একটি মিথ্যেকে বার বার সাজিয়ে গুছিয়ে প্রচার করতে করতে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা যায়, যার ফলে মিথ্যেটাই মানুষের বিশ্বাসে সত্যি হিসেবে জ্বল জ্বল করে। এই সত্যটাকেই মাথায় রেখে তাবৎ রাজনীতিকরা পরিবেশ দূষণ নিয়ে প্রচারে নেমেছেন। কত টাকা বাড়ছে সেমিনারে, ওয়ার্কশপে, গাছ বিলি করতে, গাছ পুঁততে, কত লক্ষ মিটার দুর্মূল্য ফিল্প, কত টন নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে তার হিসেব রাখা ভার। কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রচারে ফল পাওয়া গেছে দারুণ। এখন পরিবেশ বলতে তামাম দেশবাসীর মাথায় শুধু ভেসে ওঠে প্রাকৃতিক পরিবেশের ছবি। কিন্তু পরিবেশ বলতে কি শুধুই প্রাকৃতিক পরিবেশ? মানূষের ওপর শুধুই কি প্রাকৃতিক পরিবেশই প্রভাব ফেলে?

যারা পরিবেশ বলতে শুধুই প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা সাধারণ মানুষের মাথায় ঢোকাতে চাইছে, তারা ভালমতই জানে ‘আর্থ-সামাজিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক’ নামের দুটি বিশাল প্রভাবশালী পরিবেশের কথা, মানবজীবনে যাদের প্রভাব বহু ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক পরিবেশের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। সমাজ- সাংস্কৃতিক পরিবেশের বিপুল প্রভাবের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ রাশিয়া সমেত পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলো থেকে মার্কসবাদের বিদায়। ওইসব মার্কসবাদী দেশে দীর্ঘ দিন ধরে নানা ভাবে পাচার করা হয়েছে মার্কিন সংস্কৃতি, উত্তেজক মার্কিন সংস্কৃতি, ভোগসর্বস্ব মার্কিন সংস্কৃতি। মার্কসবাদী দেশগুলোর সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ভেসে আসা উদ্দাম মার্কিন সংস্কৃতি মানুষগুলোকে মানসিকভাবে নেশাগ্রস্থ করেছে, ক্ষুধার্ত করেছে। আর তাইতেই একের পর এক ধস নেমেছে।

‘সংস্কৃতি’ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ‘সংস্কৃতি’ প্রগতির ধারক। মানবতাবাদী জীবনবোধের উপাদানই হল সংস্কৃতি। যে ‘সংস্কৃতি’ এই সব ধারার বিপরীতগামী তা ‘অসংস্কৃতি’। ভারতবর্ষের সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, দূরদর্শনে, যাত্রায়, নাটকে সর্বত্র এক অসংস্কৃতির ঢল নেমেছে। কারণ এইসব সৃষ্টির পিছনে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়াস নেই। বরং রয়েছে ভোগসর্বস্ববাদ, অবাধ যৌনতা, হত্যা-হানাহানি-ধর্ষণ, দুজ্ঞেয়বাদ, অদৃষ্টবাদ, ঠাকুর দেবতার রমরমা, ধর্মীয় সংস্কার সৃষ্টি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মানুষকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তুলে বৃহত্তর শোষিত জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রাখার প্রয়াস।

কোনও কোনও সমাজ সচেতন গোষ্ঠি কোনও কোনও জায়গায় শোষিত মানুষদের যখন বোঝাচ্ছে তাদের বঞ্ছনার কারণগুলো আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র বা স্বর্গের দেবতা নয়, বঞ্ছনার কারণ এই সমাজব্যবস্থা, যখন এই অসাংস্কৃতিক প্রভাব মুক্ত করতে সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইছে তখন বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম সাহিত্য পত্রিকায় দুই ঔপন্যাসিকের কলম ঝলসে উঠল ওইসব সমাজ সচেতন যুক্তিবাদী গোষ্ঠির বিরুদ্ধে। কলমচিরা জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে, অলৌকিক ক্ষমতাবানদের পক্ষে সোচ্চার হবেন।

যারা সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশকে ধর্তব্যের মধ্যে আনতেই নারাজ, তাঁরা কি বলবেন। দেশ জুড়ে এই যে ধর্ম নিয়ে উন্মাদা, হানাহানি এ-সব কোন পরিবেশের ফল?

ধর্ম নিয়ে এমন উন্মত্ততা তো একদিনে গাছের পাকা ফলটির মত টুপ করে এসে পড়েনি। সাম্প্রদায়িক দল বলে আজ যাদের গাল পাড়ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেই সাম্প্রদায়িক দলটি তো হঠাৎ করে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেনি। ভারতবর্ষের মাটিতে ধর্মের চাষ, ধর্মের ফসল উৎপাদন ও ধর্মব্যবসা দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বারোয়ারী দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজোর রমরমা বেড়েছে। অনেক মার্কসবাদী দলের নির্দেশে পুজো কমিটিতে ঢুকে জনসাধারণের মধ্যে কাজ করতে নেমে পড়েছেন। এই নতুন শক্তির আগমনে পুজোর বাজেট বেড়েছে চড়চড় শীতলার দোকান খুলেছে। রাজনীতিকরা পুজো উদ্বোধন, জ্যোতিষ-মহাসম্মেলন উদ্বোধনে হাজির থেকে পোঁতা বিষবৃক্ষের বীজে সার ঢেলেছেন, জলসিঞ্চন করেছেন, বাবা ‘তারকনাথ’, ‘সন্তোষী মা’ ছবির কৃপায় পাড়ায় পাড়ায় যুবক-যুবতীদের উদাত্ত অংশগ্রহণে মাইক, আলো, দেবদারুপাতা ও বাঁক-শোভিত চত্তরের সংখ্যা বেড়েছে। বাঁক কাঁধে শ্লীল, অশ্লীল, স্লোগান দিতে দিতে যুবক-যুবতীরা ছুটে চলে তারকেশ্বরে। ‘জয় সন্তোষী মা’ ছবির কৃপায় মা স্নতোষীর জাঁক-জমক বাড়ে। দূরদর্শনে ‘রামায়ণ’ ‘মহাভারত’ দেশবাসীকে ভাবাবেগ ও ভক্তিরসের তীব্র নেশায় বুঁদ করে রাখে। ‘সতী মন্দির’ রাজস্থানের ব্যাপার, পশ্চিমবাংলার মাটিতে বসবাসকারী রাজস্থানী ভোটারের সংখ্যা এতই নগণ্য যে তারা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারবে না। এই অংক মাথায় রেখে ভোটারদের কাছে প্রগতিশীল ইমেজ তৈরি করতে তাবড় রাজনীতিকরা ঘোষণা করেন, মৃতকে নিয়ে স্মৃতি-সৌধ হতে পারে, কিন্তু মৃতকে পুজো? এ তো কুসংস্কার। এই কুসংস্কারের আবর্জনা আমরা পশ্চিম বাংলায় জমতে দেব না। এই রাজনীতিকরাই আবার রামকৃষ্ণ, রামঠাকুর, অনুকূলচন্দ্র, লোকনাথের পুজো নিয়ে নীরব থেকে পরোক্ষ মদত দিয়েছেন। এইসব মৃত ধর্মীয় নেতাদের ভক্ত-সংখ্যা বিশাল এবং তাদের ভোটাধিকার আছে বলেই কি এইসব রাজনীতিকদের প্রগতিশীল বুলির ফানুস চুপসে যায়?

“আত্মা অবিনশ্বর” এই যুক্তিহীন বিশ্বাস যতদিন মানুষের মনে থাকবে ততদিন সতী-মন্দির সহ নানা মৃত বাবাজী মাতাজীদের মন্দিরও থাকবে তাঁদের আশীর্বাদ লাভের আশায়। বিভিন্ন ধর্ম-বিশ্বাসে বলা হয়েছে ‘আত্মা মানে ‘চিন্তা’ ‘চেতনা’ ‘চৈতন্য’ বা ‘মন’। শরীরবিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে আমরা এও জেনেছি ‘চিন্তা’ ‘চৈতন্য’ ‘চেতনা’ বা ‘মন’ হল মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের কাজকর্মের ফল। মানুষ মারা গেলে তার মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষগুলোও মারা যায়। তারপর এক সময় মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষগুলোর অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায় সমাধির মাটির তলায়, আগুনে পুড়ে, পচে অথবা কোনও প্রাণীর পাকযন্ত্রে হজম হয়ে। মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষগুলোর অস্তিত্বই যখন থাকে না তখন সেই অস্তিত্বহীন স্নায়ুকোষের কাজকর্মের ফল হিসেবে ‘চিন্তা’ ‘চেতনা’ ‘চৈতন্য’ বা ‘মন’ -এর অস্তিত্বও যে আর থাকতে পারে না, এই সাধারণ যুক্তির কথাটুকু বুদ্ধিজীবী রাজনীতিকদের অজানা থাকার কথা নয়। ধরে নিলাম শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া, অশিক্ষিত সমাজবিরোধী মাফিয়া নেতা এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিছু শক্তিমান রাজনীতিক আছেন যারা শক্তিপ্রয়োগের বিষয় যতটা বোঝেন, ‘চিন্তা’ ‘চেতনা’ ‘মন’ ইত্যাদির কথা ততটাই বোঝেন  না। কিন্তু এর বাইরে যে সংখ্যাগুরু বুদ্ধিমান, শিক্ষিত ধুরন্ধর রাজনীতিবিদরা রয়েছেন তাঁদেরকেও মাথা-মোটা ভাবলে ভুলই করা হবে। সব-গুলো মাথা-মোটার পেছনে অর্থ ব্যয় করে তাদের নির্বাচন জিতিয়ে আনলেই বা লাভ কি? ওইসব মাথা-মোটারা কি দেশের দরিদ্র শোষিত মানুষদের মগজ ধোলাই করে বঞ্ছনার থেকে উঠে আসার সম্ভাবনাময় প্রতিবাদের কন্ঠকে রোধ করতে পারবে? পারবে না। তাহলে তো রাতারাতি শোষকশ্রেণীর গণেশ উল্টোবে, ধুরন্ধর এইসব ধনীর দালাল রাজনীতিকরা ‘চিন্তা’ ‘চেতনা’ ‘মন’ ‘আত্মা’ ‘অদৃষ্টবাদ’ ‘কর্মফল’ ইত্যাদি খুব ভালমতই বোঝেন। বোঝেন বলেই জানেন, দরিদ্র মানুষগুলোর চেতনা কতদূর পর্যন্ত এগোতে দেওয়া নিরাপদ। ওইসব রাজনীতিক ও তাদের দলের বুদ্ধিজীবিরা ভালমতই জানেন ‘আত্মা অবিনশ্বর’ এই ভ্রান্ত চিন্তা মানুষের মাথায় বদ্ধমুল করতে পারলে সেই সূত্র ধরেই গরীবদের মাথায় ঢোকান যায়, ‘এই জন্মে এই যে এতো কষ্ট পাচ্ছি, এসব গত জন্মের কোনও পাপের ফল, এজন্মে দেব-দ্বিজে ভক্তি রেখে, রাজপদে (বর্তমানে রাজনীতিকদের পায়ে) ভক্তি রেখে, কোনও হিংসার আশ্রয় না নিয়ে ঈশ্বরের দেওয়া এই জীবনের দুঃখগুলোকে মেনে নিয়ে সুশীল হয়ে চললে আগামী জন্মে ভাল ফল পাব।’

শিল্পপতিদের মালিকানাধীন বিশাল বিশাল ঝাঁ-চকচকে কাগজগুলোতে বিশাল বিশাল মাইনেয় বিশাল বিশাল লেখক পোষা হচ্ছে। পত্রিকার মালিক নিত্য রুটিন মাফিক পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদকের সঙ্গে মিটিং করছেন, বুঝিয়ে দিচ্ছেন পেপার পলিশি। আর সেই পেপার পলিশিকে মাথায় রেখেই কলম চালাচ্ছেন, কলম চালাতে হচ্ছে মাইনে করা তা-বড় লেখকদের।

পেপার পলিসি কি? পত্রিকার মালিকগোষ্ঠির স্বার্থরক্ষার কৌশলই, পত্রিকার কৌশল। পত্রিকার মালিকের স্বার্থ কখনো ব্যক্তিগত, যেখানে আর এক জনগোষ্ঠির তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী। আবার কখনো শ্রেণীগত, যেখানে সামগ্রিকভাবেই ধনীকশ্রেণীর স্বার্থ মিলেমিশে আছে। পত্রিকার মালিক এই দুই ধরনের স্বার্থেই তাঁর মাইনে করা লেখকদের কাজে লাগিয়ে পাঠক-পাঠিকাদের মগজ ধোলাই করে।

এ-যুগের সাংস্কৃতিক পরিবেশ এমনই হাজারো উপায়ে হাজারো ফন্দিতে মুঠোবন্দী করে রেখেছে হুজুরের দল, হুজুর-মজুর সম্পর্ককে বজায় রাখতেই। দেশের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের এই বিশাল দূষণ নিয়ে, পচন নিয়ে নীরব কেন সেসব রাজনৈতিক দল যারা গরীবি হটাতে চায়, যারা শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের হাতিয়ার? যারা দেশপ্রেমী জাতীয়তাবাদী? ওদের নীরবতার একটাই অর্থ- ওরা চায় এই সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ বজায় রাখতে,  তাই তো পরিবেশ বলতে শুধুমাত্র ‘প্রাকৃতিক প্রিবেশ’র কথা আমাদের মাথায় ঢোকাতে দীর্ঘস্থায়ী লাগাতার প্রচার চালিয়েই যাচ্ছে।

error: Content is protected !!