লন্ডনের পরীক্ষাকেন্দ্রে ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ পত্রিকার তরফ থেকে এক গোছা বন্ধ খাম রাখা হয় টেবিলের ওপর। খামের ভিতরে কি আছে তা ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ পত্রিকার ডঃ ক্রিস্টোফার ইভান্স এবং ডঃ যোশেফ হ্যানলন ছাড়া আর কেউ জানতেন না। এই খামের ভিড়ের থেকে একটা খাম তুলে এগিয়ে দেওয়া হল অধ্যাপক অর্থার এলিসন –এর হাতে। খাম খুলতেই বেরিয়ে এল একটা ফোটোগ্রাফ। ফোটোগ্রাফটা একটা পুলিশের গাড়ি, গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন পুলিশ।
ছবিটি টেবিলের ওপর রাখা হল। সকলেই ছবি দেখলেন। নিউইয়র্ক পরীক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি টেলিফোনে যোগাযোগ স্থাপন করলেন অর্থার এলিসন। তারপর ইংলন্ডে বসে থাকা এলিসনের সঙ্গে নিউইয়র্ক বসে থাকা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিটির শুরু হল কথোপকথন। মাঝে মাঝে কথা, মাঝে মাঝে নীরবতা। এমনি করে কেটে গেল ঘণ্টা দুয়েক। শেষ পর্যন্ত নিউইয়র্ক থেকে টেলিফোনে ভেসে এলো –“গাড়ি গাড়ি গাড়ি। গাড়ির কথাটাই সবার আগে মনে এসেছে আমার। একটা চকচকে লম্বা গাড়ি।“
পরামনোবিদ অধ্যাপক অর্থার এলিসন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। জানালেন, “পরীক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য লক্ষ্য করা গেছে।“
প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হল আটলান্টিক সাগর পেরিয়ে আশ্চর্য টেলিপ্যাথি যোগাযোগের বিস্ফোরক সংবাদ, তবে সংক্ষিপ্ত আকারে। পত্র-পত্রিকাগুলোতে বেশি কিছুদিন ধরেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে টেলিফোন টেলিপ্যাথির অসাধারণ সাফল্যের কথা প্রচারিত হল। ‘নিউ সায়েনটিস্ট’ পত্রিকায় ডঃ যোশেফ হ্যানলন তাঁর লেখা প্রতিবেদনে পুরো ঘটনাটার খুঁটিনাটি বিবরণ দিলেন। দিলেন টেলিফোনে কথাকথনের বর্ণনা। সেই সঙ্গে তাঁদের পত্রিকার নিউইয়র্ক প্রতিনিধি সিডনি ইয়াং কি দেখেছেন, তারও বিবরণ। ফলে গোটা ব্যাপারটার যে ছবি নিখুঁত ফুটে উঠল, সেটা আপনাদের সামনে পর্যালোচনার জন্য তুলে ধরছি।
‘নিউ সায়েনটিস্ট’ পত্রিকা কি বলছে
অধ্যাপক অর্থার এলিসন –এর সঙ্গে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিটির সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপনের পর নিউইয়র্কের তরফ থেকে দীর্ঘ নীরবতা। সম্ভবত নিউইয়র্কের পরামনোবিদ মনসংযোগ করছেন। দীর্ঘ নীরবতায় শেষ পর্যন্ত এলিসনের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তিনি এ-প্রান্ত থেকে চেঁচালেন –“এখন তুমি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় কি দেখতে পাচ্ছ?” পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের আগেই জানানো হয়েছিল, এলিসনের হাতে তুলে দেওয়া হবে একটি বন্ধ খাম, যাতে থাকবে কোন কিছুর ছবি। নিউইয়র্ক থেকে বলতে হবে লন্ডনের এলিসনের সামনের টেবিলে কিসের ছবি রাখা হয়েছে।
-”আমি তিনটে জিনিসের ছবি দেখতে পাচ্ছি।“ নিউইয়র্ক থেকে খবর ভেসে এলো।
-“ঠিক কি ধরনের ছবি তুমি দেখতে পাচ্ছ, বলো। আমাদের ছবির সঙ্গে তার মিল কতখানি দেখি।“
অন্যপ্রান্ত কোন উত্তর দিল না। দীর্ঘ কুড়ি মিনিটের নীরবতার পর ভেসে এল একটি ক্লান্ত কণ্ঠস্বর, “আমি ক্লান্ত।“
পরামনোবিদ এলিসন উৎসাহ যোগালেন, “এত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হচ্ছ কেন আজকাল? মনস্থির করে বসো। বসে ভাবতে থাক। বলো, আমরা এখানে যে ছবিটার দিকে মনসংযোগ করেছি, সেটা তোমার মনে কি ভাবে ভেসে উঠেছে?”
-“একটা সাদা কোন কিছুর ওপর তিনটে মানুষের ছবি।“
এলিসন কোন উৎসাহ দেখাতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পরে নিউইয়র্ক থেকে ভেসে এলো, “একটা লম্বা মতো…”
ও প্রান্ত কথা শেষ করার আগেই উত্তেজিত এলিসন চেঁচিয়ে উঠলেন, “ঠিক ঠিক, লম্বাটে ধরনেরই কিছু বলে যাও।“
এলিসন-এর এই সাহায্যে কোন কাজ হল না। লম্বাটে ধরনেরই একটা কিছুর ছবি বলে জানানো সত্যেও ও প্রান্ত থেকে যা বলল তা এলিসনের পক্ষে যথেষ্ট হতাশজনক।
-“হ্যাঁ আমি দেখতে পাচ্ছি একটা লম্বা কুকুর, একটা ঘোড়া আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে।“
এলিসন কোন উৎসাহ দেখালেন না। ও-প্রান্ত বুঝে নিল, উত্তর ঠিক হয়নি। আবার নতুন করে শুরু করল, “আমি দেখতে পাচ্ছি একটা তিনকোনা মতো – একটা অর্ধবৃত্ত – একটা পাহাড় –“
এলিসন কোন সাড়া দিলেন না।
ও-প্রান্ত হঠাৎই উত্তেজিত কন্ঠে বলল… “ঘোড়া, কুকুর… কুকুর।“
ছবিটির কোথাও কুকুর নেই। এলিসন তাই নীরব।
ও-প্রান্ত নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, “দেখুন তো ঘরে কোনও কুকুরের ছবি আছে কি না?”
না, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ঘরে কোনও কুকুরের ছবি দেখা গেল না। এলিসন তাঁর প্যারাসাইকোলজিকে এমনভাবে মার খেতে দেখে আবার নতুন উত্যমে শুরু করলেন, “লম্বা কোনও কিছুর কথা বলছিলে না তুমি?”
ও-প্রান্ত বলল, “একটা ছবি আমি খুব স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছি।“
-“তার কথাই বলো।“
“একটা চওড়া মতন লম্বা বস্তু, উজ্জ্বল রঙ্গের।“
-“বাঃ, খুব ভাল বলেছ। বলে যাও।“
“টেবিল-ফুল-“
এলিসন কোনও উত্তর দিলেন না।
নিউইয়র্কের অতীন্দ্রিয়-ক্ষমতাবানেরও গলা নীরব হল। মিনিট পাঁচেক পরে নিউইয়র্ক থেকে ভেসে এলো আর একটি কন্ঠস্বর। এটি ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ পত্রিকার সিডনি ইয়াং-এর।
ইয়াং বললেন, “ও টেলিপ্যাথির সাহায্য নিয়ে একটা ছবি আঁকছে। ছবিটা গাড়ির বা শুয়োরছানার।
এলিসন উৎসাহ দিলেন, “ওকে চালিয়ে যেতে বলুন।“
-ছবিটা এখন দাঁড়িয়েছে একটা কাঠের খেলনার মতো।“ গাড়ি বা শুয়োরছানার মতো ওপরটা। নীচে চাকা বা পা নেই, গোল মতো।“
-“ও অনেকটা সফল হয়েছে। আপনি ছবি দেখে বলে যেতে থাকুন।“
-”ছবিটা এবার থালার আকার নিয়েছে। সেটার দিকে হাতির পায়ের মতো কিছু একটা নেমে আসছে। এবার মনে হচ্ছে একটা স্তনের মতো কিছু।“
ছবি আঁকা শেষ হতে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার মানুষটি নিজেই ফোন ধরলেন। জানতে চাইলেন, “কিসের ছবি তোমরা দেখছো?”
-“এটা পুলিশের গাড়ির ছবি।“ এলিসন জানালেন।
-“গাড়ি-গাড়ি। এই ছবিটাই তো কতবার এঁকেছি। একটা চকচকে লম্বা গাড়ি।“
এলিসন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, “ঠিক ধরেছ,একটা চকচকে লম্বা গাড়ি।“
ও-প্রান্ত থেকেও উচ্ছ্বাস ভেসে এলো –“আমি এত দূরে থেকেও ছবিটা দেখতে সফল হয়েছি, সত্যিই আমি খুশি।“
এতেই পরামনোবিদ অধ্যাপক এলিসন পরামনোবিদ্যার ‘অভাবনীয় সাফল্য খুঁজে পেলেন।‘
যেহেতু বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ অলৌকিক কোনও কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাসী, জনপ্রিয় পত্রিকাগুলো ও টিভি চ্যানেলগুলো তাই প্রকৃত ঘটনার কাঁচি চালিয়ে অলৌকিকের মোড়কে মুড়িয়ে লোভনীয় চাটনির মতোই পরিবেশন করছে।
‘নিউ সায়েনটিস্ট’ পত্রিকার প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “সে যে ছবি এঁকেছে, সেটা জন্তুর, টেবিলের, পাহাড়ের অথবা বিশ্বের যে কোনও বস্তুর বলে দাবী করা যেতে পারে।“
মুখেও সে ছবির বর্ণনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবু প্রচার-মাধ্যমগুলোর পূর্ণ সহযোগিতায় একটা মামুলি ব্যাপার অলৌকিকের চেহারা পেল।
‘নিউ সায়েনটিস্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে যদিও কোনও প্রতিবাদ ‘সানডে মিরর’ পত্রিকার তরফ থেকে ওঠেনি।
১১.২ ডুবোজাহাজে টেলিপ্যাথির পরীক্ষা
১১.৩ টেলিপ্যাথির সাহায্যে নোটের নম্বর বলা
১১.৪ টেলিফোনে টেলিপ্যাথিঃ আয়োজক লন্ডনের ‘সানডে মিরর’
১১.৭ টেলিফোন টেলিপ্যাথির আর এক আকর্ষণীয় ঘটনা
১১.৮ এমিল উদ্যা ও রবেয়ার উদ্যা’র টেলিপ্যাথি
১১.৯ অতীন্দ্রিয় ইউরি গেলারকে নিয়ে ‘নেচার’ (Nature)-এর রিপোর্ট
১১.১০ আই আই টি-তে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও