাবলী সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারি। বাংলাদেশে ফেলে আসা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনদের অবস্থা ভেবে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে মন৷ পাকিস্তান সরকার ও সেনা বাহিনীর ন্যাক্কারজনক আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। সেই সেনা বাহিনীতেই চাকুরী করছি বলে নিজের প্রতি আত্মধিক্কার জাগে মনে। ভাবি, এ অবস্থায় প্রবাসে বসে আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই? বাঙ্গালীদের ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের কি কোন দায়িত্বই নেই? সমগ্র বাঙ্গালী জাতির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য আকুল হয়ে উঠে মন। অস্বস্তিকর পরিবেশে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সময় কাটতে থাকে আমাদের।
ইতিমধ্যে আমাদের কোর্সও প্রায় শেষ হচ্ছে। কোর্সে আগত বাঙ্গালী অফিসারদের মধ্যে ক্যাপ্টেন তাহের, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নূর চৌধুরী এবং লেফটেন্যান্ট মতির সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। চিন্ত-ভাবনার মিলই ছিল আমাদের এই ঘনিষ্ঠতার প্রধান কারণ। আমি লোকাল অফিসার। এরা প্রায়ই আমার মেসে আসত। দল বেধে আনন্দ-ফুর্তি করে আমরা অবসর কাটাতাম। একসাথে খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, ক্লাবে আড্ডা মারা ছিল আমাদের বিনোদনের উপায়। লেফটেন্যান্ট সুমিও প্রায়ই আমাদের সাথে যোগ দিত। আমরা একত্রিত হয়ে আনন্দ-ফুর্তি করতাম ঠিকই কিন্তু তার ফাঁকে আলোচনা চলত বাংলাদেশ নিয়ে। সবারই একই চিন্তা। আমাদের কিছু একটা করা উচিত। মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে নির্বিকার হয়ে বসে থাকলে চলবে না। জাতীয় সংগ্রামে আমাদের সাধ্যমত অবদান রাখতে হবে। কিন্তু কি করা সম্ভব! ইতিমধ্যে জানতে পারলাম আমাদের ১৬ ডিভিশনকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হবে। অত্যন্ত সুখবর! ডিভিশন গেলে আমিও ইউনিটের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে পারব। খবরটা পেয়ে তাহের, নূর, মতি এবং সুমি সবাই খুশি। কোর্স শেষ হল। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ আদেশ জারি করলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত কোন অফিসারকে তাদের ইউনিটে ফেরত পাঠানো হবে না। তাদের সবাইকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন ইউনিটে পোষ্টিং দেয়া হবে। এ কি ব্যাপার! এমনটি তো হবার কথা নয়। আমরা সবাই বিভ্রান্ত হয়ে পরলাম। কোর্স শেষে ইউনিটে ফিরে যাওয়াইতো নিয়ম; তাহলে এ ধরণের আদেশের উদ্দেশ্য কি? তাহের, নূর, মতি সবার ইউনিটই পূর্ব পাকিস্তানে। তারা সবাই আটকা পড়ে গেল। আর আমি ফিরে এলাম ইউনিটে। কিন্তু ইউনিটে যোগদান করেই বুঝতে পারলাম অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবেশও অনেক বদলে গেছে। ইতিমধ্যে দেশে ইমারজেন্সী ঘোষিত হল।
একদিন আমার কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মিয়া হাফিজ আমাকে তলব করে পাঠালেন। তার অফিসে যাওয়ার পর তিনি কিছুটা বিব্রতভাবেই বললেন, “শরীফ ব্যাটারি কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমি তোমাকে এ্যাডজুটেন্ট পদে বহাল করতে চাই। দেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে আমার ষ্টাফ অফিসার হিসাবে তোমাকেই আমি মনোনীত করেছি।” তার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার সাথে কর্নেল হাফিজের সম্পর্ক ছিল খুবই ভাল। ব্যাচেলার হ্যাপিগোলাকি টাইপ কমান্ডো কর্নেল হাফিজ আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। আমি তাই সরাসরি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “স্যার আমি ইউনিটে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একজন। সে ক্ষেত্রে আমাকে ব্যাটারি কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিয়ে জুনিয়র পদে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? বেচারা কর্নেল হাফিজ মুখ কাচুমাচু করে বললেন, “দেখ, জিএইচকিউ থেকে অর্ডার এসেছে কোন বাঙ্গালী অফিসারকে দায়িত্বপূর্ন কোন পদে রাখা যাবে না। তাছাড়া বর্তমান অবস্থায় সব বাঙ্গালীদের উপর নজর রাখার নির্দেশও জারি করা হয়েছে। তোমার শুভাকাঙ্খী হিসাবে এই গোপনীয় নির্দেশের কথা তোমাকে বিশ্বাস করে বললাম। আমার অনুরোধ সব বুঝে তুমি চোখ- কান খোলা রেখে সতর্কতার সাথে চলবে। তোমার কোন কিছু হলে ব্যক্তিগতভাবে আমি কষ্ট পাব। বোঝার চেষ্টা কর, নেহায়েত অপারগ হয়েই আমি এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।
তার সিদ্ধান্তে কষ্ট পেলেও তার আন্তরিক স্বীকারোক্তি শুনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। তার সতর্কবাণী সবাইকে জানাবার জন্য ছুটে গেলাম ক্যাপ্টেন তাহেরের মেসে। সেখানে ডেকে পাঠালাম নূর এবং মতিকে। সব শুনে সবাই ঠিক করলাম আমাদের সবকিছুই করতে হবে অতি সাবধানে। পশ্চিমারা আমাদের সব বাঙ্গালীকেই অবিশ্বাসের চোখে দেখছে। তাই এতটুকু অসতর্ক হলে আর রক্ষা নাই। মহাবিপদে পড়তে হতে পারে। সিদ্ধান্ত নিলাম স্বাভাবিকতা বজিয়ে চলতে হবে আমাদেরকে। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে গোপনে মিলিত হব আমরা। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বস্ত লোক ছাড়া অন্য কারো সাথে আলোচনা করা ঠিক হবে না৷ কর্নেল মিয়া হাফিজের সাথে আলাপের পর ঠিক বুঝতে পারলাম ইউনিটের সাথে আমার আর বাংলাদেশে যাওয়া হবে না। ঘটনা প্রবাহ এগিয়ে চলল অতি দ্রুতগতিতে। হঠাৎ করে ডিভিশন হেডকোয়ার্টারসের জিওয়ান বাঙ্গালী অফিসার কর্নেল দস্তগীরকে বদলি করে দেয়া হল জিওয়ান মুজাহিদ কোর হেডকোয়ার্টারস লাহোরে। তার এ বদলিতে আশ্চর্য হয়ে গেল কোয়েটাতে অবস্থিত সব বাঙ্গালী। আমাদের কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল কিন্তু অন্যান্য বাঙ্গালীরা অবাক হয়ে গেল তার এ অস্বাভাবিক পোস্টিং এ। ডিভিশনের বাঙ্গালীরা যারা বাংলাদেশে যাবার আশায় উন্মুখ হয়ে ছিলেন তাদের গুড়ে পড়ল বালি। আমি ও নূর একদিন গেলাম কর্নেল দস্তগীরের বাসায়। তার পরিবার তখন বাংলাদেশে। তাকে বললাম,
– স্যার এরপরও কি আমাদের চুপচাপ বসে থাকা যুক্তিসঙ্গত?
– কি করতে চাও? পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি। আমি বললাম,
– দেশের সংগ্রামে অবদান রাখার চেষ্টা করতে হবে যেভাবেই হোক।
– পাগল হয়েছ? দেড় হাজার মাইল দূরে বসে কি করতে পার তোমরা?
– পালিয়ে গিয়ে যোগদান করতে পারি স্বাধীনতা সংগ্রামে। নয়ত বেলেলির এ্যামুনিশন ডিপো উড়িয়ে দিতে পারি। এতে করে সমস্ত সামরিক বাহিনীর সেকেন্ড লাইন এ্যামুনিশন ধ্বংস হয়ে যাবে। অপূরনীয় ক্ষতি হবে সামরিক জান্তার। যুদ্ধ করার ক্ষমতাও কমে যাবে অনেকাংশে।
– পাগল নাকি? কি সব অদ্ভুত কথা ভাবছ? ইমোশনাল হয়ে এ ধরণের পদক্ষেপ নিলে তোমরা তোমাদের জন্যই শুধু বিপদ ডেকে আনবে না, বিপদ ডেকে আনবে পশ্চিম পাকিস্তানের সব বাঙ্গালীর জন্য। অবাস্তবব চিন্তধারা।
তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন,
– পাসিং আউট করার দিন শপথ নিয়েছিলে, “ To remain loal to the constitution. So be faithful and Prove your integrity.”
পরিশেষে তিনি বললেন, তার উপর কড়া নজর আছে; তাই সাবির্ক মঙ্গলের জন্য এভাবে যখন তখন তার সাথে যেন দেখা না করি। কি আশ্চর্য্য! এই দস্তগীর সাহেবকে জানতাম ভীষণভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক হিসাবে। তাকে শ্রদ্ধাও করতাম সে কারণে। কিন্তু একি! আজ তার মুখ থেকে একি শুনছি! মুহুর্তে মনটা বিষিয়ে উঠলো, নূরকে বললাম,-চলো যাওয়া যাক। বেরিয়ে আসছিলাম। তিনি বললেন,
– Don’t be so sentimental. Even if Bangladesh becomes a reality, Preserve yourself, Bangladesh can’t go without you and me.
তার সুবিধাবাদী উক্তি শুনে গা’টা ঘিঘিন্ করে উঠল। এ সংসারে সত্যিই মানুষ চেনা দায় ! বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে আমি ও নূর ফিরে এলাম। এরপর যেদিন তিনি লাহোরের পথে যাত্রা করছিলেন সেদিনও তাকে আকুল মিনতি জানিয়েছিলাম, “স্যার এখনও সময় আছে। আপনার মত বিচক্ষণ সিনিয়র অফিসারের প্রয়োজন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। আপনি রাজি থাকলে আমরা বুকের রক্ত বাজি রেখে আপনাকে সাথে করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারি।
তিনি রাজি হলেন না। রওনা হয়ে গেলেন লাহোরের পথে। ফিরে এলাম হতাশ হয়ে। এবার একাই সিদ্ধান্ত নিলাম বেলেলি ডিপো উড়িয়ে দেবার। কমান্ডো ট্রেনিং ছিল আমার। Sympathetic Detonation এর মাধ্যমে Explosive দিয়ে Sabotage করে উড়িয়ে দেব ডিপো। তখন আমার বিশেষ এক বন্ধু ছিল ডিপোর চার্জে। তার ওখানে যাওয়া-আসার মাধ্যমে সব প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলাম অতি গোপনে। পাঠান বন্ধুটি বাঙ্গালীদের প্রতি ছিল বেশ সহানুভূতিশীল। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে একটা Trace তৈরি করে ফেললাম। Trace টা নিয়ে একদিন গেলাম ইঞ্জিনিয়ার্স এর মেজর কাদেরের বাসায়। উদ্দেশ্য তাকে দিয়ে পরখ করিয়ে নেব আমার Trace টা ঠিক হয়েছে কিনা। তাকে গিয়ে সব কথা খুলে বলে তার সাহায্য প্রার্থনা করলাম। আমার প্ল্যান শুনে তিনি ভীষণভাবে আতঁকে উঠলেন। বললেন, “কি সাংঘাতিক! তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ডালিম? তুমি কি বুঝতে পারছো না কি করতে যাচ্ছ তুমি? তোমার প্ল্যান কার্যকরী করলে প্রায় কোয়েটা শহরটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাতে আমরাও ধ্বংস হয়ে যেতে পারি। তাছাড়া তোমার এ কাজ অত্যন্ত ঝুকিঁপূর্ণ। আমি এ ব্যাপারে তোমাকে Encourage করতে পারি না। আমার অনুরোধ তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা।” এখানেও হতাশা। ফিরে আসার আগে তাকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম আমার প্ল্যান সম্পর্কে তিনি যেন অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তির সাথে আলাপ না করেন। তিনি রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিদানে আমাকেও কথা দিতে হয়েছিল আমি এ ধরণের কাজ থেকে বিরত থাকব। আমি কিন্তু আমার প্ল্যান কার্যকরী করার চেষ্টা করে চলেছিলাম। ইতিমধ্যে হঠাৎ করেই আমার বন্ধু একদিন বদলি হয়ে পিন্ডি চলে গেল। আমার মাথায় বাজ পড়ল। তার অবর্তমানে ডিপোতে আসা-যাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল ফলে বাধ্য হয়ে আমাকে আমার পরিকল্পনাও বাদ দিতে হল। দুঃখ পেয়েছিলাম অনেক। কিন্তু অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিতে হল। নতুন করে আবার ভাবতে শুরু করলাম কি করা যায়? ঠিক করলাম পালিয়ে গিয়ে যোগ দিব স্বাধীনতা সংগ্রামে। এমন অবস্থায় একদিন নূর এল আমার মেসে। লনে বসে আলাপ করছিলাম দু’জনে। হঠাৎ করেই নূর বলল,
– স্যার, ক্যাপ্টেন তাহের আপনাকে ডেকেছেন। জরুরী আলাপ আছে।
– ঠিক আছে। আজ রাতে আমরা একসাথে তার মেসে ডিনার করব।
নূর চলে গেল। কি এমন জরুরী আলাপের জন্য ক্যাপ্টেন তাহের ডেকে পাঠিয়েছেন ভেবে কোন কুল কিনারাই পেলাম না। সন্ধ্যার পর গিয়ে হাজির হলাম তার মেসে। নূর ইতিমধ্যেই এসে গেছে। ডিনারের আগে তার রুমে বসে গান শুনছিলাম। গানের আওয়াজের আড়ালে নিচু গলায় আমরা আলাপ শুরু করলাম। কোন ভণিতা ছাড়াই ক্যাপ্টেন তাহের বলল,
– ডালিম, আমি ও নূর পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি চমন বর্ডার দিয়ে আফগানিস্তানে। সেখান থেকে বাংলাদেশ। আকবর বতির ছেলেদের সাথে তোমার বন্ধুত্ব আছে। তাছাড়া তুমি স্থানীয় অফিসার। এ ব্যাপারে আমরা তোমার সাহায্য চাই।
স্বল্পভাষী ক্যাপ্টেন তাহেরের অনুরোধের জবাবে বললাম,
– স্যার আমিও পালাবার চেষ্টা করছি। ক্যাপ্টেন তাহের আমার জবাব শুনে খুব খুশি হলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– তাহলে তুমি সময় নষ্ট না করে যেভাবেই হোক বর্ডারটা একবার রেকি (Recce) করে আস।
আমি সম্মতি জানিয়ে ফিরে এলাম মেসে। আমরা তিনজনে কোরআন শরীফ হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমাদের এ পরিকল্পনা সম্পর্কে কাউকেই কিছু বলা চলবে না। সুযোগমত একদিন Regimental Exercise Area Reece করার উছিলায় ইউনিটের গাড়ি নিয়ে প্রফুল্লচিত্তে (Reece) করে ফিরে এলাম। বন্ধুরা আমাদের পালাতে সাহায্য করবে জানতে পেরে নূর ও তাহের দু’জনেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। এভাবে সব যখন প্রায় ঠিকঠাক হঠাৎ করে একদিন সিগন্যাল কোরের হাবিলদার নাজির রাতের অন্ধকারে আমার সাথে দেখা করতে এল। লোকাল বাঙ্গালী অফিসার হিসাবে সবার সাথেই আমার যোগাযোগ ছিল। বিশেষ করে জুনিয়রদের মধ্যে আমার একটা বিশেষ প্রভাব ছিল। নাজিরের মত সিনিয়র, জুনিয়র অনেকেই তাদের সমস্যাদি নিয়ে আমার কাছে আসতো সুখ-দুঃখের কথা কইতে এবং আমার পরামর্শ নিতে। ভাবলাম, নাজিরও নিশ্চয়ই তেমন কোন ব্যাপারেই আলাপ করতে এসেছে। কিন্তু তাকে দেখেই আতঁকে উঠলাম। তার মুখ ভীষণভাবে থমথম করছিল। চোখ দু’টোও টলটল করছিল। তাকে দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ভীষণ কিছু ঘটেছে। আমি তাকে নিয়ে সোজা আমার ঘরে চলে গেলাম।
– কি হয়েছে নাজির? এত গম্ভীর কেন?
জবাবে নাজির অতি নিচুস্বরে বলল,
– স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে। ডিভ-কমান্ডার GHQ-তে Cipher Message এর মাধ্যমে জানিয়েছেন ২৯ EME Battalion এর ৩জন Junior Commission Officer (JCO) এবং Non-Commission Officer (NCO) চমন হয়ে আফগানিস্তানে পালাতে গিয়ে ধরা ২জন পড়েছে।
খবর শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। নাজিরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিয়ে ছুটে গেলাম ক্যাপ্টেন তাহেরের মেসে। ডেকে পাঠানো হল লেফটেন্যান্ট নূরকে। গভীর রাত অব্দি আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল চমন বর্ডার দিয়ে পালানোর প্রচেষ্টা হবে অত্যন্ত বিপদজনক। তাই এই পথ পরিত্যাগ করে অন্য পথে পালাবার চেষ্টা করতে হবে। অন্য পথ হিসাবে আমাদের সামনে খোলা থাকলো কাশ্মীর, লাহোর, শিয়ালকোট কিংবা ভাওয়ালপুর সেক্টর। ভাওয়ালপুর সেক্টর দিয়ে রাজস্থানের মরুভূমি পাড়ি দিতে সময় লাগবে দুই থেকে তিন দিন। অন্যান্য যে কোন সেক্টর দিয়ে বর্ডার পেরোতে লাগবে ৫ থেকে ৬ দিন। এত সময় পাওয়া যাবে কিভাবে অনেক চিন্তা- ভাবনা করে ভাওয়ালপুর-ভাওয়ালনগর সেক্টরকেই বেছে নিলাম আমরা। এ সেক্টর দিয়ে পালাতে শুধু সময়ই কম লাগবে তা নয় আমাদের ডিভিশনের অপারেশনাল এরিয়া ছিল এই সেক্টর। ফলে প্রয়োজনীয় ইনটেলিজেন্স ইনফর্মেশন সংগ্রহ করাও সহজ হবে। পালাবার পরিকল্পনা করার দায়িত্ব যুক্তিগত কারণেই আবার আমাকেই নিতে হল। শুরু হল আবার এক নতুন পরিকল্পনা। এভাবেই সময় বয়ে যাচ্ছিল।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের এক ছুটির দিনে, দুপুরের খাওয়া শেষ করে মেস থেকে ফিরে বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছিলাম, হঠাৎ করে দরজায় কড়া নড়ে উঠল। কে জিজ্ঞেস করতেই লেফটেন্যান্ট মতির গলা শুনতে পেলাম। ভেতরে এল মতি। শুকনো মুখ, মলিন চেহারা। চিন্তিত লাগছিল ওকে। জিজ্ঞেস করলাম,
– কি ব্যাপার ! হঠাৎ কি মনে করে এলে?
– স্যার কিছুদিন যাবত মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছি ভীষণভাবে। অবশেষে আজ মনস্থির করে এসেছি আপনার পরামর্শ নিতে।
– খুব সিরিয়াস ব্যাপার কিছু কি?
– হ্যাঁ স্যার। মনস্থির করে ফেলেছি। পালাবো। যে করেই হোক পালিয়ে গিয়ে স্বাধীনতা
সংগ্রামে শরীক হবো। চেষ্টা ব্যর্থ হলে যা হবার তা হবে। যে কোন ঝুঁকি নিতে আমি প্রস্তুত। আপনি কি বলেন?
ভালো করে তার মুখের দিকে চেয়ে তার মনের ছবি পড়বার চেষ্টা করলাম। না, তাকে ভীষণ সিরিয়াস মনে হল। কিন্তু আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি আমাদের তিনজনের সিদ্ধান্তের কথা কাউকে বলা যাবে না। তাই সে মুহুর্তে আমাদের চিন্তা-ভাবনার কথা না বলে শুধু বললাম,
– মতি তোমার আন্তরিকতা প্রশংসনীয়। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে কি করতে পারি?
মতি চুপ করে ভাবছিল কিছু। আমি বেয়ারাকে ডেকে নাস্তার ফরমায়েস দিলাম। নাস্তা এল৷ মতি তৃপ্তির সাথে খেলো নাস্তা। ওর খাওয়া দেখে বুঝতে পারছিলাম দুপুরের খাওয়া হয়নি তার। হঠাৎ করেই মতি প্রশ্ন করল,
– স্যার সবকিছু সম্পর্কে আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন । এ অবস্থায় আমরা চোখ-কান বন্ধ করে হাত গুটিয়ে শুধু বসে থাকব? আমাদের কি কোন দায়িত্বই নেই? আপনি কি কিছুই ভাবছেন না? আমি মতির প্রশ্নের তাৎক্ষনিক জবাব না দিয়ে বললাম,
– কাল বিকেলে চায়না ক্যাফেতে ৬টায় এসো; আলাপ হবে বিস্তারিত।
মতি চলে গেল। ও চলে যাবার পর আমি কাপড় পড়ে গাড়ি নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলাম নূরের কাছে। গিয়ে দেখি নূর দিবা নিদ্রা দিচ্ছে। ওকে উঠালাম ঘুম থেকে। প্রথমে নূর কিছুটা থতমত খেয়ে গিয়েছিল।
– কি ব্যাপার স্যার হঠাৎ আপনি ! এ সময়ে?
– বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি নূর।
তাকে মতির ব্যাপারে সব খুলে বললাম। সব শুনে নূর বলল,
– মতির ব্যাপারে আপনি কি ভাবছেন।
আমি বললাম,
– ওকে সঙ্গে নিলে কেমন হয়?
নূর কিছুক্ষন চিন্তা করে বলল,
– আমার আপত্তি নেই তবে ক্যাপ্টেন তাহেরের মতামতটা জানা দরকার।
– বেশ তবে চল তার ওখানেই যাওয়া যাক।
– তাই চলুন।
আমার গাড়িতে করেই গেলাম ক্যাপ্টেন তাহেরের ওখানে। তাকে সব কথা খুলে বলে জানালাম তাকে সঙ্গে নিতে আমার এবং নূরের কোন আপত্তি নেই। ক্যাপ্টেন তাহের আমাদের সাথে একমত হয়ে বললেন, ঠিক আছে ও যদি বিশ্বাসযোগ্য হয় তবে তাকে সঙ্গে নেয়া হোক। ফিরে এলাম; পথে নূরকে নামিয়ে দিয়ে। পরদিন নির্ধারিত সময়ে আমি ও নূর চায়না ক্যাফেতে গেলাম মতির সাথে আলোচনা করতে। গিয়ে দেখি মতি আমাদের পৌঁছার আগেই আমাদের প্রিয় ডিশগুলোর অর্ডার প্লেস করে অপেক্ষা করছে। চায়না ক্যাফে তখন কোয়েটা শহরের একমাত্র চাইনিজ রেস্তোরা৷ আমাদের বিশেষ পছন্দের আড্ডা মারার জায়গা। একটি চাইনিজ পরিবার বাবা, মা ও মেয়ে মিলে রেস্তোরাটা চালায়। আমরা তাদের পুরনো রেগুলার কাষ্টমার। তাই গেলে বিশেষ খাতির-যত্ন করে। আমরা যোগ দেবার পরপরই খাওয়া শুরু হল। সাথে আলোচনা। আমি প্রথমেই বললাম,
– মতি তোমার গতকালের প্রশ্নের জবাব আজ দিচ্ছি। কোন কারণবশতঃ সেটা কাল দেয়া সম্ভব হয়নি। আমি, নূর এবং ক্যাপ্টেন তাহের পালাবার চেষ্টা করছি বেশ কিছুদিন যাবত। চমন বর্ডার দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু EME Batalion এর ঘটনার পর সে পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে। এখনও চেষ্টা করছি ভাওয়ালপুর-ভাওয়ালনগর হয়ে রাজস্তান বর্ডার ক্রস্ করব। তুমি আমাদের সঙ্গে ইচ্ছে হলে আসতে পার। মতির চোখে মুখে খুশি উপছে পড়লো।
– স্যার, আমি জানতাম আপনি এ সময়ে চুপ করে বসে থাকতে পারেন না।
– I am so happy that I can’t tell you. I am proud of you Sir.
আমি পকেট থেকে ছোট্ট একটা কোরআন শরীফ বের করে তার উপর হাত রেখে ওকে শপথ নিতে বললাম। ও কোরআন শরীফের উপর হাত রাখলো। আমি বললাম,
– বলো, আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অন্য কোন ব্যক্তিকে কিছু বলা চলবে না, কোন পরিস্থিতিতেই। প্রয়োজনমত তোমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হবে সেটা বিনা প্রশ্নে তুমি পালন করবে। অযাচিতভাবে পরিকল্পনা সম্পর্কে কৌতুহলবশতঃ কোন প্রশ্ন তুমি করতে পারবে না। একে অপরের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে সমস্ত সিদ্ধান্ত মেনে চলবে।
আমার কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করল মতি। কোন জড়তা নেই। কোন দ্বিধা নেই। এভাবেই শেষ হল আমাদের বৈঠক।
আমার উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সবচেয়ে শর্টকাট এবং গ্রহণযোগ্য পথ খুজে বের করা এবং সে পথের Operational map sheet যোগাড় করে তার উপর Own troops এবং Enemy troops position এবং Deployment Trace যোগাড় করা। তাছাড়া কম্পাস, বাইনোকুলার এবং Personal weapons যোগাড়ের দায়িত্বও আমাকেই নিতে হয়েছিল লোকাল অফিসার হিসাবে। এর সবগুলোই আমার রেজিমেন্টে বিস্তর রয়েছে কিন্তু Classified items হিসাবে Operational purpose ছাড়া এগুলো ষ্টোর থেকে বের করার হুকুম নেই। তাই অন্যপথ খুঁজে বের করতে হল। ম্যাপ যোগাড় করার জন্য ঠিক করলাম ইনফ্যানট্রি স্কুলের ইনন্টেলিজেন্স এর বাঙ্গালী হাবিলদার শফিকের সাহায্য নেব। ছেলেটার সাথে কোর্স করার সময় বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। কোর্সে বাঙ্গালী হয়েও ভালো রেজাল্ট করায় ও আমাকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করত। ক্লাশের ফাকে ফাকে প্রায়ই ওর সাথে দেশ নিয়ে আলাপ হত। ও অনেক কথাই বলত আমাকে আপনজন ভেবে, বিশ্বাস করে। কোর্স করার সময় ও সবসময় আমাকে নানাভাবে সাধ্যমত সহযোগিতা করত অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। এ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতেই আমি ঠিক করেছিলাম, দেখা যাক না চেষ্টা করে ও আমাকে ম্যাপের ব্যাপারে কোন সাহায্য করে কিনা। একদিন ওকে খবর পাঠালাম আমার সাথে দেখা করতে। ও ঠিক এল আমার মেসে। নানা ধরণের আলাপ- আলোচনা হল দেশ সম্পর্কে । এক সময় আমি ওকে বললাম,
– শফিক তোমার কাছে আমি একটি ব্যাপারে সাহায্য চাই। যদি ভরসা দাও তবে বলি৷ ও যেন কিছুটা লজ্জা পেল। বলল,
– স্যার আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? আমি আপনার কোন কাজে লাগতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। আপনি নির্দ্বিধায় বলুন কি প্রয়োজন আপনার?
– আমি যা চাইবো সেটা সাধারণ কোন জিনিস নয় শফিক।
বুদ্ধিমান তরুণ শফিক জবাব দিল,
– আপনি আমার কাছে কোন সাধারণ জিনিস চাইবেন না সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। তবুও আপনি বলুন আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?
ম্যাপ শীটের নম্বরগুলো তাকে লিখে দিয়ে বললাম,
– এগুলো আমার চাই।
ম্যাপ শীট নম্বরগুলো দেখেই বুদ্ধিমান শফিক হয়তোবা আঁচ করতে পেরেছিল আমার উদ্দেশ্য কি? আমার দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে চুপ করে বসে থাকলো শফিক। কি যেন পরখ করে খুজে দেখছিল আমার মাঝে ।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে আমি বললাম,
– হ্যা, আমি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছি, তাই এ ম্যাপ শীটগুলো আমার প্রয়োজন।
আমার কথা শুনে ও বললো,
– আ-কিন্তু স্যার …?
– জানি শফিক তাতে যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেলে তোমার শাস্তিও হতে পারে। তাই যা কিছুই করার সিদ্ধান্ত তুমি নেবে সেটা ভেবে চিন্তে স্থিরভাবেই তোমাকে নিতে হবে। এ ঝুঁকি নেবার ব্যাপারে আমার তরফ থেকে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তবে আমার অনুরোধ এ ঝুঁকি তোমার পক্ষে যদি নেয়া সম্ভব না হয় তবে তুমি অন্য কাউকে আজকের আলোচনা সম্পর্কে কিছু বলবে না। আশা করি তুমি এ অনুরোধ রক্ষা করবে। হাবিলদার শফিক আমার মুখের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। কথা শেষ হতেই সে আমাকে আবেগে জড়িয়ে ধরে বললো,
– স্যার আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি এ বিশ্বাসের অবমাননা জান থাকতে হতে দেব না। কাল বিকেল ৫টায় খোকা বাজারে আমার সাথে আপনি দেখা করবেন। দেখি আমি আপনার জন্য কি করতে পারি।
পরদিন বিকেল ৫টায় আমি খোকা বাজারে নির্দিষ্ট স্থানে হাবিলদার শফিকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। প্রতিটি মুহুর্ত কাটছিল চরম উত্তেজনায়। ৫ মিনিট, ১০ মিনিট হয়ে গেল ৫টা বেজে শফিকের দেখা নেই। শফিক কি তবে আসবেনা? কোন অঘটন ঘটলো না তো? নাকি মুখের উপর না বলে আমাকে বিব্রত না করে আজ না এসে বুঝিয়ে দিল এ কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। চুপচাপ দাড়িয়ে লোকজনের আসা-যাওয়া দেখছিলাম আর নানা ধরণের কথা ভাবছিলাম। ৫টা ২০ হয়ে গেল ভাবলাম শফিক আর আসবে না। চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছি হঠাৎ দেখি ত্রস্ত পায়ে শফিক হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছে আমার দিকে। বাম হাতে একটি ঝোলা। ডান হাত উঁচু করে আমাকে ইশারায় তার আগমন বার্তা জানাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই লোকের ভীড় ঠেলে ও আমার কাছে এল। ওকে দেখে খুশি হয়ে উঠলো মন।
– স্যার স্যরি, একটু দেরী হয়ে গেল। ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল শফিক। বললাম,
– চলো কোথাও বসা যাক।
মার্কেটের মধ্যেই সাজি কাবাবের দোকানে গিয়ে বসলাম দু’জনে। ইন্টার ইউনিট ম্যাচ ছিল আজ। দারুন খেলা হয়েছে। তারপর ১ ঘন্টা হেভী এক্সারসাইজ করায় বেশ ক্ষিধে পেয়েছিল। আস্ত দু’টো মুরগির সাজ্জি সাথে কড়াই কাবাব এবং নান অর্ডার দিয়ে বসলাম দু’জনে। বেয়ারা কাওয়ার পট এবং কাপ রেখে গেল। রেখে গেল। কোনার দিকে একটি নিরিবিলি জায়গাতে বসেছিলাম আমরা। রেকর্ড প্লেয়ারে জনপ্রিয় ফিল্মিগান বাজছিল। ফলে আমাদের আলাপ করার সুবিধা হল। পাশের টেবিলের লোকরাও আমাদের কথা কিছু শুনতে পাবে না ৷
– আমিতো প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম। কিছুটা চিন্তিত হয়েও পড়েছিলাম।
– কি কষ্ট করে যে আপনার জিনিস হাসিল করেছি, সে একমাত্র আল্লাহপাকই জানেন। এতে ঝুঁকি আছে প্রচুর। কিন্তু আপনি দেশের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমার কিছু হলেও শান্তনা পাব এই ভেবে যে দেশের স্বাধীনতায় আমিও কিছু অবদান রাখার সুযোগ পেলাম। বলেই আস্তে টেবিলের নীচ দিয়ে সে ঝোলাটি আমার হাতে তুলে দিল।
– আমি তোমার অবদানের কথা সর্বদা স্মরন রাখব শফিক। ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাকে ছোট করব না। তবে একটি কথা জেনে রাখ। ২৫শে মার্চ ন্যাক্কারজনক পাশবিক ঘটনাবলীর পর থেকে দেশ ও স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখার জন্য অনেক কিছুই ভেবেছি এবং অনেক বাঙ্গালীর সাথে আলাপ করেছি। কেউই তোমার মত নিঃস্বার্থ আন্তরিকতা দেখায়নি। কেউ আমার চিন্তা-ভাবনায় আতঁকে উঠেছেন। কেউ বা রেগে গিয়ে হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করেছেন। কোয়েটার অনেক বাঙ্গালীর কাছেই আমি ইতিমধ্যে বিপদজনক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছি। অনেকে আমার সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তোমার এ সাহায্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমার এ অবদান সামান্য নয়। যদি সংগ্রামে যোগ দেবার তৌফিক আল্লাহ আমাকে নছীব করেন; দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদি বেঁচে থাকি তবে তোমার নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে থাকবে ভাই, এ ওয়াদা আমি তোমাকে দিলাম।
শফিকের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছিল। রুমালে চোখ মুছে নিয়ে ধরা গলায় বললো,
– স্যার আমার এ অবদান অতি সামান্য । ইচ্ছে হয় আপনার সাথে আমিও পাড়ি জমাই। কিন্তু আমি ফ্যামিলিম্যান। পরিবার ফেলে কি করে পালিয়ে যাই! আমার এ অক্ষমতা আমাকে পীড়া দেবে সারাজিবন। নিজেকে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারবো না স্যার।
– কেন মিথ্যে দুঃখ পাচ্ছ ভাই। বাংলাদেশের সবার পক্ষে কি যুদ্ধে সরাসরিভাবে যোগ দেয়া সম্ভব হবে? অনেকেই নানাভাবে সংগ্রামে অবদান রাখবেন। তারাও মুক্তিযোদ্ধা৷ যেমন আজকে তুমি রাখলে এক অমূল্য অবদান। যারা যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করবে তাদের অবদানের চেয়ে তোমার এ অবদানের মূল্য কোনক্রমেই কম নয়; সেভাবে তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার কথায় শফিক নিজেকে সামলে নিল। বেয়ারা ইতিমধ্যেই খাবার পরিবেশন করে গেছে।
– এসো খাওয়া যাক।
দু’জনে তৃপ্তি সহকারে খেলাম। খাওয়া শেষে শফিক বলল,
– আজ আমাদের নাইট ট্রেনিং আছে তাই চলে যেতে হবে। সময় প্রায় হয়ে এল।
– চলো তোমাকে নামিয়ে দেই।
গাড়িতে বসে শফিক বলল,
– স্যার একটি কথা, যদি আমার কিছু হয় তবে আমার পরিবারকে একটু দেখবেন।
– যদি বেঁচে থাকি তাহলে এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার। কথা দিলাম।
শফিককে নামিয়ে দিয়ে মেসে ফিরে এসে লনের মাঝখানে ছাতির মত দাড়িয়ে থাকা প্রিয় আখরোট গাছটার নীচে গিয়ে বসলাম। বসন্তের ফুরফুরে বাতাস নানা ধরণের ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছিল। গার্ডেন লাইটগুলোর স্বল্প আলোকে ম্লান করে দিয়ে বেশ বড় একটি চাঁদ সামনের মুরদার পাহাড়ের গা ছুঁয়ে উকি দিয়ে হাসছে। মনোরম এক শান্ত পরিবেশ। কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম হাবিলদার শফিক সম্পর্কে।
বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর মালেক তখন পর্যন্ত ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার ব্রিগেডের অপারেশনাল এরিয়ার আওতায় পরেছে ভাওয়ালনগর ফোর্ট আব্বাস সেক্টর৷ ভাওয়ালপুর হয়ে ভাওয়ালনগর। সেখান থেকে ফোর্ট আব্বাসের পথে ছোট ষ্টেশন হারুনাবাদ। হারুনাবাদ থেকেই শুরু করতে হবে আমাদের পদযাত্রা। পাক বাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর ডিফেন্স ভেদ করে ২৫ মাইল দুরত্ব অতিক্রম করে আমাদের পৌঁছতে হবে শ্রীকরণপুর। মেজর মালেকের কাছ থেকেই পেতে হবে পাক বাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর Deployment trace. এতে বিশদভাবে আঁকা থাকে Top secret up-to-date intelligence information. যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। ম্যাপ পাবার পরদিনই টেলিফোন করে মেজর মালেককে বললাম জরুরী প্রয়োজনে অবিলম্বে দেখা করতে চাই। অনুমতি নিয়ে তার অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলাম মতিকে সঙ্গে নিয়ে। অফিসে একাই ছিলেন মেজর মালেক।
দ্বারে উপস্থিত হতেই ভারী গলায় প্রশ্ন রাখলেন,
– কি ব্যাপার ডালিম?
– আপনার নতুন গাড়ি দেখতে এলাম। কেমন চলছে?
অল্প কিছুদিন আগে তিনি একটি Skoda Sedan Car কিনেছেন।
– তোমার Volks Wagon এর মত শানদার না হলেও I have no complain.
– স্যার বাসায় চলেন । লাঞ্চ খাব একসাথে।
– লাঞ্চ খাবে তা বেশতো; তোমার ভাবীকে ফোন করে বলে দাও। But what is your problem? Have you picked up again on some one? তা তোমার সাথের ছেলেটিকে তো চিনলাম না?
আমি ইতিমধ্যেই টেলিফোন তুলে নিয়ে রিং করছিলাম,
– হ্যালো ভাবী, ডালিম here. আমরা বাসায় আসছি, Three of us over lunch. অসুবিধে হবেনা তো?
– কোন দিকে সূর্য উঠলো আজ! এতদিন পর হঠাৎ ভাবীকে মনে করে যেচে লাঞ্চ খেতে চাচ্ছ?
ভাবীর জবাবে একটু লজ্জা পেলাম।
– বিশ্বাস করেন ভাবী, কোর্সের ঝামেলায় এত ব্যস্ত ছিলাম; তাই আসা হয়ে উঠেনি। আমার সময় কি করে কেটেছে সে শুধু আমিই জানি।
– চলে এসো; ভাবী বললেন।
কথোপকথন শেষ করে রিসিভার নামিয়ে রেখে বললাম,
– All clear Sir at the home front. 3, Let me introduce Lieutenant Moti from 3rd East Bengal and Moti this is Major Malek from senior Tiger.
মতি মেজর মালেকের সাথে হাত মিলিয়ে বললো,
– স্যার আপনার সাথে আগে দেখা হয়নি কিন্তু আপনার কথা অনেক শুনেছি।
আপনার সাথে আগে দেখা হয়নি কিন্তু আপনার কথা অনেক শুনেছি। প্রাণখোলা উচ্ছল প্রকৃতির মেজর মালেক স্মিত হাসলেন।
– Moti is here for OW-JTC. He has done pretty well in the course. বললাম আমি।
– You mean right away!
কিছুটা আশ্চর্য হলেন মেজর মালেক।
– That’s correct. এতো চাকুরি করে কি আর হবে স্যার! বললাম আমি৷
– চলো তবে।
মেজর মালেক Buzzer টিপলেন। পিএ এসে সেল্যুট করে দাড়ালো।
এসে সেল্যুট করে দাড়ালো। তাকে কিছু নির্দেশ দিয়ে মেজর মালেক তাকে বললেন তিনি অফিসে আজ আর ফিরছেন না। এরপর আমরা বেরিয়ে এলাম অফিস থেকে। বাসায় ফিরে ড্রইং রুমে বসে আলাপ শুরু হলো।
– Well now tell me what’s up? প্রশ্ন করলেন মেজর মালেক।
– Sir, the matter is very serious and urgent at the same time confidential পালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জবাব দিলাম আমি।
অপ্রত্যাশিত জবাবে কিছুটা চমকে উঠলেন মেজর মালেক। চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ কিচেনে ভাবী রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
– Just a minute, বলে উঠে গেলেন মেজর মালেক।
অল্পক্ষণ পর সিগারেট হাতে ফিরে এসে বললেন,
– কি জানো, my batman is not that reliable. তাই বেটাকে পাঠিয়ে দিয়ে এলাম ক্যান্টিন থেকে সিগারেট আনতে।
বুঝলাম আমার কথার গুরুত্ব উপলদ্ধি করে তিনি Precaution নেবার জন্যই তিনি এমনটি করেছেন।
– Now then are you sure? একরাশ প্রশ্ন তার চোখে।
– জি স্যার। এভাবে আর চাকুরি করার কোন মানে হয় না। নিজের প্রতি ঘৃণা বাড়ছে। আজ আমাদের মত লোকের প্রয়োজন স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার জন্য। What do you think Sir? প্রশ্ন রাখলাম আমি।
– Well you may be right. কিন্তু সংগ্রাম সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্যইতো আমরা জানতে পারছি না। সে অবস্থায় এ ধরণের পদক্ষেপ নেয়াটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে? Wouldn’t it be too risky?
পাল্টা প্রশ্ন রাখলেন মেজর মালেক ।
– আপনার কথায় যুক্তি আছে।
কিন্তু যেভাবে যেভাবে এখান থেকে জরুরী ভিত্তিতে Re- enforcement পাঠানো হচ্ছে আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে লাশ আসছে তাতে করে এতটুকু নিশ্চয়ই প্রমাণিত হয় যে, সেখানে কিছু একটা ঘটছে। তদপুরি International media কি সবটাই মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে বলে মনে করেন আপনি?
এ্যাপ্রন পরা ভাবী ন্যাপ্কিনে হাত মুছতে মুছতে টেবিলে যাবার অনুরোধ জানালেন। ভাবীর আগমনে পরিবেশটাকে হালকা করে দেবার জন্য হঠাৎ করেই মেজর মালেক কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
– এসো আগে পেট-পুঁজো করা যাক। খালি পেটে ঠিকমত চিন্তাও করা যায় না।
সবাই গিয়ে টেবিলে বসলাম। বাচ্চারা সবাই স্কুলে। খাবার দেখে জিভে পানি এসে গেল। টাটকা মাছের বিভিন্ন ব্যঞ্জন। জিজ্ঞেস করলাম,
– ভাবী The Great! এ জিনিসগুলো কোথা থেকে আমদানি করলেন?
জবাবে ভাবি বললেন,
– ওরোখ্ থেকে আজ সকালেই আনিয়েছি।
কোয়েটা শহর থেকে ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট একটি সবুজ উপত্যকা ওরোখ্। একটি পাহাড়ী ঝরনা বয়ে যাচ্ছে উপত্যকার ঠিক মাঝ দিয়ে। বিভিন্ন ফলের গাছ-গাছালিতে ছেয়ে আছে উপত্যকাটা। চারিদিকে ঘিরে আছে পাহাড়ের গায়ে চির-সবুজ বন। আকর্ষনীয় পিক্নিক্ স্পট। সেই ঝরনাতেই ট্রাউট এবং অন্যান্য জাতের মাছ পাওয়া যায়। বাঙ্গালীরা সুযোগ পেলেই মাছ আনায় ওরোহ্ থেকে। আমরা Bachelor Boys প্রায়ই গাড়ি ভর্তি করে মাছ নিয়ে এসে ইচ্ছেমত যেকোন ভাবীর শরনাপন্ন হই টাটকা মাছ-ভাতের স্বাদ মেটাতে। হৈ চৈ করে তৃপ্তি মিটিয়ে খাওয়া শেষ করে আমরা আবার ড্রইং রুমে এসে বসলাম। খাবার সুযোগে সবকিছু ভেবে নিয়ে আমার অনুরোধের জবাবটা ঠিক করে নিয়েছিলেন মেজর মালেক। সোফায় বসে সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে মেজর মালেক বললেন,
– Well I admire your courage. আমি নিশ্চয়ই তোমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করবো। শুধু অনুরোধ এ ব্যাপারটা আমার এবং তোমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
– Definitely Sir, we give you our words.
আমি জবাব দিলাম।
– আমরা যোগাড় করেছি।
মেজর মালেক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকাতেই তাড়াতাড়ি বললাম,
– Not from my Regiment. From elsewhere.
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হাঁফ ছেড়ে যেন বাচঁলেন মেজর মালেক।
– Then bring them to me tomorrow. বললেন মেজর মালেক।
– Not tomorrow. এখনি Map-Sheets গুলো দিয়ে যাচ্ছি আপনাকে, কাল এসে নিয়ে যাবো। মতিকে পাঠালাম গাড়ি থেকে Map Sheets গুলো নিয়ে আসার জন্য। সেগুলো নিয়ে মতি ফিরে এলো। Map-Sheetsগুলো পরখ করে মেজর মালেক স্বগোক্তি করলেন,
– Incredible ! জিনিসগুলো উঠিয়ে নিয়ে কোন গোপন জায়গায় রেখে ফিরে এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে।
– আমরা তবে আজ উঠি স্যার, Still a lot to be done.
– বুঝেছি। কি জানো ডালিম, তোমাদের মত দেশপ্রেমিকদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ স্বাধীন হবে নিশ্চয়ই ইনশাল্লাহ্। ইচ্ছে হচ্ছে আমিও তোমাদের সাথে পালিয়ে যাই, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়৷ পরিবারের দায়িত্ব বাধা হয়ে আছে। How can I leave them and go?
ভারী গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলছিলেন মেজর মালেক।
– আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। কিন্তু আমাদের সাহায্য করে আপনিতো কম অবদান রাখলেন না স্যার? সেভাবে বিচার করলে আপনিওতো একজন মুক্তিযোদ্ধা৷ আমরা বেঁচে থাকলে আপনার এই অবদানের কথা দেশবাসী জানবে। বিশ্বাস করেন স্যার, আপনিই একমাত্র সিনিয়র অফিসার যার কাছ থেকে আন্তরিকতা, সহানুভূতি ও সহযোগিতা পেলাম। বাকি সবাইকে চেনা হয়ে গেছে। All are paper tigers. তারা ভিতু, স্বার্থপর। মুখে মুখেই সব বাঙ্গালী এর বেশি কিছু নয়।
আমার কথায় মেজর মালেকের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। হৈ হুল্লরবাজ বলে পরিচিত মেজর মালেকের মাঝে সাচ্চা বাঙ্গালী দেশপ্রেমিক মেজর মালেককে খুঁজে পেয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সালাম জানিয়ে উঠে পড়লাম। গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন তিনি। গাড়িতে বসতে যাচ্ছি ঠিক তখন আবেগে আমাকে এবং মতিকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,
– I wish you all well boys, take care ফিরে এলাম মেসে।
– সত্যি অদ্ভুত লোক মেজর মালেক। বললো মতি।
– আমিও কিন্তু ভাবিনি তার কাছ থেকে ঠিক এতটা সহযোগিতা পাবো। সত্যি পৃথিবীতে মানুষ চেনা দায়; জবাব দিলাম।
আরো কয়েকটি বিষয়ে আলাপ-আলোচনার পর মতি চলে গেল।
লেফটেন্যান্ট সুমি ফিরে যাচ্ছে লাহোর। ভাবলাম ওর কাছ থেকেই চেয়ে নেব Compass এবং Binocular. যাবার আগের দিন বিদায় নিতে এসেছে সুমি। টকটকে ফরসা Well Build সুদর্শন যুবক সুমি। সব সময় মিষ্টি হাসি মুখে লেগেই আছে। সেদিন তাকে খুব মলিন দেখাচ্ছিল।
– সুমি খারাপ লাগছে লাহোর ফিরে যেতে তাই না? জিজ্ঞেস করলাম।
– ঠিক বলেছেন স্যার। আপনাদের সাথে বেশ কেটে যাচ্ছিল সময়গুলো হেসে খেলে। আপনাদের ছেড়ে যেতে মন কিছুতেই চাচ্ছে না। কিন্তু এর বিকল্পওতো কিছু নেই! যেতে তো হবেই। আপনার কথা কখনও ভুলতে পারব না স্যার। আপনি না থাকলে Life out here would have been hell and most boring.
– সুমি আজ তোমাকে একটা অনুরোধ করবো, রক্ষা না করতে পারলে কথা দাও এ ব্যাপারে তুমি কাউকে কিছুই বলবে না।
– কি এমন কথা স্যার, যার জন্য এমনিভাবে আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন?
সুমির কথায় আন্তরিকতা ফুটে উঠলো। ওকে বিশ্বাস করা চলে।
– আমি পালিয়ে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেব ঠিক করেছি। রাজস্থান বর্ডার দিয়ে ক্রস্ করবো। তোমার Compass এবং Binocular টা পেলে সুবিধে হয়।
– Fantastic, great idea. আমি নিশ্চয়ই দেব Compass এবং Binocular. কিন্তু আমাকে কি সঙ্গে নিতে পারেন না স্যার? আকুতি ঝড়ে পড়ল ওর অনুরোধে। I beg of you Sir, please take me along. আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলুন।
– Well Shumi thanks a lot. I shall remain ever grateful for your help. তোমাকে সঙ্গে নেবার ব্যাপারে ঠিক এই মুহুর্তে কোন জবাব দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ I hope you wouldn’t mind. আমাকে একটু ভাববার সময় দিতে হবে।
– That’s fine Sir. Do take your time. But be sure, even if you decide not to take me along for some reason you will get the things which you have asked for. আমিও কিছুই মনে করবো না। উঠি আজ তাহলে?
– না না সে কি করে সম্ভব! লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, লাঞ্চ করে যাবে তুমি।
বলেই খাবারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলাম বেয়ারাকে ডেকে। খাওয়ার পর সুমি যাবার জন্য বিদায় চাইল। আমি বললাম,
– সন্ধ্যায় মেসে থেকো, আমি আসবো। সম্মতি জানিয়ে চলে গেল সুমি।
সুমি চলে যাবার পর আমিও বেরিয়ে পরলাম। মতি ও নূরকে সঙ্গে করে সোজা ক্যাপ্টেন তাহরের ওখানে। অনেক আলোচনার পর ঠিক হলো সুমিকেও সঙ্গে নেয়া হবে। সন্ধ্যার একটু আগেই সুমির ওখানে গিয়ে হাজির হলাম আমি একাই। প্ল্যানিং এই স্টেজে গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্যই Strict compartmentation মেনে চলা হচ্ছিল। Need to know basis-এ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলাম আমরা অতি সতর্কতার সাথে। সুমি আমার অপেক্ষা করছিল। ঘরে ঢুকে দেখি ওর ব্যাটম্যান সবকিছু গোজগাছ করছে। যাত্রার প্রস্তুতি।
– Let’s have Chinese.
বলেই গাড়িতে সুমিকে তুলে নিয়ে সোজা চলে গেলাম China Café-তে। খাবার ফাঁকে ফাঁকে আলাপ হচ্ছিল।
– Sir, you said Rjasthan is the sector, is that correct? সুমি জানতে চাইলো।
– That’s right. জবাব দিলাম।
– তাহলে আপনার সাথেতো আমার যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না। আপনিতো জানেন, I am allergic to sand. বালির স্পর্শে আমার সমস্ত গায়ে চুলকানি শুরু হয়ে যায়। তা এর জন্য আপনার কোন অসুবিধা হোক সেটা আমি চাইনা, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি I shall stay back. সত্যিইতো এ কথাটা গতকাল আমাদের খেয়ালেই আসেনি।
– I don’t want to be a liability. এতে আপনার বিপদও হতে পারে। আমার জন্য আপনার পথে কোন বাধার সৃষ্টি হউক সেটা আমি চাই না৷ ছল ছল চোখে কথাগুলো বলছিলো সুমি
আমি ওর হাত ধরে ওকে সান্তনা দিয়ে বললাম,
– Don’t feel so bad. আমার সাথে মরুপথে যেতে পারছ না তাতে কি হয়েছে? That’s not the end of the world. এখান থেকে যাবার পর লাহোরের কসুর কিংবা ওয়াগা বর্ডার দিয়েতো তুমি পালাবার চেষ্টা করতে পারবে।
আমার কথায় সুমির চোখ উজ্জল হয়ে উঠলো।
– তাইতো লাহোর থেকেই ক্রস্ করাটা সহজ হবে আমার জন্য। I promise you Sir, লাহোর পৌঁছেই পালাবার চেষ্টা করবো যে করেই হোক না কেন।
– নিশ্চয়ই করবে। আমি পরম করুনাময়ের কাছে দোয়া করবো যাতে তুমি তোমার প্রচেষ্টায় সফল হও।
দু’জনে ফিরে এলাম সুমির মেসে। সমস্ত মেসটাই ঘুমিয়ে পড়েছে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম।
– সুমি Thanks a lot once again for all that you have done for me. আমার জন্য দোয়া করো। বেচেঁ থাকলে স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা হবে ইনশাল্লাহ্। Otherwise good luck and good bye my friend.
আবেগ এবং বিচ্ছেদের অনুভূতি সব মিলিয়ে চোখে পানি এসে গিয়েছিল নিজের অজান্তেই৷ সুমি ধরা গলায় বিদায় জানালো,
– খোদা হাফেজ, Take care Sir may Allah be with you.
সুমির দিকে আর চাইতে পারলাম না। দ্রুতপায়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে বসলাম। ইঞ্জিনে ষ্টার্ট দিয়ে ঝড়ের বেগে গেইট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। রিয়ার-ভিউ মিরর এ দেখলাম সুমি তখনও পোর্চে দাড়িয়ে হাত নাড়ছে।
এ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকমতই এগুচ্ছিল। হঠাৎ করে ঘটলো প্রথম বিপর্যয়। আকস্মিকভাবে ক্যাপ্টেন তাহেরের বদলির অর্ডার এসে গেল। এবোটাবাদে বেলুচ সেন্টারে তার পোষ্টিং হয়েছে। অবিলম্বে তাকে যোগদান করতে হবে। খবরটা পেয়েই মতি, নূর এবং আমি ছুটে গেলাম তার কাছে। মেসে গিয়ে পৌঁছাতেই তিনি জানালেন কালই তাকে By Air চলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একি বিভ্রাট! কি করবো এখন আমরা? জবাবে ক্যাপ্টেন তাহের বললেন,
– It’s OK. এ অবস্থয় তোমাদের সাথে আমার যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। But so what? আমি এবোটাবাদ থেকে পালাবার চেষ্টা করবো। তোমরা তোমাদের প্ল্যান অনুযায়ী এগিয়ে যাও।
তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব Plan execute করতে হবে। বুঝতে পারলাম পোষ্টিং অর্ডার একবার যখন আসা শুরু হয়েছে তখন যেকোন সময় মতি ও নূরের কিংবা আমার পোষ্টিং অর্ডারও এসে পরতে পারে। একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরার আগেই আমাদের কেটে পড়তে হবে। পরদিন সকালে ক্যাপ্টেন তাহেরকে এয়ারর্পোটে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম। আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব ক্যাপ্টেন তাহের ! তরুণ চৌকশ কমান্ডো অফিসার। সবেমাত্র রেঞ্জারস্ কোর্স শেষে আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। ফেরার পরপরই Detailed হয়ে কোয়েটাতে এসেছিলেন Senior Tactical Course করতে। স্বল্পভাষী, অসীম সাহসী, তেজদীপ্ত চেহারা, অস্বাভাবিক মনোবল ও আত্মপ্রত্যয়ের অধিকারী যুবক ক্যাপ্টেন তাহের দেশপ্রেমের এক দুর্লভ নিদর্শন। অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের মন জয় করে ফেলেছিলেন তিনি। অত্যন্ত আপন হয়ে উঠেছিলাম আমরা। পাকিস্তান থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মতি, নূর এবং আমিই সর্বপ্রথম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে সক্ষম হয়েছিলাম। দ্বিতীয় ব্যাচে এসেছিলেন মেজর মঞ্জুর, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন তাহের। তারা এসেছিলেন শিয়ালকোট সেক্টর দিয়ে। আমরা একসাথে যুদ্ধ করেছি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। স্বাধীনতার সংগ্রামকালে এবং পরবর্তিকালে বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তি সংগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরের নিঃস্বার্থ অবদান এবং আত্মত্যাগের ইতিহাস সর্বজন বিধিত। কিংবদন্তির নায়ক কর্নেল তাহেরের আত্মগাঁথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করবে বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের দেশপ্রেমিকরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তার নাম। কোন অপচেষ্টাই শহীদ তাহেরের স্মৃতিকে ম্লান করে দিতে পারবে না বাংলার মাটিতে। কর্নেল তাহের মরেও অমর হয়ে আছেন; আর থাকবেনও চিরদিন।
ক্যাপ্টেন তাহেরের হঠাৎ বদলিতে ভেঙ্গে পড়লেও আমরা নিজেদের সামলে নিলাম। তার চলে যাবার পর পুরোদমে আমরা আমাদের পরিকল্পনার কাজ এগিয়ে নিয়ে চললাম। সুমির পিস্তলটা পাওয়ায় আমাদের সুবিধা হলো। আমার ব্যক্তিগত হাতিয়ারের মধ্যে রয়েছে একটা পিস্তল আর একটা রিভলবার। সুমির পিস্তলটা আমাদের হাতিয়ারের সমস্যার সমাধান করে দিল। ক্রমান্বয়ে আমাদের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ হয়ে এলো। এখন শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষা।
ইতিমধ্যে আমাদের ১৬ ডিভিশনের ইউনিটগুলোকে জরুরী ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে। যে সমস্ত ইউনিটগুলো পাঠানো হচ্ছে সেগুলো থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে বাঙ্গালী সদস্যদের। এ থেকে ধরে নিলাম খুব শীঘ্রই আমার পোষ্টিং অর্ডার এসে যাবে। আমার ইউনিটে আমরা মাত্র দু’জন বাঙ্গালী। হলোও তাই। প্রায় একই সময়ে নূর এবং আমার পোষ্টিং অর্ডার এসে গেল। আমাকে যেতে হবে খারিয়ায় আর নূরকে যেতে হবে কোহাট। একই সময়ে পোষ্টিং অর্ডার পাওয়ায় দু’জনেই খুশী হলাম। এতে আমাদের Movement co-ordinate করতে সুবিধে হবে। আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে পোষ্টিং অর্ডার পেয়ে নতুন জায়গায় যাবার পথেই কেটে পড়বো আমরা। এতে করে খুব সহজেই সপ্তাহখানেকের জয়েনিং টাইম কাজে লাগানো যাবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল মতিকে নিয়ে। যেকোন কারণেই হোক না কেন ওর পোষ্টিং অর্ডার আসতে দেরী হচ্ছিল। ঠিক হল কিছু একটা করা দরকার। স্কুলে আটকে পরা সব বাঙ্গালীরাই প্রায় চলে গেছে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ইউনিটে। হঠাৎ মতির মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ও সরাসরি পিন্ডিতে MS Branch এর সাথে যোগাযোগ করে জানতে চাইলো বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের পোষ্টিং ইনচার্য কে? ভাগ্যক্রমে জানা গেল ঐ বিভাগের দায়িত্বে যে কর্নেল সাহেব রয়েছেন তিনি মতির পূর্ব পরিচিত। কর্নেল সাহেব মতির এক স্কুল-মেটের বাবা। পরিচয় জানার পর মতি আবদার করে বসলো,
– আংকেল, স্কুলের আটকে পরা সবারই পোষ্টিং হয়ে গেছে শুধু আমিই পড়ে রয়েছি। আমার একটা গতি করুন। একাকিত্বের যন্ত্রনা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। Please Uncle, you got to do something for me as soon as possible.
জবাবে কর্নেল বললেন,
– তুমি চিন্তা করোনা, আজই আমি তোমার পোষ্টিং অর্ডার পাঠিয়ে দিচ্ছি। 6 East Bengal Regiment পেশাওয়ার এ যাবার জন্য তুমি প্রস্তুত হও।
মতি কর্নেল সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিল, সম্ভব হলে পেশাওয়ার যাবার পথে মুলতান হয়ে যাবার চেষ্টা করবে ও। উদ্দেশ্য কর্নেল সাহেবের পরিবারের সবার সাথে দেখা করে যাওয়া৷ পুরো পরিবারের সাথেই মতি পূর্ব পরিচিত। কথা শেষে মতি আনন্দে উচ্ছাসিত হয়ে উঠলো,
– It is all done Sir. Well done indeed, it’s really great.
কর্নেল আংকেল এর কথা মত পরদিনই মতি তার পোষ্টিং অর্ডার হাতে পেলো। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম ।
গেইমস্ থেকে ফিরে এক্সারসাইজ করছিলাম মেসে। মতি ও নূর এলো। দু’জনেই খুব রিলাক্সড। এক্সারসাইজ শেষ করে ফ্রেস হয়ে তিনজনেই গিয়ে বসলাম লনে। ঠিক করা হলো, নূর রওনা হবে ট্রেনে করে কোহাটের পথে। কিন্তু পথিমধ্যে ভাওয়ালপুরে নেমে যাবে নূর। সেখানে সার্কিট হাউজে অবস্থান নেবে নূর। মতি ও আমি ওর যাত্রার পরদিন ভাওয়ালপুরে তার সাথে মিলিত হবো। মতি এবং আমি কিভাবে যাবো সে ব্যাপারে কিছুই আলাপ হলো না। আমাদের অঙ্গীকার অনুযায়ী কেউ এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন করলো না। আলাপ শেষে ক্লাবে চলে গেলাম “তাম্বোলা- নাইট” অ্যাটেন্ড করার জন্য।
আমাকে কমান্ডিং অফিসার নির্দেশ দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোছগাছ করে খারিয়া চলে যেতে। স্বাভাবিকভাবে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম গোছগাছ নিয়ে। সমস্ত মালপত্র ব্যাটম্যানকে দিয়ে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে ট্রেনে করে পাঠিয়ে দিলাম খারিয়ায়৷ CO-কে বললাম ট্রেনে না গিয়ে By Air লাহোর হয়ে যাবো আমি। Transit Period-টা লাহোরে আমোদ-ফুর্তি করে কাটিয়ে দিয়ে খারিয়াতে চলে যাবো আমি। সমস্যা দেখা দিল সদ্য কেনা গাড়িটা নিয়ে। নতুন গাড়ি শখ করে কেনা তাই বেচে দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। এতে লোকজনের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে। তাই ঠিক করলাম আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধুকে দিয়ে যাবো গাড়িটা। এজাজ লাহোরের ছেলে। ওর পরিবারের সাথেও আমার ঘনিষ্টতা রয়েছে। আমাকেও তারা পরিবারের একজন হিসাবেই মনে করে। এজাজকে একদিন বললাম,
– এজাজ আমি By Air লাহোর হয়ে যাচ্ছি। তুই আমার গাড়িটা রেখে দে। সুবিধামতো লাহোর পাঠিয়ে দিস। আমি পরে এক ফাঁকে খারিয়া থেকে লাহোর গিয়ে গাড়িটা নিয়ে আসবো।
এজাজ আমার প্রস্তাবে খুশী হয়েই রাজি হলো এবং বললো,
– Don’t you ever think about it. I shall manage everything. You just go and have fun at Lahore. By the way when are you planning to leave?
– Tentatively around mid April.
জবাব দিয়েছিলাম আমি। এভাবেই গাড়ির ঝামেলারও সুরাহা হল।
এরই মধ্যে ঘটলো চরম অঘটন। একদিন গেমস এর পর স্কুলের মেসে এ্যান্টিরুমে বসেছিল নূর। কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারও বসেছিল সেখানে। কথায় কথায় এক সময় বাঙ্গালী জাতি এবং শেখ মুজিব সম্পর্কে কটুক্তি করে নূরকে চটাবার চেষ্টা করছিল। ওদের একজন নূরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– নূর তেরাতো কিসমত থুল গিয়ারে। শেখ মুজিব আভি তুঝে একদমসে জেনারেল বানা দেগা, Bastard Mujib is a traitor don’t you think so? সারে বাঙ্গালী কওম হিন্দু হ্যায়। উসকানিমূলক এধরণের বক্তব্যে নূর ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে ওদের কথার জবাবে গর্জে উঠে,
– If Mujib is a Gaddar then Yahia is a rogue. He is killing thousands of Bengalees, he has let loose the forces to rape and dishonour our mothers and sisters. Therefore, he is a bigger Bastard.
এ ধরণের কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি নূর। রাগের চোটে সামনের ষ্ট্যান্ডে রাখা প্রেসিডেন্টে ইয়াহিয়া খানের ছবি তুলে নিয়ে আছড়ে ফেলে দিয়ে তার উপর দিয়ে গটগট করে হেটে বেড়িয়ে যায় নূর। প্রেসিডেন্টের ছবি পা দিয়ে মারিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার গুরু অপরাধে তক্ষুণি তার বিরুদ্ধে Open Arrest এর আদেশ জারি করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। শুরু হয়ে যায় কোর্ট মার্শাল প্রসিডিংস্। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার ও মতির মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। হতভম্ব হয়ে যাই আমরা। খবর পেয়েই ছুটে গেলাম ওর কাছে।
– একি করলে নূর? ক্ষণিকের উত্তেজনার বসে সবকিছু ভন্ডুল করে দিলে কি করে? তোমার এ ধরণের হঠকারি কার্যকলাপের পরিণামে আমরাও বিপদে পড়তে পারি। তোমার সাথে আমাদের হৃদ্যতার কথা সবাই জানে। How could you be so stupid to do a thing like that. Shame on you. এ ধরণের কাজ তোমার কাছ থেকে আশা করিনি। হঠাৎ করেই ওর উপর ভীষণ রাগ হল।
– I am sorry Sir. I was totally out of my head. যা ঘটেছে তার জন্য আমি লজ্জিত এবং অনুতপ্ত, এখন আমাকে নিয়ে বৃথা চিন্তা না করে প্ল্যানমত আপনারা চলে যাবার ব্যবস্থা করেন যত শীঘ্র সম্ভব। Summery Of Evidence শুরু হলে আপনাদের ডাক পরা অসম্ভব কিছু নয়, কেসে জড়িয়ে পরার আগেই পালিয়ে যেতে হবে আপনাদের। আমার যা হবার তা হবে। কিন্তু আপনারা ফেঁসে পড়লে আর যাওয়ার সুযোগ হবে না। তাই আমার আন্তরিক অনুরোধ Please leave me alone to my fate and just think to escape as quickly as possible. আপনাদের কিছু হলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। ছেলে-মানুষের মতই ডুকরে কেঁদে উঠলো নূর।
ওকে সান্তনা দেবার ভাষা খুজে না পেয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ফিরে এলাম। হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল এখন আমাদের কি করা উচিত; ভেবে কোন কূলকিনারাই পাচ্ছিলাম না৷ নূরের ভবিষ্যত ভেবে শংকিত হয়ে পড়লাম। বেচারা নূর! অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ঠিক করলাম মতি এবং আমি ১৬ই এপ্রিল আমাদের যাত্রা শুরু করবো৷ তখনকার দিনে করাচি থেকে একটি ফ্লাইট কোয়েটা, মুলতান হয়ে লাহোর যেত প্রতিদিন। ১৬ তারিখের ঐ ফ্লাইটেই রওনা হব আমি লাহোরের পথে। মতি স্কুল এ্যডজুটেন্টকে জানিয়ে দিয়েছে ট্রেনে না গিয়ে 3 By Air Travel করবে। পথিমধ্যে মুলতানে কয়েকদিন কর্নেল সাহেবের পরিবারের সাথে কাটিয়ে চলে যাবে পেশাওয়ার। MS Branch এর কর্নেল সাহেবের নাম শুনে অতি স্বাভাবিকভাবেই তার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল স্কুলের এ্যডজুটেন্ট. একই ফ্লাইটে আমাদের সিট বুক করলাম। Open Arrest এ থাকার ফলে আমরা নূরের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারছিলাম। Closed Arrest হলে ওর সাথে কোন যোগাযোগ রাখা সম্ভব হতো না। নূর বন্দী হওয়ার পর থেকেই মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলাম। ওকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যেতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। ঘুরে ফিরে শুধু একটি কথাই মনে হচ্ছিল, কোন মতেই কি নূরকে উদ্ধার করে আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া যায় না? অনেক চিন্তা ভাবনার পর একটা উপায় আমার মাথায় এলো। ১৫ তারিখ সকালে গিয়ে উপস্থিত হলাম মতির মেসে। গিয়ে দেখি মতির ঘর একদম খালি। বুঝলাম মতি তার মালপত্র ব্যাটম্যানের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। বাথরুমে গোসল করছিল মতি। অল্পক্ষণ পরই মতি বেরিয়ে এলো,
– কি ব্যাপার স্যার, এতো সকালে আপনি?
– একটা বিশেষ ব্যাপারে আলাপ করতে এলাম। মতি তুমি ভালো করেই জানো নূরের বন্দী হওয়ার পর থেকেই আমি ভীষণভাবে মানসিক অশান্তিতে ভুগছি। সর্বক্ষণ ওকে নিয়েই ভাবছি। বললাম আমি।
– নূরের বিষয়েই কিছু কি?
আমার মানসিক অবস্থা আচঁ করেই বোধহয় প্রশ্নটা করলো মতি।
– হ্যাঁ তাই, নূরকে সঙ্গে নেবার একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়….।
আমাকে শেষ করতে না দিয়েই মতি বলে উঠলো,
– Are you mad Sir? বন্দী অবস্থা থেকে তাকে নিয়ে যাবার কথা কি করে ভাবলেন? ওকে সঙ্গে নিলে আমরা ধরা পরতে বাধ্য।
– আহা আগে শোনই না আমার আইডিয়াটা। মতিকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।
– বেশ বলেন কি বলতে চান৷
– দেখো মতি, নূরই প্রথম আমার কাছে পালিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। মানছি হঠাৎ করে ও একটা ভুল করে ফেলেছে। মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। তাছাড়া ওর ভবিষ্যতটা একটু ভেবে দেখ। এ অবস্থয় ওকে অসহায় একা ফেলে রেখে যেতে বিবেকে বাধছে, ওকে ফেলে রেখে যাওয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না মতি।
– But then how? প্রশ্ন মতির।
– শোন মন দিয়ে। আমি ওর জন্য ৩ দিনের Attend ‘C’ ( Sick in quarters ) যোগাড় করে আজই ওকে রওয়ানা করিয়ে দিতে চাই ভাওয়ালপুরের উদ্দেশ্যে। ওখানে পৌঁছে সে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ওকে কিছুই বলা হবে না। শুধু এতটুকুই বলা হবে আগামীকাল ভাওয়ালপুর ষ্টেশনে ওর সাথে নির্ধারিত সময়ে আমাদের দেখা হবে। সময় দুপুর ২-৩টার মধ্যে। That’s all. এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন না করে ও যদি যেতে রাজি হয় তবে Let’s take him. If at all something goes wrong with him on his way even then we would be safe, as he wouldn’t be in a position to reveal anything about our rout or the next step and thus our secret will not be compromised. What do you say?
– ঠিক আছে, বুঝলাম আপনার প্লানে যুক্তি আছে। কিন্তু Attend ‘C’ কি করে যোগাড় ‘C’ করবেন? প্রশ্ন মতির৷
– First of all tell me do you agree or not to take him with us on principle?
– Well it is still risky but I shall buy it.
– জবাবে বললো মতি। আনন্দে মতিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
Thanks, you are really great Moti. Now come-along and see what I do.
গাড়ি করে ছুটে গেলাম CMH এ ষ্টাফ সার্জেন ক্যাপ্টেন জামালের কাছে। আমি যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তেন জামাল। ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে পরিচয় হয় আমাদের সেই পরিচয় আর্মিতে যোগদানের পর আরো ঘনিষ্ট হয়ে উঠে। বয়সে ক্যাপটেন জামাল আমার চেয়ে কিছুটা বড় হলেও আমরা একে অপরকে তুমি বলে সম্ভোধন করতাম। CMH এর Out Patient এ গিয়ে দেখি জামাল রুগী দেখায় খুবই ব্যস্ত। এক ফাঁকে এগিয়ে এসে বললো,
– কি বন্ধু হাসপাতালে কেন? বস কিছুক্ষণ একটু হালকা হইয়া লই।
জবাবে বললাম,
– না দোস্ত, বসনের সময় নাই খুব একটা জরুরী কামে আইছি।
– কও তইলে।
মতিকে সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম,
– কাইল যাইতাছি, দেখা না কইরা গেলেতো আমারে কাইট্টা ফেলাইতা তাই খোদা হাফেজ কইতে আইলাম। কিন্তু দোস্ত যাওনের আগে একটা শেষ আবদার লইয়া আইছি। নূরের লাইগা ৩ দিনের Attend ‘C’ লেইখা দাও। বেচারার মন-মেজাজ খুবই খারাপ ৷
নূরের ঘটনা কোয়েটার সব বাঙ্গালীর মনেই সমবেদনার উদ্রেক করেছিল। অনেকেই ওর প্রতি ছিল Sympathetic ক্যাপ্টেন জামাল ছিল তাদেরই একজন। মুহুর্তে নির্দ্বিধায় এর একটা চিট প্যাডে লিখে সেটা আমার হাতে দিয়ে জামাল বললো,
– এরই মধ্যে একদিন সময় কইরা যামুনে দেখতে কইও তারে। পোলাডা খামাখা নিজেরে কি বিপদেই না ফেলাইছে আল্লাহই জানেন, Young blood খুনকা গরমি বুঝলা বন্ধু। অনেকটা আফসোস করেই কথাগুলো বলেছিল জামাল।
– ঠিক কইছো দোস্ত। এখন তাইলে যাই, ভাবীরে বুঝাইয়া কইও সময়ের অভাবে দেখা করতে পারলাম না। বুঝতেই পারো কি তাড়াহুড়ার মইধ্যে আছি। আল্লাহ্ হাফেজ।
বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। বিকেল ৩:৩০ মিনিটে ‘বোলান এক্সপ্রেস’ এ তুলে দিতে হবে নূরকে। লাঞ্চ সেরে মতি ও আমি সোজা চলে গেলাম নূরের মেসে। গিয়ে দেখি নূর লুঙ্গি পরে খালি গায়ে শুয়ে আছে।
– Get up you lazy bum !
আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলে লুঙ্গি বাধতে বাধতে উঠে বসলো নূর।
– বিনা প্রশ্নে আমার কথা মেনে নিতে রাজি থাকলে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে পালাতে পারি। বলো রাজি।
আমার কথা বলার ধরণে প্রথমে কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল নূর। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– কিন্ত………
– কোন কিন্তু নয়। সময় নষ্ট না করে বলো রাজি। দৃঢ়তার সাথে জিজ্ঞেস করলাম আবার।
– রাজি। জবাব দিল নূর।
– বেশ এবার শোন মনযোগ দিয়ে- You have 3days Attend ‘C’, means complete bed rest OK? Send this Chit to the Adjutant through your Batman then give him Chutti for 3days. Call him now and do as I said.
নূর তক্ষুণি তার ব্যাটম্যানকে ডেকে তাকে নির্দেশ দিল চিট টা Adjutant এর কাছে পৌঁছে দিয়ে ছুটিতে বাড়ি চলে যাবার জন্য। অপ্রত্যাশিতভাবে একসাথে ৩ দিনের ছুটি পেয়ে ব্যাটার বত্রিশ দাঁত আর বন্ধই হচ্ছিল না। খুশীর ঠেলায় গদগদ হয়ে লম্বা একটা সেল্যুট মেরে ছুটে চলে গেল হুকুম তামিল করতে।
বেশ এবার শোন মনযোগ দিয়ে- You have 3days Attend ‘C’, means complete bed rest OK? Send this Chit to the Adjutant through your Batman then give him Chutti for 3days. Call him now and do as I said.
– এবার কাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও। একটা হ্যান্ডব্যাগে দুই প্রস্ত Extra Change ভরে নাও জলদি। তোমাকে বোলান এক্সপ্রেস ধরতে হবে। লাহোর পর্যন্ত টিকিট থাকবে কিন্ত ভাওয়ালপুরে নেমে যাবে তুমি। সেখানে সার্কিট হাউজে অবস্থান নেবে তুমি। আগামীকাল দুপুর ২ থেকে ৩টার মধ্যে ভাওয়ালপুর ষ্টেশনে আমরা মিলিত হবো ইনশাল্লাহ্। ভাওয়ালপুর পৌঁছে একটা কাজ করতে হবে তোমাকে। সেখান থেকে ভাওয়ালনগর যাবার উপায় কি কি এবং কোন উপায়ে কতটুকু সময় লাগবে সেটা জেনে রাখতে হবে তোমাকে। All the way you will behave like an army officer travelling to your place of posting at Bhawal Nagar. Am I clear?
– Yes Sir.
বলেই ছোট একটা হ্যান্ডব্যাগে অতি প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে নূর তৈরি হয়ে নিল। ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আমরা ছুটলাম রেলওয়ে ষ্টেশন। বোলান এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে ছিল। একটা ফার্ষ্টক্লাশ ক্যুপেতে নূরের জন্য একটা সিট রির্জাভ করা হলো। নির্দিষ্ট কামরায় উঠে বসলাম আমরা। পকেট থেকে ৫হাজার টাকা, একটা পিস্তল এবং ২৫টা গুলি নূরের হাতে তুলে দিলাম। কোন কথা না বলে সেগুলো ব্যাগে ভরে রাখলো নূর। কিছুক্ষণ পর গাড়ি ছাড়ার ঘন্টা এবং হুইসেল দু’টোই বেজে উঠলো। নূরকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
– Take care, see you tomorrow. খোদা হাফেজ।
গাড়ি নড়ে উঠলো। আমরা প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়লাম। তীব্র হুইসেল বাজাতে বাজাতে বোলান এক্সপ্রেস ষ্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমরাও ফিরে এলাম ।
আজ রাতে Div Arty এর তরফ থেকে আমার Farewell dinner. তাই মতিকে মেসে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় বললাম, “কাল এয়ারর্পোটে দেখা হবে।”
মেসে সে রাতে Div Arty-র ব্যান্ড এর সাথে অনেক রাতঅব্দি পানাহার চললো। ব্যান্ডের তালে তালে নাচগানও হলো রেওয়াজ অনুযায়ী। বেশ কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করছিলাম সারাদিনের ব্যস্ততায়। তার উপর মাথায় রয়েছে নূরের ব্যাপারে টেনশন। কিন্তু কিছুই করার নেই। সব চিন্তা মনে চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবেই সব Formalities শেষ করে অনেক রাতে ফিরে এলাম নিজের কামরায়। সেদিন হঠাৎ করে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় বেশ একটু ঠান্ডা পরেছে। তাই বেয়ারা ঘরের ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। সঙ্গে নেবার জিনিসপত্র আগেই গোছগাছ করে রাখা হয়েছে। টেবিলের উপর রাখা আমার সবচেয়ে প্রিয় ফটো এলবাম দু’টো। সাথেই আখরোটের সুক্ষকাজ করা লেটার বক্সে রাখা আছে নিম্মীর লেখা চিঠিগুলো। বেড-সাইড টেবিলের উপর ফটো ষ্ট্যান্ডে রাখা নিম্মীর ছবিটাকে ভীষণ জীবন্ত লাগছে। মনে হচ্ছে ও যেন গভীর দৃষ্টিতে আমাকে পরখ করে দেখছে। এগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কোন সূত্র রাখা চলবে না। এতে করে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ফায়ার-প্লেসের সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পোড়াবার আগে শেষবারের মত এলবামের ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। প্রতিটি ছবির সাথে জড়িয়ে আছে একেকটা স্মৃতি। ফটো দেখা শেষ হলে এলবাম দু’টো ছুঁড়ে দিলাম ফায়ার-প্লেসে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। চিঠিগুলোও ফেলে দিলাম সেই আগুনে। মুহুর্তে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিল সব। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। সযত্নে তুলে রাখা এতদিনের অমূল্য সম্পদগুলোকে এভাবে বিসর্জন দিতে হবে সেটা কখনো ভাবিনি। আগুনের দিকে চেয়েছিলাম। দু’চোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ছিল। অতীতের স্মৃতিতে তলিয়ে গেলাম আমি। মনে পরে গেল নিম্মীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের কথা৷
রিয়াজুল ইসলাম চৌধুরী (বাপ্পি)-র বোন নিম্মী। বাপ্পি আমার ঘনিষ্টতম বন্ধুর একজন। আমি, স্বপন, টুটু, হায়দার, বাপ্পি একে অপরের হরিহর আত্মা। ছুটিতে ঢাকায় এলে ২৪ ঘন্টা একসাথে থাকা, খাওয়া, হৈ হুল্লর করে সময় কাটে আমাদের। কখনো সিনেমা, কখনো পিকনিক নয়তো শিকার এভাবেই আনন্দে কেটে যায় আমাদের সময় ঝড়ের বেগে। এসব কিছু ভালো না লাগলে চলে যাই সিলেটের চা বাগানে, কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি কিংবা কক্সবাজার-টেকনাফ। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে ছুটিতে ঢাকায় এসেছি। হৈচৈ করে কেটে যাচ্ছিল সময়। একদিন হায়দার খবর নিয়ে এলো যমুনার চরে মৌসুমী পাখির আগমন ঘটেছে প্রচুর তাই শিকারে যেতে হবে। শিকারের প্রতি একটা অদ্ভুত নেশা ছিল হায়দারের। সেদিন রাতেই দল বেধে শিকারে বেরিয়ে পরলাম। আরিচা ঘাট পর্যন্ত গাড়িতে তারপর নৌকা যাত্রা। মধ্যরাতের পর খাওয়া-দাওয়ার পর নৌকায় উঠলাম। পরদিন দুপুর পর্যন্ত শিকার করে শেষ বিকেলে ফিরে এলাম। শিকার ভালোই পাওয়া গেছে। ১টা রাজহাস, ৪টা চখা এবং ২০টা বালিহাস। শীতকালে মৌসুমী পাখি সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে বাংলাদেশে ঝাঁকে ঝাঁকে। গরমের শুরুতেই আবার উড়ে ফিরে যায় তুন্দ্রা অঞ্চলে। পাসপোর্ট কিংবা ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নেই তাদের। যখন যেখনে খুশি উড়ে চলে যায় ওরা। শুধুমাত্র মানুষের কাছ থেকেই বৈষয়িক স্বার্থে এই স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। বাসায় ফিরতেই আমার ছোট দুই বোন মহুয়া ও কেয়া বায়না ধরে বসলো, বৃটিশ কাউন্সিলে একটা ফাংশন হচ্ছে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। সারা দিন রাত শিকারের ধকলে সবাই ক্লান্ত৷ কেউই ওদের নিয়ে যেতে রাজি হলো না। ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও আমি ওদের মানা করতে পারলাম না। অনেক কষ্টে বাপ্পিকে সঙ্গে যাওয়ার জন্য রাজি করালাম। যখন বৃটিশ কাউন্সিলে পৌঁছলাম তখন রাত ৯টার উপর। বারান্দায় কয়েকটি মেয়ে দাড়িয়ে আছে দেখতে পেলাম। ফাংশন অথচ লোকজনের ভীড় নেই একদম। গাড়ি পোর্চের নিচে দাড় করাতেই মহুয়া কাচ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এই নিম্মী এদিকে এসো।”
নিম্মীটি আবার কে! দেখলাম একটি মেয়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে এলো।
“কি এত ফাঁকা কেন? প্রশ্ন করলো মহুয়া।
“ফাংশন শেষ। জানালো মেয়েটা।” বাপ্পি ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “তুমি এখনও এখানে কি করছো?
“রিক্সা পাচ্ছি না। জবাব দিল মেয়েটা।” মহুয়াই পরিচয় করিয়ে দিল, “ভাইয়া, নিম্মী বাপ্পি ভাইয়ার বোন আমাদের হলিক্রসে পড়ে।” বাপ্পিদের বাসায় যাওয়া আসা থাকলেও নিম্মীর সাথে আগে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি।
“চলো না ভাইয়া নিম্মীকে নামিয়ে দিয়ে আসি ফাংশন যখন আর দেখাই হলো না।” মহুয়া অনুরোধ জানালো।
“বেশ চল।” নিম্মীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বাপ্পিদের বাসার দিকে রওনা হলাম। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের একহারা গড়নের নিম্মী কেয়া-মহুয়ার সাথে পেছনের সিটে বসেছে। বাপ্পি আমার পাশের সিটে। রিয়ার ভিউ মিরর এ নিম্মীকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। দেখলাম, সুন্দর ফিগারের অধিকারিণী নিম্মী দেখতে আকর্ষনীয় এবং মিষ্টি। সবচেয়ে আকর্ষনীয় তার চুল। ঘনকালো চুলের একটা অসাধারন মোটা বেনী হাটু ছাড়িয়ে প্রায় গোড়ালির কাছ অব্দি ঝুলছে। হালফ্যাশানে বাঙ্গালী মেয়েদের মাঝে এ ধরনের ঘনকালো লম্বা চুল খুব একটা দেখা যায় না। গাড়ো নীল রং এর বুটিদার কামিজ ও চুড়িদার পায়জামা পরেছিল নিম্মী। কথা বলার ধরণও ভীষণ আন্তরিক। সবকিছু মিলিয়ে প্রাণবন্ত উচ্ছল প্রকৃতির নিম্মীকে প্রথম দেখাতেই ভালো লাগলো। সেই ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসা। আশ্চর্য হয়েছিলাম নিজেই। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি জীবনে শুধুমাত্র লেখাপড়ার জন্যই নয় বিভিন্ন কারণে বেশ নাম ডাক ছিল বরাবরই। একনামে পরিচিত ছিলাম বিভিন্ন মহলে। মেয়েদের সাথে মেলামেশার অবাধ সুযোগও হয়েছে ছোটকাল থেকেই। কিন্তু প্রেম-ট্রেমের ধার ধারিনি কখনো। দু’একটা প্রেমপত্র গল্পের বই আদান-প্রদানের মাধ্যমে হাতে এসে পৌঁছায়নি তাও নয়। কিন্তু সেগুলো মনে তেমন একটা দাগ কাটতে সক্ষম হয়নি। ঘটনাগুলো নেহায়েত নেকামী বলেই মনে হয়েছে সবসময়। অবশ্য পছন্দ না হলেও প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে অনেক বন্ধু-বান্ধবকেই নানাভাবে সাহায্য করতে হয়েছে এ পর্যন্ত ক্ষেত্রবিশেষে। ছাত্র রাজনীতি, খেলা-ধুলা, গান-বাজনা, নাটক, সমাজসেবা ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকাটাই ছিল আমার নেশা। তাই মেয়েদের ব্যাপারে ধ্যান দেবার সময় ছিল না মোটেও। কাউকে দেখে তেমনভাবে আকর্ষণও বোধ করিনি কখনো। সেই আমিই কিনা প্রথম দেখার ভলোলাগা থেকে একেবারে ভালোবেসেই ফেল্লাম নিম্মীকে! এমনটিই বোধহয় হয়। যাকে ভালোলাগে তাকে প্রথম দেখাতেই ভালোলাগে। প্রথমে নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হয়তোবা ক্ষণিকের মোহ; কিন্তু না এতো মোহ নয়৷ এরপর যতই দিন গেছে নিম্মীর প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে আমার। গভীর হয়েছে আমার ভালোবাসা। এক অদ্ভুত অনুভূতি! প্রতিদানে নিম্মীও সবটুকু মন উজাড় করে ভালোবেসেছে আমাকে। তার পবিত্র, আন্তরিক ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার গহীন অতলে তলিয়ে গেছি আমি। নিম্মী তার প্রথম যৌবনের কুমারী মনের সবটুকু মাধুৰ্য্য বিলিয়ে দিয়ে একান্ত বিশ্বাসে আমাকে স্বীকার করে নিয়েছিল তার ভালোবাসার মানুষ হিসাবে। আমি স্থান পেয়েছিলাম তার মনের মণিকোঠায়। আমি ধন্য হয়েছি তার ভালোবাসা পেয়ে। আমাদের ভালোবাসাকে সানন্দেই গ্রহণ করে নিয়েছেন দুই পরিবারের সবাই বিশেষ করে গুরুজনরা। খুশী হয়েছে বন্ধু-বান্ধবরা। এবার ছুটি থেকে ফেরার আগে আমাদের বিয়ের ব্যাপারেও সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এ বছরের শেষাশেষি কিংবা আগামী বছরের প্রথম দিকে আমাদের বিয়ে হবে ঠিক হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই দৈবচক্রে সবকিছুই ওলোট-পালোট হয়ে গেল। ভবিষ্যত হয়ে উঠল অনিশ্চিত। ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর কোন চিঠিপত্র পাইনি ওর কাছ থেকে। জানিনা ঠিক এই মুহুর্তে ও কোথায়, কি অবস্থায় আছে! নিম্মীর বাবা জনাব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৬৯ সাল থেকে কোলকাতায় পাকিস্তান দূতাবাসে কূটনৈতিক হিসেবে পোষ্টেড পোষ্টেড আছেন। তিনি নিম্মীর ছোটবোন মানুকে নিয়ে কোলকাতাতেই থাকেন। খালাম্মা মানে নিম্মীর আম্মা, বাপ্পি, নিম্মী এবং নিজের পড়াশুনার জন্য ঢাকাতেই থাকেন অনেকটা বাধ্য হয়েই। ছুটিছাটায় কোলকাতায় যান মানুদের দেখে আসতে। আব্বা, মহুয়া, কেয়া, স্বপন, হায়দার, টুটু, বদি ওদেরও কোন খবরা-খবর নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ওরা কিছুতেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। ওরা নিশ্চয়ই জনগণের সাথে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে। আমি যে ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পাড়ি জমাচ্ছি তার জন্য একজন পদস্থ সরকারি অফিসার হিসেবে তার এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর অভিসম্পাত নেমে আসতে পারে। পাক-বাহিনীর অত্যাচারের শিকারেও পরিণত হতে পারেন তারা। কথাটা ভেবে মনটা হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে পড়লো। ব্যথায় বুকটা ভারী হয়ে উঠলো। কিন্তু না, এ পর্যায়ে এমনভাবে দুর্বল হওয়া চলবে না। সবকিছুর বিনিময়ে এমনকি জীবনের পরোয়া না করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্তে অটল থাকতেই হবে। ব্যক্তি, গোষ্ঠি, পারিবারিক সব স্বার্থ থেকে দেশ এবং জাতীয় স্বার্থ অনেক বড়। সে প্রশ্নে কোন আপোষ করা চলবে না কিছুতেই। আমার এই সিদ্ধান্তে-র ফলে কারো কিছু হলে দুঃখ পাবো কিন্তু জাতীয় প্রয়োজনে কোন অবদান রাখতে না পারলে নিজের কাছে নিজেই হেয় হয়ে যাবো। কাপুরুষতার গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে সারাজীবন। ইতিমধ্যে অনেক দিনের জমানো স্মৃতির নিদর্শনগুলো সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সারাদিনের ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত শরীরে। আগামীকাল ভোর ৭টায় এয়ারর্পোটে যেতে হবে তাই শ্লথগতিতে উঠে পরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলাম।
পরদিন ভোর ৬টায় অভ্যাসমত ঘুম ভেঙ্গে গেল। মেস ওয়েটার বেড টি দিয়ে গেল। বেড টি শেষে প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করে শেষ বারের মত ডাইনিং হলে গেলাম নাস্তার জন্য। হেড ওয়েটার ফিদা খান নিজেই সমাদর করে নিজের তদারকিতে নাস্তা করালো। নাস্তা শেষে বয়, বাবুচী, ওয়েটার এবং হেড ওয়েটার সবাইকে বকশিশ দিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। মেসের সামনের কারপার্ক গাড়িতে ভরে গেছে। Div Arty -র প্রায় সব অফিসারই জমায়েত হয়েছে আমাকে এয়ারপোর্টে See Off করতে যাবার জন্য। ওদের আন্তরিকতা আমাকে বিল করে তুলেছিল। সামরিক জান্তার পাশবিকতা আর এদের বন্ধুসুলভ আন্তরিকতায় কত তফাৎ! ভাবছিলাম আজ ইয়াহিয়া খান ও তার দোসররা রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাচারের যে ষ্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছে তার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কতটুকু সমর্থন রয়েছে ? সময় হয়ে এল। আমার CO মিয়া হাফিজ এসে বললেন,
– Sharif it’s time, let’s go.
– Yes Sir.
বলে যারা এয়ারপোর্টে যাবে না তাদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কর্নেল হাফিজের পাশে গাড়িতে উঠে বসলাম। তিনি গাড়িতে ষ্টার্ট দেবার সাথে সাথে যারা যাবার তারা সবাই যার যার নির্দিষ্ট গাড়িতে উঠে বসলো। কাফেলা চললো এয়ারপোর্টের দিকে। মিনিট বিশেকের মধ্যেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেলাম। মতি আমার আগেই পৌঁছে Check-In করে অপেক্ষা করছিল।
– আরে মতি তুমি এখানে? ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা করলাম।
– মুলতান যাচ্ছি পেশাওয়ারের পথে। জবাবে বললো মতি।
– I see that’s good. প্লেনে তাহলে গল্প করে সময়টা ভালোই কাটবে। বললাম আমি। Check-In পর্ব শেষ করে সবার সাথে কথাবার্তা বলছিলাম, হঠাৎ দেখি Div Art Commander ব্রিগেডিয়ার বাদশা এয়ারপোর্টে অপ্রত্যাশিতভাবে এসে হাজির। ব্রিগেডিয়ার বাদশা আমাকে A young good gunner officer হিসেবে খুবই স্নেহ করতেন। ব্রিগেডিয়ার বাদশা জাতিতে পাঠান। তিনি এগিয়ে আসতেই আমরা সবাই সেল্যুট করে দাড়ালাম ।
– আলাকা শরিফ তু হামকো ছোরকে যা রাহা হ্যায় ইলিয়ে হামে দুখ্ হ্যায়, লেকিন এহি জিন্দেগী হ্যায় বেটা। নয়া ইউনিটমে আচ্ছা রেহ্া অওর খোশ রেনা এহি মেরা দোয়ায়ে হ্যায়।
পিতৃসুলভ ব্রিগেড কমান্ডারের কথাগুলো মনে দাগ কেটেছিল। বোডিং এর ঘোষণা হল। সবার সাথে কোলাকুলি করে বিদায় নিলাম। ব্রিগেডিয়ার বাদশার ইশারায় কয়েকজন Young Officers কাঁধে তুলে নিয়ে He was a jolly good fellow বলতে বলতে আমাকে প্লেনের সিড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গেল। পুরনো বন্ধুদের ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে প্লেনে উঠে বসলাম। মতিও উঠে বসেছে। জানালা দিয়ে দেখলাম সবাই লাইন করে দাড়িয়ে হাত নাড়ছে। অল্পক্ষণ পরেই প্লেন ষ্টার্ট নিয়ে Take-Off করলো। সবাই তখনও দাড়িয়ে। কেউ কেউ রুমাল নাড়িয়ে শেষ বিদায় জানাচ্ছিল। প্লেন এয়ারপোর্টের উপর দু’টো চক্কর দিয়ে মেঘের ভিতর দিয়ে উপরে উঠে গেল। সবাইকে পিছনে ফেলে প্লেন উড়ে চললো মুলতানের উদ্দেশ্যে। এভাবেই শুরু হলো আমাদের নিরুদ্দেশ যাত্রা। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই আমাদের বহনকারী ফোকার- ফ্রেন্ডশিপ বিমানটি মুলতান এয়ারপোর্টে অবতরণ করল। প্লেন থেকে বেরুতেই মুখে লাগলো গরম বাতাসের ঝাপটা। কোয়েটার তুলনায় মুলতানের আবহাওয়া অনেক উষ্ণ ভাওয়ালপুর ভাওয়ালনগরের দিকে উষ্ণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। ছোট এয়ারপোর্ট ক্যান্টনমেন্টে এরিয়ার মধ্যেই অবস্থিত। প্লেন থেকে অবতরণ করে ট্রানজিট লাউঞ্জে না গিয়ে মতির সাথে সোজা চলে গেলাম Arrival এ। ওখানে PIA কাউন্টারে গিয়ে আমার লাহোর যাওয়া Cancel করে দিয়ে বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট থেকে। মুলতান শহর এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় ৫মাইল দূরে অবস্থিত। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা চলে এলাম শহরে। কিছু কেনাকাটা করার ছিল। Survival Kit, Firstāid Box, Anti Snake Bite Kit এগুলো সব সঙ্গে করে আনা হয়েছে। তিনজনের জন্য Desert Shoes, এক বোতল ব্রান্ডি, সুইটস-চুইঙ্গাম, বিস্কিটস, কিছু ড্রাই ফ্রুটস প্রভৃতি কেনা হলো।
তারপর গেলাম সোনার দোকানে। ওখানে দু’টো আংটি বানালাম একেকটা দেড় ভরি ওজনের। একটাতে খোদাই করলাম ‘ s ‘ এবং অন্যটাতে ‘ M ‘। আমি ও মতি আংটি দু’টো পরে নিলাম। কেনাকাটার পাঠ চুকিয়ে গেলাম Railway Station-এ। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম ১২টার ট্রেন ধরলে দু’টো-সোয়া দু’টোর মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ভাওয়ালপুর। ঠিক করলাম দুই বাঙ্গালীর একসঙ্গে সফর করাটা ঠিক হবে না। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো মতি যাবে ট্রেনে আর আমি যাব বাসে। বাসে করে আমি মতির আগেই পৌঁছে যাব ভাওয়ালপুর। ওখানে ষ্টেশনে মিলিত হব আমরা। মতিকে ট্রেনে তুলে দিয়ে ট্যাক্সি করে গিয়ে পৌঁছালাম বাস ষ্ট্যান্ডে। প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর বাস ছাড়ছে ভাওয়ালপুরের উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষমান বাসে উঠে বসলাম। মালপত্রের বেশিরভাগই মতি নিয়ে গেছে সাথে। আমার কাছে রয়েছে হালকা ছোট্ট একটা ব্যাগ। দু’টো বাজার আগেই পৌঁছে গেলাম ভাওয়ালপুর। বাস ষ্ট্যান্ডে নেমে টাঙ্গা করে পৌঁছলাম ষ্টেশনে। ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নূর প্ল্যাটফর্মের একপ্রানে- একটা খবরের কাগজ হাতে দাড়িয়ে আছে। সোয়া দু’টোর দিকেই মতির ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে এসে দাড়ালো। মতি নামলো ট্রেন থেকে। একে অপরের সাথে চোখাচোখি হল কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বললাম না৷ তিনজনেই আলাদাভাবে সার্কিট হাউজে পৌঁছলাম। নূরের ঘরে ঢুকেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম উল্লাসে। নূর আগেই আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। ঘরেই লাঞ্চ করলাম। লাঞ্চের সময় নূর জানালো পথে ওর কোন অসুবিধেই হয়নি। আরো জানালো ভাওয়ালপুর থেকে ভাওয়ালনগর দু’ভাবে যাওয়া সম্ভব। ট্রেনে করে গেলে লাগবে ঘন্টা তিনেক। ট্রেনের সময় বিকেল ৪টা। আর ট্যাক্সিতে গেলে সময় লাগবে বড়জোর ঘন্টা দু’য়েক। ঠিক হলো ট্যাক্সিতেই যাব। কারণ ভাওয়ালনগর থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার ট্রেন ধরতে হবে আমাদের। প্রতিদিন দু’টোই ট্রেন যায় ভাওয়ালনগর থেকে ফোর্ট আব্বাস, একটা সকালে অপরটি সন্ধ্যায়। সাড়ে সাতটার ট্রেন মিস করলে পুরো রাতটা কাটাতে হবে ভাওয়ালনগরে। সেটা হবে আমাদের জন্য খুবই বিপদজনক কারণ সমস্ত ভাওয়ালনগরটাই একটা ক্যান্টনমেন্ট। লোকাল ট্রেনের সময়ের কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। কোনরকম রিস্ক নেয়া চলবে না। ট্যাক্সিতে গেলে সাড়ে সাতটার অনেক আগেই পৌঁছে যাবো ভাওয়ালনগর। কিছু সময় বিশ্রাম করে বিকেল ৪টায় একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে এনে রওনা হলাম ভাওয়ালনগরের উদ্দেশ্যে। সিন্ধী ড্রাইভার। ওকে বললাম, সাতটার মধ্যে ভাওয়ালনগর পৌঁছে দিতে পারলে বকশিশ মিলবে। তরুণ ড্রাইভার জবাবে বললো,
– কই বাতই নেহি হ্যায় সাব। আপকো সাতসে পেহলেই পৌঁচা দেঙ্গে।
উল্কাবেগে ছুটে চলেছে ট্যাক্সি। শেভ-ইম্পালা গাড়ি। সৌখিন ছোকরা ক্যাসেটে ফিল্মী গান লাগিয়ে দিল। আমরা চুপচাপ বসে গান শুনছিলাম আর ভাবছিলাম ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যত। এক সময় ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। হঠাৎ বিকট একটা শব্দে চমকে তিনজনেই জেগে উঠলাম। একটা ঝাকুনি দিয়ে ট্যাক্সি ততক্ষণে থেমে গেছে।
– কি হলো? ব্যাপার কি?
প্রায় একেইসাথে বলে উঠলাম তিনজনে
– দেখতে হেঁ সাব।
দেখতে হেঁ সাব।
বলে গাড়ি থেকে নেমে গেল ড্রাইভার। কিছুক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফিরে এসে বললো,
– গাড়িকা ক্র্যাঙ্কশাফ্ট টুট গিয়া।
বলে কী ব্যাটা !
– ফির আব হাম কেয়া করেঙ্গে? জিজ্ঞেস করল নূর।
– ঘাবড়াও মাত স্যার, পাঁচছে মিল রেহেতে হ্যায় কোই না কোই সোয়ারী জরুর মিল যায়েগা উসমে বেঠা দেঙ্গে আপলোগকো।
কি সর্বনাশ! তবে কি ঘাটে এসে তরী ডুবল? গাড়িটাকে সবাই মিলে ঠেলে রাস্তার সাইডে রাখা হল। অন্য কোন গাড়ি না আসা পর্যন্ত কিছুই করার নেই। অপেক্ষা করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। দূরে ভাওয়ালনগরের বাতিগুলো এক সময় জ্বলে উঠল। ৭টা বেজে গেল কোন গাড়ির লক্ষণ নেই। অস্থির হয়ে উঠলাম সবাই। হতাশায় মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলাম প্ৰায়৷ হঠাৎ দূরে গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল; কিছু একটা আসছে ভাওয়ালপুরের দিক থেকেই। রাস্তা ব্লক করে দাড়ালাম চার জনেই। যাই হোক না কেন থামাতে হবে। কাছে আসতে দেখলাম একটা ল্যান্ডরোভার। আমরা হাত দিয়ে ইশারা করায় গাড়িটা থামল। Roads & Highways এর এক ইঞ্জিনিয়ার যাচ্ছেন ভাওয়ালনগর। ভদ্রলোককে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম।
তিনজন আর্মি অফিসারের দুর্গতি দেখে ভদ্রলোক সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন,
– আপনাদের কষ্ট না হলে আমি আপনাদের নিয়ে যেতে পারি।
কষ্ট ! হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম। ধন্যবাদ জানিয়ে তাড়াতাড়ি ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে মালপত্র নিয়ে জিপে উঠে বসলাম। অধাঘন্টার মধ্যেই ভাওয়ালনগর পৌঁছে গেলাম। তখন রাত পৌনে আটটা। আমাদের ট্রেন নিশ্চয়ই এতক্ষনে ছেড়ে চলে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
– কোথায় নামবেন?
ষ্টেশন এর কথা না বলে বললাম,
– শহরের যে কোন খানে নামিয়ে দিলেই চলবে।
এমনটি তো হবার কথা নয়। ট্রেন চলে কেন ষ্টেশনে? ট্রেন কি তাহলে এখনও
Town Centre এ নামিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। সেখান থেকে একটা টাঙ্গা করে কাছেই ষ্টেশনের দিকে রওনা হলাম। ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি অসম্ভব ভীড়। যাবার পর ষ্টেশন থাকবে জনশূন্য তাহলে এত লোক আসেনি? হঠাৎ করে কিছুটা আশার আলো ঝলকে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ষ্টেশন মাষ্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– ফোর্ট আব্বাসের ট্রেনের খবর কি?
দু’বাক্যে ষ্টেশন মাষ্টার বললেন,
– ট্রেন লেট, এখনও এসে পৌঁছেনি।
জানে পানি ফিরে এল। দৌড়ে গিয়ে মতি ও নূরকে খবরটা দিতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওরা লাফ দিয়ে টাঙ্গা থেকে নেমে পড়ল। কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে টাঙ্গার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে প্লাটর্ফমে চলে এলাম। পথে একটি ভিক্ষুক দাড়িয়েছিল। আনন্দের আতিসয্যে একশ টাকার একটি পুরো নোটই তাকে দিয়ে দিলাম। সোয়া আটটায় আমাদের ট্রেন এল। ফাষ্টক্লাসের তিনটি টিকেট কাটা হল ফোট আব্বাস পর্যন্ত। বর্ডার এলাকার ট্রেন। আমাদের মত ফৌজি ছাড়া ফাৰ্ষ্টক্লাশের যাত্রি বিরল। অতি সহজেই একটা খালি কামরা পেয়ে উঠে বসলাম। ট্রেনে উঠেই বুফে কার থেকে ডিনার আনাবার বন্দোবস্ত করা হল। খাবার সার্ভ করে গেল বেয়ারা। দরজা বন্ধ করে খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে নিলাম। ট্রেন ইতিমধ্যে চলতে শুরু করেছে। খাওয়া শেষ করার পর পদযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হল। সবাই ডার্ক কালারের কাপড় পরে নিলাম। আমাদের কাছে তখন সর্বমোট প্রায় হাজার বিশেক টাকা। ওগুলো কাপড়ের বিভিন্ন চোরা পকেটে ঢোকানো হল। স্যুটকেস থেকে হ্যাভারস্যাক বের করে ওতে তিন জনের আর এক প্রস্ত করে কাপড় নেয়া হল। প্রয়োজনীয় সাথে নেবার সবকিছু রাখা হল হ্যাভারস্যাক এ। ম্যাপ বের করে নাইট মার্চ চার্ট আঁকা হল। পাকিস্তানের মটরাইজড ইনফ্যানট্রি ডিভিশনের ডিফেন্সিভ এলাকার মধ্য দিয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির একটি ট্যাংক রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারস এর পাশ ঘেষে যেতে হবে আমাদের। রাস্তায় পড়বে এ্যান্টিট্যাংক অবস্ট্যাকল মাইন ফিল্ড। এদের মাঝে গ্যাপ বের করে নিয়ে যাত্রাপথ নির্ধারন করা হয়েছে। পথে দুই তরফের পেট্রোল পার্টির মোকাবেলায় পড়তে হতে পারে। সিদ্ধান্ত নেয়া হল যেকোন উপায়েই হউক own troops and enemy Troops -কে এড়িয়ে চলতে হবে আমাদের। নেহায়েত বিপাকে পড়লেই সংঘর্ষের মাধ্যমে শত্রুকে পরাস্ত করার উদ্যোগ নেয়া হবে । কোন অবস্থাতেই ধরা পড়া চলবে না। ধরা পড়ার আগেই আমরা আত্মহত্যা করব। কোন কারণে অবস্থার প্ররিপ্রেক্ষিতে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে ব্যক্তিগত উদ্যোগে করনপুর পৌঁছবার চেষ্টা করতে হবে। কম্পাসে রুট এবং বিয়ারিং সেট করা হল, পরা হল Desert shoes. হাতিয়ার এবং গুলি নিজেদের মাঝে ভাগ করে নিলাম। ম্যাপ, কম্পাস, বাইনোকুলার, নাইট মার্চ চাটর্, একটি টর্চ, একটি কম্বল এবং সাথে নেবার হ্যাভারস্যাকটি ছাড়া সবকিছুই সুবিধামত কোন জায়গায় লুকিয়ে ফেলতে হবে। নিজেদের ID Card ছাড়া অন্যান্য সব কাগজপত্র পুড়িয়ে টয়লেট দিয়ে ফেলে দেয়া হল ট্রেন থেকে। ক্যামেরা দু’টো হ্যাভারস্যাকে ভরে নিলাম। ছোট্ট কোরআন শরীফটাও নেওয়া হল হ্যাভারস্যাকে। অর্ডার অফ মার্চ মতি আগে তারপর আমি, পেছনে নূর। হ্যাভারস্যাক পালাক্রমে বহন করা হবে। মার্চের সময় প্রতি এক ঘন্টা অন্তর দশ মিনিট বিরতি। বিরতিকালে কম্বলের নিচে ঢুকে টর্চের আলোয় ম্যাপ দেখে নেয়া হবে, ঠিক পথে যাচ্ছি কিনা? প্রয়োজনে কম্পাস বিয়্যারিং এ্যডজাষ্ট করা হবে। আমরা তিনজনই কমান্ডো ট্রেনিংপ্রাপ্ত। নাইট মার্চের সব কৌশলই আমাদের নখদর্পনে।
রাত দশটা বেজে পনেরো মিনিটে আমাদের ট্রেন হারুনাবাদ ষ্টেশনে এসে পৌঁছল। ছোট্ট ষ্টেশন৷ প্ল্যাটফর্মের যেখানে আমাদের বগিটা গিয়ে থামল সেখানে বেশ জমাট অন্ধকার। আমরা নেমে পড়লাম। অল্প কয়েকজন যাত্রী উঠা-নামা করল। আমরা আধাঁরে চুপ করে দাড়িয়ে থাকলাম। অল্পক্ষণ পর হুইসেল দিয়ে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল। যে সমস্ত যাত্রি ট্রেন থেকে নেমেছিল তারা সবাই ষ্টেশনের চেকিং গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। চুপচাপ দাড়িয়ে আমরা জায়গাটা ভাল করে দেখে নিচ্ছিলাম। অপর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক আলোয় ষ্টেশন ঘরটার সামনে কিছুটা অংশই আলোকিত হয়েছিল। প্ল্যাটফর্মের বেশিরভাগ অংশই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ষ্টেশনের বাইরে একটা মাঝারি আকারের উঠান, কয়েকটি চায়ের দোকান, তাদের সামনে কয়েকটি টাঙ্গা যাত্রিদের অপেক্ষা করছে। চার পাঁচশ গজ দূরে হাইওয়ে রেল লাইনের প্রায় সমান্তরালভাবেই উত্তর দক্ষিনে চলে গেছে। মাঝে মধ্যে দূরপাল্লার বড় বড় ট্রাকগুলো আওয়াজ তুলে ভীষণ বেগে আসা-যাওয়া করছে। রাস্তার ওপারেই হারুনাবাদ শহর। শহর বলতে একটি বর্ধিষ্ণু বাজার। বাজারের চারদিকে জনবসতি। আমরা হারুনাবাদ শহরের ডানদিক দিয়ে প্রয়োজনীয় দুরত্ব বজিয়ে রেখে যাত্রা শুরু করব। একেতো বর্ডার এলাকার মরু অঞ্চল, রাতও বেশ হয়েছে, লোকজন নেই খুব একটা, সমস্ত শহরটাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা প্ল্যাটফর্ম খালি হয়ে যাবার পর ষ্টেশনের সদর দরজার দিকে না গিয়ে প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে এলাম। অতি সাবধানে হাইওয়ে ক্রস করে একটা বাবলা ঝোপের মধ্যে অবস্থান নিলাম। হারুনাবাদ শহরের বসতির শেষপ্রান্ত থেকেই শুরু হয়েছে মরুভূমি। উচু-নিচু বালির পাহাড়। মাঝে মধ্যে কাটার ঝোপঝাড়। যে জায়গায় পানির আধার রয়েছে সেখানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট গৃহস্থালি। তাকে কেন্দ্র করেই ছোট ছোট চাষাবাদের খামার। অরহর, কলাই, যব, ভুট্টার ক্ষেত। মোটামুটি এ ধরণের টেরেনই (Terrain) অতিক্রম করে যেতে হবে আমাদের। যাত্রা শুরু করার আগে আমি ও মতি কম্বলের নিচে বসে কম্পাস সেটিং ও নাইট মার্চ চার্ট ঠিক করে ম্যাপের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। ম্যাপ অনুযায়ী আমাদের অবস্থানের অদূরেই একটি কারেজ থাকার কথা। কারেজ হল মরু অঞ্চলে গভীর কুয়োঁর সারি। এগুলো খুঁড়ে তাতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা হয় প্রয়োজনমত ব্যবহার করার জন্য। আবাদি জমিতে জলসেচের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে কারেজ থেকে। নূরকে পাঠানো হল কারেজটি খুঁজে বের করার জন্য। উদ্দ্যেশ্য আমাদের সাথের মালপত্র সব কারেজের কুয়োতেই ডাম্প করব। সেটাই হবে সবচেয়ে নিরাপদ। অল্পক্ষণ পরেই নূর কারেজের সন্ধান বের করে ফিরে এল। আমরা সবাই হ্যাভারস্যাকটা রেখে বাকি মালপত্র সব নিয়ে গিয়ে কারেজের একটি কুয়োতে ফেলে দিয়ে এলাম। এবার সর্বিকভাবে যাত্রা শুরু করতে আমরা প্রস্তুত।
বিসমিল্লাহ্ বলে আমরা পদযাত্রা শুরু করলাম শ্রীকরনপুরের উদ্দেশ্যে। ঘন্টায় গড়ে চার থেকে পাঁচ মাইল বেগে চলতে হবে। আকাশে বড় একটা চাঁদ। সপ্তঋষীর মন্ডল, দ্রুবতারা, ক্যাসোপিয়া, ওরিয়েন্ট বেল্ট সবগুলোই দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। কম্পাস ছাড়া তারকারাজির সাহায্যেও আমাদের পদযাত্রা চলতে পারে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে কিভাবে তারকারাজির সাহায্যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে সেটা আগেই ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছি প্রত্যেকে। প্রথম ঘন্টা কেটে গেল নির্বিঘ্নে। পথে কোন লোকজনের সামনা-সামনি হতে হয়নি। বিরতি কাটিয়ে চলা শুরু হল আবার। মিনিট দশেক পর থমকে দাড়িয়ে পড়ে ইশারা করল মতি। এন্টি-ট্যাংক অবস্ট্যাকল সামনে। একটি খাল, খালে পানি। খালের দুই দিকেই ৬০ ́ এ্যাঙ্গেলের বেশি উচু Any obstacle is always covered by fire তাই ক্রসিং এর আগে প্রথমে রেকি করতে হবে। মতি ও আমি চললাম। একে অপরকে কভার করে চলেছি। কিছু হলে যাতে অবস্থার মোকাবেলা করা যায়। নূর অপেক্ষায় থাকল একটি বাবলা ঝোপের আড়ালে। রেকি করে দেখলাম। খালে বুক পর্যন্ত পানি। হেটেই ক্রস্ করা যাবে অসুবিধা নই। স্রোতও নেই তেমন। পাড়ে বসে ইনফ্রারেড বাইনোকুলার দিয়ে ক্রসিং এলাকাটা ভাল করে দেখে নিচ্ছিলাম। মতি ফিরে গিয়ে নূরকে সাথে করে নিয়ে এল। অল ক্লিয়ার এর আদেশের সাথে সাথে একে একে ট্যাকটিক্যাল ক্রসিং শুরু হল। সবার শেষে আমিও পার হয়ে গেলাম। ওপারে উঠে রুট অনুযায়ী আবার যাত্রা শুরু করলাম। গতি এবং সময়ের সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে অবিরাম ছুটে চলেছি নিঃশব্দে। ইশারা সঙ্কেতে প্রয়োজনমত ভাবের আদান-প্রদান চলছিল। আর দশ মিনিট হাটলেই দ্বিতীয় বিরতি। মতি সঙ্কেত দিল। সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম। দেখলাম চারটি উটের একটি ছোট কাফেলা। একটি বর্ডার পেট্রোল মরু অঞ্চলে এভাবেই একটি BOP (Border Observation Post) থেকে অন্য BOP –তে পেট্রোলিং করা হয়ে থাকে উটের পিঠে চড়ে। ক্রলিং করে কাছেই কাটা ঝোপের মাঝে আস্তে ঢুকে গিয়ে পজিশন নিয়ে নিথর হয়ে শুয়ে থাকলাম। পেট্রোলটি উত্তর দিকে চলে গেল। ওরা হদিসও পেলনা তাদের উটের প্রায় পায়ের নিচেই শুয়ে রয়েছে জলজ্যান্ত তিনজন লোক। আমরা উঠে আবার হাটা শুরু করলাম। দ্বিতীয় বিশ্রামের পর কিছুদূর যেতেই মাটি থোড়ার শব্দ দুর থেকে ভেসে এল। থমকে দাড়িয়ে পড়লাম আমরা। ম্যাপ অনুযায়ী এখানেতো কোন পক্ষেরই কোন ডিফেনসিভ পজিশন থাকার কথা নয়। তবে মাটি খুঁড়ছে কারা? মতিকে পাঠানো হল রেকি করতে। একটি নতুন ডিফেন্সিভ লাইন তৈরি করতে বাংকার খোঁদা হচ্ছে। তাই নির্ধারিত রুট থেকে একটু বেকিয়ে কিছুদূর যেয়ে পরে আবার নির্ধারিত রুটে ফিরে আসতে হবে আমাদের। সেভাবেই কম্পাস বিয়ারিং এবং নাইট মার্চ চার্ট সেট করে আবার যাত্রা শুরু করলাম। ডিফেন্সিভ পজিশন বাইপাস করে এগিয়ে চললাম আমরা।
এখানে আর একটি নালা কেন? তবে কি আমরা ভুল পথে এগোচ্ছি? যাত্রা থামিয়ে ঝোপের আড়ালে তিনজনেই কম্বলের তলায় ঢুকে ম্যাপ দেখতে লাগলাম গভীর মনোযোগ দিয়ে। না আমরা ঠিক পথেই চলেছি। ওটা নতুন করে খোঁড়া হয়েছে। তবে সেটার অবস্থান ম্যাপের মার্কিং-এ নেই কেন? আমরা বর্ডার ক্রস করে ভারতীয় ডিফেন্সের সীমানায় ঢুকে পড়েছি। ঘড়িতে তখন আড়াইটা বাজে। হিসেবমত আমরা এখন ভারতীয় সীমার ভিতরে। এটা ভারতীয় ডিফেন্স এর অবস্ট্যাকল নতুন করা হয়েছে বিধায় ম্যাপের মার্কিং-এ নেই। একইভাবে সতর্কতার সাথে খালটা ক্রস্ করে পাড়ে উঠে এলাম। এখন থেকে বিপদের ঝুঁকি অনেক বেশি। চলতে হবে খুব সাবধানে। আর এক দেড় ঘন্টার মধ্যেই পৌছে যাবার কথা শ্রীকরনপুর শহরের সীমানায়। খালের পরই দেখলাম বাংকারে ভারতীয় সাজোয়া বাহিনীর ট্যাংকগুলো ডিপ্লয় (Deploy) করা আছে। বাংকারগুলো থেকে মাঝে মাঝে মানুষের কথোপকথোনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। গভীর রাত; তাই সমস্ত এলাকা জুড়ে ছিল অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। আমাদের এগিয়ে চলার জন্য এ ধরণের পরিবেশ অতি অনুকুল। চারিদিকে সর্তক দৃষ্টি রেখে ক্ষিপ্র গতিতে ভারতীয় ডিফেন্স এর বুহ্য ভেদ করে এগিয়ে চললাম আমরা। কেউ কিছু টের পেল না। বেশ কিছুদূর চলে এসেছি। হঠাৎ দেখি অল্প দুরত্বে কয়েকটি ট্যাংক। কতগুলো গাড়ি সেগুলোকে ঘিরে রয়েছে। বুঝলাম এটি হেডকোয়ার্টারস। ঐ অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে চুপিসারে এগিয়ে চললাম গন্তব্যস্থলের দিকে। ইতিমধ্যে দূরদিগন্তে শ্রীকরনপুরের আলোকচ্ছটা দেখা যাচ্ছিল। আর মাত্র চার/পাচঁ মাইলের পরই পৌঁছে যাবো শ্রীকরনপুরে। আমাদের জোশ দ্বিগুন হয়ে গেল। পথের ক্লান্তি ভুলে গিয়ে প্রায় দৌড়ে এগুতে থাকলাম সেই আলোকচ্ছটার দিকে। পৌনে চারটায় পৌঁছে গেলাম শ্রীকরনপুর শহরের সীমানায় একটি গ্রামে। গ্রামের প্রায় সবগুলি ঘর মাটি দিয়েই গড়া। প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনা মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। গ্রামের ভেতর কুকুর ডাকছে। আমরা একটি পরিত্যাক্ত বাড়ির উঠোনে গিয়ে বসলাম। উঠোনটিও মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বসে বসে ভাবছি এখন আমাদের কি করা উচিত? ঠিক এ মুহুর্তে এমন অসময়ে জনবিরল শহরে আমাদের ঢোকা ঠিক হবে কিনা? অপরিচিত শহরে এমন অসময়ে তিনজন লোক ঘোরাঘুরি করাটা সন্দেহজনক হবে। তাই ঠিক করা হল সকাল হওয়ার পর আমরা শহরে ঢুকে জনগণের মধ্যে মিশে যাবো। তারপর ঠিক করা হবে কি হবে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। চুপচাপ বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ট্রেনের আগমনের আওয়াজ পেলাম। দেয়ালের বাইরে উকি মেরে দেখলাম প্রায় ৬-৭শত গজ দূরে একটি ট্রেন ফোঁস ফোঁস করতে করতে এসে থামল। বুঝলাম এটা একটা ষ্টেশন। মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হল ট্রেনে করে এই মুহুর্তেই পালাতে হবে বর্ডার এলাকা ছেড়ে। দৌড়ে ছুটলাম ষ্টেশনের দিকে। কাছে পৌঁছে দেখলাম লাল রঙ্গের একটি ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে আছে। কোথাকার ট্রেন কোথায় যাবে কিছুই জানি না; শুধু বুঝলাম এটা যাত্রী বহনের ভারতীয় ট্রেন। ষ্টেশনে লোকজন একদম কম। দৌড়ে গিয়ে একটি খালি কামরায় উঠে গেলাম নির্দ্বিধায়। উঠেই দরজা-জানালা ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর ট্রেন সিটি বাজিয়ে ছেড়ে দিল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাচঁলাম প্ল্যাটফর্মে উঠেই লক্ষ্য করেছি ষ্টেশনটির নাম শ্রীকরনপুর। শ্রীকরনপুর রাজস্থান প্রভিন্সের জেলা শ্রীগঙ্গানগরের অধীন একটি সাব ডিভিশন। আমাদের লক্ষ্য দিল্লী পৌঁছানো। ট্রেনতো যাচ্ছে দক্ষিনে কিন্তু আমাদের যেতে হবে উত্তর দিকে। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটি একটি ষ্টেশনে এসে দাড়াল। একটি জংশন ষ্টেশন। উল্টো দিক থেকে আর একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনের আগমন ঘটল। আমরা আস্তে করে ট্রেন বদল করে অন্যটির একটি খালি কামরায় উঠে বসলাম। আমাদর ট্রেনটাই আগে ছাড়ল। চলেছি উত্তর দিকে। পথিমধ্যে আবার শ্রীকরনপুর পড়ল। করনপুর পেছনে পড়ে থাকল। আমাদের ট্রেন আমাদের নিয়ে ছুটে চলল। শারিরীক ক্লান্তি এবং মানসিক উৎকন্ঠা সব মিলিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না৷ হঠাৎ ঝাঁকুনিতে জেগে উঠলাম। জানাল খুলে দেখি সকাল হয়ে গেছে। ষ্টেশনের নাম শ্রীগঙ্গানগর। সবাই মহা খুশি। নেমে পড়লাম ষ্টেশনে। বর্ডার থেকে তখন আমরা অনেকে ভিতরে চলে এসেছি। আপার ক্লাস ওয়েটিং রুমে যেয়ে ডুকলাম। হাত মুখ ধুয়ে পোষাক বদলিয়ে ভদ্র হয়ে নিলাম প্রথমে। তারপর বসলাম ঠিক করতে, কি করা যায়? ঠিক হল এখন থেকে আমরা তিনজনই কোলকাতা বিশ্বব্যিালয়ের ছাত্র। স্টাডি ট্যুর-এ বেড়িয়েছি, পুরো রাজস্থান ঘুরে বেড়াচ্ছি। তিনজনেই হিন্দু নাম গ্রহণ করলাম। আমি হলাম শ্রী সৌমেন ব্যানার্জি। মতি শ্রী মনোজ বোস আর নূর শ্রী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। টাকা-পয়সার বন্দোবস্ত করতে হবে। কোলকাতা থেকে আগত বাঙ্গালী ছাত্র তাই পাকিস্তানী টাকা ভাঙ্গানো বিপদজনক হবে। ঠিক হল আংটি দু’টো বিক্রি করার চেষ্টা করতে হবে। ষ্টেশন মাষ্টারের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম শহর ষ্টেশন থেকে প্রায় এক মাইল দূরে অবস্থিত। দোকানপাট ৯টার আগে খুলবে না। অগত্যা ৯টা পর্যন্ত ওয়েটিং রুমেই অপেক্ষা করতে হবে। ঠিক ৯টায় তিনজনই বেরিয়ে পড়লাম। আমার ও মতির গলায় ঝুলিয়ে নিলাম ক্যামেরা দু’টো, নূরের পিঠে হ্যাভ্যারস্যাক। চোখে রেবনের সানগ্লাস, টুরিষ্টের মতই লাগছিল তিনজনকে। শহরে পৌঁছে দেখলাম কয়েকটা রাস্তাকে কেন্দ্র করেই ডিষ্ট্রিক হেডকোয়ার্টারস গঙ্গানগর শহর। মফস্বল শহর তাই খুব একটা বড় নয়। শহরের শহরের প্রধান রাস্তাগুলির দুই দিকে সব দোকানপাট। একসাথে দুই তিনটি সোনার দোকান। সবচেয়ে বড়টিতে গিয়ে ঢুকলাম। দোকানের মালিক ধুতি নিমা পড়া তিলক কাটা মোটা গোছের একটি লোক ধুপধুনো জ্বেলে গদিতে বসে পূঁজো করছিলেন। পুঁজা সেরে হরিণাম জপতে জপতে আমাদের কাছ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন, “কি চাই?” জবাবে বললাম,
– আমরা ছাত্র। কোলকাতা নিবাসী। স্টাডি ট্যুরে এসে টাকা-পয়সার অভাব দেখা দিয়েছে; তাই আংটি দু’টো বিক্রি করতে চাই।
আংটি দু’টো হাতে নিয়ে পরখ করে দেখে মালিক বললো,
– চারশো টাকা পাবে।
বলে কি ব্যাটা! আমরা জানি পাকিস্তান থেকে ভারতে সোনার দাম বেশি। তাছাড়া ভারতীয় মুদ্রার তুলনায় পাকিস্তানী মুদ্রার মূল্যও অনেক বেশী। সেক্ষেত্রে মালিক আমাদের যে দাম দিতে চাচ্ছে তার দ্বিগুন দামই আমাদের পাওয়া উচিত। ব্যাটা বেনিয়া আমাদের অসুবিধার সুযোগ নিয়ে ডাহা ঠকাবার চেষ্টা করছে। ভীষণ রাগ হল তার ফন্দি বুঝতে পেরে। আংটি দু’টো ফেরত নিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। অন্য দোকানে আর গেলাম না। বুঝতে পারলাম ওতে বিশেষ লাভ হবে না। ভীনদেশে অবস্থার সুযোগ নিয়ে সব বেনিয়াই ঠকাবার চেষ্টা করবে। ঠিক করলাম একটা ক্যামেরা বেচে দেব। একই রাস্তার উপর সবচেয়ে বড় ক্যামেরার দোকানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। দোকানের মালিক ২৪-২৫ বয়সের এক তরুণ। জামা কাপড়ে বেশ ফিটফাট। হিন্দী-উর্দু মিশিয়ে তাকে আমাদের সমস্যা বুঝিয়ে বললাম,
– একটা ক্যামেরা বেচে দিতে চাই। তরুণ যুবক আমাদের অবস্থা শুনে সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলো।
ক্যামেরা দু’টো হাতে নিয়ে বললো,
– এতো অত্যন্ত দামী ক্যামেরা। বিদেশ থেকে ইম্পোর্টেড?
– হ্যাঁ ভাই বিদেশ থেকেই প্রবাসী আত্নীয়ের মাধ্যমে খুব শখ করে আনিয়েছিলাম। নেহায়েত বিপাকে পড়েই বিক্রি করতে হচ্ছে।
– কিন্তু এতো দামী ক্যামেরা এই ছোট শহরে ভালো দামে বিক্রি করতে পারবে না। তাছাড়া শখের জিনিষ কষ্ট করে আনিয়েছ বিক্রি করে দিলে আর কিনতেও পারবে না। তাই বলছি কি, তোমাদের কাছে আর অন্য কিছুই কি নেই?
– আছে ভাই। দু’টো স্বর্নের আংটি। বলে পকেট থেকে আংটি দু’টো বের করে ওর হাতে দিলাম এবং সোনার দোকানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ওকে সব খুলে বললাম।
সব শুনে ও একটু হাসল। বললো,
বলেই যুবক দোকানের কর্মচারীটিকে ডেকে আমাদের চা এনে দিতে বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল; চায়ের কথা বলতেই আমরা বলে উঠলাম,
– চায়ের প্রয়োজন নেই ভাই। আমাদের আংটি দু’টো বিক্রি করে দিতে পারলেই আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
সে আমি দেখছি। চা খাও। এতদূর থেকে তোমরা আমাদের রাজস্থন সফরে এসেছো। তোমাদের একটু আপ্যায়ন করার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে?
যুবকের আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করলো। কর্মচারী ইতিমধ্যে চা-নাস্তার যোগাড় করতে বেরিয়ে গেছে। যুবকটিও আমাদের দোকানে বসিয়ে বেরিয়ে গেল। অপরিচিত তিনজন লোকের কাছে পুরো দোকান ফেলে দিয়ে যেতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হল না। অপরিচিত ভীনদেশে এমন একজন সাহায্যকারী পেয়ে ধন্য হলাম। কর্মচারী গরম গরম লুচি তরকারী ও চা এনে রাখল সামনে। খাবারের গন্ধ পেয়ে এতক্ষন কষ্ট করে ভুলে থাকা ক্ষুধা পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। দেরি না করে গোগ্রাসে লুচি তরকারী খেলাম। তারপর আস্তে আস্তে সুখ করে খেলাম গরম ধূমায়িত চা৷ নাস্তা পেটে পড়ায় শরীরটা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলো। মিনিট বিশেক পর যুবক হাসিমুখে ফিরে এল।
– তোমাদের কাজ হয়ে গেছে এই নাও। বলে আটশত পঞ্চাশ টাকা আমার হাতে দিল। চা নাস্তা খেয়েছতো?
– হ্যাঁ খুব মজা করে খেলাম লুচি তরকারী আর চা। ভাই তোমার নামটা জানতে পারি কি?
– নিশ্চয়ই, রমেশ ত্রিপাঠি। আমরাও আমাদের বাঙ্গালী হিন্দু নামের পরিচয় দিলাম।
– রমেশ ভাই তুমি যদি কখনও কোলকাতায় আস তবে অবশ্যই আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে। বিদেশে তোমার কাছ থেকে পাওয়া আন্তরিকতা এবং সাহায্যের কথা চিরকাল মনে থাকবে।
তিন নম্বর পার্ক সার্কাস, একটা ভুয়া ঠিকানা দিয়ে রমেশকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে ওর দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম।
আজকের পৃথিবীতে ভাল লোক যে একদম নেই তা নয়। রমেশের মতো ভাল লোক কিছু রয়েছে বলেই পৃথিবীর চাকা এখনো ঘুরছে। রমেশের দোকান থেকে বেরিয়ে সোজা গিয়ে বসলাম একটা বড় আকারের রেষ্টুরেন্টে। পেটে লুচি তরকারী এবং চা পড়ায় ক্ষুধা বেড়ে গিয়েছিল। পেটপূজা না সারা পর্যন্ত অন্য কিছুতেই মনযোগ দেয়া সম্ভব নয়। পেটভরে খাওয়া হল মুরগির রোস্ট, পরোটা, তরকারী এবং ঘন ডাল। হিন্দুদের অন্য ধাঁচের রান্না। Change of Test ভালোই লাগলো। আমাদের খাওয়ার নমুনা দেখে বাচ্চা বয়টা অবাকই হয়ে গিয়েছিল।
পেট পুরে খাওয়ার পর নূর গেল খবরের কাগজ কিনতে। দু’তিনটা খবরের কাগজ নিয়ে সে ফিরে এল। খবরের কাগজ খুলতেই দেখা গেল বাংলাদেশের উপর বিস্তারিত সচিত্র সংবাদ। জনাব নজরুল ইসলাম, জনাব তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে প্রবাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার সংবাদ, মুক্তি ফৌজের সংবাদ, সবকিছুই বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়েছে। ভারতীয় সরকারের পরোক্ষ সহযোগিতার কথাও লেখা হয়েছে। রনাঙ্গনের ছবিতে মেজর খালেদ মোশাররফের ছবি ছাপা হয়েছে। মুক্তি ফৌজের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। কাগজগুলো থেকে বুঝতে পারলাম আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যতটুকু জানতাম ঘটনা প্রবাহ তার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। সত্যিই যুদ্ধ চলছে বাংলার মাটিতে। স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগদানের জন্য ঝুঁকি নিয়ে আমরা ভুল করিনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রনাঙ্গনে যেয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হবে আমাদের। তিনজনে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা শুরু করলাম নিচু স্বরে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের চোখে ফাঁকি দিয়ে মুজিবনগর যাবার চেষ্টা করা হবে রিস্কি। নিয়ম অনুযায়ী বর্ডার ক্রস করার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পন করাটাই ছিল যুক্তিসঙ্গত। স্বেচ্ছায় ধরা দিলে আমাদের উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে কোন সন্দেহ দেখা দেবে না ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনে। ধরা না দিলে আমাদের উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকবে। কিন্তু ধরা দেব কোথায়? গঙ্গানগরে ধরা দিলে অযথা সময় নষ্ট হবে। কারণ আমাদের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্তই আসবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। সেক্ষেত্রে এখানকার কর্তৃপক্ষের হাতে বন্দী হয়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশের অপেক্ষায় সময় নষ্ট হবে অযথা। তাছাড়া তিনজন কমান্ডো ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাকিস্তানী সামরিক অফিসারদের কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য জানার জন্য যে উপায় অবলম্বন করা হবে নিম্ন পর্যায়ে। তা সহ্য করার মত মানসিক এবং শারিরীক অবস্থা বর্তমানে আমাদের কারোই নেই। তার চেয়ে বরং দিল্লী পৌঁছে আত্মসমর্পন করাটাই হবে শ্রেয়। যা হবার সেখানেই হোক। ঠিক হল দিল্লী যেয়েই আত্মসমর্পন করা হবে Ministry of External Affairs -এ। কিন্তু বর্ডারে আত্মসমর্পন না করে দিল্লী পর্যন্ত পৌছানোর জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনে যাতে কোনরূপ সন্দেহের সৃষ্টি না হয়- কেন বর্ডারে আত্মসমর্পন না করে আমরা দিল্লী রওনা হলাম, তার যুক্তি বর্ণনা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে একটি আবেদনপত্র লিখে ফেললাম তিনজনে মিলে। ঠিকানা লেখা হল মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, ভারত সরকার, প্রযত্নে Ministry of External Affairs, রাষ্ট্রপ্রতি ভবন, সাউথ ব্লক, নয়া দিল্লী। পোস্ট অফিসে গিয়ে রেজিষ্ট্রারড মেইল-এ চিঠিটা পাঠিয়ে রশিদ নিয়ে ফিরে এলাম রেষ্টুরেন্টে। পোষ্ট মাষ্টার বলেছিলেন দু’এক দিনের মধ্যেই চিঠিটা পৌঁছে যাবে দিল্লীতে। চিঠিটার একটা কপি পাঠাতে হবে মুজিবনগর সরকারের কাছে। এ এলাকা থেকে মুজিবনগর সরকারের কাছে রেজিস্টারড পোষ্ট পাঠান যুক্তিসঙ্গত হবে না। ঠিক করলাম দিল্লী থেকে ওটা পোষ্ট করব। এরপর নূরকে পাঠানো হল ষ্টেশনে দিল্লী যাবার টিকিট করার জন্য। ফিরে এল নূর। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় কালকা মেইলে করে দিল্লী যাব আমরা। দ্বিতীয় শ্রেণীর তিনটি টিকেট কেটে নিয়ে এসেছে নূর। পয়সা কম থাকায় প্রথম শ্রেণীর টিকেট কাটা সম্ভব হয়নি। হাতে প্রচুর সময়। দুপুরে আর একপ্রস্থ খাওয়া-দাওয়া করে শহরটা একটু ঘুরে ফিরে দেখার জন্য বেরুলাম। ঘুরে ফিরে দেখছি আর ক্যামেরায় ছবি তুলছি স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখার জন্য। ছোট্ট শহর ঘোরা শেষ হয়ে গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। ঠিক হল সময় কাটানোর জন্য Matinee Show সিনেমা দেখব। একটি হলে গিয়ে দেখলাম ‘অঞ্জনা’ চলছে। ববিতা-রাজেন্দ্রকুমার অভিনীত। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। মফস্বল শহরের সিনেমা হল। ব্যবস্থা মোটামুটি। ভরদুপুর রোদে উপরের টিনের চাল তেতে উঠেছে। ভীষণ গরম লাগছিল লোকের ভীড়ে। সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি। House Full কিন্তু বেশ মজাই লাগছিল বাদাম, চানাচুড় চিবুতে চিবুতে ছবি দেখতে। ছবি শেষ হল। হল থেকে বেরিয়ে এলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। আবার গিয়ে বসলাম সেই সকালের হোটেলে। আর একপ্রস্থ খাওয়া হল। ধীরে সুস্থে পৌনে সাতটায় ষ্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম। কালকা মেইল ট্রেন আসবে সাড়ে সাতটায় কিন্তু তখনও প্ল্যাটফর্ম একদম খালি। ব্যাপার কি? টিকেট কালেক্টরকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ট্রেন সাড়ে ছয়টায় ছেড়ে চলে গেছে। মানে? মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! নূর বোর্ড থেকে ট্রেনের সময় সাড়ে ছয়টার জায়গায় সাড়ে সাতটা পড়েছে। ভীষণ রাগ হল। মতি ও আমি নূরকে তার গাফিলতির জন্য বকাবকি করতে লাগলাম। আমাদের বকাবকি শুনে কালেক্টর সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,
– যা হবার তা হয়ে গেছে। গোলমাল করে সময় নষ্ট না করে ট্যাক্সি পাকড়ো। ড্রাইভারকে বকশিশ দেবার কথা বললে ও তোমাদের ট্রেন পৌঁছানোর আগেই পরের ষ্টেশনে পৌঁছে দিতে পারবে।
তার মধ্যস্থতায় একটি ট্যাক্সি ঠিক করে উঠে বসলাম। কালেক্টর সাহেব ড্রাইভারকে পাঞ্জাবীতে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। শিখ ড্রাইভার তার হিন্দুস্থান ট্যাক্সি চালিয়ে দিল উল্কা বেগে। রাস্তার অবস্থা মোটামুটি। তীব্র বেগে ছুটে চলেছে আমাদের ট্যাক্সি। ভাবলেশহীন অবস্থায় ষ্ট্যায়ারিং হাতে বসে আছেন সরদারজী। আমরাও চুপ করেই বসেছিলাম। মুখে কেউ কিছু না বললেও প্রতিমুহুর্তে মনে হচ্ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে বোধ হয় আর যাওয়া হল না। রাজস্থানের এই মরুভূমিতেই মোটর দুর্ঘটনায় অক্কা পেতে হবে। মনে মনে দোয়া-দুরুদ পড়তে লাগলাম। সরদাজীর চেষ্টা সার্থক হল, ট্রেনের আগেই সে আমাদের পৌঁছে দিল পরবর্তী ষ্টেশনে। ড্রাইভার পাঞ্জাবীতে বলল,
– দেখো সাবজি আছি পৌহছ-ই-গ্যায়ে।
সরদারজীর মুখে একটা গর্বের হাসি। আমরা ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়ার উপর মোটা বকশিশ দিতেই সরদারজীর হাসি আরো বড় আকার ধারন করল। মিনিট পনেরো পর ট্রেন এসে গেল। আমরা নিজেদের নির্দিষ্ট কামরায় গিয়ে উঠে বসলাম। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর নেমে গেল। মেইল ট্রেন ছুটে চললো। কামরায় আমরা মোট চারজন যাত্রী। দূরপাল্লার মেইল ট্রেন। বুফে কার আছে। বিছানা পত্রেরও বন্দোবস্ত রয়েছে। পয়সা দিয়ে বিছানা আনিয়ে নিয়ে যার যার বার্থে শুয়ে পড়লাম। রাতে ছুটে চলেছে কালকা মেইল। পরদিন ভোরে দিল্লী পৌঁছবো আমরা। ট্রেনের শব্দ ও মৃদুমন্দ দোলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানান কথা চিন্তা করতে করতে এক সময় গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেকদিন পর আরামের ঘুম হল। হঠাৎ করে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখি আমাদের সহযাত্রী পাশের ভদ্রলোক আগেই ঘুম থেকে জেগে জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে বসে আছেন। শুয়ে শুয়েই দেখলাম বাইরের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। ভোরের পূর্বাভাস দেখতে দেখতে চারিদিক ফর্সা হয়ে এল। পূর্ব দিগন্তে লাল সূর্যের উদয় হল। উদীয়মান সূর্যের লালিমায় রক্তিম হয়ে উঠল পূর্ব আকাশ, সূর্যের আলোয় জেগে উঠল পৃথিবী। জানালা তুলে দিলাম আমি। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগলো চোখেমুখে। মুখ ঘোরাতেই চোখে পড়লো -পাশের ভদ্রলোক সূর্যের দিকে চেয়ে নমষ্কার করছেন, আর বিড়বিড় করে কি সব বলছেন। বুঝলাম সূর্য দেবের ভক্তি করে মন্ত্র পাঠ করছেন ভদ্রলোক। আমি উঠে টয়েলেটে গিয়ে ঢুকলাম। প্রাতঃক্রিয়া সেরে হাতমুখ ধুয়ে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে দেখি মতি ও নূর তখনও ঘুমুচ্ছে। ওদের ডেকে তুললাম। একে একে ওরাও প্রাতঃক্রিয়া সেরে আমার পাশে এসে বসল। কালকা মেইল ঘন ঘন হুইসেল দিতে দিতে মন্থর গতিতে এগুচ্ছিল। ঘড়িতে তখন ৬:৩০ মিনিটের উপরে বাজে। বুঝলাম দিল্লীর কাছাকাছি এসে গেছি। ৭টায় পৌঁছানোর কথা। ঠিক সাতটার সময় কালকা মেইল এসে থামল দিল্লী ষ্টেশনে। বিরাট বড় দিল্লী ষ্টেশন। অসম্ভব ভীড়। এত সকালেও লোকজনের অভাব নেই। ব্যস্তভাবে সবাই ছুটোছুটি করছে। একটির পর একটি গাড়ি দাড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মে। নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে আমাদের ট্রেন এসে থেমে গেল। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না, এত সহজেই দিল্লী পৌঁছে গেলাম। ট্রেন থেকে নেমে ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরুতেই ট্যাক্সিওয়ালারা ঝেঁকে ধরল। একজন এসে বললো,
বললাম,
– বাঙ্গালীবাবু, ট্যাক্সি চাইয়ে?
– হ্যাঁ, নিয়ে চল মাঝারি দামের ভাল কোন হোটেলে। সিটি সেন্টারের কাছাকাছি হলে ভাল হয়।
– লে চলতে হে, সাব আইয়ে।
বলে ও আমাদেরকে ওর ট্যাক্সির কাছে নিয়ে গেল। দরজা খুলে আমরা ভেতরে বসলাম। ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই চালক একটি হোটেলের সামনে গাড়ি থামাল। হোটেল নটরাজ। ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে রিসেপশনে এগিয়ে গিয়ে দু’টো কামরা বুক করলাম। একটি সিঙ্গেল রুম আমার জন্য, আর একটি ডাবল রুম মতি ও নূরের জন্য। পাশাপাশি কামরাই পাওয়া গেল। পোর্টার আমাদের হ্যাভারস্যাক কাধে তুলে কামরায় পৌঁছে দিল। থ্রি-ফোর ষ্টার হোটেল। ভালোই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। চার্জও রিজেনেবল। প্রতিটি কামরার সাথে ছোট্ট একটা ব্যালকনি। ব্যালকনি থেকে দিল্লী শহরের অনেকদূর দেখা যায়৷ আমরা রুম পেয়েছিলাম চার তলায়। প্রতিটি রুমের সাথেই রয়েছে এটাচ্যাড বাথরুম। Hot shower নেয়ার পর ট্রেন সফরের ক্লান্তি, গ্লানি সব দূর হয়ে গেল। রুম সার্ভিস ডাকিয়ে নাস্তা করলাম তিনজন একত্রে। নাস্তা খেতে খেতে ঠিক করে নিলাম ২০ তারিখ সকালে নিজেদের সমর্পন করব Ministry of External Affairs -এ গিয়ে। ইতিমধ্যে আমাদের পোষ্ট করা চিঠিও পৌঁছে যাবে কর্তৃপক্ষের হাতে।
দিল্লীর অভিজ্ঞতা
দিল্লীতে আমাদের মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়। উষ্ণ অভ্যর্থনায় আমরা খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এবং ভবিষ্যত বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় নীল নক্শা আমাদের হতাশ করেছিল।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্ল্যান অনুযায়ী ২০শে এপ্রিল Ministry of External Affairs এ গিয়ে নিজেদের সারেন্ডার করলাম রাষ্ট্রপতি ভবনের সাউথ ব্লকে। সেখানে আমাদেরকে জেনারেল ওবান সিং (তদানিন্তন রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW) প্রধান) এর হাতে আমাদের হস্তান্তর করা হলো। তখন থেকেই আমরা রইলাম তার নিয়ন্ত্রণে। ব্রিগেডিয়ার নারায়ণ নামের এক ভদ্রলোক হলেন আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। ৪ দিন ৪ রাত্রি আমাদের কঠিন সওয়াল সেশন চললো। সেশনগুলো পরিচালনা করেছিলেন বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা। আমরা যতটুকু সম্ভব সোজাসুজি এবং সত্য জবাবই দেবার চেষ্টা করছিলাম।
একদিন বিকেলে জনাব একে রায় দু’জন ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। ভদ্রলোক দু’জন ছিলেন জনাব শাহাবুদ্দিন ও জনাব আমজাদ হোসেন। জনাব শাহাবুদ্দিন ও জনাব আমজাদ হোসেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় সচিব হিসেবে পাকিস্তান দিল্লী মিশনে কর্মরত ছিলেন। প্রবাসী সরকার ১৭ই এপ্রিল গঠিত হওয়ার খবর জেনে তারা দু’জনে দুতাবাস থেকে Defect করে ভারতীয় সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করে তাদের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তাদেরকেও আমাদের মত গোপন আরেকটি সেফ হাউজে রাখা হয়েছে। আমাদের মত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দু’জন তরুণ অফিসারও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। খুব খুশি হলাম ওদের পেয়ে। তারাও খুশি হলেন আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। ওরা বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই বলেছিলেন। আমাদের মতো অভিজ্ঞ অফিসার যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন, তারা সে কথাও উল্লেখ করলেন।
ইতিমধ্যে আমরা বিগ্রেডিয়ার নারায়ণকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মুজিবনগর সরকারের সাথে আমাদের বিষয়ে ভারত সরকার কোন সরকার কোন যোগাযোগ করছে কিনা? জবাবে বিগ্রেডিয়ার জানিয়েছিলেন যোগাযোগ করা হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কয়েকজন নেতা আসছেন দিল্লীতে। তাদের কাছেই আমাদের হ্যান্ডওভার করে দেওয়া হবে। এটা ছিল আমাদের জন্য একটি বিশেষ সুখবর। অবশেষে, একদিন প্রতিনিধি দল এসে পৌছাল। জনাব তাজুদ্দিন আহমদ (প্রধানমন্ত্রী), জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ (পররাষ্ট্র মন্ত্রী) এবং কর্নেল ওসমানী (মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ) এরাই প্রতিনিধি দলের মূল ব্যক্তি। বৈঠকের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন হঠাৎ করে বললেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাদের আরো সপ্তাহ দু’য়েক দিল্লীতেই থাকতে হবে। এ সময়ে ভারতীয় বিভিন্ন এজেন্সির বিশারদরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সর্ম্পকে ব্রিফিং দেবেন এবং স্পেশালাইজড অফিসার হিসেবে আমাদের যুদ্ধে যোগদানের পর যে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হবে সে বিষয়েও বিস্তারিত জানাবেন।
তার সিদ্ধান্ত শুনে কিছুটা অবাক হলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে না জেনে ভারতীয় সরকারের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ব্রিফিং নিতে হবে কেন? তাহলে আমাদের সংগ্রামের প্রতি ভারত সরকারের সহানুভূতি নিঃস্বার্থ নয়? বুঝতে পারলাম ভারত সরকারের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর৷ মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে ভারত সরকারের মনোভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। কেমন যেন ঘোলাটে ঠেকলো ব্যাপারটা। বেশ কিছু প্রশ্ন দেখা দিল মনে।
বাংলাদেশের সংগ্রাম কাদের সংগ্রাম? কাদের নিয়ন্ত্রনে সংগঠিত হচ্ছে এ যুদ্ধ? ভারত নেপথ্যে থেকে কি স্বার্থে কলকাঠি নাড়ছে? পৃথিবীর সব দেশের স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রাম হিসেবে সংগঠিত হয়েছে, জাতীয় সরকারের অধিনে। আমাদের বেলায় এর ব্যাতিক্রম কেন? কেন তড়িঘড়ি করে প্রবাসে দলীয় আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত করা হল ভারত সরকারের প্রচ্ছন্ন অনুমোদনে? জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নিয়োজিত আপামর জনগণের উপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়ার উদ্দ্যেশ্য কি? আইয়ূব বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণআন্দোলন সবকিছু সংগঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সবগুলো রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের একলা চল নীতি কি কারণে সমর্থন করছে ভারত সরকার?
পরদিন আমাদের স্থানান্তরিত করা হল দিল্লীর পালাম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কাছে গ্যারিসন এলাকার একটি সামরিক প্রশিক্ষন কেন্দ্রে। সেখানে পরিচয় হল মেজর সুরজ সিং এর সাথে। পাকানো স্বাস্থের অধিকারী মেজর সুরজ সিং একজন বিচক্ষণ কমান্ডো এবং Insurgency and counter insurgency expert; ব্রিগেডিয়ার নারায়ণও তাই। এরা দু’জনেই আমাদের মূল শিক্ষক। আমাদের জন্য দু’সপ্তাহের একটি crash course এর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পাঠ্যক্রমের Insurgency and counter insurgency, guerilla warfare, urban warfare, jungle warfare, shall arms, explosive, unarmed combat Specialized officer হিসেবে আমরা তিনজনই এ সমস্ত বিষয়ে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত। তবুও যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দেবার আগে আমাদের জ্ঞানকে ঝালাই করে নেবার সুযোগ পেয়ে ভালোই হল। শুরু হল আমাদের প্রশিক্ষন। এ সমস্ত বিষয়গুলোর পাশাপাশি চললো স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত ব্রিফিং। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মির শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ প্রভৃতি সংগঠনের বাঙ্গালী সদস্যরা। বাঙ্গালী সদস্যরা। তাদের কেন্দ্র করে জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে সৃষ্টি হয়েছে মুক্তি সংগ্রাম। এ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে দলমত নির্বিশেষে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য পেশাধারী জনগণের বৃহদাংশ। ভারত সরকার বাংলাদেশের ঘটনাবলী অতি সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষন করছে। বাংলাদেশ থেকে বর্ডার ক্রস করে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে লক্ষ লক্ষ শরনার্থী। এভাবেই ভারত সরকার সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে, অনেকটা মানবিক কারণেই। স্বতঃস্ফুর্তভাবে গড়ে উঠা স্বাধীনতার সংগ্রামকে ফলপ্রসু করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের। আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে সেই নেতৃত্ব এর জন্যই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে অস্থায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। ভারত আওয়ামী লীগ ও অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্বাস করে। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে সংগঠিত করে তুলতে হবে এ সংগ্রাম। আওয়ামী লীগ ও সদ্য গঠিত প্রবাসী সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রনের বাইরে অন্য কোন রাজনৈতিক দল ভিন্ন কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী গ্রুপ কিংবা ব্যক্তি কাউকেই কোন সাহায্য করবে না ভারত সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের একক কর্তৃত্ব অস্বীকার করে বিরোধিতা করতে পারে মূলতঃ দুইটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি।
প্রথমতঃ পাকিস্তান সেনা বাহিনীর প্রাক্তন সব সদস্যরাই দীর্ঘ দিন যাবত রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদারিত্ব করেছে। তাদের কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে প্রতিরোধ সংগ্রাম। তাই এ সংগ্রামের কর্তৃত্ব দাবি করে তারা ক্ষমতালিপ্সু হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারেন।
দ্বিতীয়তঃ হুমকি আসতে পারে চরমপন্থী নকশালীদের কাছ থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রবেশ ঘটেছে চরমপন্সীদের। তাছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা মনিপুর, মিজোরাম প্রভৃতি প্রদেশে নকশালী তৎপরতা ক্রমবর্ধমান। ভারতের পূর্বাঞ্চলের নকশালীরা বাংলাদেশের চরমপন্থীদের সাথে এক হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের সুযোগে মিলিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠতে পারে। এই মিলিত শক্তি আবার একত্রিতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে নেবার চেষ্টাও করতে পারে ঐ সমস্ত অঞ্চলের চলমান বিচ্ছিন্নবাদী সংগ্রামে। এসমস্ত ক্ষমতালিপ্স শক্তিসমূহকে সমূলে উৎপাটন করে যুদ্ধাবস্থায় এবং যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ এখন থেকেই গ্রহণ করা উচিত বলে ভারত সরকার মনে করে। একইভাবে বাংলাদেশের একইভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যাতে কোনক্রমেই ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে না দাড়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চক্রান্তের ফলে তার জন্যও প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। এ ব্যাপারে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীও একমত হয়েছেন। যৌথ উদ্যোগে একটি পরিকল্পনাও প্রনীত হয়েছে। ঠিক হয়েছে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্য থেকে বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে একটি বিশেষ রাজনৈতিক সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা হবে। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা হবে এক লক্ষ। বিশেষ ট্রেনিং ক্যাম্পে ওদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে ভারতীয় সেনা বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। এ বাহিনীর রিক্রুটমেন্ট, ডিপ্লয়মেন্ট ট্রেনিং সব কিছুই থাকবে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডের আওতার বাইরে। এ বাহিনী সরাসরিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্ৰী দ্বারা। এদের সশস্ত্র করা এবং পরিচালনা করার দায়িত্ব নেবে ভারত সরকার। ভারত সরকারের তরফ থেকে এ বাহিনী গঠনের মূল দায়িত্বে থাকবেন জেনারেল ওবান সিং। এদের মূল কাজ হবে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা। প্রশিক্ষণের পর এদের দলে দলে পাঠানো হবে বাংলাদেশের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ অধ্যায়ে। ভেতরে গিয়ে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে তারা প্রস্তুত হয়ে থাকবে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি যে কোন চ্যালেঞ্জ এর মোকবিলা করার জন্য। এ বাহিনীর নাম রাখা হবে বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স)। যুদ্ধকালে এবং স্বাধীনতার পরে পর্যায়ক্রমে ঐ বাহিনীর নাম রাখা হয় মুজিব বাহিনী এবং কুখ্যাত রক্ষীবাহিনী। বাংলাদেশ সরকার আমাদের তিনজনকে মনোনীত করেছে ভারতীয় সেনা বাহিনীর সহযোগিতায় এই বিএলএফ গঠন করার জন্য। আমাদের totally non- political মনে করে এবং মুজিবর রহমানের প্রতি আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা দেখেই বোধ হয় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আমাদের পেশাগত যোগ্যতা, সাহস, অন্ধ দেশপ্রেম, ব্যাকগ্রাউন্ড এবং সিনসিয়ারিটি সম্পর্কে নিশ্চয়ই কনভিন্স হয়েছিলেন দুই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল। সুদূরপ্রসারী এ নীল নকশা এবং ভারত সরকারের মনোভাব জানতে পেরে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে উঠল। গত কয়েকদিন যাবত মনে যে সমস্ত প্রশ্নগুলো দেখা দিয়েছিল সেগুলোর অনেকগুলোরই জবাব পেয়ে গেলাম। জানবাজী রেখে যারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, অকাতরে প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না যারা, তাদের প্রতি কী অবিশ্বাস! ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নিবেদিত প্রাণ মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার কী ভয়ানক ষড়যন্ত্র! শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সাথে কী চরম বিশ্বাসঘাতকতা! চানক্যবুদ্ধির এ নীল নকশা ফাটল সৃষ্টি করবে জাতীয় ঐক্যে। জাতি হয়ে পড়বে বিভক্ত। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত হয়ে উঠবে দুর্বল। নস্যাৎ হয়ে যাবে জাতীয় সংগ্রামী চেতনা। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত দুর্বল বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি করদ রাজ্যে। নাম সর্বস্য বাংলাদেশের খোলসে অর্থহীন হয়ে পড়বে স্বাধীনতা৷ আট কোটি বাংলাদেশীর মুক্তির আকাঙ্খা পথ হারাবে বিশ্বাসঘাতকতার চোরাবালিতে। একই সাথে নির্মূল করা হবে ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার স্বাধীনতার সংগ্রামগুলোকেও ।
মন বিদ্রোহ করে উঠল। এ চক্রান্তের অংশীদার হতে পারবো না। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এ নীল নকশার বিরুদ্ধে। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে সহযোদ্ধাদের। ঐক্যমত্য সৃষ্টি করতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে; অতি সংগোপনে। অন্যের দেয়া নামেমাত্র স্বাধীনতা নয়, প্রকৃত স্বাধীনতাই অর্জন করতে হবে। নিজেদের শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। শিক্ষা নিতে হবে গণচীন, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাস থেকে।
১৯৭১ সালের ২৫-২৬শে মার্চের কালোরাত্রি, মুক্তিযুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি এবং যুদ্ধ সম্পর্কে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার বই ‘সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট’ এ লিখেছেন, “২৫শে মার্চের রাতে সামরিক জান্তার পাশবিক ক্র্যাকডাউনের পর যেহেতু ঐ ধরনের কোন সামরিক অভিযানের মোকাবেলা করার কোনো প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের ছিল না সেই পরিপ্রেক্ষিতে নেতাদের সবাই ভারতে পালিয়ে গিয়ে কোলকাতায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ‘অখন্ড ভারতের’ স্বপ্নদ্রষ্টা পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর যোগ্য উত্তরাধিকারী দীর্ঘদিন যাবত এ ধরনের একটি সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। শ্রীমতি গান্ধী এই সুবর্ণ সুযোগের সময়মত যথাযথ সদব্যবহারই করলেন। ভারত যে শুধুমাত্র তাদের দীর্ঘদিনের প্রধান ও এক নম্বর শত্রু পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করে দেশটিকে দুর্বল করতে সক্ষম হয় তাই নয়; এই মুক্তিযুদ্ধের আবরণে সাফল্যের সাথে পশ্চিমবঙ্গ ও তার আশেপাশের প্রগতিশীল বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলোকেও নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়।”
২৫-২৬শে মার্চ ১৯৭১ এর বিভিষিকাময় কালোরাত্রির প্রত্যক্ষ সাক্ষীঃ
খালাম্মা, নিম্মী এবং বাপ্পী ২৫-২৬শে মার্চের আর্মি অপারেশন এবং এর ভয়াবহ পরিণামের জীবন- সাক্ষী। তাদের বর্ণনা লোমহর্ষক এবং এক করুণ উপাখ্যান।
ফেব্রুয়ারীর শেষে মা (খালাম্মা) কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। উদ্দ্যেশ্য দেশের অবস্থা দেখে শুনে প্রয়োজন হলে আমাকে ও নিম্মীকে সঙ্গে নিয়ে কোলকাতায় ফিরে যাবেন। ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১০টা অব্দি তিনি শেখ সাহেবের বাসাতেই ছিলেন। ৩২নং ধানমন্ডি থেকে লালবাগের বাসায় ফেরেন রাত প্রায় সাড়ে দশটায়। বাসায় ফেরার পর সবাই তাকে ধরে বসলাম নেতা কি বললেন? মা শুকনো বিচলিত কন্ঠে জবাব দিলেন,
-নেতাকে অনেক বোঝানোর পরও তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে রাজি হলেন না। পার্টির নেতা কর্মীরা, ছাত্রনেতারা, অন্যান্য অনেকেই আসন্ন সামরিক অভিযান সম্পর্কে শেখ মুজিবকে সতর্ক করে দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, পাক বাহিনী যদি জনগণের উপর ঝাপিয়েই পড়ে তখন জনগণের পাশে থেকে প্রতিরোধ সংগ্রামে তিনি তাদের নেতৃত্ব দেবেন সেটাই তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু শেখ মুজিবর রহমানের এক কথা, তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। অস্ত্রের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না। পাক বাহিনী নিরীহ জনগণের উপর শ্বেত সন্ত্রাসের ষ্টিম রোলার চালিয়ে দেবে এ ধারণা সম্পর্কেও তার দ্বি-মত ছিল। তিনি উপস্থিত সবাইকে বলেছিলেন, প্রয়োজনবোধে সামরিক জান্তা তাকে বন্দী করবে কারণ তাদের বিরোধ তার সাথে। কিন্তু অনেকেই যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে বর্তমানের দ্বন্দ্ব শুধু সামরিক জান্তা ও শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; আজকের দ্বন্দ্ব সামরিক জান্তা এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে। এ সত্যকে অস্বীকার করা হবে মারাত্মক ভুল। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ। যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতেও তারা প্রস্তুত। এক্ষেত্রে নেতৃত্বের দায়িত্ব হবে তাদেরকে সংগঠিত করে যে কোন অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য সার্বিকভাবে প্ৰস্তুত থাকা৷ সামরিক অভিযানের মোকাবেলায় প্রয়োজনবোধে অস্ত্রও হাতে তুলে নিতে হতে পারে। এর জন্য মানসিকভাবে নেতৃত্ব ও জনগণকে তৈরি থেকে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতিও নেয়া উচিত। এতেই কমবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি, জনগণ ছিনিয়ে নিতে পারবে তাদের ইপ্সিত স্বাধীনতা৷ কিন্তু শেখ মুজিব কোন যুক্তিই গ্রহণ করলেন না। তার শেষ কথা, ‘২৭শে মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালিত হবে।’ এ কর্মসূচী ঘোষণা করে তিনি সবাইকে বিদায় করলেন। ঘোষণার সাথে এটাও তিনি বলেছিলেন,‘পাক বাহিনীর আক্রমনের ভয় যারা করেন তারা গোপন আস্তানায় গা ঢাকা দিতে পারেন।’ সেদিন রাতে যারা ৩২নং ধানমন্ডিতে সমবেত হয়েছিলেন তারা তার নেতিবাচক মনোভাবে হতাশ হয়েই ফিরে গিয়েছিলেন তার ঘোষণা শোনার পর। মাও ফিরে এসেছিলেন চিন্তিত মন নিয়ে। যেখানে সবাই ধারণা করছে পাক বাহিনী সামরিক অভিযান চালাবে সেখানে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কি কোন কিছুই করার নেই? জনগণকে সে ধরণের শ্বেত সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা করার কোন দায়িত্বই কি নেই জনাব শেখ মুজিব ও তার দলের? তাহলে সেই চরম পরিস্থিতির হাত থেকে সাধারণ নিরস্ত্র জনগণকে বাচাঁবে কোন নেতৃত্ব? শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগকেই তো নেতৃত্বের স্থানে মেনে নিয়েছে দেশবাসী। তাদের ডাকেই তো সাড়া দিয়ে সংগ্রামকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে জনগণ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। সংগ্রামের চরম পর্যায়ে কেন তবে নেতা শেখ মুজিব পিছিয়ে যাচ্ছেন জনগণকে আগে ঠেলে দিয়ে? এ সমস্ত প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে না পেয়ে মা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল; আতংকিত হয়ে উঠেছিল তার স্পর্শকাতর মন। সচেতন বিবেক তার কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না নেতার এ ধরণের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। সব বৃত্তান্ত শুনে আমরা সবাই হতবাক! এটাই যদি শেষ সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তবে কি আর করার আছে? শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সময় অতিবাহিত করা ছাড়া কিছুই করার নেই। একমাত্র সময়ই বলতে পারবে শেখ মুজিবের চিন্তা-ভাবনা ও তার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা কতটুকু।
মার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ রাতটা সবাই জেগেই কাটাব ঠিক হল। বাবুন ও আমি খাবার পর কিছুক্ষণের জন্য বাইরে বের হলাম অবস্থা বুঝে আসার জন্য। রাত প্রায় ১১.৩০ মিনিটের দিকে ফিরে এসে জানালাম নিউমার্কেট, ইউনিভার্সিটি এলাকায় আর্মি টহল দিচ্ছে। রেডিও ষ্টেশনেও কড়া আর্মি নিরাপত্তা বহাল করা হয়েছে। সমস্ত শহর ছেয়ে গেছে আর্মিতে। রাত বেশ গভীর। হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ করে কিছু একটা এগিয়ে আসছে বলে মনে হল। শব্দটা ভালো করে শুনে আমি বললাম, শহরে ট্যাংক নামানো হয়েছে। ঐ বিকট ঘড়ঘড় শব্দটা ট্যাংক চলার শব্দ। শহরে এত রাতে ট্যাংক কেন! এক অজানা আশংকায় সবার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেল। দেয়াল ঘড়িটাতে সময় এগিয়ে চলছে টিক্টিক্। রাত প্রায় বারোটা। আচমকা রাতের নিরবতা ভেঙ্গে গর্জে উঠলো কামান, মর্টার, ট্যাংক, মেশিনগান, রিকয়েলেস্ রাইফেল। কেপে উঠল গোটা ঢাকা শহর। জানালার কয়েকটি কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল ভূ-কম্পনে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হুমড়ি খেয়ে পরলাম ঘরের মেঝেতে। আমি তড়িৎ গতিতে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলাম। সবরকম অস্ত্র নিয়ে পাক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘুমন্ত বাঙ্গালী জাতির উপর। গোলাগুলির আওয়াজ আসছে সবদিক থেকেই। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালাম, সমস্ত আকাশ ফ্লেয়ার ও ট্রেসারের আলোতে উদ্ভাসিত। আগুনের ফুলকির মত ছুটে চলেছে অগুনিত ট্রেসার বুলেট। আজিমপুর, নিউমার্কেট, পিলখানা, ইউনিভার্সিটি এলাকায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আকাশে পেঁচিয়ে উঠে যাচ্ছে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী, অল্পক্ষণ পরে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে শোনা গেল মানুষের মরনকান্না, আহতের আর্তনাদ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মৃত্যু যন্ত্রনার হাহাকার পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। শ্বেত সন্ত্রাসের পাশবিক তান্ডবলীলায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে পরে থাকলাম সবাই। এভাবেই কেটে গেল রাত। সকাল হল। পোড়া বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। রেডিও খুলতেই শোনা গেল বিশেষ জরুরী ঘোষণা, গতকাল মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছে। জনগণকে বাইরে বেরুতে মানা করা হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের সাথে না জড়ানোর জন্য হুশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে সবাইকে। কারফিউ জারি করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্যে, কিছুই করার নেই। শেখ মুজিব ও তার দলের চিন্তা- ভাবনা ভুল প্রমাণিত হল। আমরা সবাই নেতার কথাই ভাবছিলাম। ক্ষণিকের জন্য মনে ভেসে উঠেছিল তার চেহারাটা। নেতা কি অবস্থায় আছেন? আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দই বা কোথায়? কারফিউ চলছে। বেরোবার কোন উপায় নেই। বাসায় দরজা-জানালা বন্ধ করে পুরো ২৬শে মার্চ সবাই অন্তরীন হয়ে থাকলাম। সন্ধ্যার পর আবার গোলাগুলি, আর্তনাদ, মিলিটারি বহনকারী যানবাহন চলাচলের শব্দ, ভারী বুটের আওয়াজ রাস্তায়। নিশ্চুপ হয়ে আলো নিভিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দোয়া-কালাম পড়তে থাকলেন সবাই। অত্যন্ত অসহায় অবস্থা। যে কোন মুহুর্তে দরজা ভেঙ্গে বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে জল্লাদ বাহিনী। শুরু হতে পারে লুটতরাজ, মারপিট, ধর্ষণ। বাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে ছিলাম আমি, বাবুন, মুন্নি, নুন্নি এবং মাও। মেয়েদের সবাইকে ছাদে পানির ট্যাংকে লুকিয়ে রাখা হল। চরম যে কোন অঘটন ঘটার প্রতীক্ষায় অসহায় চেতনাহীন অবস্থায় বসে রইলেন মুরুব্বীরা। সময় কাটছিল না কিছুতেই। ভোর হল একসময়। সূর্যের আলোয় প্রাণ ফিরে পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠলাম সবাই। রেডিও খুলতেই ঘোষণা শোনা গেল, সরকার কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিয়েছে সাধারণ জনগণের সুবিধার্থে। ঘর থেকে সামনের রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। ৫-৬ জন ইপিআর এবং বাঙ্গালী সৈনিকদের একটি ছোট দল ছুটে আসছে দেখতে পেলাম। তাদের মধ্যে দু’জন গুরুতরভাবে আহত। রক্তে ভেসে গেছে ওদের পরিধেয় কাপড়-চোপড়। কাছাকাছি পৌঁছে তাদের একজন আকুতি জানালো,
বললাম,
– ভাই একটু পানি দেন।
– নিশ্চয়ই। আসুন আমাদের বাসায়।
– না ভাই, আমাদের সময় নেই। অতি কষ্টে পালিয়ে বেচেছি। নদীর ওপারে না পৌঁছার আগে আমরা নিরাপদ নই। খান সেনারা আমাদের মত সবাইকে হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখতে পেলে রক্ষা নেই। কুকুরের মত গুলি করে মারবে।
আমি দৌড়ে গিয়ে বাবুনের সহায়তায় বালতি করে পানি এনে তাদের খাওয়ালাম। পানি খাবার পর ওরা কিছুটা প্রকৃতস্থ হল।
– আপনাদের এ অবস্থা কেন? জিজ্ঞেস করলাম।
– ভাই হানাদার বাহিনী সব শেষ করে ফেলেছে। তারা মাঝরাতে অতর্কিতে হামলা করে পিলখানা, পুলিশ লাইন ও ক্যান্টনমেন্টের বাঙ্গালী ইউনিটগুলির উপর। ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছে হাজার হাজার সৈনিক। যারা পেরেছে তারা পালিয়ে বেচেঁছে আমাদের মত। বস্তিগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইউনিভার্সিটির হলগুলোকে গোলার ঘায়ে ধুলিসাৎ করে দেয়া হয়েছে। মারা গেছে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। সমস্ত শহরে আর্মি টহল দিচ্ছে। কাউকে দেখে এতটুকু সন্দেহ হলেই গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। আপনাদের মত তরুণরাই ওদের টার্গেট। ভাই আপনারাও পালান। চলে যান শহর ছেড়ে গ্রামে। হানাদার বাহিনীর কবল থেকে জাতিকে বাঁচাতে হলে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ সংগ্রাম। এ সংগ্রামে আপনাদের মত তরুণ যুবকদের প্রয়োজন হবে সবচেয়ে বেশি। আচ্ছা চলি ভাই। বেচে থাকলে দেখা হবে ইনশাল্লাহ।
বিদায় জানিয়ে একইভাবে দৌড়ে চলে গেল ওরা। জোয়ান ভাইদের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম সবাই। একি ব্যাপার! কি করে এতটা বর্বর আর হিংস্র হয়ে উঠতে পারল পাকিস্তানের শাসকরা! তাদের হঠকারী পদক্ষেপ পাকিস্তানের অখন্ডতার মূলেই কুঠারাঘাত হেনেছে এরপর পূর্ব পাকিস্তান কোনক্রমেই আর পাকিস্তানের অংশ হিসাবে থাকতে পারে না৷ স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করেই এই ন্যাক্কারজনক শ্বেত সন্ত্রাসের জবাব দিতে হবে। কারফিউ উঠিয়ে নেয়ার সুযোগে বাইরে বেরিয়ে অবস্থাটা সচক্ষে একটু দেখে আসার ইচ্ছে হল। বাসায় ফিরে প্রস্তাবটা দিতেই মা, বাবুন এবং নিম্মী সঙ্গে যেতে চাইলো। কোন যুক্তিই তারা শুনল না। একা আমাকে কিছুতেই ছাড়বেনা ওরা। অগত্যা চারজনই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় অসম্ভব ভীড়। লোকজন, যানবাহন সবই ছুটে চলেছে উর্ধ্বশ্বাসে। সবাই চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ বেরিয়েছে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। বাসার কাছের বস্তি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সমস্ত বস্তি লোকশূন্য। নিউমার্কেটের পাশে, কাটাবন, নীলক্ষেত বস্তিরও একই অবস্থা। সমস্ত পিলখানা আর্মি ঘিরে রেখেছে। প্রতিটি রাস্তায় মেশিনগান ফিট করা খান সেনা বহনকারী ট্রাকগুলো টহল দিচ্ছে। রাস্তার স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি এলাকা একদম ফাঁকা। থমথম করছে। ইকবাল হল (ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রস্থল), জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল মর্টার ও ট্যাংক ফায়ারে ইট ও কংক্রিটের ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। হলগুলোর মাঠে বুলড্রেজার দিয়ে গণকবর খুড়ে পুতে দেয়া হয়েছে মৃত ব্যক্তিদের লাশগুলো। রোকেয়া হলের কাছে এ ধরণের একটি গণকবরে তাড়াহুড়া করে পুতে রাখা একটি লাশের দু’টো পা বেরিয়ে রয়েছে দেখতে পেলাম। দেখে আতঁকে উঠলাম সবাই। মিলিটারি গাড়িগুলো থেকে খান সেনারা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল আমাদের। হঠাৎ মার খেয়াল হল এভাবে ঘোরাফেরা করাটা মোটেও নিরাপদ নয়। বাসাবো, রামপুরা টিভি ষ্টেশন, কমলাপুর রেল ষ্টেশন, রেডিও ষ্টেশন ঘিরে রেখেছে শত শত আর্মি। কালো পোশাক পরিহিত মিলিশিয়া বাহিনীকেও নামানো হয়েছে। সব জায়গায় বস্তিগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে দু’রাতের মধ্যেই। মালিবাগে তোদের বাসায় সবার খবর নিতে গেলাম। আমাদের দেখে চাচা অবাক হয়ে গেলেন। ভীষণ রেগে গিয়ে মাকে বললেন,
– কোন সাহসে আপনারা বেরিয়েছেন? এক্ষুণি ফিরে যান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যান নদী পার হয়ে। আমরাও সরে পড়ছি। ঢাকা শহর মোটেও নিরাপদ নয়।
যে স্ফুলিঙ্গ লেলিহান শীখার জন্ম দিয়েছিল
২৫-২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালের বিভিষিকাময় কালোরাত্রির কয়েকদিনের মধ্যে পাকিস্তান আর্মি ঢাকা শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। টিভি এবং বেতারে সরকারি প্রচারণা স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের কর্মস্থলে ফিরে যেতে নির্দেশ জারি করা হয়। কিন্তু সমগ্র জাতি তখন যুদ্ধে নিয়োজিত।
মেজর জিয়ার তূর্যধ্বনি অগ্নিশিখার সৃষ্টি করেছিল সমগ্র জাতির মধ্যে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যরা সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সারাদেশে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুললো। শুধুমাত্র ঢাকা শহরই পাক বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে রইলো। মুক্তিযোদ্ধারা জয় করে নিয়েছিলো দেশের অন্যান্য প্রায় সব অঞ্চল- চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর। পুরো দেশটাই তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে। স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র এবং আপমর জনসাধারন যোগ দিলেন বিদ্রোহী সৈনিকদের সাথে।
পুরো পূর্ব পাকিস্তানে এভাবেই তখন পরিণত হয়েছে এক যুদ্ধক্ষেত্রে। বিভিন্ন জায়গায় প্রচন্ড লড়াই হয়। সদ্য গঠিত মুক্তিবাহিনী সব জায়গাতেই অসীম সাহসিকতার সাথে খান সেনাদের সাথে আগ্রাসনের বিরোধিতা করছিল বীরবিক্রমে এবং প্রচন্ড সাহসিকতার সাথে। যতটুকু সম্বল ছিল তা দিয়েই সৈনিকরা ট্রেনিং দিচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। সবকিছুই ঘটছিল স্বতঃস্ফুর্তভাবে স্থানীয় ভিত্তিতে। পাক বাহিনী দেশের শহরগুলো পুনরোদ্ধার করার জন্য বিপুল পরিমাণে রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাচ্ছিল প্রতিটি জেলা এবং মহকুমায়। ফলে এপ্রিলের মাঝামাঝি খানসেনারা শহর বন্দরগুলো দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এর ফলে সম্মুখ যুদ্ধে না গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে নিজেদের পুর্নগঠিত করে দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ ইতিমধ্যে হাজার হাজার শরনার্থী ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এদের বেশিরভাগই ছিল ‘হিন্দু’ সম্প্রদায়ের লোকজন। ভারত সরকার পরোক্ষভাবে প্রচার মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানায়। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের অনেকেই ভারত চলে যায় নিজেদের বাহিনী পুর্নগঠনের জন্য। কারণ সেই মুহুর্তে পাক বাহিনীর সুশিক্ষিত এবং উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শক্তির মুখোমুখি মোকাবেলা করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নেন দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সংগঠিত করে দেশ স্বাধীন করার।
১৯৭১ সালের ২৫-২৬শে মার্চ কালোরাত্রির সাক্ষী হয়ে আছে সেই সময়ের দেশি- বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলি।
ভয়াবহ সামরিক অভিযানের নিষ্ঠুর পাশবিকতার লোমহর্ষক কাহিনী প্রচার করেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকগন। তাদের বর্নিত ঘটনাবলী ছিল অতি করুণ এবং মর্মান্তিক।
২৫শে মার্চের কালোরাত্রির শ্বেত সন্ত্রাস এবং নৃশংস হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক কাহিনী বিবরণ আজঅব্দি অনেক ছাপা হয়েছে। ভুট্টোর আমলের সেনা প্রধান ‘১৯৭১ সালের জল্লাদ’ জেনারেল টিক্কা খান প্রখ্যাত মিশরীয় সাংবাদিক জনাব হাইকেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার আমলে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “আমি যখন মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানে যাই তখন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি ছিল অতি দুর্বল। সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সঠিক তথ্য পরিবেশন করতে অপারগ ছিল। তাদের সাথে জনগণ কোনরূপই সহাযোগিতা করছিল না। গোয়েন্দা বিভাগসমূহের বাঙ্গালী কর্মচারীবৃন্দের আন্তরিকতায়ও যথেষ্ট অভাব লক্ষ্য করি। এর আগে এমন পরিস্থিতি কখনও হয়নি। সেনাবাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরাই ছিল আমাদের খবরা-খবরের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সূত্র। বেঈমান মুজিবের কারসাজিতে সমগ্র বাঙ্গালী জাতিই তখন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। তারা সেনাবাহিনীকে রীতিমত বয়কট করেছে।” জনাব হাইকেলের মতে জেনারেল টিক্কা বুঝতে পারেননি তিনি একটি জাতীয় বিপ্লবের মোকাবেলা করছিলেন। তিনি জানতেন না এ বিপ্লবের শিকড় প্রথিত ছিল তীব্র জাতীয়তাবাদী চেতনায়। বাঙ্গালীর স্বাধীকারের দাবির পেছনে যুক্তিও ছিল প্রচুর। এরপর ঢাকা আলোচনা কিভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল সে কথা বলতে গিয়ে জেনারেল টিক্কা খান জনাব হাইকেলকে বলেন, “ঢাকা আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর রাষ্ট্রপতি আমাকে আদেশ দেন, ২৫শে মার্চ রাতে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাঙ্গালী বিদ্রোহ দমন করে পূর্ব পাকিস্তানে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য।” জনাব হাইকেল এর বর্ণনায়, “২৫শে মার্চের মধ্যরাত্রি প্রায় ১১টা ৩০ মিনিটে পাক বাহিনী ঘুমন্ত বাঙ্গালী জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুলির আওয়াজে ভীত-সন্ত্রস্ত বাঙ্গালীরা জেগে উঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল, পুলিশের হেডকোয়টার্স মতিঝিল এবং ইপিআর এর সদর দফতর পিলখানায় মূল আঘাত হানা হয়। অবিশ্রান্তভাবে গোলাগুলি চলতে থাকে। মেশিনগান, রকেট, এমনকি ট্যাঙ্ক ফায়ারিং এর আওয়াজও শোনা যায়। সাথে মুমুর্ষ ব্যক্তিদের মরন চিৎকার। রাতের আকাশ আলোকিত হয়ে উঠে ফ্লেয়ার ফায়ারিং এ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল এবং জগন্নাথ হলকে রিকয়েলেস রাইফেল এবং মর্টার ফায়ারে ধূলিসাৎ করে দেয়া হয়। মারা যায় অসংখ্য ছাত্র। ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণ হারায় অগনিত লোক।” তার প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাক বাহিনীর আক্রমণের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লেখেন, “মাঝরাতের পরপরই পাকিস্তান আর্মির সাঁজোয়া বাহিনীর একটি কলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে যায়। সেনাবাহিনী বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী দখল করে সেটাকে ফায়ার বেস করে ছাত্রাবাসগুলির উপর আক্রমণ চালায়। ঘুমন্ত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ইকবাল হলের দুইশতেরও বেশি ছাত্র প্রাণ হারায়। বিদ্রোহী ছাত্রদের একটি কেন্দ্র ছিল ইকবাল হল। দু’দিন যাবত অসংখ্য লাশ ছড়িয়ে ছিল মাঠে, পথে, হলগুলির চত্বরে এবং কক্ষগুলিতে। দু’দিন পরই সৈনিকরা হলগুলির প্রাঙ্গনে গর্ত খুড়ে মৃতদেহগুলিকে মাটি চাপা দেয়। গণ কবরগুলি খুড়তে বড় বড় বুলডোজার ব্যবহার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় বস্তিগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।”
জনাব হেনড্রিক ভানডার হেইজডেন, আন্তর্জাতিক ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সে সময় ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি দি নিউইয়র্ক টাইমস-এ এক প্রতিবেদন ছাপান। সেটা ১৪ই জুলাই লন্ডনের দি টাইমস এ প্রকাশিত হয়। তার উপর ভিত্তি করে একই দিনে দি টাইমস-এ একটি সম্পাদকীয়ও ছাপা হয়। পাক বাহিনীর পাশবিক আচরনের বিবরণ তাতে বিস্তারিতভাবে লেখা হয়। সেই প্রতিবেদন পড়ে বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হয়ে যান। বিশ্ব পরিসরে বাঙ্গালীদের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তুলতে জনাব হেনড্রিকের প্রতিবেদন ও দি টাইমস এর সম্পাদকীয় বিশেষ অবদান রাখে। ২৭শে মার্চ সকাল ৯টার সময় কারফিউ উঠিয়ে নেয়া হয় দুপুর পর্যন্ত। হাজার হাজার ভীত- সন্ত্রস্ত নর-নারী প্রাণভয়ে গ্রামের দিকে যাত্রা করে। পথে পাক বাহিনীর সৈন্যরা তাদের উপরও গুলিবর্ষন করে। অনেক নিরীহ ব্যক্তি এতে প্রাণ হারায়। উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকেও পলায়মান নিরস্ত্র জনগণের উপর গুলি চালানো হয়। এভাবে জনগণের মনে ভীতি সন্ত্রাস সৃষ্টি করার চেষ্টা চালানো হয়। সেনা ছাউনিতে আচমকা আক্রমণের ফলে শত শত নিরস্ত্র পুলিশ এবং ইপিআরের সৈনিকরা প্রাণ হারান। যারা বেচে যান তারা অস্ত্রাগার লুট করে শহরের জায়গায় জায়গায় সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু বিপুল আক্রমণের মুখে তাদের অসংগঠিত প্রতিরোধ ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ে। সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা ছড়িয়ে পরেন গ্রামে-গঞ্জে। পাক বাহিনী নৃশংস হিংস্রতায় তাদের ধাওয়া করতে থাকে।
সেনাবাহিনীর জেনারেল ফজলে মুকিম খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতের নিষ্ঠুর আগ্রাসনের তারিফ করে বলেন, “প্রয়োজনের খাতিরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহ দমন করার জন্য মর্টার, রিকয়েলেস রাইফেল, মেশিনগান, এমনকি ট্যাঙ্কও ব্যবহার করতে হয়েছিল। সে রাতে মারণাস্ত্রসমূহের শব্দ থেকে মনে হচ্ছিল সমস্ত ঢাকা শহরই একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।” ঢাকায় অবস্থানরত সব বিদেশী সাংবাদিকদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা নিবাসে। সেখান থেকে তাদের সোজা এয়ারপোর্ট নিয়ে গিয়ে বিশেষ প্লেনে তুলে দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। সে রাতে বন্দী অবস্থায় তাদের সাথে সেনাবহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে। সেনাবাহিনীর হাত থেকে মাত্র তিনজন বিদেশী সাংবাদিক রেহাই পান। এরা গোপনে ঢাকায় লুকিয়ে থেকে সেনাবাহিনীর চোখে ধুলো দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা ছিলেন জনাব আরণল্ড জেইথলিন, জনাব মিসেল লরেন্ট এবং সাইমন ড্রিংগ। তাদের মাধ্যমেই পরে বিশ্ববাসী ২৫-২৬শে মার্চ রাত্রের ঘটনাবলী এবং সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ড সম্পর্কে জানতে পারে। জনাব সাইমন ড্রিংগ ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ এক বিবরণীতে লেখেন, “পাকিস্তানের ঐক্যের জন্য ঢাকাকে চরম খেসারত দিতে হয়েছিল।”
খালাম্মা, নিম্মী এবং বাপ্পির দুঃসাহসিক পলায়ন
কোলকাতা দূতাবাসের ডিফেকশনের পর চৌধুরী পরিবারের জন্য ঢাকা কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের কোন জায়গাই নিরাপদ ছিল না।
কোলকাতার মিশনের ডিফেকশনের খবরও আমরা জানতে পারি। এ খবর জানার পর পরিবারের সবাই বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। বাবাও ডিফেক্ট করেছেন সবার সাথে। খবর পেলাম তার এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে পাকিস্তান সরকার। প্রতিশোধের আক্রোশে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিশ্চয়ই গ্রহণ করবে সামরিক জান্তা। সবাই একমত হলেন, আমাদের আর লালবাগে থাকা ঠিক হবে না৷ সরে পড়তে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি (বাপ্পি), মা ও নিম্মী বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম আমাদেরই এক ফুপুর বাড়ি। কোন জায়গায় বেশিদিন একনাগাড়ে থাকা ঠিক নয়। তাই আমরা পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম বাড়ি থেকে বাড়ি। এভাবে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম আনু মামার বাড়ি, শহিদ মামার শ্বশুর বাড়ি, আত্মীয় অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার পেরু মামার বাড়িতে। সে বাড়িতেই ঘটল বিভ্রাট। একদিন গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার এলেন পেরু মামার বাসায় কোন এক কাজে। সেখানে ঘটনাক্রমে তিনি মাকে হঠাৎ করে দেখে ফেলেন। মিসেস চৌধুরীকে চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হল না তার। সন্দেহপ্রবন হয়ে ফিরে গেলেন ভদ্রলোক ৷ তিনি জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের সদর দপ্তরে খবরটা পৌঁছে দেন। পরদিনই পেরু মামার বাড়ি ও লালবাগের বাসায় একই সাথে রেইড করা হল আমাদের খোঁজে। কিন্তু ভদ্রলোকের ভাবসাব বুঝে আমরা ভদ্রলোক চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পেরু মামার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। এভাবে আমরা বেঁচে যাই সে যাত্রায়। এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার বুঝা গেল পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগ প্রতিশোধ হিংসায় হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের। বাংলাদেশে আর থাকা সম্ভব নয়। পালিয়ে যেতে হবে সীমান্ত পেরিয়ে।
ইতিমধ্যে স্বপন, বদি ওরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আমিও যাব তাদের সাথে । মা বাধ সাধলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে যাবে সেতো গর্বের কথা। কিন্তু তার আগে আমাদের কোলকাতায় তোমার বাবার কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে। আমাদের পৌঁছে দিয়ে তুমি যুদ্ধে যাবে তার আগে নয়।’ মার যুক্তিসঙ্গত অনুরোধ উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। মা ও সমর্থ বোনের পালিয়ে যাবার দায়িত্ব যার তার উপর বিশ্বাস করে দিয়ে দেয়া চলে না। আমাকেই নিতে হবে এ কঠিন দায়িত্ব । পালাবার পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ঠিক করা হয় ঢাকা থেকে পালিয়ে যাব নানা বাড়ি নবীনগর। সেখান থেকে সুযোগ মত কসবা সেক্টর দিয়ে আগরতলায় পাড়ি জমাতে হবে। নবীনগর থেকে কি করে বর্ডার ক্রস করতে হবে সেটা নবীনগর গিয়েই ঠিক করতে হবে অবস্থা বুঝে। আনু মামা, আলতু নানাকে সঙ্গে নিয়ে মা, নিম্মী ও আমি এক রাতে নরসিংদী হয়ে নবীনগর এসে পৌঁছালাম। ঢাকা থেকে নরসিংদীর গাড়িতে। সেখান থেকে লঞ্চে নবীনগর একদম বাড়ির ঘাটে। নবীনগর গ্রামে খান সেনারা তখনও হানা দেয়নি। কিন্তু তবুও দলে দলে হিন্দুরা সব বসতবাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল ভারতে। বর্ধিষ্ণু নবীনগর গ্রামে খাঁ বাড়ি বিশেষ পরিচিত। বড় আব্বা ও নানা দাপটশালী জমিদার হিসাবে এক কালে দশ গ্রামে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বড় আব্বাকে বৃটিশ সরকার খেতাবেও ভূষিত করেছিল। প্রাসাদপম জমিদার বাড়ির সামনে জোড়া দীঘি। নবীনগরের মুক্ত পরিবেশে পৌঁছে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাচঁলাম৷ আনু মামা দু’একদিন বিশ্রাম করে ঢাকায় ফিরে গেলেন। তার পুরো পরিবার তখনও রয়েছে সেখানে। খান সেনাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে আমরা পালিয়ে আসতে পারায় বাড়ির সবাই মহাখুশি। নবীনগরের শান্ত পরিবেশ এবং প্রকৃতির নির্মল সংস্পর্শে কয়েক দিনেই ভুলে গেলাম ঢাকার দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা। ২৫-২৬শে মার্চ রাতের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা, বাড়ি বাড়ি লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাবার বিড়ম্বনা, ২৭শে মার্চ সকালের তিক্ততা সবকিছুই দুঃস্বপ্নের মত অতীত হয়ে গিয়েছিল আমাদের কাছে। সনাতন দা গ্রামের বাড়ির মুরুব্বীদের একজন। পুরনো বিশ্বাসভাজন আপনজন।
বংশানুক্রমে তারা খাঁ বাড়ির জমিদারী তদারক করে এসেছেন। তিনিই সব দায়িত্ব নিলেন আমাদের বর্ডার পার করে দেবার। সার্বিক দেখাশুনা ও পালাবার পরিকল্পনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারিনী সবার অতি আদরের ছোট নানী বেগম আমির আলী খান ও কবির। ছোট নানীর বড় ছেলে, হবিগঞ্জের এসডিও (SDO) জনাব আকবর আলী খান (খসরু মামা) খান সেনাদের শ্বেত সন্ত্রাসের বিরোধিতায় ইতিমধ্যেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন এবং সেই সময় আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অবস্থান করছিলেন। ঠিক হল আগরতলাতে খসরু মামার কাছেই যাব আমরা। একই গ্রামের কলেজ পড়ুয়া ছেলে মোমেন আমাদের গাইড হয়ে সঙ্গে যাবে। সনাতন দা যাত্রার সব বন্দোবস্ত করে দেবেন। অসম্ভব উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী তরুণ যুবক মোমেন অসীম সাহসীও বটে। ইতিমধ্যেই সে কয়েকটি শরনার্থী দলকে আগরতলায় নিজ তদারকিতে পৌঁছে দিয়ে এসেছে খান সেনাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। কসবা সেক্টর দিয়ে আগরতলা পৌঁছানোর চোরা রাস্তাগুলো ওর নখদর্পণে। ঠিক হল নৌকাযোগে মেঘনা, তিতাস পাড়ি দিয়ে খরস্রোতা গোমতী নদী বেয়ে কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া GT Road পর্যন্ত গিয়ে তারপর পদযাত্রা। বর্ডার পার হওয়ার পর পথিমধ্যে পড়বে একটি বড়সড় বাজার। সেখান থেকে ভাড়াটে গাড়িতে আগরতলা। বড় একটা গয়না নৌকা ঠিক করলেন নানী ও সনাতন দা। মাঝি-মাল্লারা সবাই অত্যন্ত বিশ্বস্ত। দুর্যোগপূর্ণ এক ঝড়ের রাতে আল্লাহ্ নাম করে মোমেন, কবির ও আলতু নানাকে সঙ্গে করে নৌকায় উঠে পাড়ি জমালাম এক অজানা ঠিকানায়। দুর্যোগের রাতে খান সেনাদের চোখ অতি সহজেই ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলেই ঝড়ের রাতে নৌকা যাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। বদর বদর বলে মাঝি-মাল্লারা মেঘনার উত্তাল বুকে অন্ধকারে নৌকা ভাসিয়ে দিল। ভাল করে সাঁতার জানি না আমি ও নিম্মী দু’জনেই। ঝড়ো হাওয়ায় মেঘনা হয়ে উঠেছে বিক্ষুব্ধ। বিশাল ঢেউয়ের পাহাড় ভেঙ্গে নৌকা এগিয়ে চললো দুলতে দুলতে। ঢেউয়ের দোলা ও ঝড়ের তীব্রতার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চুপ করে বসে আল্লাহ্-রাসূলকে স্মরন করতে থাকলাম সবাই। এমনি করে সারারাত একটানা নৌকা বেয়ে ফজরের ওয়াক্তে এক জায়গায় নৌকা ভেড়ালো মাঝিরা। সেখানে নেমে পড়তে হল সবাইকে।
শুরু হল পদযাত্রা। ধানক্ষেত, পাটক্ষেতের আলের উপর দিয়ে, কাদা পলির উপর দিয়ে খালি পায়ে হেটে পাহাড়ী টিলাগুলো পার হচ্ছিলাম। পরনে সবার গ্রাম্য লেবাস। দুপুরের আগেই GT Road এর কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা। একটি পাটক্ষেতের মধ্যে সবাইকে লুকিয়ে রেখে মোমেন আর আমি এগিয়ে গেলাম রাস্তাটা রেকি করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলাম আমরা। রাস্তা ক্লিয়ার। ক্ষিপ্র গতিতে রাস্তা পার হয়ে দূরে চলে যেতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। দূরের জঙ্গলে গা ঢাকা দেবার আগে খান সেনাদের দৃষ্টিতে পড়লে রক্ষে নেই। নিঃঘাত মৃত্যু। পরি কি মরি সবাই দৌড়ে ছুটে চলেছি রাস্তা ক্রস করার জন্য। আর একটু গেলেই উঁচু রাস্তা। হঠাৎ মোমেন বলে উঠলো, ‘সবাই শুয়ে পড়ুন, খান সেনাদের টহল গাড়ি আসছে।’ তার নির্দেশে সবাই ধানক্ষেতের কাঁদা পানিতে অসাড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। চারদিকে যতটুকু দৃষ্টি যায় ছোট ছোট পাহাড়, টিলা, ধান আর পাটের ক্ষেত। লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। ধানক্ষেতের কাদা-পানিতে মুখগুজে পড়ে থেকে সবাই প্রমাদ গুনছিলাম, ‘যদি টহলদার খান সেনারা দেখে ফেলে!” ভয়ে নিম্মীর দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আল্লাহ্ই বাঁচানে ওয়ালা। খান সেনাদের গাড়িটা অল্প কয়গজ দূর দিয়ে উত্তর দিকে চলে গেল। ওরা ধানক্ষেতে পড়ে থাকা মানুষগুলি দেখতে পেল না। গাড়িটি অনেক দূরে দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলে সবাই উঠে এক দৌড়ে রাস্তা ক্রস করে অপরদিকের পাটক্ষেতে গিয়ে বসে পড়লাম। একটু দম নেয়া দরকার। মা বেচারীর ডান পা’টা কিছুদিন আগে ভেঙ্গে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটির সিড়ি থেকে পিছলিয়ে গিয়ে। ভাঙ্গা পা’টা দুনিয়ে ফুলে উঠেছে। অসম্ভব সহ্য শক্তি মার। মুখ ফুটে কখনও নিজের অসুবিধার কথা ব্যক্ত করে না। তাই শুধু বলল, একটু দম নেয়া যাক। আমি ও নিম্মী মার পায়ের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম হাটতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে তাঁর। বুঝতে পারলেও কিছুই করার নেই।
বাকিটা পথ হেটেই যেতে হবে তাঁকে। মাঝামাঝি পথ অতিক্রম করেছি আমরা। এখন থেকে বাকি পথের সবটুকুই পাহাড়ী উচু-নিচু পিচ্ছিল পথ। সবাই কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম কিন্ত মুখে কিছুই বললাম না। মাকে উৎসাহ দেবার জন্য হেসে বললাম, ‘মা তুমি দেখছি হাটাতে আমাদেরকেও হার মানিয়ে দিলে। কষ্ট হচ্ছেনা তো?” কোন জবাব না দিয়ে মা উঠে দাড়াল। আবার শুরু হল হাটা। হাটতে হাটতে সন্ধ্যার সময় আমরা পৌঁছলাম সেই বাজারে। বর্ডার এলাকার বাজার। কিন্তু শরণার্থীদের ভীড়ে পুরো বাজারটাই গমগম করছে। চালের বস্তা ভর্তি অসংখ্য ট্রাক দাড়িয়ে আছে। মোমেন বলল, ‘আমরা পৌঁছে গেছি।’ ঐ চাল বাংলাদেশ থেকে স্মাগলড হয়ে চলে যাচ্ছে ইন্ডিয়ায়। কিছুদূর এগুতেই বাজারের অন্যপ্রান্তে একইভাবে দাড়িয়ে আছে পাট ভর্তি ট্রাকের সারি। ওগুলোও পাচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকেই।
দীর্ঘপথ চলায় সবাই তখন পরিশ্রান্ত। একটা চায়ের দোকানে বসে পানি, কিছু চা-নাস্তা খেলাম সবাই। খাওয়া শেষে একটি পুরনো জিপ গাড়ি ভাড়া করে আগরতলার পথে রওনা হলাম। ছোট্ট জিপটাতে প্রায় ১২জন যাত্রী ঠাসাঠাসি করে ঢোকালো ড্রাইভার। কিছুই বলার নেই। এটাই রীতি। বাজার থেকে আগরতলার দূরত্ব প্রায় পঁয়ত্রিশ মাইল। পুরনো সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার আমলের জিপ। ১২-১৪ জন যাত্রীর ভারে আর্তনাদ করতে করতে কোনমতে এগিয়ে চললো আগরতলার পথে। কিছুদূর যাবার পর গাড়ি থামিয়ে বনেট খুলে পানি ঢেলে বুড়ো ইঞ্জিনকে ঠান্ডা করতে হচ্ছিল বারবার। এভাবেই অতি কষ্টে রাত প্রায় ১২টায় আমরা এসে পৌঁছালাম আগরতলা শহরে।
শহর থেকে ৫-৬ মাইল দূরে এক পোড়া রাজবাড়িতে খসরু মামা ও আরো কয়েকজন পদস্থ বাঙ্গালী অফিসার সপরিবারে অবস্থান করছিলেন। মোমেন জায়গাটা আগেই দেখে গেছে। জিপ থেকে নেমে রিক্সা করে চলে গেলাম সেই আস্তানায়। রাজবাড়িতে পৌঁছে খুজে বের করতে বেগ পেতে হলনা খসরু মামাকে। খসরু মামা আমাদের সবাইকে দেখে অবাক,
-হেনা বুজি আপনারা?
–হ্যাঁ পালিয়ে এলাম। মোমেনই নিয়ে এসেছে আমাদের। ঢাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
মুক্তি ফৌজের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী
তার স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা।
মুজিব নগর হেডকোয়াটার্সে আমরা পৌছানোর পর কর্নেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে শুরু হয়েছিল; বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে এক বিশদ বিবরণ দিলেন। তিনি শুরু করলেন, “তোমাদের মনে রাখতে হবে ২৫শে মার্চের পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমনের পর ২৬শে মার্চ থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে প্রথমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈনিক, প্রাক্তন ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বীর জোয়ানরা। ২৬-২৭শে মার্চ মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে বীর জোয়ানদের সঙ্গে স্বতঃস্ফুর্তভাবে এসে যোগ দিয়েছিলেন ছাত্র, যুবক এবং আপামর জনসাধারণ। সর্বপ্রথম যুদ্ধ হয় নিয়মিত পদ্ধতিতে। আর এই পদ্ধতিতে যুদ্ধ চলতে থাকে মে মাস পর্যন্ত। শত্রুকে ছাউনিতে যথাসম্ভব আটকে রাখা এবং যোগাযোগের কেন্দ্রসমূহ তাদের কব্জা করতে না দেয়ার জন্য নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতিতে যুদ্ধ করা হচ্ছিল। নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, যত বেশি বাধা সৃষ্টি করা যায় তা সৃষ্টি করা হবে। যে সমস্ত ন্যাচারাল অবস্ট্যাকল রয়েছে তা রক্ষা করতে হবে, সাথে সাথে শত্রুর প্রান্তভাগে এবং যোগাযোগের পথে আঘাত হানতে হবে। মূলতঃ এটাই ছিল নিয়মিত বাহিনীর রণকৌশল। সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সাথেই এ পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি রেজিমেন্টকে দু’টি ব্রিগেডের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে হয়। সংখ্যায় কম থাকায় নিয়মিত বাহিনীর রণকৌশলে পরে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল। কমান্ডাররা ছোট ছোট পেট্রোল বা ছোট ছোট কোম্পানী, প্লাটুনের অংশ দিয়ে শত্রুপক্ষের তুলনামূলক অধিক সংখ্যক সৈন্যকে এনগেজড করে রাখছিলেন। একই সাথে শত্রুর উপর আচমকা হামলাও চালানো হচ্ছিল। এভাবেই চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোর, খুলনাতে যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছিল। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা বুঝতে পারছিলেন, কেবলমাত্র নিয়মিত পন্থায় যুদ্ধ চালানো সম্ভব নয়। কারণ তখনকার পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিল সর্বমোট ৫টি ব্যাটালিয়ন। তাদের সাথে ছিল ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ছাত্র, যুবক ও জনতা। কমান্ডাররা ছাত্র যুবকদের অল্প কিছুদিনের ট্রেনিং দিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এ ধরণের শক্তি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পাক বাহিনীর ৩-৪টি ডিভিশনকে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তাদের উপুর্যপরি আক্রমনের মুখে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ ক্রমশঃই দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সে ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের এই বিশাল শক্তিকে ধ্বংস করে দেশকে স্বাধীন করা অসম্ভব হয়ে উঠে। তখনই কমান্ডাররা অনুভব করেন তাদের প্রস্তুত হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের জন্য। এই পাঁচটি ব্যাটালিয়নকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে হবে এক বিশাল গেরিলা বাহিনী। একমাত্র বিশাল গণবাহিনীই পারবে শত্রুপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে নিউট্রেলাইজড করতে। এ গণবাহিনী এমনভাবে সংগঠিত করতে হবে যেমন মানুষের পেটের অন্ত্রে একটি শক্তিশালী জীবানু অন্ত্রটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে, তেমনি ভেতর থেকে শক্তিশালী দক্ষ গেরিলা বাহিনী শত্রুর অন্ত্রকেও বিনষ্ট করে দেবে। এছাড়া দেশকে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। কারণ শত্রুপক্ষের সংখ্যা বেশি। ওদের বিমান বাহিনী রয়েছে তাছাড়া সম্বলও তাদের অনেক বেশি।
কর্নেল ওসমানীর কথা শুনে মনে প্রশ্ন দেখা দিল? ২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনী যদি নিরীহ জনগণের উপর পৈশাচিক শ্বেত সন্ত্রাস না চালাত; একই সাথে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ এবং অন্যান্য সামরিক ইউনিটগুলোর বাঙ্গালী সদস্যদের উপর হামলা না চালাত; তবে কি স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটত? স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বাঙ্গালী বীর জোয়ানরা? এ ধাঁধাঁর জবাব ঐতিহাসিকরাই আগামীতে খুঁজে বের করবেন সে বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চললাম। কর্নেল ওসমানী বলে চলেছেন, “আমার বিশ্বাস ক্লাসিক্যাল গেরিলা ওয়ারফেয়ার করে দেশ মুক্ত করতে হলে বহুদিন যুদ্ধ করতে হবে এবং ইতিমধ্যে আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ জনসম্পদ। সেটা ধ্বংস হয়ে যাবে।”
জনাব ওসমানীর কথায় টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী চিন্তাধারা পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ল। পৃথিবীর কোন জাতি তাদের মুক্তি অল্পত্যাগে পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। যারা হয়তো বা পেয়েছেন তাদের সে স্বাধীনতা অর্থবহ হয়নি। প্রসুতির আতুর ঘর থেকেই বিভিন্ন চক্রান্তের স্বীকারে পরিণত হয়েছে তাদের সে স্বাধীনতা। ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও স্বাধীনতার সুফল জাতীয় মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। নেতৃত্ব পৌঁছে দিতে পারেননি স্বাধীনতার সুফল জনগণের ঘরে ঘরে। অদৃশ্য কলকাঠির নড়াচাড়ায় যে সমস্ত দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে; সে সমস্ত দেশের পুতুল সরকারগুলোর কাছ থেকে জনগণ পেয়েছে শুধুই বঞ্চনা, প্রতারণা আর দারিদ্রের অভিশাপ।
আবার কর্নেল ওসমানীর বক্তব্য শুনতে মনযোগ দিলাম, “যুদ্ধকে স্বল্পস্থায়ী করার জন্য এপ্রিল মাসেই আমার মাথায় একটি প্ল্যান এসেছে। একাটি বড় গেরিলা বাহিনী গঠন করে ভেতর থেকে শত্রুর আঁতে আঘাত হানতে হবে এবং পাশাপাশি নিয়মিত বাহিনীর ছোট ছোট ইউনিট অর্থাৎ কোম্পানী বা প্লাটুন দিয়ে শত্রুকে আঘাত করতে হবে এবং বিচ্ছিন্ন হবার জন্য তাকে বাধ্য করতে হবে, যাতে করে কনসেনট্রেটেড অবস্থা থেকে তারা ডিসর্পাসড হয়ে যায়। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে তাদের সংখ্যাগরিষ্টতা অকেজো হয়ে পড়বে। শত্রুপক্ষ ছোট ছোট গ্রুপে নিজেদের কমিট করতে বাধ্য হবে। তখন গেরিলা পদ্ধতিতে তার যোগাযোগের রাস্তা, বেতার সংযোগ, রি- ইনফোর্সমেন্টের পথ ধবংস করে তাকে ছোট ছোট পকেটে আইসোলেটেড করে চরম আঘাতে তাদের ধ্বংস করতে হবে। এজন্য আমার নিয়মিত বাহিনীরও প্রয়োজন রয়েছে। আমার এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিটেইলড প্ল্যান ইতিমধ্যেই অস্থায়ী সরকার এবং মিত্রদের কাছে পেশ করেছি। তাতে আমি উল্লেখ করেছি, কমপক্ষে দু’লাখের মত গেরিলা বাহিনী এবং ২৫ হাজারের মত নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে কমান্ডারদের অধিনে যে সমস্ত মুক্তিফৌজ রয়েছে তাদের ছাড়া এই নূন্যতম শক্তি আমাকে অবশ্যই গড়ে তোলার অনুমতি দিতে হবে।
বর্তমানে মুক্তিবাহিনীর মধ্যে রয়েছে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ বাহিনীর সদস্যগন তাদের আমি বলি নিয়মিত বাহিনী। সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্র যুবকদের বলি অনিয়মিত বাহিনী। ভারতীয়রা তাদের বলেন FF (Freedom Fighters). আমার মতে পরীক্ষিত যোগ্য মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সাথে নতুন রিক্রুটেড বীর জোয়ানদের ট্রেনিং দিয়ে তিনটি নিয়মিত ইনফ্যানট্রি ব্রিগেড গঠন করার পরিকল্পনা নিতে হবে। নিয়মিত বাহিনীর বাকি সদস্যরা Sector troops হিসাবে স্থানীয় কমান্ডারদের অধিনে থাকবে। তাদের মূল দায়িত্ব হবে গেরিলাদের জন্য বেইস তৈরি করে তাদের ট্রেনিং দেয়া এবং দেশের ভেতর ছোট ছোট গ্রুপে তাদের induct করা। গেরিলাদের অপারেশন কোঅর্ডিনেট করার দায়িত্ব থাকবে সেক্টর কমান্ডারদের উপর৷ সেক্টর কমান্ডারদের সাহায্যের জন্য গেরিলা অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হবে। সমগ্র বাংলাদেশের রনাঙ্গনকে তিনি ১১টি সেক্টরে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেক্টরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকবেন একজন সেক্টর কমান্ডার। সেক্টরগুলোর হেডকায়ার্টারস স্থাপিত হবে বাংলাদেশের ভেতর মুক্তাঞ্চলে। সেক্টরগুলোই হবে গেরিলা যুদ্ধের মূল ভিত্তি। কারণ, বাংলাদেশের মত এত বড় একটা থিয়েটার অর্থাৎ দেশব্যপী রণক্ষেত্রে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা ও ব্যাপক দূরত্ব। কেন্দ্রীভূতভাবে দৈনন্দিন যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে যুক্ত সামরিক সদর দফতর, উপযুক্ত সামরিক অফিসার ও ষ্টাফ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সম্পদ এবং সঙ্গতির প্রয়োজন তা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। আমার থাকবে ১০জন অফিসার বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র সশস্ত্র বাহিনীর হেডকোয়ার্টারস। এত বড় একটা বিরাট অঞ্চলব্যাপী সামগ্রিক যুদ্ধে একটি মাত্র কেন্দ্র থেকে দৈনন্দিন আদেশ, নির্দেশ প্রেরণ করা ও সে অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা শুধু অসম্ভবই নয়, অবাস্তবও বটে। তাই আমি আমার কমান্ডারদের কাছে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য, আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক বিবেচ্য বিষয়ের সঠিক মূল্যায়ন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রমের কোন কোন পথ উন্মুক্ত রয়েছে ইত্যদি বিষয়ে সঠিক চিত্র তুলে ধরার জন্য যথাশীঘ্র সম্ভব সেক্টর কমান্ডারদের একটি জরুরী বৈঠক তলব করার চিন্তা-ভাবনা করছি। জাতীয় লক্ষ্য, আমাদের বাহিনীর করণীয়, বিভিন্ন সেক্টরের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন এবং সাংগঠনিক ও যুদ্ধ পরিচালনার নীতি নির্দেশ জারি করার দায়িত্ব হবে আমার হেডকোয়ার্টারসের। আমাদের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডারের নীতি নির্ধারণ ও স্থানীয়ভাবে তাদের দৈনন্দিন যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। সেক্টর কমান্ডারদের সাথে লিয়াঁজো অফিসার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার ইচ্ছা রয়েছে আমার। এছাড়া আমার কমান্ডারদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা এবং যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কে সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের জন্য আমি এক সেক্টর থেকে অন্য সেক্টরে যাতায়াতও করবো প্রয়োজনে।” কর্নেল ওসমানীর যুদ্ধ প্রস্তুতির বিশদ বিবরণ আমরা তিনজনই মনযোগ দিয়ে শুনলাম। তার বক্তব্যে সামরিক প্রস্তুতির বিশদ বিবরণ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের মূল বিষয় তথা রাজনৈতিক দিকটির সম্পর্কে তেমন কিছুই বললেন না তিনি।
যে কোন জাতির মুক্তি সংগ্রামকে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে সফল করে তোলার জন্য রাজনৈতিক আদর্শ ও নেতৃত্বের ভূমিকা মূখ্য। জনগণকে সাথে নিয়েই সংগঠিত করা হয় গেরিলা যুদ্ধ। জনগণকে গেরিলা যুদ্ধে আকৃষ্ট করতে হয় রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে। কারণ রাজনৈতিক নীতি আদর্শের মাধ্যমেই জনগণ দেখতে পায় তাদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন এবং বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি। তাই অতি প্রয়োজনের খাতিরেই জনগণের মুক্তি ও তাদের আশা- আকাঙ্খার পরিপ্রেক্ষিতে নীতি ও আদর্শ প্রণয়ন করে জাতীয় পরিসরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানের জন্য গঠন করতে হয় সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। এ সরকার সাধারণতঃ গঠিত হয় পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে। এটাই হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত জনযুদ্ধের প্রক্রিয়া। সমসাময়িক পৃথিবীতে সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে পরীক্ষিত এ প্রক্রিয়ার বিপক্ষে একদলীয় একটি অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রনে দীর্ঘস্থায়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সফলভাবে এগিয়ে নেয়া কি করে সম্ভব? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্ম হয়েছে দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন পেশার জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আদর্শ এবং নীতিমালায় সর্বস্তরের জনগণের আশা- আকাঙ্খার প্রতিফলন নেই। আওয়ামী লীগ মূলতঃ বাংলাদেশের উঠতি বুর্জুয়া এবং পাতি বুজুয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক দল। সেক্ষেত্রে আপামর জনসাধারণকে সশস্ত্র সংগ্রামে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের একক সরকার নেতৃত্ব দেবে কোন যুক্তিতে? ‘৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে ভোট নিয়েছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে, ধর্মীয় আদর্শের আওতায় পাকিস্তানের নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে সে দাবিতে। সেখানে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের কোন অঙ্গীকার ছিল না। কর্নেল ওসমানীর বক্তব্য থেকে একটি বিষয়ও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার সংগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আহ্বানে শুরু হয়নি। স্বাধীনতার প্রথম ডাক দিয়েছিলেন অখ্যাত এক তরুণ মেজর জিয়াউর রহমান আর তার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ। তাদের অংশগ্রহণে বাঙ্গালী বীর সৈনিক ও নওজোয়ানরা সংগঠিত করেছিলেন প্রতিরোধ মুক্তি সংগ্রাম বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার, মুজাহিদ, ইপিআর এবং পুলিশ বাহিনীর দেশপ্রেমিক যোদ্ধারাই অগ্রণী হয়ে স্বীয় উদ্যোগে গঠন করে তুলেছিলেন মুক্তিফৌজ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেয়া তো দূরের কথা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও শেখ মুজিব কখনোই চিন্তা করেননি সশস্ত্র সংগ্রামের কথা। তাই ছিলনা তাদের কোন পূর্বপ্রস্তুতি। তাদের পার্টি মেনিফেষ্টো, নির্বাচনী প্রচারণা এবং পরবর্তী সময়ে ইয়াহিয়া শাহীর সাথে তাদের রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ও অন্যান্য কার্যক্রম থেকে এ সত্যই প্রমাণিত হয়। এ সত্যকে অস্বীকার করে আজ কোন অধিকারে প্রবাসে দলীয় অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের সকল কৃতিত্বের একচ্ছত্র দাবিদার হয়ে উঠলেন তারা? “মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যে ছিল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। অনেকেরই বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগ একাই মুক্তিযুদ্ধ করবে। অন্য কোন দল বা গোষ্ঠি করুক তা হবে না।” (দৈনিক ইনকিলাবের সাথে জনাব শান্তিময় রায়ের সাক্ষাৎকার)।
এ ধরণের সুবিধাবাদী নেতৃত্বের অধিনেই দেশ স্বাধীন করে গণমুক্তির স্বপ্ন দেখছেন কর্নেল ওসমানী। পরিকল্পনা করেছেন গেরিলা যুদ্ধ করার। অবশ্য তাঁর কথার ফাকে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের পক্ষপাতী তিনি ও তার সরকার নন। তার মানেই বা কি? তবে কি পর্দার অন্তরালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্য কোন ষড়যন্ত্র চলছে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারতীয় সরকারের বোঝাপড়ার মাধ্যমে? তড়িঘড়ি করে অস্থায়ী দলীয় সরকার কায়েম করার মত তাড়াহুড়া করে স্বাভাবিক পরিণতির পরিবর্তে অস্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশকে তথাকথিত স্বাধীনতা প্রদানের ফন্দি আটা হচ্ছে কি সবার অলক্ষ্যে? ভারতীয় নীল নকশা যা আমরা দিল্লীতে অনুভব করে এসেছি তার সাথে কোথায় যেন একটা যোগসুত্র খুজে পেলাম। তবে কি কর্নেল ওসমানীও ভারতীয় নীল নকশা বাস্তবায়নেরই একজন? এ কথা বিশ্বাস করতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। কর্নেল ওসমানীকে আমরা চিনি একজন নির্ভীক, স্পষ্টবাদী, স্বাধীনচেতা একজন বাঙ্গালী সৈনিক হিসেবে। অবসর গ্রহণের পর হালে রাজনীতিতে যোগদান করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি হয়েছেন তিনি। কিন্তু তাই বলে কোন লোকের চরিত্রতো রাতারাতি সম্পূর্নভাবে বদলে যায় না৷ তার বেলাই বা সেটা কি করে সম্ভব? একবার ভাবলাম আমাদের দিল্লীর অভিজ্ঞতা তাকে সম্পূর্ণ খুলে বলে আমাদের মনোভাব পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করি। আবার ভাবলাম আগে তার কাছ থেকে বুঝে নিতে হবে তিনি এসবের সাথে কতটুকু জড়িত। সেটা না বুঝে সবকিছু খুলে বললে হিতে বিপরীতও হতে পারে। আমরা তিনজনই মহা বিপদের সম্মুখীন হতে পারি। প্রাসঙ্গিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে উভয় সংকটে পড়লাম।
আলোচনাকালে কর্নেল ওসমানী হঠাৎ করেই বলে উঠলেন, “I have decided to send you and Moti as Guerilla Advisor to the sector commanders and Noor shall be at the HQ as my ADC & Personal Staff Officer (PSO).”তার কথা শুনে চমকে উঠলাম। কি অবাক কান্ড ! তাহলে কর্নেল ওসমানী আমাদেরকে নিয়ে ভারতীয় সরকার এবং প্রবাসী সরকার কি ভাবছে সে সম্পর্কে কি কিছুই জানেন না? মনে খটকা লাগলো। মনে করলাম আমাদের ব্যাপারে হয়তো বা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্বয়ং তাজুদ্দিন ও ভারতীয় সরকারের প্রতিনিধিরা। জনাব তাজুদ্দিন তখন পর্যন্ত কর্নেল ওসমানীকে তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছুই জানাননি। আশ্চর্য! মুক্তিফৌজের কমান্ডার-ইন্তচীফ এর কাছে বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) নামের স্পেশাল পলিটিক্যাল ফোর্স গঠনের ব্যাপারে সবকিছুই গোপন রেখেছেন অস্থায়ী সরকার প্রধান জনাব তাজুদ্দিন আহমদ। তার মানে এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীকেও বিশ্বাস করেনি ভারত এবং আওয়ামী লীগ সরকার।
মনে আশার সঞ্চার হল। কর্নেল ওসমানী নীল নকশার প্রণেতাদের একজন নয়। নিশ্চিন্ত হলাম৷ তাকে বিশ্বাস করে সবকিছুই বলা যায়। বেচারা কর্নেল ওসামানী! তাকে Side track করে ইতিমধ্যেই অন্য খেলা শুরু হয়ে গেছে অথচ তিনি তার কিছুই জানেন না। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আমি বললাম,
– স্যার আপনি আমাদের গেরিলা অ্যাডভাইজার হিসাবে নিয়োগ করতে চাচ্ছেন এতে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু স্যার, জনাব প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের নিয়ে অন্য কিছু চিন্তা করছেন। আপনি কি BLF গঠন করার ব্যাপারে কিছুই জানেন না?
– What is BLF? Can you frankly tell me what is going on? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
– নিশ্চয়ই বলবো স্যার। আপনাকে বিশ্বাস করে সবকিছুই খুলে বলবো। মুক্তিযুদ্ধের কর্ণধার হিসেবে আপনার উপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। জাতির সাথে আপনি কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না সেটা আমাদের বধ্যমূল ধারণা। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী যে কোন চক্রান্তকে নস্যাত করে দেবার মত দৃঢ়তাও আপনার রয়েছে, সে ব্যাপারেও আমরা তিনজনই একমত। আমাদের অনুরোধ সবকিছু শুনে আপনি উত্তেজিত না হয়ে অত্যন্ত ধীরসস্থিভাবে চিন্তা করবেন ভবিষ্যতে করণীয় সম্পর্কে। যে কোন অসতর্ক পদক্ষেপের চরম মূল্য দিতে হতে পারে আমাদের সবার।
– I promise you. It will be just between me and you three. Now, let me hear everything that you want to tell in details.
তার অভয় অঙ্গীকারে আন্তরিকতার আবেদন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল। আমি বলতে লাগলাম,
– স্যার, দিল্লীতে আমাদের সময় কেটেছে জেনারেল ওবান সিং ও তার সহকর্মীদের সাথে। গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদির প্রশিক্ষন ছাড়াও রাজনৈতিক মটিভেশন দেয়া হয়েছে আমাদের। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদ বর্তমান অবস্থায় গঠিত মুক্তিবাহিনীর বেশিরভাগ কর্মকর্তা এবং সদস্যদের পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি তাদের সার্বিক আনুগত্য সম্পকেও তারা সন্দিহান। প্রবাসী আওয়ামী সরকার ও তাদের দল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে কার্যকরী effective নেতৃত্ব সফলতার সাথে কতটুকু দিতে পারবে সে সম্পর্কেও ভারত সরকার সুনিশ্চিত নয়। রাজনৈতিক দল হিসাবে চারিত্রিক দুর্বলতা আওয়ামী লীগের রয়েছে প্রচুর, আদর্শগতভাবে রক্তক্ষয়ী একটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবার মত মানসিকতা ও প্রস্তুতি কিংবা চরম ত্যাগ স্বীকার করার মত চারিত্রিক গুনাবলীও নেই দলের বেশিরভাগ সদস্যদের মধ্যে। সেক্ষেত্রে এ সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লে নেতৃত্ব চলে যেতে পারে আওয়ামী লীগের হাত থেকে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে মূলতঃ দু’টি শক্তি। চরমপন্থী রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবীরা অথবা প্রাক্তন সেনা বাহিনী, আনসার, ইপিআর, মুজাহিদ এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। বর্তমান পরিস্থিতিতে মুক্তি বাহিনীর মধ্যে এদের অবস্থান অতি সুদৃঢ়। দীর্ঘকালীন যুদ্ধে ক্রমান্বয়ে তাদের শক্তি বেড়ে যাবে। পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে। সেই অবস্থায় ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার স্বাধীনতা সংগ্রামগুলোও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। বিষয়ে তারা বিশেষভাবে চিন্তিত। যেহেতু ভারত সরকার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বাইরে অন্য কাউকেই বিশ্বাস করছে না, সে জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে একমাত্র আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রনেই পরিচালিত করতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধাত্তোর উভয় অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে কোন হুমকির মোকাবেলা করার জন্য বিশেষভাবে গঠন করা হবে একটি সম্পূর্ন রাজনৈতিক সশস্ত্র বাহিনী। বাহিনীর নাম হবে BLF (Bangladesh Liberation Force) এ বাহিনীর সংখ্যা হবে প্রায় এক লক্ষ। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা এবং কেন্দ্রীয় যুব এবং ছাত্র নেতারাই বিভিন্ন অঞ্চল এবং যুব শিবির এবং শরনার্থী শিবির থেকে রিক্রুটমেন্টে সহযোগিতা করবেন এই BLF গঠনের ব্যাপারে। রিক্রুটেড সদস্যদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থার ভার গ্রহণ করবে ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিশেষ সদস্যরা। ট্রেনিং শেষে ওদের ভরনপোষণ এবং deployment করা প্রভৃতি বিষয়ে সবকিছুই করবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ বাহিনী সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহ্মদ এবং আমরা তিনজন ছাড়া কেউ কিছু জানতে পারবে না। আমাদের দায়িত্ব আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে ভারতীয় সেনা বাহিনী ও প্রধানমন্ত্রীর মাঝে লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে। এ বাহিনীর মূল কাজ হবে স্বাধীনতা উত্তরকালে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রনে থেকে আওয়ামী লীগ এবং তদীয় সরকারের স্বার্থ রক্ষা করা। পরে প্রয়োজনে এ বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হতে পারে মুজিব বাহিনী। কোন সন্দেহ অথবা ভুল বোঝাবুঝির উদ্রেক যাতে না হয় তার জন্য যুক্তি হিসাবে প্রচার চালানো হবে, এ বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে বিশেষ এক প্রয়োজনে। শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাকুঠির থেকে মুক্ত করে আনার জন্য এদের দায়িত্ব দেয়া হবে। রিক্রুটমেন্টে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় সরকার ইতিমধ্যেই চারজন যুব ও ছাত্রনেতাকে সিলেক্ট করে নিয়েছে। তারা হলেন জনাব শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং জনাব তোফায়েল আহমদ (পরবর্তীতে তারা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারনের কাছে ‘চার খলিফা’ বলে পরিচিতি লাভ করেন)। RAW (Research and Analysis Wing) ভারতীয় গোয়েন্দা এজেন্সীর প্রধান জেনারেল ওবান সিং এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেরাদুনের অদূরে চাকুরাউল-এ এদের ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিশেষ সদস্যরা ট্রেনিং দেবে। ট্রেনিং পর্যায়ে এবং পরবর্তিকালে ওদের রি-অর্গানাইজ করার দায়িত্বে ভারতীয়দের সাথে আমাদেরও থাকতে হবে। মানে পর্যায়ক্রমে আমরাও হয়ে পড়বো মুজিব বাহিনীর সদস্য।
আমাদের কথা শুনে কর্নেল ওসমানী স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। হতবাক হয়ে বললেন,
– How strange ! এ সমস্ত ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। I must find out from the Prime Minister how much does he know?
– অবশ্যই তা আপনাকে জানতে হবে তবে সেটা করতে হবে বিশেষ সতকর্তার সাথে। অত্যন্ত সেনসেটিভ ব্যাপার। তাই বুঝে শুনে কথা বলতে হবে আপনাকে। জনাব তাজুদ্দিনের সাথে আপনার আলাপের পরই না হয় আমরা সিদ্ধান্ত নেব কি করা যায়।
সেদিনের মত আমাদের একান্ত বৈঠক শেষ হল। কর্নেল ওসমানী শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেলেন। আমরা তার ঘরের অপরপ্রান্তে মেঝেতে বিছানা পেতে তিনজনই শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালেই কর্নেল ওসামানী জনাব তাজুদ্দিনের কাছে গিয়ে গত রাতের আলোচনা সম্পর্কে আলাপ করে ফিরে এসে জানালেন,
– প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না ৷
– এ কি করে সম্ভব! দিল্লীতে আমাদের বলা হয়েছে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সবকিছুই জানেন।
– No, Boys. He is as much as in dark as I am. And I don’t think he is lieing. এ ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে তিনি যতটুকু সম্ভব জানার চেষ্টা করবেন। of course not exposing anyone. তোমরাও যদি আরো কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পার তবে আমাকে জানাবে। Prime Minister wants to know everything about this nefarious plan. তোমাদের ব্যক্তিগত কার্যক্রম সম্পর্কে ভেবেচিন্তে আমাকে জানিও তোমরা কি করবে? বললেন তিনি।
এখানে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে, BLF পরবর্তিকালে মুজিব বাহিনী গঠন এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW (Research & Analytical Wing) সম্পর্কে জেনারেল অরোরার মন্তব্য তুলে ধরা হল:- মুজিব বাহিনী এমন এক বাহিনী যা মুক্তি বাহিনী থেকে ছিল একেবারেই আলাদা৷ আমি এই বাহিনী সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। একদল ছাত্র যারা নির্বাচনের সময় মুজিবের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে তারা অর্থাৎ আওয়ামী লীগের এই তরুণ অংশ আমাদের ইনটেলিজেন্সকে জানায় তারাই মুজিবের প্রকৃত সমর্থক। তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে পাঠালে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে ভালো যুদ্ধ করতে পারবে। এ ব্যাপারে আমি এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। তবে মুক্তি বাহিনীর সাথে যখন তাদের গোলমাল হয় তখন প্রবাসী সরকার (তাজুদ্দিনের সরকার) এ বাহিনী সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চায়। আমি আমাদের চীফ অফ ষ্টাফ জেনারেল মানিক শ’-কে এ ব্যাপারে জানাতে বলি। তিনিই আমাকে জানান যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW এই বাহিনী গড়ে তুলেছে। এই বাহিনী নিয়ে সমস্যা যখন বাড়তে থাকে তখন দূর্গা প্রসাদ ধর (ইন্দিরা গানন্ধীর তৎকালীন মূখ্যসচিব) আমাকে জানালেন, “মুজিব বাহিনীর ব্যাপারটা বাংলাদেশ সরকারকে না জানানোর কোন বিশেষ সিদ্ধান্ত নেই। ব্যাপারটা পরিস্থিতির জন্যই বর্তমানে গোপন রাখা হয়েছে মাত্র।” (বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতিচারন শিরোনামে নিখিল চক্রবর্তীকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার
এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ থেকে বুঝা যায় প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিনকে সত্যিই ভারত সরকার এবং “র” এই বাহিনী গঠনের ব্যাপারে অন্ধকারেই রেখেছিল নিজেদের স্বার্থে।
ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত
জাতির সাথে বেঈমানি করে “র” এর হাতে বড়ে হতে মন আমাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠে।
আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত কর্নেল ওসমানীকে জানিয়ে দিলাম। ভারতীয় নীল নকশার সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়তে চাই না আমরা। রাজনৈতিক একটি দলের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য গঠিত ঠেঙ্গারে বাহিনীর নেতা হওয়ার খায়েশ নেই আমাদের তিনজনের একজনেরও। আমরা এতদূর থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসেছি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই যুদ্ধ করব আমরা৷ কর্নেল ওসমানীর সাজেশান অনুযায়ী গেরিলা অ্যাডভাইজার হয়ে সেক্টর কমান্ডারদের সাহায্য করে মুক্তিফৌজ (অনিয়মিত বাহিনী) গঠন করার দায়িত্ব নিয়ে তখনই কাজে যোগদানের সিদ্ধান্ত জানালাম আমরা। কর্নেল ওসমানী আমাদের জবাবে খুশি হলেন। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে কি বলা যায়? তারা যদি জানতে পারে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের ইচ্ছার বিরোধিতা করেছি তবে অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠবে। অনেক চিন্তাভাবনা করে কর্নেল ওসমানী ঠিক করলেন, যদি প্রশ্ন উঠে তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তিনি বলবেন, BLF কিংবা মুজিব বাহিনীর মত রাজনৈতিক একটি বাহিনী তৈরি করার দায়িত্ব সার্বিকভাবেই থাকা উচিত রাজনৈতিকভাবে সচেতন পরীক্ষিত ব্যক্তিবর্গের হাতে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মতে আমাদের তিনজনের একজনের ও সে ধরণের রাজনৈতিক ওরিয়েন্টেশন অথবা কমিটমেন্ট কোনটাই নেই। Therefore we are not fit for such as important assignment. Some more politically conscious persons have to be found out to lead such a highly politisized force. সময় মত তাদের এ যুক্তি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিলেন। ফলে “চার খলিফা”কেই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় BLF তথা মুজিব বাহিনী গড়ার। আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম রাহুগ্রাস থেকে। আমাকে গেরিলা অ্যাডভাইজার টু দ্যা সেক্টর কমান্ডার হিসাবে ৮নং এবং ৯নং সেক্টরে পোষ্টিং অর্ডার ইস্যু করে দেন কর্নেল ওসমানী। মতিকেও একই দায়িত্ব দেয়া হল ১০ এবং ১১ নং সেক্টরে। নূরের সব যুক্তিকে খন্ডন করে প্রায় জোর করেই তাকে কর্নেল ওসমানী পার্সোনাল ষ্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োজিত করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন কলহকে কেন্দ্র করে বহুমূখী চক্রান্তের সূচনা ঘটে।
♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত
♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ
♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার
♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন
♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ
♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার
♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী
♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম
♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান
♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ
♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব
“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ