কে জানে কোথায় চলিয়াছি ভাই মুসাফির পথচারী,

দু’ধারে দু’কূল দুঃখ-সুখের—মাঝে আমি স্রোত-বারি !

আপনার বেগে আপনি ছুটেছি জন্ম-শিখর হ’তে

বিরাম-বিহীন রাত্রি ও দিন পথ হ’তে আনপথে।

নিজ বাস হ’ল চির-পরবাস, জন্মের ক্ষণপরে

বাহিরিনু পথে গিরি-পর্বতে—ফিরি নাই আর ঘরে !

পলাতকা শিশু জন্মিয়াছিনু গিরি-কন্যার কোলে,

বুকে না ধরিতে চকিতে ত্বরিতে আসিলাম ছুটে চ’লে ।

 

জননীরে ভুলি’ যে পথে পলায় মৃগ-শিশু বাঁশি শুনি’,

যে পথে পলায় শশকেরা শুনি’ ঝর্ণার ঝুনঝুনি,

পাখি উড়ে যায় ফেলিয়া কুলায় সীমাহীন নভোপানো,

সাগর ছাড়িয়া মেঘের শিশুরা পলায় আকাশ যানে,—

সেই পথ ধরি’ পলাইনু আমি ! সেই হ’তে ছুটে চলি

গিরি দরী মাঠ পল্লীর বাট সোজা বাঁকা শত গলি ।

 

—কোন্ গ্রহ হ’তে ছিঁড়ি’

উল্কার মত ছুটেছি বাহিয়া সৌর-লোকের সিঁড়ি !

আমি ছুটে যাই জানি না কোথায়, ওরা মোর দুই তীরে

রচে নীড়, ভাবে উহাদেরি তরে এসেছি পাহাড় চিরে।

উহাদের বধূ কলস ভরিয়া নিয়ে যায় মোর বারি,

আমার গহনে গাহন করিয়া বলে সন্তাপ-হারী !

উহারা দেখিল কেবলি আমার সলিলের শীতলতা,

দেখে নাই—জ্বলে কত চিতাগ্নি মোর কূলে কূলে কোথা !

 

—হায়, কত হতভাগী—

আমিই কি জানি—মরিল ডুবিয়া আমার পরশ মাগি’ !

বাজিয়াছে মোর তটে-তটে জানি ঘটে-ঘটে কিঙ্কিণী,

জল-তরঙ্গে বেজেছে বধূর রিনিকি ঝিনি।

বাজায়েছে বেণু রাখাল-বালক তীর-তরুতলে বসি’,

আমার সলিলে হেরিয়াছে মুখ দূর আকাশের শশী ।

জানি সব জানি, ওরা ডাকে মোরে দু’তীরে বিছায়ে স্নেহ

 দীঘি হতে ডাকে পদ্মমুখীরা, “থির হও বাঁধি’ গেহ !”

 

আমি বয়ে যাই—বয়ে যাই আমি কুলুকুলু কুলুকুলু,

শুনি না—কোথায় মোরই তীরে হায় পুরনারী দেয় উলু।

সদাগর-জাদী মণি-মাণিক্যে বোঝাই করিয়া তরী

ভাসে মোর জলে,–“ছল ছল” ব’লে আমি দূরে যাই সরি’!

আঁকড়িয়া ধরে দু’তীর বৃথাই জড়ায়ে তন্তুলতা,

ওরা দেখে নাই আবর্ত মোর, মোর অন্তর-ব্যথা।

 

লুকাইয়া আসে গোপনে নিশীথে কূলে মোর অভাগিনী,

আমি বলি চল্ ছল্ ছল্ ছল্ ওরে বধূ তোরে চিনি।

কূল ছেড়ে আয় রে অভিসারিকা, মরণ-অকূলে ভাসি !

মোর তীরে-তীরে আজো খুঁজে ফিরে তোরে ঘরছাড়া বাঁশি

সে পড়ে ঝাঁপায়ে জলে,

আমি পথে ধাই—সে কবে হারায় স্মৃতির বালুকা-তলে !

 

জানি না ক’ হায় চলেছি কোথায় অজানা আকর্ষণে,

চলেছি যতই তত সে অথই বাড়ে জল খনে খনে।

সম্মুখ-টানে ধাই অবিরাম, নাই নাই অবসর,

ছুঁইতে হারাই—এই আছে নাই—এই ঘর এই পর !

ওরে চল্ চল্ ছল্ ছল্ ছল্ কি হবে ফিরায়ে আঁখি?

তোরি তীরে ডাকে চক্রবাকেরে তোরি সে চক্রবাকী !

 

ওরা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যায় কূলের কুলায়-বাসী,

আঁচল ভরিয়া কুড়ায়ে আমার কাদায়-ছিটানো হাসি।

ওরা চ’লে যায়, আমি জাগি হায় লয়ে চিতাগ্নি শব,

ব্যথা-আবর্ত মোচড় খাইয়া বুকে করে কলরব !

 

ওরে বেনোজল, ছল্ ছল্ ছল্ ছুটে’ চল্ ছুটে চল !

হেথা কাদাজল পঙ্কিল তোরে করিতেছে অবিরল।

কোথা পাবি হেথা লোনা আঁখিজল, চল্ চল্ পথচারী !

করে প্রতীক্ষা তোর তরে লোনা সাত-সমুদ্র-বারি !



মিলন-মোহনায়

হায় হাবা মেয়ে, সব ভুলে গেলি দয়িতের কাছে এসে !

এত অভিমান এত ক্ৰন্দন সব গেল জলে ভেসে !

কূলে কূলে এত ফুলে ফু’লে কাঁদা আছাড়ি’ পিছাড়ি’ তোর,

সব ভুলে গেলি যেই বুকে তোরে টেনে নিল মনোচোর !

সিন্ধুর বুকে লুকাইলি মুখ এমনি নিবিড় ক’রে

এমনি করিয়া হারাইলি তুই আপনারে চিরতরে—

যে দিকে তাকাই নাই তুই নাই ! তোর বন্ধুর বাহু

গ্রাসিয়াছে তোরে বুকের পাঁজরে—ক্ষুধাতুর কাল রাহু !

বিরহের কূলে অভিমান যার এমন ফেনায় উঠে,

মিলনের মুখে সে ফিরে এমনি পদতলে পড়ে লুটে?

এমনি করিয়া ভাঙিয়া পড়ে কি বুক-ভাঙা কান্নায়,

বুকে বুক রেখে নিবিড় বাঁধনে পিষে গুঁড়ো হ’য়ে যায়?

তোর বন্ধুর আঙুলের ছোঁওয়া এমনি কি যাদু জানে,

আবেশে গলিয়া অধর তুলিয়া ধরিলি অধর পানে !

একটি চুমায় মিটে গেল তোর সব সাধ সব তৃষা,

ছিন্ন লতার মতন মুরছি’ পড়িলি হারায়ে দিশা !

—একটি চুমার লাগি

এতদিন ধ’রে এত পথ বেয়ে এলি কি রে হতভাগী?

গাঙ-চিল আর সাগর-কপোত মাছ ধরিবার ছলে,

নিলাজী লো, তোর রঙ্গ দেখিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলে।

দু’ধারের চর অবাক হইয়া চেয়ে আছে তোর মুখে,

সবার সামনে লুকাইলি মুখ কেমনে বঁধুর বুকে?

নীলিম আকাশ ঝুঁকিয়া পড়িয়া মেঘ-গুণ্ঠন ফেলে

বৌ-ঝির মত উঁকি দিয়ে দেখে কুতূহলী-আঁখি মেলে ।

 

“সাম্পান”-মাঝি খুঁজে ফেরে তোরে ভাটিয়ালী গানে কাঁদি’,

খুঁজিয়া নাকাল দু’ধারের খাল–তোর হেরেমের বাঁদি !

হায় ভিখারিণী মেয়ে,

ভুলিলি সবারে, ভুলিলি আপনা দয়িতেরে বুকে পেয়ে !

তোরি মত নদী আমি নিরবধি কাঁদি রে প্রীতম্ লাগি’,

জন্ম-শিখর বাহিয়া চলেছি তাহারি মিলন মাগি’ !

যার তরে কাঁদি—ধার ক’রে তারি জোয়ারের লোনা জল

তোর মত মোর জাগে না রে কভু সাধের কাঁদন-ছল।

আমার অশ্রু একাকী আমার, হয়ত গোপনে রাতে

কাঁদিয়া ভাসাই, ভেসে ভেসে যাই মিলনের মোহনাতে,

আসিয়া সেথায় পুনঃ ফিরে যাই। –তোর মত সব ভুলে

লুটায়ে পড়ি না—চাহে না যে মোরে তারি রাঙা পদমূলে !

যারে চাই তা’রে কেবলি এড়াই কেবলি দি’ তারে ফাঁকি ;

সে যদি ভুলিয়া আঁখি পানে চায় ফিরাইয়া লই আঁখি !

—তার তীরে যবে আসি

অশ্রু-উৎসে পাষাণ চাপিয়া অকারণে শুধু হাসি !

অভিমানে মোর আঁখিজল জমে করকা-বৃষ্টি সম

যারে চাই তারে আঘাত হানিয়া ফিরে যায় নির্মম !

একা মোর প্রেম ছুটিবে কেবলি নিচু প্রান্তর বেয়ে,

সে কভু ঊর্ধ্বে আসিবে না উ’ঠে আমার পরশ চেয়ে—

চাহি না তাহারে ! বুকে চাপা আমার বুকের ব্যথা,

যে বুক শূন্য নহে মোরে চাহি’ –হব না ক’ ভার সেথা !

সে যদি না ডাকে কি হবে ডুবিয়া ও-গভীর কালো নীরে,

সে হউক সুখী, আমি রচে যাই স্মৃতি-তাজ তার তীরে !

মোর বেদনার মুখে চাপিয়াছি নিতি যে পাষাণ-ভার

তা দিয়ে রচিব পাষাণ-দেউল সে পাষাণ-দেবতার !

 

কত স্রোতধারা হারাইছে কূল তার জলে নিরবধি,

আমি হারালাম বালুচরে তার, গোপন-ফল্গুনদী !

error: Content is protected !!