পরামনোবিদ্যা বা Parapsychology নিয়ে আলোচনার গভীরে ঢোকার আগে Parapsychology-র বিষয়বস্তু কি? সংজ্ঞা কি? এগুলো আগে জানা থাকলে পরবর্তী আলোচনায় আমাদের ঢুকতে সুবিধা হবে।

যুগ যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধর্মগুরু, পুরোহিত, ওঝা-গুণিন ইত্যাদির উৎপত্তি হয়েছে, হচ্ছে এবং জানি না আরও কত যুগ ধরে হবে। এই সব শ্রেণীর লোকেরা বরাবরই নিজেদের প্রচার করেছেন, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী বলে। আমাদের সাধারণভাবে পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। বিশেষ কোন কারণে ইন্দ্রিয় পাঁচের কম হতে পারে। কিন্তু পাঁচের বেশি হতে পারে না। এই পাঁচটির কোন এক বা একাধিক ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কোন কিছু অনুভব করি। ক্ষমতালোভী কিছু মানুষ নিজেদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অধিকারী বলে দাবী করে। এরা তান্ত্রিক, ওঝা বা অতিন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করেন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পাওয়া অতিরিক্ত অস্বাভাবিক ক্ষমতার নাম দিয়েছেন, ‘অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা’, ইংরেজিতে যাকে বলে Extra-sensory perception বা সংক্ষেপে E.S.P।

Parapsychology বা পরামনোবিদ্যা গড়ে উঠেছে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি (E.S.P) জাতিস্মর ও মৃত ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ (Planchette) –কে আশ্রয় করে।

পরামনোবিদ্যার উপর গত কয়েক বছরে বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। সবগুলো পড়ার সুযোগ না হলেও কয়েকটিও পড়েছি। তাতে লক্ষ্য করেছি নতুন তথ্যের অভাব এবং পুরোনো তথ্যগুলোকেই বিজ্ঞানগ্রাহ্য করে তোলার চেষ্টা। পরামনোবিজ্ঞানীদের একটা প্রচেষ্টা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো, তা হল, ওরা প্রমাণ করতে চান রাশিয়ার মতো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী দেশের বিজ্ঞানীরাও পরামনোবিদ্যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। Wolman সম্পাদিত “hand-book of Parapsychology”, Van Nostrand – New York 1971 বইটিতে ‘Soviet Institute of Brain Research’ –এ গবেষণারতদের পরামনোবিদ্যা সংক্রান্ত কিছু মন্তব্যের উল্লেখ আছে। যেমন, ‘Their (the research team of the Soviet Institute of Brain Research) first efforts were directed towards confirming” one … Italian physiologist’s claim “that he had discovered brain waves approximately 1 c.m in length, which could be ideal basis of telephathy, Soviet Scientists failed to confirm this claim.” (Page 887)

Wolman-এর Handbook of parapsychology বইটিতে আরও বলা হয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে “ন্যাটিলাশ” ডুবোজাহাজে আমেরিকান সেনাবাহিনীর সাহায্যে টেলিপ্যাথি সংক্রান্ত যে সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছিল তা রাশিয়াকেও অনুপ্রাণিত করে। ক্রুশ্চফ-এর শাসনকালে রুশ সরকার পরামনোবিদ্যার চর্চাকে যথেষ্ট উৎসাহ দান করে! “The Nautilus experiment was latter shown to be a hoax of fiction masquerading as science but it was apparently quite seriously taken up in Russia. From the political point of view the authorities, it appears, were reluctant to ignor parapsychology if there was any likelihood that the American military establishment was conducting successful experiments in U.S.A.” (Page-887)

আর এক পরামনোবিজ্ঞানী Hans Hozer তাঁর “Truth About E.S.P.” বইটিতে জানান, “রাশিয়ার অন্তত ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরো সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কর্মী নিয়োগ করে পরামনোবিদ্যার গবেষণাকেন্দ্র খোলা হয়েছে। আরও কথা হল, ওখানে গবেষকদের কাজ-কর্মের ওপর কোনও রকম বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না (সরকারি তরফ থেকে) এবং স্বাধীনভাবে যে কোনও কিছু ছেপে প্রকাশ করতে দেওয়া হয়, এমন কি তা মার্কসবাদকে সমর্থন করুক বা না করুক।“ (পৃষ্ঠা – ১৮)

“At this time there are the least 8 Universities in the Soviet Union with full time, full-staffed research centres in Parapsychology. What is more, there is no restictians placed upon those working in the field and they were free to publish anything they confirm to dialectical Marxism.” (Page 18)

ঐ বইয়েই Holzer বলেছেন, “E.S.P. is no way interferes with their political philosophy; dialectical Marxism may be opposed to the soul in man, but it seems quite compatible with telepathy and communication between minds, … Although the Russions cling to the nation that there is a physical basis for E.S.P faculties. (ibid, Page 40)

বইগুলির এই লেখাগুলি পুরোপুরি সত্যি হলে শুধুমাত্র এইটুকুই ধরে নেওয়া যায় রাশিয়াতেও এক সময় পরামনোবিদ্যা নিয়ে গবেষণা চলেছে। তার মানে এই নয় যে, পরামনোবিদ্যাকে রাশিয়ার ‘বিজ্ঞান একাডেমি’ স্বীকৃতি দিয়েছে। এই গবেষণার ফল পরামনোবিদ্যার যথার্থতা বা অসারতা দুইয়ের যে কোনটিই প্রমাণ হতে পারে।

আমি প্রবীর ঘোষ, অতীন্দ্রিয় শক্তি নিয়ে অনুসন্ধান করছি বলে এই নয় যে, আমি এর যথার্থতা স্বীকার করে নিয়েছি। অনুসন্ধান বা গবেষণা কোনও কিছুর স্বীকৃতি নয়।

যতদিন না অতীন্দ্রিয় অনুভূতি, জাতিস্মর ও প্ল্যানচেট নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য ‘বিজ্ঞানসম্মত তথ্য’ পরামনোবিজ্ঞানীরা হাজির করতে পারছেন, ততদিন কোন বিজ্ঞান মনস্ক, যুক্তিবাদী মানুষ এই তথ্যকে সত্য বলে স্বীকার করে নেবেন না। ‘বিজ্ঞানসম্মত তথ্য’ বলতে বোঝাচ্ছি সেই সব তথ্যকেই যা অন্য পরীক্ষাকেন্দ্রেও এই শর্তাধীন অবস্থায় অন্য পরীক্ষকদের দ্বারা পরীক্ষিত এবং সমর্থিত।

Hans Holzer রাশিয়ার ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চলার কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁদের নাম উল্লেখ করেননি, ফলে তাঁর বক্তব্যের সত্যতা বিষয়ে বেশ কিছুটা সন্দেহ থেকে যায়। রাশিয়ায় পরামনোবিদ্যা চর্চার সত্যতা জানতে ১৯৭৫ সালে ‘সোভিয়েট বিজ্ঞান অ্যাকাদেমি’র সঙ্গে যোগাযোগ করেন ভারতের কিছু প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ও শারীরবিজ্ঞানী। উত্তরে বিজ্ঞান অ্যাকাদেমির সাইন্টিফিক সেক্রেটারী আর. এল. গলিনোভা ১৯৭৫-এর ১৭ এপ্রিল যে চিঠি পাঠান, তা পড়লেই বোঝা যায়, এই বিষয়ে রাশিয়ায় উচ্চতম বিজ্ঞান চর্চার সংস্থা ‘বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি’ খুব একটা আগ্রহী বা ওয়াকিবহাল নন।

বিখ্যাত রুশ মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক আসরেটিয়ান রাশিয়ায় পরামনোবিদ্যা বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার চর্চা বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে একটি চিঠিতে লেখেন, “There is no Special Institute in our country on investigations in the field of “mystic process” but there are some scientists, and particularly. Dr. Yu. A. Kholodov, in our institute, who works on the problems, which are closed to that you are interested in. And under separate cover I am sending to you some reprints of Dr. Yu. A. Kholodov’s works.” (মানবমন’ পত্রিকার ১৯৭৫ সাল সংখ্যা)

ডঃ খোলজেভ-এর Dr. Kholodov গবেষণার যে বিবরণ চিঠির সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল, তা পড়লে স্পষ্টতই বোঝা যায়, তাঁর অনুসন্ধানের বিষয় – তড়িৎচুম্বক শক্তি কিভাবে অনেক সময় ইন্দ্রিয় মাধ্যম ছাড়াই মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করতে পারে। তাঁর লেখায় এমন কিছুই ছিল না, যার দ্বারা মনে হতে পারে তিনি পরামনোবিদ্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন বা কোনও অতীন্দ্রিয় শক্তির পরিচয় পেয়েছেন।

আসুন, এবার দেখা যাক পরামনোবিজ্ঞানীদের পীঠস্থান আমেরিকায় পরামনোবিদ্যা নিয়ে কি ধরনের কাজ চলছে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে পরামনোবিদ্যায় চর্চা শুরু হয়েছে জোর কদমে। ডঃ জে.বি. রাইন, ডঃ মিসেস লুইসা রাইন, ওয়াল্টার লেভি ইত্যাদি পরামনোবিজ্ঞানীরা প্যারাসাইকোলোজির পক্ষে নানা ধরনের সফল পরীক্ষা (?) চালিয়ে সারা বিশ্বে দস্তুর মতো ঝড় তুলেছিলেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ-ক্যারোলিনা স্টেটের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামনোবিদ্যার অধ্যাপক ও অধ্যাপিকা শ্রী ও শ্রীমতী রাইন পরামনোবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করে বেশ কিছু প্রকাশ করেন। ডঃ জে.বি. রাইন পরবর্তীকালে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইকোলোজি বিভাগের ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। অবশ্য এক সময় ডঃ রাইন-এর অবৈজ্ঞানিক কাজকর্ম নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর ‘গবেষণা’ বন্ধ করে দেন। তাতে অবশ্য রাইনের মতো করিৎকর্মা লোক দমে না গিয়ে তাঁর স্ত্রী লুইসা ই. রাইন-এর সহযোগিতায় নর্থ ক্যারোলিনা স্টেটেই ডারহাম –এ Institute of Parapsychology প্রতিষ্ঠা করেন। ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর হন আর এক পরামনোবিজ্ঞানী ওয়াল্টার লেভি।

১৯৭৪-এর আগস্ট, পরামনোবিজ্ঞানীদের কাছে ‘কালা দিবস’ হিসেবে পরিচিত। এই বিশেষ দিনটিতে ওয়াল্টার লেভি সফল পরামনোবিদ্যার পরীক্ষা দিতে গিয়ে তাঁরই প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের হাতে ধরা পড়ে যান। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে যারা পরামনোবিদ্যার সত্যতায় বিশ্বাস স্থাপন করে অথবা সত্যতা অনুসন্ধানের জন্য এই ইন্সটিটিউটে যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরাই এই অতীন্দ্রিয় পরীক্ষার সফলতার পিছনে যে যান্ত্রিক কলা-কৌশল আছে –তা ফাঁস করে দেন। শ্রী ও শ্রীমতী রাইন-কে চূড়ান্ত অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে ফেলে ওয়াল্টার লেভি পালিয়ে যান।

ভারতেও পরামনোবিদ্যার ঢেউ এসে লেগেছে। ১৯৮৪-র ২১ ও ৩১ এপ্রিল নায়াদিল্লির গান্ধী মেমোরিয়াল হলে পরামনোবিদ্যার এক আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্র হয়েছিল। আমন্ত্রিত ছিলেন দেশ বিদেশের প্রচার মাধ্যমগুলো ও কিছু ভি.আই.পি ব্যক্তি। আর উপস্থিত ছিলেন পরামনোবিজ্ঞানী এবং সর্বোপরি পরামনোবিদ্যার অধিকারী অবতারেরা।

ঈশ্বরের অবতারেরা প্রথম দিনেই বক্তব্য রাখলেন –যে বিদ্যা আয়ত্ব করা দুনিয়ার সব থেকে কঠিন, তা হল পরাবিদ্যা। পরামনোবিদ্যাই হল ব্রক্ষ্মবিদ্যা। পরাবিদ্যার সাহায্যে নিজেকে জানা যায়, নিজের আত্মাকে (?) জানা যায়।

অধিবেশনে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছিলেন লিন ডেভিড মার্টিন, দুবাই থেকে ঈশ্বর বাবা, কানাডা থেকে ফ্লাইং বাবা। আরও যারা এসেছিলেন তাঁদের সব অদ্ভুত অদ্ভুত নাম, যেমন, আত্মা বাবা, পাইলট বাবা, লাল বাবা, বালতি বাবা, তৎ বাবা, আরও কত কি। এছাড়াও ছিলেন স্বামী আত্মানন্দ, সাধক সন্তোষ চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি। বাবাদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার খবর আমাদের দেশের প্রায় সব ভাষা-ভাষীর প্রধান পত্র-পত্রিকাগুলোতেই প্রকাশিত হয়েছিল। আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবেদনটির কিছুটা এখানে তুলে দিচ্ছি। এই প্রতিবেদনটি পড়লে বাবাদের ক্ষমতার কিছুটা আঁচ আপনারা পাবেন বই কিঃ

এক একজন এক এক ধাঁচের অলৌকিক শক্তির অধিকারী। কেউ নাকি মাসের পর মাস সমাধিস্থ থাকতে পারেন গ্রাণ স্পন্দনকেও থামিয়ে দিয়ে। কেউ আবার কার কি জিজ্ঞাসা আছে এবং তাঁর নাম, ধাম পরিচয়ই বা কি, তাও আগে ভাগে বলে দিতে পারেন।

তাঁদের কেউ কেউ অধীত শক্তির পরিচয় দিলেন। সঠিক উত্তর না পেয়ে দর্শকদের মধ্যে থেকে অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করতেও ছাড়লেন না। বাবারা অবশ্য নির্বিকার। সন্দেহকারীদের দিকে কৃপার দৃষ্টি হেনেছেন শুধু।। ভাবখানা যেন, আমাকে পরীক্ষা করতে এসেছ?

অবিশ্বাসের গোড়াপত্তন কিন্তু আলোচনাচক্রের শুরু থেকেই। কৃষি দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী যোগেন্দ্র মাকোয়ানা ভগবান বিষ্ণুর ছবিতে মালা দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে উদ্বোধনী ভাষণ শুরু করলেন এভাবে- “অবিশ্বাসী হলেও খোলা মন নিয়ে আমি এসেছি, কারণ দেশের অনেক ঋষি-মহর্ষিই এক সময় আমাকে ভগবান দর্শনের জন্য মন্দিরে ঢুকতে দেননি। আমি নাকি অচ্ছুৎ। ঈশ্বর দর্শন করতে তাই আমি মন্দিরে যাই না। যে-সব বাবা এখানে এসেছেন, তাঁরা নাকি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁরা নাকি অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী। বিশ্বাস আমি করি না, তবে মন খোলা রেখেছি। বিশ্বাস করলে বলে যাব। আমি বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, বুজরুকিতে নই।“

মাকোয়ানার এই কথায় যেন অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল। মঞ্চে বসা পাইলট বাবা, বালতি বাবার চোখ জ্বলে উঠল। বিচারপতি ভি কৃষ্ণ আয়ার পাক্কা সাতান্ন মিনিট ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন, পরাবিদ্যা ও অতীন্দ্রিয় শক্তি নিয়ে শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে আজ চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষা চলছে রাশিয়া-আমেরিকার মতো বিজ্ঞানে উন্নত দেশগুলিতেও। তিনি জানালেন, অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রয়োগেই জর্জিয়ার এক মহিলা অসুস্থ রুশ প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে দীর্ঘ স্বস্তি দিয়েছিলেন। রুশরা এই পরাবিদ্যাকে বলছে বায়ো-এনার্জি। এটা শুধু বিজ্ঞান-নির্ভর নয়, পুরোপুরি বিজ্ঞান।

বক্তৃতায় আর মন ভরছে না। সুবেশা মহিলারা আসনে এগিয়ে বসেছেন আগ্রহে; বাবাদের কৃপাপ্রার্থী তাঁরাই বেশি। অতঃপর বালতি বাবার ক্ষমতা দেখানো শুরু হল। পাঁচজন সাংবাদিক, পাঁচজন মহিলা ও পাঁচজন সাধারণ দর্শক নির্দিষ্ট হলে একটি করে প্রশ্ন মনে মনে তাঁরা ভাববেন। উনি বলে দেবেন কে কি ভেবেছে। কিভাবে?

মঞ্চে একটা বালতি এল। তাতে পরিমাণমতো জল ও দুধ ঢাললেন তিনি। সাদা কাগজ ফেলে দিলেন তাতে। বালতির মুখ চাপা দিলেন খবরের কাগজ দিয়ে। অল্পক্ষণ মুদ্রিত নেত্রে ধ্যান। তারপর হাত ঢুকিয়ে সেই সাদা কাগজ বের করা হবে। তাতে লেখা থাকবে প্রশ্নকর্তার নাম ও উত্তর।

নির্দিষ্ট সাংবাদিকদের মধ্যে আমি ছিলাম। প্রশ্ন ছিল মেহতা ও ইদ্রিস হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে কি না। বালতি বাবা কোন উত্তর কিন্তু দেননি। পাশে বসা এক মহিলা সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল লোকসভার নির্বাচন হবে না পিছুবে। তার কোন জবাবও তিনি দিলেন না। ১৫ জনের মধ্যে জবাব পেলেন পাঁচজন। তাঁরা অবশ্য জানালেন জবাবে সন্তুষ্ট।

এইভাবে ক্যালিফোর্নিয়ার ‘সাধক’ লিন ডেভিড মার্টিনও তাঁর অধীত শক্তির পরীক্ষা দিলেন। ভাঁজ করা প্রশ্ন চোখ বন্ধ করে কপালে ঘষে তিনি জবাব দেন। চারজন প্রশ্নকর্তা বললেন, উত্তরটা কেমন যেন ভাসা ভাসা হল। আর একজন মঞ্চে উঠে গিয়ে তাঁকে স্পষ্ট বলে এলেন, এই প্রশ্ন আমি করিনি। জবাবটাও আমার নয়। আমি জানতে চেয়েছিলাম আমার বন্ধুর হারিয়ে-যাওয়া ছেলেটি ফিরবে কি না। লিন কড়া চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বসে পড়েন। আর কোন প্রশ্নকর্তার জবাব তিনি দেননি। আমারটাও নয়।

সেমিনারে কনভেনার এম সি ভান্ডারি কলকাতার মানুষ। তাঁর ভাষায়, বিজ্ঞান ও অলৌকিকতার পার্থক্য, প্রকৃত সাধক ও জোচ্চোরদের পার্থক্য দেখতেই এই আলোচনা সভার আয়োজন। আর বিশ্বশান্তির জন্য যোগীরা কি অসাধ্য সাধন করতে পারেন, সাধারণ মানুষকে তা জানানোই সম্মেলনের লক্ষ্য। সুযোগ দিলে এই যোগীরা নাকি মহাশূন্যের হাঁড়ির খবর দিয়ে যেতে পারেন। পাইলট বাবা সে কথাই সগর্বে ঘোষণা করলেন, “এই সরকার এত অর্থ ব্যয় করে রাকেশ শর্মাকে মহাকাশে পাঠাল। কি তথ্য সে জানিয়েছে? দিক আমার দায়িত্ব, হাজার গুণ বেশি খবর আমি জানিয়ে দেব।“

তাই শুনে কলকাতার যোগী ও দিল্লিতে আশ্রম তৈরি করে সমাজসেবায় ব্যস্ত ‘মাধবী মা’ বললেন, “যত সব বুজরুকি। জানান না যা উনি জানাতে পারেন। কেউ বারণ করেছে?”

পাইলট বাবাকে এই কথা জানাই। বিহারের সাসারামের এই যোগী তা শুনে করুণার দৃষ্টিতে তাকালেন। শুধু বললেন, ’৫৬ থেকে ৭১’ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সে ন্যাট ও হান্টার চালিয়েছি। ৬৫-তে পাকিস্থানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। তারপর আত্মসন্ধানে সংসারত্যাগী হই। ব্রক্ষ্মের দেখা পাই মহাকাশে বিমান চালানোর সময়। একাধিকবার। ৭৩ থেকে হিমালয়ে সাধনা। সিদ্ধি পেয়ে চলে এসেছি ৮০ সালে। এখন বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করছি। সারা পৃথিবীতে ১০ কোটি শিষ্য। এই মহাশূন্য, এই ব্রক্ষ্মান্ড সম্পর্কে জানি না এমন কিছুই নেই। সরকার দায়িত্ব দিক, সব সন্দেহ দূর করে দেব।‘

দুদিন ধরে বাবাদের এই কান্ড চলবে। তৎ বাবা চোখ বন্ধ করিয়ে কুন্ডলিনীর স্পর্শ দেবেন। পাইলট বাবা সমাধিস্থ হয়ে থাকবেন। তাঁর আত্মা ত্যাগ করবে শরীর, বন্ধ হবে প্রাণের স্পন্দন। সেই অবকাশে তিনি বিচরণ করবেন মহাশূন্যে। কানাডার ফ্লাইং স্বামী সমাধিস্থ অবস্থায় ভেসে থাকবেন দীর্ঘ সময়।

কলকাতা থেকে সম্মেলনে আমন্ত্রিত সাধক সন্তোষ চট্টোপাধ্যায়। “অতীন্দ্রিয় শক্তি, সাধনায় অর্জন করা সম্ভব” –বললেন তিনি। “তেমন সাধক বামাক্ষ্যাপা, তৈলঙ্গস্বামী, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। ঠাকুর অষ্ট অনিষ দান করেছিলেন স্বামীজিকে। স্বামীজিই পেরেছিলেন তা প্রত্যাহার করতে। কারণ এই শক্তি মানুষকে লোভী করে তোলে, করে ধাপ্পাবাজ। সাধক শঙ্করাচার্য রাজা আমরূপের দেহে প্রবেশ করেছিলেন কামশাস্ত্র জানতে। যোগ সাধনায় সিদ্ধ না হলে এ অসম্ভব। আর অনেক সিদ্ধ পুরুষই ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে অনাচারী হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী হয়। দেখতে হবে এখানে ক্তজন প্রকৃত, কতজন জাল।“

হিমালয়সিদ্ধ স্বামী আত্মানন্দের আগমনও এই এক উদ্দেশ্যে। আমন্ত্রিত নন উনি। বললেন, হিমালয়ে থাকি। নির্দেশ পেয়ে চলে এসেছি। সুবেশা দুই তন্বীর সঙ্গে একান্তে আলাপচারী স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করি –কি বুঝছেন? কতটা দুধ, কতটা জল? প্রশ্ন শুনে উনি গম্ভীর হন এবং স্থান ত্যাগ করেন সঙ্গীদের বিমূঢ় রেখে। সম্মেলনে নিন্দিকের অভাব ছিল না। প্রকাশ্যেই আলোচনা শোনা গিয়েছে, রতাজনীতিবিদদের ওপর যোগীদের প্রভাবের কথা। স্থানীয় এক সাংবাদিক চেপে ধরেছিলেন সম্মেলনের কনভেনার ভাণ্ডারিকে। উনি বললেন, যোগীরা বলেছেন, ওর হাতে নাকি বড় রাজনীতিক হবার রেখা আছে।

 

Extra-sensory perception বা E.S.P. (অতীন্দ্রিয় অনুভূতি)

অতীন্দ্রিয় অনুভূতি বা E.S.P মোটামুটিভাবে সাধারণত চার রকমের। (১) Telepathy (দূরচিন্তা) (২) Precognition (ভবিষ্যৎ দৃষ্টি) (৩) Clairvoyance (অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি) (৪) Psycho-Kines বা PK (জড় পদার্থে মানসিক শক্তি প্রয়োগ) আগেই স্পষ্ট বলে রাখা ভাল, এই ধরনের ভাগগুলো করা হয়েছে পরামনোবিদ্যারই সূত্র ধরে। বিজ্ঞানের কাছে এইসব ভাগ একান্তই মূল্যহীন, কারণ বিজ্ঞানে অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তার স্থান নেই।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x