শ্রদ্ধেয় মেঘনাথ সাহার বক্তব্য থেকে জানতে পারি, তাঁর সংগৃহীত তথ্য অনুসাবে আমাদের দেশের শতকরা ৯৯ ভাগ পুরুষ ও ১০০ ভাগ মহিলা ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসী । ইউরোপে ফলিত জ্যোতিষে আস্থাবান পুরুষের সংখ্যা শতকরা ৫ জন ও মহিলার সংখ্যা শতকরা ৩৩ জন ।

তারপর অনেক বছর অতীত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশও প্রভাবিত হয়েছে। পরিবেশগতভাবে সে-সব দেশের মানুষ আরো বেশি বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনিষ্ঠ হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। ফলে অন্ধবিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করার মতন মানুষের সংখ্যাও কমার কথা। কিন্তু সব সময় সব কিছু সরল নিয়মে চলে না। মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা বিভ্রান্ত হয় প্যারাসাইকোলজিস্টদের দ্বারা, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো কিছু মানুষের দ্বারা। এই বিজ্ঞানবিরোধিতা ঠেকাবার রাস্তাও সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে নিচ্ছে বিজ্ঞানই, বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষরাই।

আমাদের দেশেব মানুষদের মধ্যে জ্যোতিষ-বিশ্বাসীর শতকরা আনুমানিক হার নিয়ে কোনও গবেষণা এখনও পর্যন্ত হয়নি। তবে অতি সামান্যভাবে আমাদের সমিতি প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের ওপর কিছু অনুসন্ধান চালিয়েছে। অবশ্য আমাদের অনুসন্ধানগুলোর মতামত সংগ্রহীত হয়েছিল আমাদের সমিতি পরিচালিত কুসংস্কার বিরোধী শিক্ষণ-শিবিরে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থেকে।

আমাদের সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তরফ থেকে প্রতি মাসে অন্তত একটি করে কুসংস্কার-বিরোধী শিক্ষণ-শিবির পরিচালনা করা হয় গ্রামে-গঞ্জে, আধা-শহরে এবং শহরে । এ-ছাড়া সপ্তাহের সোম, বুধ, শুক্র, কলকাতা অফিসে ক্লাশ চলে। এ ছাড়াও অনেক সময় কলকাতা অফিসে বাড়তি শিক্ষণ-শিবিব চালান হয়ে থাকে । যারা আগ্রহ নিয়ে শিক্ষণ-শিবিরে বা ক্লাসে নিজেকে যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মী হিসেবে তৈরি করার মানসিকতা নিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই যে সাধারণ মানুষদের চেয়ে যুক্তিতে কিছুটা এগিয়ে থাকবেন, কুসংস্কার থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত থাকবেন—এটা নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত। এমনি আন্দোলনকর্মী হতে এগিয়ে আসা মানুষদের মধ্যে থেকে ৩০০০ জনের কাছে একটি ছাপান মতামত- জ্ঞাপনপত্র হাজির করেছিলাম। একটু জানিয়ে রাখি, এঁদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ছিলেন, ছিলেন অধ্যাপক, শিক্ষক, ছাত্র, সাংস্কৃতিককর্মী, শ্রমিক, কৃষক, লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ইত্যাদি। মতামত জ্ঞাপনপত্রের একটি প্রতিলিপি এখানে তুলে দিলাম:

প্রশ্ন পড়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তরে √ চিহ্ন দিতে হবে ।

১। ঈশ্বরজাতীয় কারও অস্তিত্ব বাস্তবিকই আছে কী ? হ্যাঁ / না

২। ঈশ্বরজাতীয়রা কী কখন কখন মানুষের ওপর ভর করেন ? হ্যাঁ / না

৩। প্ল্যানচেটের সাহায্যে কী আত্মা আনা সম্ভব ? হ্যাঁ / না

৪। ভূত আছে কী ? হ্যাঁ / না

৫। ভূত কী কখন কখন মানুষের ওপর ভর করে ? হ্যাঁ / না

৬। আত্মা কী অমর ? হ্যাঁ / না

৭। কারো পক্ষে কী জাতিস্মর হওয়া সম্ভব ? হ্যাঁ / না

৮। তুকতাকের বাস্তব অস্তিত্ব আছে কী ? হ্যাঁ / না

৯। মন্ত্রে কী অলৌকিক কোনও কিছু ঘটান সম্ভব ? হ্যাঁ / না

১০। অতীতের কোনও অবতারের অলৌকিক ক্ষমতা ছিল কী ? হ্যাঁ / না

১১। বর্তমানেব কেউ কেউ কী অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ? হ্যাঁ / না

১২। জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্যে হাত দেখে বা জন্ম ছক দেখে কী কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব ? হ্যাঁ / না

১৩। ‘ভাগ্য’ বলে কিছু আছে কী ? হ্যাঁ / না

১৪। গ্রহ-নক্ষত্ররা কী ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে ? হ্যাঁ /না

১৫। সঠিক গ্রহরত্ন পরলে কী ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটান সম্ভব ? হ্যাঁ / না

১৬। ধাতু, শিকড় বা মাদুলি ধারণ কবে কী ভাগ্য পাল্টান সম্ভব ? হ্যাঁ / না

১৭। তামা কী বাত কমাতে সাহায্য করে ? হ্যাঁ / না

১৮। বিষ-পাথবে কী সাপের বিষ তোলা যায়? হ্যাঁ / না

১৯। মন্ত্রশক্তির সাহায্যে সাপের বিষ কী নামান যায় ? হ্যাঁ / না

২০। বাটিচালান, কণ্যিচালান, নখদর্পণ বা চাল-পড়া খাইযে কী চোর ধরা যায ? হ্যাঁ/ না

২১। ‘টেলিপ্যাথির’র অস্তিত্ব বাস্তবিকই আছে কী ? হ্যাঁ / না

১২, ১৩, ১৪, ১৫ এবং ১৬ নম্বর প্রশ্নগুলো সরাসরি জ্যোতিষশাস্ত্র সংক্রান্ত। এই পাঁচটি প্রশ্নের অন্তত একটিতে ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন ১৩১২-জন অর্থাৎ শতকরা ৪৩.৭৩ জন। ১৭ নম্বর প্রশ্নটি সরাসরি জ্যোতিশাস্ত্র সংক্রান্ত না হলেও শরীরে ধাতুর প্রভাব বিষয়ে কী ধারণা উত্তরদাতা পোষণ করেন, সেটা বোঝা যায়। ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন ২১৪৫জন। অর্থাৎ শতকরা ৭১.৪১ জন

যুক্তিবাদী আন্দোলনে এগিয়ে আসা মানুষদের মধ্যে যদি শতকরা ৪৪ জন অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী হন এবং শরীরে ধাতুর প্রভাব বিষয়ে শতকরা ৭১ জন ভুল ধারণা পোষণ করে থাকেন, তবে সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী এবং শরীরে ধাতুর প্রভাব বিষয়ে বিশ্বাসীর সংখ্যা যে এর চেয়ে অনেক বেশি হবে, এবং বিশাল সংখ্যকই হবে, এটুকু আমরা নিশ্চয়ই সাধারণ যুক্তি বুদ্ধিতেই অনুমান করে নিতে পারি ।

অবশ্য এটুকু জানান নিশ্চয়ই অমূলক হবে না, শিক্ষণ-শিবির শেষে একই মতামত জ্ঞাপনপত্র আমাদের সমিতি আবারও হাজির করেছিল ওই ৩০০০ ব্যক্তির কাছে। তাতে শতকরা ১০০ ভাগ অংশগ্রহণকারীই ১ থেকে ২১ প্রশ্নের প্রতিটিতেই ‘না’-এর পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন।

সাধারণের তুলনায় চিন্তায় কিছুটা যুক্তির পক্ষে এগিয়ে থাকা মানুষদের একটা বিশাল অংশই যদি জ্যোতিষশাস্ত্র, ভাগ্য, শরীরে ধাতুর প্রতিক্রিয়া বিষয়ে ভুল ধারণার শিকার হন, তবে সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে ভুল ধারণার বশবর্তীর ব্যাপকতা অনুমান করতে কোনও কষ্ট হয় না। তবে আমার কথা, স্বাভাবিক মানুষের চিন্তার গতি সর্বদাই যুক্তির পক্ষে, তাই আমরা সংখ্যায় দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে বেড়েই চলেছি। সুযুক্তি, সঠিক যুক্তিব সঙ্গে পরিচিত হতে পারেনি বলেই মানুষ কুযুক্তিকেই গ্রহণ করেছে। সঠিক যুক্তি গ্রহণের সুযোগ কম বলেই এমনটা ঘটেছে। আমরা যদি মানুষের সামনে বার-বার সঠিক যুক্তি বেশি করে হাজির করতে থাকি, কুযুক্তির বন্ধন ছিন্ন করে মানুষ বেরিয়ে আসবেই।

আশার কথা ছেড়ে আবার একটু অনুসন্ধানের প্রসঙ্গে আশা যাক। আমাদের চালান অনুসন্ধান থেকে দেখেছি বিজ্ঞানের শিক্ষক, বিজ্ঞানের অধ্যাপক, চিকিৎসক এবং অন্যান্য বিভিন্ন পেশার অনেক মানুষও অদৃষ্টবাদের পক্ষে কোনও না কোনওভাবে মত প্রকাশ করেছিলেন। এমনতর বিজ্ঞান বিরোধী একান্তভাবেই শুধুমাত্র বিশ্বাসনির্ভর অদৃষ্টবাদী চিন্তা ওইসব বিজ্ঞান পেশার মানুষদের কেন প্রভাবিত করল? ওঁরা তো শিক্ষার সুযোগ লাভে অক্ষম মানুষ নন? ওঁরা তো অনিশ্চিত পেশার সঙ্গেও যুক্ত নন ? তবে?

এই তবের একটিই উত্তর—পরিবেশই এইসব বিজ্ঞান পেশার মানুষদের অদৃষ্টবাদী করেছে ।

সাধারণভাবে দারিদ্র্যতা, শিক্ষার সুযোগ না পাওয়ার দরুণ অজ্ঞতা এবং অনিশ্চিত জীবনযাত্রার জন্য মূলত দায়ী আমাদের বর্তমান সমাজের প্রচলিত আর্থিক ব্যবস্থা, অর্থাৎ আর্থসামাজিক পরিবেশ। অর্থ-স্বাচ্ছন্দের মধ্যে বেড়ে ওঠা উচ্চশিক্ষিত মানুষরা যখন অন্ধ- বিশ্বাস-কুসংস্কারের দাস হয়, তখন এমনতর ঘটনার জন্য অবশ্যই দায়ী ওইসব উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত মানুষদের পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব, সমাজ-সাংস্কৃতিক পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব

মানুষের ওপর পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব বা পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা যেহেতু দ্বিতীয় খণ্ডে করা হয়েছে, তাই এইখণ্ডে আবাব সেই একই প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা নিতান্তই প্রয়োজনহীন। তবে তৃতীয় খণ্ডেই যাঁরা ‘অলৌকিক নয, লৌকিক’ বইটির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হলেন, তাঁদের বোঝাব সুবিধের জন্যে অতি সংক্ষেপে মানুষের ওপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে আলোচনা সেরে নিচ্ছি।

error: Content is protected !!