‘পরিবর্তন’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় ১৯৮৪ সালের ১৮ জানুয়ারী সংখ্যায় যে প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশিত হয়ে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছিল সেটির শিরোনাম হল – পরলোক থেকে আসা বিদেহী ডাক্তার মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকেও বাঁচিয়ে তুলছেন। লেখক- আনন্দস্বরূপ ভাটনাগর। মূল প্রতিবেদনটি সাপ্তাহিক ‘হিন্দুস্থান’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে অনুবাদ করে লেখাটি প্রকাশ করেন ‘পরিবর্তন’। অনুবাদ রুমা শর্মা।

প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছিল এইভাবেঃ

যিনি রোগাক্রান্ত হন, তিনি সাধারণত চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে যান। কেউ পছন্দ করে অ্যালোপ্যাথি। কেউ হোমিওপ্যাথি কেউবা কবিরাজি। ইদানিং শোনা যাচ্ছে আকুপাংচার করে রোগ উপশমের কথা।

কিন্তু পরলোক থেকে ডাক্তার এসে রোগ নিরাময় করছেন এ খবর নতুন। বিদেশেও হ্যারি এডওয়ার্ড একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে হাজার হাজার মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকেও বাঁচিয়েছেন।

কি তাঁদের চিকিৎসা পদ্ধতি? রোগী রোগিনীদেরই বা প্রতিক্রিয়া কি? তারই বিস্তৃত প্রতিবেদন।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিলঃ

 

“পরলোক সম্বন্ধে ধারণা”

বাস্তবে যে ব্যক্তি ইহলোকে সারা জীবন ডাক্তারী করে গেছেন পরলোকে গিয়েও তাঁর সে ইচ্ছা থেকে যায়। ,আমাদের চিন্তাই আমাদের ব্যক্তিত্বের আধার এবং ঠিক সেভাবেই আমরা নিজস্ব কার্যকলাপ অনুধাবন করি। সে চিন্তাচ্ছন্নতাই মৃত্যুর পরও আমাদের সঙ্গে থেকে যায়। অধিকাংশ লোকের পরলোক সম্বন্ধে ভুল ধারণা রয়েছে। তাঁরা ভাবেন সূক্ষ্মলোকে হয়ত ভূত-প্রেত রয়েছে বা মৃত্যুর পর আত্মা খুব তাড়াতাড়ি অন্যত্র দেহধারণ করে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। সূক্ষ্মলোকতত্ত্ব ও তাতে জীবনের গতিবিধি একটি স্বতন্ত্র বিষয়। মূলত একথা বলা যেতে পারে যে এ জগতের শ্রেষ্ঠ এবং পবিত্র আত্মাগণ যারা সঙ্গীতজ্ঞ, নাট্যকার, যোগী, কলাকার প্রভৃতি আপন সাধনায় নিমগ্ন থাকেন তাঁদেরই ভেতর থাকেন সে সব পরোপকারী আত্মা, যারা ভূ-পৃথিবীতে নেমে এসে নানারকম ভাবে মানুষের সাহায্য করেন। পরলোকপ্রাপ্ত ডাক্তাররাও রোগীর সেবায় রত থাকতে চান। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁরা কোন সুপাত্রের মাধ্যমে লোক সেবা করেন। যারা উদার হৃদয় ও ধার্মিক স্বভাবসম্পন্ন তাদেরই মাধ্যমে তাঁরা রোগীর অসাধ্য রোগ উপশম করেন।

১৯৩৫-এর কথা। হ্যারি এডওয়ার্ডকে তাঁর এক বন্ধু একটি চার্চে নিয়ে যান। সেখানে এক আত্মার মাধ্যমে তাঁকে বলা হয় যে, তাঁর মধ্যে রোগ উপশম করার প্রতিভা রয়েছে। একই ভাবে অন্য চার্চেও সেই মাধ্যম দ্বারা তাঁকে একই কথা বলা হয়। তাই তিনি ভাবলেন, একটু চেষ্টা করে দেখাই যাক না। সে সময় তাঁরই এক বান্ধবীর বন্ধু ইংলন্ডের ক্রমপটন হাসপাতালে মরণাপন্ন অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন।

হ্যারি এডওয়ার্ড

তিনি ক্ষয় রোগাক্রান্ত ছিলেন। হৃদপিন্ডের স্ফীতি হওয়াতে ভেতরের নাড়ি ফেটে রক্তস্রাব হচ্ছিল। সেখানেই হ্যারি এডওয়ার্ড তাঁর সম্পূর্ণ নীরোগ হওয়ার কামনা করে মন একাগ্র করলেন। এক সপ্তাহ পর যখন তিনি তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, তিনি বললেন, তাঁর বন্ধুর হৃদপিন্ডের স্ফীতি এখন আর নেই। রক্তস্রাবও বন্ধ হয়ে গেছে। একথা শুনে তিনি অত্যন্ত উৎসাহিত বোধ করলেন এবং সেই ভাবেই রোগীর রোগ উপশম করার চেষ্টায় ব্রতী হলেন। কিছুদিন পর সেই রোগী সুস্থ হয়ে পুনরায় নিজের কাজে যোগ দেন।

একদিন হ্যারি এডওয়ার্ড নিজের ছাপাই ও স্টেশনারি দোকানে অন্যান্য দিনের মত কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় এক মহিলা দোকানের ভিতরে এসে বললেন, কে যেন তাকে  এই দোকানে ঢোকার জন্য প্রেরণা দিচ্ছে। তাই তিনি এসেছেন। তিনি বললেন, তাঁর স্বামী লন্ডনে একটি হাসপাতালের বক্ষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অনেকদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। হাসপাতালের ডাক্তারেরা তাঁর নীরোগ হওয়ার সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন। যেকটা দিন তিনি বেঁচে আছেন, সে কটা দিন তিনি বাড়িতে ফিরে গিয়ে যেন হাসিখুশিতে বাকী জীবনটা কাটান- এ উপদেশ দিয়েছেন।

 

বিদেহী আত্মার দ্বারা প্রতিকার

সেই মহিলার মনোকষ্টে হ্যারি এডওয়ার্ড অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং তাঁকে আশ্বাস দিলেন যে তাঁর স্বামীর চিকিৎসা তিনি বিদেহী ডাক্তারের মাধ্যমে করবেন। কিন্তু এ কথা বলা যত সহজ ছিল, বক্ষ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর রোগ ততই সন্দেহজনক মনে হতে লাগল। রাতে তিনি মন একাগ্র করে সেই বিদেহী আত্মার কাছে তাঁর নীরোগ হওয়ার প্রার্থনা করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সে রোগী খুব তাড়াতাড়ি সুস্থতা লাভ করে কাজে মনোনিবেশ করলেন। কিছুদিন পর মহিলাটি তাঁর স্বামীকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে পরীক্ষা করাবার জন্য এবং তিনি ডাক্তারদের জানালেন, যে দিন থেকে তিনি হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফিরেছেন সেদিন থেকেই কোন প্রকার পথ্য গ্রহণ করেননি। ডাক্তাররা অবিশ্বাসের হাঁসি হেঁসে বললেন, তাঁদের নির্ধারিত ওষুধের গুণেই তিনি সুস্থতা লাভ করেছেন।

এইভাবে হ্যারি এডওয়ার্ড তাঁর জীবনের প্রথম দুটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত অচিন্তনীয় ভাবে সফলতা পেয়ে গেলেন তাঁর স্পিরিচুয়াল হিলিং-এর মাধ্যমে। একে অ্যাবসেন্ট হিলিং বলা হয়। অতঃপর তিনি নিজের সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হলেন যে তাঁর ভেতর রোগ উপশম করার ক্ষমতা রয়েছে। একদিন একটি মেয়ে মধ্যরাতে তাঁর ঘরে এসে জানালেন যে তাঁর বোন জ্বরাক্রান্ত হয়ে বেঘোরে পড়ে আছে এবং তার সঙ্গে অন্যান্য কিছু উপসর্গও দেখা দিয়েছে। ডাক্তারেরা জবাব দিয়েছেন। তিনি এক পরাশক্তি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধ ব্যক্তির আদেশে হ্যারি এডওয়ার্ডের কাছে এসেছেন। সে রাত্রেই তাকে অ্যাবসেন্ট হিলিং দেওয়া হল। দ্বিতীয় দিন সকালে হ্যারি এডওয়ার্ড তাদের বাড়িতে গিয়ে বোনটির মাথায় হাত রেখে মঙ্গল কামনা করলেন। সে দিনটা বৃহস্পতিবার ছিল। হ্যারি এডওয়ার্ড জানালেন যে মেয়েটি সপ্তাহখানেক পরেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। পরিবার পরিজনেরা তার দিকে অবিশ্বাস্যভরে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু দেখা গেল রবিবার সকালে মেয়েটি বিছানায় বসে চা পান করছে এবং তার জ্বরও একদম ছেড়ে গেছে। অতঃপর দেখা গেল যে, সে মেয়েটি ক্ষয় রোগাক্রান্ত এবং পনের দিন অন্তর তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান হত এবং বায়ু সেবন করা হত। হ্যারি তাঁর এই নবার্জিত প্রয়াসকে অক্ষুন্ন রেখে কাজ করে চললেন। ক্ষয় রোগ থেকে মুক্তি পেল মেয়েটি। হাসপাতালের ডাক্তারেরা তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলে ঘোষণা করলেন। পরবর্তীকালে মেয়েটি সেই হাসপাতালে নার্সের কাজ পেয়েছে এবং এখন সেই কাজেই আছে। এভাবে শরীর স্পর্শ করে চিকিৎসার পদ্ধতিটিতে এই প্রথমবার তিনি সফলতা লাভ করলেন। এটি কনডাক্ট হিলিং-এর দৃষ্টান্ত।

অতঃপর হ্যারি এডওয়ার্ডের বাড়িতে রোগীরা ভির করে আসতে লাগলেন। স্পিরিচুয়াল হিলিং-এর মাধ্যমে তারা নিরাময় লাভ করে রীতিমত উপকৃত হলেন। এখানে এই মহান মানুষ ও অপার্থিব চিকিৎসাটি সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে।

২৯ মে, ১৮৯৩ সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ৪২ বৎসর বয়সে তিনি বিদেহী আত্মার মাধ্যমে রোগ উপশম চর্চা শুরু করেন। এবং ১৯৭৬-এর ৯ ডিসেম্বর ৮৩ বৎসর বয়সে তাঁর পার্থিব দেহ পরলোকে লীন হয়। মরদেহ ত্যাগ করে সূক্ষ্মলোকে গমন করেন তিনি, সেখানে বিদেহী ডাক্তারদের মধ্যে স্থিত হন অতঃপর। ৪১ বৎসর পর্যন্ত পৃথিবীর অনেক অসাধ্য রোগীর রোগ উপশম করে তাদের রোগ মুক্ত করেছেন এই প্রয়াত মানুষটি। তাঁর বিদেহী আত্মার আরোগ্য-মন্দিরে প্রত্যেক সপ্তাহে কয়েক হাজার চিঠি আসত এবং প্রত্যেকটি চিঠির তিনি উত্তর দিতেন। ১৯৫৫ সন পর্যন্ত তিনি দশ লক্ষ চিঠির জবাব দেন। তাঁর স্বর্গ প্রাপ্তির পর আজও হ্যারি এডওয়ার্ড সেনচুরির কাজকর্ম সে প্রকারই করা হয়।

 

অসাধ্য রোগের চিকিৎসা

 

ভারতবর্ষে এখনো অনেক ব্যক্তি আছেন যারা হ্যারি এডওয়ার্ডের অ্যাবসেনট হিলিং-এর মাধ্যমে রোগ উপশম করে আরোগ্য লাভ করেছেন। ১৯৭০-এর আগস্ট মাসে ২৭ বৎসর বয়স্কা কুমারী ছায়ার পায়ে স্ফোটক হয়। কয়েক বৎসর বিভিন্ন পদ্ধতিতে তার চিকিৎসা করান হয় কিন্তু কিছুতেই তাকে সারানো যাচ্ছিল না। অতঃপর সে হ্যারি এডওয়ার্ডের কাছে তিন মাস ধরে চিঠিপত্র লেখালেখি করতে লাগল এবং আশ্চর্যের ব্যাপার সব কটি চিঠির উত্তরও পেল। একদিন সকালে সে উঠে দেখে কোন দৈববলে যেন তার স্ফোটক একেবারে উধাও হয়ে গেছে।

হ্যারি এডওয়ার্ড ইংলন্ডের একটি জাঁকজমকপূর্ণ আলো ঝলমলে বিশাল সভাকক্ষে হাজার হাজার দর্শকের সামনে বিদেহীরূপে এসে তাঁর অত্যাশ্চর্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে আরোগ্যলাভ হওয়ার প্রক্রিয়া প্রদর্শন করতেন। রয়েল অ্যালবার্ট হলে একবার তাঁর এরকম একটি ঘটনার সময় দিল্লির স্পিরিচুয়াল হিলার শ্রীমতী স্বর্ণনারঙ্গ উপস্থিত ছিলেন। এই প্রদর্শন কক্ষে জনৈক জটিল রোগাক্রান্ত রোগীকে একটি মঞ্চের ওপর এসে দাঁড়াতে বলা হল। এক যুবক তাঁর অতি বৃদ্ধা মাকে কোলে করে নিয়ে এসে সেই মঞ্চের ওপর দাঁড় করালো কোনক্রমে। সেই বৃদ্ধার সম্পূর্ণ শরীর বাতে আক্রান্ত ছিল। মাইকে এসে তিনি অস্ফুট শব্দে বললেন, ‘বাছা, তুই আমার শরীরের আর কি ভাল করবি! কিন্তু এতটুকু উপকার কর যাতে আমার আঙ্গুল গুলো অন্তত সোজা হয়ে যায়, আমি যেন নিজের হাত দিয়ে নিজের খাবারটুকু খেতে পারি। আমার ছেলে, নাতির হাত দিয়ে তুলে দেওয়া খাবার মুখে নিতে বড় লজ্জা করে। দর্শকরা হেঁসে উঠলেন হও হও করে। এর কিছুক্ষণ পরেই সেই বৃদ্ধা নিজের চেষ্টায় আস্তে আস্তে মঞ্চের উপর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। খুব খানিকটা হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করতে শুরু করলেন, আবার একটু দৌড়েও নিলেন আনন্দে। এভাবে হ্যারি এডওয়ার্ড তাঁর রোগ নিরাময় ক্ষমতা দেখিয়ে দিলেন পৃথিবীর মানুষের চোখের সামনে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x