আমাদের পাশের বাসায় থাকত নাদু দিলুরা।
তারাও আমাদেরই মতোই অল্পআয়ের বাবা-মার পুত্রকন্যা। সবাই একসঙ্গে ধুলোমাটিতে গড়াগড়ি করে বড় হচ্ছি। ওমা একদিন শুনি, ওরা বড়লোক হয়ে। গেছে। দেখতে দেখতে ওদের কাপড়চোপড় পালটে গেল। কথাবার্তার ধরন ধারণও বদলে গেল। এখন আর ওরা দাঁড়িয়াবান্দা কিংবা চি-বুড়ি খেলার জন্যে আমাদের কাছে আসে না।
ঈদ উপলক্ষে ওরা নতুন কাপড় তো পেলই সেইসঙ্গে পেল ট্রাই সাইকেল। ট্রাই সাইকেলটি শিশুমহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করল। আমিও এর আগে এই জিনিস দেখিনি। কী চমৎকার ছোট্ট একটা রিকশা! এর মধ্যে আবার বেলও আছে। টুং টুং করে বাজে। এই বিস্ময়কর বাহনটিতে একবার শুধু চড়তে পারার দুর্লভ সৌভাগ্যের জন্যে আমি তখন আমার সমস্ত পৃথিবী দিয়ে দিতে পারি। চেষ্টা করে বিফল হলাম। সবসময় নাদু দিলুর সঙ্গে একজন কাজের মেয়ে থাকে। আমি কাছে গেলেই সে খ্যাঁক করে ওঠে। হাত দিয়ে একটু দেখার অনুমতি চাইলাম সেই অনুমতিও পাওয়া গেল না। আমরা শিশুরা সমস্ত কাজকর্ম ভুলে ট্রাই সাইকেল ঘিরে গোল হয়ে বসে রইলাম। অনেক চিন্তা করে দেখলাম ট্রাই সাইকেল কেনার কথা বাবাকে কি বলা যায়। মনে হল সেটা ঠিক হবে না। বাবার তখন চরম আর্থিক সমস্যা যাচ্ছে। তার সবচে আদরের ছোট বোন অসুস্থ। সেই বোনের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার ভার বহন করতে হচ্ছে। ঈদে আমরা ভাইবোনেরা কোনো কাপড়চোপড় পাইনি। শেষ মুহূর্তে বাবা আমাদের তিন ভাইবোেনকে তিনটা প্লাস্টিকের চশমা কিনে দিলেন, যা চোখে দিলে আশেপাশের জগৎ নীলবর্ণ ধারণ করে। কাপড় না পাওয়ার দুঃখ রঙিন চশমায় ভুললাম। তারচেও বড় কথা, দিলু এই চশমার বিনিময়ে আমাকে তার ট্রাই সাইকেল খানিকটা স্পর্শ করার দুর্লভ সুযোগ দিল। সে বড়ই আনন্দময় অভিজ্ঞতা।
যতই দিন যেতে লাগল এদের রমরমা সমসমা বাড়তেই লাগল। শুনলাম, তাদের জন্যে বিশাল দুতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। বাড়ি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কোনোরকম কষ্টেসৃষ্টে এখানেই থাকবে। এর মধ্যে এই দুই ভাইবোনের জন্মদিন হল। জন্মদিন বলে যে একটা ব্যাপার আছে আমার তা জানা ছিল না। এই দিনে উৎসব হয়। খানাদানা হয়-উপহার নিয়ে লোকজন আসে কে জানত! আমরা অভিভূত।
শেফু একদিন বাবাকে গিয়ে বলল, আমার জন্মদিন করতে হবে।
বাবা খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে মা, করা হবে। কিন্তু শুধুই একবার। এই উৎসব আমি দ্বিতীয়বার করব না। তোমরা বড় হবার চেষ্টা করো। অনেক বড়, যাতে সারা দেশের মানুষ তোমাদের জন্মদিনের উৎসব করে। বাবা-মার করতে না হয়।
শেফু বলল সে প্রাণপণ চেষ্টা করবে বড় হবার।
আমি দেখলাম সুযোগ ফসকে যাচ্ছে। শুধু শেফুর জন্মদিন হবে আমার হবে, এ কেমন কথা! আমি গম্ভীর গলায় বললাম, বাবা, আমিও খুব বড় হবার চেষ্টা করব। আমারও জন্মদিন করতে হবে। বাবা বললেন, আচ্ছা তোমারও হবে।
শুধু ইকবাল ঘোষণা করল সে বড় হতে চায় না। ছোটই থাকতে চায়। তার জন্মদিন লাগবে না।
আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। নভেম্বরের ৯ তারিখ শেযুর জন্মদিন। দেখতে দেখতে ৯ তারিখ এসে পড়ল। আমরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই উপলক্ষে কাউকে বলা হল না। বাবা বললেন, আমরা নিজেরা নিজেরা উৎসব করব। কাউকে বলব না।
পায়েস ছাড়া অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য তৈরি হল না। আমাদের মন ভেঙে গেল। সন্ধ্যার পর জন্মদিনের উৎসব শুরু হল। বাবা বীরপুরুষ কবিতা আবৃত্তি করলেন। প্রাণেশ কাকু তিনটা গান গাইলেন। পায়েস খাওয়া হল। তারপর বাবা ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিয়ে শেফুর হাতে একটা উপহারের প্যাকেট তুলে দিলেন। সেই উপহার দেখে আমাদের সবার বিস্ময়ে বাবোধ হয়ে গেল। আমার দরিদ্র বাবা খুবই দামি উপহার কিনেছেন। চীনেমাটির চমৎকার খেলনা টি সেট, যা দেখলে একালের শিশুদেরও চোখ কপালে উঠে যাবার কথা।
বাবা বললেন,পছন্দ হয়েছে মা?
শেফু কাঁদতে কাঁদতে বলল, এত সুন্দর জিনিস সে তার জীবনে দেখেনি। আনন্দে সারারাত সে ঘুমাতে পারল না। বারবার বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখে আসে টি সেট ঠিকঠাক আছে কি না। সেই রাতে আমি নিজেও উদ্বেগে ঘুমুতে পারলাম না। আর মাত্র তিন দিন পর আমার জন্মদিন। নাজানি কী অপেক্ষা করছে আমার জন্যে! গোপনসূত্রে খবর পেলাম, আমার জন্যে দশগুণ ভালো উপহার অপেক্ষা করছে। খবর দিলেন মা। মার খবর খুবই নির্ভরযোগ্য।
জন্মদিন এসে গেল। গান, কবিতা আবৃত্তির পালা শেষ হবার পর আমার হাতে উপহারের প্যাকেট তুলে দেয়া হল। প্যাকেট খুলে দেখি একটা বাঁধানো ফ্রেমে দীর্ঘ একটি কবিতা। বাবা ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছেন। কবিতার প্রথম দুটি চরণ
সাতটি বছর গেল পরপর আজিকে পরেছে আটে,
তব জন্মদিন নয়ত মলিন ভয়াল বিশ্ব হাটে…
বাবা খুবই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, উপহার পছন্দ হয়েছে। অনেক কষ্টে কান্না চাপা দিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে পছন্দ হয় নাই।
আমি চুপ করে রইলাম।
বাবা খানিকক্ষণ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এই উপহার এখন তোর কাছে সামান্য মনে হচ্ছে। এমন একদিন আসবে যখন আর সামান্য মনে হবে না।
বাবা কবি ছিলেন না। হৃদয়ের তীব্র আবেগ-প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তিনি কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর অতি আদরের ছোট বোনের মৃত্যুর খবর পাবার পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে কবিতা লিখতে বসেছেন। চোখের জলে লেখা দীর্ঘ কবিতা হয়তো শুদ্ধতম কবিতা হয়নি। কিন্তু যে-আবেগের তাড়নায় কলম, নিয়েছিলেন সেই আবেগে কোনো খাদ ছিল না। বাবার কাছ থেকে প্রথম শিখলাম, মনে তীব্র ব্যথা কমানোর একটি উপায় হচ্ছে কিছু লেখা, যে-লেখা ব্যক্তিগত দুঃখকে ছড়িয়ে দেয় চারদিকে।
বাবা হচ্ছেন আমার দেখা প্রথম কবি।
আমার দেখা দ্বিতীয় কবি হচ্ছেন আমাদের বড়মামা ফজলুল করিম। তিনিও আমাদের বাসায় থাকতেন এবং এম. বি. কলেজে আই. এ. পড়তেন। আমার মেজো চাচা যেমন প্রতি বছর পরীক্ষা দিয়ে ফেল করতেন, বড়মামা ফেল। করতেন পরীক্ষা না দিয়ে। পরীক্ষা না দেবার চমৎকার সব যুক্তি বের করতেন। এইসব যুক্তিতে অতি সহজেই মাকে কাবু করে ফেলতেন।
পরীক্ষার আগের দিন মুখ গম্ভীর করে বলতেন, বুবু, এই বছরও পরীক্ষা দেব। বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কেন? এই বছর আবার কী হল?
গত বৎসর পাশের হার বেশি ছিল, কাজেই এই বৎসর কম হবে। পরীক্ষা দিলে ফেল করতে হবে। আগামী বৎসর চেষ্টা চালাব ইনশাল্লাহ।
এই বৎসর পরীক্ষাটা দে, পাশ-ফেল পরের ব্যাপার।
আরে না! পরীক্ষা দিয়ে এনার্জি লস করার কোনো মানে হয় না।
বলাই বাহুল্য, পরের বৎসর তিনি পরীক্ষা দেন না। কারণ রুটিন খুব খারাপ হয়েছে। গ্যাপ কম। তবুও দিতেন, কিন্তু এনার্জি লসের ভয়ে দিচ্ছেন না। বড়মামা সব এনার্জি জমা করে রাখলেন এবং শুভক্ষণে পুরো এনার্জি নিয়ে জনৈকা তরুণীর প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রেমের আবেগে কবিতার পর কবিতা বের হতে লাগল। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল এইসব কবিতা যথাস্থানে পৌঁছে দেবার। আমি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করে যেতে লাগলাম।
তরুণীর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় প্রেমে ভাটার টান ধরল। গোটা পঞ্চাশেক বিরহের কবিতা লিখে বড়মামা হৃদয়যাতনা কমালেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বড়মামার সেইসব কবিতা কিন্তু বেশ ভালো ছিল বলে আমার ধারণা। তিনি এইসব কবিতা প্রকাশ করার ব্যাপারে কোনোরকম আগ্রহ দেখাননি কিংবা পরবর্তী সময়ে কবিতা লেখার চেষ্টাও করেননি। তার ভাবটা এরকম, এইসব কবিতা তিনি শুধু দুজনের জন্যেই লিখেছেন—তৃতীয় কারওর জন্যে নয়।
আমি নিজে নানাভাবে বড়মামার কাছে ঋণী। গল্প বলে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলার দুর্লভ ক্ষমতা তার ছিল। তার এই ক্ষমতা আমাকে বারবার বিস্মিত করত। একই গল্প যখন বড়মামার কাছে শুনতাম, তখন অন্যরকম হয়ে যেত। এর কারণ বুঝতে পারতাম না, তবে কারণ নিয়ে ভাবতাম এটা মনে আছে। জীবনের প্রথম ছবি আঁকা তার কাছ থেকেই শিখি। তিনি হাতি আঁকাব চমৎকার একটা সহজ কৌশল শিখিয়ে দিলেন। এই কৌশলে আমি তিন হাজারের মতো হাতি এক মাসের মধ্যে এঁকে ফেলি। বাড়ির সাদা দেয়াল পেনসিলে আঁকা হাতিতে হাতিময় হয়ে যায়।
তার একটা সাইকেল ছিল। সারাদিন সাইকেলে করে ঘুরতেন। মাঝে মাঝে আমাকে পেছনে বসিয়ে বেড়াতে বের হতেন। সাইকেল চলত ঝড়ের গতিতে। এই সাইকেল বড়মামার প্রতিভার স্পর্শ পেয়ে একদিন মোটরসাইকেল হয়ে গেল। যখনই সাইকেল চলে ভটভট শব্দ হয়। লোকজন অবাক হয়ে তাকায়। দেখতে সাইকেল অথচ শব্দ হচ্ছে মোটরসাইকেলের, ব্যাপারটা কী? ব্যাপার কিছুই না, দুটুকরা শক্ত পিসবোর্ড সাইকেলের সঙ্গে এমনভাবে লাগানো যে চাকা ঘোরামাত্র শোকের সঙ্গে পিসবোর্ডের ধাক্কা লেগে ভটভট শব্দ হয়। শিশুরা প্রতিভার সবচেয়ে বড় সমঝদার। আমরা বড়মামার প্রতিভার দীপ্তি দেখে বিস্মিত। আমাদের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করল যখন তিনি হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করলেন। হাঙ্গার স্ট্রাইকের কারণ মনে নেই, শুধু মনে আছে দরজার গায়ে বড় বড় করে লেখা-আমরণ অনশন। নীরবতা কাম্য। তিনি একটা খাটে শবাসনের ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। বাবা পুরো ব্যাপারটায় মজা পেয়ে খুব হাসাহাসি করছেন। বড়মামা তাতে মোটেই বিচলিত হচ্ছেন না। তার হাঙ্গার স্ট্রাইক ভাঙানোর কোনো উদ্যােগ নেয়া হল না। একদিন কাটল, দুদিন কাটল, তৃতীয় দিনও পার হল। তখন সবার টনক নড়ল। মা কান্নাকাটি শুরু করলেন। বাড়িতে টেলিগ্রাম গেল। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় বড়মামা এক গ্লাস শরবত খেয়ে অনশন ভঙ্গ করলেন এবং গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন-এদেশে থাকবেন না। কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে এদেশে থাকা সম্ভব নয়। তিনি বিলেত যাবেন।
তখন বিলেত যাওয়া খুব সহজ ছিল। দলেদলে সিলেটিরা বিলেত যাচ্ছে। মামারও পাসপোর্ট হয়ে গেল। তিনটি নতুন স্যুট বানানো হল। মামা স্যুট পরে ঘোরাফেরা করেন। আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখি। কাঁটাচামচ দিয়ে ভাত-মাছ খান। দেখতে বড় ভালো লাগে।
শেষ পর্যন্ত বিলেত যাওয়া হল না। মামা বললেন—আরে দূর দূর, দেশের উপর জিনিস নাই। বিদেশ গিয়ে আমি ঘাস কাটব নাকি? আমি ভালোই আছি। বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি তা হলে যাচ্ছ না?
জি না।
কী করবে কিছু ঠিক করেছ?
আই. এ. পরীক্ষা দেব। এইবার উড়াউড়া শুনেছি ম্যাক্সিমাম পাশ করবে। পরীক্ষা অবশ্য দিলেন না, কারণ পরীক্ষার আগে-আগে খবর পেলেন, এইবাব কোশ্চেন খুব টাফ হবে। গতবার ইজি হয়েছিল, এইবার টাফ। টাফ কোশ্চেনে পরীক্ষা দেয়ার কোনো মানে হয় না।
তিনি একটা ক্যারামবোর্ড কিনে ফেললেন। মামা এবং চাচা দুজনে মিলে গভীর রাত পর্যন্ত টুকুস টুকুস করে ক্যারাম খেলেন। বড় সুখের জীবন তাদের।
আমার জীবনও সুখের, কারণ বাসার প্রধান শাসক বাবা অনুপস্থিত। তিনি প্রমোশন পেয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর হয়েছেন। তাকে বদলি করা হয়েছে। দিনাজপুরের জগদলে। সেই সময় বর্ডাররক্ষার দায়িত্ব ছিল পুলিশের উপর। বাবা চলে গেলেন বর্ডারে। আমার পূর্ণ স্বাধীনতা। কারওরই কিছু বলার নেই।
সেই সময় দেশে বড় ধরনের খাদ্যাভাব দেখা দিল। ভয়াবহ অবস্থা। হাজার হাজার মানুষ খাবারের সন্ধানে শহরে জড়ো হয়েছে। থালা-হাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরছে।
সিলেট শহরে অনেকগুলি লঙ্গরখানা খোলা হল। লঙ্গরখানায় বিরাট ডেকচিতে খিচুড়ি রান্না করা হয়। ক্ষুধার্ত মানুষদের একবেলা খিচুড়ি খাওয়ানো হয়।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওদের খাওয়া দেখি। কলার পাতা কেটে লাইন ধরে সবাই বসে। প্রত্যেকের পাতায় দুহাতা করে খিচুড়ি দেয়া হয়। কত আনন্দে, কত আগ্রহ নিয়েই-না তারা সেই খিচুড়ি খায়! ওদের আনন্দে ভাগ বসানোর জন্যই হয়তোবা এক দুপুরে কলার পাতা নিয়ে ওদের সঙ্গে খেতে বসে গেলাম। সেই খিচুড়ি অমৃতের মতো লাগল। এর পর থেকে রোজই দুপুরবেলায় লঙ্গরখানায় খেতে যাই। একদিন বোনকেও নিয়ে গেলাম। সেও মহানন্দে কলার পাতা নিয়ে আমার সঙ্গে বসে গেল। খাওয়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে এক ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে আমাদের দু-ভাইবোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বললেন, এরা কারা?
ধরা পড়ে গেলাম। কানে ধরে আমাদের দুজনকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হল। আমার মা ক্রমাগত কাঁদতে লাগলেন। লঙ্গরখানায় খাওয়ার অপমানে তার নাকি মাথাকাটা যাচ্ছে। লঙ্গরখানায় আমি পাতা পেতে খেয়েছি এতে লজ্জিত বা অপমানিত বোধ করার কী আছে তা আমি ঐদিন বুঝতে পারিনি। আজও পানি না।
নিঃসন্তান গনি চাচার জীবনে এই সময় একটি বড় ঘটনা ঘটল। এক ভিখিরি-মা ছেলে কোলে নিয়ে এসেছে ভিক্ষা করতে। ফুটফুটে ছেলে। গনি চাচার ছেলেটাকে বড়ই পছন্দ হল। তিনি প্রস্তাব দিলেন ছেলেটাকে তিনি আদরযত্নে বড় করবেন, তার বিনিময়ে ভিখিরি-মা দশ টাকা পাবে। কিন্ত কোনোদিন এই ছেলেকে তার ছেলে বলে দাবি করতে পারবে না। মা রাজি হয়ে গেল।
এই ঘটনা আমার মনে বড় ধরনের ছাপ ফেলে।
এখনও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখি, ভিখিরি-মা মুখ কালো করে ঘরের বারান্দাতে বসে আছে। গনি চাচার স্ত্রী তার ছেলে-কোলে বারান্দায় এসে ধমকাচ্ছেন-কী চাও তুমি? তোমাকে না বলেছি, কখনো আসবে না! কেন এসেছ?
ব্যথিত মা করুণচোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে যাচ্ছে।
ভিখিরিণীর হাত থেকে বাঁচার জন্যে গনি চাচা কয়েকবার বাড়িবদল করলেন। কোনো লাভ হল না। যেখানেই যান সেখানেই মা উপস্থিত হয় সারাদিন বারান্দায় বসে থাকে।
শেষটায় গনি চাচা চেষ্টা-চরিত্র করে সিলেট থেকে বদলি হয়ে গেলেন। মৌলভী বাজার। হতদরিদ্র মার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন একটি শিশু। আমার তখন বয়স অল্প, খুবই অল্প। পৃথিবীর জটিলতা বোঝার বয়স নয়, তবুও মনে হল-এটা অন্যায়। খুব বড় ধরনের অন্যায়। ঐ ভিখিরিণী-মার সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হত। আমি তার পেছনে পেছনে হাঁটতাম। বিড়বিড় করে সে নিজের মনে কথা বলত। নিজের দুপাশে থুথু ফেলতে ফেলতে এত। হয়তো তার মাথা-খারাপ হয়েছিল। একজন ভিখিরিণীর মাথা-খারাপ হওয়া এমন কোনো বড় ঘটনা নয়। জগৎসংসারের তাতে কিছুই যায় আসে না। পৃথিবী চলে তার নিজস্ব নিয়মে। সেইসব নিয়ম জানার জন্য একধরনের ব্যাকুলতা আমার মধ্যে হয়তো তৈরি হয়েছিল। অনেক ধরনের প্রশ্ন মনে আসত। কাউকে করতে পারতাম না। প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের মনেই খুঁজতে হত।
মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়-এই প্রশ্নটা একদিন মনে এল। ভালো মানুষেরা বেহেশতে, খারাপ মানুষেরা দোজখে-এ সহজ উত্তর মনে ধরল না। মনে হল-উত্তর এত সহজ নয়। মৃত্যু-সম্পর্কিত জটিল প্রশটি মনে আসার কারণ আছে। কারণটা বলি।
একদিন সিলেট সরকারি হাসপাতালের সামনে দিয়ে আসছি। হঠাৎ দেখি নর্দমায় একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। লোকজন ভিড় করে দেখছে। কৌতূহল মিটে গেলে চলে যাচ্ছে। আমিও দেখতে লাগলাম। মৃতদেহ দেখে আমার শরীর কাঁপতে লাগল। কারণ মৃত মানুষটির ঠোঁটে হাসি। তার চোখ বন্ধ, কিন্তু হাসি, ভঙ্গিতে ঠোঁট বেঁকে আছে। দেখেই মনে হয় কোনো-একটা মজার ঘটনায় চোখ বন্ধ করে সে হাসছে। আমার বুকে ধক করে ধাক্কা লাগল।
দৌড়ে পালিয়ে এলাম।
মৃতদেহটির হাসিহাসি-মুখের ছবি নিজের মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারলাম না। বিকেলে আবার দেখতে গেলাম। মৃতদেহ আগের জায়গাতেই আছে। তার মুখের হাসিরও কোনো হেরফের হয়নি।
পরদিন আবার গেলাম। লাশ সরানো হয়নি। তবে মুখের হাসি আর চোখে। পড়ল না। অসংখ্য লাল পিপড়ায় সারা শরীর ঢাকা। লোকটির গায়ে যেন লাল রঙের একটা চাদর। খুব ইচ্ছা করল চাদর সরিয়ে তার মুখটি আরেকবার দেখি। দেখি, এখনও কি সেই মুখে হাসি লেগে আছে?
আমি বাসায় ফিরলাম কাঁদতে কাঁদতে। বাসায় ফিরেই শুনি, বাবার চিঠি এসেছে—আমরা সিলেটে আর থাকব না। চলে যাব দিনাজপুর, জায়গাটার নাম জগদল। মৃত মানুষটির কথা আর মনে রইল না। আনন্দে লাফাতে লাগলাম।
মৃত লোকটির কথা আর মনে রইল না-বলাটা বোধহয় ঠিক হল না। মনে ঠিকই রইল, তবে চাপা পড়ে গেল। একমাত্র শিশুরাই পারে সব ঘটনা সহজ ভঙ্গিতে গ্রহণ করে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে। তারা একটি স্মৃতি থেকে অতি দ্রুত চলে যেতে পারে অন্য স্মৃতিতে। সব আলাদা আলাদা রাখা। ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। মাঝে মাঝে ঢাকনার মুখ তুলে দেখে নেয় সব ঠিকঠাক আছে কি না। কোনোকিছুই সে নষ্ট করতে বা ফেলে দিতে রাজি না।
কষ্টকর স্মৃতি মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা আমি শুধু বড়দের মধ্যেই দেখি। শিশুদের মধ্যে দেখি না।
“আমার ছেলেবেলা” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ